![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2021/10/Cover-789x1024.webp)
ভাণ পত্রিকা
অষ্টম সংখ্যা, প্রথম ই-সংস্করণ, সেপ্টেম্বর ২০২০
সম্পাদক :
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2021/08/b040b0_45afbde0f8f748c79cfbff99eef81d25_mv2-150x150.png)
সম্পাদনা সহযোগী :
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2021/09/b040b0_41e0d80578104054a256d24f4b7c7d28_mv2-150x150.png)
প্রচ্ছদ :
নক্সা পরিকল্পক :
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2021/08/b040b0_c9c583acc1444109b6384cdba4c1af01_mv2-150x150.png)
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2021/08/b040b0_3448b0870d0b4e93aa12a89ad1a65e15_mv2-150x150.png)
অন্যান্য কাজে :
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2021/08/b040b0_e064a731345341f28c345444c4a6506c_mv2-150x150.png)
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2021/08/b040b0_759cdd3dbeee43cf86e3c6b21e760bbe_mv2-150x150.png)
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2021/08/b040b0_c0d63ec0a5ed4b42a7d589770dfa181f_mv2-150x150.png)
ভাণ-এর পক্ষে:
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2021/08/b040b0_154877b2d7a44f1784778829605d879d_mv2-150x150.png)
ও মৌলিকা সাজোয়াল
কর্তৃক
৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬
( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )
৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) [email protected] ( ই – মেল )
Reg. No : S/2L/28241
সূচি
বিষয় বিশেষ
বিকল্প থিয়েটার : নিছক চমক অথবা অঙ্গন বিনির্মাণের অনিবার্যতা
অভিজ্ঞতা শোনালো :
প্রসেনিয়াম মঞ্চের বাইরে রঙ্গের নানা মঞ্চ নিয়ে মন্তব্য করলেন :
চলচ্চিত্র :
২০১৯-এর বাংলা ছায়াছবি :
গান :
‘ এই রঙিন গানের রঙ ’
সম্পাদক বললেন:
দুই হাজার বিশ , অনেকের ব্যাখ্যায় বিষাক্ত একটা বছর। অনেকের কাছে শিক্ষার। কেউ বলছে শিক্ষার বটে, কিন্তু শিখছে কে? শেখার হলে উনিশশো বিশ- ই তো যথেষ্ট ছিল। যা শিখলে, জানলে বুঝলে পৃথিবীর অসুখ সারে, সে শিখতে দিচ্ছেই বা কে ? নিউ নরমাল মানে তো যে স্বাভাবিক পরিমন্ডলে অস্বাভাবিক শাসন শোষণ চলছিল, তাই ফিরে আসা!
মার্চ থেকে ভাণ ও মার খাচ্ছে। কী করবে, কী করবে ভেবে পত্রিকাটিকে ই – ফরম্যাটে বার করা হবে মনস্থ হলো। এবং বাৎসরিক দুটো, বড়জোর তিনটি সংখ্যার ভাণ কে মাসিক প্রকাশেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া গেল। প্রয়োগ কলা বিষয়ক রকমারি লেখা যেমন ছিল, তেমন থাকবে। যদিও তার বিস্তার কিছু বেশি হবে বলে আশা করা যায়। প্রতি ইংরেজি মাসের এক তারিখে এটি আপনাদের কাছে পৌঁছে যাবে। আপাতত বিনি পয়সায় এমনটিও সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে শুভানুধ্যায়ীদের থেকে সাহায্য চাওয়া হবে, প্রয়োজনীয় খরচ সামাল দিতে।।আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা এই, ই- ভাণের নির্বাচিত রচনা নিয়ে বৎসরান্তে একটি ছাপা সংকলন প্রকাশিত হবে।
এই সংখ্যায় অভিনয়ের নানা মঞ্চ নিয়ে জুলফিকার জিন্নার একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা রইলো। মুক্ত ও অন্তরঙ্গ মঞ্চ নিয়ে নিজের কাজের অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন প্রশান্ত ও প্রিয়া। প্রসেনিয়ামের বাইরের নাট্য চর্চা নিয়ে সুচিন্তিত মন্তব্য করলেন একালের এক প্রধান নাটককার উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় এবং সু- অভিনেতা, তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনাময় নির্দেশক কৌশিক কর । ২০১৯, চলচ্চিত্রের কেন উল্লেখযোগ্য বছর নয়, জানালেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সমালোচক অনিরুদ্ধ ধর। বাংলা গানের রঙিন এক জগত নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রস্তুত করলেন অধ্যাপক গবেষক অভিষেক ঘোষাল।এই নিয়ে প্রথম ‘ই’ ।
অনেকে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। ভাণ ও কাজে ফিরলো। আশঙ্কা থাকলো কিছু। সে থাক , পালিয়ে কি বাঁচা যায়?
বিকল্প থিয়েটার
নিছক চমক অথবা অঙ্গন বিনির্মাণের অনিবার্যতা
– জুলফিকার জিন্না
থিয়েটার অপ্রতিরোধ্য স্রোতস্বিনীর মতো এক তট থেকে অন্য তটে সুদূরাভিসারে নিরন্তর রেখেছে তার প্রবহমানতা। মূলগতভাবে থিয়েটার একটি অভিনব, অনবদ্য গতিশীল শিল্প। গতিবিজ্ঞান অধ্যয়ন করলে বোঝা যায় যে কোনো গতির পিছনে কাজ করে দ্বন্দ্বসূত্রের তিনটি নিয়ম। প্রথম নিয়মটি হল, পরিমাণগত পরিবর্তনই গুণগত পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে (quantitative change leads to qualitative change)। উদ্ভবের সেই প্রথম লগ্ন থেকেই থিয়েটারের ক্ষেত্রভূমিতে ছোটো ছোটো অজস্র পরিমাণগত পরিবর্তনই গুণগতভাবে পৃথক করেছে গ্রিক ডিথিরাম্ব থেকে অধুনা থিয়েটার চর্চাকে। প্রতি মুহূর্তের বিকল্পের অনুসন্ধানই এই পরিমাণগত পরিবর্তনের ধারাকে রেখেছে অব্যাহত। গতিশীলতার দ্বিতীয় নিয়মটা হল, ‘নেতির নেতিকরণ’ (negation of negation) অর্থাৎ পুরোনোকে নাকচ করে যে নতুনের জন্ম হয় তার মধ্যেও নাকচ হওয়ার শর্ত থাকে। এই নাকচের ক্রমধারাবাহিকতারই আর এক নাম অগ্রগতি। থিয়েটারের ইতিহাস দেখিয়েছে যে পূর্বতন সংস্কার, প্রথা, রীতি, বিশ্বাস, অনুশীলন, চর্চা এবং ধ্যানধারণাকে নাকচ করতে করতেই থিয়েটার অর্জন করেছে নতুন রীতি, নতুন আঙ্গিক, নতুন অনুশীলন, নতুন উপস্থাপনা। এই ‘নতুন’ সৃজিত হয়েছে আবার নিজেই নাকচ হওয়ার সত্যকে মান্যতা দিয়েই। গতিবিজ্ঞানের তৃতীয় সূত্রটি দার্শনিক হেগেলের প্রজ্ঞানির্দেশিত একটি বিশেষ প্রণিধান। তিনি বলেছিলেন প্রত্যেক নবনির্মাণের পিছনে থাকে ‘বিপরীতের ঐক্য’ (unity of opposite)। অর্থাৎ আগত ও বিগত, নতুন ও পুরাতনের দ্বন্দ্বের মধ্যে আসলে একটা ঐক্য থাকে। মোট কথা, গতিবিজ্ঞানের এই ত্রিবিধ সূত্রের সমস্তটাই প্রযুক্ত হয়েছে থিয়েটারের বিবর্তনের ইতিহাসে। এক অনবদ্য গতিশীল শিল্প হিসেবে থিয়েটার প্রতি মুহূর্তে বিকল্পের অনুসন্ধান করে থাকে, নইলে তার গতি শুধু স্তিমিত নয়, রুদ্ধ হয়ে পড়তে বাধ্য। থিয়েটারের এই গতির মধ্যেই থাকে প্রতি মুহূর্তে পরিমাণগত পরিবর্তনকে আত্মস্থ করার প্রবণতা, পূর্বতন প্রথাকে নাকচ করার প্রবণতা, আর অজস্র বৈপরীত্যের মধ্যে সংশ্লেষণ ঘটানোর প্রবণতা।
![julfikar jinna.jpg](https://static.wixstatic.com/media/3e4e48_e2c0400cde9944fe81ce589005c9605b~mv2.jpg/v1/fill/w_221,h_300,al_c,q_80,usm_0.66_1.00_0.01/julfikar%20jinna.webp)
মঞ্চ থেকে মঞ্চ– পরিমাণগত পরিবর্তন
বর্তমানে আমরা ‘থিয়েটার হল’ বলতে যে-প্রসেনিয়ম মঞ্চকে বুঝি তার স্থাপত্য ও পরিকাঠামো আদিতে ঠিক এইরকমের ছিল না। থিয়েটারের সূচনা প্রাচীন গ্রিসে হলেও প্রসেনিয়ম মঞ্চের উদ্ভব ও বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছিল ইতালির রেঁনেসার পরবর্তী সময় থেকে। ইতালির নবজাগরণের ফলে উদ্ভূত নব্য অভিজাত শ্রেণির মনোরঞ্জনের তাগিদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবেই মঞ্চস্থাপত্যের বিকাশ ঘটেছে। অভিজাতদের প্রমোদালয় হিসেবে চতুর্বর্গীয় প্রসেনিয়মের সৃজন হয়েছিল বলেই শুরু থেকেই তা ছিল দর্শক-শ্রোতাদের প্রতি দায়বদ্ধতাশূন্য এলিট আয়োজন। ক্লাসিক স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থলেখক বিট্রুভিয়াসের ‘De Architectura’ গ্রন্থের তথ্য অনুসারে ইতালির প্রথম স্থায়ী প্রসেনিয়ম মঞ্চ ‘Teatro Olimpico’
![Teatro_Olimpico_pianta_Bertotti_Scamozzi](https://static.wixstatic.com/media/3e4e48_725c380604d8430a96ba58706a1f067b~mv2.jpg/v1/fill/w_355,h_245,al_c,q_80,usm_0.66_1.00_0.01/Teatro_Olimpico_pianta_Bertotti_Scamozzi.webp)
নির্মিত হয় ভিসেনঞ্জা নগরীতে। ইতালির এই ‘অলিম্পিকো’ রঙ্গালয়ের আকৃতি ছিল অর্ধ ডিম্বাকৃতি। ফলে সমস্ত দর্শকের পক্ষে অনুষ্ঠানকে সমমাত্রায় উপভোগ করা অসুবিধা হয়ে পড়েছিল। পরবর্তী সময়ে পরিমাণগতভাবে বিপুল সংস্কারের পথ বেয়েই প্রসেনিয়ম মঞ্চ বর্তমান পরিকাঠামোতে রূপান্তরিত হয়েছে। একটি বিষয় আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে পৃথিবীর সর্বত্রই অভিজাত সংস্কৃতির পাশাপাশি লোকজাত সংস্কৃতির অনাবিল ধারাটি সেই আদিম যুগ থেকেই নিরন্তর প্রবহমান আছে। রেঁনেসাঋদ্ধ ইতালিতে যখন ক্লাসিক রীতির অনুসরণে একের পর এক বিশালাকার থিয়েটার-স্থাপত্য গড়ে উঠতে শুরু করল তখন ঠিক সেই সময়ে এরই পাশাপাশি অনাড়ম্বর অথচ জনপ্রিয় নাট্য-উপস্থাপনা রীতিরও প্রকাশ ঘটতে থাকে। এই থিয়েটার রীতিকে বলা হয় ‘কমেদিয়া ডেল আর্তে’। এই লোকরীতির নাট্যোপস্থাপনার কোনো নির্দিষ্ট স্পেস ছিল না। ‘কমেদিয়া ডেল আর্তে’র নাট্যদলগুলি ছিল পরিভ্রমণকারী নাট্যদল। নানা দেশের নানা স্থানে পরিভ্রমণ করে সুবিধাজনক যেকোনো স্থানে এরা অভিনয় করত। কখনো রাস্তায়, কখনো বাজার-প্রাঙ্গণে, কখনো সরাইখানার প্রাঙ্গণে এদের সহজ উপস্থাপনাগুলিতে সাধারণ মানুষেরা দর্শক
হিসেবে ভিড় জমাত। এদের অভিনয় স্পেসের গঠন ছিল ভীষণ সরল। অতি সাধারণ একটি বর্গাকার প্ল্যাটফর্মই ছিল এদের অভিনয় স্পেস। প্লাটফর্মের একদিকে বা কখনো দুইদিকে দুটি সিঁড়ি লাগানো হত। তবে ‘কমেদিয়া ডেল আর্তে’র দৃশ্যরীতি সম্পর্কে এ-কথা বলতেই হবে যে ইতালিতে প্রসেনিয়াম মঞ্চের ক্লাসিক প্রযোজনার বিবর্তনের সাথে সাথে এদের দৃশ্যরীতিরও বিবর্তন ঘটেছিল। সূচনাপর্বে শুধু প্লাটফর্ম ব্যবহৃত হলেও পরের দিকে প্লাটফর্মের দুই পার্শ্বে কাপড়ের উইং দিয়ে ঢেকে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। মোটামুটি জানা যায়, নাটকে পার্শ্ব-আচ্ছাদনকারী এই উইং-এর ব্যবহার শুরু হয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে। এইভাবে পথের প্রান্তের নাটকের উপরেও মঞ্চস্থাপত্যের প্রভাব পড়েছিল। আজও আমাদের লোকালয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্লাবে বা স্কুলে নাটক করার সময় কাঁধে করে তক্তা এনে যে প্লাটফর্ম বানানো হয় তার তিনদিক ঢেকে দিয়ে পার্শ্ব-আচ্ছাদনকারী উইংস দেওয়া হয়। মাঠে-ময়দানে এই নাটক হলেও আসলে এখানে প্রসেনিয়ামের দৃষ্টিকোণ থেকেই অভিনয়রীতি অনুশীলিত হয়। ঠিক এই কারণেই প্রসেনিয়ামরীতির ক্রমবিবর্তনের পথে কখনো একটি অন্যটির ‘বিকল্প’ হয়ে উঠতে পারেনি। আমাদের মনে রাখতে হবে ‘পরিবর্তন’ মাত্রেই ‘বিকল্প’ নয়। প্রসেনিয়ম ধারার মধ্যেও প্রতি মুহূর্তে যেমন পরিমাণগত পরিবর্তনের নিরীক্ষা চলছে, ঠিক তেমনি নন-প্রসেনিয়মের মধ্যেও প্রতিনিয়ত পরিমাণগত পরিবর্তনের সন্ধান চলছে। কিন্তু এই পরিমাণগত পরিবর্তনটি যতক্ষণ না গুণগতভাবে পৃথক হয়ে স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করছে ততক্ষণ তাকে ‘বিকল্প’ বলা যাবে না।
আমাদের দেশে ইংরেজদের হাত ধরে প্রসেনিয়াম ধারার বিবর্তনের অন্তিম উৎকর্ষের দ্যুতি এসে পৌঁছেছিল। নাটকে সেট-ডিজাইনে বহুমাত্রিকতা সঞ্চারের কিছু অভিনব প্রয়োগ বৃটিশেরা দেখিয়েছিল। গ্রিস, রোম বা এলিজাবেথীয় যুগে ক্লাসিক্যাল নাট্যধারায় ‘প্রথাগত’(Conventional) দৃশ্যের কোনো আড়ম্বর ছিল না। তবে সেক্ষেত্রে নাট্যোপস্থাপনায় কোনো বাধার সৃষ্টি হয়নি। শিল্পীর তুলিতে আঁকা পশ্চাদপটের সামনে অভিনেতারা অভিনয় করতেন। প্রথমদিকে নাট্যকার শেক্সপিয়রের নাটকও এই জাতীয় প্রসেনিয়ামে অভিনীত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে অভিনয় অংশের সম্মুখভাগ ছাড়া সবটাই কালো পর্দায় ঢেকে দেওয়ার রীতি অনুসৃত হয়েছিল। মঞ্চের এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘স্পেস স্টেজ’। এই প্রক্রিয়ায় কালো রঙের পর্দায় মঞ্চকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলা হয়। এর ফলে মঞ্চে নিঃসীম গভীরতার (Depth) দ্যোতনা হয়। বিশিষ্ট মঞ্চবিদ অ্যাডলফ অ্যাপিয়া তাঁর মঞ্চ-প্রয়োগরীতি দিয়ে পাশ্চাত্য থিয়েটারের প্রসেনিয়াম ধারাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। অ্যাপিয়া নাটকের দৃশ্যকে শুধুমাত্র পরিবেশ সৃষ্টি বা মায়া-সৃষ্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি দৃশ্যকে নাট্যের অঙ্গীভূত করে অভিনেতা ও অভিনয়-অনুষঙ্গকে ঐকতানে বাঁধতে চেয়েছিলেন। এই ‘ঐকতান’ সৃষ্টির প্রয়োজনে তাঁর দৃশ্য পরিকল্পনার মূল তত্ত্ব ছিল ‘ত্রিমাত্রিকতা’ (Three Dimensional)। ত্রিমাত্রিক অভিনেতৃবর্গ যে-পারিপার্শ্বিকের মধ্যে অভিনয় করবেন তা ‘দ্বিমাত্রিক’ (Two Dimension) হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। এই কারণেই অ্যাপিয়ার দৃশ্য পরিকল্পনায় প্রধান হয়ে উঠেছে মঞ্চ-স্তর-বিন্যাস। অঙ্কিত বা চিত্রিত দৃশ্যপটের তিনি ছিলেন বিরোধী। তিনি চরিত্র ঘটনা ও দৃশ্যসজ্জার মধ্যে গতি সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন। প্রতিটি দৃশ্যের রূপান্তরে সেট-ডিজাইনের পরিবর্তনে নাটক হয়ে উঠবে আকর্ষণীয়, জীবন্ত ও বৈচিত্র্যময়। অ্যাপিয়ার ভাবনার আধুনিকতম সংস্কারের যুগে আমরা বাস করছি। চমকের পর চমক সৃষ্টির প্রাণান্তকর প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে প্রসেনিয়াম মঞ্চে। এই সমস্ত চমক থেকে গুণগতভাবে আলাদা মানবসভ্যতার আদিমকৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে আগত লোকনাট্যরীতির ধারা।
নাট্যশিল্পের আদিম প্রয়াসের যে-বর্ণনা আমরা পাই সেখানে পাহাড়ের পাদদেশে বা উন্মুক্ত প্রান্তরে প্রকৃতির সহজ ছন্দেই তৈরি হতো নাট্যাঙ্গন। আদিম মানুষের শিকার নৃত্য, জাদু নৃত্য বা যাবতীয় কৃত্যের (Rituals) মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠছিল নাট্যের বীজ। আহারাদি ও বসবাসের ব্যবস্থার পর পরই আদিম মানুষ অবকাশ মুহূর্তে মেতে উঠতো আনন্দ উৎসবে। সহজ যাপনের যাবতীয় আবেগ স্বকীয় অভিব্যক্তিতে ফুটিয়ে তুলত। গুহাবাসী সঙ্গীদলই ছিল তাদের দর্শক। তারা দাঁড়িয়ে যেত চারপাশে, বৃত্তাকারে। স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হত বৃত্তাকার অভিনয় ক্ষেত্র (Acting area)। আদিম বা প্রাথমিক নাট্য প্রয়াসের এই অভিনয় ক্ষেত্রকে বলা হয় আদিম অ্যারেনা (Primitive Arena)। মূলত বহিরঙ্গনের সূতিকাগার থেকেই থিয়েটারের জন্ম।
মঞ্চায়ন থেকে বিমঞ্চায়ন– গুণগত পরিবর্তন
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, থিয়েটারের বিকাশের ইতিহাসে নন-প্রসেনিয়ম ধারা গুণগতভাবে নিজের স্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করেছে। অর্থনৈতিক সমস্যা অথবা প্রেক্ষাগৃহ পাওয়ার অপ্রতুলতার কারণ থেকে নন-প্রসেনিয়ম ধারা জন্ম নেয়নি। আমাদের দেশে বাদল সরকারের নাটকগুলি যখন প্রসেনিয়ম মঞ্চে দারুণভাবে সফল তখন তিনি প্রসেনিয়ম ছেড়েছেন। পৃথিবী জুড়ে নন-প্রসেনিয়ম চর্চা ছিল আসলে মতাদর্শগত সংগ্রাম। স্তানিস্লাভস্কির নাম আমরা হয়তো অনেকেই শুনেছি, কিন্তু অনেকেই শুনিনি ইউজিন ভক্তানগভের নাম, যিনি একই সময় একই স্থানে নাটক নিয়ে অভিনব কাজ করেছিলেন।
![মায়ারহোল্ড](https://static.wixstatic.com/media/3e4e48_7a053677b97541d5a145c6ed7a5e7764~mv2.png/v1/fill/w_305,h_305,fp_0.48_0.3,q_75/3e4e48_7a053677b97541d5a145c6ed7a5e7764~mv2.png)
![স্তানিস্লাভস্কি.](https://static.wixstatic.com/media/3e4e48_bd14565abc614d41a3e63d8e3a36445f~mv2.png/v1/fill/w_306,h_305,fp_0.51_0.23,q_75/3e4e48_bd14565abc614d41a3e63d8e3a36445f~mv2.png)
Out of gallery
স্তানিস্লাভস্কির পাশাপাশি তিনিও নিরীক্ষা করেছিলেন অভিনব নাট্যরীতির। বলা বাহুল্য, প্রসেনিয়ম ধারার প্রতি ঐতিহ্যানুরাগের কঠোরতায় কেউ ফিরেও তাকায়নি ভক্তানগভের প্রয়াসের দিকে। ভক্তানগভের প্রথম প্রযোজনা ওপেন-এয়ার এরেনায় অভিনীত হয়।, যেভাবে কনস্তানতিন তেপলভ শেকভের ‘শীগাল’ করেছিলেন, ঠিক সেইভাবেই খোলা আকাশের নীচেই ভক্তানগভ তাঁর প্রথম প্রযোজনাটি উপস্থাপিত করেছিলেন। তখন ভক্তানগভের বয়স উনিশ বছর। প্রসেনিয়াম মঞ্চের গুরু স্তানিস্লাভস্কি, মায়ারহোল্ড প্রমুখকে দেখেও তাঁদের পথে হাঁটতে চাননি তিনি। কিশোর ভক্তানগভের চ্যালেঞ্জকে স্যালুট না করলে ইতিহাসের অমর্যাদা হবে। তাঁর কাছে থিয়েটারের ইতিহাস পেল ফ্যানটাস্টিক রিয়েলিজমের ধারণার বীজ। প্রায় পরস্পরবিরোধী স্তানিস্লাভস্কির রিয়েলিস্টিক আর মায়ারহোল্ডের থিয়েট্রিক্যাল অভিনয়রীতির অদ্ভুত মিথষ্ক্রিয়া ঘটিয়েছিলেন ভক্তানগভ। তাঁর থিয়েটার পদ্ধতিতে যে-রীতির প্রবর্তন করেছিলেন ভক্তানগভ তাতে ব্রেখট-সহ বিশ্বের খ্যাতিমান নাট্যব্যক্তিত্বরা স্তানিস্লাভস্কির রিয়েলিজম ও মায়ারহোল্ডের থিয়েট্রিক্যালিজমের চূড়ান্ত ও উৎকৃষ্ট সিনথিসিস হিসেবে মান্যতা দিয়েছেন। পরবর্তীতে বিশ্বের অনেক দেশেই নাট্যসৃজকেরা ভক্তানগভের এই সিনথিসিসের পথ ধরেই বিকল্পের পথযাত্রী হয়েছিলেন। বলা যায়, ভক্তানগভের ‘পয়েন্ট অব ডিপার্চার’কেই গুণগত বিকল্পের মাইলফলক ধরে নিয়েই যুগ পরিক্রমায় বার্টোল্ড ব্রেখট, জর্জিও গ্রুটস্কি, পিটার ব্রুক, ইউজিনিও বার্বা সকলেই তাঁদের থিয়েটার রসায়নাগারে নতুন সংশ্লেষণে গেছেন।
![ভক্তানগভ.png](https://static.wixstatic.com/media/3e4e48_e1b69547953d4987b975e3e9ef7dacaa~mv2.png/v1/fill/w_211,h_211,al_c,q_85,usm_0.66_1.00_0.01/%E0%A6%AD%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%97%E0%A6%AD.webp)
ইউজিন ভক্তানগভ থিয়েটারে সেট নির্মাণের দিকে তেমন নজর দিতেন না, গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত সাধারণ জিনিসপত্র দিয়েই তিনি এমন অভিনব দৃশ্যসজ্জা করতেন তা প্রচলিত থিয়েটার প্রকরণে ছিল এক প্রচণ্ড প্রত্যাঘাত। তাঁর অন্যতম সেরা প্রযোজনা ‘প্রিন্সেস টুরানডট’ থিয়েটারের বিকল্প প্রকরণের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি দর্শকের সামনেই অভিনয়শিল্পীদের সাজপোশাক পড়াতেন, যেন দর্শক বুঝতে পারেন একজন অভিনয়শিল্পী কীভাবে একটি চরিত্রে রূপান্তরিত হচ্ছে। প্রিন্সেস টুরানডটের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অভিনয় দেখে স্তানিস্লাভস্কি নতুন ধারার সৃজনকে শুধু মান্যতাই দেননি, নিজেকেও নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন। স্তানিস্লাভস্কি ছিলেন প্রসেনিয়ম ধারার কিংবদন্তী সৃজক, কিন্তু সেদিন তিনি বহিরঙ্গনের নিরীক্ষাকে নিছক চমক বলে উড়িয়ে দেননি।
ইতালিয়ান নাট্যকার কার্লো গজির মতে ভক্তানগভের ফ্যানটাস্টিক রিয়েলিজম ছিল আসলে প্রথম যুদ্ধোত্তরকালীন চিত্রকলার রিয়েলিজম ও ন্যাচারেলিজমের যৌগিক সংশ্লেষণ। সমগ্র বিশ্বের সচেতন নাগরিকদের কাছে ১৯১৪-র প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। সার্বিক ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতিতে যেমন মননের জগতকে গ্রাস করল হতাশা, অবসাদ, বিষন্নতা, বিমর্ষতা, ক্লান্তি, মৃত্যুমুখীনতা, ক্ষয়িষ্ণুতা ঠিক তেমনি তিন বছরের ব্যবধানে রাশিয়ায় বলশেভিক রেভ্যুলুশনে উৎসারিত হল নবোজ্জীবনের প্রণোদনা, উৎসাহ, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, সঞ্জীবন। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে শিল্পী-সাহিত্যিকেরা তাঁদের সৃজনকর্মের অভিমুখ ঠিক করে ফেলতে বিলম্ব করেননি। ভয়াবহ রক্তাক্ত পরিস্থিতিতে থিয়েটারচর্চা আর প্রসেনিয়মনির্ভর, প্রযুক্তিনির্ভর থাকতে চায়নি। বিকল্পধারার উৎসমুখ খুলে দিয়ে বার্টল্ড ব্রেখট চলে আসেন নাৎসি বাহিনীর বেয়নেটের নিশানায়।
![বার্টল্ড-ব্রেখট.png](https://static.wixstatic.com/media/3e4e48_d340a74b12e64a4da4fe78624018a07e~mv2.png/v1/fill/w_269,h_268,al_c,q_85,usm_0.66_1.00_0.01/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%A1-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%96%E0%A6%9F.webp)
হিটলারের শিকার তালিকায় পাঁচ নম্বরে নাম ছিল বার্টল্ড ব্রেখটের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক নাট্যজগতে ব্রেখট সর্বাপেক্ষা প্রভাব সৃষ্টিকারী নাট্যকার ও তাত্ত্বিকরূপে পরিগণিত হয়েছেন। তিনি নাট্যজীবনের শুরুতে এক্সপ্রেশনিজমের কাছে ঋণী, কিন্তু ১৯২২-এর পর থেকেই তিনি এক্সপ্রেশনিজমের প্রভাব মুক্ত হতে সচেষ্ট হন এবং নিজস্ব ধারা ও তত্ত্ব নির্মাণের উপযোগী থিয়েটার নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী আরও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। অবক্ষয়িত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র আর সংঘটিত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আয়োজন করতে না পারলেও পৃথিবীকে নিয়ে গেছে এক স্থায়ী যুদ্ধপরিস্থিতির দিকে। পৃথিবীর পাড়ায় পাড়ায় প্রায় প্রতিটি নাগরিকই মৃত্যু-হত্যা-প্রতিহত্যা-সন্ত্রাস-প্রতিসন্ত্রাসের ভয়াবহ রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিনযাপন করছে। এই পরিস্থিতিতে দায়বদ্ধ নাট্য আন্দোলনের ধারা কোনো-না-কোনোভাবে ব্রেখটীয় বিকল্প ভাবনাকেই আরও পরিশীলিত ও শাণিত করতে চেয়েছে। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে যখন সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয় তখন পশ্চিমা দেশগুলোর নাগরিকদের মধ্যে জমাট হতে থাকে নানা অসন্তোষ। তারা হয়ে ওঠে প্রতিবাদী, ফেটে পড়ে বিক্ষোভে। গড়ে ওঠে বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন। এমতাবস্থায় এসব আন্দোলনের গর্ভ থেকেই জন্ম নিয়েছিল বিশেষ থিয়েটার ভাবনা– পুওর থিয়েটার, থিয়েটার অব দ্য অপ্রেসড, লেজিসলেটিভ থিয়েটার, ম্যাস থিয়েটার, গ্রাউন্ড থিয়েটার, থার্ড থিয়েটার, ফোরাম থিয়েটার, রেড রেভ্যু থিয়েটার, রেভল্যুশনারি থিয়েটার প্রভৃতি। পুরো বিষয়টাই আবর্তিত হয়েছে নাট্যসৃজকের রাজনৈতিক দর্শনের উপর। তাই বলা যায়, নন-প্রসেনিয়াম ধারা কোনো গিমিক বা চমক থেকে জন্ম নেয়নি, এটা মতাদর্শগত সংগ্রামের ফসল থেকেই উঠে এসেছে। থিয়েটার নিশ্চিতভাবেই সামাজিক যাপনবাস্তবতায় অভিনিবিষ্ট এক সৃজনশিল্প। কালান্তরের পাঠপরিচয়ের ক্ষেত্রে বলা যায়, অধুনা রাষ্ট্রলালিত মানবাত্মার বিপর্যস্ত হৃদয়ার্তির পুনর্দশর্নের দিব্যমাধ্যম হলো থিয়েটার। অনেকেই থিয়েটারের এই পুনর্দশর্নের আকাঙ্ক্ষালালিত বিকল্পের অনুধ্যানকে নিছক ‘চমক’ বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।
এই প্রসঙ্গে আমার অভিমত ব্যক্ত করার জন্য এক নাট্যসুজন খুঁজে পেতে প্রখ্যাত মঞ্চস্থপতি খালেদ চৌধুরী মহাশয়ের একটা লেখা উদ্ধৃত করে ফেসবুকে পোস্ট করে জানালেন যে তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘…বহিরঙ্গের অভিনবত্ব দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অনেকের মধ্যেই একটা ব্যতিক্রম সৃষ্টির চেষ্টা দেখছি। নাটকের ক্ষেত্রে প্রসেনিয়ম স্টেজ ভীষণ পুরোনো হয়ে গেছে, অতএব থার্ড, ফোর্থ, ফিফথ থিয়েটার আমদানি করে নতুন কিছু করতে হবে! অথচ ছবি আঁকার জন্য একটা চারকোণা ফ্রেম সেই কোন যুগ থেকে আজ পর্যন্ত পুরোনো হল না। ওই সীমাবদ্ধ ফ্রেমে অসীমের ভাবনা প্রকাশ করতে গিয়ে যুগে যুগে কতই না নতুন ভাবনাচিন্তা, কত নতুন শিল্প আন্দোলনের ঢেউ উঠেছে, পড়েছে। ফ্রেম কিন্তু চারকোণাই আছে, ছবির ছবিত্ব বাড়াতে কেউ তাকে দশকোণা করার কথা ভাবেননি। এখনকার থিয়েটারের নিত্যনতুন ফর্ম আবিষ্কারের পিছনে রয়েছে নিছক বৈচিত্র্যের জন্য
![খালেদ-চৌধুরী.png](https://static.wixstatic.com/media/3e4e48_e0f1d113c4174bac9efdee55b88bf721~mv2.png/v1/fill/w_203,h_203,al_c,q_85,usm_0.66_1.00_0.01/%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%A6-%E0%A6%9A%E0%A7%8C%E0%A6%A7%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%80.webp)
কিছু করার প্রয়াস, জীবনের মর্মমূল থেকে তা স্বতোৎসারিত নয়’ (নাট্যায়ণ আয়োজিত আলোচনাচক্রে প্রদত্ত ভাষণ, ১৯৮৭)। শ্রীযুক্ত খালেদ চৌধুরী মহাশয় আমার প্রণম্য ব্যক্তিত্ব এবং তিনি কিংবদন্তীপ্রতিম নাটমঞ্চের শিল্পরূপকার। এই ভাষণের বাকি অংশ আমার অজ্ঞাত। তবে আমি নিশ্চিত স্বয়ং খালেদ চৌধুরী মহাশয়ও জানতেন, মূলগতভাবে চিত্রকলার উদ্ভব হয়েছিল ফ্রেম-আবদ্ধ-ক্যানভাস ক্ষেত্রের বাইরে। থিয়েটারের মতোই চিত্রকলার উদ্ভব হয়েছিল ফ্রি-ফ্রেম প্রাকৃতিক ক্যানভাসে আর অধুনা তারই পরিণমন সীমান্তহীন বিস্তারে। হাজার বছর আগের প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষেরা যে-গুহাচিত্র অঙ্কন করেছিলেন তার কিছু নির্দশন আজও ইন্দোনেশিয়ার মারকো দ্বীপে রক্ষিত আছে। সেখানে তখন ফ্রেমবন্দী চারকোণা ক্যানভাস ছিল না। মানুষ একসময় পাহাড়ের গায়ে, মাটির উপরে, বাড়ির ছাদে, পশুর দেহে, বৃক্ষের বাকল ছেদন করে চিত্রাঙ্কন করেছে। খালেদ চৌধুরী সাহেব চিত্রাঙ্কনের জন্য যে চারকোণা ফ্রেমের কথা বলেছেন, চিত্রকলার বিকাশের ভূমিকায় তার অনন্য তাৎপর্য স্বীকার করেও বলা যায়, আসলে সামন্তসমাজের বিকাশের সাথে সাথে রাজা-মহারাজা-জমিদারদের তৈলচিত্র অঙ্কন ও দেওয়ালে ঝোলানোর সুবিধার জন্যই চারকোণা ফ্রেমের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। ইতিহাসের একটা সময় পর্যন্ত চারকোণা ফ্রেমের ক্যানভাসের তৈলচিত্রে শোভা পেত বড়ো মুখের পোট্রেট। আমরা জানি বাঘের ছবি আঁকা সহজ, কিন্তু ব্যাঘ্রত্বের ছবি আঁকতে গেলে পোট্রেটমুখীনতায় হবে না। মানুষের শরীর জুড়ে বাঘের চোখ এঁকে যে অন্তর্বাস্তবতার সন্ধান শিল্পী দেন তাকে তো ‘লিভিং আর্ট’ বলতেই হবে। এখানে মানুষের শরীরটাই ক্যানভাস। তাই এ-যুগেও আমরা দেখেছি মানুষ ছবি আঁকার জন্য আর চারকোণা ফ্রেমের ক্যানভাসের জন্য অপেক্ষা করেনি।
১৯৬৮ সালে ফ্রান্সে ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজপথ জুড়ে ছাত্ররা যে-গ্রাফিতি এঁকে দিয়েছিল তা রাষ্ট্রের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে তারই নিদর্শন দেখলাম বাংলাদেশের ঢাকার বিভিন্ন দেওয়ালে ‘সুবোধ পালিয়ে যা’ শিরোনামের চিত্রাঙ্কণে। মোট কথা, শিল্প এখন ফ্রেমে অথবা প্রেক্ষাগৃহে আবদ্ধ থাকতে চাইছে না। আমরা যে-বিকল্প থিয়েটারের কথা বলছি তা আসলে ‘লিভিং থিয়েটার’। প্রসেনিয়ম মঞ্চকে বলা হয় ‘পিকচার ফ্রেম স্টেজ’। ফ্রেমবদ্ধ ছবি যতটা প্রাণহীন, ফ্রেমবদ্ধ নাটক ততটাই অসার। জানি, তুমুল বিতর্ক হবে। তবু কয়েকটি উদাহরণ সামনে আনতে বাধ্য হচ্ছি। না, বিশ্বের অন্য প্রান্ত থেকে নয়। চেনাজানা পরিসর থেকেই দৃষ্টান্ত রাখছি। গত ছয়ের দশকে পোলান্ডে বসে গ্রুটস্কি যে-কথা বলেছিলেন তার বহু আগে আমাদের এখানে রবিঠাকুর তার ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধে একই কথা সোচ্চারে বলে গেছেন। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ অভিনয় ক্ষেত্রে ’অনাবশ্যক দ্রব্যরাশি’ তথা ‘আড়ম্বর’ পরিহার করার কথা বলেছিলেন। তিনি প্রবন্ধটি শুরু করেছেন এই কথা বলে যে, ‘ভরতের নাট্যশাস্ত্রে নাট্যমঞ্চের বর্ণনা আছে। তাহাতে দৃশ্যপটের কোনো উল্লেখ দেখিতে পাই না। তাহাতে যে বিশেষ ক্ষতি হইয়াছিল, এরূপ আমি বোধ করি না’। রবীন্দ্রনাথের নাট্যভাবনায় মঞ্চের কৃত্রিম দৃশ্যপট পরিহারের বিষয়টি সক্রিয় থাকার জন্য তিনি ‘শারদোৎসব’ থেকে শুরু করে শেষ পর্বের নৃত্যনাট্যগুলি উন্মুক্ত প্রাকৃতিক পরিসরেই উপস্থাপন করার প্রয়াস রেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাট্য প্রযোজনায় শান্তিনিকেতনপর্বের দিকে তাকালেই এটা পরিষ্কার হবে। শান্তিনিকেতনপর্বের প্রথম নাটক ‘শারদোৎসব’ (১৯০৮)। এটির অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তন করলেন এক নতুন উপস্থাপন রীতির। মুক্তাঙ্গনে একটি নীল পর্দা ঝুলিয়ে তার সামনে ও আশেপাশে কিছু গাছপালা ও ফুলপাতা সাজিয়ে অভিন্ন প্রাকৃতিক অনুষঙ্গে নাটকটি উপস্থাপিত হয়েছিল। নাটকে দৃশ্যবিভাগ থাকলেও যবনিকা ওঠানো-নামানোর পুরোনো প্রথা স্বাভাবিকভাবেই বর্জন করেছিলেন তিনি। তাঁর ‘ফাল্গুনী’ (১৯১৫) নাটকের আগে অভিনয়-প্রাঙ্গণে এসে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘…এই নাটকে আমি দৃশ্যপট, কনসার্ট, যবনিকা প্রভৃতি বাদ দিয়েছি। এই যে গাছের ডাল কেটে কৃত্রিম বন তৈরি হয়েছে এটাও আমার ইচ্ছা ছিল না, এইসব সরঞ্জাম দর্শকদের অনেক সাহায্য করে সন্দেহ নেই, কিন্তু এই সাহায্য সম্প্রতি এমনই বাড়াবাড়ি হয়ে উঠেছে যে দর্শকদের কল্পনা প্রায় লোপ হবার দাখিল হয়েছে…’। মোট কথা, সহজ সৌন্দর্যে আভাসিত অভিনয়-প্রাঙ্গণের প্রয়োজনীয়তার কথাই বলতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাত মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘… ‘ফাল্গুনী’র সাজসজ্জার মধ্যে এমন একটি অকৃত্রিম আড়ম্বরশূন্য নিরাভরণ সৌন্দর্য ছিল যা বাংলাদেশের নাট্যমঞ্চের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল’। আমার মনে হয়, শুধু বাংলার থিয়েটারচর্চায় নয়, রবীন্দ্রোত্তর কালের সাড়া বিশ্বের নিরীক্ষামূলক থিয়েটার ভাবনায় রবীন্দ্রচিন্তা আধারিত সজীব মঞ্চোপকরণের রীতিই নানা আঙ্গিকে জনপ্রিয় হয়েছিল। হয়তো দুর্ভাগ্যবশত ‘লিভিং থিয়েটার মুভমেন্ট’-এর ক্ষেত্রে রবীন্দ্র-অনুষঙ্গটি অনুচ্চারিত থেকে গেছে। শান্তিনিকেতনে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ যখন ‘সজীব থিয়েটার’-এর কথা ভেবেছেন, তার অনেক পরে পাশ্চাত্য দেশে শুরু হয়েছিল ‘লিভিং থিয়েটার’ মুভমেন্ট। নিউইয়র্কে বসে ‘এনভায়রনমেন্টাল থিয়েটার’-এর প্রবক্তা রিচার্ড শেখনার যখন লিভিং থিয়েটার প্রসঙ্গে বলেন, ‘There is an actual, living relationship between the spaces of the body and the spaces where body moves through; human living tissue does not abruptly stop at the skin, exercises with the space are built on the assumption that human beings and spaces are both alive’ তখন কি আমরা রবীন্দ্র-কন্ঠেরই প্রতিধ্বনি শুনি না?
থিয়েটারের সুদীর্ঘ ইতিহাসের গতিপথে চোখ রাখলে এই সত্য অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে যায় যে অভিনয়শিল্পে প্রসেনিয়ম মঞ্চের পৃথক কোনো গুরুত্ব নেই। প্রসেনিয়াম মঞ্চ একটা স্পেস মাত্র। অ্যারিস্টটল তাঁর ‘পোয়েটিকস’ গ্রন্থে যে দুটি ঐক্যের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন তা হল ঘটনা-ঐক্য ও কাল-ঐক্য (Unity of Action and Unity of Time)। তিনি কোথাও স্থান-ঐক্যের (Unity of space) কথা উল্লেখ করেননি। থিয়েটারের প্রয়োজনেই স্পেস নিরীক্ষিত হয় নির্মাণ-বিনির্মাণের পথ বেয়ে। নাট্যানুশীলনের ধারায় আবিষ্কার-পুনরাবিষ্কারের প্রচেষ্টায় অভিনয়-স্পেস বার বার নিরীক্ষিত হয়েছে। উত্তরাধুনিক কথামালায় বলা যায়, ডিকনস্ট্রাকশনের উপক্রমণিকায় বিমঞ্চায়নের সৃজনিক প্রয়াসেই অভিনয়ের স্পেসচেতনা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। থিয়েটারের শক্তি অপরিসীম, মঞ্চের সসীমতাকে অসীমতায় সম্প্রসারিত করতে পারে।
অভিজ্ঞতা শোনালো
প্রশান্ত সূত্রধর
আমার জন্ম ও বড়ো হয়ে ওঠা কোচবিহারে। সৌভাগ্যবশত আমার এলাকাতেই থাকতেন উত্তরবঙ্গের প্রখ্যাত
মূকাভিনেতা স্বর্গীয় শংকর দত্তগুপ্ত। ছোটোবেলায় স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে শংকরবাবুর বাড়ি থেকে প্রায়ই
শুনতাম গান,কবিতা, সংলাপ, হাসি-কান্না আর চিৎকারের মিলিত শব্দ। কৌতূহল হত। সেই কৌতূহলের তাপমাত্রা
ধীরে ধীরে এমন বাড়ে যে রহস্যের সমাধান টানতে গিয়ে একদিন পৌঁছে যাই সেই বাড়ির ভেতরে। আমায় দেখে
শংকর জেঠু ভারী গলায় বলে ওঠেন, নাটক করবি? কিছু না বুঝে হয়তো ভয়েই মাথা নাড়িয়ে ইচ্ছা প্রকাশ করে
ফেলেছিলাম। এভাবেই শুরু হয় থিয়েটারের শিক্ষা, চর্চা। বয়স তখন ৯, এরপরে একটানা ১০ বছর কাজ শিখেছি,
কাজ করেছি উনার সাথে আনন্দম কালচারাল সেন্টারে। তারপর স্নাতক শেষ করে কলকাতায় পাড়ি দেওয়া। নাটক নিয়েই স্নাতকোত্তর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর রাষ্ট্রীয় নাট্য বিদ্যালয়ে (sttc) পড়াশোনা। এই সম্পূর্ণ সময়টাতেই দেশ এবং বিদেশের প্রচুর থিয়েটার দেখেছি। আধুনিক থিয়েটারের পরিভাষা কী হতে পারে তা জানবার, বুঝবার চেষ্টা করেছি। পড়াশোনা করেছি। নিজে যখন কাজ করবার চেষ্টা করেছি তখনই বার বার অসফল হয়েছি। এর প্রধান কারণগুলি হিসেবে আমার মনে হয় আমার তখনও কম অভিজ্ঞতা। খুব ভালো করেই বুঝে গেছিলাম যেকোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তার অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দিক ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সুতরাং সবার আগে সেই ভাবনা পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন। শুরুতেই ছাত্রাবস্থায় আরও কয়েকজনকে নিয়ে একটু বড়ো ধরনের প্রযোজনা করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না তাই শুরুটা একা এবং অতি স্বল্প অর্থমূল্যে কিছু একটা করতে হবে– এই ভাবনা থেকেই শুরু হয় কাজ করা। কিন্তু কী করব? শুরু হয় ভাবনা, বিষয়বস্তু খোঁজাখুঁজি। আমি তখন স্ক্রিপ্ট লিখতে পারতাম না তাই পেপার কাটিং জমাতে শুরু করলাম। ভারতবর্ষ গল্পের দেশ। এখানে দর্শক গল্প শুনতে পছন্দ করেন। রামায়ণ-মহাভারত এমনকী পঞ্চতন্ত্র, ঠাকুরমার ঝুলি প্রভৃতি তাই বোধ হয় এত জনপ্রিয় প্রত্যেক স্তরের মানুষের কাছে। তাই খবরের কাগজ থেকে নির্বাচিত কিছু সত্যিকারের ঘটনাকে improvisation করে সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে স্টোরি-টেলিং করব সিদ্ধান্ত নিলাম। সংগ্রহে জমা হয় অনেক গল্প। সেই গল্পগুলো গান, নাচ ও শারীরিক ভাষার মাধ্যমে অভিনয় করে দেখাতে এবং শোনাতে শুরু করি সামনে বসা দর্শকদের। তাই কোনো নির্দিষ্ট গল্পকে মাথায় রেখে নাম ঠিক না করে পারফরম্যান্সের নাম রাখা হয় ‘XYZ’। মাত্র ১৭ টাকা অর্থমূল্য খরচে এই প্রযোজনা আজও করে চলেছি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ।
দর্শকদের থেকে রিঅ্যাকশন–
আসলে দর্শক তো একজন রক্তমাংসের মানুষ। কোনো অ্যাকশনের প্রতিক্রিয়ায় মানুষ রিঅ্যাকশন দেবেন এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু আমার কাজ spectator-কে সাইকলজিক্যালি পারফরম্যান্সের মধ্যে involve করানো সেহেতু এই প্রক্রিয়ায় প্রত্যেকবার spectator থেকে spect-actor হয়ে উঠতে দেখবার অভিজ্ঞতা বিস্ময়কর। বেশিরভাগ সময়ই পারফরম্যান্সের শেষে দর্শক এসে বিস্তর সময় ধরে পারফরম্যান্সের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করেছেন। এমন অনেক মানুষ আছেন যারা পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা চালিয়ে গেছেন বহুদিন। প্রত্যেকটা পারফরম্যান্সের পর দর্শক কাছে টেনে নিয়েছেন। গ্রামেগঞ্জে, মফস্বলে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে পারফরম্যান্সের পর দর্শকদের উদ্দেশ্যে গামছা পেতে দিলে দর্শক নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ সাহায্য দানে কৃপণতা করেননি । এমনকী পারফরম্যান্স শেষ করে ফেরার সময় দর্শক নিজের জমি থেকে শাকসবজি, তরিতরকারি দিয়েছেন এমন অভিজ্ঞতাও আমার আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি শো দেখবার পর পরবর্তী শোগুলির ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন দর্শকরাই। আজ খুব দায়িত্ব নিয়ে এ-কথা বলতেই পারি আমার নিজের বেশ কিছু দর্শক তৈরি হয়েছেন, যাঁরা শুধুমাত্র পশ্চিমবাংলায় বসবাস করেন না। এমন অনেক মানুষ রয়েছেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন কোণায় এমনকী বিদেশেও, যাদের বেশিরভাগের সঙ্গেই বিভিন্ন social networking মাধ্যমের মধ্য দিয়ে আলোচনা, মত বিনিময় হচ্ছে আজও। তবে হ্যাঁ, আবারও বলছি দর্শকদের টেম্পারমেন্ট বোঝাটা খুবই জরুরি একজন পারফর্মারের জন্য। আমার মনে হয় একসাথে সব স্তরের সব শ্রেণীর দর্শকের কাছে পৌঁছোতে গেলে সেই বিশেষ দর্শকের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকাটা পারফর্মারের প্রথম কাজ । ভারতবর্ষ বৈচিত্রের দেশ কিন্তু প্রতিটি শিল্পমাধ্যমের একটি নিজস্ব ভাষা আছে। ভঙ্গি আছে। যেমন থিয়েটারের ক্ষেত্রে theatrical language, craft। একটি স্থানের উপর দাঁড়িয়ে নিজের বক্তব্য সেই ভাষাতেই শরীর ও মন দিয়ে সঠিকভাবে প্রকাশ করাই পারফর্মারের কাছে তুরুপের তাস।
কোন কোন স্পেসকে কীভাবে এবং কেন ব্যবহার?
থিয়েটার শরীর, স্থান ও মস্তিষ্কের সমন্বয়-সাধন । একজন পারফর্মার হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা এবং গভীর বিশ্বাস– যেকোনো পারফরম্যান্সেই স্পেস স্পেসিফিক, কালচার স্পেসিফিক। এখনও পর্যন্ত প্রায় একশোর অধিকবার ‘এক্স ওয়াই জেড’ পারফর্ম করেছি রাজ্য এবং রাজ্যের বাইরে। বাড়ির ছাদ, উঠোন, বাগান, ড্রয়িংরুম, পরিত্যক্ত রাজবাড়ি, স্কুল ঘরের ভেতর, মাঠে, চাষের জমিতে, রেলগাড়ির কামরায়, জঙ্গলের ভেতর, ওয়াটার ট্যাংকের উপর, স্টুডিও থিয়েটার ব্ল্যাকবক্সে, মন্দিরের চাতালে, প্রসেনিয়াম থিয়েটার মঞ্চে বহুবার এই উপস্থাপনা পরিবেশন করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই ভিন্ন ভিন্ন স্থানগুলোতে পারফর্ম করতে গিয়ে সবসময় উপলব্ধি করেছি একটি বিশেষ স্থানের গঠন এবং সেখানকার দর্শকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের ওপর পারফরম্যান্সটি কেমন বদলে বদলে যায় এবং প্রত্যেকটি আলাদা স্থান তার নিজের মতো করেই পারফরম্যান্স লজিস্টিক তৈরি করে । প্রথমেই বলেছিলাম ‘এক্স ওয়াই জেড’-এর নির্দিষ্ট কোনো স্ক্রিপ্ট নেই। সম্পূর্ণ পারফরম্যান্সটি ইম্প্রোভাইজেশন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে চলে। তাই আমার কাছে বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন গল্প বলবার সুবিধা আছে। বাড়ির ছাদ, উঠোন, বাগান, ড্রয়িংরুম– এইরকম স্থানগুলোতে যখনই পারফরম্যান্স করেছি কিংবা করছি তখন পারিবারিক আড্ডা দেওয়ার কায়দায় গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাই। আবার পরিত্যক্ত রাজবাড়ি, যেখানে দিনের-পর-দিন অসামাজিক কাজকর্ম চালিয়ে গেছেন কিছু মানুষ, সেই রাজবাড়িতেই পারফর্ম করেছি ওই অসামাজিক কাজকর্মের বিরুদ্ধে। লোকসংগীতের আস্তরণের মধ্য দিয়ে মাঠে চাষের জমিতে কৃষক ও খেটে খাওয়া মজুরের অধিকার নিয়ে আলোচনা করেছি। পরিবেশের ভারসাম্য, জল অপচয়, জমি-জঙ্গল, জঙ্গলে বসবাসকারী আদিবাসীর অধিকার নিয়ে কথা বলতে, আলোচনা করতে পারফরম্যান্স স্পেস হিসেবে বেছে নিয়েছি জঙ্গলের ভেতর, ওয়াটার ট্যাংকের উপরকে। মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়েই সাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম, রাজনীতি প্রসঙ্গে আলোচনা করেছি দর্শকের সাথে। বার বার এই পারফরম্যান্সটির নান্দনিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমি অবশ্যই বিশ্বাস করি আমি একজন পারফর্মার এবং আমার কাজ পারফরম্যান্স করা এবং তাতে এস্থেটিক অবশ্যই জরুরি। স্টুডিও থিয়েটার ব্ল্যাকবক্স, প্রসেনিয়াম থিয়েটার মঞ্চে যখনই কাজ করবার সুযোগ পাই তখন বিশেষভাবে ওইসব বিশেষ প্রশ্নের সমাধান হয় । একজন থিয়েটারের ছাত্র ও পারফর্মার হিসেবে ‘Art for peoples’ & ‘Art for art’ এই দুটোর ভারসাম্য বজায় রাখা আমার প্রধান কাজ হিসেবে মনে করি ।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা–
ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে এবং বাংলাদেশ থেকে ডাক পেয়েছিলাম অতিথি পরিচালক হিসেবে কাজ করবার। আকস্মিক মহামারী সেখানে ছন্দপতন করেছে। এখন বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে পড়াশোনা চলছে, যাতে বিবিধ প্রান্তের রিচুয়াল ও লোক আঙ্গিকের নাটক নিয়ে কাজ করতে পারি। এছাড়া কোচবিহারে একটি নাটকের স্পেস তৈরির কাজ শুরু করব ভেবেছিলাম মহামারীর আগে। নিজের বাড়িতেই। যেখানে বিভিন্ন নাট্য কর্মশালা এবং নাটকের কাজ করা যেতে পারে। আপাতত সে-কাজ বন্ধ রয়েছে।
কেন অন্তরঙ্গ ফরম্যাট ?
অন্তরঙ্গ কিংবা ইন্টিমেট থিয়েটারের সংজ্ঞা এখনও আমার কাছে খুব একটা পরিষ্কার নয়। আমি যে-কাজটা করি সেটি অবশ্যই একটি থিয়েট্রিক্যাল পারফরম্যান্স। আর ফরম্যাট বলতে গেলে আমি এই মুহূর্তে আমার কাজটিকে অফ প্রসেনিয়াম ফরম্যাট বলেই ইতি টানব। আমার মনে হয় প্রসেনিয়াম মঞ্চে দাঁড়িয়ে যদি কোনো অভিনেতার অভিনয়ে শেষ রো-তে বসা দর্শক একাত্ম হতে পারেন তবে সেটাও একটা ইন্টিমেসি তৈরি করে। সেক্ষেত্রে ওটা ইন্টিমেট পারফরম্যান্স হবে না কেন ?
যাক গে, মঞ্চের বাইরে এসে কাজ করবার কারণ হিসেবে শুরুর দিকটায় অর্থনৈতিক অবস্থাই ছিল মূল কারণ। কিন্তু কয়েক বছর পর আজ আর কিছু জোরালো উদ্দেশ্য তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আর্টিস্ট ও অ্যাক্টিভিস্টের দূরত্বকে ভেঙে দেওয়া। বিষয়টা অভিনয় হলেও অভিনেতা হিসেবে অনেক বেশি সত্যের কাছাকাছি থাকা। প্রসেনিয়াম শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘প্রস্কেনিয়ন’ থেকে। যে-উঁচু অংশে দাঁড়িয়ে পারফর্মার পারফর্ম করে তাহাই প্রস্কেনিয়ন। এই উঁচু-নীচু আইডিয়াকে ভেঙে অভিনেতা ও দর্শকের মধ্যেকার এস্থেটিক ডিসটেন্স বা নান্দনিক দূরত্বকে মুছে দিয়ে একসময়ে একই জায়গায় অবস্থান করা। এতে solo performer হিসেবে আমার কাজ করতে সুবিধা হয়।
প্রিয়া সাহা
নাটকের নাম ‘ভীতু’ আর দলের নাম ‘অশিক্ষিত’। ‘অশিক্ষিত’ নাটকের দলের নাম শুনেই
লোকেরা একটু ভুরু কোঁচকায়, কিন্তু আমরা যদি গভীরভাবে চিন্তা করে নিজেকে প্রশ্ন করি,
হাজার খানা ডিগ্রি নিয়ে সত্যি কি শিক্ষিত হতে পেরেছি? যাই হোক, দলের নাম অশিক্ষিত
রাখার কারণ বয়স তখন তেইশ বছর। ২০১৭ সাল। এর আগে কিছু নাটক লিখেছি কিন্তু সবই
প্রায় খাতায় বন্ধ, নাটকের নির্দেশনা বা সহ নির্দেশনা দেওয়ার কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তেমন
কোনো তথাকথিত বড়ো নাটকের দলে কাজ করার অভিজ্ঞতাও নেই, সুতরাং নাটকের জগতে
আমরা অশিক্ষিত। ‘ভীতু’ নাটকটির কথা ২০১৫ সাল থেকে ভাবতে শুরু করে নাটক হিসাবে
মঞ্চস্থ করতে পেরেছি ২০১৭ সালে। নাটকের ভাবনা নিজের, বান্ধবী এবং আশেপাশে থাকা মহিলাদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আসা। প্রথমত নাটকের ভাবনা অনুযায়ী দর্শক হিসেবে মাসের কাছে পৌঁছানোটা বেশি দরকার ছিল। এই কারণেই আমি নাটকের জায়গায় হিসেবে রাস্তা বেঁচেছি। প্রথম শো করা হয়েছে টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের সামনে। শো শেষ হতে না হতেই এসে হাজির মেট্রোগার্ড। তারা এসে আমার পপস এদিকে-ওদিকে ছুড়ে ফেলে দেয়। ভীতুর এখনও পর্যন্ত ২৩০ মতো শো হয়েছে। বহরমপুরে ভীতুর ২৩০তম শো হয়েছে। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ নয় দিল্লি, হরিয়ানার বিভিন্ন জায়গায় নাটকটি করা হয়েছে। ইচ্ছে আছে নাটকটি ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছানো। কিন্তু সেই জায়গায় আর্থিক অবস্থান বার বার সামনে এসে দাঁড়ায়। তেমন কোনো কল শো পাই না অথচ নাটকের শেষে অনেকেই বলে, ‘আমরা আমাদের অঞ্চলে ডাকব।’ সেই ডাক আর আসে না। এখন আপনারা ভাবতেই পারেন কল শো যদি নাই পেয়ে থাকি তাহলে এতগুলো শো হল কী করে? নিজেদের উদ্যোগে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তাম। খালি জায়গা পেলে সেখানে মঞ্চ সাজিয়ে ‘ভীতু’ করে ফেলতাম। কোনোদিনও রাস্তায় কাজ করার জন্য সরকার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়নি। আশা করি ভবিষ্যতে আপনাদের রাস্তায় দেখা হয়ে যাবে।
প্রসেনিয়াম মঞ্চের বাইরে রঙ্গের নানা মঞ্চ নিয়ে মন্তব্য করলেন
উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় নাটক যা করেছি সবই আজকের এই অন্তরঙ্গ অভিনয়। একটা সেমিনার হলে
বক্তৃতা হত আর আমার নাটক মাঝে মাঝে।
পরে প্রসেনিয়াম নাট্যে আমার মূল যোগ হলেও থার্ড থিয়েটার বলে যেটি বাদল সরকার করতেন তা আমার
যুক্তিপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বলে মনে হত।
এখন আমি এইভাবে খুব কান খরচা করে নিজের কথা বলব এই বিচার নিয়ে কিছু কাজ কল্পনা করছি। একটু
আলো ও একটি প্রকরণ ব্যবহার করে মিনিমাল ইনপুট দিয়ে ওই স্পেসটি অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা করলে
পাহাড় প্রমাণ স্টেজের দায় থেকেই মুক্তি এবং এমন কথাই আজ বলতে হবে যা অপ্রসাধিত। সত্যকে আজ
আর সাজিয়ে বলে নিজেকেই ঠকানো। এমনভাবে বানানো হোক যাতে স্টেজে হলে করতে পারব। ছোট্ট
ঘর বা ছোটো নাট্যস্পেসেও ও পারব।
ভীমরতি দলের সঙ্গে আমি এইরকম কাজ করছি। অন্তরঙ্গে লাগে অন্তরঙ্গ একাগ্রতা এবং নির্দ্দিষ্ট বিষয়
নির্বাচন। ও অনন্য এক মেথড অভিনয় রীতি। এই রীতি নিয়ে আলাদা করে আলোচনা হওয়া দরকার।
কৌশিক কর
অল্টারনেটিভ যতই থিয়েটার প্রচলিত ফরম্যাটের বাইরে বেরিয়ে আসবে, ছড়িয়ে পড়বে, ততই থিয়েটার তার
মূল উদ্দেশ্যের দিকে ধাপে ধাপে পা বাড়াবে। কারণ ব্ল্যাকবক্স থিয়েটার ও থার্ড থিয়েটার দুটোই আলাদা
আলাদা পারপাস সার্ভ করে। কোনটা প্রভাবহীন বা বেশি শক্তিশালী তা এককথায় বর্ডার টেনে দেওয়া
মুশকিল ও ন্যায়সঙ্গত নয়। কারণ, প্রতি ক্ষেত্রেই টার্গেট অফ অডিয়েন্স বা ভিউয়ার আলাদা আলাদা
স্থান-কাল- পাত্রেই যুক্ত হয়। আলাদা ইকোনমি, আলাদা ক্লাস,আলাদা স্তর। যেহেতু থিয়েটার একটি
উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে চলে, কেবলমাত্র বিনোদনের আখড়া নয়, তাই যত বেশি অল্টারনেট স্পেস
এক্সপ্লোর হবে ততই তার বিভিন্ন স্কেলে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যকারিতা বেড়ে চলবে।
সংকট অন্তত থিয়েটার এক্সপ্লোরেশনে নেই। সংকট থিয়েটারকে পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক করে ফেলায়।
সে-চান্স কম-বেশি আছেই ব্ল্যাকবক্স থিয়েটারে, বা হয়ে চলেছে সেই অ্যাপ্লিকেশন ক্রমাগত। তবে
অল্টারনেটিভ স্পেস সংকট নয়,সম্ভাবনাই তৈরি করবে। আসলে সবটাই নির্ভর করে ইউজার্সের
মানসিকতার ওপর।
চলচ্চিত্র
২০১৯-এর বাংলা ছায়াছবি
– অনিরুদ্ধ ধর
![FB_IMG_15984391638448365.jpg](https://static.wixstatic.com/media/3e4e48_ae3ad6992bd145208f0f3c34bb0e038b~mv2.jpg/v1/fill/w_243,h_240,al_c,q_80,usm_0.66_1.00_0.01/FB_IMG_15984391638448365.webp)
একটা পরিসংখ্যান দিয়ে লেখাটা শুরু করতে চাই।
হিসেবটা এই রকম। ২০১৯ সালে প্রায় ৯০ টি বাংলা সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। তার মধ্যে অর্ধেকের কাছাকাছি যাকে বলে ‘ঝাপসা’ ছবি। ‘ঝাপসা ছবি’ খুব চালু একটা টার্ম। এর অর্থ যে ছবি তৈরি করেন তিনি আনাড়ি কেউ, অভিনয় করেন আনাড়িরা , আর যিনি তাতে অর্থ লগ্নী করেন তিনি কী কারণে এই ধরণের ছবিতে টাকা ঢালেন সেটা গবেষণার বিষয়। এই সব সিনেমা কোথায় প্রদর্শিত হয় , কীভাবে তৈরি হয় সেটাও বেশ কৌতূহলের বিষয় । কারণ এই ছবি কবে মুক্তি পায় কেউ জানতে পারেনা। এদের আগাম বার্তা পাওয়া যায় কেবল টালিগঞ্জের গ্ল্ফ ক্লাবের দেওয়ালে। কিন্তু এই প্রতিটি ছবি তৈরি হয় সমস্ত নিয়ম কানুন মেনে। ইম্পায় নাম রেজিস্ট্রি করা থেকে শুরু করে সেন্সরের ছাড়পত্র যোগাড় করা পর্যন্ত প্রতিটি নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মেনে তৈরি হয় এই সব ছবি। ৫০ শতাংশেরও বেশি তৈরি হওয়া এই ছবিগুলি অবস্থান করে মূল সিনেমার সমান্তরাল ভাবে। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ভিতরে এ এক অন্য ইন্ডাস্ট্রি, যা নিয়ে মূল ইন্ডাস্ট্রি একেবারেই ভাবিত নয়। অথচ, এদের উপস্থিতি অগ্রাহ্যও করা অসম্ভব। আমি কয়েকটা সিনেমার নাম বলছি, যাদের নাম আপনি শোনেনই নি। যেমন, ‘ যাহ শালা হড়কে গেল হিসেব ’, ‘ দ্য হ্যাকার ’, ‘৭৪ ব্রোকেন লাইনস’, ‘তুই আমার রানি’, ‘উইক এন্ডে সূর্যোদয়’, ‘নেম প্লেট’ । এমনই সব নাম। এই সব ছবির পরিচালক কিংবা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নাম কেউ শোনেন নি, কোনও কাগজ বা ম্যাগাজিনে এঁদের নিয়ে একটি শব্দও লেখা হয়না। অথচ, এই সব ছবি বাংলা সিনেমার অংশ। শুধু গত বছর নয়, প্রতি বছর এমন ছবি ডজন ডজন তৈরি হচ্ছে।
এর বাইরে আরও এক ধরণের সিনেমা তৈরি হয় ফি বছর। তার সংখ্যাও মুক্তি প্রাপ্ত মোট সিনেমার প্রায় ২৫ শতাংশ। এগুলি ঠিক ঝাপসা নয় , কারণ এই সব ছবিতে ছোট-বড় নানা ভূমিকায় থাকেন চেনা শিল্পীরা।
এগুলিকে বলা হয় ‘হাফ গেরস্থ’ ছবি। কোনও রকমে কয়েকজন চেনা অভিনেতা-অভিনেত্রীকে আগে রাজি করানো হয়। কেউ এক দিন কেউ দু দিন এমন শর্তে কাজ করতে রাজি হন। তারপর দ্রুত ওই সব শিল্পীদের কথা মাথায় রেখে একটা গল্প ভেবে ফেলা হয় এবং বড়জোর দিন সাত -আটের মধ্যে শুটিং শেষ করে ফেলা হয়। এ বছর মুক্তি পেয়েছে এই ঘরানার কয়েকটি ছবির নাম হল ‘গোয়েন্দা তাতার’, ‘দোতারা’, ‘এক মুঠো রোদ্দুর’,‘বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’ , ‘থাই কারি ’, ‘কুসুমিতার গল্প’ । এই সব ছবিতে যাঁদের নাম দেখতে পাওয়া গিয়েছে তাঁরা হলেন খরাজ মুখার্জি, সুপ্রিয় দত্ত, সমদর্শী, দেবলীনা দত্ত, হিরণ প্রমূখ। আর কখনও কখনও সৌমিত্র, মাধবীর নাম দেখতে পাওয়া যায়। ছোটখাট সিঙ্গল স্ক্রিনে এই সব ছবি মুক্তিও পায়। বলাই বাহুল্য দিন তিন কিংবা চার দিন এদের আয়ু।
‘ঝাপসা’ ছবির শুটিং হয় বড়জোর দিন পাঁচেক। ছবির বাজেট আট থেকে লাখ দশেক। আর ‘হাফ গেরস্থ ছবির’ শুটিং সাত -আট দিনের মধ্যে শেষ আর বাজেট ২০ লাখ থেকে ৪০-৪৫ লাখের মধ্যে।
হিসেব মতো ৪০% ছবি হয় ‘ঝাপসা ছবি’ , ৩০% ছবি হয় ‘হাফ গেরস্থ’ । আর বাকি ৩০ % ছবির খবরাখবর আমরা পাই কাগজে পত্তরে। এই ধরনের ছবির সংখ্যা ২০১৯-এ হল ৩০।
এই ৩০ টি ছবি বানিয়েছেন ২৪ জন পরিচালক। আর বাকি ৭০ টি ছবির পরিচালক আরো ৭০ জন। অর্থাৎ, ২০১৯ সালে বাংলা সিনেমা বানিয়েছেন ৯৪ জন পরিচালক।
ভাবাই যায়না, একটা আঞ্চলিক ভাষায় প্রতিবছর ছবি বানাচ্ছেন প্রায় ১০০ জন পরিচালক। এই হল আমাদের বাংলা সিনেমার পরিস্থিতি। ৯৪ জন পরিচালকের মধ্যে ৭০ % জনের সিনেমা নিয়ে কোনো প্রশিক্ষণ নেই, চিত্রনাট্য সম্পর্কে ধারণা থিয়েটারের, টেকনিক্যাল জ্ঞান শূন্য। কেবলমাত্র একজন ধান্দাবাজ এবং অসৎ মানুষকে খুঁজে বের করতে হয় এঁদের যিনি অর্থ লগ্নী করেন তাঁর বান্ধবী কিম্বা শালীকে সিনেমায় সুযোগ দেবেন বলে।এগুলো নতুন কোনও তথ্য নয়। সবাই জানেন। গত বছর ‘ঝাপসা’ এবং ‘হাফ গেরস্থ’ ছবির পিছনে লগ্নী হয়েছে অন্তত ২০ কোটি টাকা। এর রিটার্ন প্রায় শূন্য।
এবার আসা যাক যে- বাংলা সিনেমার খবর আমরা জানি, গত বছর তেমন ছবির খবর।
আমার হিসেব মতো এমন ছবির সংখ্যা ৩০। যে ২৪ জন এই ছবিগুলি বানিয়েছেন তাঁরা নিয়মিত ছবি বানাচ্ছেন। অর্থাৎ, এঁদের খবরাখবর কাগজে – ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। এঁদের পিছনে লগ্নী হয়েছে অন্তত ১০০ কোটি টাকার কাছাকাছি।
সন্দীপ রায়ের ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও এলডোরাডো’ -র বাজেট প্রায় ১০ কোটি। এখনও পর্যন্ত লগ্নির ৫০ শতাংশ বিক্রি হয়নি। অর্থাৎ, প্ৰযোজকের ঘরে এসেছে মাত্র ২৫%। নিশ্চিত করে বলা যায় ৫০% -এর বেশি বিক্রি অসম্ভব। টেলিভিশন রাইট কত হবে জড জানে! বছরের সবচেয়ে বেশি বাজেটের ছবির এই অবস্থা। তবে এই প্রথম শঙ্কু-কে পর্দায় দেখা গেল। ধৃতিমানকে শঙ্কু হিসেবে অনেকেই মেনে নেন নি। তবে সীমিত সামর্থ্যে ভিএফএক্স -এর কোয়ালিটি মন্দ নয়।
বছরের সবচেয়ে আলোচিত ছবি ছিল ‘গুমনামি’ । সৃজিত মুখোপাধ্যায় প্রসেনজিৎকে একই সঙ্গে গুমনামি বাবা এবং নেতাজি বানিয়ে ফাটকা খেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ। সিনেমা হিসেবেও তেমন কিছু হয়নি। এমনকী ‘চৌরঙ্গী’ ছবির রি-মেক ‘শাহজাহান রিজেন্সি’ -ও তেমন জমেনি। বরং তাঁর থ্রিলার ঘরানার ‘ভিঞ্চি দা’ কিছুটা পদের হয়েছে। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যয়-ও সৃজিতের মতো গত বছর তিনটে ছবি বানিয়েছেন। কীকরে বছরের পর বছর এঁরা ফি-বছর তিনটে করে ছবি বানান কে জানে ! এত প্রোডাকটিভ পরিচালক পৃথিবীর আর কোথাও নেই। ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’ এবং ‘বিজয়া’ সিম্পল ন্যাকা ন্যাকা যাত্রাপালা। আর হাতে রইল ‘নগর কীর্তন’ । এই ছবি নিয়ে সবাই আহা-উহু করেছেন। কিন্তু ২০১৯-এ দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষের সমসাময়িক সামাজিক- রাজনৈতিক এই পরিস্থিতিতে কেন এই সমকাম সমস্যাকে গুরুত্ব দেব, এ-প্রশ্ন কেউ করছেন না। তবে ঋত্বিক এবং ঋদ্ধি দুজনেই ভালো অভিনয় করেছেন।
বাণিজ্যিক ভাবে ফাটিয়ে থাকেন এমন পরিচালক জুটি হলেন নন্দিতা-শিবু । গত বছরও তাঁরা তাঁদের সামাজিক যাত্রাপালা উপহার দিয়েছেন। ‘গোত্র’ এবং ‘কন্ঠ’। অন্যান্য বছর তাঁদের ছবির বিক্রির যে রমরমা থাকে গত বছর সে তুলনায় তাঁদের বিক্রি কম। হয়ত দর্শক ধীরে ধীরে তাঁরা যে ধরনের সিনেমা বানান সেদিক থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন।
অনেক দিন পর অপর্ণা সেন ছবি বানালেন। গত বছর মুক্তি পেল ‘ঘরে বাইরে আজ’। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ নির্ভর এই ছবি। রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থেকে অবধুনিক সময়ে গল্পকে নিয়ে এসেছেন অপর্ণা। কিন্তু তাঁর নিজের রাজনৈতিক ধারণা এতই অস্বচ্ছ ,যে তার প্রতিফলন সিনেমায় প্রতিফলিত হয়েছে। কিস্যু দাঁড়ায় নি। নিখিলেশ এবং সন্দীপ চরিত্র দুটিকে বুঝতেই পারেন নি অনির্বাণ এবং যীশু।
অবরে সবরে ছবি বানান অতনু ঘোষ। এর আগে চমৎকার একটি ছবি বানিয়েছিলেন । ‘ময়ূরাক্ষী’। তাই তাঁর নতুন ছবি ‘রবিবার’ নিয়ে কৌতূহল ছিল। কিন্তু তিনি হতাশ করলেন। প্রসেনজিৎ এবং জয়া আহসান কে নিয়ে একটা অশ্ব ডিম্ব প্ৰসব হল।
‘ভুতের ভবিষ্যত’ বানিয়ে চমকে দিয়েছিলেন অনীক দত্ত। গত বছর অনেক ঝড় এবং ঝাপটা কাটিয়ে মুক্তি পেল তাঁর ‘ভবিষ্যতের ভূত’। সিটকম গোত্রের ছবি। কিন্তু অশ্লীলতার মাত্রা অত্যাধিক। এবং আল্টিমেটলি সিনেমা হয়নি। তাই দর্শক এবারের ছবিটিকে তেমন সাফল্য দেন নি।
সাহিত্য থেকে এবার পর্দায় এলেন গোয়েন্দা মিতিন মাসি। আনলেন অরিন্দম শীল। নাহ, জমেনি। মিতিন মাসির পাশের বাড়ির মাসিমার চেহারাটা আসেনি কোয়েল মল্লিকের চেহারায়। চরম ব্যর্থ।
অনেক কথা শোনা গিয়েছিল প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যর ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’ নিয়ে। যতক্ষণ শরৎচন্দ্র অটুট ছিলেন ততক্ষণ ছবিটি চমৎকার। তারপর কীসব করলেন পরিচালক। খোলা মাঠে তাঁবু খাটিয়ে বাইজি গানের আসরে শ্রীকান্ত উপস্থিত। বেশিক্ষণ ওই এক্সপেরিনেন্ট নেওয়া খুব চাপের।
আরেকটি ছবি সুদীপ্ত রায়ের ‘কিয়া অ্যান্ড কসমস’ । একটু নতুন ধরনের ছবি। এইটুকুই বলা যায়।
ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন’ সম্ভবত এ বছরের সব চেয়ে লাভজনক সিনেমা। এক নতুন জনর-এর ছবি বানাচ্ছেন ধ্রুব। শুধু ভাবনার নতুনত্বের জন্য এই ছবিটি তারিফযোগ্য ।
গান
এই রঙিন গানের রঙ
– অভিষেক ঘোষাল
‘‘গহন কুসুম কুঞ্জমাঝে,
তোমার জন্য বাঁশি বাজে,
এখনি কি তুমি ব্যস্ত কাজে?
এসো, তুমি এসো না…
এখানে আমার ব্যবস্থা ভালো,
তোমার জন্য মেঘ চমকালো,
শাওন রজনী ঘনঘোরকালো,
এসো, তুমি এসো না…’’
পাঠক, অনুগ্রহ ক’রে লক্ষ্য করুন, ‘শাওন রজনী’ শব্দটি। শেষ কবে বাংলা গানে এই শব্দের ব্যবহার পেয়েছিলেন মনে পড়ে? এই উচ্চারণ খানিক রাবীন্দ্রিক, কিন্তু গদগদ মধ্যবিত্তের শান্তিনিকেতনী রাবীন্দ্রিকতা নয়। এই ব্যবহার পদাবলীর, কিন্তু এটি কীর্তন নয়। অথচ, রবীন্দ্রনাথ আর কীর্তন মিশে আছে এই গানের কথাগুলোয়। এই গান ‘রঙিন’ নামে এক গানের দলের। কলকাতার নবীন গানের দল, যারা অনায়াসে শোনাতে পারে, ‘তুমি আসবে না ক’রে দিয়েছ ফতোয়া জারি,/ এই কুঞ্জপথে তাই প্রেমের মহামারী।’ এই ভাষ্য আজকের, কিন্তু এতে সাবলীল মিশে থাকে ‘কুঞ্জপথ’। নাগরিক কবিয়াল আমাদের শুনিয়েছিলেন, ‘যমুনা কোথায়, শহরে শুধু নালা!/ নোংরা বইছে টালিগঞ্জ থেকে টালা,/ রাধাকে টানছে নাগরিক বাঁশুরিয়া,/ অটোরিক্সায় বিপন্ন পরকীয়া!’ সেই শহুরে মোচ্ছবের মাঝে একটুকরো সাঙ্কেতিক নিভৃত কুঞ্জবন আমাদের। শহুরে এই পরিসরের গানই শোনায় ‘রঙিন’, কিন্তু ঠিক শহুরে ফর্ম্যাটে নয়।
তবে কি ‘রঙিন’ লোকগানের দল? মাটির সুর, বাউলাঙ্গ আর আনাড়ি একতারা? একেবারেই না। ‘রঙিন’ আদ্যন্ত শহুরে, আর সে বিশ্বাস করে নাগরিক স্মার্টনেস চারটে অসংলগ্ন কথা পরপর বসানোয় নয়, শহুরে সুরে মিশে থাকে অনেক শেডস। শহুরে লিরিক পদাবলীর তীব্র শারীরিকতা আত্মস্থ করতেই পারে, কারণ কীর্তন কেবল গ্রাম বাংলার নয়, আপামর বাঙালির সম্পদ।
নব্বইয়ের দিনগুলোয় যখন বাংলা গানের ধারা সম্পূর্ণ একার হাতে অন্য খাতে বইয়ে দিচ্ছিলেন সুমন, নাগরিক ক্লান্তি, বিষণ্ণতা আর কলকাতার প্রান্তিক বো ব্যারাকের জীবন উঠে আসছিল অঞ্জন দত্তর গানে, ‘জীবনমুখী’ তকমায় একের পর এক মুখে মুখে ফেরা মানুষের গান শোনাতে চাইছিলেন অসম্ভব স্কিলফুল নচিকেতা, সেই দিনগুলোই ছিল ’রঙিন’-এর রূপকার সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিভৃত প্রস্তুতির সময়। মধ্য কুড়ির এই যুবক তখন নতুন গানের স্বপ্নে বিভোর। সুমনকে ছাপিয়ে যাওয়া কি সম্ভব ? না, ছাপিয়ে গিয়ে নয়, কিন্তু এড়িয়ে গিয়ে ? তাও কি হয় ! সুদীপ সেরকমই কিছু চেয়েছিলেন। ‘বিজল্প’র বন্ধু কবি প্রসূন ভৌমিক মাঝেমাঝে এক একটি রাগ নির্দিষ্ট ক’রে দিতেন সুদীপকে। সুদীপের কাজ ছিল নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেই রাগের কাঠামোয় একটা গান তৈরি। এভাবেই চলছিল। গান লেখা, সুর করা, কবিতায় আশ্রয় খোঁজা। আর মনে ছিল একটা ‘রঙিন’ স্বপ্ন। একটা গানের দল হবে তাদের। যে দল ঐতিহ্যকে আত্মস্থ ক’রে বয়ে যাবে আগামীর পথে, আগমনী সুরে। যে দল মঞ্চে গাইবে নিজেদের গান, লোকগান আর নিধুবাবু-দাশরথি-গোপাল উড়ের গান। বাংলা কাওয়ালি কিংবা আধুনিক কাব্যগীতি। সবই তো নিজেদের। ‘সব আমাদের জন্য’।
পাশে দাঁড়িয়েছিলেন জয় গোঁসাই। কবি জয় গোস্বামী। এই ‘রঙিন’ আনুষ্ঠানিক পথ চলা শুরু করে ২০১৪-য়। রোটারি সদনের অনুষ্ঠানে ‘রঙিন’-এর সদস্যরা শোনাতে চেয়েছিল ছকভাঙা আধুনিক গান। আধুনিক শব্দটা গোলমেলে, বিশেষত যখন এই অনুষ্ঠানের নান্দীভাষে জয় বলেন, ‘রঙিন’ চায় কবিগান, টপ্পা, ঠুংরির ঐতিহ্য মেনে নিয়ে সমসময়ের ভাষ্যে তার কাঠামো প্রয়োগ করতে। ‘রঙিন’-এর গান যাপনে অন্তরঙ্গ থাকেন রজনীকান্ত সেন, নজরুল ইসলাম, শচীন দেব বর্মন, হিমাংশু দত্ত। থাকেন উমা বসু, সন্তোষ সেনগুপ্ত, নিশীথ সাধু কিংবা প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই আবহমানের বাংলা গানের ধারাকে রিইন্টারপ্রিট করতে চাইলো ‘রঙিন’, সুদীপের স্বপ্ন আর স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। সদ্য যুবক সুদীপ ‘রঙিন’ নামে আস্ত একটি গান বেঁধেছিলেন, রেকর্ডে ধরাও ছিল তা তার নিজের গলায়। মঞ্চে ‘রঙিন’ গাওয়া হয় নতুন ছাঁদে, নতুন সঙ্গীতায়েজনে। ‘প্রেম বাধ্যকোমল, প্রেম বদমেজাজি’ ‘রঙিন’-এর অসামান্য এক পংক্তি। রঙ দোলের এমন সব গানে সমসাময়িকতা কোথায়, ভাবতে ইচ্ছে হয়।
সমসাময়িকতা কি কেবল খানাখন্দ? জমে থাকা জল? নারীধর্ষণ কিংবা বহু ভিনধর্মীর প্রাণ বাঁচিয়ে হাসপাতালে লড়তে থাকা একলা যুবক? প্রলেপ সমসাময়িক নয়?
‘কী হয় যদি না ভাবি, কী ছিল আমার দাবি?
কী ছিল তোমার শ্রান্তির অধিকার?
কোন্ পরিযায়ী পাখি, রাখে বলো ধার বাকি?
ওড়ার মুহূর্তই তার সংসার।’
এই স্ফুলিঙ্গের পাখায় ‘ক্ষণকালের ছন্দ’ পাওয়াই ‘রঙিন’, মঞ্চে আর জীবনমঞ্চে যারা সমান খেয়ালী। ‘রঙিন’ বছরে কয়েকবার মঞ্চে ওঠে। কোনো বৈদ্যুতিক বাদ্যযন্ত্রের উচ্চকিত আত্মঘোষণার সঙ্গে তার সঙ্গীতদর্শনের বিরোধ। তারা কমফর্টেবল তবলা, শ্রীখোল, বেহালা কিংবা ডুবকিতে। গীটার থাকে, কিন্তু ইলেকট্রিক নৈব নৈব চ। হারমোনিয়াম। ‘সমস্ত সুর হন্তদন্ত’ হারমোনিয়াম। অম্লান, সুমন, মৃণালকান্তি কিংবা গৌতমের মত সরস্বতীর বরপুত্ররা ’রঙিন’। মধুমিতা, শঙ্খমালা, শ্রুতি কিংবা সুদীপ-মিলে ‘রঙিন’।
‘থাক্ তবে থাক্, থেমে থাক্ না
সময়ের অসময়ী পাখনা-
গন্ধে পেয়েছি যার, আঁচলের সমাচার,
সে কলসে না দেবো না ঢাকনা।’
‘রঙিন’-এর তৈরি একটা বাংলা কাওয়ালি এটা। কাওয়ালির পরিচিত ঢং তার দেশকালের সীমা লঙ্ঘন ক’রে মিশে যেতে চায় বাংলা ভাষায়। ‘যে ভাষার জন্যে এমন হন্যে এমন আকুল’ সবাই, তাকে প্রণতি জানিয়ে ‘রঙিন’-এর শঙ্খমালা লেখে, ‘ভাষা এবং ভালোবাসা এক নৌকোর নবী,/ ভীষণ ভালোবাসলে তবে ভুলবে ভাষার ভবি’। শঙ্খমালা পাশ্চাত্য মার্গসঙ্গীতে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। তার সুরে সেই প্রভাব মেলে স্বভাবতই।‘রঙিন’ সদস্য মধুমিতার কন্ঠে প্রাণ পায় লালন কিংবা শাহ আবদুল করিম। তার গলায় এক আশ্চর্য পিওরিটি আছে, প্রাকৃত প্যাশন। আর অতুলপ্রসাদী অলৌকিকতায় শ্রুতির গানে মিশে যায় নতুন ঝিনুকে লাগা পুরোনো আদর— ‘আমায় ডোবাও যদি, ডোবে কি সাগর
নতুন ঝিনুকে লাগে পুরোনো আদর।
তন্দ্রা আমায় দেয় অস্থিরতা!’
এই দলের বেশকিছু গান ইতোমধ্যে বেশ জনপ্রিয়। ‘সোনাঝুরি বনের একাকী’ শোনেননি, কলকাতায় আজ বাংলা গানের এমন শ্রোতা দুর্লভ। আর হবে নাই বা কেন? স্মার্ট ছিপছিপে উচ্চারণ আজকের প্রজন্মকে টানে, আর মেদুর মূর্ছনা নস্টালজিক করে পুরোনোদের। বাংলা গান থেকে যখন ক্রমশ বাঙালির সাউন্ডস্কেপ উড়ে যেতে বসেছে, ‘রঙিন’-এর সুর আশ্রয় দেয় শ্রোতাকে। সুরের আবেদন নতুন পুরোনো মানে না। ‘সুরের দেশভাগ হয় না’- এটা ‘রঙিন’-এর লেখা, আচার্য কবীর সুমনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে।
‘রঙিন’ বিকল্প সংস্কৃতির হদিশ দেবার কথা বলে না ঠিক। কারণ অতো সাহস তাদের নেই। চারিদিকে যখন ‘অন্যরকম’ কিছু করার ধুম লেগেছে, ট্র্যাশস্য ট্র্যাশও যখন ‘ইউনিক’ স্রেফ প্রচারের জোরে, আপনারা ‘রঙিন’-এর ফেসবুক পেজ ঘুরে আসুন। দেখবেন শেয়ার করা হয়েছে টি এম কৃষ্ণা, অর্পিতা কার্লেকর, বিদূষী গিরিজা দেবীর গান। পাবেন কিশোরী আমনকর, ওঙ্কারনাথ কিংবা কবিতা কৃষ্ণমূর্তি। শেয়ার করা হয় নচিকেতা ঘোষ, পান্নালাল ভট্টাচার্য, নির্মলা মিশ্রর গান। যদু ভট্ট কিংবা বিষ্ণুপুরী ঘরানার ধ্রুপদও অমিল নয়। আমাদের জানাবোঝার মধ্যে একমাত্র ‘রঙিন’ই সেই দল, যারা মঞ্চে দিলীপকুমার রায় গাওয়ার স্পর্ধা দেখান। ভুল হয়, ভুল শুধরে শ্রুতি আবার গেয়ে ওঠে, ‘বাঁশি ডাকে ওই যমূনার কূলে, আসি আসি বলে প্রাণ’। দিলীপকুমার রায়। দ্য মিউজিকাল জিনিয়াস দিলীপকুমার রায়। সেই কুঞ্জবন, যমুনার কূল আর রাধা-কৃষ্ণের প্রত্নকল্প। এও কি সমসাময়িক? অবশ্যই। সমসাময়িক এর অ্যাপ্রোচে, এর সুরকাঠামোয়। আধুনিক তার চলনে। ‘রঙিন’ এটাই বিশ্বাস করে। চিরন্তন কি আধুনিক নয়? সমসাময়িক আর শাশ্বত কি হাত ধরাধরি করতে পারে না? আধুনিকতা কী ক’রে ঐতিহ্য বিস্মৃত হবে? কী ক’রে ভুলে যাবে তার শিকড়? ‘রঙিন’ তার সাংগীতিক প্রয়াসে এই অতীতকে, শিকড়কে পুনরাবিষ্কারে রত। পাশে থাকুন।
‘তোমায় গোপন বলবো, কিন্তু বলার সে পথ কোনদিকে?
এতো দিন ধরে পুষেছি, ছি ছি, মন পোড়া মন বন্দীকে।
তুমি কি এখন ঘুমোচ্ছো? বলো, সুখনিদ্রায় স্বপ্নময়,
তোমায় সঠিক চাইনি বলেই বুঝেছি আঁধার মন্ত্রময়।
অন্ধকারেও স্পর্শ হয় …’
বাংলা গানের লিরিক থেকে কাব্যত্ব হারাচ্ছে ক্রমে। ‘রঙিন’ সেই কাব্যগীতির শুকিয়ে যাওয়া ধারাকে ফিরে দেখতে চায়। এই দল বলতে পারে, ‘মরমিয়া, ঘুমিও না, বসন্তদিন পালাচ্ছে’। ‘বসন্ত এসে গ্যাছে’র একঘেয়েমি যখন প্রায় সুমন কল্যাণপুরকে ভুলিয়ে দিয়েছে, ‘বসন্তদিন পালাচ্ছে’ ব’লে কী প্রমাণ করতে চায় এরা? এটাই, যে বসন্ত চিরস্থায়ী নয়, কিন্তু যেটুকু আছে বেঁচে নিতে হবে। হবেই। ‘মরমিয়া, ঘুমিও না, বসন্তদিন পালাচ্ছে।/ এখনও আমার প্রেম বাকি,/ আজ রাত্রেই চৈত্র শেষ,/ ভোর হ’লে কাল বৈশাখী!’ এখনও অনেক প্রেম বাকি। সেই বাকি, ‘না পাওয়ার রঙ নাও তুমি …’
সম্পাদক বললেন:
দুই হাজার বিশ , অনেকের ব্যাখ্যায় বিষাক্ত একটা বছর। অনেকের কাছে শিক্ষার। কেউ বলছে শিক্ষার বটে, কিন্তু শিখছে কে? শেখার হলে উনিশশো বিশ- ই তো যথেষ্ট ছিল। যা শিখলে, জানলে বুঝলে পৃথিবীর অসুখ সারে, সে শিখতে দিচ্ছেই বা কে ? নিউ নরমাল মানে তো যে স্বাভাবিক পরিমন্ডলে অস্বাভাবিক শাসন শোষণ চলছিল, তাই ফিরে আসা!
মার্চ থেকে ভাণ ও মার খাচ্ছে। কী করবে, কী করবে ভেবে পত্রিকাটিকে ই – ফরম্যাটে বার করা হবে মনস্থ হলো। এবং বাৎসরিক দুটো, বড়জোর তিনটি সংখ্যার ভাণ কে মাসিক প্রকাশেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া গেল। প্রয়োগ কলা বিষয়ক রকমারি লেখা যেমন ছিল, তেমন থাকবে। যদিও তার বিস্তার কিছু বেশি হবে বলে আশা করা যায়। প্রতি ইংরেজি মাসের এক তারিখে এটি আপনাদের কাছে পৌঁছে যাবে। আপাতত বিনি পয়সায় এমনটিও সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে শুভানুধ্যায়ীদের থেকে সাহায্য চাওয়া হবে, প্রয়োজনীয় খরচ সামাল দিতে।।আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা এই, ই- ভাণের নির্বাচিত রচনা নিয়ে বৎসরান্তে একটি ছাপা সংকলন প্রকাশিত হবে।
এই সংখ্যায় অভিনয়ের নানা মঞ্চ নিয়ে জুলফিকার জিন্নার একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা রইলো। মুক্ত ও অন্তরঙ্গ মঞ্চ নিয়ে নিজের কাজের অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন প্রশান্ত ও প্রিয়া। প্রসেনিয়ামের বাইরের নাট্য চর্চা নিয়ে সুচিন্তিত মন্তব্য করলেন একালের এক প্রধান নাটককার উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় এবং সু- অভিনেতা, তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনাময় নির্দেশক কৌশিক কর । ২০১৯, চলচ্চিত্রের কেন উল্লেখযোগ্য বছর নয়, জানালেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সমালোচক অনিরুদ্ধ ধর। বাংলা গানের রঙিন এক জগত নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রস্তুত করলেন অধ্যাপক গবেষক অভিষেক ঘোষাল।এই নিয়ে প্রথম ‘ই’ ।
অনেকে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। ভাণ ও কাজে ফিরলো। আশঙ্কা থাকলো কিছু। সে থাক , পালিয়ে কি বাঁচা যায়?