দশম সংখ্যা, তৃতীয় ই-সংস্করণ, নভেম্বর ২০২০

ভাণ পত্রিকা

দশম সংখ্যা, তৃতীয় ই-সংস্করণ, নভেম্বর ২০২০

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :

প্রচ্ছদ :

অয়ন্তিকা সাজোয়াল

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

ও মৌলিকা সাজোয়াল

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) [email protected] ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সূচি

সম্পাদকের কথা

১. সদ্য প্রয়াত অমলা শঙ্কর কে স্মরণ করলেন – শ্রীপর্ণা

২. পথের নাটক দেখতে গিয়ে নাটকের পথের সন্ধান পেলেন পার্থ হালদার নাট্য: ইঁদুর কল – পার্থ হালদার

৩. কালী কাল্ট নিয়ে গড়গড় করে দু’ চারটি কথা পাড়লেন – বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

৪. পুরাণ থেকে তন্ত্রে কালিকা সংস্কৃতির সন্ধানে – সুজয় কৃষ্ণ চক্রবর্তী

৫.” হাজার চুরাশির মা” নাট্য নির্মানের গল্পে – মীনাক্ষী সিনহা

৬. “Breathe”  ওয়েব সিরিজের শ্বাস প্রশ্বাস মাপতে বসলেন – অজন্তা সিনহা

৭. প্রসেনিয়াম এর বাইরে রঙ্গের নানা মঞ্চ নিয়ে মন্তব্য করলেন – মৈনাক সেনগুপ্ত

অবন্তী চক্রবর্তী

৮. তৃতীয় থিয়েটার ও দুটি নাট্য পত্র নিয়ে কলম ধরলেন – আশীষ গোস্বামী

৯. অল্টারনেটিভ স্পেসে কাজের অভিজ্ঞতা শোনালেন – গুলশানারা খাতুন

সায়ন্তন চক্রবর্তী

সম্পাদকের কথা

উৎসবের মরসুম। দুর্গার বিসর্জনের বিষাদ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই লক্ষ্মী- কালী -জগদ্ধাত্রী ! এই বাঙলাদেশ। এই বাঙালি। এই আমরা। আমাদের কিছুই ফুরোয় না। কখনো শেষ হয় না। একটা শেষ মানেই অন্যকিছুর শুভারম্ভ। কিন্তু উৎসবের দিনগুলিতে বিষাদ আর আশঙ্কার বাস্তবকে কিছু দিনের জন্যেও আলাদা করা গেল না এবারে। ভারত ১০৭ টি দেশের মধ্যে ক্ষুধার সূচকে লজ্জাজনক ৯৬ তম স্থানাধিকারী হয়ে জগৎ সভায় নিকৃষ্ট উদাহরণ রেখেছে। কাজ নেই, খাদ্য নেই, নিরাপত্তা নেই। শুধু লোভ লালসা হিংসা অস্পৃশ্যতা প্রাদেশিকতা সাম্প্রদায়িকতার হুঙ্কার। সঙ্গে আছে মহামারীর প্রকোপ। আর আমাদের হঠকারিতা, অবিবেচনা এবং  হাস্যকর হুজুগ ও হুজ্জুতির প্রতি মোহান্ধতা।

 

থিয়েটার ভালো নেই। চলচ্চিত্র ভালো নেই। গান বাজনার মন খারাপ।  সময় নিজেই এখন এমন নাটকীয় তাকে নাট্য দিয়ে ধরা যায় না। এমনই বেসুরো পরিস্থিতি এখানে গান বাঁধা যায় না। এমন এবড়ো খেবড়ো ভূমি ও ভূমিকা নৃত্যকলা হোঁচট খেয়ে পড়ে।

 

তবু সময়ের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে। আহত হয়েও শিল্প কে পথ খুঁজতে হয়। তেমনি একটি সমকালীন নাট্য , মানুষের নাট্য নিয়ে লিখেছেন পার্থ। এসময়ের ‘ ইঁদুর কল’ নিয়ে। হাজার চুরাশির মা এর নাট্য নির্মাণ ও অভিজ্ঞতার গল্প শুনিয়েছেন  অধ্যাপক নাট্যজন মীনাক্ষী সিনহা। এই অসময়ে বহু উঁচু মার্গের শিল্পীকে  সজল নেত্রে বিদায় জানিয়েছি আমরা। তাঁদেরই একজন বিশ্বখ্যাত নৃত্য শিল্পী অমলাশঙ্করকে নিয়ে লিখেছেন শ্রীপর্ণা। অজন্তা সিনহা লিখেছেন একটি বিখ্যাত ওয়েব সিরিজ নিয়ে। খুবই স্বতন্ত্র তাঁর লেখনী। এছাড়াও এই সংখ্যার বিশেষ আকর্ষণ আসন্ন কালী পূজার আবহে কালিকা সংস্কৃতি ও কালী কাল্ট কে নিয়ে প্রবীন ও নবীন দুই অধ্যাপকের দু দুটি মনোজ্ঞ নিবন্ধ। অধ্যাপক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অধ্যাপক সুজয় কৃষ্ণ চক্রবর্তী।

 

এছাড়াও বিষয় বিশেষ শিরোনাম ” রঙ্গের নানা মঞ্চ” কে মাথায় রেখে প্রখ্যাত নাট্য গবেষক আশিষ গোস্বামীর  নিবন্ধ এবং নাটককার মৈনাক ভৌমিক ও নাট্য নির্দেশক অবন্তী চক্রবর্তীর প্রাসঙ্গিক মন্তব্য পাঠককে নিঃসন্দেহে ভাবাবে।  প্রেক্ষাগৃহের বাইরের নাট্য চর্চার জ্যান্ত অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন সায়ন্তন চক্রবর্তী ও গুলশানারা খাতুন।

 

প্রতিমাসের মাস পয়লায় ভাণ পত্রিকা পেতে সাবস্ক্রাইব করুন। নিজে পড়ুন। পাশের জনকে পড়তে বলুন। কেমন লাগছে ভাণ? জানাতে আমাদের মেল করুন। ভালো মন্দ জানান। আরও ভালোর পরামর্শ দিন। ভালো থাকবেন। পরের সংখ্যা কথা মতো পয়লা ডিসেম্বরে। আরো নতুন নতুন লেখা নিয়ে ,ভাবনা নিয়ে ভাণ হাজির  হবে যথাসময়ে।

স্মরনে কিংবদন্তী নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্কর

 
 

শ্রীপর্ণা ভট্টাচার্য

 
 
 
 
 

নৃত্যের তালে নৃত্যের বোলে নৃত্যের মায়া কাটালেন ১০১ বছরে ।

 
 
 

অমলা শঙ্কর কিংবদন্তী নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের স্ত্রী, এবং কিংবদন্তী শিল্পী রবিশঙ্করের ভ্রাতৃজায়া।

 

এক তরুণী নৃত্যশিল্পী হিমালয়ে নাচের পূর্ণাঙ্গ চর্চাকেন্দ্র গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। আর্থ-সমাজিক

 

পরিস্থিতি নানাভাবে তাঁর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, উদয়শঙ্করের অনবদ্য সৃষ্টি ‘কল্পনা’র

 

(১৯৪৮) বিষয়বস্তু ছিল এটাই। আর এই ‘কল্পনা’কে বাস্তবে অবিস্মরণীয় করে তুলেছে

 

অমলাশঙ্করের নৃত্য।২০১২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় ‘কল্পনা’ চলচ্চিত্র।

 

কিংবদন্তী অমলাশঙ্কর আমন্ত্রিত হন এই উৎসবে এবং রেড কার্পেটে অভ্যর্থনা জানানো হয় তাঁকে।

 
 
 
 
 
 

২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিংবদন্তী নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্করকে ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মান প্রদান

 

করেন।

 

শেষবার অমলা শঙ্করকে মঞ্চে দেখা গিয়েছিল ২০১১ সালে। ৯২ বছর বয়সে ‘সীতা স্বয়ম্বর’

 

নৃত্যনাট্যে অভিনয় করেছিলেন তিনি। রাজা জনকের চরিত্রে দেখা মিলেছিল তাঁর।

 
 
 
 
 
 
 
 

সেই বছরই আরেকটি নৃত্যনাট্যে ‘মিসিং ইউ’তেও অংশগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর দেখানো পথেই

 

এগিয়েছেন গোটা বিশ্বের অসংখ্য নৃত্যশিল্পী। অমলা শঙ্করের নৃত্য পরম্পরায় সমৃদ্ধ বাংলার

 

সংস্কৃতি। নাচের পাশাপাশি আঁকতেও ভালোবাসতেন অমলা শঙ্কর। তবে কোনওদিন তুলি দিয়ে

 

ছবি আঁকেননি তিনি। হাত দিয়েই ক্যানভাসে রঙ করতেন । তাঁর কিছু চিত্র ‘লাইফ অফ বুদ্ধ’

 

এবং ‘রামলীলা’র মতো নাটকে ব্যবহৃত হয়েছে।

 
 
 

ভারতনাট্যম থেকে অনুপ্রাণিত তাণ্ডব নৃত্যের আঙ্গিকে পার্বতীর ভূমিকাতেই হোক (শিব- উদয়শঙ্কর), অথবা

 

কথাকলি ভিত্তিক অনন্য ধারার ‘কার্তিকেয়’র শুরুর দৃশ্যে ধ্রুপদী ও লোকায়ত নৃত্যের অসামান্য সংমিশ্রণে,

 

কিংবদন্তী স্বামী উদয়শঙ্করের পাশে চিরকাল সমুজ্জ্বল থেকেছেন তাঁর স্ত্রী তথা কিংবদন্তী নৃত্যশিল্পী

 

অমলাশঙ্কর।

 
 
 
 

উদয়শঙ্করের মতো বিরাট মাপের শিল্পীর সঙ্গে অমলাশঙ্কর কেবল সঙ্গত করে গিয়েছেন এমন নয়, বরং

 

শিল্পকর্মে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন বরাবর। খাঁটি ধ্রুপদী ঘরানা থেকে উঠে আসা বিভঙ্গের সঙ্গে পরিমিতি

 

বোধ ও সমসাময়িকতার মিশেলই অমলা শঙ্করের নৃত্যকে কালজয়ী করেছে। পরবর্তীকালে উদয়শঙ্করের

 

পরম্পরাকে আরও সম্প্রসারিত করেছেন তিনি। সাতটি ধ্রুপদী নৃত্য ধারার সঙ্গে ভারতের লোকনৃত্যের

 

সংমিশ্রণ ঘটিয়ে অমলাশঙ্কর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নৃত্যশিল্পকে এক ভিন্ন মাত্রায় উপস্থিত করেছেন।

 
 
 

১৯১৯ সালের ২৭ জুন জন্ম হয় তাঁর বাংলাদেশের যশোর জেলায়, তখন তিনি ছিলেন অমলা

 

নন্দী।১৯৩০ সালে প্যারিসের উদ্দেশে রওনা দেন স্বর্ণ ব্যবসায়ী বাবা অক্ষমকুমার নন্দীর সঙ্গে।

 

উপলক্ষ ছিল আন্তর্জাতিক ঔপনিবেশিক প্রদর্শনীতে ভারতীয় কারূকর্মের প্রতিনিধিত্ব করা ।সেখানেই

 

শঙ্কর পরিবারের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি ঘটে।

 
 
 

বছর ত্রিশের উদয়শঙ্কর ততদিনে নৃত্যদুনিয়ায় পরিচিত নাম।মুম্বইয়ের ‘জে জে স্কুল অব আর্টে’ পড়া শেষ

 

করে ‘রয়্যাল কলেজ অব আর্টে’ চিত্রকলা নিয়ে পড়ার জন্য ততদিনে লণ্ডনে পাড়ি দিয়েছেন উদয়শঙ্কর।

 

সেখানে পরিচয় হয় বিখ্যাত রাশিয়ান ব্যালে শিল্পী আনা প্যাভলভের সঙ্গে ।সেখানেই ‘রাধাকৃষ্ণ’ এবং

 

‘একটি হিন্দু বিবাহ’ নামের দুটি ব্যালেডের অনুষ্ঠান করেন উদয়শঙ্কর রাশিয়ার প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী আনা

 

প্যাভলভের সঙ্গে। আনা প্যাভলভের ও উদয়শঙ্করের নৃত্যাভিনয় মুগ্ধ করে পশ্চিমী দুনিয়াকে। তারপর

 

তিনি নিজ দেশে ফিরে নিজ দল গঠন করেন এবং ভারতীয় ভাবধারাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি করেন

 

এক নতুন নৃত্য-ধারা, যা কেবলমাত্র সমবেত যন্ত্র সংগীতের সাহায্যে ভারতীয় নৃত্যনাট্য

 

উপস্থাপিত করা যায় ।

 
 
 
 
 
 

১৯৩০সালে উদয়শঙ্কর তাঁর দল এবং মা হেমাঙ্গিনী দেবীকে নিয়ে ফ্রান্সে অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিলেন ।

 

আর তখনই পরিচয় ঘটে অমলা নন্দী ও তাঁর বাবা অক্ষমকুমার নন্দীর সাথে।হেমাঙ্গিনী দেবীর

 

অমলাকে দেখেই পছন্দ হয়।সেখানেই অমলাকে নাচের কয়েকটি মুদ্রা চেষ্টা করে দেখতে বলেন উদয়শঙ্কর।

 

ঠিক যেমনটা বলেছিলেন, ছোট্ট অমলা হুবহু তা করে দেখান। অমলার সেই নাচ দেখে মুগ্ধ হন উদয় এবং

 

তাঁর মা হেমাঙ্গিনী দেবী। তিনি অমলার বাবাকে অনুরোধ করেন যাতে তিনি ২ মাসের জন্য ইউরোপে মেয়েকে নাচের অনুষ্ঠান করার অনুমতি দেন। তার কিছুদিন পর থেকেই উদয় শঙ্করের কাছে নাচের তালিম নেওয়া শুরু করেন এবং দলের সাথে নৃত্যের প্রদর্শনী করেছেন বিভিন্ন দেশ-

 

বিদেশে ।এর পরে ১৯৪২ সালে ৮ই মার্চ তাঁদের বিয়ে হয়। বিশ্বের অন্যতম চর্চিত নৃত্যুশিল্পী- দম্পতি হয়ে উঠেন উদয় শঙ্কর ও অমলা শঙ্কর।

 
 
 
 
 
 
 

তাঁদের প্রথম সন্তান ছিলেন আনন্দ শঙ্কর জন্ম নিয়েছিলেন ওই বছরেরই ডিসেম্বরে ।১৯৫৫ সালের

 

জানুয়ারি মাসে কন্যা মমতা শঙ্করের জন্ম হয় ।তাঁদের দুই সন্তানকেই অভিনয় ও নৃত্যের তালিম

 

দেন তাঁরা নিজেরাই।পরবর্তীকালে নৃত্য জগতে গোটা শঙ্কর পরিবারই বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করে।

 
 
 

১৯৭৭ সালে শিল্পী উদয় শঙ্করের মৃত্যুর পর বহু বছর শিল্পচর্চা এবং শিক্ষা চালিয়ে গিয়েছেন অমলা

 

শঙ্কর। ১৯৯৯ সালে আনন্দ শঙ্করের মৃত্যুর পর পরবর্তী সময়ে তাঁদের পরিবারে নৃত্যের ধারা

 

এগিয়ে নিয়ে চলেছেন কন্যা মমতাশঙ্কর ও পুত্রবধূ তনুশ্রীশঙ্কর।আজও তাঁদের দেখানো পথেই

 

এগিয়ে চলেছেন অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। আর তাঁদের নৃত্যের এই পরম্পরা সমৃদ্ধশালী করে তুলেছে

 

বাংলার সংস্কৃতিজগতকে।২০২০ সালের ২৪ শে জুলাই শুক্রবার সকালে ১০১ বছর বয়সে শিল্পী

 

অমলাশঙ্করের জীবনাবসান হয়। তবে তিনি চির অমলিন হয়ে রইবেন কল্পনায় এবং সংস্কৃতির আকাশে।

ইঁদুরকলঃ দুঃসময়ের একটি সাহসী প্রযোজনা

পার্থ হালদার

 
 

বিগত ছয় মাসের কিছু বেশিদিন আমরা তথা পুরো বিশ্ববাসী এক প্রকার থেমে

 

গিয়েছি। যাঁরা থামতে জানতেন না, তাঁরাও থেমেছেন বাধ্য হয়ে। অদৃশ্য এক

 

মানবশত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য। বদলে গেছে জীবনযাত্রা। প্রত্যেকটি

 

মানুষের। কিন্তু আবার ধীরে ধীরে ‘ নিউ নর্ম্যাল ’ কে সঙ্গী করে পুরোনো পথে

 

হাঁটছেন অনেকে। আবার অনেকে এখনোও থেমেই আছেন। হয়তো কারণে , হয়তো

 

আবার ভয়ে। যেহেতু ব্যক্তিগত ভাবে বিগত সাড়ে তিন বছর বাংলা থিয়েটারের

 

সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে যুক্ত তাই থিয়েটারের চিত্রটি যে সাদা কাগজে সাদা রঙ

 

দিয়ে ছবি আঁকার মতো হয়ে আছে সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই। ১লা অক্টোবর থেকে

 

খুলেছে থিয়েটারের রঙ্গমঞ্চ। তার আগে একপ্রকার সিঁটিয়ে-সেঁধিয়ে এই

 

থিয়েটার বসেছিল সমাজের এক কোণায়। দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনের কারণ

 

হিসেবে থিয়েটার, শিল্পের গুরুত্ব যে সর্বদা তিন পা পিছিয়ে তা এই সংকটকালে

 

ঢের বোঝা গেল। তবুও রবীন্দ্রনাথের শব্দানুযায়ী ‘ অপ্রয়োজনের আনন্দ ’ যে

 

কড়া নাড়ে মনে গভীরে, সেই ডাকের কী হবে? এই ডাকের সাড়া বিগত ছয় মাসের

 

মধ্যে নানা থিয়েটার কর্মী, শিল্পী নানান ভাবে দিয়েছেন। মূলত বায়বীয় মাধ্যমে,

 

অর্থাৎ ভার্চুয়ালি। উপায় ছিল না। এরই মধ্যে অগাষ্ট মাসে বাংলার একটি

 

থিয়েটার দল ‘ জনগণমন ’, চিরাচরিত মার্জিন থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের মাঝে

 

নিয়ে গেল থিয়েটারকে। যখন সরকার ৫০ জনের জমায়েতকে অনুমতি দিয়েছে।

 

নাটিকার নাম ‘ ইঁদুরকল ’। কী এই নাটিকার বিষয়বস্তু?

 
 
 
 
 
 
 
 

একটি ছোট্ট চাষীর ঘরে এক ইঁদুর কে মারার জন্য চাষী এবং তার স্ত্রী

 

দীর্ঘদিন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু নানা ভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন। শেষমেশ নানা

 

ফন্দি-ফিকির এঁটে চাষীর পরিবার খোঁজ পেল ‘ ইঁদুরকল ’এর। ইঁদুর নিজের

 

সংকটজনক পরিস্থিতির কথা ভেবে মুরগী, শিক্ষিত পাঁঠা, পুরোহিত পায়রার কাছে

 

যায় সাহায্যের জন্য। কিন্তু পুরোহিত পায়রা ইঁদুরকে মুসলমান বলে তাড়িয়ে দেয়।

 

দূর ছাই করে নিজের এলিট ক্লাসকে বজায় রেখে গরিবের তকমা লাগিয়ে মুরগী

 

ভাইও সাহায্যের হাত ফিরিয়ে নেয়। অন্যদিকে ইংরেজি বুলি আওড়ানো তথাকথিত

 

বুদ্ধিজীবী পাঁঠা ইঁদুরের মানসিক অবস্থার কথা বুঝেও নিজের মালিকের পাশে

 

দাঁড়াতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে। মনের কষ্টে ইঁদুর পাড়ি দেয় ভিন্ন স্থানে। জয় হয়

 

মালিক পক্ষের। বাকিরা মনের আনন্দে মালিকের সঙ্গে সহাবস্থান করে। কিন্তু

 
 
 
 
 
 
 
 

একদিন সেই ইঁদুরকলের কলে একটি সাপ ধরা পড়ে এবং সেই সাপের কামড়ে মর-

 

মর অবস্থা হয় চাষীর বউয়ের। ওঝা এসে বিধান দেয় পায়রার মাংস এই রোগের

 

অন্যতম ওষুধ। খাওয়াতেই হবে। এইবার শুরু হয় ক্ষমতার প্রয়োগ নির্বিচারে।

 

পুঁজিবাদের চরিত্র হয় উন্মোচন। পুরোহিত পায়রা মারা পড়ে সবার আগে।

 

তারপরেও যখন শরীর ঠিক হয় না তখন বিধান আসে মুরগির ঝোলের। অতঃপর

 

নিধন হয় পোষা মুরগির। কিন্তু অদৃষ্টের লীলা দেখুন, এত করেও বউ বাঁচলো না।

 

বুদ্ধিজীবী পাঁঠা মনে করলো, তার শিক্ষে কাজে এসেছে। সবাই জাঁতাকলে ফেঁসে

 

গেলেও , সে কিন্তু এইসবের থেকে উর্ধ্বে। কিন্তু বৃহৎ ত্যাগের স্বার্থে যে

 

তাকে বলি হতে হবে এ কথা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সে। বউয়ের শ্রাদ্ধে লোক

 

খাওয়ানোর জন্য চাষী তার শিক্ষিত পাঁঠার বলি দিল। অতঃপর, মালিকপক্ষের

 

দানা খাওয়া মুরগি, পাঁঠা, পায়রা মালিকপক্ষেরই ইঁদুরকলের জন্য জীবন হারালো।

 

ইঁদুর বহুদিন আগে বারণ করলেও নিজেদের ‘ সেফ জোন ’ থেকে তারা কেউ বেরিয়ে

 

এসে সাহায্য করতে চায়নি। ভেবেছিল এই বেশ ভালো আছি, সুখে থাকতে ভূতে

 

কিলায় নাকি! কিন্তু আজ না হোক কাল ক্ষমতার তৈরি জাঁতাকলে প্রত্যক্ষ বা

 

পরোক্ষভাবে সকলকেই যে পড়তে হবে তা বুঝিয়ে দিয়ে যায় এই নাটিকা পরতে

 

পরতে। বোঝা যায় আজ যা আমাদের সুখের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না, যা আমরা

 

রবিবারের মাংসের চোয়া ঢেকুরের সঙ্গে বলি ; “ অতো ভেবে কী হবে, আমরা তো

 

ভালো আছি ” , সেই আমাদের মেদওয়ালা গালে সপাটে চড় মেরে দিয়ে যায় এই

 

নাটিকা।

 
 
 
 
 
 
 
 

নাটককার রাজা বিশ্বাস রূপকের আড়ালে এই নাটিকা শুরু করলেও নাটিকার শেষে

 

খুব দৃঢ় কন্ঠে সেই রূপকের বর্মকে ভেদ করে সত্য বলেছেন। দৃপ্ত কন্ঠে ‘

 

নিরপেক্ষ ’ শব্দটির পৃথুল ব্যাখ্যার বিরোধীতা করে, পক্ষ নিতে বলেছেন। আজ

 

যে কৃষিবিল আমাদের ৫০টাকা কেজি মিনিকেট চাল কেনার পথে বাধা হয়ে

 

দাঁড়াচ্ছে না, কাল তা যে আমাদের শোষণ করে নিংড়ে নিতে পারে সেই আশঙ্কার

 

কথা বলেছেন। চোখে চোখ রেখে বলেছেন, যে কাশ্মীর, আসাম নিয়ে আমাদের

 

কোনো মাথাব্যথা নেই, তা ভবিষ্যতে আমাদের ঘরে ঘরে ত্রাস সৃষ্টি করতে

 

পারে। শিরদাঁড়া সোজা রেখে আমাদের বুঝিয়েছেন , যে বাবরি মসজিদের ঐতিহাসিক

 

রায় নিয়ে আপনার কোনো হেলদোল নেই, সেই রায় ভবিষ্যতে আপনার নিজের

 

পরিবারের জন্য একটি ভয়াল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।

 

শুধু বিষয়বস্তু নয়, তার নির্মাণেও আছে পেশাদারিত্বের ছাপ। সঙ্গে শিল্পের

 

ছোট ছোট গিট গুলো সুচারু ভাবে বেঁধেছেন পরিচালক শুভঙ্কর দাশশর্মা। শুরুতে

 
 
 

চেনা বলিউডি গানের প্যারোডি দিয়ে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে সেটি

 

তিনি বুঝেছেন। কারণ নাটিকাটি সবশ্রেণীর মানুষের জন্য। মাত্র পাঁচ অভিনেতার

 

উপস্থিতিতে ( পরিচালক সহ ) এই নাটিকার উপস্থাপনা হয়েছে। প্রত্যেক

 

অভিনেতা নিজেদের জায়গায় সাবলীল এবং স্পষ্ট। সাবলীল বললাম কারণ, আমার

 

নাট্যগুরু শ্রী গৌরাঙ্গ দণ্ডপাট সবসময় বলেন, একটি রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা

 

নিয়ে তৈরি নাটকে যাঁরা যাঁরা অভিনয় করবেন , তাদের সকলের আদর্শ এবং

 

পলিটিক্যাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং যদি এক না হয় তাহলে সেই নাটকে ফাঁক থেকে

 

যায়। কিন্তু এই নাটিকায় কোনো ফাঁক পাইনি। সকল অভিনেতারা অন্তত

 

মানসিকভাবে এক সরলরেখায় এই নাটিকায় অভিনয় করেছেন বলেই বিশ্বাস।

 

স্পষ্ট বলার কারণ, পথনাটক করার অনেক অসুবিধা আছে। যাঁরা করেন তাঁরা

 

জানেন। সেই অসুবিধাগুলো মাথায় রেখে কখন উচ্চাঙ্গে গান গাইতে হবে, কখন

 

নিচু স্বরে সংলাপ বলতে হবে, কখন একটা গাড়ি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলে তাকে নিয়ে

 

স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটি সংলাপ তৈরি করে সেই বাধা পড়া মুহূর্তকে এড়িয়ে যেতে

 

হবে , এইসব কিছুর স্পষ্ট ধারণা রেখেছেন সকলে। ঐ যে বললাম, পরিচালক

 

সুন্দর করে গিঁটগুলো এঁটেছেন। নাচ, গান, কায়িক অভিনয়ে অনেক বেশি এগিয়ে

 

কুনাল চক্রবর্তী এবং মিষ্টি মন্ডল। এইরকম তেজি এবং সক্রিয় অভিনয় খুব

 

কম দেখা যায়। মূলত গানের ক্ষেত্রে সুদীপ দে’র গান আমার ভালো লেগেছে।

 

ভিড়ের মধ্যেও কানে বাজে। তুলনায় পরিচালক শুভঙ্কর দাশশর্মা এবং বাজনদার

 

তথা অভিনেতা সূর্য রায় একটু পিছিয়ে।

 
 
 
 
 
 

তবুও আমার সবথেকে ভালো লেগেছে একে অন্যের সমন্বিত অভিনয়। কোনো

 

ব্যক্তি নয়, দলগত অভিনয় এই নাটিকায় দেখতে পাওয়া যায়।

 
 
 
 
 
 

এই নাটিকা মাথা উঁচু করে কিছু রাজনৈতিক বক্তব্যের সামনে আমাদের দাঁড় করায়।

 

যে প্রশ্ন গুলি আমরা ভুলতে বসেছি, যে প্রশ্ন আমরা এড়িয়ে যাই, যে প্রশ্ন গুলি

 

দেখলে আমরা আমাদের উঁচু নাক নিয়ে শিঁটকে উঠি, এই নাটিকা সেই প্রশ্নের সামনে

 

দাঁড় করায়। সরাসরি, কোনো আড়াল-আবডালের সাহায্য না নিয়ে, নিজেদের

 

রাজনৈতিক অবস্থান জোর গলায় ব্যক্ত করে। সকল রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে

 

এই নাটিকা পথ চলে না। কিন্তু সকল শ্রেণির সাধারণ মানুষের জন্য এই নাটিকা যেন

 

মুক্তকণ্ঠ। এইরকম একটি পিছিয়ে পড়া সময়ে, যখন মানুষ আতঙ্কে বাঁচছে তখন

 

ভয় কে জয় করে মানুষের মাঝে গিয়ে মানুষের কথা বলতে গেলে এলেম প্রয়োজন হয়

 

এবং বলতে দ্বিধা নেই ‘ জনগণমন ’ প্রযোজিত নাটিকা ‘ ইঁদুরকল ’ বাংলা থিয়েটারে

 
 
 

একটি এলেমওয়ালা কাজ করে দেখিয়েছে যার জন্য দল এবং সদস্যদের কুর্ণিশ।

 

আমি চৌদ্দ নম্বর উপস্থাপনা দেখেছি। আশা রাখছি, বছরান্তে হাফ সেঞ্চুরি হলে

 

অবাক হওয়ার কিছু নেই।

কালী কাল্ট নিয়ে গড়গড় করে দু' চারটি কথা পাড়লেন

বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

 
 
 
 
 
 
 
 

উত্তর পূর্ব ভারতে কালী প্রতিমা নানা রূপে পূজিতা। বাংলায় বিশেষ করে বাঙালী হিন্দুদের মধ্যে কালী এক উল্লেখযোগ্য দেবী হিসেবে পূজিতা। গৃহস্থের ঘরে আগে কালিমূর্তি পূজা হত না। মূলত তান্ত্রিকদের উপাস্য দেবী হিসাবে শ্মশানে, গৃহের বাইরে, বিশেষ অনুষ্ঠানে উপলক্ষ্যে এই মূর্তির পূজা হতো। শ্মশানকালী বিশেষ ভাবে পূজিতা ছিলেন। তাঁর ছবিও বাড়িতে রাখা যেত না। দক্ষিনাকালীর ধারনা পরে আসে, এবং তিনি গৃহস্থের দ্বারা পূজিতা দেবী হিসাবে স্বীকৃতি পান। শ্মশানকালীর রূপ অন্যরকম তা ভয়ংকর সৌন্দর্য্য বিভাসিত এবং কালীর বামচরণ শিবের বুকের উপর ন্যয্য। সৌন্দর্য্যে এই কালী বামকালী হিসাবে চিহ্নিত। অন্যদিকে দক্ষিণাকালীর দক্ষিণাচরণ শিবের বুকের উপর ন্যয্য থাকে এবং কালীর মূর্তি কিছুটা স্নিগ্ধ ও বরাভয়প্রদায়িনী হয়। মুখের ভঙ্গির জন্য, যদিও হাতে অস্ত্র, নরমুণ্ড ইত্যাদি কিন্তু থাকে। প্রসঙ্গত মনে হয়েছে কালিমূর্তি জনজীবনের এবং গৃহস্থের পূজার অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেই এটি সৃষ্টি করেছে একটি বিশেষ ধারা যাকে আমরা কালি কাল্ট (kali cult) বলে চিহ্নিত করতে পারি। দক্ষিনাকালীর আবার বিভিন্ন রূপ আছে এবং এই মূর্তি বা মূর্তির ছবি বাড়িতে রাখতে বাধা নেই, এই কথা লোকাচারে রয়েছে।

 

তন্ত্রে কালীর একটি ধ্রুপদী রূপ ছিল। গুপ্তযুগের মাঝামাঝি থেকে তন্ত্রের ধারনা বিকশিত হতে থাকে। তারপর বৌদ্ধ যুগে এটি বিবর্তিত হয়ে সহজযান, বজ্রযান কালচক্রযানে বিভাষিত হয়। এটা ঠিক যে, কালীর ধারণার মধ্যে অতিরিক্ত কুয়াশা ছিল। নানা রূপ বর্ননা, বৌদ্ধতন্ত্রের নানা মায়াজাল পেরিয়ে হননের একটি বৃহৎ অংশের ভেতরে কালী প্রতিমার ভাবরুপ আনতে অনেক সময় নিয়েছ। বৈদিক জগতের সঙ্গে কালীর ধারণায় মিল আমরা পাইনি। বৈদিক সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে পৌরাণিক সংস্কৃতির ধারণার বহু বন্দর পেরিয়ে তবে মিলেছে কালী প্রতিমার গৃহস্থান রূপ। মানুষ যেখানে ভিড়িয়েছে ভক্তি ও ভয়ের নৌকা। সমীকরণ খুঁজেছে। উদাসীন ভরা জোৎস্নার ভেতরে নিছক বিশ্বাসে কালো মহিষের পিঠে চেপে তারা পেরিয়ে যেতে চেয়েছে সাংসারিক দুঃখের জ্লাভূমি। বাঙালি মধ্যবিত্তের চেতনায় এসেছে গৃহস্থ কালীর রূপ। যিনি আগে ছিলেন ডাকাত দের পূজিতা, যেখানে নরবলি স্বাভাবিক ছিল তা ভুলে বাঙালি হিন্দু প্রথমে ছাগ ও মহিষ বলি তারপর ঐ বীভৎসতা ছেরে কুমড়ো বলি , আখ বলিতে এসে স্থির হল। কালীভজনার ধারা এগিয়ে গেলো বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। এখন এই বিবর্তনের প্রেক্ষাপট খুঁজতে হবে।

 

দেবী কালিকাকে সম্পূর্ণভাবে সৃষ্টিশীল শক্তির দেবী বলা যায় না। কারণ তাঁর মধ্যে ধ্বংসের ক্ষমতাও বিদ্যমান। এমনকি দক্ষিণা কালিকার স্তবেও একটা ভয়াল শক্তির ইঙ্গিত আছে। দক্ষিণা কালীর স্তবে রয়েছে

 

করাল রদনাং ঘোরাং

 

মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাম

 

কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং

 

মুণ্ডমালা বিভূষিতাং

 

এই রূপে বৈদিক প্রভা নেই। আভাস রয়েছে মাতৃতান্ত্রিক এক গোষ্ঠীর মাতৃবন্দনার। পরে এতে নানা ধারনা সন্নিবেশিত হয়েছে। অন্য এক বিভা নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। কালী – কাল্ট ( kali – cult)। এই অন্য বিভা কল্পনার ফলে কালীর অজস্র রূপ। কালীর সমিধারার নানা রূপকে বোঝাবার জন্য দশমহাবিদ্যার আগমন বা ৫১ পীঠের কাহিনির সৃষ্টি। যার কেন্দ্রে কিন্তু রয়েছেন আদি শক্তি। তাঁকে মা বলা হয়েছে কারণ জগতের যাবতীয় সৃষ্টির উৎস তিনি। কাজেই কালী বিশ্বমাতার রূপ এমন ভাবা হয়। দেবী ভাবনা থেকে মাতৃ ভাবনা আসে।

 

আমার বিশেষ পরিচিত একজন সাধক নিগূড়ানন্দ লিখেছিলেন, ” তাঁর জাগরণেই প্রথম কালের উৎপত্তি, সেই জন্য কালের অধীশ্বরী হিসাবে তিনি কালী। কালীর গলায় পঞ্চাশটি মূণ্ডমালা ও হাতে একটি অর্থাৎ একান্নটি মুন্ড হল প্রকৃতির বস্তুজগতে আত্মপ্রকাশের পেছনে রয়েছে যে একান্নটি তরঙ্গ, এটা তারই প্রতীক”। এরকম অনেক ভাবনা রয়েছে।

 

৫১ টি মুণ্ডের সঙ্গে বর্ণমালার ৫১ অক্ষরের সম্পর্ক এবং বিশ্বের সৃষ্টির ৫১ টি পর্যায়ের কথাও অনেকে বলে থাকেন। এসব তত্ত্বের উথ্যানের ফলে কি হয়েছে ? এই উথ্যান ক্রমশঃ একটা ভাব বা বিস্তার জ্যামিতি তৈরি করেছে, মানুষের বুদ্ধির কাছে সারা মিলেছে। কালীপূজা অঙ্গীভূত হয়েছে সামাজিক ভাবে। কিন্তু এসব পরের কথা, বাঙালির বিদ্যাচেতনার দ্যোতনা জাগবার পরের রূপ। যখন কালী কিছুটা সমাজের অন্যান্য পূজার সঙ্গে গৃহস্থ বাড়িতে জায়গা পেয়েছে। তখন নূতন ও পুরাণের ধারণার সমন্বয় ঘটিয়ে বলা হল ” কালী হলেন আদি শক্তি, শাক্তশাস্ত্রে যাকে বলে আদ্যশক্তি, Primal energy, Kinetic in Nature”. কালের জন্মদাত্রী বলে তিনি কালী, কালী মানে এক ধরনের শক্তি যে শক্তি শূন্যে সুপ্তাকারে ছিল। প্রকৃতিতে এই শক্তি বিরাজ করছে। ফলে কালিকে কেউ আধুনিক বিশ্ব চেতনায় স্থান দেওয়া হল। ‘ kali-cult’ কে justify করা হল। আগেই গৃহস্থের ঘরে হয়েছিল কালীর আবির্ভাব এখন বুদ্ধিজীবীদের চেতনায় এলো। পশুবলীর বদলে কুমড়ো ও আখ বলীর ফল এলো। কিন্তু কবে? ও কেনো?

 

ইতিহাসের প্রেক্ষিতে সপ্তদশ শতক থেকে ‘ কালী’ এই প্রতিমার রূপের সঙ্গে সাধারণ মানুষ পরিচিত হতে শুরু করে পণ্ডিতদের মাধ্যমে। আমরা এ বিষয়ে কৃষ্নানন্দ আগমবাগীশের নাম বলবো। যিনি ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে মানুষ। নদিয়ায় তাঁর জন্ম। ‘তন্ত্রসার’ বলে একটি গ্রামে তিনি লিখছেন দক্ষিণা কালীর কথা। এটি ছিল একটি কালিসাধনার একটি turning point. এই দক্ষিণা কালী প্রসঙ্গে তিনি লিখছেন কালীর ডান পা শিবের বুকের ওপর এবং এই দক্ষিণা কালী গৃহস্থের পক্ষে মঙ্গলময়ী, ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ এনার কাছে পাওয়া যাবে। সাধারণ গৃহস্থ ত তাই চাইবে। এই ভাবে কৃষ্নানন্দ আগমবাগীশ দক্ষিণা চারের কথা বললেন এবং বামাচারের ভেতর যে ভয় ও সাধারণ ভাবে অস্বাভাবিকতা ছিল ত থেকে বেরিয়ে যাবার পথ দেখালেন। পরবর্তী শতক অর্থাৎ সপ্তদশ শতক থেকে দক্ষিণা কালীর ফল প্রচার হল। ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ এর দেবী হিসেবে মানুষ তাঁকে ঘরে তুলে নিল। শিবচন্দ্র বিদ্যার্নব ‘ তন্ত্রসারের’ ব্যাখ্যা করলেন।

 

এর কিছু পরে লেখা হলো কালিকামঙ্গল কাব্য। লিখলেন বলরাম। অষ্টাদশ শতকে এসে আর একটি মোড় বাঁক চোখে পড়ে। যেটি হলো কৃজ্ঞভজনার সঙ্গে কালীকে মেলানো বা কালীকৃজ্ঞ অভেদ এই কথা প্রচার। বৈভব রীতির সঙ্গে শাক্ত রীতির মেলবন্ধন হল।

 

” দেখ নয়নে অভেদ কালে যেই কালী সেই মূরলী”। কিন্তু কেনো হলো? আসলে অষ্টাদশ শতক ছিল ঘোর দুর্দিনে দশক। রাজনৈতিক ও সামাজিক পালাবদল ও বিপর্যয়ে সন্দিহান ছিল মানুষের লক্ষ্যের পথ। বড়ো জমিদারি ভোগ পাওয়া , মুঘল সম্রাটদের অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়া, বাংলার নবাবদের খাজনার জন্য বাড়াবাড়ি, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের বিভীষিকা, মানুষের আর্তনাদ অন্যতর ধর্মচেতনার জন্ম দিল। যা প্রাসন্নতন্ত্রের গোড়ামির বাইরে। এইখানে বৈষ্ণব ও শাক্ত ধর্ম মিলেমিশে গেলো। অনেক ক্ষেত্রে কালীকীর্তনে ছাপ পড়লো তার। রামপ্রসাদের গানে, ভারতচন্দ্রের কবিতায় দেবতা বিশেষ করে দেবী ঘরের লোক হয়ে উঠলেন মনুষ্য চরিত্রের বিপন্নতার ভেতর দিয়ে। না, কোন সংশয় ছিল না রামপ্রসাদের গানে। কালী তখন হয়ে উঠেছেন মা এবং কখনও কন্যা।

 

” এবার তনয়ে ছলিতে কন্যা রূপে রামপ্রসাদের বাঁধলে বেড়া”।

 

ঠিক এইসময় নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে তন্ত্র পথ থেকে একটু সরে তৈরি হলো বহুকালী মূর্তি। কোথাও তিনি শ্যামা কালী, কোথাও বড়ো মা, কোথাও বা মুক্তকেশি, কোথাও মন্থনা কালী, কোথাও কন্যাকালী, কোথাও দয়াময়ী কালী, কোথাও সিদ্ধেশ্বরী কালী ইত্যাদি। বোঝা গেলো শ্মশানকালীর গন্ডী ভেঙ্গে কালী এসে ঢুকেছেন ঘরে, মানুষকে সাহস যোগাবার জন্য।

 

এমনকি দক্ষিণাকালীর ” সেই করালবদনাং ঘোরাং ” রূপ ও আর নেই। তা জ্যোতির্ময়ী ও স্নেহময়ী হয়ে উঠেছে। কোথাও তিনি ভবতারিণী কালী কোথাও বিপদতারিনী কালী। উনিশ শতকে ‘কালী – কাল্ট’ বা ধারা পুষ্ট হয়ে একটি বিন্যাসের মধ্যে চলে আসে। আর এই সময় বেশ কিছু ব্যাখ্যা নূতন রূপ পায়। যেমন পঞ্চ ‘ ম’ কারের ধারনা বদলে যায়। বদলে যায় বলীর ধারনা। নরবলী পেরিয়ে, ছাগ মহিষ বলী পেরিয়ে, আরো অন্যরকম কুমড়ো ও আখ বলীর দিকে সেই ধারনা প্রতিষ্ঠিত হয়। বিভৎসতা দুর হয়ে অন্য এক জগৎ আসে যেখানে মাংস নেই, বলীর রক্তপাত নেই, বারি নেই কারণ সাধারণ গৃহস্থের বাড়ির মেয়েটির মতো হয়ে ওঠেন কালী। তাঁর পুজো হয়ে ওঠে আনন্দোৎসব যেখানে ভক্তিবাদ প্রধান হয়ে ওঠে।।

 

তন্ত্রে বলা হয়েছিল মাংস, মদ্য, মৎস্য, মুদ্রা, মৈথুন এই পাঁচটি বামাচারীদের দরকার। সাধারণ মানুষ শিউরে উঠতো শুনে কারণ এগুলি আক্ষরিক অর্থে তান্ত্রিকরা ব্যাবহার করতেন। পরে এর ব্যাখ্যা পাল্টে গেছে এবং গৃহস্তের কাছে তা কিভাবে গ্রহণীয় হচ্ছে দেখুন।

 

১) মাংস মানে বাকসংযম। কারণ মা মানে জীব আর মাংস মানে জীব থেকে যা আসে অর্থাৎ ভাষা তাই।

 

২) মদ্য মানে মদ নয়, কারণ নয়, মদ মানে ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে যে রস ক্ষরিত হয়। যা আনন্দের সৃষ্টি করে। যৌগিক পদ্ধতিতে এই রস বা হরমোন হয়।যোগ শাস্ত্রে এই ক্ষরণ করবার পদ্ধতির কথা বলা আছে।

 

৩) মৎস্য মানে মাছ খাওয়া নয়, ইড়া ও পিঙ্গলা দুই নাড়ি মৎস্য। শ্বাস ও প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ। বামনাড়ির শ্বাস, দক্ষিণ নাড়ির শ্বাস। যা একটি যৌগিক পদ্ধতি।যা মৎসের মতো নড়ে চড়ে।

 

৪) মুদ্রা মানে পরিত্যাগ অর্থাৎ অসৎ চিন্তা ও সঙ্গ পরিত্যাগ।

 

৫) মৈথুন মানে নাড়ির সঙ্গে রমন নয়। ধ্যানের মধ্য দিয়ে পুজো পদ্ধতির মধ্য দিয়ে ঈশ্বর চিন্তার সঙ্গে যুক্ত হওয়া।

 
 
 

পঞ্চ – ম’ কারের এই ব্যাখ্যা ‘ কালীকে’ প্রতিষ্ঠিত করেছিল সমাজে। কালিসাধনাকে সহজতর করেছিল। ” কালী – কাল্ট” গড়ে ওঠার পথও সহজতর হয়ে গিয়েছিল। গৃহস্থ তান্ত্রিকদের সংখ্যা বেড়েছিল। দুর্ভিক্ষ, দুসাশনে জর্জরিত মানুষ খুঁজে পেয়েছিল সাহস। কালী চিন্তা থেকে এসেছিল এই বরাভয় ও লড়বার শক্তি। যেমন দেশভাগের পর হিন্দু উদ্বাস্তু মানুষদের কলোনীর অনেক বাড়িতে আমরা কালীর স্থান প্রতিষ্ঠা হতে দেখেছি। ভর হতে দেখেছি। পরিবারে কালী পূজা চালু হতে চাক্ষুষ দেখেছি এমনকি বৈষ্ণব পরিবারেও।

 

পরিশেষে কিছু কথা:

 

” কালী- কাল্ট (kali – cult) কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হল এবং তার সমাজবীক্ষ্ন কি? অর্থনৈতিক পটভূমি কি? তা লিখতে বসে বুঝছি এতো স্বল্প পরিসরে বলা সম্ভব নয়। আমি Rachel Fell Medermott যিনি Encountering Kali বা Singing to the Goddess ইত্যাদি লিখেছেন তার মত অনুসারেও বলবো না। আমি আমার নিজস্ব কিছু অনুধাবন বা বীক্ষ্ন রয়েছে সেই কথা বলতে চাই। তার ব্যাপ্তি বিশাল হয়ে যাবে সুতরাং সংক্ষেপে কতগুলি কথা বলে নিই। মূলত দেখা যায় ” শ্রীশ্রী চণ্ডী ” তন্ত্রের সপ্তম অধ্যায় থেকে কালী ধারণাটির সৃষ্টি। তখন দেবীর সঙ্গে অসুরদের যুদ্ধ চলছে। মনে রাখতে হবে এই যুদ্ধ কিন্তু মহিষাসুর বধের পরবর্তী ঘটনা। শ্রী শ্রী চন্ডীতে তৃতীয় অধ্যায়ে কিন্তু মহিষাসুর বধ সমাপ্ত হয়ে গেছে। তারপর অসুরদের সঙ্গে পরবর্তী সংগ্রামে চন্ডমুন্ড বধ শুম্ভ নিশুম্ভ বধ প্রভৃতি রয়েছে। শুভ্রবর্না দেবী নিজেরই ভেতর থেকে এক কৃষ্ণবর্ণ দেবীর সৃষ্টি করে তার সাহায্য নিলেন অসুর নিধনে। তিনিই কালী। চণ্ডিতে বলা হয়েছে,

 

ভ্রুকুটি কুটিলক্ষ তস্য ললাট কলকা দ্রুতম

 

কালী করাল বদনা বিনিশক্রান্তাসিপাশিনী ।।

 

ঠিক এইখান থেকে কালী চিন্তার উদ্ভব। একে আবার চামুণ্ডাও বলা হয়েছে। দেখা গেছে এই কালী অসুরদের প্রায় ধ্বংস করেছে। রক্তবীজের রক্ত খেয়ে ফেলেছে। ফলে আর রক্তবীজের সৃষ্টি হয়নি। সুতরাং কালীর একটা ধ্বংসাত্মক শক্তি কিন্তু অশুভ দলনের শক্তি আত্মপ্রকাশ করেছে। শমির তারতম্য ভেদে এই কালী দ্বিভূজ থেকে চতুর্ভুজ, চতুর্ভুজ থেকে অস্টভূজ, দশভূজা ইত্যাদি হয়েছেন শক্তির মাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। সুতরাং একটা চমৎকারিত্ব ছিল।

 

এই ভীষণতাকে কিভাবে শ্যাম গম্ভীর সরসায় রামপ্রসাদের (১৭১৮-১৭৭৫) গান রূপান্তরিত করেছে, তা আমরা শুনেছি। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে উত্থান হিসেবে তন্ত্র প্রতিরোধের গান গেয়েছে অন্যভাবে। তন্ত্রে জাতিভেদ প্রথা অস্বীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে সাম্যের কথা। তন্ত্রে বলা হয়েছে মেয়েদের যে অপমান করে, অত্যাচার করে তার কালী সাধনা হবে না। উচ্চবর্না নয় অন্ত্যজ শ্রেণীর নারীদের তন্ত্র পরম মমতায় স্থান দিয়েছে। বৈদিক সাধনার মতো subjective সাধনা এটি ছিল না। কালী সাধনা ছিল Objective । একমাত্রিক নয় বহুমাত্রিক সাধনা ছিল। পরিবেশ থেকে বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ এর সাধনা ছিল। তাই ” কালী ” কাল্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল বঞ্চিত শোষিত সাধারণ জনগণের ভিতরেও।

কালীর রূপ : পুরাণ থেকে তন্ত্রে

ড. সুজয়কৃষ্ণ চক্রবর্তী

 
 

মহাকালের তিনি মনমোহিনী— কমলাকান্ত এরূপই দেখেছিলেন তাকে। অষ্টাদশ শতকের যুগসন্ধিক্ষণের কালপর্বে মহাকালের মনোমোহনকারিণী কালিকাকে তিনি মাতৃকা দর্শনের আকাঙ্ক্ষায় দেখতে চেয়েছেন। মহাকাল শব্দের লক্ষণার্থে শিবকে বোঝালেও আসলে অভিধাতেই রয়েছে এর গভীরতা। মহাকাল কেবলমাত্র শিবের একটা বিশেষরূপ নন। আসলে অতীত বর্তমান ভবিষ্যত এই ত্রিকাল ব্যাপ্ত এক সময় পুরুষ। একেশ্বরবাদের সুত্র ধরে এ-জাতীয় পরম দেবতার আবির্ভাব। যে দেবতা শিবের ত্রিগুণাত্মক মূর্তির মধ্যে সংহরণকারী (সংহারকারী নয়), তিনিই মহাকাল। শৈবাগম থেকে এই দ্যোতনাতেই তন্ত্রে তার আবির্ভাব। কিন্তু এই ত্রিকাল ব্যাপক চরিত্র আরাধ্য হলেও এর প্রকৃতি রূপই তন্ত্র শাস্ত্রে উপাস্যা। তিনিই মোক্ষপ্রদায়িত্রী কালিকা। কালিকা নামের মধ্যেই মহাকালের অধীশ্বরী প্রকৃতি দেবীর মাত্রা সন্ধিত হয়। কালিকা বা মহাকালী তন্ত্রশাস্ত্রে আরও বহু নামে থাকলেও বাংলায় পূজিত হয়েছেন দক্ষিণীকালীরূপেই অধিকতরভাবে।

 
 
 
 
 
 
 
 

যাঁরা শাস্ত্রচর্চা পুরাণ চর্চা করে থাকেন তারা জানেন। এই কালীদেবীর উৎস বৈদিক সভ্যতা নয়। যদিও এমন দেবীর সন্ধান আমরা ঋক্‌ বেদে পেয়ে থাকি যিনি ‘রুদ্রের ধনুকের ছিলায় টান দেন’।১ কিন্তু মহেঞ্জোদারো-র মাতৃপ্রতিমা ঋক্‌ বেদের দশম মণ্ডলের চেয়ে প্রাচীনতর। আর্য সভ্যতার সঙ্গে প্রাগার্য সভ্যতার টানাপোড়েনেই একসময় পুরাণের কালের উদ্ভব। যেখানে মাতৃকাদেবী ক্রমেই ইন্দ্রাদি দেবগণকে সরিয়ে ক্রমে জায়গা করে নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে মার্কণ্ডেয় পুরাণের ভাষ্য এই সংমিশ্রণের ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করেছে। অথবা বলা যায়, বৈদিক সংস্কৃতির বিপুলতর প্রকৃতি ভাবনাকে সরিয়ে দিয়ে মার্কণ্ডেয় চণ্ডী আর্য ও আর্যপূর্ব সভ্যতার সংমিশ্রণের তাত্ত্বিক ভাষ্য রচনা করেছে। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর মধ্যে অদ্ভূত তিনটি বৈশিষ্ট্য আছে। এগুলি যথাযথ উল্লেখ করলে বৈদিক সংস্কৃতির সঙ্গে যোগটি পরিস্ফুট হবে। এর মধ্যে প্রথমটি মার্কণ্ডেয় পুরাণের একটি প্রাচীনতর ভাষ্য সম্পর্কিত। এই ভাষ্যটি মহাভারতের মধ্যে পাওয়া যায়। মহাভারতের বনপর্বে মার্কণ্ডেয়সমাস্যা নামক একটি পর্বাধ্যায় আছে।

 
 
 
 
 
 

২ সেই পর্বাধ্যায়েই শেষাংশের কাহিনি ‘স্কন্দোৎপত্তি’। মহাভারতেও কাহিনিটি মার্কণ্ডেয় মুনিকথিত। এখানে স্কন্দোৎপত্তি কাহিনির মধ্যে অগ্নিপুত্র (শিবপুত্র নন) স্কন্দদেব মহিষাসুরকে (তারকাসুর নন) বধ করছেন। এই প্রাচীন ভাষ্য থেকে আমরা নবীনতর ভাষ্য মার্কণ্ডেয় পুরাণের ‘সাবর্ণি মন্বন্তরে’র অধ্যায়গুলিতে পাই। সেখানে মহিষাসুরকে পরাজিত করছেন দেবতাগণের তেজসম্ভূত দেবী চণ্ডিকা। এই চণ্ডীদেবীর তিনটি রূপ: প্রথম রূপে তিনি মধুকৈটভ নামক দুই অসুরকে নাশ করতে বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে জাগ্রত করেন। দ্বিতীয় রূপে তিনি দেবতাগণের তেজাংশ থেকে উদ্ভূত হয়ে সসৈন্যে মহিষাসুরকে বিনাশ করেন। আর তৃতীয় রূপে তিনি শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক দুই অসুরকে সসৈন্য বধ করেন। এইটি এই কাহিনির দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য। এই কাহিনির তৃতীয় বিশেষত্বটি হল বৈদিক ও পৌরাণিক দেবতার সমন্বয়ে পরমাদেবীরূপে শক্তি-স্বরূপিণীকে দেখা যায়। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর অষ্টম অধ্যায়ে দেখা গেল দেবী নানারূপ ধারণ করছেন, যে সমস্ত রূপগুলির সঙ্গে পুরাণের ও বৈদিক সাহিত্যের দেবতাদের সংযোগ রয়েছে। অদ্ভুতভাবে পৌরাণিক দেবতারাই এখানে প্রাধান্য পেয়েছেন— ব্রহ্মার থেকে ব্রহ্মাণী শক্তি, শিব থেকে মাহেশ্বরী, বিষ্ণু থেকে বৈষ্ণবী, কার্ত্তিকেয় থেকে কৌমারী বা কার্ত্তিকী, বরাহ (বিষ্ণুর তৃতীয়াবতার) থেকে বারাহী, নরসিংহ (বিষ্ণুর চতুর্থাবতার) থেকে নারসিংহী। এরপরে ইন্দ্র থেকে আসেন ঐন্দ্রী বা ইন্দ্রাণী শক্তি। এছাড়া কুবের, বরুণ প্রভৃতি দিকপালদের শক্তি থেকেও দেবীদের উৎপত্তি হয়েছে, কিন্তু তারা প্রথম অষ্টমাতৃকার মধ্যে জায়গা পাননি। আরও গুরুত্বপূর্ণ হল এই অষ্টমাতৃকার মধ্যে চামুণ্ডার অবস্থিতি। ইনি মাতৃগণের মধ্যে শুরুতেই উদ্ভূতা। দেবী চণ্ডিকার ভ্রূকুটিকুটিল ললাট থেকে এই করালবদনা কালীর জন্ম।

 
 
 

ভ্রূকুটিকুটিলাৎ তস্যা ললাটকলকাদ্‌দ্রুতম্‌।

 
 
 
 

কালী করালবদনা বিনিষ্ক্রান্তাসি পাশিনী।। বিচিত্র খট্বাঙ্গ ধরা নরমালা বিভূষণা। দ্বীপিকর্ম্মপরীধানা শুষ্কমাংসাতিভৈরবা।। অতি বিস্তার বদনাজিহ্বা ললন ভীষণা। নিমগ্নারক্ত নয়না নাদাপুরিত দিঙ্‌মুখা।। সা বেগেনাভিপতিতা ঘাতয়ন্তী মহাসুরান্‌। সৈন্যে তত্র সুরারীণা মভক্ষয়ভ তদ্‌বলম।।

 
 
 
 
 
 
 

কালীর উদ্ভব খড়্গধরা এবং পাশ হস্তা রূপে।

 

অম্বিকার ললাটোদ্ভূতা দেই দেবী বিচিত্র নরকঙ্কালধারিণী, নরমুণ্ডমালিনী, ব্যাঘ্রচর্মপরিহিতা, অস্থিচর্মমাত্রদেহা, অতিভীষণা, বিশালবদনা, লোলজিহ্বায় ভয়প্রদা কোটরগত আরক্তচক্ষুবিশিষ্টা এবং বিকটশব্দে দিঙ্‌মণ্ডলপূর্ণকারিণী তিনি সবেগে অসুর সেনার মধ্যে ধাবিতা হয়ে মহাসুরগণকে আঘাত করে সৈন্যসমূহ ভক্ষণ করতে লাগলেন। এই দেবীই চণ্ডমুণ্ড নামক দুই অসুর সেনানায়ককে বধ করে চামুণ্ডা নামে আখ্যাতা হলেন। এরপরই রক্তবীজ নামক অসুররাজ যুদ্ধে এলেন। যার শরীর থেকে পতিত রক্তবিন্দু থেকে পুনরায় রক্তবীজের জন্ম হতে লাগল। মাতৃকাগণ রক্তবীজের যুদ্ধে বিভ্রান্ত এবং দেবগণ বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন। এমত সময় দেবী চণ্ডিকা কালীকে বললেন, ‘উবাচ কালীং চামুণ্ডে বিস্তরং বদনং কুরু’— ‘চামুণ্ডে আপন আনন বিস্তৃত করো। আমার অস্ত্রাঘাতে উৎপন্ন রক্তবিন্দুসমূহ এবং রক্তবিন্দুজাত মহাসুরগণকে ভক্ষণ করো। এইভাবেই রক্তবীজ ক্ষীণ হবেন।’ কালীও এইভাবে রক্তবীজের শোণিত পান করে রক্তবীজকে বধ করলেন। এই যে চামুণ্ডারূপা দেবী কালীকে আমরা দেবী ভাগবত, কালিকাপুরাণ প্রভৃতি পরবর্তী পৌরাণিক সাহিত্যে দেখতে পাই, কিন্তু তাতে কোনো নতুনতর মাত্রা ছিল না। নতুনতর মাত্রা সম্বলিতা দেবীর দেখা মিলল তন্ত্রশাস্ত্রে।

 

হিন্দু তন্ত্রাচারের উৎস যে বৌদ্ধতন্ত্রাচারে লুকিয়ে আছে সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। এককথায়, এ-কথাগুলি এইখানে বলা হলেও এই প্রক্রিয়ার সংমিশ্রণ নিয়ে মোটা গ্রন্থ রচনা করা যায়। আর্য ব্রাহ্মণ্য বা বৈদিক সংস্কৃতির সময়ে ব্রাত্য শূদ্র এবং অনার্যদের মধ্যে নাস্তিকরা ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছিলেন। বিশেষত ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় বর্ণের প্রাধান্য যেখানে অস্বীকৃত, সেই বৌদ্ধধর্ম বিস্তারের প্রধান সহায়ক ছিলেন বৈশ্য সমাজ। নাস্তিকতা নানামাত্রায় শূদ্র ব্রাত্য (বেদাচার বর্জিত আর্য) এবং তথাকথিত নিষাদ প্রভৃতি অনার্যদের মধ্যে যেমনভাবে ছড়াচ্ছিল, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের সূত্র ধরে প্রাগার্যদের মাতৃকা যাজনও ক্রমশ বিভিন্ন প্রকরণে তেমনি নাস্তিক্যবাদী ধর্মগুলির মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছিল। ফার্টিলিটি কাল্টের পূজা-অর্চনা নানাভাবে বৈদিক সংস্কৃতিতেও প্রবিষ্ট হয়ে ভেতরে ভেতরে একে পরিবর্তিত করার চেষ্টা করেছিল। প্রাগার্য দেবতা যিনি কপর্দীন্‌, যিনি বিষাণিন্‌, যিনি ব্রাত্যদের দেবতা ও তস্করদের দেবতা, তিনি যজুর্বেদে যখন রুদ্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন শিবরূপে তার প্রাগার্য সংস্কৃতি থেকে আর্য ব্রাহ্মণ্য সমাজে লড়াই করে নিজের স্থানটি পাকা করে নিতে হয়েছিল। মঙ্গলকাব্যে যেমন দেখা গেছে নবোদ্ভূত দেবতারা লড়াই করছেন বিশেষ মর্যাদার জন্য, তেমনি প্রাগার্য কৃত্তিবাস ত্রিশূলধারী বৃষারূঢ় দেবতাকেও যে নিজ স্থান নির্ধারণ করতে প্রবল লড়াই করতে হয়েছিল, তার সাক্ষ্য পুরাণের দক্ষযজ্ঞের কাহিনিতে বিদ্যমান। আর একইসঙ্গে পরমপুরুষের সঙ্গে পরমাপ্রকৃতির আর এক আবির্ভাব দক্ষযজ্ঞের কাহিনিতে আছে। যেখানে দক্ষযজ্ঞে বিনা নিমন্ত্রণে গমনোদ্যত সতীর সঙ্গে শিবের মতান্তর হয়, তখনই দেবী তার দশমহাবিদ্যা রূপ প্রদর্শন করেন। কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী এবং কমলা। এছাড়া নানা পুরাণে নানাভাবে মহাবিদ্যারূপে দেবীর কয়েকটি বিশেষ রূপ অর্চিত হয়েছে। বৌদ্ধ মহাযান ধর্ম একদা বহু দেবতার ভাবনায় তরঙ্গিত ও পল্লবিত হয়ে উঠেছিল। বৌদ্ধ তন্ত্রগুলি মহাযান ধর্মের নানা উপশাখা। মহাযানধর্ম দেহবাদী সাধনচর্যাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, তারই ক্রম-পরিবর্তিত রূপ বসেছে বজ্রযান, কালচক্রযান, সহজযানে। এই ধারায় একদিকে দেহসাধনা পল্লবিত হয়েছে আর অন্যদিকে শিবের মতোই বজ্রধর পুরুষদেবতা হেরুক বা বাজিল-এর মতো দেবতার সৃষ্টি হয়েছে এবং তারই শক্তিরূপে অবধুতিকা দেবী বিচিত্র নানারূপে সম্মুখে এসেছেন। এর মধ্যে অক্ষোভ্যকুলের দেবী একজটা, মহাচিনতারা (উগ্রতারা), প্রত্যঙ্গিরা, বৈরোচনকুলের দেবী বজ্রবরাহী, বিত্নসম্ভবকুলের দেবী প্রসন্নতারা, বজ্রতারা, অপরাজিতা, বজ্রযোগিনী (ছিন্নমস্তা), অমোঘসিদ্ধিকুলের মহামায়ুরী (কৌমারী) দেবীর সঙ্গে নাম ও রূপের ক্ষেত্রে হিন্দু তন্ত্রের দেবীদের বিরাট ঐক্য দেখা যায়।

 
 
 
 
 
 

পক্ষান্তরে, বিভিন্ন বৌদ্ধ যানে হিন্দু ঐতিহ্যের পৌরাণিক দেবদেবীরাও প্রবিষ্ট হয়েছেন। এই আদান-প্রদানের সূত্রেই মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে আবির্ভূত কালিকা বা চামুণ্ডা অথবা মহাকালী দেবীর নানারূপের উৎপত্তি। এই যে দশমহাবিদ্যা রূপ, এরা ছাড়াও স্থানিক দেবীরূপে একান্নটি পীঠদেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। পৌরাণিক মতে, এই একান্ন পীঠদেবীর উৎপত্তি দক্ষযজ্ঞে মৃত সতীর দেহকে যখন বিষ্ণু খণ্ড খণ্ড করে শিবের স্কন্ধ থেকে পৃথিবীতে ফেলে দেন, তখন। এর বিস্তৃত বিবরণ বহু গ্রন্থে রয়েছে। এমনকি মঙ্গলকাব্যগুলিতেও। একান্নটি শক্তিপীঠের সিংহভাগই বঙ্গদেশে। সেজন্য বঙ্গদেশে দেবী কালিকার এত প্রচার এবং প্রতিষ্ঠা। কেউ কেউ এর সঙ্গে মহাযানতন্ত্রের যোগসূত্র খুঁজে পান। সাধনমালায় উড্ডিয়ান, কামাখ্যা, সিরিহট্ট এবং পূর্ণগিরি— এই চারটি ক্ষেত্রকে তন্ত্র সাধনার পীঠস্থান বলা হয়েছে। এদের সর্বত্র বজ্রযোগিনীর একটি করে মন্দির ছিল। এর মধ্যে কামাখ্যা ও শ্রীহট্টকে চেনা যায়, কিন্তু উড্ডিয়ানের কোনো খোঁজ মেলে না। পূর্ণগিরিও আসামে। সুতরাং এইসব ক্ষেত্রগুলি কালিসাধনার ক্ষেত্রে বিপুল ভূমিকা যে রাখবে, বলাই বাহুল্য। বলা ভালো, এর থেকেই উভয় ধর্মের মধ্যেকার যোগসংযোগ বেশ বোঝা যায়। তবে কালিকা বঙ্গদেশে যতটা মান্যা, দক্ষিণভারতে নন। সেখানে ললিতাদেবী সর্বতোভাবে মাননীয়া। ললিতা হচ্ছেন তন্ত্রশাস্ত্রের দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী বা দশমহাবিদ্যার দেবী ষোড়শী। বঙ্গদেশে কালিকা দেবী পুরাণের মাত্রা থেকে বেরিয়ে প্রবেশ করলেন তন্ত্র দর্শনের মধ্যে। এখানেই তিনি হয়ে উঠেছেন পরমা প্রকৃতি মহাকালপ্রিয়া।

 
 
 

কালীতন্ত্র এই দেবীর ধ্যানমন্ত্র বলছেন এইভাবে—

 

 

 

করালবদনাংঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভূজাম্‌। কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুণ্ডমালা বিভূষিতাম্‌।। সদ্যচ্ছিন্ন শিরঃ খড়্গবামাধোর্দ্ধ করাম্বুজাম্‌। অভয়ং বরদঞ্চৈব দক্ষিণোর্দ্ধাধঃ পাণিকাম্‌।। মহামেঘ প্রভাং শ্যামাং তথাচৈব দিগম্বরীম্‌। কণ্ঠাবসক্ত মুণ্ডালীগলদ্রুধির চর্চ্চিতাম্‌।। কর্ণাবতং সতানীত শবযুগ্ম ভয়ানকাম্‌। ঘোরদংষ্ট্রা করালাস্যাং পীনোন্নত পয়োধরাম্‌।। শবানাং করসংঘাতৈঃ কৃতকাঞ্চীং হসন্মুখীম্‌। সৃক্কদ্বয়গলদ্রক্তধারা বিস্ফুরিতাননাম্‌।। ঘোররাবাং মহারৌদ্রীং শ্মশানালয়বাসিনীম্‌। বালার্কমণ্ডলাকার লোচন ত্রিতয়ান্বিতাম্‌।। দন্তুরাং দক্ষিণব্যাপি মুক্তালম্বিকচৌচ্চয়াম্‌। শবরূপ মহাদেব হৃদয়োপরি সংস্থিতাম্‌।। শিবাভির্ঘোররাবাভিশ্চতুর্দিক্ষু সমন্বিতাম্‌। মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম্‌।। সুখপ্রসন্ন বদনাং স্মেরানন সরোরুহাম্‌। এবং সংচিন্তয়েৎ কালীং সর্বকামসমৃদ্ধিদাম্‌।।

 
 
 
 
 
 
 
 

এই ধ্যানে দক্ষিণাকালী করালবদনা ভীষণাকৃতি আলুলায়িত কেশা এবং চতুর্ভূজা। দেবীর গলদেশে মুণ্ডমালা এবং বামভাগের অধঃকরে সদ্যশ্ছিন্ন মুণ্ড ও ঊর্দ্ধকরে খড়্গ এবং দক্ষিণভাগের অধোহস্তে অভয় ও ঊর্দ্ধহস্তে বরমুদ্রা বিদ্যমান আছে। দেবীর গা মেঘের মতো শ্যামবর্ণা ও তিনি দিগম্বরী। তাঁর কণ্ঠের মুণ্ডমালা থেকে শোণিতধারা বেরিয়ে দেবীর সর্বাঙ্গ লিপ্ত করেছে। তাঁর কর্ণে দুটি শবশিশুর অলংকার, তাঁর করাল মুখে ভয়ংকর দশনপংক্তি রয়েছে। পীনোন্নত পয়োধরা এই দেবীর কটিদেশ শবহস্ত নির্মিত কাঞ্চীদ্বারা আবৃত। হাস্যবদনা এই দেবীর ওষ্ঠপ্রান্তদ্বয় বিগলিত শোণিত ধারায় মুখমণ্ডল সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। গম্ভীর নিনাদকারিণী কালিকাদেবী শ্মশানবাসিনী। নরাদিত সূর্যের মতো তার তিনটি লোচন, উন্নতদশনা, তাঁর কেশপাশ আলুলায়িত এবং লম্বিত। তিনি শবরূপী শিবের উপর সংস্থিতা। তাঁর চারিদিকে শ্মশানবাসী শিবা বা শৃগালগণ ভৈরব রব করছে। এরই মধ্যে দেবী মহাকালের সঙ্গে বিপরীত রতিতে যুগনদ্ধ রয়েছেন। দেবীর মুখকমল সুপ্রসন্ন এবং হাস্যবিকশিত। এইভাবে সর্বকামসমৃদ্ধিদাত্রী কালীকে চিন্তা করবেন সাধক।

 
 
 

তন্ত্রসারে আর একটি ধ্যানে পাওয়া যায়

 

অঞ্জনাদ্রি নিভাং দেবীং করাল বদনাং শিবাম্‌। মুণ্ডমালাবলীকীর্ণাং মুক্তকেশীং স্মিতাননাম্‌।। মহাকাল হৃদম্বোজ স্থিতাং পীন পয়োধরাম্‌। বিপরীত রতাসক্তা ঘোরদংষ্ট্রাং শিরৈঃ সহ।। নাগযজ্ঞোপবীতাঢ্যাং চন্দ্রার্দ্ধকৃত শেখরাম্‌। সর্বালঙ্কার সংযুক্তাং মুণ্ডমালা বিভূষিতাম্‌।। শবহস্তসহস্রৈস্তু বদ্ধকাঞ্চীং দিগংশুকাম্‌। শিবাকোটি সহস্রৈস্তু যোগিনীভি বিরাজিতাম্‌।। রক্তপূর্ণ মুখাম্ভোজাং মদ্যপান প্রমত্তিকাম্‌। বহৃর্ক শশিনেত্রাঞ্চ রক্ত বিস্ফুরিতাননাম্‌।। বিগতাসুকিশোরাভ্যাং কৃতবর্ণাবতংসিনীম্‌। কণ্ঠাবসক্তমুণ্ডালী গলদ্রুধির চর্চ্চিতাম্‌।। শ্মশানবহ্নিমধ্যস্থাং ব্রহ্মকেশব বন্দিতাম্‌। সদ্যঃকৃত্ত শিরঃ খড়্গ বরাভীতি করাম্বুজাম্‌।।

 
 
 
 
 
 
 
 

অর্থাৎ দেবী কালিকা অঞ্চল কাজল পর্বতের ন্যায় কৃষ্ণবর্ণা, করাল বদনা, মুণ্ডমালাধারিণী, মুক্তকেশী এবং হাস্যযুক্তা। মহাকালের হৃদ্‌পদ্ম স্থিতাদেবী পীনপয়োধরা এবং মহাকালের সঙ্গে বিপরীত বিহারে রত্যাসক্তা সর্প দ্বারা দেবীর যজ্ঞোপবীত নির্মিত। ইনি ঘোর দংষ্ট্রা এবং তার মস্তকে অর্দ্ধচন্দ্র শোভিত। দেবী অলংকার ও মুণ্ডমালাতে সুশোভিত সহস্র শবহস্তের কাঞ্চী দ্বারা তাঁর কটিদেশ আবৃত। সহস্র সহস্র শিবা বা শৃগাল বা যোগিনীগণ দ্বারা দেবী পরিবৃতা। তার মুখপদ্ম রক্তাক্ত এবং তিনি মদ্যপানে প্রমত্ত, অগ্নি, সূর্য এবং চন্দ্র দেবীর রক্তাক্ত বদনমণ্ডলে তিনটি চক্ষু স্বরূপ। দুইটি মৃত শিশুর শবে দেবীর কর্ণভূষণ নির্মিত। মুণ্ডমালানিঃসৃত রক্তে দেবীর শরীর রক্তাক্ত। ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু এর উপাসনা করেন। ইনি শ্মশান বহ্নি মধ্যস্থা সদ্যচ্ছিন্ন শির, খড়্গ, বর ও অভয়মুদ্রা এর হস্তে শোভিত।

 

এই দুইটি প্রচলিত ধ্যানের অর্থ একই। দ্বাবিংশত্যক্ষরি বীজমন্ত্রের সঙ্গে প্রথম ধ্যানটি অধিক প্রচলিত। এছাড়াও অন্য আরো বীজমন্ত্রের প্রচলিত ধ্যান আছে— যথা বিশ্বসার তন্ত্রোক্ত ধ্যান

 
 
 

চতুর্ভুজা কৃষ্ণবর্ণা মুণ্ডমালা বিভূষিতা। খড়গঞ্চ দক্ষিণে পানৌ বিভ্রতীন্দীবরদ্বয়ম।। কর্ত্রীঞ্চ খর্পরঞ্চৈব ক্রমাদ্বামেন বিভ্রতী। দ্যাং লিখন্তীং জটামেকাং বিভ্রতী শিরসাস্বয়ম্‌।। মুণ্ডমালাধরা শীর্ষে গ্রীবায়ামথ চাপরম্‌। বক্ষসানাগহারঞ্চ বিভ্রতী রক্তলোচনা।। কৃষ্ণবস্ত্র ধরাকট্যাং ব্যাঘ্রাজিনসমন্বিতা। বামপাদং শবহৃদি সংস্থাপ্য দক্ষিণং পদম্‌।। বিলাপ্য সিংহপৃষ্ঠতুলেলিহানা শবং স্বয়ম্‌। সাট্টহাসা মহাঘোররাবযুক্তা সুভীষণা।।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

এই দেবী চতুর্ভূজা কৃষ্ণবর্ণা মুণ্ডমালায় বিভূষিতা। ডানহাতে খড়্গ এবং দুইটি নীলপদ্ম রয়েছে। বামহস্তে কর্ত্তৃকা বা অসি এবং খর্পর ধারণ করেছেন। দেবীর জটাদ্বয়ের একটি গগনস্পর্শী। দেবী শিরে এবং গলদেশে মুণ্ডমালাদ্বয় এবং বক্ষঃস্থলে নাগহার ধারণ করে আছেন। এই দেবীর চক্ষু রক্তবর্ণ, কটিদেশে কৃষ্ণবস্ত্র এবং ব্যাঘ্রাজিন। ইনি শবহৃদয়ে বামপদ এবং সিংহপৃষ্ঠে দক্ষিণ পদ স্থাপন করে আছেন। ইনি মদ্যপাননিরতা অট্টহাস্যযুক্তা ভীষণ শব্দকারিণী এবং ভীষণাকৃতি।

 

পূর্বোক্ত প্রথম দুইটি ধ্যানেই চতুর্ভূজা মহাকালিকা দেবীকে মহাকালের সঙ্গে বিপরীত বিহারে রতিক্রিয়ারত অবস্থায় দেখা যায়। এই ধরনের যুগনদ্ধ মূর্তি হেরুক এবং অবধূতিকা মহামায়ার বা ধ্যানীবুদ্ধ বজ্রসত্ত্বের দেখা যায়। দেবী কালিকাকে এইরূপে কেউই দেখেন না। কিন্তু শেষোক্ত ধ্যানের মূর্তি বহু জায়গায় দেখা যায়, বিশেষত রক্ষাকালী রূপে। তবে তার মাথায় জটা, মুণ্ডমালা, কণ্ঠদেশে নাগহার, হাতে খড়্গ কর্ত্তৃকা খর্পর ও নীলোৎপল, কটিতে ব্যাঘ্রচর্ম এবং বামপদ অগ্রে স্থাপিত হওয়ায় দেবী তারার সঙ্গে এই দেবীর অধিক সাদৃশ্য রয়েছে। একে কেউ কেউ বামাকালীও বলেন। তবে একাক্ষর মন্ত্রপক্ষে সিদ্ধেশ্বর তন্ত্রোক্ত দেবী কালিকার ধ্যান বঙ্গদেশে সুবিখ্যাত। এই মন্ত্রে এবং এই ধ্যানেই সর্বত্র কালীপূজা হয়ে থাকে।

 
 
 
 
 

শবারূঢ়াং মহাভীমাং ঘোরদংষ্ট্রাংবরপ্রদাম্‌। হাস্যযুক্তাং ত্রিনেত্রাঞ্চ কপালকর্ত্তৃকাকরাম।। মুক্তকেশীং ললজ্জিহ্বাং পিবন্তীং রুধিরং মুহুঃ। চতুর্বাহুযুতাং দেবীং বরাভয়করাংস্মরেৎ।।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

শবারূঢ়া চতুর্ভূজা কৃষ্ণবর্ণা হাস্যযুক্তা যে দেবীকে আমরা মন্দিরে মন্দিরে দেখতে পাই, তিনি ধ্যানমন্ত্র অনুযায়ী মহাভীমা বা ভীষণা ও ঘোরদংষ্ট্রা। ধ্যান বলছে তার হস্তে কপালপাত্র এবং কর্তৃকা বা অসি। এই ধ্যানে তিনি ললজ্জিহ্বা, যিনি মুহুর্মুহু রুধির পান করছেন বরাভয়হস্তা মহাদেবী। মন্ত্রান্তরে চামুণ্ডাতন্ত্রে অসামানম্যা কবিত্বপূর্ণ ধ্যান পাওয়া যায়।

 
 
 

খড়্গোদ্ভিন্দেন্দু খণ্ড স্রবদমৃতরসাপ্লাবিতাঙ্গী ত্রিনেত্রা, সব্যে পানৌ কপালাদ্‌ গলদসৃজমথ মুক্তকেশীপিবন্তী। দিগ্বস্ত্রা বদ্ধকাঞ্চী মণিময়মুকুটাদ্যৈর্যুতা দীপ্তজিহ্বা, কায়ান্নীল্লোৎপলাভা রবিশশি বিলসৎ কুণ্ডলালীঢ় পাদা।।

 
 
 
 
 
 
 
 

চন্দ্রকে খড়গদ্বারা ছিন্ন করে তার থেকে নির্গলিত সুধারসে যার সর্বদেহ আপ্লুত মুক্তকেশী ত্রিনেত্রা দেবী, যিনি বামহস্তের নৃকপাল থেকে রুধির পান করছেন। দিগ্‌বস্ত্রা অর্থাৎ নগ্ন মূর্ত্তি— সেই যার কটিদেশ কাঞ্চী দ্বারা বদ্ধ। দীপ্ত মণিমুকুটে শিরোদেশ ভূষিত, রসনা বা জিহ্বা প্রসারিত। নীলপদ্মের বর্ণা সেই দক্ষিণপদ সম্মুখে রেখে দণ্ডায়মানা দেবীর চন্দ্র-সূর্যের মতো কুণ্ডলদ্বয়। এই ধ্যানটি বঙ্গদেশে পূজায় তেমন ব্যবহার নেই। কিন্তু আদ্যা কালীর আর একটি ধ্যান মহানির্বাণ তন্ত্রে আছে, তবে এই ধ্যানটি দ্বিভূজা দেবীর ধ্যান। সঙ্গে আছেন মহাকাল।

 
 
 

মেঘাঙ্গীং শশিশেখরাং ত্রিনয়নাং রক্তাম্বরং বিভ্রতীং পাণিভ্যামভয়ং বরঞ্চ বিকসদ্রক্তারবিন্দ স্থিতাম্‌। নৃত্যন্তং পুরতো নিপীয় মধুরংমাধ্বীকমদ্যং মহা- কালং বীক্ষ্য বিকাসিতাননবরামাদ্যাং ভজে কালিকাম্‌।।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

অর্থাৎ, মেঘের মতো নীলবর্ণা সেই দেবী যার মস্তকে অর্দ্ধচন্দ্র শোভিত, রক্তবস্ত্র পরিধান করে আছেন, সেই ত্রিনেত্রা দেবী তার উভয় হস্তে বর ও অভয় মুদ্রা প্রদর্শন করছেন। যিনি বিকশিত রক্ত পদ্মের উপর বসে আছেন, সম্মুখে মধুর মাধ্বী পান পূর্বক মহাকালকে নৃত্যরত দেখে যিনি অতি প্রসন্ন আননে উপবিষ্টা, সেই আদ্যা কালিকাকে বন্দনা করি।

 

এই ধ্যানেও বহুক্ষেত্রে দেবীকে পূজিত হতে দেখা যায়। এই ধ্যানে দেবী খড়্গ মুণ্ড ধরা চতুর্ভূজা রক্তপানোদ্যতা বা মহাকালের সঙ্গে বিপরীত বিহারে রিত্যাসক্ত, মুণ্ডমালাধারিণী, উলঙ্গিনী, আলুলায়িত কুন্তলা ললজিহ্বা দেবী নন। ইনি শান্তরস প্রভাবে অভিষিক্তা দেবী। তিনি যে রূপেই ধ্যায়িত হন না কেন, দার্শনিকভাবে এই রূপকে প্রায় সর্বতোভাবেই তত্ত্বায়িত করা হয়েছে। তবু এই তত্ত্বের বাইরে ছড়িয়ে আছে কিংবদন্তী। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ আদেশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন পরদিন ঊষাকালে যাকে প্রথম দেখবেন, তার মধ্যেই তিনি দেবীকে দেখতে পাবেন। তিনি প্রাতঃকালে এক গোপকন্যাকে দেখেন যিনি লজ্জাবশত আগমবাগীশকে দেখে জিভ কেটে পালিয়ে যান। তার পূর্বে গোবর দেবার জন্য উর্দ্ধোহাত উত্থিত ছিল। সেখান থেকেই এই মূর্তির প্রকাশ। ষোড়শ শতক থেকে এই শিবের উপরে চতুর্ভূজা মূর্তিই পূজিত হয়ে আসছেন। অষ্টাদশ শতকে এই মূর্তিকেই আশ্রয় করে হিন্দু বাঙালি সমাজ আত্মবল সঞ্চার করেছিল। তাই ঘোরা ভীষণা শ্মশানবাসিনী মুণ্ডমালাধারিণী মমতাময়ী মাতৃমূর্তিতে রূপান্তরিতা হয়েছেন। হয়েছেন মহাকালের মনমোহিনী।

 
 
 

তথ্যসূত্রঃ

 

১. ঋক্‌ বেদের দশম মণ্ডলের দেবীসূক্তে আছে

 

‘অহং রুদ্রায় ধনুরাতনোমি ব্রহ্মদ্বিষে শরবে হন্তবা উ!’

 

ঋক্‌, ১০ মণ্ডল, সূক্ত ১২৫

 

উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : বেদ, দ্বিতীয় খণ্ড : হরফ প্রকাশনী।

 

২. মার্কণ্ডেয়সমাস্যা প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনি সমৃদ্ধ পর্বাধ্যায়। মহাভারতের বনপর্বে আছে। কলিকাতা সংস্করণে ১৮১ থেকে ২৩২ অধ্যায় ক্রিটিক্যাল এডিশনে আছে ১৭৯-২২১ অধ্যায়।

 

৩. মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর অংশ, উত্তরচরিত্র, সপ্তম অধ্যায়, শ্লোকসংখ্যা ৬-৯।

 

৪. দ্রষ্টব্য : বৌদ্ধদের দেবদেবী, বিনয়তোষ ভট্টাচার্য, চিরায়ত প্রকাশন।

 

৫. বৃহৎ তন্ত্রসার, প্রথম খণ্ড, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, বসুমতী সাহিত্য মন্দির, পৃ. ৩১০।

 

৬. তদেব, পৃ. ৩১১।

 

৭. তদেব, পৃ. ৩২০।

 

৮. তদেব, পৃ. ৩১৮।

 

৯. তদেব, পৃ. ৩১৯।

 

১০. মহানির্বাণ তন্ত্র : পঞ্চমোল্লাস শ্লোক ১৫১, হরিহরানন্দ ভারতী, জগন্মোহন তর্কালঙ্কার কৃত অনুবাদ, নবভারত পাবলিশার্স, পৃ. ২১১।

 
 

হাজার চুরাশির মাঃ স্মৃতি সত্তা অভিনয়

 মীনাক্ষী সিনহা

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

গত শতকের সত্তরের দশক। সেই উত্তাল সময়ে ছিলাম শহরতলির দক্ষিণেশ্বরে।

 

প্রতিদিন টুকরো-টুকরো খবর ছিটকে পড়ছে খবরের কাগজের পাতায়। সত্যি মিথ্যে

 

যাচাই করতে পারিনি, ভালো-মন্দ, ঠিক-ভুলের বিচারও নয়। বন্দুকের নলই শক্তির

 

উৎস কিনা, সে বিষয়েও কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তখন কেবল বাতাসে বারুদের

 

গন্ধ ভারি করছে পরিবেশ, পরিমণ্ডল।

 

সেই সময় একদিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ছাপা হল বারাসাতের রাস্তায় পড়ে

 

থাকা গুলিবিদ্ধ এক তরুণের ছবি। চমকে উঠলো পাঠক, সঙ্গে আমরাও। ছেলেটির ছবি

 

দেখে বারাসাতে ছুটে গেলেন তার বাবা, যিনি আমার স্বামীর কর্মক্ষেত্রে

 

দায়িত্ববান এক অফিসার। তাঁর নাম উহ্য থাক, বি. কে. সি. কলেজের দ্বিতীয় বর্ষ

 

বিজ্ঞানের উজ্জ্বল ছাত্র তাঁর পুত্রের নামও আবৃত রইলো। সত্যের মুখ তো এমনই

 

ঢাকা থাকে বহু সময়।

 

তারপর উদ্ঘাটিত হল আধো আলো আধো কুয়াশায় ঢাকা ঘটনা- একটি ছেলে নয়, মোট

 

আটটি তরুণের প্রাণহীন গুলিবিদ্ধ দেহ বারাসাতের পথে পথে ছড়ানো। তারা সবাই

 

আদতে দক্ষিণেশ্বর, আড়িয়াদহ, কামারহাটি অঞ্চলের। সেই ছবিটি যেন অনেকটাই

 

প্রতিবিম্বিত হল একটি বইয়ের পাতায়- ‘হাজার চুরাশির মা’, লেখিকা মহাশ্বেতা

 

দেবী।

 

তারপর কেটে গেল বহুদিন, হাজারো স্মৃতি বহন করে সময়ের নদী বয়ে গেল, আকাশের

 

নীল হল ধূসর। স্মৃতি-বিস্মৃতি ছায়ে আজও মনে পড়ে বারুদের গন্ধে ভেসে আসা

 

অকরুণ ছবি।

 

কেন জানি না, ‘হাজার চুরাশির মা’ পড়ে এক অনুভূতি হল, ব্রতীর মার ক্ষোভ, বেদনা,

 

বিদ্রোহ যেন হাজার-হাজার ব্রতীর কথা মনে করিয়ে দিল। তাদের অনেককেই যেন

 

চিনি, সবটা চিনি না। তারাই একদিন সমু, বিজিত, পার্থ, লালটু আর ব্রতীর সঙ্গে

 

মিশে গেল।

 

আর তাদের কথা ভেবেই এক অধ্যাপিকা অনাম্নী নাট্যকর্মী হয়ে উঠতে চাইলেন-

 

হাজার চুরাশির মা, সালটা ১৯৯৫।

 
 
 

বেথুন কলেজের প্রাক্তনীদের পুনর্মিলনে প্রথম দেখা গেল ব্রতীর মাকে- একা,

 

নিঃসঙ্গ। সাধারণ পরিচয়ের মধ্য থেকে ধীরে ধীরে জন্ম নিল ব্রতীর মা সুজাতা

 

চ্যাটার্জি- ‘হাজার চুরাশির মা’। অনেক অনেক নাম না জানা, পরিচয় হারানো ব্রতীরা

 

উঠে এলো পাদপ্রদীপের আলোয়। আমার মতো সাধারণ একজন মঞ্চে একক

 

অভিনয়ে নিয়ে এল হাজার চুরাশির মাকে। সেই থেকে আমার অভিনয়ের মধ্য দিয়ে শুরু

 

হল নিরন্তর খুঁজে ফেরা ব্রতীর মাকে, ব্রতীর মতো আরো অনেক ছেলের মাকে,

 

শোক, ক্ষোভ, প্রতিবাদ যাদের বুকের আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে।

 

আমার নিজের করা স্ক্রিপ্টের কথা জানিয়ে স্বয়ং মহাশ্বেতা দেবীর কাছ থেকে

 

পেলাম অভিনয় করার অনুমতিপত্র ( যা আমার কাছে সযত্নে রক্ষিত আছে )।

 

তারপরেও একদিন মহাশ্বেতা দেবীর সামনে একক অভিনয়ে নিয়ে এলাম ব্রতীর

 

মাকে, তাঁর হাজার চুরাশির মাকে। সেটুকুই আমার অহংকার, আমার গৌরব।

 

লন্ডনে ১৯৯৯ সালে ‘হাজার চুরাশির মা’ অভিনয়ের পরে ভারি হয়ে উঠেছিল ঘরের

 

বাতাস। প্রবাসী এক তরুণী সজল চোখে জানালেন, কলকাতায় বরানগরে এই

 

আন্দোলনে রত তার ভাইকে পুলিশের গুলিতে হারিয়েছেন। সেদিন আমি নিজের মধ্যে

 

খুঁজে পেয়েছিলাম ব্রতীর মাকে। তারও পরে কলকাতায় ‘হাজার চুরাশির মা’-র এক

 

ঘরোয়া পরিবেশে অভিনয়ের পরে আমার কাছে এগিয়ে এসেছিল বছর চারেকের এক

 

শিশু। ছোট্ট ছেলেটি আমার হাত ধরে প্রশ্ন করলো- “তোমার ছেলে মারা গেছে বলে

 

এতো কাঁদছ ?”

 

বাংলা সাহিত্যের এক সাধারণ অধ্যাপিকা বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের এক অনাম্নী অঙ্গনা

 

সেদিন সত্যি হয়ে উঠেছিল ‘হাজার চুরাশির মা’। অভিনেত্রী বলে বিশেষ পরিচিতি

 

হয়তো নেই, তবু আজও কখনো কখনো আমার চেনা পরিচয় ছাপিয়ে ‘হাজার চুরাশির

 

মা’ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সেদিন শ্রদ্ধেয়া সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওঁর মেয়ে

 

সৌমির সঙ্গে পরিচয় হতেই আমাকে বিস্মিত করে উনি বললেন- “হাজার চুরাশির মা”।

 

অভিভূত হয়ে জানলাম একটি অনুষ্ঠানে আমার অভিনয় উনি দেখেছেন, মনে রেখেছেন।

 

কেটে গেল বহু দিন। ১৯৯৫ থেকে ২০২০। বহুবার অভিনয় হয়েছে- কলকাতা থেকে

 

ঢাকা, চট্টগ্রাম, লন্ডন। আমার অখ্যাত শিল্পী জীবনের অনেক স্মৃতি। বাংলাদেশের

 

বিশিষ্ট নাট্যকার, প্রযোজক, অধ্যাপক, মুক্তিযোদ্ধা সদ্যপ্রয়াত মমতাজ উদ্দীন

 

আহমদ আমার ‘হাজার চুরাশির মা’ দেখে তাঁর লেখা একক সংলাপে আমায় রূপ দেবার

 

জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। এ সবই আমার পরম প্রাপ্তি।

 
 
 

‘হাজার চুরাশির মা’ সুজাতা চ্যাটার্জির সন্তান শোক হাজার হাজার সন্তান হারা

 

মায়ের বুকে যন্ত্রণার যে দাহ সৃষ্টি করেছে, তা স্মৃতিবেদনায় লগ্নিত তাঁদের হৃদয়ে।

 

অস্তিত্বে তাই অলক্ষ্য কোনো অমোঘ বিধানে আমি যখন হারালাম আমার

 

কন্যাকে, তখন কোথায় যেন ব্রতীর মার যন্ত্রণা ব্যাপ্ত হল আমার জীবনে।

 

না, আমার প্রাণপ্রতিম ছোট মেয়ে কোনো বিপ্লব আন্দোলনে হারিয়ে যায়নি, যুগের

 

কালান্তক মারণ ব্যাধিতে সে অকাল প্রয়াত। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা সব জননীর

 

অনুভবে এক ও অভিন্ন।

 

আমার কন্যার প্রয়াণের ঠিক এক মাস পরে ‘কথাকৃতি’ নাট্যগোষ্ঠীর আমন্ত্রণে

 

ছিল আমার ‘হাজার চুরাশির মা’-র শততম অভিনয়। সেদিন কখন কোন অনুভবে

 

ব্রতীর মৃত্যুশোকে মিলে গিয়েছিল আমার কন্যা হারানোর বেদনা। কাহিনি, কল্পনা,

 

বাস্তব জীবন একাকার হয়ে গেল। সেদিন ৮ই মার্চ ২০১৯ তৃপ্তি মিত্র সভাগৃহে

 

আমি সত্যি হয়ে উঠেছিলাম ‘হাজার চুরাশির মা’।

"Breathe" ওয়েব সিরিজের শ্বাস প্রশ্বাস মাপতে বসলেন

অজন্তা সিনহা

 
 
 
 
 

সত্যি কথা বলতে কি, ‘Breathe’ সম্পর্কে আমি প্রথম আগ্রহী হই জুনিয়র বচ্চনের ওয়েব সিরিজ

 

অভিষেক নিয়ে নেটিজেনদের প্রবল উচ্ছ্বাস দেখে। তথ্যসূত্র ফেসবুক। সেখানে দেওয়াল জুড়ে লোকজন

 

উদ্বেলিত। এমনিতে বেচারার দেওয়াল লিখন তেমন সুবিধার নয় ইদানীং। সেক্ষেত্রে এই সিরিজ কি তাঁর

 

ভাগ্য ফেরাতে পারবে ? বিশেষত এমন এক সময়, যখন বলিউডে নেপোটিজম বিতর্ক একেবারে তুঙ্গে।

 

আর বেচারা অভিষেক তো কেরিয়ারের জন্মলগ্ন থেকেই নেপো-বদনামের শিকার। তাঁর সাম্প্রতিক টুইট

 

বিতর্ক আবার সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে। যাই হোক, এই সবের মধ্যেই এই সিরিজের স্ট্রিমিং শুরু। এত

 

বছর বিনোদন জগৎ নিয়ে কাজ করছি। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত ঠিক কি দাঁড়ালো, তাই নিয়ে আগ্রহ

 

অনুভব করবো না ? বলা যায়, এভাবেই প্রথমে আমি ‘Breathe : Into the shadow’ দেখলাম আগে, যা

 

কিনা আসলে ‘Breath’ সিরিজের সিকোয়েল বা দ্বিতীয় সিজন।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

আমাজন প্রাইমে দ্বিতীয়টি দেখানো শুরু হয় ২০২০’র জুলাইতে, চলে ১২টি পর্বে, যা ইতিমধ্যেই

 

সমাপ্ত এবং ব্যাপক হারে আলোচিত। উপমহাদেশীয় জনতা ছোটে বচ্চনকে পছন্দ করেছে। একজন

 

সমালোচক বা বিশ্লেষক হিসেবে দর্শকের মতামতকে চিরকালই প্রাধান্য দিই আমরা। এক্ষেত্রেও

 

নিশ্চয়ই দেব। কিন্তু তার আগে কিছু কথা। ‘Breathe’ প্রথম সিজন দেখানো হয় ২০১৮’র জানুয়ারিতে,

 

৮টি পর্বে। এখানে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন আর মাধবন। দক্ষিণের এই অভিনেতা বলিউডে

 

বহুবছর ধরে চুটিয়ে কাজ করছেন। কেরিয়ারের শুরুতে হিন্দি টেলিভিশনে বেশ কিছু হিট ধারাবাহিকে তাঁকে

 

পেয়েছি আমরা। এখানে, দুই সিরিজের মধ্যে অভিনয়ের তুল্যমূল্য বিচারে মাধবনকেই এগিয়ে রাখবো।

 

প্রসঙ্গত, চিত্রনাট্য ও সংলাপের গুণগত মানের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টির তুলনায় প্রথমটি উন্নত।

 

মাধবনের অভিনয় ভালো হওয়ার এটা একটা কারণ হতে পারে। এছাড়াও মাধবনের টেলিভিশন অভিনয়ের

 

অভিজ্ঞতা তাঁকে ওয়েব সিরিজে কাজের ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে বলে মনে হয় ।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

বড় ও ছোট পর্দায় অভিনয়ের ক্ষেত্রে অভিব্যক্তি ও শরীরী অভিনয়ের মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন হয়, একথা

 

সকলেরই জানা। অভিষেককে এই ব্যাপারে ভাবতে হবে অবশ্যই। ক্লোজআপ শটে তাঁর ঘাটতিগুলি চোখ

 

এড়ায় না। তাঁর ওয়েব সিরিজে কাজ করা উপলক্ষে দর্শকের উত্তেজনা প্রশমিত হলেই, এই ঘাটতি ধরা

 

পড়বে নিশ্চিত।

 
 
 
 
 

চরিত্রগুলির বিন্যাসে পরিচালক ময়ঙ্ক শর্মা প্রথম সিজনে দক্ষতা দেখিয়েছেন বেশি। তাঁর সহযোগী

 

অভিজিৎ দেশপান্ডের নামও উল্লেখ দরকার এই প্রসঙ্গে। ‘Breathe : Into the shadow’ র ক্ষেত্রে

 

ময়ঙ্ক গল্প লিখেছেন বিক্রম টুলিকে নিয়ে। এ গল্প অনেক বেশি জটিল। জটিল অথচ বাঁধুনি আঁটোসাঁটো

 
 
 

নয়। থ্রিলারের ক্ষেত্রে যা একান্ত জরুরি। দুটি সিজনে দুটি সম্পূর্ণ পৃথক গল্প হলেও কিছু বিষয়

 

অবশ্যই আছে, যা একটি সূত্রে গাঁথে এই থ্রিলার সিরিজকে। দুক্ষেত্রেই মূল বিবেচ্য বাবার প্রবল

 

সন্তানস্নেহ। এই প্রাবল্য এতটাই যে সেই বাবা, সন্তানের প্রাণ রক্ষার তাগিদে খুনের মতো অপরাধে

 

জড়িয়ে পড়তে পিছপা হয় না। তাও এক-দু’টি নয়, সিরিয়াল কিলিং। লোকজন ‘Breathe’ সিরিজের স্টোরি-

 

লাইনের এত প্রশংসা করেছে, যে, একজন ছাপোষা সামাজিক মানুষ রাতারাতি সিরিয়াল কিলারে পরিণত

 

হতে পারে কিনা, সেই প্রশ্ন আর তুলতে সাহস পেলাম না। এ ব্যাপারে মনস্তাত্ত্বিকেরা হয়তো ভালো

 

বলতে পারবেন ! একজন দর্শক হিসেবে আমার বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি, এটুকু বলতে পারি।

 

খুন করা এত সহজ কাজ নয়, যে চাইলেই করে ফেলা যায়। প্রেক্ষিত থাকলেও নয়। প্রসঙ্গত,সন্তানের

 

জীবনরক্ষা নিয়ে যে ভাবাবেগ, সে ব্যাপারে দু’টি সিরিজে কিছু পার্থক্য রয়েছে।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

আগেই বলেছি, ‘Breathe : Into the shadow’ তুলনায় জটিল। এখানে ডঃ অবিনাশ সবরওয়াল পেশায়

 

একজন মনরোগ চিকিৎসক। তার ৬ বছর বয়সী মেয়েকে কিডন্যাপ করে এক মুখোশধারী। শেষে জানা

 

যায়, এই মুখোশধারী আসলে অবিনাশ স্বয়ং। সে মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিজঅর্ডারের শিকার। নিজেই

 

ওই মুখোশধারী চরিত্রটি হয়ে, নিজের মেয়েকে কিডন্যাপ করে। তারপর সেই চরিত্রেরই নির্দেশে

 

মেয়েকে মুক্ত করার জন্য একের পর এক খুন করে। তার স্ত্রীও অবিনাশকে সমর্থন করে শুধু

 

সন্তানস্নেহের ব্যাকুলতায়। অবশ্যই, তার স্বামীর অপর সত্তাই যে সেই কিডন্যাপার, সেকথা না

 

জেনে। অবিনাশের এই অসুখের পিছনে তার শৈশবের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে, যা বেশ কয়েকটি

 

পর্বে বিন্যস্ত। বর্তমান সময় আর ফ্ল্যাশব্যাক, দুইয়ের মধ্যে অনেকবারই গল্প গুলিয়ে যাওয়ার

 

পরিস্থিতি তৈরি হয়, যা এহেন থ্রিলারের রসগ্রহণে ব্যাঘাত ঘটায় নিঃসন্দেহে।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

এছাড়া সিরিজের তৃতীয় পর্বেই মোটামুটি বোঝা হয়ে যায় অবিনাশই মুখোশধারী। খুনির পরবর্তী টার্গেট

 

কে, বাচ্চা মেয়েটির ভাগ্যে কীআছে শেষ পর্যন্ত, তাই নিয়ে কিছুটা টেনশন থাকলেও, খুনি কে,

 

কিডন্যাপার কে, সেটা বোঝা হয়ে গেলে সাসপেন্সটা আর থাকে না। অর্থাৎ থ্রিলারের অনেকটা মজাই

 

নষ্ট। এছাড়াও মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার, মেয়েটির কিডন্যাপ হওয়া (সেই মেয়েটিও আবার

 

এক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত), তাকে ফিরে পাওয়ার শর্ত হিসেবে একাধিক খুন—বিষয়টি গুলিয়ে

 

যেতে বাধ্য। সত্যি বলতে কি, জটিল এই অঙ্ক, চিত্রনাট্যে প্রকাশের ক্ষেত্রে স্বচ্ছন্দ মনে হয়নি

 

লেখকযুগলকে। এই দুর্বলতাও অভিষেকের অভিনয়ের যথার্থ রূপ তুলে আনার পরিপন্থী হলেও হতে

 

পারে।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

প্রথম সিজনের কাহিনী তুলনায় সরল। ফুটবল কোচ ড্যানির একমাত্র সন্তান জশের শ্বাসকষ্টজনিত

 

রোগ। তার বেঁচে থাকার জন্য সত্ত্বর অর্গান ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন। বহু চেষ্টার পরও ব্যর্থ

 
 
 

হয়ে খুনের পথ বেছে নেয় ড্যানি। চিত্রনাট্যে কোনও একটি যুক্তি দেখানো হলেও, কেন যে সে

 

ডোনারদের খুন করে, সেটা পরিষ্কার নয়। রেসিপিয়েন্টদের খুন করাটাই স্বাভাবিক ছিল। তাহলেই তো

 

তার ছেলের সামনের লাইনটা কমে আসতো দ্রুত। এই ডোনারের ক্ষেত্রেও একখানা টুইস্ট আছে।

 

যাদের খুন করছে বা করবে সে, তাদের মধ্যে রয়েছে এই খুনগুলির তদন্তকারী ইনস্পেক্টরের স্ত্রী।

 

এখানেই শেষ নয়। আরও টুইস্ট আছে। অনবধানে সেই ইনস্পেক্টরের সার্ভিস রিভলভারের গুলিতে

 

একমাত্র সন্তান মারা যায়। সেই যন্ত্রনা ও আত্মগ্লানি ভুলতে না পেরে দিনরাত নেশায় চুর সে।

 

স্ত্রীও বিরক্ত হয়ে ডিভোর্স নেবার পথে। সে যাই হোক, আমরা দেখতে পাই, সিরিয়াল খুনের তদন্ত

 

এবং স্ত্রীর প্রাণ বাঁচাতেই হবে, এই দুই টার্গেট নিয়ে দিবারাত্র এক করে ফেলে ইন্সপেক্টর কবীর।

 

এই ইন্সপেক্টর কবীরকে আমরা পরের সিজনেও পাই। সেখানে সে মুখোশধারী অবিনাশের পর্দা ফাঁস

 

করবে এবং একটি অনিচ্ছাকৃত অপরাধের জালে জড়িয়ে বদনামের ভাগীদার হবে। কবীর ও তার পুলিশ

 

টিমই একমাত্র কমন ‘Breathe’-এর দুটি সিজনে । বাকি পাত্রপাত্রীর বদল ঘটেছে।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

শোনা যাচ্ছে দর্শক অধীর আগ্রহে রয়েছে তৃতীয় সিজনের জন্য। প্রযোজকদের তরফে এখনও কোনও

 

খবর না থাকলেও, সেটি হ’লে কবীর নিশ্চয়ই সেখানেও হাজির থাকবে দুষ্টের দমনে। চরিত্রটিতে

 

অভিনয় করেছেন অমিত সাধ। দু’দুটি ‘Breathe’ মিলিয়ে অভিষেক বচ্চন ও মাধবনের সমান্তরাল তাঁর

 

চরিত্র। কিন্তু বড্ড আশাহত করেছেন ‘কাই পো চে’ খ্যাত এই অভিনেতা। অভিব্যক্তি নিয়ে কিছু বলা

 

ছেড়েই দিলাম। শুধুমাত্র বডি মুভমেন্ট দিয়েই পুরোটা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। প্রতিটি

 

সংলাপ খুব কষ্ট করে বুঝতে হয়েছে। অথচ কী স্বাভাবিক, শক্তিশালী অভিনয় করেছেন তাঁর সঙ্গে

 

প্রায় প্রতি দৃশ্যে থাকা হৃষিকেশ জোশি। বলতে দ্বিধা করবো না, দুই সিজন মিলিয়ে অভিনয় ক্ষেত্রে

 

সেরা প্রাপ্তি হৃষিকেশ। মারাঠি সিনেমা, টিভি ও থিয়েটারের এই অভিনেতা বুঝিয়ে দিয়েছেন, চারপাশের

 

বাকি বিষয়গুলি যতই প্রতিকূল থাক, একজন যথার্থ অভিনেতা চরিত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে সব

 

সময় সক্ষম। বাকিদের মধ্যে অভিজ্ঞ নীনা কুলকার্নি জশের ঠাকুমার চরিত্রে নিখুঁত। বিশেষত ছেলে

 

খুনি এটা জানতে পারছেন যখন, সেই দৃশ্যে তাঁর অভিব্যক্তি মর্মস্পর্শী।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

পরিচালক ময়ঙ্ক শর্মা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সাইকোলজিকাল থ্রিলার বানানোর শখ তাঁর

 

দীর্ঘদিনের। সেই শখ পূর্ণ করেছেন তিনি। দর্শক গ্রহণ করেছে তাঁর কাজ। কয়েকটি বিষয় অবশ্যই

 

প্ৰশংসার দাবীদার। ঝকঝকে সেট, দ্রুত গতি, যথাযথ ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর। কিন্তু যে প্রশ্নগুলি

 

উঠে এলো এই সিরিজ দেখার পর, তারও খোলসা হওয়া প্রয়োজন। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, ওয়েব

 

সিরিজে ক্রাইম ও সাইকোলজিকাল থ্রিলারেরই প্রাধান্য এখনও পর্যন্ত। দর্শক মূলত জেন ওয়াই।

 

প্রায় সকলেই ভারতীয় প্রযোজনার পাশাপাশি সারা বিশ্বের সিরিজগুলি দেখছে।

 
 
 
 
 

প্রেক্ষিত আলাদা হলেও লোকজন ‘ব্রেকিং ব্যাড’, ‘দ্য সোপ্রানোস’, ‘নারকোস’-এর মতো সিরিজ

 

দেখেছে। দেখেছে ‘মাইন্ড হান্টার’-এর মতো রিয়েল লাইফ সিরিজ। এমনকি ‘সেক্রেড গেমস’, যেটা দিয়ে

 
 
 

এদেশের ওয়েব সিরিজের জয়যাত্রা শুরু, তারও একটি বলার মতো উচ্চমাত্রা স্থাপিত হয়েছে । অর্থাৎ

 

প্রতিযোগিতা আছে। দর্শকের ভাবনাতেও লাগছে তুল্যমূল্য বিচারের ভাবনা। সেখানে পরিচালকরা

 

আরও একটু বেশি না ভাবলে কী করে চলবে ?

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

টেলিভিশনের তথাকথিত সাস-বহু সিরিয়াল থেকে একদা মুখ ফিরিয়েছিল নয়া প্রজন্ম। তারাই আজ

 

ওয়েব সিরিজের উপভোক্তা। এখানেও তাদের চাহিদা পূর্ণ হচ্ছে কিনা, পয়সা উসুল হচ্ছে তো, এসব

 

তারা আজ না হোক কাল পরখ করবেই। হিন্দি ও বাংলা, দু’ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। তার আগেই

 

প্রযোজনার মান উন্নত করতে হবে। বাইরের চাকচিক্য এসে গেছে। এবার নজর দিতে হবে ভাবনা ও

 

তার সামগ্রিক বিন্যাসের ক্ষেত্রে। রিসার্চের কাজটা আরও নিখুঁত ও গভীর হওয়া জরুরি। যুক্তিনিষ্ঠ

 

ও বিজ্ঞানমনস্ক হওয়াও খুবই দরকার । তবে, এ দায়িত্ব শুধু পরিচালক বা লেখকের নয়। নয় শুধু

 

প্রযোজকের। ওয়েব দুনিয়ার এই সমান্তরাল বিনোদন প্ল্যাটফর্মকে সঠিক মাত্রায় পৌঁছতে অভিনেতা

 

থেকে সংশ্লিষ্ট সকলকেই যত্নবান হতে হবে।

প্রসেনিয়াম এর বাইরে রঙ্গের নানা মঞ্চ নিয়ে মন্তব্য করলেন

মৈনাক সেনগুপ্ত

 
 
 
 
 
 
 

ভাণ – অল্টারনেটিভ স্পেসে যে থিয়েটার হচ্ছে সেই থিয়েটার বাদলবাবুর থার্ড থিয়েটার ফর্মের বাইরেও

 

নানারূপে বাংলায় কাজ হচ্ছে। বাংলায় এই অল্টারনেটিভ স্পেসের সম্ভাবনা ও সংকট সম্বন্ধে আপনার কী

 

অভিমত?

 

মৈনাকবাবু – একজন দর্শক হিসেবে আমি বলছি অনেকগুলো কারণে এটা হচ্ছে । থিয়েটার সবসময় নতুন ভাষা

 

খোঁজে। বদলবাবু তাঁর সময় তাঁর মতো করে একটা অন্যতর ভাষা খুঁজেছিলেন। তার পেছনে একটা অন্য দর্শনও

 

ছিল। বাদলবাবুর অনেক উত্তরসূরি রয়েছেন যাঁরা তাঁর দর্শনটা নিয়েও কাজ করছেন। বিকল্প দর্শনের জায়গা

 

থেকেও কাজটা করছেন। সেই ধারাবাহিকতাটা রয়েছে এবং তার বাইরেও অনেকে করছেন। বিভিন্ন স্পেসে কাজ

 

হচ্ছে। আমি শুভদীপবাবুর একটা কাজ দেখেছিলাম যেটা জঙ্গলের ব্যাকগ্রাউন্ডে। নাম করলে বিশাল তালিকা

 

হবে। এইরকম প্রচুর কাজ হচ্ছে। এটা গত চার–পাঁচ বছরে একটু বেশিই হচ্ছে না?

 

ভাণ- হ্যাঁ, তা তো বটেই।

 

মৈনাকবাবু- দেখো, বিকল্প দর্শনের কিন্তু সবসময় আমরা দেখছি না। এইরকম অনেক নাটকই আমরা জানি

 

যেটা প্রোসেনিয়ামেও হচ্ছে আবার নন-প্রোসেনিয়ামেও হচ্ছে। তাতে আমার ব্যাক্তিগতভাবে দর্শক হিসেবে

 

কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সেক্ষেত্রে হল পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা থাকে। আমি এমন একটা

 

প্রোডাকশন তৈরি করব যেটা ফ্লেক্সিবল্, যেকোনো স্পেসে করা যায়। আবার কোনো কোনো প্রোডাকশনে

 

ততটা ফ্লেক্সিবিলিটি থাকছে না। সেটা প্রোসেনিয়াম ফরম্যাটেই বানানো কিন্তু সেটা কোনো ইন্টিমেট স্পেসে

 

হচ্ছে। ইন্টিমেট স্পেসের যে বিজ্ঞান, যে ব্যাকরণ, যে আবেগ দর্শককে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার সেটার অভাব

 

দেখছি অনেক সময়। আবার, কিছু কিছু স্পেস স্পেসিফিক কাজও দেখছি। যেমন–গোবরডাঙা নকশা বা থিয়েটার

 

প্লাটফর্ম তারা একটি নাটক বানাচ্ছেন একটি নির্দিষ্ট স্পেসে করবেন বলেই। এটা ভাষা নিয়ে পরীক্ষা

 

নিরীক্ষা তো বটেই, দর্শন নিয়ে কতটা সেটা জানিনা। বাদলবাবুর ধারাতে কেউ কেউ রয়েছেন, কেউ কেউ অনেকটা

 

সরে এসেছেন। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে যে, স্যালারি গ্রান্টের একটি শর্ত থাকে যে প্রতি বছর একটি

 

প্রযোজনা নির্মাণ করতে হবে। হলের অপ্রতুলতা বা অন্যান্য পরিকাঠামোগত অসুবিধে সেগুলোর জন্যেও কিছু

 

কিছু দল সম্ভবত একটি নাটক করছেন যেটি স্পেসে করে নেওয়া যাবে। তাতে খরচও কম হবে। এটা সংকটের

 

দিক নয়। অবশ্যই প্রোসেনিয়াম থিয়েটারের ঘেরাটোপের বাইরে বেরোনোর ক্ষেত্রে বাদল সরকারের বহু আগে

 

পানু পাল কাজ করেছেন পথ নাটক নিয়ে। বাংলা নাটকে পানু পালকে পথিকৃৎ বলা যায়। তারপর বাদলবাবু অঙ্গন

 

মঞ্চেও কাজ করেছেন। বিভিন্ন লোক বিভিন্নভাবে কাজ করছেন। অনেকে যূথবদ্ধভাবে তৃপ্তি মিত্র সভাগৃহ

 

ভাড়া নিয়ে পাঁচ-ছয়টি দল একসঙ্গে কাজ করছে। প্রোসেনিয়াম নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসা ভালো। আরও

 

ভালো হয় যদি এই স্পেসগুলোর থেকেও বেরিয়ে খোলা ময়দানে করা যায়।

 

ভাণ – আপনি যে শ্রুতিমধুর ব্যাপারটা বললেন, তার মানে যারা শুধুমাত্র এই স্পেসটাকে ইউজ করছে, দর্শনের

 

দিক থেকে নয় নিজেদের একটা কনভিনিয়েন্সের জন্য ।

 

মৈনাকবাবু- এটা আমার একেবারেই ব্যাক্তিগত অভিমত। তবে তুমি চারপাশে খেয়াল করলেই দেখতে পাবে যে

 

নাটকটি স্পেসে হচ্ছে সেই নাটকটিই আবার প্রোসেনিয়ামে হচ্ছে। নাটক যদি এইরকম ফ্লেক্সিবল্ হলে উঠতে

 
 
 

পারে তাহলে তো কোনো অসুবিধে নেই। কিন্তু ওই নাটকটা যদি তুমি দুটো জায়গাতে দেখো প্রোসেনিয়মে এবং

 

নন–প্রোসেনিয়ামে তাহলে বুঝতে পারবে সব প্রযোজনাই তত ফ্লেক্সিবল্ নয়। হল পাওয়ার সমস্যাটা আমরা

 

সবাই জানি। তাই সেখান থেকে বিকল্প জায়গা খোঁজার একটা তাগিদ রয়েছে। এটার একটা বড়ো ভালো দিক হলো

 

প্রতিষ্ঠান নির্ভরতা থেকে সরে আসার চেষ্টা। হয়তো প্রাথমিকভাবে সেই স্পেস উপযোগী থিয়েটার বানাতে

 

পারছিনা, কিন্তু একটা চেষ্টা তো করছি। আমাকে কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে না। চর্চা করতে করতে

 

হয়তো আমরা একটা ভালো জায়গায় পৌঁছতে পারবো। প্রোসেনিয়ামে দর্শককে আনতে হয়। আনাটা বড় কঠিন

 

হয়ে যাচ্ছে আজকের দিনে। প্রোসেনিয়ামের চাকচিক্যের সঙ্গে অনেকেই পাল্লা দিয়ে উঠতে পারছেননা। তাই

 

তার বিকল্প পথ খুঁজতে গিয়ে যদি তারা বিকল্প পথের সন্ধান পেয়ে যান মন্দ কি।

 

ভাণ – ধন্যবাদ মৈনাকদা।

অবন্তী চক্রবর্তী

 
 
 
 
 
 
 

নন প্রোসেনিয়াম কাজ এখন শিল্পগত ভাবে বেশি টানে…

 

আমার মনে হয় যে, অল্টারনেটিভ স্পেস থিয়েটারের বা নন-প্রোসেনিয়াম থিয়েটার যেটাকে বলছো,

 

সেখানকার থিয়েটারই এখন একমাত্র ভবিষ্যৎ আমাদের থিয়েটারের। কারণ প্রথমত, প্রোসেনিয়ামের ইকোনমিক্সটা

 

আমরা মিট করতে পারছিনা। সেক্ষেত্রে ছোট ছোট স্পেসে এবং অল্টারনেটিভ স্পেসে যে পারফরম্যান্সগুলো

 

হচ্ছে সেগুলো এক ধরনের ইকোনমিক্সকে সাপোর্ট করছে এবং সেটা হয়ত যে যার নিজের ফ্লেক্সিবিলিটি

 

অনুযায়ী প্র্যাকটিক্যালি করতে পারছে। আর্টিস্টিক্যালি বলব যে, এটা একটা চয়েস্ যে তুমি কোন ফর্মে কাজ

 

করতে ইন্টারেস্টেড প্রোসেনিয়ামে নাকি নন-প্রোসেনিয়ামে নাকি স্ট্রিটে। দ্যাটস আ ম্যাটার অফ আ চয়েস্ ফর

 

অ্যান আর্টিস্ট। সো ইন দ্যাট কেস নন-প্রোসেনিয়াম বা অল্টারনেটিভ স্পেসে কাজ করা আমার কাছে অ্যাজ

 

অ্যান আর্টিস্ট অলওয়েজ মাচ মোর চ্যালেঞ্জিং, বিকজ আ স্পেস ইজ মোর ফ্লুইড। স্পেসে ফ্লুইডিটিটা বেড়ে যায়

 

এবং ফ্লেক্সিবিলিটিটাও বেড়ে যায়। তুমি একটা স্পেসকে নানানভাবে ভাঙতে পারো, গড়তে পারো, রিকনস্ট্রাক্ট

 

করতে পারো। সেটা প্রোসেনিয়ামের মধ্যেও সম্ভব। এমন নয় যে সেটা প্রোসেনিয়ামের মধ্যে সম্ভব নয়। আমি

 

এমন অনেক প্রোসেনিয়াম দেখেছি যেখানে প্রোসেনিয়াম স্ট্রাকচারটাকে ভেঙ্গে অন্য ফর্মে ট্রান্সফর্ম করা হয়েছে।

 

দ্যাট এগেইন ডিপেন্ডস অন আ লট অফ ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল সাপোর্ট। যে পরিশ্রমটা একটা প্রোসেনিয়ামকে

 

ভাঙতে লাগে সেখানে অলরেডি একটা ফ্লেক্সিবল স্পেস যদি আমি নির্বাচন করি ফর মাই পারফরম্যান্স তাহলে

 

অনেকটা বেশি কম্ফোর্টেবল হয় সেটা। আমার মনে হয় ফর অ্যান অ্যকটার অলসো মাচ মোর ইন্টারেস্টিং টু

 

পারফর্ম ইন নন-প্রোসেনিয়াম। কারণ তারা তখন ওই পেডেস্ট্রালটা থেকে নেমে আসে। যেখানে অডিয়েন্সের

 

সঙ্গে তাদের কমিউনিকেশন প্রায় নেই বললেই চলে। হোয়ার অ্যাজ ইন অ্যান অল্টারনেটিভ স্পেস অ্যান

 

অ্যাক্টর হ্যাজ মাচ মোর পসিবিলিটিস এন্ড স্কোপ টু এক্সপ্লোর উইথ দা অডিয়েন্স। আমার কাজগুলো

 

বেশিরভাগই প্রোসেনিয়ামে। আমি যে কাজগুলো ডিরেক্ট করেছি তার নব্বই শতাংশই প্রোসেনিয়ামে। তবে কিছু

 

কিছু এক্সপেরিমেন্টাল কাজ আমিও করেছি। বাট টু বি ভেরি ফ্র্যাঙ্ক এন্ড অনেস্ট দ্যাটস নট মাই নেচার

 

ওয়ার্ক। বাট আই হ্যাভ ট্রায়েড হোয়েন আই গট অ্যান অপর্চুনিটি। কারণ এটা আমার খুব ইন্টারেস্টিং লাগে।

 

ভবিষ্যতেও আমি এরকম কাজ অবশ্যই করতে চাই। আর্টিস্টিক্যালি মাচ মোর ইন্টারেস্টিং ইজ টু ওয়ার্ক ইন

 

অ্যা নন-প্রোসেনিয়াম অ্যাট দিস মোমেন্ট।

তৃতীয় থিয়েটার ও দুটি নাট্য পত্র নিয়ে কলম ধরলেন

আশীষ গোস্বামী

 
 
 
 
 
 
 
 

সত্তরের দশকের তৃতীয় থিয়েটার নিয়ে আমরা কম বেশি জানি। পক্ষে-বিপক্ষে জেনে বা না-জেনে

 

বিস্তর মতামত চালু আছে বাজারে। তখনো তাই ছিল এখনো সমানে চলছে। তাই নতুন করে সে বিষয়ে

 

কথা বলতে চাইছি না। আমাদের আলোচ্য এই তৃতীয় থিয়েটার নিয়ে দুটি নাট্য পত্র, যা প্রকাশিত

 

হয়েছিল কিছু সময় নিয়মিত, তারপর অনিয়মিত। গরিবের সংসার যেমন চলে। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়,

 

এক্ষেত্রেও তাই। নিয়মিত বলা যাবে না বা দীর্ঘজীবীও নয়, কিন্তু এই দুটি পত্রিকায় তৃতীয়

 

থিয়েটারের প্রকৃত প্রতিবিম্ব আমাদের কাছে। অসীম মূল্যবান ইতিহাসের কাছে। দেখতে খুবই

 

সাদামাটা, পৃষ্ঠাসংখ্যার কোনো স্থিরতা ছিল না। যেমন লেখা জোটের সঙ্গে “যেমন টাকা জোটে”

 

কথাটাও জুড়ে নিতে হবে এখানে। পত্রিকা দুটি হল, ভিন্ন প্রথার থিয়েটারের মুখপত্র ঋতম এবং অন্য

 

রীতির নাট্যপত্র অঙ্গন। ঋতম প্রকাশিত হয় ১৯৭৮-এর অক্টোবরে আর অঙ্গন প্রকাশিত হয়

 

১৯৮৬-এর ডিসেম্বরে। শুরুতে ঋতম পত্রিকার মূল্য ছিল ৫০ পয়সা, পরে দাঁড়ায় এক টাকা। ঋতম

 

পত্রিকার ১৬ টি সংখ্যা প্রকাশের পর অঙ্গনের জন্মলাভ। তখন আক্ষরিকভাবে তৃতীয় থিয়েটার

 

চর্চা পনেরো বছর পার করেছে। ঋতমের সম্পাদকমন্ডলীতে ছিলেন গৌতম সেনগুপ্ত, যুগল সেন,

 

দেবাশীষ চক্রবর্তী, দিলীপ দাস এবং কল্যাণ মিত্র। পরবর্তীকালে অবশ্য সম্পাদক হিসেবে

 

কেবলমাত্র গৌতম সেনগুপ্তের নাম পাওয়া যায় এবং সহসম্পাদক হিসেবে নতুন দুজনের নাম পাই তরুণ

 

ভট্টাচার্য ও সব্যসাচী বিশ্বাস। সেটা ছিল ১৯৭৮ সাল। পত্রিকার প্রচ্ছদে লেখা ছিল ‘নব কলেবরে’।

 

অন্যদিকে, অঙ্গন নাট্যপত্র সম্পাদক ছিলেন দেবাশীষ চক্রবর্তী ও সম্পাদকমন্ডলীতে ছিলেন

 

দীপঙ্কর দত্ত, দুলাল কর এবং আশু মুখোপাধ্যায়। উপদেষ্টামণ্ডলীতে ছিলেন সুনীল চট্টোপাধ্যায় ও

 

শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। ঋতম-এ প্রথমদিকে আলাদা করে কেউ সম্পাদক হিসেবে ছিলেন না। ঋতম

 

পত্রিকায় পরের দিকে উপদেষ্টা হিসেবে বাদল সরকারের নামে প্রকাশিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, দুটি

 

পত্রিকার সঙ্গেই বাদল সরকার পরামর্শদাতা এবং লেখক-নাটককার হিসেবে প্রথম থেকেই জড়িত

 

ছিলেন। পত্রিকা দুটির সাংগঠনিক এই অদল-বদল প্রথমে এইভাবে চোখে পড়ে। একটি পত্রিকা

 

প্রকাশের পরে কেন আর একটি পত্রিকার প্রকাশের প্রয়োজন হয়ে পড়লো তা পত্রিকা পড়ে বোঝা

 

যাবে না। আভ্যন্তরীণ কোন কারণ থাকলেও আমাদের কাছে তা অজানা। শুধু জানতে পারলাম, পূর্বতন

 

পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলীর একজন পরবর্তী পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন।

 

সম্পাদকমণ্ডলী এবং উপদেষ্টামণ্ডলী আলাদা করে তৈরি হয়েছে। নতুন পত্রিকার প্রস্তাবনায়

 

ঘোষণা হল – “ অঙ্গন নাট্যপত্রের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হলো। অঙ্গন রীতির নাট্যচর্চা আজ

 

পনেরো বছরে পড়লো। এই রীতির মুখপত্র হিসেবে ইতিমধ্যে ঋতম-এর ১৬ টি সংখ্যা প্রকাশিত

 

হয়েছে। এতদিন এই রীতি একমাত্র মুখপাত্র ছিল ঋতম। আজ থেকে যুক্ত হলো আরও একটি নতুন

 

নাম, অঙ্গন। ” আপাত নিরীহ এই ঘোষণায় আমরা আনন্দিত যে আরো একটি পত্রিকা প্রকাশিত হলো,

 

যার ঐতিহাসিক ভূমিকা অনস্বীকার্য আজ।

 

‘ ঋতম ’ – এর প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় জানানো হলো, “ এবার থেকে ভিন্ন প্রথার থিয়েটারের

 

মুখপত্র এই নামকরণে পরিপূর্ণ থিয়েটারের কাগজ হয়ে ত্রৈমাসিক ঋতম প্রকাশিত হবে। ” প্রথম

 

সংখ্যাটি ছিল প্রবীর দত্ত উৎসর্গীকৃত সংখ্যা । উৎসর্গ পত্রে লেখা হয়েছিল, “ নাট্যকর্মী প্রবীর দত্তের

 

হত্যা মুক্তনাট্য তথা সমগ্র থিয়েটারের জগতে এক লজ্জাকর অধ্যায়। তাই ভিন্ন প্রথার থিয়েটারের

 
 
 

মুখপত্র প্রকাশকালে, প্রবীর দত্তকে স্মরণ করে যেমন গভীর শোকচ্ছায়া নেমে আসে, তেমনই গভীর

 

একাগ্র সংকল্প দৃঢ়চিত্ত হয়ে ওঠার তাগিদ বোধ করি। ভিন্ন প্রথার থিয়েটারের মুখপত্র ঋতম – এর

 

প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যাটি তাই প্রবীর দত্তের আত্মার প্রতি উৎসর্গীকৃত হলো। থিয়েটারের

 

পত্র-পত্রিকার ইতিহাসে ভিন্ন প্রথার থিয়েটারের মুখপত্র সম্ভবত এই প্রথম। আজ আমরা স্মরণ

 

করি থিয়েটারে নিবেদিত সর্বযুগের মহান মানুষদের। আর প্রণত হই সকল প্রতিভার পদপ্রান্তে।

 

থিয়েটারের সমস্ত মেরুর নাট্যকর্মীদের সহযোগিতা ও বন্ধুত্ব দাবি করে এই ভিন্ন প্রথার

 

থিয়েটারের মুখপত্র, ঋতম জন্মলাভ করলো। ” এই সম্পাদকীয়, যা মুখকথা নামে প্রত্যেক সংখ্যায়

 

থাকতো, সেদিকে লক্ষ রাখলেই আমরা এই থিয়েটার নিয়ে থিয়েটার মহলের তাপ-উত্তাপ অনেকটাই

 

টের পাব। পরপর কয়েকটি মুখকথা-র অংশবিশেষ পড়ে নেওয়া যাক।

 

“ ভিন্ন প্রথার থিয়েটারের মুখপত্র, ঋতমের তৃতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হলো। জানি হয়তো খুব বেশি

 

সংখ্যক নাট্যপ্রিয় মানুষের কাছে আমাদের গত সংখ্যাদুটি পৌঁছয়নি। অবশ্য আমরা বিভিন্ন মহলে

 

এবং প্রথাগত থিয়েটারের গুণী ব্যক্তিদের কাছেও কাগজটি পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আশা

 

করেছিলাম এই কাগজ এবং এই থিয়েটার সম্পর্কে কিছু মূল্যবান আলোচনা আসবে। আসেনি।

 

প্রসেনিয়াম মঞ্চের থিয়েটার এবং ভিন্ন প্রথার থিয়েটারে অন্য যে তফাতই থাকুক না কেন মূল বিষয়ে

 

কোনো ফারাক নেই। অর্থাৎ উভয় থিয়েটারই মানুষের স্বপক্ষে কথা বলে। সেক্ষেত্রে পরস্পর

 

পরস্পরের পরিপূরক নয় কি? সেই কারণেই ভেবেছিলাম অন্তত গুণী নাট্যকর্মীদের কাছ থেকে কিছু

 

কিছু ক্রিয়েটিভ আলোচনা পাবো। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেরকম রচনা বিশেষ পাইনি। তাহলে কি ধরে

 

নেব কোন প্রশ্ন নেই? ” ( প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, জুলাই ১৯৭৯ )

 

এরপরের সংখ্যার মুখকথা-এ প্রকাশিত হল, “ এই থিয়েটারকে গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু মহল

 

এর বিরুদ্ধে সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন। একবার কোনো একটি থিয়েটারের কাগজে একজন

 

প্রতিষ্ঠিত থিয়েটার কর্মী অপসংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধে স্থান দিলেন আমাদের থিয়েটারকে। অন্য

 

আরেকজন বহির্বঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করলেন আমাদের। কলকাতার কোন একটি

 

নামী নাট্যদলের একজন দায়িত্বশীল কর্মী আমাদের কাগজের কথা বলতে গিয়ে এমন একটি বাক্য

 

প্রয়োগ করলেন যাতে পরিষ্কার এই অর্থ দাঁড়ায় যে, এই কাগজটি উল্টোরথ জাতীয় পত্রিকার

 

সমগোত্রীয়। কেউ বা সামগ্রিক বিষয়টিকে যেন একটু করুণার চোখে দেখছেন। মজার ব্যাপার, এ

 

সমস্ত আলোচনা, নিন্দা অন্য কোন শিল্প মাধ্যম থেকে ধ্বনিত হচ্ছে না, হচ্ছে থিয়েটারেরই জগত

 

থেকে। হচ্ছে প্রসেনিয়াম নাট্যকর্মীর কন্ঠে। ” ( প্রথম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, অক্টোবর ১৯৭৯ )

 

পূর্ববর্তী সংখ্যায় শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় অঙ্গন মঞ্চ রাজনৈতিক বিবেচনা ’শিরোনামে ছোট্ট একটি প্রবন্ধ

 

লিখেছিলেন। সেই প্রবন্ধটি প্রকাশের পর নানাবিধ মতামত প্রকাশিত হতে থাকে। সেই প্রবন্ধের এক

 

জায়গায় তিনি লিখেছিলেন, “ … প্রেক্ষাগৃহের ভাড়া, বিজ্ঞাপনের ব্যয় যেখানে বাঁধা, সেখানে

 

প্রবেশমূল্যের হারও এত উঁচুতে বাঁধা থাকবে যে সমাজের কেবলমাত্র একটা বিশেষ অর্থনৈতিক স্তর

 

থেকেই দর্শক আসবেন থিয়েটারে। অমোঘ যুক্তিবন্ধে স্পষ্ট হয়ে যায়, যারা ওই অর্থনৈতিক স্তরের

 

স্বাচ্ছন্দ্যে প্রতিষ্ঠিত তারা স্বভাবতই সমাজ পরিবর্তনে তেমন আগ্রহী হবেন না। কারণ সমাজ

 

কাঠামোয় তেমন ধাক্কা লাগলে তাদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়টুকু ভেঙে পড়তে পারে। এই অর্থনৈতিক

 

স্তরের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার প্রসার কামনাই রাজনৈতিক ভূমিকার মুখ্য ভিত্তি। কলকাতা

 

থিয়েটার এদেরই মনোরঞ্জনে মুখ্যত নিয়োজিত। … অথচ শতাব্দী, ঋতম, লিভিং থিয়েটার গ্রুপ

 
 
 

প্রভৃতি সম্প্রদায় যে বিকল্প তুলে ধরেছেন, তাকে মেনে নিতে কলকাতার নাট্যসম্প্রদায়গুলির এত

 

ভয় কেন ? ” এই প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। চেতনা নাট্যদলের

 

আয়োজনে আলোচনা সভা বসেছিল। মৌখিক আলোচনা তো ছিলই। ঋতম পত্রিকাতেই অশোক

 

মুখোপাধ্যায়ের কালান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখার উল্লেখও রয়েছে। সেখানে অশোকবাবু

 

নানা কথার মাঝে বলেছেন, “ রাজনীতি চেতনা ছড়ানোর প্রশ্নেই তৃতীয় থিয়েটার সবচেয়ে মারাত্মক

 

ভূমিকা গ্রহণ করতে চাইছে। এদের প্রযোজনাগুলি একের পর এক বিশ্লেষণ করলে দেখানো যেত এই

 

উদ্দেশ্য আপাতদৃষ্টিতে আকর্ষণীয় কিন্তু এর পিছনে প্রচ্ছন্ন রয়েছে ভয়ঙ্কর মতলববাজি। …

 

থিয়েটার তুমি কার ? বুকের রক্ত দিয়ে ৪০ বছর যে তোমাকে মহিমার আসনে বসালো তার? নাকি

 

অর্বাচীন যে সর্বনাশ আজ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তোমার গায়ে পাঁক ছুঁড়ছে তার ? ” ১৯৭৯-তে শমীক

 

বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই লেখা এবং তৃতীয় থিয়েটার নিয়ে বাদানুবাদ তীব্র আকার ধারণ করেছিল। বাদল

 

সরকার নানা লেখায় তাঁর ভাবনাগুলি বলার চেষ্টা করে গেছেন। বিপরীতে অন্য মতাবলম্বীদের

 

মতামতও পাওয়া যাচ্ছিল নানা পত্রপত্রিকায়। যেমন, আলোচ্য ঋতম সংখ্যায় বাদল সরকার নাট্য

 

বিষয়ক বক্তব্য –এ লিখলেন, “ ভিন্ন প্রথার থিয়েটার, অঙ্গন মঞ্চ, তৃতীয় থিয়েটার, মুক্ত মঞ্চ, মুক্ত

 

অঙ্গন, নন প্রসেনিয়াম, আন্টি প্রসেনিয়াম – বহু রকম নামে, এই যে নতুন প্রথার থিয়েটার আরম্ভ

 

হয়েছে, এই থিয়েটারকে অভিহিত করা হয়। কোন একটা নাম হতে পারে না – যে নামটা সমস্ত ব্যাপারটা

 

স্পষ্ট করতে পারে ? নামটা খালি সুবিধার জন্য দেওয়া হয়, সেটার ব্যবহার করে আমরা বুঝতে পারি

 

এটা এই জাতীয় থিয়েটার। কিন্তু খালি নামটা আমি সমস্ত থিয়েটারের ব্যাখ্যাটা দিতে পারেনা। সেই

 

জন্য নামের উপর খুব বেশি গুরুত্ব আমি দিতে চাই না। ” বাদল সরকারের এসব যুক্তিগুলো খুব বেশি

 

মনোযোগ দিয়ে সেই সময় শুনেছিলেন কিনা বোঝা মুশকিল। প্রসেনিয়ামপন্থীদের অনেক যুক্তির জবাব

 

প্রশ্ন ওঠার আগেই দিয়েছেন তিনি। যেমন, তিনি কোনোদিন বলেননি, তিনি মঞ্চবিরোধী। পোশাক,

 

দৃশ্যসজ্জা ইত্যাদিরও বিরোধী ছিলেন না, তাঁর অভিমত ছিল, “ নীতিগতভাবে আমি ওগুলো বর্জন

 

করিনি। তবে ওগুলোর উপর আমার নাটককে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল করে তুলতে চাইনি। ” অথচ গ্রুপ

 

থিয়েটার পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হলো, “ নবাগত তৃতীয় থিয়েটার

 

যখন একমাত্র নিজেদেরকেই জনগণের থিয়েটার বলে দাবি করে, এবং সর্বাঙ্গে ব্যয়বহুল অলংকরণ

 

থাকার অভিযোগে প্রসেনিয়াম থিয়েটারকেও দেশের দরিদ্র জনগণের থিয়েটার হওয়ার সম্পূর্ণ

 

অযোগ্য বলে বর্জনের দাবি তোলে, তখন সন্দেহ হয়, এরা এজিড প্রপের ঐতিহ্যকে গোপন করেন

 

কেন? … নতুন থিয়েটারের দাবির সবচেয়ে বিপজ্জনক ইঙ্গিত হলো প্রসেনিয়াম থিয়েটারের মত

 

জনপ্রিয় এই শিল্পরীতিকে ছেড়ে চলে যাওয়ার অর্থই তো তাকে প্রতিক্রিয়াশীলদের বেলেল্লাপনার

 

অবাধ অধিকার প্রতিষ্ঠার পরো্ক্ষে সাহায্য করা। আবার এ সত্যকেও কি সম্পূর্ণ অস্বীকার করা

 

যাবে যে, অঙ্গন পদ্ধতির এই নতুন থিয়েটারেও স্বল্প সংখ্যক দর্শকমন্ডলী, সাজসজ্জাহীনতা

 

বিকিকিনির হাটে পণ্যমূল্যে বিকৃত হতে না চাওয়ার চটকদার মাত্র একটাকা প্রবেশমূল্য হাঁকা সবটাই

 

বুদ্ধিজীবীর কৌশলমাত্র। এও এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদ, অবশ্য থিয়েটারের জগতে। থিয়েটারের

 

জগতে এই বিচ্ছিন্নতার মনোভাব তাঁদের সামাজিক জীবন থেকেও কী বিচ্ছিন্ন করে দেবে না?

 

জনগণের থিয়েটারের প্রশ্নে যখন এত কথা, তখন জিজ্ঞাস্য, জনগণের থিয়েটারের সমাজতান্ত্রিক

 

দেশেও কী প্রাক–বিপ্লব কালে কিম্বা বিপ্লবোত্তরকালে প্রসেনিয়াম থিয়েটার পরিত্যক্ত হয়েছে? ”

 
 
 

মাত্র বারোটি শীর্ণকায় ঋতম সংখ্যা প্রবলভাবে তৃতীয় থিয়েটার এর মুখপত্র হয়ে উঠেছিল এটা

 

বোঝা যায় পারিপার্শ্বিক এইসব প্রতিক্রিয়া দেখে। ১৯৭৯-এর ঋতম পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যার

 

নিরিখেই থিয়েটার বুলেটিন একটি থার্ড থিয়েটার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন। সেই সংখ্যার সম্পাদকীয়

 

পড়লে তখনকার উত্তাপ বোঝা যাবে। “ অবশেষে প্রকাশিত হলো। বিষয়টি নিয়ে ইদানিং প্রবল

 

আলোচনা-বিতর্ক এমনকি তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে। পোড়া বঙ্গদেশে ! কাজের চেয়ে তত্ত্বকথা

 

বরাবরই একটু বেশি। … প্রসেনিয়াম বনাম থার্ড থিয়েটার প্রতিপক্ষ খাড়া করে ইস্টবেঙ্গল বনাম

 

মোহনবাগান জাতীয় উত্তেজনা সৃষ্টি ও তাকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা। অথচ একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার

 

চেষ্টাও করিনা সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে অন্যরা কতখানি এগিয়ে গিয়েছে। কাজের থেকে কাজিয়া বেশি

 

হলে অবশ্যম্ভাবী যা তাই ঘটেছে।

 

প্রসেনিয়াম ও থার্ড থিয়েটার কে লড়িয়ে দিয়ে যে সমস্ত নষ্ট বুদ্ধিজীবীরা মজা পাচ্ছিলেন তাদের

 

বিভেদপন্থী চালটা বানচাল করার উদ্দেশ্যেই থিয়েটার বুলেটিনের থার্ড থিয়েটার সংখ্যার

 

পরিকল্পনা। কোন একপক্ষীয় প্রচার নয়, আমরা চেয়েছিলাম এই বিশেষ সংখ্যাটিতে সমস্ত রকমের

 

মতামত প্রতিফলিত হোক। কিন্তু বাদ সাধলেন থার্ড থিয়েটারের কিছু বন্ধুরা। আমাদের আহ্বানে

 

সাড়া দিতে তাঁরা কেন যে এতটা সংকুচিত হয়ে পড়লেন তা এখনো আমাদের বোধের বাইরে। থার্ড

 

থিয়েটারের প্রধান পুরুষ বাদল সরকারকে লেখা দেওয়ার জন্য বহু অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি তাঁর

 

অক্ষমতা জানালেন। বুলেটিন সম্পাদকের সঙ্গে এ বিষয়ে তাঁর কথায় হয়তো খানিকটা তিক্ততা বা

 

বেদনার আভাসও পাওয়া গিয়েছিল। অন্যদিকে থার্ড থিয়েটার এর কর্মী না হলেও প্রধানতম সমর্থক

 

শমীক বন্দোপাধ্যায় প্রথমে এ বিষয়ে লেখার প্রতিশ্রুতি দিয়েও পরে তা প্রত্যাহার করে নেন। তবে

 

তিনি বলেছেন এই বিশেষ সংখ্যার সব লেখাগুলি পড়ে পরবর্তী একটি সংখ্যায় তিনি এ বিষয়ে লেখার

 

ইচ্ছে রাখেন। ঠিক একই কথা জানিয়েছেন ঋতমের দেবাশীষ চক্রবর্তী। ” থিয়েটার বুলেটিনের জুলাই-

 

অগাস্ট ১৯৮০ – তে এই লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু ওই একই বছরের জানুয়ারির ঋতমের পাতায়

 

বিপরীত চিত্রটিও লিপিবদ্ধ ছিল। সেই সংখ্যার একেবারে শেষ পাতায় সম্পাদকমন্ডলী ঋতমের

 

বক্তব্য ছিল, “ ঋতমের ১৯৭৯-র জুলাই সংখ্যায় শমীক বন্দোপাধ্যায়ের একটি নাতিদীর্ঘ রচনা অঙ্গন

 

মঞ্চ : রাজনৈতিক বিবেচনা প্রকাশিত হয়। সেই লেখাটির পরিপ্রেক্ষিতে নাট্য মহলে নানান আলোচনা

 

সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। আমরা চেয়েছিলাম সেইসব আলোচনাও ঋতমে প্রকাশ করতে। দু’একজনের

 

কাছে লেখার কথাও বলেওছিলাম। কিন্তু সহযোগিতার হাত বাড়াননি তাঁরা। ”

 

থিয়েটার বুলেটিন – এ প্রকাশিত কয়েকটি মতামতের দিকে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

 

রফিকুল ইসলাম : বাদল বাবুর নাটক কলকাতায় দেখে আমাদেরও মনে হতো এরকম বালখিল্য কুস্তির

 

মাধ্যমে স্পার্টাকাসকে অবোধ্য করে তোলার পেছনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করছে নিশ্চয়।

 

সহজ কথাকে চেষ্টিত জটিলতায় গুলিয়ে দেওয়ার এই একনিষ্ঠ সাধনা কিছুতেই আকস্মিক হতে পারে

 

না। বাংলার রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের পুষ্টি ও ব্যাপ্তি লক্ষ করেই বাদল বাবুকে মদত দিচ্ছে

 

প্রতিক্রিয়াশীল কেন্দ্রীয় সরকার। … এ তো বড় আশ্চর্য কথা। সারা বিশ্বে প্রচলিত একটা কথা (

 

থার্ড থিয়েটার ) ব্যবহার করব, অথচ তাকে নিজস্ব মনগড়া একটা অর্থ দেব – এটাকে বুদ্ধিজীবী

 

মহলে রাহাজানি বলেই তো অভিহিত করা হয়।

 
 
 

অজিতেশ বন্দোপাধ্যায় : আমাদের দেশে উক্ত থার্ড থিয়েটারের চর্চার স্লোগান চলতি থিয়েটারের

 

বিকল্প হিসেবে স্রেফ ফ্যাশন বলে মনে হয়। বিকল্প হিসেবে না বললে কিছু বলার নেই। নাচ, গান,

 

রূপসজ্জা, আলো, কাব্য, গদ্য – থিয়েটারের নানা শাখা নিয়ে অবশ্য বহুল চর্চা চলতে পারে। উক্ত

 

থার্ড থিয়েটার টোটাল থিয়েটারের অংশ মানতে আদৌ আপত্তি নেই, এমনকি বেশ গুরুত্বপূর্ণ অংশ

 

বলেও, কিন্তু এ টোটাল থিয়েটারের বিকল্প – এ প্রস্তাব কদাচ গ্রহণযোগ্য নয়। অংশ কখনো

 

সম্পূর্ণটার সমান হতে পারে না।

অল্টারনেটিভ স্পেসে কাজের অভিজ্ঞতা শোনালেন

গুলশানারা খাতুন

 
 
 
 
 

‘স্পেস থিয়েটার আসলে একটা জার্নি’ গুলশানারা খাতুন

 

স্পেস বা অঙ্গনের থিয়েটার আসলে একটা জার্নি। আর সে জার্নি নতুন কিছু নয়। যদি চৈতন্য দেবকে বাংলা থিয়েটারের সূত্রধার

 

হিসেবে মাথায় রাখি, তাহলে দেখা যাবে স্পেস থিয়েটার সেই কতকাল থেকে আমাদের চর্চা ও চর্যায় রয়েছে৷ দর্শকের সঙ্গে

 

অভিনেতার নামমাত্র দূরত্ব ও স্থানগত পার্থক্যকে সরিয়ে রেখে, একটি গল্প বলা হয়ে গেল। অনুভূতি ছোঁয়া গেল পারস্পরিক।

 

আমার অভিনয় জীবন প্রসেনিয়ামের হাত ধরে শুরু হলেও, অঙ্গনের থিয়েটার আঙ্গিক বহুল মাত্রায় টানে আমায়। এখানে বেশ

 

খানিকটা রাজনৈতিক মতাদর্শও কাজ করে বটে৷

 

মূলত এই ধরণের থিয়েটার আমার কাছে অনেকটা প্রতিষ্ঠানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোর মত। কানহাইয়ালাল হেইসনামজির

 

মণিপুরের থিয়েটার গ্রামে যাবার অভিজ্ঞতা এই ভাবনাকে উসকে দিয়েছিল। 'আন্ডার দ্য শাল ট্রি' ফেস্টিভ্যাল চাক্ষুষ করা ও

 

সেখানে কিছুদিন কাটানোর পর প্রথম প্রসেনিয়ামের ঘেরাটোপ ছেড়ে বেরোতে উদ্বুদ্ধ করে। অর্থাৎ থিয়েটার করতে গেলে যে

 

ধরনের সরকারি গ্রান্ট বা প্রাইভেট ফিনান্স নিয়ে হাপিত্যেশ করতে হয়, তা থেকে দূরে থেকেও থিয়েটার করা যায়। বিশ্বাস

 

করেছি ও ব্যবহারের চেষ্টাও করেছি। সরকারি বা বেসরকারি হল পাওয়া নিয়ে প্রোডাকশন আটকে থাকে অনেক সময়। স্পেস

 

থিয়েটার শুধু অন্য ভাবে থিয়েটারকে ভাবাতে শিখিয়েছে তাইই নয়, নতুন নতুন থিয়েটারের ক্ষেত্র খুঁজে নিতেও সাহায্য করেছে।

 

থিয়েটারি সূত্রে আলাপ ও বন্ধুত্ব হবার সূত্রেই লাকিজি গুপ্তার কাজ খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম। ভিক্টোরিয়া প্রাঙ্গন বা

 

যাদবপুরের পার্কিং লট, লাকিজির শিল্পগুণে থিয়েটারের মঞ্চ হয়ে উঠেছে। আমার সাম্প্রতিকতম কাজ, ‘কথাদের বায়োস্কোপ’

 

আমি একটি স্টুডিও ও আর্ট গ্যালারিতে করেছি। দর্শক বা পারফর্মারদের যেটুকু সমস্যা হয়েছে তা মঞ্চটিতে ফর্ম নিয়ে

 

খেলতে সাহায্য করেছে।

 

‘কথাদের বায়োস্কোপ’ প্রথমে পদাতিক লিটল থিয়েটারে করার কথা ভাবি আমরা। কিন্তু নানা কারণে স্পেসটি শোয়ের কিছুদিন

 

আগে ক্যানসেল্ড হয়৷ ফলত নতুন জায়গা খোঁজার তাগিদেই রঙে রেখায় নামে একটি আর্ট গ্যালারি আবিষ্কার করি৷ বর্গাকার

 

চিত্র প্রদর্শনী শালা। একে কেন্দ্র করে ফর্ম নিয়ে খেলা চলতে থাকে। তার আলো, অভিনয়ের মাত্রা সবই পাল্টে যায়। আমরা

 

অনুভব করি, থিয়েটারকে কোনও জায়গায়, গ্রান্টে, প্রতিষ্ঠানে আটকে রাখা যায় না। পরের স্টুডিওতে মাঝখানে একটি পিলার

 

ছিল। তখন সেটিকে ব্যবহার করে আমাদের কাজ শুরু হয়। এখন কেউ যদি বাড়ির ছাদে থিয়েটার করতে ডাকেন, তখন স্ক্রিপ্ট এক

 

রেখেও আমরা এই নাটকটি করতে পারব।

সায়ন্তন চক্রবর্তী

 
 
 
 
 

বেলঘড়িয়া হাতেখড়ি…./ সায়ন্তন চক্রবর্তী

 
 
 

বাংলা নাটকের আঙিনায় নিজের ইচ্ছাশক্তিকে ভর করে চলতে চেষ্টা করা এক নবীন কিশোর। উন্নতির সিঁড়ি বাড়িয়ে দেওয়ার বা

 

অতিপ্রাকৃত অনুপ্রেরণা দেওয়ার কেউ কোনোদিন ছিল না, আর বাস্তবে দরকারও পড়ে নি।

 

মঞ্চে এই দলের যে নাটক দর্শক সাধারণ ও নাট্য-মোদীদের সমাদর পায়, তারমধ্যে ইটসি-বিটসি, সুনীল গাঙ্গুলি, ৪৬গণনাট্য

 

স্ট্রীট, কিউমুলনিম্বাস অন্যতম।

 

কিন্তু মঞ্চ-নাটকের সীমাবদ্ধতা, ভালো দিন/সময়ে ভালো মঞ্চ পাওয়ার ইঁদুর দৌড় এসব যেন নাট্য চর্চাকে পিছনে ফেলে

 

দিচ্ছিল….নাটকের ভাবনা বা মহড়ার থেকে বেশি গুরুত্ব যেন অমুক মঞ্চের আবেদনপত্র জমা দেওয়ার তাগিদ।

 

হাতেখড়ি খুঁজতে থাকে এক ব্যতিক্রমী জায়গা, যেখানে মানুষের কাছাকাছি নাট্য চর্চা ও অভ্যেস করা সম্ভব। চললো খোঁজ…

 

পাওয়া গেলো কল্পনাতীত একটি স্পেস।

 

সুখচর এর পাইন ঠাকুর বাড়ি। ১৬০বছরের পুরনো রাধা-কৃষ্ণ মন্দির, সংলগ্ন রাস মঞ্চ ও সামনে এক বিস্তৃত চাতাল। সামনেই

 

বয়ে চলেছে সেই আদি-অকৃত্রিম গঙ্গা। প্রকৃতির মাঝে একটা এমন জায়গা, যার সর্বত্রই শুভতা বিরাজ করে।

 

নতুন উদ্যম নিয়ে কাজ শুরু হলো। গত ২০১৮এর এপ্রিল মাসে হাতেখড়ি আয়োজন করলো, ‘ হাতেখড়ি-র ৩কুড়ি; এপাড়া ওপাড়ার

 

থিয়েটার’….মোট২০টি দল ৩দিন ধরে এই স্পেসে তাদের নাটক অভিনয় করলো। সঙ্গে রইলো গান, সেমিনার, মন্দিরের ভোগ

 

খাওয়া….৩দিন পর যখন ফেস্টিভাল শেষ হলো, হাতেখড়ি-র ঘর ভরে উঠল শুভেচ্ছা বার্তায়। মুখ থুবড়ে পড়ার যে প্রবল আশঙ্কা

 

নিয়ে শুরু হয়েছিল, সহযোগী নাট্যদলগুলির ভালোবাসা, নাট্য-ব্যক্তিত্বদের পিঠ চাপড়ানি সেই আশঙ্কাকে মনোবলে রূপান্তরিত

 

করলো।

 

সেই সাহস বুকে নিয়ে আবার ২০১৯ এর গত ২৫,২৬,২৭ জানুয়ারি হাতেখড়ি আয়োজন করলো তার দ্বিতীয় বর্ষের নাট্যউৎসব।

 

এবার ১২টি দল অভিনয় করলো তাদের নাটক, সঙ্গে রইলো ছৌ নাচ, গান, আড্ডা, খাওয়াদাওয়া। ৩দিনের এই আয়োজনের জন্যে

 

যত কষ্ট করেই কাজ করা হোক, আমন্ত্রিত নাট্যদলের তৃপ্তি, বন্ধুদের হাসি সেসব পরিশ্রমের গ্লানিকে নিমেষে দূর করে

 

দেয়।

 

২০২০ তে হাতেখড়ি-র এই প্রয়াসের তিন-এ পা।

 

আগামী ২৩,২৪,২৫,২৬ জানুয়ারি; এই চারদিনে মোট ১৫টি নাটক অভিনীত হবে। আবার কোমর বেঁধেছে হাতেখড়ি, এই ভরসায় যে

 

আপনারা শক্ত করে হাত ধরে রাখবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *