নবম সংখ্যা, দ্বিতীয়া ই-সংস্করণ অক্টোবর ২০২০

ভাণ পত্রিকা

নবম সংখ্যা, দ্বিতীয়া ই-সংস্করণ অক্টোবর ২০২০

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :

প্রচ্ছদ :

লিপি সেনগুপ্ত

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

ও মৌলিকা সাজোয়াল

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) [email protected] ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সূচি

সম্পাদকের কথা

রাগমালা চিত্র: ধ্রুপদী সঙ্গীত ও চিত্রকলার আলাপচারিতা

এই নিয়ে আলাপ করেছেন – প্রত্যুষা চক্রবর্তী

২. ” ভাগীরথী “: এক জীবন নাচের গল্প

মঞ্জুশ্রী চাকী সরকারের অভিনব নৃত্যকলা নিয়ে – ঐশিকা চক্রবর্তী

৩. “ STRANGER THINGS: পপুলার কালচার ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

নেটফ্লিক্স এর বিখ্যাত ওয়েব সিরিজ নিয়ে – সাম্য সেন শর্মা

৪. রঙ্গের নানা মঞ্চ

নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করলেন প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব -অশোক মুখোপাধ্যায়

৫. ” থিয়েটার ও বিকল্প স্থানের সন্ধান

করলেন বিকল্প থিয়েটারের অন্যতম প্রধান কাণ্ডারী – কল্লোল ভট্টাচার্য্য

৬. “ সাম্পান

থিয়েটারের পক্ষ থেকে অন্য ধারার অভিনয় চর্চার অভিজ্ঞতা শোনালেন – পিঙ্কি আর বৈশালী

৭. ” দর্শক বোকা নয়

শিখতে এসেছি, শেখাতে নয় – এই মনোভাব নিয়ে গড়ে উঠুক বিকল্প। কথা পাড়লেন – সত্যজিৎ

সম্পাদক বললেন:

কথা মতো ১লা অক্টোবর বেরোচ্ছে ভাণ। নবম সংখ্যা। আবারও পাঠক -বন্ধুদের মনে করাই। মার্চ ‘ ২০২১ পর্যন্ত ই- ভাণ ‘এর নির্বাচিত লেখা নিয়ে এপ্রিল’২০২১ এ একটি ছাপা সংকলন প্রকাশিত হবে। প্রথম ই- সংখ্যায় আপনাদের অভাবনীয় সাড়া পেয়ে ভাণ পরিবার উচ্ছ্বসিত। আমাদের উৎসাহ আর দায়িত্ব বাড়লো। প্রয়োগ কলা, সংস্কৃতি চর্চা বিষয়ক বাংলা ভাষায় এ পত্রিকার সাধ অনেক, সাধ্য কম। আবেদন থাকলো পাঠকের কাছে আমাদের পত্রিকা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সঙ্গে আপনারাও যদি একটু ভাগ করে নেন। সমঝদার প্রিয়জনদের যদি একটু চেখে দেখতে বলেন! একটা পত্রিকা গান- নাচ- সিনেমা- থিয়েটার- টিভি- ওয়েব- চিত্র- লোক-নাগরিক সংস্কৃতি নিয়ে লেখার চর্চা করতে চাইছে নিয়মিত, এটা শুধু একতরফা উৎসাহে সফল হতে পারেনা। আপনাদেরও পাশে চাই। সমালোচনা চাই, সাহায্য চাই, ভালোবাসা চাই।

 

আমাদের চলতি ‘বিষয় বিশেষ’ ‘রঙ্গের নানা মঞ্চ’ নিয়ে এবারের বড় লেখাটি লিখেছেন কল্লোল দা। কল্লোল ভট্টাচার্য। নিজের জীবন ও নাট্য চর্চার যে প্রয়াস ও প্রকরণ তিনি নিরন্তর যাপন করেন, তাতে এ বিষয়ে তাঁর কথা আমাদের কান- মন পেতে শোনা দরকার। প্রসেনিয়ামের বাইরে নিজেদের থিয়েটার চর্চা নিয়ে অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন সাম্পান নাট্য দলের বৈশালী ও পিঙ্কি। এবং থিয়েটার ফোরামের সত্যজিৎ। নানা ফরম্যাটের থিয়েটার থাকলে ক্ষতি কি ! নানাদিক দিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে তার ভেতরে ক্রিয়া করাতেই থিয়েটারের সিদ্ধি – এই জরুরি কথাটি মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব অশোক মুখোপাধ্যায়।

 

এছাড়াও নিয়মিত বিভাগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা নৃত্যশিল্পী ও বিশেষজ্ঞ ঐশিকা চক্রবর্তীর মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার ও তাঁর ভাগীরথী নৃত্যকলা নিয়ে লেখাটি অনেক নতুন কথা শোনাবে। ঐশিকা, মঞ্জুশ্রী চাকীর ছাত্রীও বটে। প্রত্যুষার রাগ- রাগিনীর ওপর সঙ্গীত চিত্রের ভাষ্যটি সিরিয়াস পাঠকের খুব পছন্দ হবে মনে হয়। ছোটরা যে বড়দের বড় করেই ভাবাতে পারে , কখনো- সখনো পড়াতেও পারে , স্নাতক স্তরের ছাত্র সাম্যর ওয়েব সিরিজ নিয়ে পাঠটি তার প্রমাণ।

 

পত্রিকা তে লেখা পাঠানোর নিয়ম কানুন জানার জন্য আমাদের মেইল করুন। বন্ধুদের পত্রিকার কথা জানান। প্রতি ইংরেজি মাসের পয়লা তে পত্রিকা পেতে সাবস্ক্রাইব করুন। ভালো থাকুন। এই দুর্দিনে ঠোঁটের কোণায় হাসি রেখে যেতে পারাটাই একটা লড়াই। 

রাগমালা চিত্র : ধ্রুপদী সঙ্গীত ও চিত্রকলার আলাপচারিতা

প্রত্যুষা চক্রবর্তী

 
 
 
 
 
 

ধ্রুপদী সঙ্গীতের আলোচনায় ‘রাগ’ শব্দটি উঠে আসবেই। সঙ্গীতের প্রাচীন শাস্ত্র অনুযায়ী কতকগুলি স্বরের সমষ্টি যখন একটি নির্দিষ্ট ভাব ও রসের প্রকাশ ঘটায়, তখন তাকে একটি বিশেষ রাগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যেমন – ভৈরব, হিন্দোল, দীপক ইত্যাদি। ভাব এবং রস শব্দদুটির কাছে পরে আবার ফিরে আসব। এখন দেখা যাক, রাগের নির্মাণে কী কী উপাদান প্রয়োজনীয়। গ্রহস্বর, অংশস্বর, ন্যাসস্বর, বর্জিত স্বর – ইত্যাদি নানাধরনের পারিভাষিক শব্দের ধাঁধায় আমি ঢুকছি না। কিন্তু এটুকু পরিষ্কার যে, স্বরের বিভিন্ন সজ্জার পাশাপাশি অন্তর্নিহিত আবেগ, ছন্দ এবং অবশ্যই লয়ের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে রাগসঙ্গীত তার সম্পূর্ণ চেহারাটি শ্রোতার সামনে আনে। শুধু তা-ই নয়, প্রতিটি রাগের সঙ্গে একজন দেবতাকে সংযুক্ত করা হয়, প্রতিটি রাগ গাওয়ার নির্দিষ্ট সময় রয়েছে, গভীর অন্তর্মুখী বিশ্লেষণ থেকে নির্ণয় করা হয়েছে কোন রাগ বা রাগিণী প্রাতঃকালের ভাব বহন করে, কোনটি মধ্যাহ্নের, কোনটি সান্ধ্যকালীন আর কোনটি নিশীথরাতের প্রাণকে ধরে রেখেছে। এমনকি প্রত্যেকটি রাগের জন্য ঋতু পর্যন্ত নির্ধারিত। একটি রাগের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের পরিবর্তে অন্য সময়ে তা গাওয়া শুধু যে নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই প্রায় অপরাধ বলে বিবেচিত হয়, তা নয়; দেবদেবীর ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার দরুন তা প্রকৃতিতেও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে মনে করা হয়। এছাড়াও রাগের শ্রেণিবিভাজনের কারণেই মূলত রাগ-পরিবারের ভাবনা তৈরি করা হয়েছে। স্বরের ব্যবহার, আরোহণ ও অবরোহণ, ঠাটের স্বাতন্ত্র্য অনুযায়ী সেখানে প্রতিটি রাগের সঙ্গে রয়েছেন তাঁদের স্ত্রী রাগিণীরা এবং তাঁদের পুত্রকন্যারাও। ফলে একথা স্পষ্ট যে কেবলমাত্র বিনোদনের উপাদান নয়, বরং বলা চলে ভারতীয় শিল্পকলার জগতে স্বতন্ত্র এক আত্মপরিচয় বহন করে রাগসঙ্গীত।

 

‘রাগ’ শব্দের অন্য যে অর্থটি সম্পর্কে আমরা সকলে ওয়াকিবহাল তা হল – রং। ফলত রাগসঙ্গীতের নামকরণে রঙের ধারণা যে বিশেষ ব্যঞ্জনা বহন করবেই এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ থাকে না। প্রতিটি রাগের বিশেষ মেজাজকে জাগিয়ে তুলতে হলে তার সঙ্গে সংযুক্ত রঙের আবহকেও খেয়াল করা জরুরি। তবে এই বিমূর্ত ভাবনার বাইরেও সঙ্গীতের সঙ্গে রঙের অর্থাৎ চিত্রকলার সার্থক মেলবন্ধন খুঁজতে চাইলে আলাপ জমাতে হবে ‘রাগমালা চিত্রকলা’-র সঙ্গে, যা আদতে একগুচ্ছ মিনিয়েচার পেইন্টিং।

 

এবারে খানিক ইতিহাসের অলিগলিতে ঘুরে আসা যাক। প্রথম যে রাগমালা চিত্রের নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় তা আঁকা হয়েছিল ১৪৭৫ সালে। একটি পাণ্ডুলিপির পাতার চারপাশে ছবির মধ্য দিয়ে  বিভিন্ন দেবদেবীর সঙ্গে সঙ্গীতের সম্পর্ককে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। এর প্রায় শ-খানেক বছর পরে ভারতবর্ষে যে রাগমালা চিত্র আঁকা হচ্ছিল, সেখানে নারী-পুরুষ চরিত্ররা এবং তাদের কার্যকলাপ আসলে রাগসঙ্গীতের বিভিন্ন মেজাজের প্রতিফলক হয়ে উঠতে থাকে। ভারতীয় চিত্রকলার অনেকগুলি ধারাতে রাগমালা চিত্রের উপস্থিতি দেখা যায় ষোড়শ-সপ্তদশ শতক থেকেই। এর মধ্যে প্রধান হল – পাহাড়ি রাগমালা, রাজস্থানী বা রাজপুত রাগমালা, দক্ষিণ ভারতীয় রাগমালা আর মুঘল রাগমালা। এছাড়া মারবার কলম, কোটা কলম, অক্ষর কলম, হায়দরাবাদী, মেবার, বিলাসপুরী ইত্যাদি বিভিন্ন বিশেষ শৈলীর উল্লেখও পাওয়া যায়।

 
 
 

চিত্র ১ : মালকোষ রাগ চিত্র ২ : ধনশ্রী রাগিণী চিত্র ৩ : টোড়ি রাগিণী

 
 
 
 
 

রাগমালা চিত্রকলা ক্রমশ আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে এবং বহু সম্রাট ও শাসকদের পৃষ্ঠপোষণা পেতে থাকে। ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই ছবিগুলির মধ্যে রঙের অভিনবত্ব, নিখুঁত ডিটেলিং এমনকি সোনার সূক্ষ্ম পাতের ব্যবহার এগুলির সৌন্দর্যবৃদ্ধির অন্যতম চাবিকাঠি হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ছবিগুলিতে নানারকম স্থানীয় বৈশিষ্ট্য ও চিত্রকল্প জায়গা করে নিতে থাকে। ছবিগুলির বৈচিত্র্যের পরিসর অবাক করার মতো। শৈলীর দিক থেকে এই ছবিগুলি কখনও অ্যাবস্ট্রাক্ট, আবার কখনও বা ন্যাচারালিস্টিক; রঙের ক্ষেত্রেও ঝলমলে থেকে শুরু করে অতিমৃদু রঙের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। ছবির বর্ডার এবং ফ্রেমিং-এর ধরনও নজরকাড়া। অনেক সময়ে, পৃষ্ঠপোষকের বা রাজসভার রুচি এবং ছবির বিষয়বস্তু অনুযায়ী এই শিল্পীরা নিজেদের চিত্রশৈলীর পরিবর্তন করে নিতেন। মূলত মুঘল রাজসভার চিত্রশৈলীর অনুসারী শিল্পীদের ছবিতে ন্যাচারালিস্টিক উপাদান দেখা যায় এবং এক্ষেত্রে বিশেষ করে ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু অঙ্কিত হত। আবার উজ্জ্বল রঙ ও অতিরিক্ত জটিলতাবিহীন ছবিগুলি নিঃসন্দেহে ম্যুরাল চিত্রের ঐতিহ্যানুসারী এবং প্রধানত পৌরাণিক কাহিনির চিত্রায়নে অনেকসময়ে বিমূর্ততার ব্যবহার দেখা যায়। শিল্পীরা দীর্ঘদিন ধরে এই কলার প্রশিক্ষণ নিতেন আবার কখনো-কখনো বংশপরম্পরায় কোনও রাজসভায় শিল্পীরা নিযুক্ত থাকতেন। তবে জনপ্রিয় এই শিল্পধারা উনিশ শতকে ব্রিটিশ শাসকদের রমরমার সময় থেকেই অভিজাত পৃষ্ঠপোষকদের হারাতে শুরু করে। যদিও রাগসঙ্গীত তার গুরুত্ব সেই যুগেও হারায়নি বা বলা ভালো আরও বেশি করে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসতে শুরু করেছিল।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

 

 

চিত্র ৪ : কামোদ রাগিণী চিত্র ৫ : বসন্ত রাগিণী চিত্র ৬ : ললিত রাগ

 
 
 
 
 

রাগমালা তো প্রকৃতপক্ষে রাগের মালা, অর্থাৎ বলা যায় একাধিক রাগ-রাগিণীর বিমূর্ততা থেকে মূর্ত চেহারায় আত্মপ্রকাশের সিরিজ। এই চিত্রকলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হল ভিন্নধারার অনেকগুলি শিল্পমাধ্যমকে ধারণ করে রাখার ক্ষমতা। সঙ্গীত আর চিত্রের কথা তো আগেই বললাম। কিন্তু রাগমালা চিত্রের মধ্যে অনেক সময়ে লেখা হত কবিতাও। বলা বাহুল্য, কবিতাগুলিও ওই বিশেষ রাগটির ভাব ও রসানুভূতি দর্শকের মনে জাগিয়ে তোলার কাজে সহায়ক। ছবির মধ্যে রাগ-রাগিণীর ভাব অনুযায়ী তাদের উপরে ব্যক্তিত্ব আরোপ করে চিত্রিত করা হত নায়ক-নায়িকাদের। কখনও আবার ছবির চরিত্র, উপাদান এবং বিভিন্ন অনুষঙ্গের মাধ্যমে প্রায় একটি নাটকীয় দৃশ্যের অভিনয়কেই সার্থকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তুলির টানে। এই শিল্পকলায় আসলে সঙ্গীত, চিত্র, কাব্য এবং নাট্য – এই চার কলারই অভিনব মিশেল দেখতে পাওয়া সম্ভব, এ কথা বললে আশা করি অত্যুক্তি করা হবে না।

 

রাগমালা চিত্রের রহস্য বোঝার আশায় শিল্পের নানাপথে ঘুরপাক খেতে খেতে তাই একবার ভরতের নাট্যশাস্ত্রের কাছে যাওয়াটা জরুরি হয়ে পড়েছে। ভরত সেখানে ‘ভাবব্যঞ্জক’ অধ্যায়ে রতি, হাস, শোক ইত্যাদি আটটি ‘স্থায়িভাব’; নির্বেদ, গ্লানি, শঙ্কা ইত্যাদি তেত্রিশটি ‘ব্যাভিচারি ভাব’ ও স্তম্ভ, স্বেদ, অশ্রু প্রভৃতি আট প্রকার ‘সাত্ত্বিক ভাব’-এর কথা বলছেন। ‘রসবিকল্প’ অধ্যায়ে তিনি বলছেন বিভাব, অনুভাব ও ‘ব্যাভিচারি ভাব’-এর সংযোগে রসনিষ্পত্তি হয়। বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণে যেভাবে ব্যঞ্জন প্রস্তুত করা হয় এবং সুমনা ব্যক্তিরা তা ভক্ষণ করে রসাস্বাদন করেন ও আনন্দ পান, ঠিক সেভাবেই সহৃদয় দর্শক বা শ্রোতার কাছে যেকোনও সফল শিল্পমাধ্যম রসাস্বাদনের অনুভূতি নিয়ে আসে। এছাড়াও ভরত প্রত্যেকটি রসের বর্ণের কথা এবং নির্দিষ্ট দেবতার কথা পাঠককে জানান। যেমন – শৃঙ্গার রস শ্যামবর্ণ ও দেবতা বিষ্ণু, বীর রস গৌরবর্ণ ও দেবতা মহেন্দ্র ইত্যাদি। এই ধারণার সঙ্গে রাগমালা চিত্রকলার মূল দিকগুলি মিলিয়ে দেখলেই আমরা বুঝব কীভাবে প্রাচ্য নন্দনতত্ত্বের বিচিত্র অভিমুখজাত বৈশিষ্ট্যগুলিকে এক অঙ্গে ধারণ করে চিত্রগুলি। উদাহরণ হিসেবে বিভাস রাগিণীর চিত্ররূপে শৃঙ্গার রসের ভাবগুলি কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তা দেখা যেতে পারে।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

 

 

চিত্র ৭ : বিভাস রাগিণী

 

ছবিতে মূল চরিত্র হিসেবে দেখা যাচ্ছে আলিঙ্গনাবদ্ধ প্রেমিক-প্রেমিকা এবং একটি ময়ূরকে। দৃশ্যটির সময়কাল ভোর হওয়ার প্রাক-মুহূর্ত বলা চলে। সারারাত একসাথে কাটানোর পর হঠাৎ ময়ূরের ডাকের কারণে তাদের বিচ্ছেদের সময় যেন দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। তাই ‘নায়ক’ একটি ধনুকে তীর সংযোজন করে ময়ূরকে মারতে উদ্যত। তবে লক্ষ করার বিষয় হল; তীর-ধনুকটি সম্পূর্ণই ফুলের তৈরি, যা আমাদের মদন বা কামদেবের ফুলশরের কথা মনে পড়ায়। নায়ক-নায়িকার পোষাক-পরিচ্ছদ, অলঙ্কারের নিখুঁত ডিটেলিং, ঘরের আসবাবপত্রের কারুকার্য আভিজাত্যের পরিচয়বাহী হয়ে উঠেছে। নায়কের পোষাকে সুগন্ধীর চিহ্ন শৃঙ্গারের আবহ নির্মাণ করে। এছাড়াও ছবিতে ময়ূরের উপস্থিতি বর্ষাকালের ইঙ্গিত দিয়ে মিলনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেয়।  

 

ছবিগুলি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শুধুমাত্র নীরস আলোচনার ঘনঘটার অবতারণা আসলে ছবিগুলির উপর অবিচার করা ছাড়া আর কিছুই নয়। তার চেয়ে বরং অনধিকার চর্চা মনে হলেও আমরা আরও কয়েকটি

 

ছবির আনাচে কানাচে একটু উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেই ফেলি।

 

 

 
 
 
 
 
বিলাবল রাগিণী
 
 
 

চিত্র ৮ : বিলাবল রাগিণী

 

বিলাবল রাগিণীর এই চিত্রে দেখব নায়িকা সখীর সহায়তায় সাজসজ্জা করছেন, আলতা পরছেন, আয়নায় মুখ দেখছেন এবং নায়কের সঙ্গে অভিসারে প্রস্তুত হচ্ছেন। বহু রাগমালা চিত্রেই আয়নার ব্যবহার দেখা যায়, যাকে একটি শুভ প্রতীক হিসেবে সেখানে রাখা হত। অপেক্ষমান নায়ককে দূরে গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে। ছবির চরিত্রগুলির পোষাক ও অলঙ্কারের সূক্ষ্ম কারুকার্য দর্শককে মুগ্ধ করবেই। এই অভিসারের চিত্র আমাদের রাধা-কৃষ্ণের অভিসার পর্যায়ের পদগুলির কথা মনে পড়ায়।

 

 

 
 
 
 
 
 
 
ভৈরব রাগ
 
 
 

চিত্র ৯ : ভৈরব রাগ

 

ভৈরব রাগের সঙ্গে শিবের সংযোগ আছে। যদিও সব ঋতুতেই এই রাগ গাওয়া যায় তবে বর্ষাকালের সঙ্গেই এই রাগের মেজাজ মানানসই হয় সবচেয়ে বেশি। এই ছবিতেও আকাশে মেঘের আনাগোনা আর প্রকৃতিতে রঙের যে ব্যবহার দেখা যায় তা বর্ষাকালের ইঙ্গিতবাহী। এছাড়া দিনের শুরুতেই এই রাগ গাওয়ার রীতি আছে। ছবির মধ্যেকার আলোআঁধারিও সেই সময়কেই ফুটিয়ে তোলে। এই রাগের সঙ্গে ‘শুদ্ধিকরণের অভিজ্ঞতা’-কে যুক্ত করা হয় বলে এই রাগের বেশিরভাগ ছবিতেই দেখা যায় শিব তাঁর সহধর্মিণীদের সঙ্গে রয়েছেন এবং তাঁরা শিবের দেহে চন্দনের প্রলেপ লাগাচ্ছেন। এই ছবিতেও সেই দৃশ্যই আমরা দেখতে পাই। ছবিটির বর্ডারের অসাধারণ কারুকার্য দর্শকের চোখ এড়িয়ে যায় না।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
আশাবরী রাগিণী
 
 
 

চিত্র ১০ : আশাবরী রাগিণী

 

এই চিত্রটি আশাবরী রাগিণীর। সঙ্গীতশাস্ত্র অনুযায়ী এই রাগিণী মর্যাদা ও সুতীব্র আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিতবাহী। ছবিতে তাঁকে দেখানো হয়েছে নির্জন অরণ্যে একাকী রমণীর বেশে। তিনি একটি সাপকে মন্ত্রমুগ্ধ করে বশ করছেন। নানা সময়ে আলাদা শৈলীর চিত্রকলায় এই নারীর সামাজিক অবস্থান বদলে গিয়েছে। এই ছবিতে তিনি একজন যোগিনী রূপে অবস্থান করছেন, তবে তিনি সালঙ্কারা। তাঁর গায়ের রঙ ঘন নীল, পরনে ময়ূরের পালক তাঁকে প্রকৃতির কন্যা হিসেবেই তুলে ধরেছে। তাঁর ডানহাতে বিষধর সাপটিকে তিনি জাদুমন্ত্রবলে বশ করছেন। তাঁর পায়ের কাছে দু’টি বৃশ্চিকও দেখা যাচ্ছে। ছবিটিতে একই সঙ্গে সম্মোহন আর ভয়ের আবহ তৈরি করা হয়েছে।

 

 

 

চিত্র ১১ : মালশ্রী রাগিণী

 

মালশ্রী রাগিণীর এই ছবিতে আমরা দেখতে পাই নায়কের বিরহ বেদনায় আচ্ছন্ন নায়িকাকে। ছবিটিতে রঙের ব্যবহার বিরহের এই মেজাজটিকে সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। পাশে দাঁড়িয়ে সখীর হাওয়া করার ভঙ্গীতে যেন খানিকটা নায়িকার প্রতীক্ষার যন্ত্রণা লাঘবের চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। প্রাসাদের বাগানে বসে নায়িকা পদ্মের পাপড়ি ছিঁড়ছেন একটি একটি করে। তাঁর অন্তহীন প্রতীক্ষার দ্যোতক হয়ে উঠেছে এই দৃশ্য। ‘কুমারসম্ভবম্‌’-এ শিবের সঙ্গে বিবাহের কথা শুনে ব্রীড়াবনতা পার্বতীর অনুরূপ একটি ছবিই যেন আমাদের মনে আসে যেখানে কবি লিখেছেন, “লীলাকমলপত্রাণি গণয়মাস পার্বতী”; এখানেও তো প্রতীক্ষা, উৎকণ্ঠা, লজ্জা – সব অনুভূতি মিলেমিশে একাকার। এই ছবিতে নায়িকার সামনেই পদ্মফুলের সারি যা পবিত্রতা আর উর্বরতার প্রতীক। পাশে প্রাসাদের ঘরটি দেখা গেলেও সেখানে শয্যা অনুপস্থিত, দরজার সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সুরাপাত্র, পান রাখার পাত্র ইত্যাদি, যা নায়কের অনুপস্থিতির কথাই মনে পড়ায়। মালশ্রী রাগ দিনের যে কোনও সময়ে গাওয়া যায়, ঠিক যেমন বিরহেরও কোনও নির্দিষ্ট সময় হয় না।  

 
 
 
 
 
 
 
 

আরও বহু রাগ-রাগিণীর কথা এই লেখায় অনালোচিত থেকে গেল। এমনকি এই লেখায় দক্ষিণ ভারতীয় রাগসঙ্গীতের ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত রাগমালা চিত্রকলার আলোচনায় ঢোকা সম্ভব হল না বিস্তৃতির কারণে। সবকথা বলে ফেলার সুযোগ এখানে নেই, কিছু কথা আবার ব্যাখ্যাতীতও বটে। ভাব থেকে রসাস্বাদনের যে যাত্রাপথ, তার বাঁকে বাঁকে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ, বর্ণ, শব্দ, ছন্দোময় উপকরণের অবাক করা প্রাচুর্য সাজিয়ে রেখেছে রাগমালা চিত্রকলা। আর একইসঙ্গে একাধিক ইন্দ্রিয়জ এবং ইন্দ্রিয়োত্তর সুখানুভূতির চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে এই ছবিগুলির অন্দরে। তার এই আভাসটুকুই বা কম কী?  

 

[ লেখায় ব্যবহৃত ছবিগুলি গুগল থেকে সংগৃহীত।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

চিত্রসূচি:

 

চিত্র ১ : মালকোষ রাগ – রাজস্থান, বুন্দি/কোটা, আঠেরো শতক

 

চিত্র ২ : ধনশ্রী রাগিণী – রাজস্থান, বুন্দি, ১৬৮০ খ্রিঃ

 

চিত্র ৩ : টোড়ি রাগিণী – মধ্যপ্রদেশ, মালওয়া, ১৬৫০ খ্রিঃ

 

চিত্র ৪ : কামোদ রাগিণী – মধ্যপ্রদেশ, মালওয়া, ১৬৫০ খ্রিঃ

 

চিত্র ৫ : বসন্ত রাগিণী – রাজস্থান, কোটা, ১৭৭০ খ্রিঃ

 

চিত্র ৬ : ললিত রাগ – মুঘল চিত্র, ১৬১০ খ্রিঃ

 

চিত্র ৭ : বিভাস রাগিণী – রাজস্থান, বুন্দি, ১৬৮০ খ্রিঃ

 

চিত্র ৮ : বিলাবল রাগিণী – রাজস্থান, বিকানের, ১৭২০ খ্রিঃ

 

চিত্র ৯ : ভৈরব রাগ – মুঘল চিত্র, সময়কাল অজানা

 

চিত্র ১০ : আশাবরী রাগিণী – উত্তরপ্রদেশ, চুনার, ১৫৯১ খ্রিঃ

 

চিত্র ১১ : মালশ্রী রাগিণী – মধ্যপ্রদেশ, মালওয়া, ১৬৪০ খ্রিঃ ]

ভাগীরথী: এক জীবন নাচের গল্প

ঐশিকা চক্রবর্তী

 

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

 
 
 

১৯৯০ সাল। ‘ডান্সার্স গিল্ড’-এর আয়না লাগানো আয়তাকার ঘরে পার(?) আর জল

 

তরঙ্গের নানা অনুষঙ্গে ঢেউ উঠছে পড়ছে। নানা স্রোতের মোচড়ে, ঘায়ে তোলপাড় হচ্ছে

 

নতুন নাচের গল্প। স্রোত বইছে নানা শরীরে, চেনা-অচেনা নানা ভঙ্গির উত্তরণ,

 

অবতরণ, আবগাহন। মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার তাঁর একাধিক মঞ্চসফল নারীকেন্দ্রিক

 

সমকালীন নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করার পর অবকাশে এক অভিনব নৃত্যনির্মানের পথে।

 

নাম ‘ভাগীরথী’। প্রাচীন সংস্কৃত পুরাণ থেকে লোককথা; মহাভারতীয় আখ্যান থেকে

 

কথকতা পাঁচালি তর্জার পথ বেয়ে আধুনিক বাংলার চলিত ভাষ্যে জাহ্নবীর ‘গঙ্গোত্রী’

 

থেকে ‘মোহনা’-য় সমুদ্রযাত্রার ইতিকথা। আদপে হয়তো একটা নদীর কথা। কিন্তু,

 

‘ভাগীরথী’ হয়ে দাঁড়ায় এক সংকটকালে তোলপাড় হয়ে চলা মানবসভ্যতার ইতিহাস।

 

উন্মেষ, ক্ষয়, সংঘর্ষ, সংকট, মৃত্যু ছাপিয়ে পুনর্জন্মের কাহিনি। ‘ভাগীরথী’ কোনও

 

ধারাবাহিক প্রবাহ নয়। টুকরো টুকরো কোলাজে সাজানো ছোট-বড় এপিসোড। কোনও

 

এক সময়ের থমকে থাকা ইতিহাসের কথা না-বলেও, নদীর কূল ওপচানো ইতিহাসদের

 

কথা— ভেঙে যাওয়া, জোড়া লাগা ভূগোল, তার ভাঙন–ধরা পার, মধ্যিখানে চরা, শুকিয়ে

 

যাওয়া তীরের কথা। সে ভাগীরথীর গল্প শুরু হয়তো তপস্যায় তুষ্ট আনন্দ জাহ্নবীর

 

মর্ত্যে অবতরণের সঙ্গে— যার শেষ নদীমাতৃক এক শহরের ভাঙন ও পুনর্গঠনের

 

অঙ্গীকারে। ভাগীরথী কূল থেকে মোহনায় ছড়িয়ে পড়ার কাহিনি। এই নদীকে নিয়ে নদীকে

 

ঘিরে অজস্র লোকগাথা/কথা আচার-অর্চনা-বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এক সুদীর্ঘ

 

টানাপোড়েন। ‘ভাগীরথী’ নৃত্যকথা এক পাহাড় ডিঙিয়ে আসা নদীর গ্রাম শহরের আঁকে-

 

বাঁকে ছুঁয়ে যাওয়া জনপদের বাঁচা-মরার কাহিনিও। এক চলমান, বহমান জীবন কথা। যে-

 

জীবন বদলায় নদীর বাঁকের সঙ্গে। ‘ভাগীরথী’ একটা সময়ের প্রবাহ, বাঁক বদলালেও

 

তার গতি থমকায় না। হাজার চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জোয়ার-ভাটার টানে ভাগীরথী বয়ে

 

চলে অবিরাম। নৃত্যনির্মাতার জীবন বৃত্তান্তের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ও অঙ্গাঙ্গীভাবে

 

জুড়ে আছে যে-‘ভাগীরথী’, এই নৃত্য-আখ্যান সেই জীবনেরও বৃত্তান্ত। যে নদীর প্রশস্ত

 

সমাহিত তীরে জন্মেছিলেন মঞ্জুশ্রী মুর্শিদাবাদের বহরমপুর শহরে আর যে নদীর পাড়ে

 

বসত গেড়েছিল তাঁর শৈশব-কৈশোর পুববাংলার পাবনার আধ-শহরে; সেই সমান্তরাল

 
 
 
 
 
 
 
 

পড়শি নদীর এক স্রোত থেকে অন্য স্রোতে তাঁর শৈশব থেকে কৈশোর কেটেছিল গভীর

 

অবগাহনে— এক মিশ্র সভ্যতা সংস্কৃতির তল সন্ধানী ডুব সাঁতারে। যদিও নদী তার

 

পার ভাঙে বারবার, যদিও সে গতি বদলায় ক্ষণে ক্ষণে, তবুও এপার-ওপার সাঁতার বন্ধ

 

হয় না। তবে, দেশভাগের দোলাচলে সেই চেনা নদীর জলটাও অবিশ্বাসের ঠেকে, গন্ধটা

 

অচেনা হয়ে যায় যেদিন। সেদিন থেকে মঞ্জুশ্রীও ভেসে চলেন শিকড়বিহীন শৈবালের

 

মতো। সেই ভাসমান, বহমান বয়ে চলার পথেই ঠিকানা হয়ে ওঠে কল্লোলিনী কলকাতা,

 

নতুন স্বাধীন রাজ্যে অন্য কোনও নামে ডাকা ‘ভাগীরথীর’–ই শাখা নদীর ধারে। তারপর,

 

বারবার ভেসে যায় তাঁর নদী। কখনও নাইগার, কখনও হাডসন— নানা দেশের জল-কাদার

 

গন্ধ মেখে যখন ফিরে আসেন আবার জাহ্নবীর উপকন্ঠে, তখন সেই চেনা নদীর শরীরের

 

স্রোতটাও অনেক অচেনা ঠেকে। তিনিও অনেকটাই অপরিচিত তখন তাঁর জন্মভূমি/

 

জন্মনদীর কাছে।

 

১৯৮০ সালের গোড়ায় ভারতবর্ষে পুনর্অভিবাসনের এক দশকের মধ্যেই মঞ্জুশ্রী তার

 

নৃত্য স্বাক্ষর রচনা করেন “ভাগীরথীর” মাধ্যমে। ছোট্ট গ্রামের পাশে বয়ে চলা নদীকে

 

সঙ্গে নিয়ে মঞ্জুশ্রী শহর ডিঙোন, দেশ ডিঙোন, মানচিত্র ডিঙিয়ে ভেসে বেড়ান অজস্র

 

নাম না–জানা মোহনার সন্ধানে। এই নৃত্য আখ্যানে ভগীরথের গঙ্গা আনন্দ জাহ্নবীর

 

রূপ ধরে পদ্মা, মেঘনা, হুগলির জলে এক হয়ে, সহস্র ভাঙন বিপর্যয় ধ্বংসের রক্ত

 

মেখেও বুকে সার সার প্রদীপ নিয়ে জ্বলে। ‘ভাগীরথী’ তাই শুধু নদীর স্রোতে ঢেউ তুলে

 

এপার–ওপারের উচ্ছ্বলিত তরঙ্গ-কথা নয়। এক নারী ও তাঁর ভিন্ন জীবন–প্রবাহ,

 

ভিন্ন ভিন্ন আবাসের কথাও। ইতিহাসের আঁচড় কাটা শরীরের জন্ম থেকে মৃত্যু ডিঙনো

 

জীবনযাত্রার কাহিনিও। নদী সেখানে একটা রূপক, একটা মেটাফর।

 

এক চলমান জীবনের প্রতিচ্ছবি। ১৯৯০–এ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুদানের

 

প্রতিশ্রুতি এলেও ‘ভাগীরথী’ কখনও কোথাও মঞ্চস্থ হয়নি। ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটের

 

বিরতিহীন এই নৃত্যকাব্য তৈরি হয়েছিল মঞ্জুশ্রীর চেনা নৃত্য–নাটিকার থেকে

 

অনেকটাই আলাদা আঙ্গিকের প্রয়োগে। কখনও ছেঁড়া ছেঁড়া কোলাজে, কখনও শাস্ত্র-

 

পুরাণের শ্লোকে গাঁথা সমকালীন নৃত্যের সূক্ষ্ম বিস্তারে, কখনও পাঁচালি কথকতার

 

গানে–গল্পে–লোকায়ত নৃত্যরূপে। আবার আধুনিক সভ্যতার প্রবাহের মুখে নারীদেহে

 

আরোপিত/আয়ত্তাধীন পুরুষালি যুদ্ধকলা বা মার্শাল আর্টের সংঘবদ্ধ প্রয়োগেও।

 

দেশজ যুদ্ধকলা ছেট, থাংতা ও কালারিপায়াত্তুর সেই চমক লাগানো স্পর্ধা জানানো

 

পদোত্তলনে এক উলটো স্রোতের কথাও বলেছিল ভাগীরথী। সহযোগী পরিচালক

 

রঞ্জাবতী সরকার এই সময়ে, মায়ের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে অসাধারণ আরও কিছু

 

নৃত্য মুহূর্ত তৈরি করেছিলেন। যোগ হয় প্রকাণ্ড সুন্দর মুখোশ বলশালী এক রাজা আর

 
 
 
 
 

পালটা আরেক রাজার বেশে। রষ্ট্রাম–এর উপর সেই বিরাটাকার মুখোশ নিয়ে রিহার্সাল

 

হয়েছে বহুবার। তবে, সে দৃশ্য কলকাতা দেখেনি কোনওদিন। তাই বলে মঞ্জুশ্রী এতদিন

 

ধরে, এত যত্নে গড়ে ওঠা নৃত্যনাট্যটি একেবারে বিসর্জনও দেননি তাঁর রেপেটর থেকে।

 

‘ভাগীরথী’–র নানা টুকরো নানাভাবে অনুষ্ঠিত হয়। ‘গঙ্গোত্রী’ অনেক পুরনো প্রযোজনা

 

(যা ছিল ‘ভাগীরথী’–রও সূত্রপাতের অংশ)। কখনও ‘প্রবাহিনী’ (পুরীর প্রথম ‘বিচ

 

ফেস্টিভ্যাল’–এ প্রথম অনুষ্ঠিত) কখনও ‘গঙ্গাপূজা’ থেকে ‘মানিকপীর’। আর তারও

 

পরে ‘চরৈবেতী’ ও ‘যুগসন্ধী’ নামে দুই সম্পূর্ণ নৃত্য–নাটকে রূপান্তরিত হয়ে মঞ্চস্থ

 

হয় কলকাতা ও ভারতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। সেই ঢেউ তোলা নদীর উপর পালতোলা

 

নৌকার মতো বয়ে চলা গল্পটা আর থাকে না ঠিকই, তবে এক অতিনাটকীয় ছন্দে মথিত

 

হয়ে পরবর্তী দু’টি নৃত্যবিন্যাস বিশ শতকের শেষ দশকে মঞ্জুশ্রীর উত্তর–আধুনিক

 

নৃত্যভাষার সোচ্চার প্রয়োগে সাক্ষর রেখেছিল প্রশ্নাতীতভাবে। এছাড়া, রঞ্জাবতীর

 

একক প্রযোজনা ‘গঙ্গাবতরণ’–– যা এক ধ্রুপদী সমকালীন নৃত্যভাষার অপরূপ

 

যুগলবন্দিতে তাঁর নৃত্যনির্মাণে নিজস্ব প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করেছিল, সে–ও ছিল

 

‘ভাগীরথী’–রই পরবর্তী আখ্যান। রঞ্জাবতীর একাহার্য অভিনয়–সমৃদ্ধ

 

‘গঙ্গাবতরণ’–এর বিষয়, আঙ্গিক। কোরিওগ্রাফি এই পরিচ্ছদের আওতাভুক্ত নয়।

 

বরং শুরু করা যাক ‘ভাগীরথী’–তে রঞ্জাবতীর ভূমিকা নিয়ে।

 

ঝিঙে ফুল পাততাড়ি তোল:

 
 
 

গঙ্গার ধারে একপাশে জড়ো হওয়া ভক্ত–সমাবেশে গাঁয়ের বউ, ঝি–দের ভিড়টাই বেশি।

 

এমন সময় স্টেজের ডানদিকের শেষ উইংস থেকে তড়িৎ পদক্ষেপে প্রকাশ ঘটে কথক

 

ঠাকুরানির। লাল পাড় সাদা গরদের শাড়িতে রঞ্জাবতী (মঞ্চে সে কখনও আসেনি এই

 

বেশে এই নৃত্যনাট্যে) দ্রুত স্বস্তিকার ছন্দে অর্ধচন্দ্রাকারে স্টেজ পরিক্রমণ

 

করেন ‘ঝিঙে ফুল/ পাততাড়ি তোল, ঝিঙে ফুল, পাততাড়ি তোল, ঝিঙে ফুল/ পাততাড়ি

 

তোল, ঝিঙে ফুল, পাততাড়ি তোল/ পাততাড়ি তোল’ ব’লে। তারপর একেবারে সামনে

 

স্টেজের ডানদিকের অফ সেন্টারে এসে কোমর থেকে সোজা হয়ে হাত ছড়িয়ে গঙ্গা

 

পূজা–র কথার জাল বোনেন।

 
 
 

শিব বলে পার্বতীরে

 

বল গো পার্বতী

 

গঙ্গার ধারে কারে পূজে

 

যতেক লক্ষ্মীবতী

 
 
 
 
 
 
 

গৌরী বলে, গঙ্গার ধারে

 

অশথ নারায়ণে

 

পূজে সতী ভাগ্যবতী

 

ভক্তিযুক্ত মনে।

 
 
 

এমনই এক ফেলে আসা গানের সুরে শুরু হয় গঙ্গাপূজা। পুত্রলাভের আশায় গঙ্গাপূজায়

 

মগ্ন লক্ষ্মীমন্ত বউদের পুজো সাঙ্গ হয়। কথক ঠাকুরানি গল্প বলে, হেসে–গেয়ে

 

দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করে,কখনও নিজেই অশ্বত্থ গাছ,কখনও নিজেই নদী হয়ে বয়ে

 

চলে স্টেজের আনাচকানাচ। তারপর কথকতার সুর মিশে যায় অন্য আরেক ধুনে। সুরের

 

পিঠে আরেক সুর ফেলে উঁচু রষ্ট্রামের বাঁদিক থেকে কালো জোব্বা পরে গাঁজার কলকেতে

 

দম দিতে দিতে দুলকি চালে ঢোকে মানিক পীরের ভক্তদল। কিছুটা ভাবে, কিছুটা নেশায়

 

ওরা গায় ‘মানিকপীর, মানিকপীর ব্যাপার পাইছ কী?’

 

উত্তর: পাইছি এক ছিঁড়া কাঁথা, আর পামু কী?

 

প্র: হোই, মানিকপীর , মানিকপীর ব্যাপার পাইছ কী?

 

উ: পাইছি এক ল্যাংড়া ঘোড়া আর পামু কী?

 

‘ব্যাপার’ অর্থে এখানে বরপণ। পীরের পুজোর ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকে প্রতিদিনকার

 

যাপনচিত্র কথাও। মানিকপীরের গান শেষ হতেও সময় লাগে না। স্টেজের রং বদলায়।

 

স্মৃতি সরে যায় আরও পিছনে一 প্রবাহিনীর কোথায় শুরু, কোথায় শেষ一 কত গল্প

 

বইছে তার স্রোতে। জীবনদায়িনী পতিতোদ্ধারিনী গঙ্গা তো ডুবিয়ে–ভাসিয়ে

 

সর্বস্বান্তও করে। নদী তো অভিশাপও বয়ে আনে কখনও মানবজীবনে। স্টেজের

 

বাঁকোণ থেকে উঠে আসে মনসা। খোলা চুলের কালো মেয়ে, পুতুল নাচের মতো বাঁধা যেন

 

তার শরীরের ভঙ্গি। ওড়িশির চৌকায় শরীরের নিম্নাংশ স্থির রেখে মনসার উপরিভাগ

 

দোলে ডানে–বাঁয়ে। পদ্মাবতীর আগমনে বিপর্যয়ের গন্ধ পায়। গন্ধ一 সে–ও উঠে আসে

 

তল ফুঁড়ে। একইভাবে পুতুল নাচের আটকানো ছন্দে গঙ্গা কখনও চৌকা, কখনও অর্ধ

 

মণ্ডল অবস্থানে ডানকোণে এসে দাঁড়ায়। শুরু হয় অ-ব্রাক্ষ্মণ্য অ-বৈদিক লৌকিক

 

সর্পদেবীর পাশে/ সঙ্গে পৌরাণিক দেবী গঙ্গার ভাবের উত্তপ্ত আদান–প্রদান।

 

সাহিত্যের ছাত্রী মঞ্জুশ্রী মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যের কোনও চরণ ছুঁয়ে এখানে

 

প্রয়োগ করেন পূর্ববঙ্গে প্রচলিত তর্জা। আসলে কিশোরবেলায় পাবনার গ্রামে পথ

 

চলা কচিপ মিঞার পুকুরের পাড় আর পদ্মায় ডুব সাঁতারটা তাঁর শরীরের স্রোতে বয়ে

 
 
 
 
 

চলেছিল অবিরাম। তারই সুর বয় ভাগীরথীর প্রবাহেও। গঙ্গা–মনসা তর্জায় তাই দেখি

 

মনসা কেমন অনুনয়ে ও সরোষে–সজোরে জানায় তার যন্ত্রণার কথা। চ্যাংমুড়ি কানীকে

 

মর্ত্যলোকে পুজো, দেবীত্বে উন্নীত করতে পারত একমাত্র শিবভক্ত সর্বশক্তিমান

 

বণিক চাঁদ সওদাগর। কিন্তু চাঁদ অন্ধ অবৈদিক সর্পদেবী মনসাকে পুজো করতে নারাজ।

 

শাস্তি হিসাবে মনসা একের পর এক তার ছ’টি সন্তানকে বিষের ছোবলে শেষ করেছে।

 

তবুও বশ মানেনি চাঁদ। সদর্পে অটল আত্মম্ভরী সওদাগরকে আরও একবার

 

প্রত্যাঘাত করতে সর্পদেবী মনসা এইবার প্রার্থনা করে জলদেবীর সাহায্যের। মনসা

 

জেনেছে সপ্তডিঙা সাজিয়ে চাঁদ বেরিয়েছে বাণিজ্য করতে। এই সুযোগ! একবার যদি

 

সপ্তডিঙা সমেত তার ধন–সম্পত্তি–সন্তান সব গ্রাস করা যায়, সব যদি মনসার

 

ষড়যন্ত্রে তলিয়ে যায় জলের তলায়一 চাঁদ হয়তো বুঝবে মনসার মাহাত্ম্য, ক্ষমতার

 

পরিমাপ ও রোষের তীব্রতা, জোর। কিন্তু এ কাজে সর্পদেবী তো একা অপারগ। বিষের

 

ছোবলে সন্তান গ্রাস করতে পারে সে। কিন্তু সপ্তডিঙা তলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা মনসার

 

নেই। তাই মনসা আহ্বান জানায় স্রোতস্বিনী গঙ্গাকে一

 

তলাইয়া দাও সকল নাও

 

তোমার অন্তরে

 

উচিত শিক্ষা দাও গো তুমি

 

চন্দ্র সদাগরে

 

ওই নীলাজ সদাগরে…

 
 
 

গঙ্গা ভীত সন্ত্রস্ত। জীবের প্রাণনাশে তার অনেক জড়তা। বারংবার ইতস্তত করে,

 

বারংবার পালাতে চায়। ফণা উঁচিয়ে আসা মনসার ছোবল থেকে কোন অপরাধে চাঁদ

 

সদাগরের বাণিজ্যতরী ডুবিয়ে দেবে গঙ্গা? তার কাছে তো কোনও অপরাধে করেনি চাঁদ।

 

ক্ষুদ্ধ মনসা এবার শেষবারের মতো সতর্কবাণী শোনায় গঙ্গাকে। যদি গঙ্গা না–ই

 

ডোবায় চাঁদ সদাগরের সপ্তডিঙা, তবে মনসার রোষ থেকে বাঁচবে না গঙ্গাও। নদী

 

গহ্বরের সহস্র নাগিনীর সঙ্গে মনসা বিষ উগরে দেবে গঙ্গায়। ছোবলের পর ছোবলে

 

জলের একটা বিন্দুও বিষের আওতার বাইরে যাবে না। শুধু একটা চাঁদ সওদাগর নয়,

 

জলবাহী সব জীব জলজ সব প্রাণ, এমনকী, নদী অববাহিকার প্রাণকে মারবে অকাতরে!

 

গঙ্গা চমকে ওঠে ভয়ে। রাজি তো তাকে হতেই হবে এবার। কারণ, স্টেজে পাক খেতে

 

খেতে মনসা ঘুরছে বনবন করে ‘আমি তরে বিষাইব। আমি তরে বিষাইব’।

 
 
 
 
 

ফেনিয়ে ওঠে জল। ঈশান কোণে মেঘ ফাটে, আকাশ জুড়ে ঝড় নামে। উত্তাল হয় ভাগীরথী।

 

অকাল জোয়ারে মাঝ–দরিয়ায় তুফান ওঠে। ডিঙি ভেঙে তলিয়ে যায় সদাগরের

 

বাণিজ্যপুঁজি। ভেসে চলে যায় সপ্তডিঙা ধন–প্রাণ সমেত। হাজার হাজার জীব মানুষের

 

প্রাণ বাঁচাতে ভাগীরথী ডুবিয়ে দেয় চাঁদের ডিঙি। তবু বিষবাহী হয়ে সহস্র নিরীহ প্রাণকে

 

হত্যার হাত থেকে বাঁচায় গঙ্গা। পরে হয়তো কোনওদিন আবার লখীন্দরের মৃতদেহ বয়ে

 

নিয়ে যাওয়া বেহুলার ভেলা সে–ই পৌঁছে দেবে দেবলোকে একদিন। একদিন চাঁদও মানবে

 

মনসাকে। চ্যাংমুড়ি কানী পূজিত হবে মর্ত্যলোকে। জীবন–মৃত্যুর বাহক তো সেই

 

ভাগীরথী।

 

তর্জা–পাঁচালি–কথকতা আবছা হতে হতে মিলিয়ে যায় এক সময়ে। দক্ষিণ সমুদ্রে ভেসে

 

আসে ভিনদেশি বণিকের তরী। ওরা আসে দেশ–দখলের লোভে। নদীকে বাঁধে, ভাঙে,

 

মানচিত্র কেটে কেটে ছিঁড়ে রেখে দেয় মানুষের জীবন ও ফেরত যাওয়ার পথে। ‘ডান্সার্স

 

গিল্ড’–এর সদ্য শিক্ষিত থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী সবাইকে কাজে

 

লাগিয়েছিলেন মঞ্জুশ্রী এই নৃত্যনাট্যে। একদল যখন ময়ূরভঞ্জ ছৌ আর

 

কালারিপায়াত্তুর পা তুলে সবলে এগিয়ে আসে জল ভেঙে, ঢেউ কেটে শক্তিমান শাসকের

 

বেশে; বাদবাকি শরীর কুঁকড়ে গোল হয়ে, মাটিতে পাক খায়। জল–কাদার মতো মুখহীন,

 

পরিচয়হীন মানুষগুলো গড়িয়ে যায় স্টেজের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তারা মানুষ

 

না ঢেউ, জলের স্রোত না রক্তমাংসের পিণ্ড一 তার হদিশ থাকে না এক সময়। এমন

 

সমকালীন নৃত্যভাষার প্রয়োগ কলকাতা ঠিক দেখেনি তখনও। শুধু ‘মুভমেন্ট’–এর

 

নতুনত্ব নয়, শুধুই নতুন রকমের লম্ফঝম্ফ ঘুরপাক বা শরীরী অঙ্গভঙ্গি নয়一 এ নাচ

 

ছিল নতুন সময়ের নতুন শরীরী প্রত্যয়। বাঙালির শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শহুরে

 

নৃত্যচর্চায় একটা বলিষ্ঠ সংযোজন, যা一 রবীন্দ্রনাথ, উদয়শংকর ও আইপিটিএ বা

 

গণনাট্য সংঘ–র পরে সম্পূর্ণ নতুন ভাষ্যে একটা নৃত্যশৈলীর জন্মদান করে।

 
 
 

‘ভাগীরথী’–র নৃত্যনির্মাণ একদিকে ‘তোমারি মাটির কন্যা’, ‘অরণ্য অমৃতা’; অন্যদিকে

 

‘তাসের দেশ’ যুগসন্ধী ও ‘ক্রৌঞ্চকথা’–র মধ্যবর্তী সময়ে মঞ্জুশ্রী চাকী সরকারের

 

নৃত্যশৈলী নির্মাণের স্টক টেকিং–এর (এক্সারসাইজ) প্রয়াসও। একের পর এক

 

শাস্ত্রীয় নৃত্য আহরণ, সংমিশ্রণ ও সাঙ্গীকরণের খেলা শেষে মঞ্জুশ্রী পেলব

 

বাঙালিনির শরীরে অনেকানেক পুরুষালি মার্শাল আর্টের প্রয়োগ করতে শুরু করেন। সব

 

মিলিয়ে বদলে যায় শরীরী উচ্চারণ। ছৌ তো ছিলই আসে কালারি, থাংতা আর শ্রীলঙ্কার

 

ক্যান্ডি一 নতুন চোখে পড়ার মতো উল্লেখযোগ্য ও ব্যতিক্রমী পদক্ষেপণ।

 
 
 
 
 

‘ভাগীরথী’ প্রত্যক্ষ করে এক বিপরীত নৃত্যভঙ্গির সহাবস্থান। একদিকে

 

মাধ্যাকর্ষণের ভারে শরীরের দ্বিধাহীন উপস্থাপন一 মাটির উপর ভর দিয়ে কখনও

 

কথাকলি, কখনও ওড়িশি বা ভরতনাট্যমের স্থানকভেদ, পার্শ্বপদ থেকে চৌকা বা

 

মণ্ডল–এ সহজ বিচরণ। অন্যদিকে ছৌ থেকে ক্যান্ডির টানে শরীরের নিম্নাংশের

 

ছড়ানো টানটান ভঙ্গি। জংঘা থেকে হাঁটু থেকে গোড়ালি অবধি পায়ের মাটি থেকে শূন্যে

 

লাফিয়ে ওঠা যথেচ্ছাচার। এ এক অন্য অনন্য শরীরী স্বাধীনতা। কত বিস্তারিত ও

 

বিস্তৃত পদক্ষেপে স্টেজের এপার–ওপার পেরিয়ে জায়গা ভরিয়ে তোলা যায়, তা

 

মঞ্জুশ্রী দেখিয়ে দিলেন এক–এক চমকে এক–এক চমকপ্রদ নৃত্য-কথিকা নির্মাণের

 

মাধ্যমে। এর চলন আলাদা, বক্তব্য ও আলাদা।

 

‘ভাগীরথী’–তে যখন রক্তস্নাত নদীর বুকে ভেসে যায় সারি সারি শবদেহ, তখনও তার

 

স্রোত থমকায় না। দাঙ্গাবিধ্বস্ত বিভাজিত ক্লান্ত দেশ আবার জেগে ওঠে নতুন

 

প্রাণ/ নতুন দিনের আশায়। মঞ্জুশ্রীর ‘চরৈবেতী’–র সমাপ্তি হয় সেই মন্ত্রে সব

 

মানুষের একত্রিত প্রত্যয়ী গতিময়তায়। প্রবহমান প্রাণের অবিনশ্বরতা প্রমাণিত

 

করে মঞ্জুশ্রী দাঁড়ি টানেন তাঁর নৃত্যনাট্যে।

 

১৯৯২–এ ‘যুগসন্ধি’ করতে এসে আর নদীর কথায় ফিরে যাননি মঞ্জুশ্রী। বরং,

 

গঙ্গাপূজা, মানিকপীর, ভগীরথের গঙ্গাবতরণ স্তোত্র অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছিল সেদিন

 

সেই মুহূর্তে। মাঝখানে দুটো বছর ১৯৯০ থেকে ১৯৯২, দেশের চালচিত্রে চমকপ্রদ

 

রাজনৈতিক পরিবর্তন। মেরুকরণ ঘটে রাতারাতি, যার ভয়াবহ পরিণামে মানিকপীরের

 

গাজন আর কথক ঠাকুরানির গানকে এক স্টেজে, এক আলোর তলায় স্বতঃস্ফুর্ত

 

সহাবস্থানের ক্ষেত্রে সংশয় জাগে। বারবার যে–ভারতবর্ষ তথা বাংলার জীবনযাত্রা

 

ঘিরে যে–রোমান্টিক যাপনচিত্র মঞ্জুশ্রী দর্শিয়েছেন, যেভাবে গঙ্গার স্তোত্রের

 

মাধ্যমে ফিরে গেছেন পুরাণে, শিব–দুর্গার পালাগানে আর গাজীর গানে一 তা এই মুহুর্তে

 

বাস্তব কতটা, কতটা মিথ一 তা নিয়েও সন্দেহ জাগে বারবার। ‘ভাগীরথী’–র আখ্যানে

 

যখন তিনি জাগিয়ে তুলেছিলেন এক বহুত্ববাদী সমাজের কথা, নানা

 

ধর্ম–আচার–লৌকিক বিশ্বাসের সহাবস্থান, হিন্দু ভারতের একচ্ছত্র একমাত্রিক

 

ধর্ম তাকে সেই মানবে কি না, সে নিয়ে এরই মাঝে ঘটে কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা। বাবরি

 

মসজিদের উপর আক্রমণ ও পরপর দেশ জোড়া দাঙ্গা। সমঝে দেওয়ার রাজনীতি।

 

১৯৯৩–তে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শচীনশঙ্করের আমন্ত্রণে ব্যালে উৎসবে যখন

 

একগুচ্ছ আধুনিক নৃত্যশিল্পীদের দল বোম্বে (তখনও এই নাম, বর্তমানে মুম্বই) শহরে

 

নৃত্য সমারোহে মগ্ন, তখনই পরপর বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে বাণিজ্য রাজধানী। অনুষ্ঠান

 

শেষে ফিরে আসে সন্ত্রস্ত ও শঙ্কিত কলকাতার নাচের দল।

 
 
 
 
 

এর কয়েকমাসের মধ্যেই মঞ্জুশ্রী মঞ্চস্থ করেন ‘যুগসন্ধি’ । গল্প–গাথা সরিয়ে সে

 

এক অন্য শরীরের রাজনীতি। পাঁচালি, কথকতা, পীরের গাজনের দুলকি চালে নয়, এবার

 

তার নৃত্যনাট্যে আসে পরিষ্কার সরলরেখায় রক্তমাংসের মানুষের রক্তের, মাংসের

 

রাজনীতি। উঠে আসে জমাট বাঁধা স্তূপীকৃত মৃতদেহ। ধানের গোলা ভাঙে, শিশু ছিটকে পড়ে

 

মায়ের কোল থেকে। ভেসে যায় মানুষ। এক বিকট রাজনৈতিক সময়ে ছিন্ন ছিন্ন সমাজের

 

কথা আঁকে ‘যুগসন্ধি’। ছেঁড়া ছেঁড়া কোলাজে। সর্বস্ব হারানোর মুখেই মানুষ খড়কুটোর

 

মতো মুখে তুলে আনে আবার করে বাঁচার শক্তি। ১৯৯০–এর গোড়াতেই নবনৃত্যের

 

নৃত্যশৈলীতে মঞ্জুশ্রী সংযোজন করেন নতুন কিছু ইউনিট অফ মুভমেন্টস বা ভঙ্গি

 

সমষ্টি। নানা আঙ্গিক স্থানক ও মুদ্রার সংমিশ্রিত রূপে এক যৌগিক কিন্তু

 

অবিচ্ছেদ্য নৃত্যরূপ। সেই নতুন ভঙ্গির নতুন নামকরণও হয় নাচের ভাব বা ইমোশন

 

অনুযায়ী সংঘর্ষ, সংঘট্ট অশ্বগতি, আকাশচারী অজস্র ভঙ্গিসমষ্টির মধ্যে দিয়ে উঠে

 

আসে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের শরীর। যুগসন্ধির শেষ টানটা মঞ্জুশ্রী দিয়েছিলেন

 

নবনৃত্যের এই নতুন আঙ্গিক ও ভঙ্গিসমষ্ঠির নির্মাণে। নয়ের দশকে ‘ডান্সার্স

 

গিল্ড’–এর অবিসংবাদী সৃজনশীলতার জন্য একের পর এক আসে স্বীকৃতির শিরোপা।

 

আঞ্চলিক ও জাতীয় স্তরে মঞ্জুশ্রীর তাঁর নিজস্বতার স্বাক্ষর রেখে দেন। নাচটা শুধু

 

আর আঁকিবুঁকি নয়। দৃঢ ও দৃপ্ত অক্ষরে লিখিত হয় তাঁর উচ্চারণ ভারতবর্ষের

 

সমকালীন নৃত্যের মঞ্চে।

STRANGER THINGS : পপুলার কালচার ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

-Samya Sen Sarma

 
 
 

Samya Sen Sarma

 
 
 
 

Mostly Non-Spoiler

 

সালটা 1981।তারিখ সাতাশে জুলাই। ফ্লোরিডার ছোট্ট শহর হলিউডের বাসিন্দা Adam Walsh তার মায়ের সঙ্গে

 

একটি স্টোরে এসেছিল।তার মা যখন কেনাকাটা ইত্যাদিতে ব্যস্ত, তার থেকে কিছু দূরে আপন মনে ভিডিও গেম

 

খেলছিল ছয় বছর বয়সী Adam। তার মা কাজ সেরে ফিরে এসে দেখে, Adam সেখানে নেই! স্টোর ক্লার্ক এবং তার

 

মা ডাকাডাকি এবং খোঁজাখুঁজি করে,কোনো সাড়া মেলে না।পুলিশ ডাকা হয়,সার্চ পার্টি দিয়ে খোঁজ চলে।

 

ষোলো দিন বাদে,দুজন জেলে মাছ ধরতে গিয়ে দূরে canal এর জলে একটি অজ্ঞাত জিনিস ভেসে থাকতে দেখে। তারা

 

কাছে গিয়ে বুঝতে পারে সেটি একটি কাটা মুন্ডু! একটি ছোট্ট বাচ্চার মাথা ধর থেকে কেটে এফোঁড়-ওফোঁড় করে

 

দেওয়া হয়েছে। Adam Walsh এর মাথা। বীভৎস ,পৈশাচিক !

 

এই কিডন্যাপিং ও মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকার ঘরে ঘরে। এ নারকীয় মৃত্যুর খবর শুনে শহরতলী ও টাউনে

 

দাবানল গতিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে থাকে।1982 সালে Missing Children’s Act আইন পাশ হয়।

 

মানুষের ভয় এবং আবেগকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ও অন্যান্য কার্যসিদ্ধির কথা নতুন কিছু নয়, এ ক্ষেত্রেও

 

তার অন্যথা ঘটে নি। রাজনীতিজ্ঞ ও নেতা-মন্ত্রীরা বুলি আওড়াতে থাকে,”প্রতি বছরে এ দেশে পঞ্চাশ হাজারের

 

কাছাকাছি শিশু-যুবক যুবতীদের অপহরণ করা হয়”। যদিও আসলে সে সংখ্যা হয়তো একশো ও ছাড়ায় না।

 

Richard Moran এ প্রসঙ্গে বলেছেন, " [The Adam Walsh Case] created a nation of petrified kids and

 

paranoid parents. "

 

অপরিচিত মানুষ বা “Stranger” এর তখন শুধুমাত্র একটাই অর্থ , “Danger” !

 
 
 
 
 
 
 
 

২০১৬ সালের জুলাই মাসে ওয়েব প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে Stranger Things মুক্তি পায় এবং অচিরেই

 

অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা লাভ করে। কল্পবিজ্ঞানের গল্প নিয়ে তৈরি এই সিরিজ। টানটান ন্যারেটিভ, চটকদার

 

ভিসুয়াল্স এবং বুদ্ধিমান এডিটিং প্লটের টুকটাক ছোটখাট খামতিগুলোকে বেশ ভালোভাবে মুছে দেয়। ‘Willing

 

Suspension of disbelief’ এ মুগ্ধ দর্শক এক নিঃশ্বাসে বসে সিরিজ দেখে ফেলে, সিট ছেড়ে ওঠার খুব একটা

 

অবকাশ এ সিরিজ দেয় না।

 

এ মহাবিশ্বে আমরা একলা নই,সভ্যতার ইতিহাসের মেকি নিরাপত্তায় মানুষ বাস করে, হয়তো বহু দূরে বা একদম

 

কাছেই বিশালতর কোনো সভ্যতার অস্তিত্ব রয়েছে যা আমরা ক্ষুদ্র প্রাণীরা সাধারণ চোখে দেখতে পাইনা।

 

হয়তো রয়েছে কোনো অপরিচিত বা “Stranger Things” এর চিহ্ন।তারা কখনো শত্রু , কখনো মিত্র হয়ে পৃথিবীতে

 

এসেছে। কল্প-বিজ্ঞানের এই প্রচলিত ফর্মুলাই ব্যবহার করা হয়েছে স্ট্রেনজার থিংস এ।

 

অপকর্ম ও হট্টগোল থেকে অনেক দূরে থাকা ইন্ডিয়ানার ফিকশনাল টাউন হকিন্সে এ গল্পের শুরু, যে টাউনে

 

আপাত-দৃষ্টিতে কোনো অপরাধ ঘটে না।ঠিক সেরকম একটা সাবার্বান নিরাপদ এলাকা কিভাবে হঠাৎ করে

 

অপরিচিত,অজ্ঞাত কিছু বন্ধুর হাতে পড়ে প্রাণটাই খোয়াতে বসলো, সে নিয়েই এ গল্প এগোয়।

 

এলাকাবিশেষে প্রত্যেক দশকেরই কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকে। জীবনযাপন,শিল্প-গান-বিজ্ঞান ও দর্শনে তার

 

নিজস্ব বিশেষ ভঙ্গিমা লক্ষ্য করা যায়। গোদাভাবে দেখলে,Stranger Things আশির দশকের আমেরিকান অতীত-

 

আর্তি।

 

নেটফ্লিক্সে এ সিরিজ দেখবার মিনিমাম বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ষোলো। অথচ মজার ব্যাপার হলো যে সিরিজের

 

মুখ্য চরিত্রগুলির বয়স 12-13। তার মানে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে এ সিরিজের টার্গেট দর্শক আজকের দিনের

 

বাচ্চারা নয়, বরং যারা 80র দশকে বাচ্চা বা যুবক ছিল,তারা।সেই নস্টালজিয়া ও আশির দশকের পপুলার কালচার

 

খুব সুষ্টভাবে ফুটে উঠেছে সিরিজের প্রত্যেক এপিসোডে।সিরিজে ব্যবহৃত বিভিন্ন গান, পরিচ্ছদপ্রণালী, বিভিন্ন

 

চরিত্রের জীবনচর্যা আমেরিকান সাবার্বান জীবনের প্রতিবিম্ব।

 

বর্তমান দিনে দাঁড়িয়ে প্রযুক্তির প্রসার এতটাই সুসিক্ত এবং সংপৃক্ত যে যুগান্তকারী বা পৃথিবী ওলট-পালট করে

 

দেওয়ার মতো কোনো আবিষ্কার না ঘটলে এ যুগের ছেলেমেয়েদের মনে বিস্ময় জাগবে না।কিন্তু 80s ছিল এমন

 

একটা সময় যখন নতুন নতুন টেকনোলজি ঘরে ঘরে পৌঁছানো সবে শুরু করেছে এবং অদেখা-অজানা এই টেকনোলজি

 

হাতে পেয়ে সবার বিশেষ করে ছোটদের মনে চমক লাগে এবং সে বিস্ময় লক্ষ্য করা যায় সিরিজের প্রধান খুদে

 

চরিত্রগুলোর মধ্যেও।প্রথম এপিসোডের শুরুতেই আমরা চারজন বাচ্চাকে সেকালের জনপ্রিয় বোর্ড গেম

 

‘Dungeons and Dragons’ খেলতে দেখি, যা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে লুপ্তপ্রায় এবং অপ্রাসঙ্গিক।তবে

 
 
 

Stranger Things মুক্তি পাবার পর এই খেলার জনপ্রিয়তা আবার কিছুটা ফিরে এসেছে। 80s এর জনপ্রিয় রক

 

ব্যান্ড ‘The Clash’ এর ‘Should I Stay or Should I go’ হয়ে ওঠে Will byers এর প্রিয় গান।” If I go,there

 

will be trouble/And if I stay it will be double”, এটা যেন Will-এর নিজের জীবনবস্থারই irony। এই এছাড়াও

 

বিভিন্ন পুরোনো রক ব্যান্ড যেমন ‘The Who’ , ‘The Police’ , ‘Foreigner’ , ‘REO SPEEDWAGON’,

 

Madonna বা Don Mclean এর বিভিন্ন গান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গোটা সিরিজ জুড়ে। কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে সে

 

সময়ে বাজার দাপাচ্ছে স্টিফেন কিং এবং ষাটের দশকে হলিউডে Sci-fi সিনেমার যে চল শুরু হয়েছিল, তার রমরমা

 

আশিতেও।স্টিফেন কিং এর লেখা এবং এ দশকের সিনেমাগুলো স্রষ্টার মনে বেশ প্রভাব ফেলেছিল স্ট্রেনজার

 

থিংস এর গল্প ফাঁদবার সময়।বিভিন্ন সিকুএন্স ও সিনেই এসব গল্প ও ছায়াছবিকে ট্রিবিউট জানিয়েছেন

 

পরিচালক।Firestarter গল্পের Charlie Mcgee চরিত্র এবং Stranger things এর ইলেভেনের মধ্যে প্রচুর মিল

 

খুঁজে পাওয়া যায় এবং এ মিলের কথা উল্লেখ ও করা হয় সিরিজে। Terry Ives এর বোন ইলেভেনের সুপারপাওয়ার

 

বোঝাতে বলে , ‘Read any Stephen King ?’ তাছাড়া, Alternate Dimension এর যে ধারণা প্রতি সিজনে ফিরে

 

ফিরে আসে, সেই ভাবনা পরিলক্ষিত হয় স্টিফেন কিং এর বহু গল্পে।

 
 
 
 

হ্যালোইন পার্টিতে আমরা Will, Mike, Dustin এবং Lucas কে দেখি ‘Ghostbusters’ সাজে।1984 সালে মুক্তি

 

পাওয়া এ সিনেমার পরে অসংখ্য sequel বেরিয়েছে।Poltergeist এর উল্লেখ , Jaws এর পোস্টার, ET সিনেমার

 

অনুপ্রেরণা ছাড়াও আরো অসংখ্য উদাহরণ এ বিষয়ে দেওয়া যায়।

 

Adam Walsh এর দগদগে স্মৃতির ব্যাড নস্টালজিয়া এবং সাহিত্য-সিনেমা-গান-খেলার গুড নস্টালজিয়াকে বাদ

 

দিলেও এ সিরিজের একটি চমৎকার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও রয়েছে যেটি না বললেই নয়।

 
 
 
 

1945 সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্ম-সমর্পণের পর কোরিয়া দেশটিকে দুভাগে ভাগ করা হয়।নর্থ

 

কোরিয়া তখন সোভিয়েটদের আন্ডারে এবং সাউথকে শাসন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। 1948 সালে নর্থ কোরিয়াতে

 

কমিউনিস্ট গভর্নমেন্ট স্থাপিত হয় এবং সাউথে anti-communist। 1950 থেকে 1953 সালের মধ্যে এই দুই

 

কোরিয়ার মধ্যে বেশ অনেকগুলি ছোট ছোট যুদ্ধ হয়।এ যুদ্ধে নর্থ কোরিয়া সোভিয়েট এবং সাউথ কোরিয়া

 

আমেরিকান সাপোর্ট পায়। মূলত ভাবাদর্শের পার্থক্য এবং পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি হয়ে ওঠার লড়াইয়ে এ

 

দুই দেশ বিভিন্ন ছোট-খাটো পরোক্ষযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং প্রায় গোটা পৃথিবীটাই তখন দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে

 

যায়। এই যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিস্থিতি আরো বেশিমাত্রায় চাড়া দিয়ে ওঠে যখন 1962 সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের

 

উপকূলের কাছে একটি ছোট্ট দ্বীপ Cuba তে Nikita Khruschev পারমাণবিক মিসাইল স্থাপন করে এবং সেটিকে

 

একটি রাশিয়ান বেস এ পরিণত করা হয়।যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিস্থিতি হলেও কখনোই দু দেশের মধ্যে ডিরেক্ট মোকাবিলা

 

হয় না কারণ দুই দেশই জানতো যে তাদের দুজনের কাছে এমন পারমানবিক অস্ত্র রয়েছে যা গোটা পৃথিবীকে এক

 

নিমেষে ধ্বংস করে দিতে পারে। এই ঠান্ডা যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ার এর রেশ চলে আরো তিরিশ বছর এবং এই কোল্ড

 

ওয়ারের পটভূমিতেই তৈরি Stranger Things।

 

গুজব কি সত্যি জানি না, তবে শোনা যায় যে কোরিয়ান যুদ্ধে বন্দি করা আমেরিকানদের কোনো “মস্তিস্ক

 

প্রক্ষালন” ; যন্ত্র বা ওষুধের ব্যবহারে “মগজ ধোলাই” করা হত।

 

এর পাল্টা জবাব দিতে আমেরিকার Central Intelligence Agency (CIA)র অধিকর্তা 1953 সালে Project MK-

 

Ultra করতে অনুমোদন দেয়। বিভিন্ন ড্রাগস এবং ইলেক্ট্র-শক থেরাপির মাধ্যমে কিভাবে মানুষের মনকে

 

নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা আবিষ্কার করাই ছিল এই প্রোজেক্টের অভিপ্রায়।

 

সরকারি কিছু কর্মীকে বাদ দিলে এই গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা প্রায় কেউই জানতো না।এই

 

এক্সপেরিমেন্টের জন্য বহু সাধারণ নিরীহ মানুষকে ব্যবহার করা হয় যাদের এই ড্রাগ ও থেরাপি নেবার ফলে

 

জীবন নষ্ট হয়ে যায়। 1973 সালে যদিও এ প্রোজেক্ট কে বে-আইনি ও নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়,কিন্তু

 

সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ চাপা পড়ে যায় সরকারি টেবিলের নীচে।

 
 
 
 
 
 
 
 

Stranger Things এর শুরুতেই দেখানো Hawkins National Lab এ চোরাগোপ্তা ভাবে CIA এক্সপেরিমেন্ট

 

চলে,হপারের ভাষায় “..to get one step ahead of the Russians”।

 

সিরিজের শুরু থেকেই শাসক বা government কে ধান্দাবাজ ও ডার্ক একটি ফোর্স হিসেবে দেখানো হয়েছে।কখনো

 

সে কিডন্যাপার , কখনো সে মার্ডারার।Alternate Dimension এর এই অজানা প্রাণীটি যেন শুধু একটি প্রতীক

 

মাত্র,বহু ক্ষেত্রেই গল্পের আসল ভিলেইন হলো গভর্নমেন্ট।

 

সিরিজের শুরুতে যে Hawkins কে আমরা দেখি, শেষে গিয়ে যেন সে টাউনের বাহ্যিক রূপই পুরো পাল্টে যায়। যে

 

এলাকার ছেলে মেয়েরা একসময় বাড়িতে একসঙ্গে আড্ডা দিয়ে,বোর্ড গেম খেলে বা সাইকেল চালিয়ে সময় কাটাতো,

 

তুলনামূলকভাবে সরল ছিল যাদের জীবনযাপন, তারাই যেন হঠাৎ খুব বেশি করে বস্তুনির্ভর হয়ে পড়লো।শান্ত-

 

শিষ্ঠ, হইচই-কোলাহল মুক্ত শহর হঠাৎ ছেয়ে গেল বড় বড় হোর্ডিং-এ এবং পুঁজিবাদের নাগপাশ থেকে

 

অপেক্ষাকৃত মুক্ত এ অঞ্চল হয়ে উঠলো ধনতন্ত্রের উদযাপন কেন্দ্র, “The death of Small Town

 

America”।এ পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় পণ্য স্টারকোর্ট মল।ঝা-চকচকে বিভিন্ন ব্রান্ডের আড়ম্বরে বুদ হয়ে

 

থাকা মানুষ ‘Capitalism’ এর জয়গান গাইতে শুরু করে,কুড়ি টাকার পপকর্ন দু’শো টাকায় চিবিয়ে অজানা উল্লাস

 

বোধ করে।এর উদাহরণ হিসেবে এরিকার কথা বলাই যায়।ঠিক যেমন একটি ছোট গ্রামের ছেলে প্রথমবার কংক্রিট

 

ও ঝকমকি আলোর জঙ্গলে এসে বিস্মিত হয়, প্রথমবার স্টারকোর্ট মলে এসে ঠিক সে বিস্ময়ই যেন ধরা দিলো

 

ইলেভেনের চোখেমুখে। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই বেজে উঠলো “Material Girl" গানের কিছু লাইন, ” Cause we are

 

living in a material world

 

And I am a material girl ! “

 

তবে Hawkins এর এই materialistic পরিণতিকে পরোক্ষভাবে খানিক নিন্দাই করা হয়েছে এ সিরিজে।স্টারকোর্ট

 

মলের কারণে বিভিন্ন ছোট ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, মানুষ কাজ হারাচ্ছে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ন্যান্সির

 

মুখে যেমন শুনতে পাই, “… What about Starcourt? How many small businesses have closed since it

 

opened, like five on main at least.Its changing the fabric of our town.”। Murray Bauman একসময়

 

বলে, “…They have been designed to present the illusion of fairness, but it’s all a scam, a trick to put

 

your money in rich man’s pocket. And,that my dear friend, is America !”

 
 
 
 
 
 

তবে এখানেই আবার পরস্পরবিরোধী ভাবে কমিউনিস্টদেরকে “evil” দেখানোর সুচতুর প্রয়াস দেখা যায়।যদিও

 

যুক্তি দেওয়াই যায় যে যেহেতু সিরিজে সব ঘটনাই ঘটছে আমেরিকান চরিত্রদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, তাই তাদের

 

রাইভাল দেশকে “Evil Russians” বলাটা অস্বাভাবিক বা অবাস্তব নয়। তবুও রাশিয়ান হেড এবং তার সৈন্যকে বহু

 

ক্ষেত্রেই মেলো-ড্রামাটিক archetypal ভিলেইন দেখানোর সুপ্ত চেষ্টা রয়েছে এখানে।হয়তো এখানেই লেখকের

 

মূল চালাকি।

 

ভারতবর্ষে নেটফ্লিক্সের দর্শক মূলত শহরের এবং তাদের বেশির ভাগেরই বয়স 16-30 এর মধ্যে।ভারতবর্ষেও

 

Stranger Things বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।আমার মতে তার কয়েকটি কারণ রয়েছে।এক, ভারতবর্ষে সায়েন্স

 

ফিকশন নিয়ে ভালো ছায়াছবির বড়ই অভাব। দুই, এ সিরিজের মূল শিশুচরিত্রদের বিভিন্ন দুর্ধর্ষ কীর্তিকলাপ

 

(যেমন রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে সাইকেল চালানো, অতিলৌকিক প্রাণীদের সঙ্গে যুদ্ধ এডভেঞ্চার)

 

,এ যেন শহুরে-ছেলেপুলেদেরই অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা ও মনের কল্পনা।ঠিক যেমন চাঁদের পাহাড় উপন্যাসটি যেন আসলে

 

বালক মনের এডভেঞ্চার-কল্পনা, তেমনি এই সিরিজ ও যেন শহুরে ছেলেমেয়েদের অতৃপ্ত শৈশবের ঘা’তে বেশ

 

ভালোভাবে বোরোলিন মেরে দেয়।

 

তৃতীয়ত , কল্পবিজ্ঞান-কোল্ডওয়ার-ভয়ানক প্রাণী এ সমস্তকে ছাপিয়ে গিয়ে Stranger Things আদ্যোপান্ত

 

এক অসম্ভব ভালো বন্ধুত্বের গল্প, মা ছেলের ভালোবাসার গল্প, যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার অপরিমেয় শক্তির

 

কাছে যে কোনো অশুভ অতিলৌকিক অজেয় শক্তি ফিকে হয়ে যায়। জিত হয় ভালোবাসার।

অশোক মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য :

 
 
 

অশোক মুখোপাধ্যায়

 
 
 

থিয়েটার ঠিক কীরকম হবে, কত রকম হবে বা কীভাবে হবে এই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক থিয়েটারের জন্মকাল

 

থেকেই চলছে। যেমন বাধা মঞ্চে, প্রসেনিয়াম থিয়েটারের দেয়াল ঘেরা মঞ্চে অভিনয় চলছে তেমনি তার

 

বাইরে খোলা মাঠে, কখনো একটা ছোট্ট ঘরে বা চত্বরে কিংবা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে নানারকম

 

থিয়েটার নানাভাবে চলছে। আমরা দেশে-বিদেশে নানা রকম খোলা মঞ্চ এবং ঘেরা মঞ্চে প্রদর্শনী, অভিনয়

 

দেখার সুযোগ পেয়েছি এবং তাতে ধারণা হয়েছে যে সব রকম ফর্মে থিয়েটার খুবই এফেক্টিভ হতে পারে।

 

সেটা নির্ভর করে যে কী বলা হচ্ছে, কী করা হচ্ছে, কীরকম করে বলা হচ্ছে তার ওপর। আমি আমার

 

নিজের থিয়েটার জীবনের ভাবনায় এইটুকু বুঝতে পেরেছি যে শেষপর্যন্ত থিয়েটারে মঞ্চ, আলো, মেকআপ,

 

আবহসংগীত -এই সবকিছুর সন্নিপাত ঘটে যে ভাষার সৃষ্টি করে সেটাও যেমন খুবই মূল্যবান হয়, তেমনি

 

আবার শুধু এই সবকিছু বাদ দিয়ে -যেমন গ্রোটস্কি তাঁর পোয়া থিয়েটারের ধারণায় বলেছিলেন যে, সমস্ত

 

অলংকার থিয়েটারের গা থেকে খুলে নিলে যেটুকু থিয়েটার পড়ে থাকে, সেই নগ্ন নির্জন থিয়েটারও ভারী

 

চমৎকার হতে পারে। কীভাবে অভিজ্ঞতাটা হবে কেউ বলতে পারে না কিংবা এই পথে গেলেই সিদ্ধি, ওই

 

পথে গেলে সর্বনাশ – এইরকম কেউ বলতে পারে না। তাই সমস্ত গোঁড়ামি বাদ দিয়ে নানা রকম থিয়েটারের

 

চর্চাই হওয়া উচিত যে কোন সুস্থ থিয়েটারি ঐতিহ্যে। সেখানে একটা ভাবনা আমার কাছে খুব অদ্ভুত লাগতো

 

যে, বাদল বাবুর মতো থিয়েটার করলে আর শম্ভু মিত্রের মতো থিয়েটার করা যাবে না কিংবা উৎপল দত্তের

 

মতো থিয়েটার করলে সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাবে তৃতীয় থিয়েটারের পথ – এগুলো সম্পূর্ণ ভুল। স্বয়ং উৎপল

 

দত্ত পথনাটক এবং মঞ্চনাটক দুটোতেই প্রবল ক্ষমতার নিদর্শন রেখে গেছেন সারাজীবন। ফলে সমস্ত রকম

 

গোঁড়ামিমুক্ত মন নিয়ে থিয়েটারকে যে যেভাবে পারে আক্রমণ করুক। থিয়েটারের অন্তর্নিহিত ঐশ্বর্য

 

আবিষ্কারে মগ্ন থাক। তাতেই থিয়েটারের মুক্তি হবে। তর্ক-বিতর্কে খুব একটা কিছু এগোবে না।

থিয়েটার ও বিকল্প স্থানের সন্ধান

কল্লোল ভট্টাচার্য

 
 
 
 
 
 

একটি নির্দিষ্ট সময়ে, একটি নির্দিষ্ট স্থানে, একজন অভিনেতা, একজন দর্শকের সামনে অভিনয়

 

করেন – এটাই থিয়েটার। থিয়েটার-এর জন্য যেমন একজন দর্শক ও একজন অভিনেতার প্রয়োজন

 

ঠিক তেমনি একটি নির্দিষ্ট স্থানের প্রয়োজন। একটি নির্দিষ্ট স্থানে একজন দর্শক এবং একজন

 

অভিনেতার মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে যে আদান-প্রদান চলতে থাকে সেটাকেই বলা হয় থিয়েটার।

 

একটি নির্দিষ্ট স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে একটি থিয়েটার বা একটি নাট্য-প্রযোজনা। স্থান

 

ব্যতিরেকে থিয়েটার করা সম্ভব নয়। স্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি থিয়েটারের জন্য। একটি নাট্য

 

প্রযোজনা কিভাবে গড়ে উঠবে – কেমন হবে প্রযোজনাটি তা নির্ভর করে কোন স্থানে সেটি অভিনীত

 

হবে তার উপর। আমাদের দেশে থিয়েটারে স্থান বলতে প্রথমেই মাথায় আসে প্রেক্ষাগৃহ।

 

প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে যে থিয়েটারটা হয় যেটাকে আমরা প্রসেনিয়াম বা মঞ্চনাটক বলে থাকি সেই

 

থিয়েটারটাকেই মূলস্রোতের থিয়েটার বা একমাত্র বা প্রধান থিয়েটার বলে মনে করা হয়। এর বাইরে

 

রয়েছে অঙ্গন মঞ্চের থিয়েটার, পথনাটক এগুলি। অল্প কিছু নাট্যদল বাদ দিলে বাকি অঙ্গন মঞ্চ বা

 

খোলা মঞ্চের নাট্য প্রযোজনা গুলির ধরন, পদ্ধতি, উপস্থাপনা প্রায় সবকিছুই মঞ্চ নাটকের মতো।

 

স্থানটির পরিবর্তন ছাড়া আলাদা কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ে না। পথনাটককে এখনো পর্যন্ত কোন

 

কিছু খুব সহজে খুব দ্রুত প্রচার করার প্রয়োজনেই ব্যবহার করা হয়। সেখানে থিয়েটারটার থেকে

 

বেশি প্রাধান্য পায় প্রচারের কাজটা। আবার যে সমস্ত নাট্যদল গুলি খুব সচেতনভাবে, গুরুত্ব দিয়ে

 

প্রেক্ষাগৃহের বাইরে খোলা মঞ্চে বা অঙ্গন মঞ্চে নাটক করেন তাঁরা তাদের থিয়েটার থেকে অনেক

 

কিছু কে বর্জন করে কাজ করেন। প্রসেনিয়াম থিয়েটার যেগুলি কে ব্যবহার করে সেগুলিকে বাদ দিয়ে (

 

যেমন আলো, মঞ্চসজ্জা, পোশাক ইত্যাদি ) থিয়েটার করেন। স্বাভাবিকভাবে থিয়েটারের মত একটি

 

মিশ্র শিল্পমাধ্যমে কাজ করতে গেলে যতরকম বিষয়, দিক নিয়ে কাজ করার প্রয়োজন পড়ে তার

 

সুযোগ এখানে থাকেনা। এই থিয়েটার গুলি প্রসেনিয়ামের বাইরে বিকল্প থিয়েটার হিসেবে চিহ্নিত।

 

এখনো পর্যন্ত থিয়েটার সংক্রান্ত চিন্তা-ভাবনা, আলাপ-আলোচনা, ওই মঞ্চনাটককেই ঘিরে

 

আবর্তিত। আমাদের থিয়েটারটা খুব বেশি রকম ভাবে মঞ্চনাটক দ্বারা প্রভাবিত। তাই এখানে

 

থিয়েটার করার কথা ভাবলেই প্রথমেই মাথায় আসে প্রেক্ষাগৃহের কথা। প্রেক্ষাগৃহ না পেলে ঐরকম

 

কিছু একটা – মাচা, অস্থায়ী – প্রেক্ষাগৃহ এই জাতীয় কিছু একটা বানিয়ে নিয়ে থিয়েটার করার কথা

 

ভাবা হয়। নাট্যদল গুলি প্রায়শই অভিযোগ করেন প্রেক্ষাগৃহ পাওয়া বা না পাওয়া নিয়ে। গ্রামাঞ্চলে

 

তো প্রেক্ষাগৃহ বা ঐরকম কোন কিছুই নেই। কিন্তু সেখানেও যাঁরা থিয়েটার করেন তাঁরাও একটা উঁচু

 

স্থানে তিন দিকে ঘিরে সেটা অনেক সময় শাড়ি দিয়ে একটা মঞ্চ মানে ওই প্রেক্ষাগৃহের মত একটা

 

কিছু বানিয়ে থিয়েটার করেন। স্বাভাবিকভাবেই এই থিয়েটার গুলো প্রসেনিয়াম থিয়েটারের অক্ষম

 

অনুকরণ হয়েই থেকে যায়। কখনো কাঙ্খিত মানে পৌঁছায় না। এখন আমরা যদি একবার প্রেক্ষাগৃহ বা

 

প্রসেনিয়াম থিয়েটার ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে ভাবি যে থিয়েটার করার জন্য একটা স্থানের –

 

স্পেসের প্রয়োজন এবং যদি এটা বিশ্বাস করি যে – যেকোনো স্থানে থিয়েটার করা সম্ভব তাহলে

 

আমরা দেখতে পাবো আমাদের চারপাশে রয়েছে কত রকমের, কত ধরনের স্থান। গ্রামাঞ্চলে যেখানে

 

প্রথাগত থিয়েটার চর্চার জন্য কোন পরিকাঠামোই নেই সেখানে আরও বেশি সুযোগ রয়েছে বিভিন্ন

 
 
 
 
 
 

স্থানকে ব্যবহার করে থিয়েটার করার। শুধুমাত্র যেকোন স্থানে থিয়েটার করা সম্ভব তাই নয় যেকোন

 

স্থানে থিয়েটারের সমস্ত দিকগুলি নিয়ে, থিয়েটারের সবকিছুর ব্যবহার করেই থিয়েটার করা সম্ভব।

 

প্রয়োজনে কোনো একটি নাট্য প্রযোজনা জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থান তৈরি কোরে নেওয়া যেতে পারে।

 

কোন একটি প্রাকৃতিক স্থান কে প্রয়োজনমতো গড়ে নেওয়া যেতে পারে। থিয়েটারের সঙ্গে সম্পর্কিত

 

কোন কিছু কে বর্জন না করে একটি সম্পূর্ণ থিয়েটার গড়ে তোলা যেতে পারে। এবং এই থিয়েটারটা

 

কোনভাবেই প্রসেনিয়াম থিয়েটারটার মতো হবে না। প্রসেনিয়াম থিয়েটারের পদ্ধতি, নন্দনতত্ত্ব,

 

প্রয়োগ কৌশল, অভিনয় রীতি কোনো কিছুর সঙ্গে এই থিয়েটার পদ্ধতিটাকে মেলানো যাবে না। নাটক,

 

নির্দেশনা, অভিনয়-রীতি, মঞ্চসজ্জা, আলোক পরিকল্পনা, আবহ সহ সবকিছু নিয়ে এবং অবশ্যই

 

দর্শকাসন নিয়েও এখানে ভাবতে হবে নতুন ভাবে। নানাভাবে ভাবার, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ ও

 

সম্ভাবনা রয়েছে এখানে। এই থিয়েটারটার খুব প্রয়োজন গ্রামাঞ্চলের জন্য। সেখানেই সুযোগ ও

 

সম্ভাবনা বেশি। গ্রামাঞ্চলে কোনভাবেই প্রসেনিয়াম থিয়েটার করা সম্ভব নয়। কিন্তু সেখানে যে

 

ধরনের স্থান গুলি পাওয়া যায় সেগুলি কে ব্যবহার করে যদি আধুনিক থিয়েটার চর্চা করা হয় তাহলে

 

থিয়েটারের একটা নতুন ভাষা তৈরি হতে পারে। তৈরি হতে পারে গ্রামাঞ্চলের একটা নিজস্ব থিয়েটার,

 

নিজস্ব দর্শক।

 

আমাদের দল ‘এবং আমরা’ যেহেতু গ্রামের মধ্যে কাজ করে তাই অন্যান্য থিয়েটারের পাশাপাশি আমরা

 

এখন গ্রামাঞ্চলের থিয়েটারের কথা ভেবে, গ্রামাঞ্চলের দর্শকের কথা ভেবে নানা ধরনের গ্রামীণ

 

স্থানকে ব্যবহার করে আধুনিক থিয়েটার করার কাজ করে চলেছি এবং এই থিয়েটারটা করাতেই আমরা

 

এখন বেশি আগ্রহী। পশ্চিম বর্ধমান জেলার সাতকাহানিয়া গ্রামে ৪ একর জমির উপর আবাদের দল

 

গড়ে তুলেছে ‘তেপান্তরের নাট্য গ্রাম।’ তেপান্তরের মধ্যে থাকা নানা ধরনের স্থানকে বিশেষত নানা

 

ধরনের প্রাকৃতিক স্থানকে ব্যবহার করে, প্রয়োজনে স্থান তৈরি করে নিয়ে, কোন স্থানকে ভেঙে-গরে

 

নিয়ে কীভাবে আধুনিক থিয়েটার গড়ে তোলা যায় সেই কাজটা আমরা গত কয়েক বছর ধরে করে চলেছি।

 

আমাদের এই কাজগুলোর মধ্যে খুব সফল, খুব আলোচিত, প্রশংসিত কাজ হচ্ছে ‘অন্ধযুগ’। ধরমবীর

 

ভারতীর লেখা নাটক ‘অন্ধযুগ’ নিয়ে আমরা এই নাট্য প্রযোজনাটি তৈরি করেছি সম্পূর্ণ নতুনভাবে,

 

স্থান তৈরি করে নিয়ে, তেপান্তর নাট্য গ্রামের মধ্যে। ‘অন্ধযুগ’ নাট্য প্রযোজনাটির জন্য আমরা

 

খোলা আকাশের নিচে একটা ৫০ ফুট লম্বা এবং ২৫ ফুট চওড়া সমতল ভূমিকে ব্যবহার করি। এটা মূল

 

অভিনয় স্থল। মূল অভিনয় স্থলের দুদিকে আরো ৫০ ফুট লম্বা এবং ২৫ ফুট চওড়া স্থানকে ব্যবহার

 

করা হয় প্রযোজনাটির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ গুলি রাখা এবং কলাকুশলীদের প্রস্তুতির জন্য।

 

১০০ ফুট লম্বা অভিনয় স্থলটির দুদিকে দুটি গর্ত কাটা হয়। যে গর্ত দুটিতে কেউ বসলে শুধুমাত্র

 

তার মাথাটা দেখতে পাওয়া যাবে। একদিকে গর্তের পিছনে অনেক বালির বস্তা রাখা হয় যেভাবে

 

মিলিটারিরা বালির বস্তা ব্যবহার করে। অভিনয় স্থলটিকে মোটা কাঠের খুঁটি দিয়ে ঘেরা হয়। খুঁটি গুলো

 

লাল কাপড় দিয়ে মোড়া থাকে। অভিনয় স্থানটির একদিকে রয়েছে আমবাগান। অন্যদিকে বড় বড় গাছ।

 

অভিনয় স্থলটি দেখতে অনেকটা টেনিস কোর্টের মত। অভিনয় স্থলটির দিকে অর্থাৎ লম্বা দিক

 

দুটিতে দর্শকদের বসানো হয়। দর্শকের পিছনে দুদিকে কালো কাপড় দিয়ে দেওয়াল তুলে দেওয়া হয়।

 

যেন দুদিকের দর্শকের দৃষ্টি নির্দিষ্ট স্থানটির মধ্যে আবদ্ধ থাকে। দু’দিকের দর্শকই পরস্পর

 

পরস্পরকে দেখতে পান। তাদের সামনে মধ্যে খানের স্থানটিতে বালির বস্তা, গর্ত দুটি, আমবাগান

 

এবং মূল সমতলভূমি এসব কিছুর মধ্যেই অভিনয় চলতে থাকে। আলো হিসেবে ব্যবহার করা হয় চারটি

 
 
 

হ্যালোজেন। অভিনয় স্থলটির চারকোণে চারটি বাঁশের খুঁটিতে হ্যালোজেন গুলি বাঁধা থাকে। গর্ত দুটির

 

মধ্যে দুটি আলো লুকোনো থাকে। এই দুটি রঙ লাল। যেদিকে বালির বস্তা গুলি থাকে তার উল্টো

 

দিকটায় বাদ্যযন্ত্রীরা বসে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আবহ তৈরি জন্য। প্রযোজনাটিতে বিভিন্ন

 

আধুনিক সরঞ্জাম যেমন হুইলচেয়ার, স্ট্রেচার, ট্রলি, মোটরবাইক, মাইক্রোফোন ইত্যাদি ব্যবহার

 

করা হয়। ল্যান্ড মাইন ফাটানো হয়। গোটা অভিনয় স্থল রক্তে ভেসে যাচ্ছে তা দেখানো হয়। এরকম

 

অনেক ঘটনাই ঘটানো হয় নাট্য প্রযোজনাটিতে। আলো, আবহ, পোশাক বিভিন্ন আধুনিক সরঞ্জামের

 

ব্যবহারে মহাভারত নির্ভর আধুনিক নাট্য উপস্থাপনা এটি। এখানে অভিনয় পদ্ধতি সহ বাকি

 

সবকিছুই এবং দর্শকের দেখা সবটাই ভিন্ন। কোনভাবেই প্রথাগত স্থান নির্ভর নাট্য প্রযোজনা

 

গুলির সঙ্গে মেলে না। দর্শক এবং কলাকুশলী সকলেই এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। এই নাট্য

 

প্রযোজনা টি আমরা কেরালা ত্রিশূড় শহরে International Theatre Festival of Kerala

 

(ITFOK) তে একইভাবে স্থান তৈরি করে নিয়ে করেছি ২০১৭ সালে। এবং একই সঙ্গে অভিজ্ঞতার

 

মুখোমুখি হয়েছি। আজও যখনই আমরা তেপান্তর নাট্য গ্রামে ‘অন্ধযুগ’ এর অভিনয় করি দর্শকের

 

ঢল নামে। প্রথাগত স্থানের বাইরে বেরিয়ে এসে ভিন্ন স্থানের ব্যবহারে আধুনিক থিয়েটার করা যাচ্ছে

 

এবং তার দর্শকের দ্বারা গৃহীত হচ্ছে এখানে এবং বাইরেও। এইভাবে বিভিন্ন স্থানকে ব্যবহার করে

 

প্রয়োজনে একটি নির্দিষ্ট স্থান তৈরি করে নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের আরও একটি নাট্য

 

প্রযোজনা ‘মহাকাব্যের পরে’ আমরা তেপান্তর নাট্য গ্রামে গাছ দিয়ে ঘেরা একটা প্রাকৃতিক স্থানে

 

কয়েকটা মাটির বাড়ি তৈরি করে নিয়ে চারপাশে দর্শক বসিয়ে অভিনয় করি। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে

 

থাকা স্থান গুলিকে শহর বা গ্রাম যেখানেই হোক ব্যবহার করে কিভাবে আধুনিক থিয়েটার করা যায়

 

সেই চর্চাটা এখন আমাদের দেশে অল্প হলেও শুরু হয়েছে। এই চর্চাটা আরো বেশি বেশি হওয়া

 

প্রয়োজন। কারণ এখানেই রয়েছে থিয়েটারের নতুন ভাষা তৈরীর সুযোগ ও সম্ভাবনা। এখানেই রয়েছে

 

থিয়েটারের যুক্তি। দর্শকের মুক্তি।

সাম্পান

থিয়েটারের পক্ষ থেকে অন্য ধারার অভিনয় চর্চার অভিজ্ঞতা শোনালেন

 

মানুষ যখনই কোনো কাজ করে তার পিছনে থাকে এক বা বিভিন্ন ধরণের তাড়না, কিছু ক্ষেত্রে সে তাড়না

 

আবার এক প্রকার অক্ষমতা। অন্তরঙ্গ নাটক তার ব্যতিক্রম নয়। মঞ্চ থেকে দর্শকের সাথে সেতু তৈরী

 

করার যে দুরত্ব, যে অক্ষমতা, সেটা যখনই বোঝা গেলো তখনই শুরু হতে থাকলো সেতু তৈরীর অন্য ভাবনা।

 

আর সেখান থেকেই আসে থার্ড থিয়েটার এবং পরবর্তী কালে অন্তরঙ্গ থিয়েটার।

 

 

 
 
 
 
 
 
 
 

আমরা, সাম্পান গত ৮ বছর ধরে নিরন্তর চেষ্টা চালাচ্ছি কিছু উত্তর খোঁজার – থিয়েটার কি, কেন করছি,

 

কাদের জন্য, কি হবে করে। ২০১৭ অবধি সেই খোঁজ চলছিল মঞ্চ এবং রাস্তায়। বারবার সব প্রশ্নের

 

উত্তরে আবছা হয়ে একটা শব্দ ভেসে উঠছিল – যোগাযোগ, মানুষের সাথে যোগাযোগ। আমাদের অন্তরঙ্গ

 

থিয়েটারের পথ চলা খানিকটা আকস্মিক ভাবেই। নিজেদের কথা দর্শকের কাছে পৌঁছে দিয়ে সেই যোগাযোগ

 

তৈরী আরও দৃঢ় করার তাড়না আর অর্থাভাব এই দুটোই মূলত অন্তরঙ্গ নাটক শুরু করার মূল কারন ছিল।

 

তারপর, কাজ শুরু করতে গিয়ে আমরা আবিষ্কার করতে থাকি অন্তরঙ্গ থিয়েটার এমন এক শক্তিশালী

 

মাধ্যম যেখানে যোগাযোগের সেতু তৈরী হচ্ছে সরাসরি, যেখানে থিয়েটার কর্মী এবং দর্শক দুজনেই একই

 

সমতলে। সেখানে ছুঁয়ে থাকার অনুভূতিটা ভীষণ ভাবে জ্যান্ত, ভীষণ ভাবে সত্যি। দর্শকের নিঃশ্বাসের শব্দ

 

শুনতে পাওয়া, তাদের সাথে একাত্ব হয়ে যাওয়ার এ এক অন্য অনুভূতি। নাটক ‘দেখতে’ আসা মানুষ আর

 

‘করতে’ আসা মানুষ একাকার হয়ে যায়। নাটক চলতে চলতে মনে হয়না পাশে বসা মানুষটি কে আজ ,

 

এইমাত্র প্রথম দেখলাম। যেন বহু বহু রাত এরা একসাথে মহড়া দিয়ে এসেছে এই একই নাটক। বহু বহু

 

দিনের চেনা আর তাই চাইলেও দিতে পারবে না ফাঁকি।

 

২০১৭তে প্রথম অন্তরঙ্গ নাটক ‘আজব দেশে’ উপস্থাপিত হয় পিঙ্কি ঘোষ দস্তিদারের পরিচালনায়। এই

 

নাটকের খানিক আকার আকৃতি পাল্টে আমরা পরবর্তীতে রাস্তাতেও করি। মূলত এক আজব রাজার আজব

 

দেশ আর আজব রীতি নীতি, সেই নিয়ে আধ ঘণ্টার একটি নাটক। আমাদের প্রথম পরীক্ষা নিরীক্ষার

 

ফসল। তারপর সে বছরই শেষের দিকে আমাদের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা; এবার আরও হাত শক্ত করে, আরও

 

পরস্পরের সাথে বেঁধে বেঁধে। পিঙ্কি ঘোষ দস্তিদারের ভাবনা এবং পরিচালনায় ‘ভাঙ্গন’। ভাঙ্গন এক

 

পালানোর গল্প – আদতে গল্প নয়, গল্পের কোলাজ বা হয়ত বলা যায় যন্ত্রণার কোলাজ। দেশ স্বাধীন

 

হওয়ার উৎসবের রাত আর দেশভাগের ভয়াবহতার রাত এই দুইয়ের সমাপতনের ভাষ্য এই নাটক। সেখানে

 

মঞ্চের দুরত্ব নেই, রাস্তার কোলাহল নেই; বন্ধ ঘরের নিবিড় অন্ধকার ‘ভাঙ্গন’ নাটকের অন্যতম

 

চরিত্র হয়ে উঠতে পারে কেবল মাত্র অন্তরঙ্গ স্পেসেই। আমরা যোগাযোগের সেতুতে মানুষের চলাচলের

 

শব্দ শুনতে পাই। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বিগত দেড় বছরের মধ্যে ভাঙ্গনের উপস্থাপনা হয় ২০ বার,

 

কলকাতায়, জেলায়, মফঃস্বলে।

 

আমরা স্বপ্ন দেখছি, আমরা আজও স্বপ্ন দেখছি। মানুষে মানুষে হাত ধরে কাছে আসবে, পাশে বসবে,

 

থিয়েটার চলবে।

দর্শক বোকা নয়

সত্য জিৎ

 
 
 
 
 
 
 
 

কোন শিল্পমাধ্যম শ্রেষ্ঠ- সে তর্কে না গিয়েও প্রত্যক্ষ করা সম্ভব যে নাটকে সব শিল্পেরই সমাহার রয়েছে । নৃত্য, গীত, বাদ্য ও অভিনয়ের সংমিশ্রণে যে দৃশ্যকাব্য তৈরি হয় তাকে ‘পঞ্চম বেদ’ বা ‘নাট্যবেদ’ বলে । নাটকের চর্চা হয় না- পৃথিবীতে এমন দেশ হয়ত খুঁজে পাওয়া অসম্ভব । কঠোর ধর্মীয় বিধিনিষেধের দেশ সৌদি আরব থেকে শুরু করে বরফ ঢাকা আইসল্যান্ড- সবখানেতেই আজকাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত শিল্প মাধ্যম । নাটকের দৃশ্যকাব্যে উঠে আসে সমাজের ছবি । ফুটে ওঠে চারপাশের মানুষের আনন্দ-বেদনা, আশা-আকাক্ষা, প্রতিবাদ-প্রতিভা । নাটক যেভাবে সহজে মানুষকে স্পর্শ করতে পারে, অন্য কোন শিল্প মাধ্যমের পক্ষে তা সম্ভব হয় না । নাটক মানুষকে চিন্তার জগতে প্রবেশ করায়, চিন্তা মানুষকে ভাবতে শেখায়, ভাবনা থেকে উঠে আসে তর্ক বিতর্ক, আর তর্ক বিতর্ক মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায় । মানব জীবনের যে কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেই ‘প্রশ্ন করার অভ্যেস’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । তাই সমস্ত সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে নাট্য চর্চার প্রসার ঘটানো প্রয়োজনীয় । কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় আমরা যারা থিয়েটার করিয়ে মানুষ, তারা খুব দ্রুত নিজেদেরকে বিজ্ঞ মনে করতে শুরু করি এবং নাট্য প্রযোজনা মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টায় মেতে উঠি । সমাজে যে কোন সমস্যার সমাধানের পথ, নাট্য প্রযোজনার মধ্যে দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া আমাদের বাঁহাতের খেল হয়ে যায় । দর্শককুলকে বোকা ভাবার এই খেলা আমাদেরকে ক্রমশ সাধারণ মানুষের ভিড় থেকে দূরে সরিয়ে দিতে শুরু করে । আর তাই হয়তো আমরা বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে হা-হুতাশ করে বলি থিয়েটারের দর্শক কমে যাচ্ছে, প্রশ্ন তুলে দিই থিয়েটার করে কেন কর্পোরেট সেক্টর এর মত টাকা পাবনা ? অথচ নিজেদের অজান্তেই আমরা বেশিরভাগ নাট্যশিল্পীরা সাধারণ কম শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষকে বোকা ভাবার খেলায় মেতে আছি, ব্যক্তিগত জীবনে গ্রুপ থিয়েটার চর্চার ‘মিশন – ভিশন – ভ্যালু’ নিয়ে আমরা বিশেষ ভাবিতও নয় । 

 

 

 

নাটকের মাধ্যমে সমাজ বদল করা যায় না, তবে সমাজকে সচেতন করা যায়, নাটককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। অগোস্ত বোয়াল বলেছেন, থিয়েটার হয়ত বিপ্লব করবে না কিন্তু বিপ্লবের স্টেজ রিহার্সাল করবার ক্ষমতা থিয়েটার রাখে । পাঁচ হাজার বছরের থিয়েটার ইতিহাসে অসংখ্যবার বিপ্লবের স্টেজ রিহার্সাল একদিন সফল ভাবেই জয়ী হয়েছে । থিয়েটার চর্চা কে নিয়ে প্রান্তিক থেকে প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে পৌঁছে যেতে হবে, যারা কোনদিন থিয়েটার দেখেনি থিয়েটার করেনি তাদেরকেই সহযোদ্ধা এবং দর্শক হিসেবে প্রথম গুরুত্ব দিতে হবে । এই প্রান্তিক এলাকার নিপীড়িত শ্রেণীর মানুষদের কাছে পৌঁছে তাদেরকে বোঝাতে হবে আমরা শেখাতে নয় আপনাদের কাছ থেকে শিখতে এসেছি । আপনারাই আমাদের শিক্ষক । তাদের বাস্তব জীবনের যে লড়াই, যে ওঠা-পড়া, যে জীবন দর্শন তা যদি আমরা শিখতে শুরু করি, তবে এই নিপীড়িত শ্রেণীর মানুষরাও আমাদের সঙ্গেই থিয়েটার চর্চায় পা মেলাবে । তৈরি হবে অসংখ্য নতুন দর্শক ও নাট্যকর্মী । যা বর্তমান থিয়েটার চর্চায় ব্যাপকভাবে জোয়ার আনবে । তাই সমস্ত নাট্যকর্মীদের যাপন হোক ‘শেখাতে নয় শিখতে এসেছি’ । কোন এক বিপ্লবের স্টেজ রিহার্সাল এখান থেকেই শুরু হয়, নাট্য হাতিয়ার ধারালো হয়ে ওঠে, পরিবর্তন হয় সমাজ ব্যবস্থার । ৫০০০ বছরের থিয়েটার ইতিহাস কানের কাছে এসে তাই তো বলছে বারবার ।

 

*কৃতজ্ঞতা স্বীকার রামেন্দু মজুমদার ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *