দ্বাদশ সংখ্যা । পঞ্চম ই-সংস্করণ । জানুয়ারি ২০২১

ভাণ পত্রিকা

দ্বাদশ সংখ্যা পঞ্চম ই- সংস্করণ জানুয়ারি ২০২০ ​ ​

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

ও মৌলিকা সাজোয়াল

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) [email protected] ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সূচি

জ্যান্ত চরিত্রের মূর্ত প্রতীক..

 
 
 
 
 

‘মছলিবাবা’। সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ আমৃত্যু করে গিয়েছেন তিনি। মিনার্ভায় থিয়েটারের মহড়াকে ভেঙে যখন কেউ তাঁর অভিনয় প্রতিভার গুণে দর্শকমনে দাগ কেটে যান, তখনই চমকে উঠি আমরা। সেই কাজ‌টাই সুনিপুণ দক্ষতায় পর্দায় করে গিয়েছেন মনু মুখোপাধ্যায়। নায়কোচিত চেহারা না হয়েও তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের চির পরিচিত সমাজের জীবন্ত চরিত্রের প্রতিনিধি। এক অর্থে পর্দায় দেখা জ্যান্ত চরিত্র। অবশেষে নব্ব‌ইয়ের কোঠায় চিরতরে বিরতি নিলেন তিনি। তাঁর প্রয়াণে বিলীন হলো বাংলা ছবির চরিত্রাভিনয়ের এক অধ্যায়। বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের চালচিত্র গড়ে তোলা অন্যতম কারিগর তিনি। রঙ্গমঞ্চের উইংস থেকে তাঁর যাত্রা শুরু। বিশ্বরূপায় একদা প্রম্পটার থেকে মঞ্চের পাদপ্রদীপে আসেন “ক্ষুধা” নাটকের হাত ধরে। কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবর্তিত শিল্পী হিসাবে অভিনয়ের সুযোগ‌ই ঘুরিয়ে দেয় মনু মুখোপাধ্যায়ের জীবনের মোড়। তারপর শুরু উত্তোরণের যাত্রাপথ। একদা টালার বাসিন্দা অভিনয়ের নেশায় হাইকোর্টে কেরানির চাকরিতে ইতি টেনে দেন। জন্মসূত্রে সৌরেন্দ্রনাথ, আমৃত্যু নিজের ডাকনাম মনু হিসাবেই পরিচিত র‌য়ে গেলেন দর্শকদের কাছে। পরবর্তী সময়ে মিনার্ভায় নিয়মিত থিয়েটার করতেন তিনি। পাঁচের দশকের শেষের দিকে মনু মুখোপাধ্যায় পদার্পণ করেন চলচ্চিত্রের অঙ্গনে। ১৯৫৯ এ মৃণাল সেন পরিচালিত ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবির হাত ধরেই সেলুলয়েডে শুরু হয় মনু মুখোপাধ্যায়ের পথচলা। সেই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রাভিনেতা কালী বন্দ্যোপাধ্যায়‌ মনু মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে গিয়েছিলেন পরিচালকের কাছে। এরপর একের পর এক ছবিতে চরিত্রাভিনেতা হিসাবে নিজের অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন মনু মুখোপাধ্যায়। তবে তাঁর জীবনের মোড় ঘোরানোর চরিত্র আসে সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ এর সৌজন্যে। যদিও তার আগেই সত্যজিতের আরেকটি ছবি ‘অশনি সংকেত’-এর একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মনু মুখোপাধ্যায়। তবে তাঁর অভিনয় জীবনের অন্যতম আইকনিক চরিত্র ‘জয় বাবা ফেলুনাথ” ছবির ‘মছলি’। সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ আমৃত্যু করে গিয়েছেন তিনি। মিনার্ভায় থিয়েটারের মহড়া চলাকালীন ল্যান্ডলাইনে আসে ফোন। সত্যজিৎ রায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। আর তারপরেটা.. ইতিহাস। ছবিতে মনু মুখোপাধ্যায় কাশীর গঙ্গার ঘাটে বসা এমন‌ই এক ভন্ড সাধু যিনি তাঁর প্রিয় ভক্তদের একটি করে মন্ত্রপুত মাছের শল্ক দেন। আর এই চরিত্রটিকে তাঁর অভিনয় দক্ষতায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন মনু মুখোপাধ্যায়। তবে এজন্য যথেষ্ট ধৈর্য্যর পরীক্ষা দিতে হয়েছে তাঁকে। শুটিংয়ের প্রথম দিন সত্যজিতের নির্দেশ মতো দেড় ঘণ্টা ধরে মেক আপ আর্টিস্টের মেকআপ গুণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মছলিবাবা। আসলে ফেলুদারূপী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দাড়িওয়ালা মুখের সঙ্গে মিল থাকার জন্যই চরিত্রটি করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে এর পরেও প্রচারের আলো সেভাবে তাঁর গায়ে এসে পড়েনি। কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজনও বোধ করেননি মনু মুখোপাধ্যায়। পরবর্তী সময়ে মনু মুখোপাধ্যায় আবার কাজ করেন মৃণাল সেনের ‘মৃগয়া’- তে। তাঁর অভিনয় গুণে সমৃদ্ধ হয়েছে পরিচালক তরুণ মজুমদারের একাধিক ছবি। সেই তালিকায় রয়েছে ‘গণদেবতা’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘দাদার কীর্তি’,’মেঘমুক্তি’, ‘খেলার পুতুল’। এছাড়াও প্রভাত রায়ের’ প্রতিদান’ ও ‘শ্বেত পাথরের থালা’-র মতো ছবিতেও তাঁর অভিনয় প্রশংসিত

 

হয়েছে।’পাতালঘর’ ছবিতে গোবিন্দ ‘অপয়া’ বিশ্বাসের চরিত্রে মনু মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় মনে গেঁথে

 

রয়েছে সিনেপ্রেমীদের। তাঁর অভিনীত ছবির তালিকায় রয়েছে, ‘দামু’, ‘দেশ’, ‘অনু’। জীবনের

 
 
 

দ্বারপ্রান্তে এসে প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যর ‘বাকিটা ব্যাক্তিগত’ ও সায়ন্তন ঘোষালের ‘আলিনগরের

 

গোলোকধাঁধা’ -য় অভিনয় করেছেন দাপটের সঙ্গে। আসলে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসায় আনন্দের

 

সঙ্গে পার্শ্বচরিত্র বা চরিত্রাভিনয়ে কাজ করে গিয়েছেন । বড় পর্দার পাশাপাশি ছোট পর্দাতেও বেশ

 

সুখের হয় রমণীর গুণে’। মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে তথাগত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত তাঁর অভিনীত শেষ সুখের হয় রমণীর গুণে’। মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে তথাগত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত তাঁর অভিনীত শেষ ছবি ‘ভটভটি’। নিজের কাজ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমার অভিনয় করার শখ যে পূর্ণ হয়েছে এটাই তো বড় পাওয়া।আমি অভিনেতা হতে পেরেছি।” মনু মুখোপাধ্যায় প্রসঙ্গে পরিচালক অতনু ঘোষের অভিমত, “ক্যামেরার সামনে অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্য, নিঁখুত মাত্রাজ্ঞান, দুরন্ত রসবোধ ও কাজের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা।” এগুলোই তাঁকে জায়গা করে দিয়েছে দর্শকমননে। কিন্তু স্বীকৃতি.. ২০১৫তে নামমাত্র টেলিসন্মান মঞ্চে ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট’ পুরষ্কার। বাংলা ছবির পর্দায় অপয়া চরিত্রে অভিনয় করা মনু মুখোপাধ্যায় বাস্তবিক সত্যিকারের পয়া অভিনেতা। বড়পর্দায় থাকা পারিপার্শ্বিক সমাজের জ্যান্ত চরিত্র। সেলুলয়েডের আঙিনায় থাকা আলোর বৃত্ত।

 
 
 

।।‌আর্ট ভার্সেস কমার্সিয়ালে বিশ্বাস ছিলনা সৌমিত্রের।।

সমস্ত কিছুর মধ্যে প্রতিপক্ষ খোঁজা বাঙালির এক চিরন্তন অভ্যাস। মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল এর উন্মাদনা তারা সর্বক্ষেত্রে খুঁজে পেতে চান। প্রতিপক্ষ যদি সত্যিই প্রতিপক্ষ হয় তাহলে তাকে প্রতিপক্ষ বলাতে অন্যায় নেই। কিন্তু কেবলই প্রতিপক্ষের মৌতাত পাওয়ার জন্য কোনো কিছুকে তলিয়ে না দেখে বিরুদ্ধতার বয়ান তৈরি করা আদতে সত্যের থেকে দৌড়ে পালানো। এ বড়ো কাজের কথা নয়। আর্ট বনাম কমার্শিয়াল সিনেমা, গ্রুপ বনাম ব্যাবসায়িক থিয়েটার কে অনেকদিন ধরেই আর একটু তলিয়ে দেখার প্রস্তাব রাখছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আমরা তেমন করে শুনতে চাইনি।

 

যে প্রস্তাব সৌমিত্র রাখেন তার সবটুকু মেনে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে না। তিনি সুঅভিনেতা ছিলেন বলেই তারে প্রস্তাব সর্বোতো সুন্দর হবে, এমন কোন প্রস্তাব এখানে রাখতে চাইছিনা। শুধু বলতে চাইছি সৌমিত্রের এই দ্বৈরথ তুলে দেবার প্রস্তাব এর ভেতরে যেটুকু সংগ্রহযোগ্য, তার থেকে কেন বা নিজেকেবঞ্চিত রাখি?

 
 
 
 
 
 
 
 

সৌমিত্র জানান চলচ্চিত্রের সঙ্গে চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী একেবারে শুরুর দিন থেকেই সংশ্লিষ্ট হয়ে গেছে।

 

চলচ্চিত্র নির্মাণের যা ব্যায় তা সাধারণ এক শিল্পীর পক্ষে ঘাড়ে নেওয়া শক্ত। তার জন্য দরকার প্রযোজক। এবং প্রযোজনার দায় সামলানোর জন্য প্রযোজকের লভ্যাংশের হিসেব বুঝে নেওয়াও খুব অন্যায় কিছু নয়। তার মাঝে দাঁড়িয়েই সৌমিত্র ভালো ছবি ও খারাপ ছবির দ্বৈরথ কে সামনে এগিয়ে দিতে চান। আমাদের বুঝিয়ে দেন আর্ট ফিল্ম এর ধারণা নিয়ে ছবি মাত্রই যেমন ভালো নয়, ব্যবসায়িকভাবে সফল ছবি মাত্রই তার শিল্পগুণ নেই; একথাও ঐতিহাসিকভাবে অসত্য। পথের পাঁচালীর ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় কোটি কোটি ব্যবসা করার তথ্য দিয়ে সৌমিত্রের বিনীত প্রশ্ন এই বিশ্বখ্যাত ছবিকে আপনি কোন কোঠায় রাখবেন!? পথের পাঁচালী আর্ট ফিল্ম নয়? আবার পথের পাঁচালী কি বাণিজ্য সফল নয়? শারদীয়া আজকাল এ প্রকাশিত একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে এমনই অনেক অসংখ্য জরুরী প্রশ্নের পরপর অবতারণা করতে থাকেন সৌমিত্র। প্রমাণ করার চেষ্টা করেন আসলে শিল্পকে ভালো এবং মন্দের দ্বৈরথ দিয়েই দেখা উচিত, অন্য কিছু দিয়ে নয়। তাহলে শিল্প ব্যাখ্যার কালে, গ্রহনের সময়, শিল্পকে আমাদের প্রি-অকুপাইড মাইন্ড সেট শিল্পের সুন্দরকে, শিল্পের তাৎপর্যকে বদলে দিতে পারে যা কাম্য হতে পারে না।সেই সমস্ত বুদ্ধিজীবী তার আক্রমণের বিষয় হয়ে ওঠেন, যারা শিল্প ব্যাখ্যার কালে কুলীন ব্রাহ্মণ এর মত আচরণ করেন। পথের পাঁচালীর ব্যবসায়িক সাফল্য নিয়ে কথা বলতে গেলে যারা চেয়ার ছেড়ে উঠে যান। কিন্তু বিষয়টা অত সরল নয়। পথের পাঁচালীর মতো ব্যতিক্রমী ছবির স্রষ্টা সত্যজিৎ রায় কে বিশিষ্ট জনেরা সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন সেনেট হলে। সেখানে বক্তারা সত্যজিৎকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন বক্সঅফিসে চিন্তা মাথায় না

 

রেখে পথের পাঁচালী নির্মাণ করার জন্য।সভার শেষে শেষ বক্তা হিসেবে সত্যজিৎ বলেছিলেন- বক্সঅফিস কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তিনি ছবি করেছেন এই ব্যাখ্যা তিনি নিজেই মানতে চাইছেন না। সমস্ত ফিল্মমেকারদের মতো তিনিও চেয়েছিলেন তার এই ছবিও বহুলোক দেখুক। কিন্তু বক্সঅফিস সম্পর্কে সাধারণত যে ধারণা থাকে বহু পরিচালক-প্রযোজকের, ছবির সাফল্য সম্পর্কে সে তুলনায় কিছুটা ভিন্ন ধারণা ও পথ দেখাতে চেয়েছিলেন তিনি।

 
 
 
 
 
 
 
 

জনপ্রিয়তা সম্পর্কেও তার স্পষ্ট একটি বিশ্বাসের জগত ছিল। সে বিশ্বাস অবশ্যই যুক্তিনির্ভর। সত্যজিৎ সম্পর্কে তার মতামত ছিল সত্যজিৎ রায় তার চলচ্চিত্রে তথাকথিত আর্ট এবং কমার্শিয়াল তৈরীর ক্ষেত্রে মধ্যপন্থী ছিলেন। সৌমিত্র লিখেছেন- ” মধ্যপন্থী’ এক অর্থে খুবই অসুন্দর শব্দ। সত্যজিৎ রায় সচেতনভাবে খানিকটা শিল্প গুণান্বিত খানিকটা দর্শকের মনোরঞ্জনের দিকে নজর দিয়ে ছবি করেছেন এমন কখনো ঘটেনি। তিনি সর্বদাই শিল্প গুণান্বিত ছবি করার চেষ্টা করেছেন। আরো পরিস্কার করে বললে তিনি সর্বদাই শিল্প গুণান্বিত সুন্দর ছবি দিয়েই দর্শকদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করে গেছেন” একথা বেশি করে সত্যি হয়ে আমাদের কাছে ধরা দেয় যখন দেখি নির্মল দে সম্পর্কে সত্যজিৎ লেখেন বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রয়োজন এই ধরনের ডিরেক্টরের। আমরা মনে করতে পারি নির্মল দে সেই পরিচালক যিনি বানিয়েছিলেন” বসু পরিবার”” সাড়ে চুয়াত্তর” এর মতো হিট ছবি বাংলা হাসির শ্রেষ্ঠ ছবিগুলির একটি’ সাড়ে চুয়াত্তর’। যার চিত্রনাট্যকার ছিলেন নবান্ন খ্যাত বিজন ভট্টাচার্য।অসিত সেন রাজেন তরফদার অজয় করেরা মৃণাল তপনের পাশে মোটেও অনুজ্জ্বল নন। এদের ভালো এবং জনপ্রিয় ছবির জোগান, মৃণাল -ঋত্বিকদের ও ভাবাতো নিশ্চয়ই। নইলে প্রায় গল্প হীন সুবর্ণরেখা এর এতো খ্যাতি জোটে কি করে? মোটকথা চ্যাপলিন কিংবা হিচকক, বিলি ওয়াইল্ডার থেকে তপন সিনিহা সকলেই বানিজ্য সফল ভালো সিনেমা বানিয়েছেন।

 

মোটকথা পুঁজিবাজার এর একচ্ছত্র আধিপত্যের প্রভাব সামগ্রিক ভাবে কালচার ইন্ডাস্ট্রির কতটা এবং

 

কেমন ক্ষতি করে চলেছে এটা নিশ্চিত ভাবেই ভাবতে হবে। এবং অগ্রাধিকার দিয়েই। কিন্তু পুঁজি বিরোধিতার বামাদর্শে বিশ্বাসী বলেই আমার ছবি ,আমার থিয়েটার ভালো- এই সহজ সমীকরণ কে নাকোচ করার প্রস্তাব রাখেন সৌমিত্র। এবং বাজারের অভ্যন্তরে শিল্পীর লড়াইও যে পার্থক্য তৈরি করতে পারে এই বিশ্বাস তিনি আমৃত্যু যত্ন করে রেখে দেন।

রবীন্দ্র গীতিনাট্য নৃত্যনাট্যের চরিত্রেরা এবং প্রেমের রাস

 
 
 
 
 

‘ওহে জীবনবল্লভ, ওহে সাধন দুর্লভ সৃষ্টিকর্তা; তুমিই ফললাভের আনন্দস্বরূপ ‘ব্রহ্মাস্বাদসহোদরা’। তুমিই দেব, তুমিই হৃদয়স্বামী; হে জীবনদেবতা, দুর্লভ সাধনের ধন, তোমারই অঙ্গুলি চালনায় বিশ্বচরাচর চালিত হয়। তুমিই সৃষ্টিকর্তা; তুমিই ফললাভের আনন্দস্বরূপ ‘ব্রহ্মাস্বাদসহোদরা’। তুমিই দেব, তুমিই হৃদয়স্বামী; তুমি পূজ্য, তুমিই আবার প্রণয়ী; তোমাকে লাভের আকাঙ্ক্ষাতেই জগৎ প্রেমতুর-প্রেমতুরা।

 

তোমাকে তনু-মন সমর্পনে কখনো সে পুরুষ, কখনো বা নারী; কখনো সখা, কখনো প্রেমময়ী

 

মানসী। তুমিই সর্বজ্ঞ; তুমি শূণ্য-পূণ্য-ধী-স্থি অধীপ; আবার তুমিই হৃদয়াসনে বিরাজ করো– তাই

 

তোমায় প্রণাম দেবো?  নাকি হৃদয়?  তুমিই জগতের উৎপত্তি; তোমাতেই প্রেমের নিবৃত্তি। কখনো

 

তুমি পিতা কখনো বা প্রাণেশ। ‘;তোমায় আমায় মিলন হবে বলে’ ই যুগযুগান্ত ধরে কত না

 

আয়োজনে ব্যস্ত এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড। হে প্রাণাধিক, তোমার স্তবগানে মুখরিত হৃদয়; সেই ‘প্রথম

 

দিনের উদয় দিগঙ্গন’ থেকেই সে নাদ গুঞ্জরিত হয়ে চলেছে –

 

‘শ্রিতকমলাকুচমন্ডল ধ্রুতকুন্ডল

 

কলিত ললিত বনমাল

 

জয় জয় দেব হরে।’

 

হে ‘স্বামী’, বড় বিচিত্র, বড় জটিল তোমার-আমার সম্বন্ধ-সম্পর্ক। এ যেন সংগীতে শ্রুতির

 

অবতারণা; সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নাড়ির মেলবন্ধন। এ যেন পৃথক হতে চায়না, হতে পারেনা। তুমিই

 

কেন্দ্রবিন্দু, তোমায় আবর্ত করেই কতনা বিচিত্র লীলা লীলায়িত হয়ে চলেছে। প্রাক-ইতিহাস

 

প্রাক-পুরাণ থেকে শুরু করে সেই জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক বয়ে চলেছে তার জীবনতরঙ্গ বদলে

 

যাচ্ছে শুধু কায়া কিন্তু অন্তরের ভাবচ্ছায়া সেই অবিনশ্বর প্রেম জ্যোতিতে ভাস্বর। আমি তোমার

 

চির-পূজারিনী; আমিই তোমার চরণ-বিলাসিনী। হে প্রাণের দোসর জন্মজন্মান্তরের খেলার সাথি

 

তো তুমিই। তুমিই আমার বাল্যসঙ্গী কখনো ‘যমুনার কূলে নবনীপমূলে’ আবার কখনো বা

 

তপোবনে অন্ধমুনীর পুত্র ঋষিকুমার রূপে আর তোমার খেলার সঙ্গিনী লীলা একাত্ম হয়ে যায়

 

সেই আমার সাথেই। মনে পড়ে সেই নিষ্পাপ সুখস্মৃতি; তুমি আমায় যত্নে সাজিয়ে দিতে হাতে

 

মৃণালবালা, কানে চাঁপার দুল, মাথায় বেলের সিঁথি আর খোঁপায় বকুলফুল দিয়ে। তপোবনের

 

আনাচে-কানাচে রয়ে গেছে তার স্বাক্ষর ; চির স্রোতস্বিনী তটিনী আজও গেয়ে চলে সেই

 
 
 

বাল্যলীলার আখ্যান বনদেবীদের আশীর্বানী সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু একদিন ছেলেবেলার খেলা সাঙ্গ

 

হলো চিরতরে কালমৃগয়ার অভিশপ্ত কষাঘাতে- খেলার সাথি যাত্রা করলো 'অনন্তধামে মোহমায়া

 

পাশরি’।

 

কিন্তু তুমিই তো বলেছো-

 

‘ বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়

 

নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরানি

 

তথা শরীরানি বিহায় জীর্ণা

 

ন্যান্যহি সংযাতি নবানি দেহি।’

 

আমার আত্মা সুর মেলালো তোমার সুরে –

 
 
 

‘নতুন নামে ডাকবে মোরে ডাকবে

 

বাঁধবে নতুন বাহুডোরে

 

আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।’

 

‘তখন আমায় নাই বা মনে রাখলে’- কিন্তু আমার প্রেমের সেই ভাবসম্পদ; তার অমৃত সুগন্ধ

 

পারিজাতের মতোই চির অমলিন, নিষ্কলঙ্ক তার পরিমল। জন্ম নিল আরেক বিচিত্র লীলার

 

প্রকাশ  প্রেমানুভূতি যে মায়াঞ্জন পরিয়ে দেয় তাতে আঁখির কাজ বন্ধ হয়; মরীচিকার ভ্রাম্যমানতা

 

তাকে তার স্বভাবসুলভতা থেকে বঞ্চিত করে – সৃষ্টি হয় ‘মায়া’। ‘মায়ার খেলা’য় সামিল হয় হৃদয়।

 

কিন্তু প্রেম তো সহজলভ্য বস্তু নয়; মায়ার পরত ভেদ করে তাকে জানতে হয়। নবযৌবন

 

উন্মেষের মাধুর্যতায় পরিপূর্ণা প্রমদা যখন নিজের সৌন্দর্য্যে নিজেই বিমোহিতা হয়ে গেয়ে

 

উঠলেন-

 

‘দে লো, সখী, দে পরাইয়ে গলে

 

সাধের বকুলফুলহার

 

আধফুট জুঁইগুলি যতনে আনিয়ে তুলি

 

গাঁথি গাঁথি সাজায়ে দে মোরে

 

কবরী ভরিয়ে ফুলভার’ – তখন আত্মলীলায় মত্ত প্রমদা প্রেমের পরিপূর্ণ রূপ বুঝতে কালক্ষেপ

 

করায় তার প্রেমাস্পদ চিরতরে হারিয়ে যায় তার কাছ থেকে। কিন্তু পরবর্তীতে যখন সে নিজে

 

নিজের হৃদয়ের ভাষা বুঝতে শেখে তখন সময় পার হয়ে গেছে – তার হৃদয়ে তখন এই বিলাপই

 

বোধহয় করে উঠেছিলো-

 

‘আমার মন, যখন জাগলি না রে

 

ও তোর মনের মানুষ এলো দ্বারে।

 

তার চলে যাওয়ার শব্দ শুনে ভাঙল রে ঘুম-

 
 
 

ও তোর ভাঙল রে ঘুম অন্ধকারে।।’

 
 
 

কিন্তু আত্মমগ্নতা তথা আত্মলীলা তো বিদ্যাপতী রচিত শ্রীরাধার গুণবিশেষ; প্রসাধন চর্চিত

 

সজ্জার অন্তরালে বিদ্যাপতীর পদাবলী তে মিশেছিলো সাধনার ঐকান্তিকতা। সেখানে শৃঙ্গার

 

রসের ভোগবাদী প্রকাশের অন্তরালে দৈবী প্রেমভক্তির গভীরতা একাসনে বিরাজ করে।

 

বিদ্যাপতীর রাধা ব্যক্তিত্বসম্পন্না। গৌড়ীয় প্রেমধর্মের স্তর বিন্যাসে বয়ঃসন্ধি, পূর্বরাগ,অনুরাগ,

 

মান, অভিসার, প্রেম বৈচিত্ত্যের পথ বেয়ে বিদ্যাপতির রাধিকা মাথুরের বিরহে সিঞ্চিতা। তাঁর

 

শ্রীরাধিকা মুকুলিত যৌবন আবেশে নিজের দেহের মধ্যে একটি আত্মসচেতন নারীকে আবিষ্কার

 

করেছেন

 

‘খনে খনে নয়ন কোণ অনুসরঙ্গ

 

খনে খনে বসন ধূলি তনু ভরঙ্গ’

 

তিনি চন্ডীদাসের রাধার মতো একান্ত কৃষ্ণময়ী নন, বিদ্যাপতির রাধা কৃষ্ণ প্রেমের পাশাপাশি তাঁর

 

স্বতন্ত্র সত্ত্বাকে হারায়নি তাই তিনি বলে ওঠেন

 

‘তোমার অভিসারে যাব অগম পারে’।  কিন্তু পরিশেষে আধ্যাত্মিক কৃচ্ছসাধনাই যে অভিসারের পথ

 

তা তিনি বুঝতে পারেন সেই দুর্গম অভিযাত্রাই বিদ্যাপতীর রাধাকে প্রেমতাপসী ব্রতচারিণী

 

রাধাতে উন্নীত করে। রবি কবির ভাষায়-

 

'তোমার অভিসারে যাব অগম পারে

 

চলিতে পথে পথে বাজুক ব্যথা পায়ে

 

'মায়ার খেলা’র প্রমদাও পরবর্তীতে সেই কৃচ্ছসাধনই মেনে নেন-

 

‘মায়ার খেলা’র প্রমদাও পরবর্তীতে সেই কৃচ্ছসাধনই মেনে নেন- নেন-

 

‘হায় হায়, এ সংসার যদি না পূরিল

 

আজন্মের প্রাণের বাসনা,

 

চলে যাও ম্লানমুখে, ধীরে ধীরে ফিরে যাও-

 

থেকে যেতে কেহ বলিবে না।

 

তোমার ব্যথা তোমার অশ্রু তুমি নিয়ে যাবে-

 

আর তো কেহ অশ্রু ফেলিবে না।।’

 
 
 

‘আপনারে লয়ে আপনি মত্ত’ প্রমদা মায়ার পরত ভেদ করে তার প্রাণের দোসর কে চিনতে

 

কালক্ষেপ করেছিলেন; বুঝতে পারেন নি ‘মায়ার ফাঁদ পাতা ভুবনে, কোথা কে ধরা পড়ে কে

 

জানে’!!! কিন্তু রাজনটী শ্যামা তো কালক্ষেপ করেন নি, শৃঙ্খলে জর্জরিত বজ্রসেন কে দেখে

 

তিনি প্রেমের শৃঙ্খলে নিজেই আবদ্ধ হয়েছিলেন; নিজেই ঘোষণা করেছিলেন ‘সুন্দরের বন্ধন

 
 
 

নিষ্ঠুরের হাতে ঘুচাবে কে?’ এবং উপায়ও তিনি বের করেছিলেন বজ্রসেনের শৃঙ্খল মোচনের।

 

নিঃসন্দেহে শ্যামার এই অভিপ্রায় প্রশংসার দাবী রাখত কিন্তু বাধ সাধলো সেই ‘মায়া-অঞ্জন’।

 

হিতাহিতজ্ঞান শূণ্য শ্যামা জ্ঞেতসারে ঘটিয়ে ফেললেন চরম অঘটন; এক নিষ্পাপ প্রমিক হৃদয়ের

 

চড়লো বলি। শ্যামা যে বড়ো ভয় পেয়েছিলেন প্রেমাস্পদের সাথে তার মিলনের পথে কাঁটা হয়ে

 

থাকা সব প্রতিকূলতাকে। প্রেমিক বজ্রসেনের সাথে বিচ্ছেদের প্রবল ভয় তাড়নায় শ্যামা হয়ে

 

উঠেছিলেন উন্মত্তা। কোথাও কি শ্যামার হৃদয়তন্ত্রীতে ধ্বনিত হয়েছিলো কৃষ্ণ বিচ্ছেদে জর্জরিতা

 

রাধার প্রলাপ?

 

‘সখী লো, দারুন আঁধিভরাতুর এ তরুণ যৌবন মোর।

 

‘হায় একি সমাপন!লাহল জীবন করল অঘোর।।’

 

তৃষিত প্রাণ মম দিবসযামিনী শ্যামক দরশন-আশে।

 

আকুল জীবন থেহ না মানে, অহরহ জ্বলত হুতাশে।

 

‘…্য কহি তোয়,’

 

খোয়াব কব হম শ্যামক প্রেম সদা ডর লাগয় মোয়।।’

 

প্রেমের কঠোর আত্মত্যাগ শ্যামার বুঝতে পারেন নি তাই তার সমাপন মধুরেণ হয় কি করে?!

 

শ্যামা বলে ওঠে

 

'হায় একি সমাপন!

 

অমৃতপাত্র ভাঙিলি, করিলি মৃত্যুরে সমর্পণ!

 

এ দুর্লভ প্রেম মূল্য হারালো হারালো

 

কলঙ্কে, অসম্মানে।।’

 
 
 

বিরহের দহনে দগ্ধ হয়েই আসে প্রেমের সার্থকতা বিরহ পরবর্তী মিলন যেন দুটি হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ

 

সম্পদ হয়ে ওঠে। শীত যে বসন্তেরই ভূমিকা, শীতের ছল মাত্র; তাই সে নিয়ে আসে যৌবনের

 

প্রত্যাশা; বসন্তেরই ছদ্মবেশে বিরহও তেমনি বয়ে আনে আসন্ন মিলনের শুভমহরৎ। বিষন্না

 

রাধার কানে হঠাৎ যেন মধুবর্ষণ হতে থাকে-

 

'…

 

সহসা রাধা চাহল সচকিত, দূরে খেপল মালা

 

কহল, সজনী, শুন বাঁশরী বাজে, কুঞ্জে আওল কালা।…’

 

সেই প্রাণের ডাক অন্তরের গহিন হতে হৃদয়ের রক্তস্রোতে বারবার দোলা লাগায়; সেই ডাক শুনে

 

ঘরে থাকা দায়; সবরকম আগল ভেঙে বেরিয়ে যেতে চায় মন; নিয়ম-কানুন-বাঁধা-বাঁধনের

 
 
 

পর্বতসম অচলায়তনের কারা তুচ্ছ হয়ে ভেঙে  পড়ে। কিছু কি মনে পড়লো?! নিয়ম মতে চলতে

 

আমরা চঞ্চল,  আমরা অদ্ভুত।’ংশীয়দের প্রভু; কিন্তু হঠাৎ নিয়মের তালে ‘ফাঁক”’

 

গেলো কেটে; এ কী ছন্দপতন? না নতুন ছন্দের বোল উঠলো বেজে নতুন যৌবনদূতের হাতে?!

 

' আমরা নূতন যৌবনেরই দূত।

 

আমরা চঞ্চল,  আমরা অদ্ভুত।'

 

বিদেশী রাজপুত্রের অচেনা ছন্দে রাণীবিবি, ইস্কাবনী, টেক্কানি, চিঁড়েতনী, হরতনীদের হৃদয়ের

 

ছন্দ কেমন জানি পাল্টে গেলো, অচলায়তনের মুখোশ খসিয়ে তাদের মুখ ভাবও গেল বদলে;

 

অতীত স্মৃতি জেগে উঠলো হরতনীর মনে- ” হঠাৎ মনে হলো আমি মালিনী, আর জন্মে ফুল

 

তুলতেম। আজ পুব হাওয়ায় সেই জন্মের ফুলবাগানের গন্ধ এলো। সেই জন্মের মাধবী বন থেকে

 

ভ্রমর এসেছে মনের মধ্যে।” অশান্তিমন্ত্রে দীক্ষিতা জীবন-যৌবনকে নতুন করে আবিষ্কার করা

 

রানীবিবি এবং টেক্কানির দল ভেঙে ফেলতে চাইলেন বাঁধনের আগল –

 

‘ ভাঙো, বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও।

 

বিসরি ত্রাস লোকলাজ সজনী, আও আও লো।।’াজে,

 

এ তো শ্রীরাধিকা এবং গোপিনীগণের শাসনের রুদ্ধকারা ভাঙারই রূপ-

 

' গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে মৃদুল মধুর বংশী বাজে,

 

বিসরি ত্রাস লোকলাজ সজনী, আও আও লো।।'

 

সমস্ত লৌকিক বন্ধন উপেক্ষা করে রাধা গিয়ে পৌঁছলেন তাঁর পরানবঁধুর কাছে, দু চোখ ভরে

 

দেখলেন কৃষ্ণরূপ-

 

‘সুখদ রজনী নব নাগর আয়ে

 

বামে হেলে মোহনচূড়া কি শোভা পাখির পাখাগো

 

বৃন্দাবিপীন সুকন্থে।।’

 

কৃষ্ণরূপে বিভোর রাধা মনে মনে দুঃখী হয়ে উঠলেন; প্রেমমায়া আবার তাকে ঘিরে ধরলো!

 

‘হম সখী দারিদ নারী।মণীগণ মুকুটমণি” শ্রীরাধিকা বলে চললেন-

 

'হম সখী দারিদ নারী।

 

জনম অবধি হম পীরিতি করনু, মোচনু লোচনবারি

 

রূপ নাহি মম, কছুই নাহি গুণ, দুখিনী আহির জাতি

 

নাহি জানি কছু বিলাস-ভঙ্গিম যৌবনগরবে মাতি।

 

……

 

নিঠুর বিধাতা এ দুখ জনমে মাঙব কি তুয়া – পাশ

 

জনম অভাগী উপেখিতা হম বহুত নাহি করি আশ

 

দূর থাকি হম রূপ হেরইব, দূরে শুনইব বাঁশি

 
 
 

দূর দূর রহি সুখে নিরীখিব শ্যামক মোহন হাসি।

 

……

 

ভানুসিংহ ভনয়ে, শুন কালা,

 

দুখিনী অবলা বালা-

 

উপেখার অতি তিখিনী বাণে না দিহ না দিহ জ্বালা।।'

 

লজ্জা শঙ্কাহীন পৌরুষোচিত দৃপ্ততা; বীর্যে পুরুষাহংকর, কীণাঙ্কিত বাহুর অধিকারিণী,

 

রণকৌশল ও মৃগয়ায় সিদ্ধহস্তা মণিপুরী রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা তো ঠিক একই কথা বলেছিলেন।

 

অর্জুনের রূপে মুগ্ধ চিত্রাঙ্গদা প্রেমনিবেদনে প্রত্যাখ্যাতা হয়েছিলেন; দোষারোপ করেছিলেন

 

নিজের দেহসৌষ্ঠব কে; পূজা নিবেদন করে নবতনুর বর চেয়েছিলেন পঞ্চশরের অধিষ্ঠাতা মদন

 

দেবের কাছে-

 

মোর দেহ পাক তব স্বর্গের মূল্য’

 

লভি নাই মনোহরনের দীক্ষা

 

কুসুমধনু,

 

অপমানে লাঞ্ছিত তরুণ তনু।

 

অর্জুন ব্রহ্মচারী

 

মোর মুখে হেরিল না নারী

 

ফিরাইল, গেল ফিরে।

 

দয়া করো অভাগীরে

 

শুধু এক বরষের জন্য

 

পুষ্পলাবন্যে

 

মোর দেহ পাক তব স্বর্গের মূল্য'

 

কিংশুকদলের প্রান্তে দোলা শিশিরকণা যে নিমেষের সোহাগিনী ; কিন্তু তাকেই কামনা করলেন

 

অর্জুন ব্রহ্মচর্য ভাসিয়ে দিয়ে; বদলে পেলেন সুতীব্র তৃষ্ণা, হৃদয়দাহ-

 

‘ অশান্তি আজ হানলো একি দহনজ্বালা

 

 

মরণ-সুতোয় গাঁথল কে মোর বরণমালা’

 

মোহভঙ্গ হলো উভয়েরই। চিত্রাঙ্গদা উপলব্ধি করলেন তাঁর দেবদত্ত বহিরঙ্গ প্রকৃত চিত্রাঙ্গদাকে

 

আড়াল করছে; এক মোহের প্রাপ্তিতে এ যেন আরো গভীরতর এক মোহ- অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হল

 

চিত্রাঙ্গদার দুই সত্তার- সুরূপা এবং কুরূপার। চিত্রাঙ্গদা উপলব্ধি করলেন মিথ্যে সৌন্দর্য

 

আকর্ষণীয় হলেও সত্যরূপহীণতা তার চেয়ে অনেক বেশী মূল্যবান। তিনি অনায়াসে ফিরিয়ে

 

দিলেন মদনদেবের মিথ্যে সৌন্দর্যের দানকে; প্রিয়ের সামনে উপস্থিত হলেন স্বমহিমায় স্বরূপে

 

পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।’নন্দিনী

 
 
 

নহি দেবী নহি সামান্যা নারী

 

পূজা করি মোরে রাখিবে উর্ধ্বে সে নহি নহি

 

হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি

 

যদি পার্শ্বে রাখ মোরে সঙ্কটে সম্পদে

 

সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে সহায় হতে

 

‘না যেও না যেও না গো’যে বৈসাদৃশ্য ধরা পড়ে; ‘ভিতর পানে না দেখে সে বাহির পানে ধায়।'

 

ধন্য হলো উভয়ের প্রেম; মিলন হয়ে উঠল সার্থক। রূপ-অরূপের দ্বন্দ্ব প্রেমের বিষয়বস্তু হয়ে

 

উঠতে পারেনা। কারন প্রেমের ভাবসম্পদই হলো অরূপ। কোনো দ্বন্দ্বের মাধ্যমে তাকে লাভ করা

 

যায় না। দ্বন্দ্ব পরবর্তী সার্থক আত্মার মিলনই সত্য এবং তা অপরূপ।

 

সেই অপরূপ প্রেমের সাক্ষর রেখেছিলেন আরো এক জোড়া প্রেমপূর্ণ হৃদয়। জন্মান্তরের প্রেমকে

 

সঞ্জীবীত করতে শাপভ্রষ্ট সৌরসেন কুরূপ অরুণেশ্বর রূপে তার প্রেয়সী মধুশ্রী তথা এ জন্মের

 

কমলিকাকে অন্তরালে থেকে প্রেম নিবেদন করেন এবং কমলিকাও তনুমন সমর্পণ করেন তার

 

অদেখা প্রিয়কে। কিন্তু তিনিও তো অভিশাপের অংশীদারিনী; তাই এতো সহজে তো তিনি

 

প্রিয়কে লাভ করতে পারেন না। কঠোরতম পরীক্ষায় তাকে উত্তীর্ণ হতে হবে তো। কমলিকার

 

মানবীয় চর্মচক্ষুতে এখনো যে বৈসাদৃশ্য ধরা পড়ে; 'ভিতর পানে না দেখে সে বাহির পানে ধায়।'

 

অতএব অন্তরাল অন্তর্হিত হতেই অরুণেশ্বরের কুৎসিত রূপের প্রতি তিনি সদয় হতে না পেরে

 

পালাতে চাইলেন বাস্তব কে ফেলে। প্রেমের রঙ্গমঞ্চে আবারো ঘটলো করুণ বিচ্ছেদ।

 

অরুণেশ্বরের করুন আর্তি ধ্বনিত হলো

 

'না যেও না যেও না গো

 

মন্দির মোর’ ; আর কমলিকার যখন 'পিয়া বিনে পাঁজর ঝাঁঝর ভেল' তখন তিনি বলে উঠলেন –

 

এ যেন মাথুর পর্বের পাগলিনী রাধার করুন আর্তি-

 

' বার বার সখী বারণ করনু ন যাও মথুরা ধাম

 

বিসরি প্রেমদুখ রাজভোগ যথি করত হমারই শ্যাম।

 

ধিক তুঁহু দাম্ভিক, ধিক রসনা ধিক, লইলি কাহারই নাম

 

বোল তো সজনি, মথুর অধিপতি সো কি হমারই শ্যাম

 

….

 

বিসরল বিসরল সো সব বিসরল বৃন্দাবনসুখসঙ্গ

 

নব নগরে সখি নবীন নাগর- উপজল নব নব রঙ্গ…।।'

 

‘সখী আঁধারে একেলা ঘরে মন মানেনা…’ অবশেষে কমলিকার চর্মচক্ষু থেকে আবরণ গেল সরে;

 

মন্দির মোর’ ; আর কমলিকার ‘পিয়া বিনে পাঁজর ঝাঁঝর ভেল’তখন তিনি বলে উঠলেন –

 

'সখী আঁধারে একেলা ঘরে মন মানেনা…' অবশেষে কমলিকার চর্মচক্ষু থেকে আবরণ গেল সরে;

 
 
 

হৃদয় চক্ষু উন্মেলিত হলো। সেই চোখে দেখলেন প্রেমের উজ্জ্বলতায় ভাস্বর অরুণেশ্বরের দৈহিক

 

কুঞ্জবনে দুঁহু দুঁহু দোঁহার পানে চায়।’অপূর্ব রূপ তোমার!' যুগল মিলনে জয়ী হল

 

প্রেম। দীর্ঘ মাথুর যাপনের পর ঠিক যেমন শ্রীকৃষ্ণ গোকুলের লীলাক্ষেত্রে ফিরে এলে শ্রীরাধিকা

 

বিরহ পরবর্তী মিলনের সুখে বিভোর হয়ে ওঠেন। যুগলরূপকে কেন্দ্র করে সখীরা গেয়ে ওঠেন

 

‘আজু সখী মুহুমুহু গাহে পিক কুহুকুহু

 

কুঞ্জবনে দুঁহু দুঁহু দোঁহার পানে চায়।'

 

জন্মজন্মান্তরের এই ‘মায়ার খেলায় কখনো নেমে এসেছে চির বিচ্ছেদের যন্ত্রণা কখনো বা

 

মধুরতম মিলন। এই সত্যপ্রেমের পথে আর এক স্তম্ভ হল ত্যাগ। ত্যাগের পথেই ঘটে আত্মার

 

শুদ্ধি; প্রেমের শুচী শুভ্র রূপের জ্যোৎস্নায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে হৃদয়। ত্যাগের পথে প্রানপ্রিয়ের

 

সাথে সার্থক মিলনের কাহিনি তো চিরন্তন; চোখে আসে মন আলো করা এক প্রতিমা। কুম্ভের

 

রাণা ভোজকে হৃদয়স্বামী রূপে গ্রহন করতে পারেন নি তিনি কারণ তাঁর হৃদয়রাজা তো

 

একজনই- শ্রীকৃষ্ণ আর তিনি হলেন তাঁর একনিষ্ঠ যোগিনী প্রেমিকা মীরা বাঈ। তিনি গেয়ে

 

উঠেছিলেন –

 

‘মেরে কো গিরধর গোপাল দুসরো না কোঈ

 

কে। মীরার হৃদয়ের সুর একাত্ম হয়ে গেলো ‘মায়ার খেলা’র আরেক নায়িকা শান্তার হৃদয়ে।

 

তাঁর প্রাণপ্রিয়কে তিনি নিঃস্বার্থ প্রেমে ভরিয়ে দিয়েছিলেন। মীরার প্রেম কৃষ্ণ প্রেমের প্রত্যাশী

 

ছিলো না তাই সহজেই মীরা কঠোর ত্যাগের পথে ফেলে এলেন পার্থিব সকল সুখ-সম্মান-সোহাগ

 

কে। মীরার হৃদয়ের সুর একাত্ম হয়ে গেলো ‘মায়ার ‘র আরেক নায়িকা শান্তার হৃদয়ে।

 

নামের সার্থক প্রতিরূপা শান্তা স্থি হৃদয়ে হৃদয়স্বামীকে বরণ করে নিয়েছিলেন অস্ফুটে। হৃদয়ের

 

অকুন্ঠ প্রেমই তাঁর সম্পদ; যে প্রেম প্রত্যাশী নয়। শান্তা জেনেছিলেন অমরের উদাসীনতা কিন্তু

 

তিনি প্রেমের শুচীশুভ্ররূপ কে প্রত্যক্ষ করেছিলেন; পেয়েছিলেন ত্যাগের মহামন্ত্র। তাই অকুন্ঠে

 

তিনি মীরা বাঈয়ের মতো বলেছিলেন-

 

' আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই গো

 

আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে আর কিছু নাহি চাই গো..

 

যদি আরো কারে ভালোবাস যদি আরো ফিরে নাহি আস

 

প্রেম সেখানে প্লেটনিক প্রেমে পর্যবসিত। সেই ‘মাটির কন্যা’ প্রকৃতি, যাকে সমাজ ‘চন্ডালিকা’

 

এ কি অপূর্ব লীলা! পার্থিব জগতের কষাঘাত কে তুচ্ছ করে অপার্থিব প্রেমে নিমজ্জন। মনে পড়ে

 

এক অতি পরিচিত কাহিনি। পার্থিব জগতের কষাঘাতে জর্জরিতা এক নারীর উত্তোরণ; মোহময়

 
 
 

প্রেম সেখানে প্লেটনিক প্রেমে পর্যবসিত। সেই ‘মাটির কন্যা’ প্রকৃতি, যাকে সমাজ ‘চন্ডালিকা’

 

নামে পরিচয় দেয়; জন্মাবধি ঘোর অমানবিক সমাজ যাকে তাচ্ছিল্য করে 'ওকে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো

 

নামে পরিচয় দেয়; জন্মাবধি ঘোর অমানবিক সমাজ যাকে তাচ্ছিল্য করে ‘ওকে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো

 

‘যে মানব আমি সেই মানব তুমি কন্যা’ ; তাকে ‘মানুষের তৃষ্ণা মেটানো সম্মান’; প্রদান করলেন

 

তার হাত থেকে জল গ্রহণ করে। প্রকৃতির নবজন্মলাভ হল; তার মুখের কথা তো আর তার

 

নিজের রইলোনা; আনন্দের শেখানো মানবপ্রেমের বাণীতেই সে সঞ্জীবিত হলো। কিন্তু পার্থিব

 

কন্যা প্রকৃতি মানবপ্রেমের গূঢ় সত্যকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন নি তখনো তাই আনন্দকে

 

হৃদয়স্বামী হিসেবে মেনে নিয়ে দেহজ প্রেমের বেড়িতে বাঁধতে চায় তাঁকে। ‘ক্ষুধার্ত প্রেম’ তাকে

 

দিয়ে ভুলের পর ভুল করাতে থাকে। অবশেষে চরম ভুলে ভ্রান্ত প্রকৃতি যখন নাগপাশবন্ধনে

 

আবদ্ধ ম্লান আনন্দ কে দেখে তখন প্রকৃতির মনে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে; মোহমায়ার জাল ছিন্ন

 

করে সত্যপ্রেমের আলোকে উদ্ভাসিত প্রকৃতি বুঝতে পারে মুক্তিই হলো প্রেমের পথ বন্ধন নয়।

 

ত্যাগের গৈরিক বসন ধারন করলো প্রকৃতি, মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত হলো সে; উত্তোরন ঘটলো তাঁর;

 

আনন্দের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিলেন তিনি— ভেসে আসে মীরার ভজন

 

‘ম্যায় সাবরে কি রঙ্গ রাচি

 

সাজি সিঙ্গার বাঁন্ধ পগ ঘুঙ্গরু

 

লোক লাজ ত্যাজ নাচি

 

……

 

বাজুবন্ধ করুণা সোহে

 

সিন্দুর মাঙ্গ ভরি

 

এ তো সেই ‘কিশোর বালকের কথা; যে প্রেমের প্রত্যাশী না থেকেই অকুন্ঠ ভালোবেসেছিলো

 

কৃষ্ণ দর্শনের নিরন্তর অপেক্ষায় মীরা ধ্যানমগ্না। একনিষ্ঠ প্রেম সাধনায় তিনি ভয়ংকর পরীক্ষায়

 

উত্তীর্ণা৷ তিনি গেয়ে চললেন

 

মীরা ভকত রূপ ভঈ সাচি।।’

 

ম্যায় নাহি তোড়ু রে

 

তোসু প্রীত ছোড় কৃষ্ণা

 

কৌন সঙ্গ জোড়ু রে।।'

 

এ তো সেই 'কিশোর বালকের কথা; যে প্রেমের প্রত্যাশী না থেকেই অকুন্ঠ ভালোবেসেছিলো

 

রাজনটী শ্যামাকে। বালক উত্তীয়- শ্যামার প্রেম সে কোনোদিনই পায়নি; সে শুধু সর্বস্ব দিয়ে

 

শ্যামাকে ভালোবেসে গেছে; প্রতিদান চায় নি কোনো। উত্তীয়ের প্রেম যে কোন পর্যায়ের প্রেম

 

ছিলো তা শ্যামার বোধগম্যতার বাইরে; তাই শ্যামা ও তার প্রেমিক বজ্রসেনের মিলনের জন্য

 
 
 

উত্তীয় নিজের প্রেম নিজের প্রাণেরও আহুতি দিয়েছিলো। আক্ষরিক অর্থেই ত্যাগের সর্ব্বোচ্চ

 

নিদর্শন উত্তীয়ের প্রেম এবং প্রেমের জন্য প্রাণাহুতি-

 

‘আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরি করেছো দান

 

তুমি জানো নাই তুমি জানো নাই

 

তৈত্তিরীয় উপনিষদ তাই বলেছে ‘ রসো বৈ সঃ’ অর্থাৎ ব্রহ্ম রসের আধার আর বৈষ্ণব দর্শনে এই

 

নিজের প্রেমিকসত্তাকে অনন্তের সাথে মিলিয়ে দিয়ে গেলেন উত্তীয়। এ কি মীরার আত্মাহুতির

 

প্রতিচ্ছবি নয়? মীরা তাঁর ঐশ্বরিক প্রেম সাধনার পথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন তাঁর প্রেমপিয়ার

 

সাথে; সমগ্র বিশ্ব চরাচরে তখন মীরা বাঈয়ের ভজনের গুঞ্জরণ –

 

'তেরি ম্যায় তো প্রেম দিওয়ানি

 

মেরো দর্দ না জানে কোঈ

 

যো ম্যায় অ্যায়সি জানতি

 

প্রীত কিয়ে দুখ হোঈ

 

নগর ঢিন্ডোরা পিটতি

 

প্রীত না কিযো কোঈ

 

জন্মজন্মান্তরের প্রেমোপাখ্যান যেন শতধারায় কৃষ্ণমহাসমুদ্রের দিকে বয়ে চলেছে। উৎসমুখ,

 

প্রবাহের বিভঙ্গ বিভিন্ন হলেও বয়ে চলেছে সেই চির-একের অভিমুখে। এইতো জন্মজন্মান্তরের

 

রাসলীলা! রস থেকে রাসের উৎপত্তি। সার, নির্যাস, আনন্দ, হ্লাদ, অমৃত ও ব্রহ্ম ই হলো রস।

 

তৈত্তিরীয় উপনিষদ তাই বলেছে ‘ রসো ব’ অর্থাৎ ব্রহ্ম রসের আধার আর বৈষ্ণব দর্শনে এই

 

মধুর রসের ঘনীভূত আধার পুরুষোত্তম কৃষ্ণ এবং তাঁকে ঘিরে হ্লাদিনি শক্তির প্রকাশই হলো

 

রাস। রাস মিলনেরই কাহিনী গেয়ে চলেছে আদিঅনন্তকাল ধরে এবং সেই কাহিনীর চরিত্রেরা

 

নামে ভিন্ন হলেও প্রেমে অভিন্ন। তাই বিবেকানন্দের কথায় রাসলীলা হলো ঐশ্বরিক লীলার

 

বহিরানুভূতি যা প্রত্যেকের নশ্বর হৃদয়ে লীলায়িত হয়ে চলেছে অবিনশ্বরের প্রতি।

গায়কী অঙ্গ

দ্বিতীয় পর্ব

 

অরিত্র দে

 

তখন দামাল কিশোর। দাপিয়ে বেড়ানো মন। লাফিয়ে চলা শরীর। হাঁফিয়ে ওঠা পরিশ্রম। তবুও সহজে হাঁফ ধরে না। তাই একটানে পড়ে ফেললাম। শ্যামসুর রহমান। ইস্কুলের বইয়ে ছিল। ‘আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। খুব শক্ত। সব ভুলে গিয়ে একটা বাক্য মনে ছিল। এখনও আছে। “পাখী সব করে রব’; বলে মদন মোহন তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক”। উনিশ শতকের মদন মোহন। সংস্কৃত পণ্ডিত। ‘ধীরোদাত্ত’ মানে জেনেছি ‘উদাত্ত’ বুঝে। আর ‘অনুদাত্ত’ বুঝে। আরও পরে জেনেছি ‘স্বারিতা’। বেদের চয়ন। মন্ত্রের সাধন। সাংগেতিক। সামবেদে আছে। আমরা জানি ‘সামগণ’। পরে আসে ‘ছন্দ’। আর আসে ‘প্রবন্ধ’। প্রায় মৌখিক। একটু যন্ত্রযোগ আছে। বরাবরই ছিল। মিলেজুলে সঙ্গীতের রূপান্তর। বৈজ্ঞানিক রূপান্তর। ‘গান্ধর্ব বেদ’। আমরা বলি ‘ধ্রুপদ’।

 

তেরশো শতক। একদিন তুর্কী এলো দেশে। উত্তাল তরঙ্গের মতো। উদ্দাম জনপদের বেশে। উত্তর ভারত বেশ বুঝলো। এবার বদল আসছে। রদবদল। জীবনে। যাপনে। শিল্পে। সাহিত্যে। সঙ্গীতেও। এবার নতুন দরবার। এখন অন্য রাজা। যবন রাজা। অগত্যা মন্দির ভাঙ্গা পড়ল। অনেক। ঈশ্বরও মন্দির ছাড়লেন। অনেক আগেই। শিল্পী-পণ্ডিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন দেশময়। থিতু হতে পারছেন না কোথাও! তবুও মুখ দেখতে হয়। চেনা মুখ। অচেনা মুখ।

 

মানুষের মুখ। মানুষ চাই। জনপদ চাই। রাজার। প্রজার। ঈশ্বরেরও। তাই দেবদূতদের আসতেই হল। রাজার তরফে সূফী। প্রজার তরফে যোগী। সহজ মধ্যস্থতা। সহজাত বন্ধন। কীর্তনে মিশল কাওয়ালী। ভজনে মিলল গজল। সামা- সে থিতু হল সঙ্গীত। আর দরবারে থিতু হল ধ্রুপদ। পুরুষ্টু হল ঠাট।

 

যখন প্রথম ফিজিক্স পড়তে শুরু করি, তখন ‘ফিজিক্স’ বলতাম না। বলতে পারতাম না। ‘জড়বিজ্ঞান’ বলতাম। অনেক পরে ‘পদার্থবিদ্যা’তে ধাতস্থ হই। আত্মস্থ হই নি। কেবল বইতেই লেখা থাকতো। উঠতি বয়সে সময় বদলে যাচ্ছিল। প্রতিনিয়ত। পর্যাণুক্রমে। অথচ স্যার পড়াতেন ধ্রুবক। আমি সাইন বদলে দিতাম। প্যারামিটারে ভুল করতাম। ডেফিনিশান কঠিন লাগত খুব। তারপর একদিন ধ্রুবক বদলে constant হয়ে গেল। আমি গ্রাম বদলে শহরে এলাম। আমার ভাষা বাংলা বদলে ইংরেজি হল। অনেকটা। কিন্তু তখন বুঝিনি। ধ্রুবক আসলে একটা ধ্রুবতারা ছিল।

 

আজও তাই আছে। ক্ষণ পালটে ফিরে আসে। এবার এলো সঙ্গীতে। ধ্রুপদ ভেঙ্গে পেলাম ‘ধ্রুব’। সেই চিরস্থায়ী নক্ষত্র। ভাসমান। বিদ্যমান। আর পেলাম ‘পদ’। ঘরে ফেরার গান। সে গানও তৈরিই ছিল। মন্ত্রে। আর কাব্যে। টান পড়লো শব্দে। তান লাগল স্বরে। ঘুরতে লাগল বিশুদ্ধ রাগ। ফিরতে লাগল বিশুদ্ধ কাল। একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে।

 

মুক্তির বিন্দু। ঈশ্বরারোহণ। এ চিজ বশমে আনতেই হবে। দিল্লীতে থাকতেই মালুম হয়েছিল আবুলের। বাকি সব বেকার। এক ইয়েহি আসলিয়াত পহেচানমে এসেও এখনো জেনানার বাইরে এলো না। আবুলের আফসোস হয়। চেষ্টার কসুর করেনি। ওয়াক্ত পে ওয়াক্ত। ইধার সে উধার। বেপান্‌হা হিন্দুস্থানের কোনে কোনে আলাপ জমিয়েছেন। লেকিন আল্লার মেহেরবানী হয়নি। ফিরভি কোশিশ করতেই হবে। ফিরসে যেতে হবে। দুসরা মূলক। দরবার ভি শুখা মেহেসুস হচ্ছে এখন। ইরানের

 

বন্দিশ ভি বহুৎ পুরানা হয়ে গেছে। এ দরবারে একটাই নেশা। মেহ্‌ফিল। হারেমও লেড়কির কমি নেই। ইয়া আল্লাহ্‌!

 
 
 
 
 
 
 
 

চমকে উঠল আবুল। সহি ওয়াক্ত পর কথাটা দিলে এসেছে বটে! জেনানার কাওয়ালী ফরমাতে হবে ইসবার। হারেমের গজল লিখতে হবে। সুলতানকে লিয়ে। দরবারকে লিয়ে। উও ভি হিন্দুস্থানের নজদিক হবে। এখানের রাগের ইস্তেমাল করতেই হবে। হিন্দুস্থানের সুলতানকো হিন্দুস্থানের রাগ পহেচান করাতে হবে। ইরানের সুর ভি উসমে মিশে যাবে।

 

লেকিন এক বাত! ইয়ে গজলমে কেবল লেড়কি থাকবে। ঊনকি চেহ্‌রা অউর ঊনকা মায়া মেহ্‌সুস হবে। ঊনকি প্যারকা ছমক ভি ইয়াদ দেবে। ইস জমিন পে জন্নতকা ইন্তেজাম মালুম হবে। একটু বেশরমি লাগছে বটে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতেই হল আবুলকে। আদমিকা দিলমে ঘুসতে হবে। পুরা হিন্দুস্থানমে ঘুসতে হবে। নতুন সুর নিয়েই।

 

অগত্যা আবার লিখতে বসলেন আবুল হাসান। নু-সিফেরের প্রকাশক আমীর খুসরুর চোখ এবার তবে হারেমে গিয়ে পড়লো!

 
 
 
 
 
 
 
 

আলাপ শুরু হয়েছে। নিখাদ তরঙ্গ। নির্মোহ তান। কোন শব্দ নেই। শব্দবন্ধ নেই। শুধু অনুধ্যান। পরতে পরতে গভীরতা বাড়ছে। পদে পদে রাগের চরিত্র খুলে যাচ্ছে। সাধক চলেছেন সঙ্গীতে। ভেসে ভেসে। ডুবে ডুবে। পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। ভক্তি গদগদ মন পুঞ্জীভূত হচ্ছে এদিক ওদিক থেকে। ভেসে আসছে স্বর। ওম, নাম, রে, রি, না, তা, তম্‌ ।

 
 
 
 
 
 
 
 

আবার মন্ত্র। দৈব আবাহন। ধর্মপ্রবাহ বইছে। এবার তিনটে অক্টেভ এলো। আলাপ পূর্ণ হল। মুড আরও ধারালো হল। এবার আসর জমবে। এবার কাঁসর বাজবে। প্রায় হঠাৎ করেই। জোর করে। জোর ধরে। এই জোর আর ঝালাই

 

সেতুবন্ধন করছে। বরাবরের মতো। কম্পোজিশনে ফিরে যেতে চক্র ফিরছে। আমরা বলি তাল সাইকেল। চৌতালাই বেশি। বারো বিট। তবে দশ বিটের ‘সুলা’ আসে। সাত বিটের ‘তীব্র’ও আসে। আর আসে ‘ধামার’। চোদ্দ বিটের তাল। তালে তাল দেওয়ার লোক রয়েছেন। ‘পাখোয়াজ’এর সাথে। সঙ্গত সুরে। একটু দূরে। নির্নিমেষ জনগণ। নিবাত পরিমণ্ডল। যেন দেবী সরস্বতী মহাসঙ্গীতের মহার্ঘ্য রচনা করছেন। আর হেলায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন ব্রম্ভান্ডে।

সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত

 
 
 
 
 

এই যে নব নব থিয়েটার তৈরি হওয়া এটা সবসময় ভালো দিক। এই যে ভয়ঙ্কর

 

প্যান্ডেমিকের মধ্যে আমরা পড়লাম সেখানে বিভিন্ন স্থানে থিয়েটারকে ছড়িয়ে দেওয়া –

 

কেউ বাড়ির ছাদে , কেউ বাড়ির উঠোনে, কেউ গ্যারেজে থিয়েটার করছে , এটা তো

 

থিয়েটারের একটা বাঁক বলতে পারি। বিভিন্ন সময়ে থিয়েটার নিজেকে সময় উপযোগী করে

 

নিয়েছে। আমার মনে হয় এটা থিয়েটারের অভিযোজনের মধ্যেই পড়ে। অভিযোজন দিয়েই

 

থিয়েটার টিকবে। এটা আমার প্রথম কথা। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে বাদল সরকার যে

 

থিয়েটারের কথা ভেবেছিলেন , একটা ছোট জায়গায় এসে থিয়েটার করার কথা ভেবেছিলেন

 

, যেটা উনি কার্জন পার্কে নিয়মিত করতেন বা কফি হাউসে কলেজ স্ট্রীটে করতেন ,

 

সেটাতে উনি কিছু বডি ল্যাঙ্গুয়েজের ব্যবহার করতেন এবং একটা অন্যভাবে থিয়েটারটা

 

করার চেষ্টা করতেন। সেটা উনি একটা বিশ্বাস থেকে প্রোসেনিয়াম থেকে সরে এসে

 

স্পেসে থিয়েটার করেছেন। আর এখন‌ও যারা থিয়েটার করছে এই যে প্রোসেনিয়ামে

 

থিয়েটার করা, আমরা তো বিলিতি থিয়েটার দেখে প্রোসেনিয়ামে থিয়েটার করি, আমাদের

 

নিজস্ব থিয়েটার এখনও জেনারেট করেনি। যেটা বাদলবাবু পরে বিভিন্নভাবে বলেছেন।

 

তার মধ্যেও ওনার বিদেশি শিক্ষা, ভাবনা চিন্তা সেগুলোর প্রভাব ছিল। কিন্তু দেওয়ালে

 

পিঠ ঠেকে গেলে তো বাঁচার উপায় ঠিক করে নিতে হবে। এটা আমার মনে হচ্ছে একজন

 

যে স্থানিক থিয়েটার বা স্পেস থিয়েটারের কথা বলা হচ্ছে সেটা থিয়েটারের জন্যে একটা

 

ব্যাপ্তি। আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ার একটা জায়গা। কিন্তু আবার যে থিয়েটার আমরা

 

এতদিন করে এসেছি সেটা থেকে এটা ভিন্নধর্মী। সেটার জন্যে এই থিয়েটারকে তো

 

আবার তৈরি হতে হবে। একটা ছোট শিশু যখন হাঁটতে শেখে তারপর কথা বলে- একটা

 

মানুষ হিসেবে তৈরি হওয়ার রাস্তাটা তৈরি করতে হবে। তেমনি থিয়েটার তো শুধু করে

 

ফেললেই হলো না, থিয়েটার একটা শিল্প। সেটা আমি গ্যারেজে করলে কেমন করে করব,

 

ছাদে করলে কেমন করে করব, প্ল্যাটফর্মে করলে কেমন করে করব, মাঠে করলে কেমন

 

করে করব সেগুলো আলাদা আলাদা হওয়া উচিৎ। সেটা অবশ্যই চিরকাল যতরকমের

 

পথনাটক হয়ছে, প্রচারমূলক রাজনৈতিক নাটক হয়েছে সেগুলো সব রাস্তাতেই হয়েছে

 

এবং এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখন প্রোসেনিয়ামটা বন্ধ রাখতে হয়েছে কারণ

 

আমরা জনসমাবেশ এড়াতে চাইছি। আবার এটার যেটা ঝুঁকি থিয়েটার আরও

 

মুষ্টিমেয়ের থিয়েটার হয়ে যায়। ওই চাকচিক্য, গ্র্যাঞ্জার, স্পটলাইট, প্রোসেনিয়ামের তিন

 

দিক ঘেরা মঞ্চ, তার বিভিন্ন সঙ্গীতের সাহায্য, বিভিন্ন টেকনোলজি সেগুলোর তো একটা

 

জায়গা আছে। এবার সেগুলোকে ছেড়ে যদি নতুন করে কিছু উদ্ভাস পাওয়া যায়, নতুন

 

করে কিছু হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায় সেটা আমার কাছে খুব ভালো। এর ফল কী

 
 
 

হবে সেটা ভবিষ্যত বলবে। সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমি চল্লিশ বছর

 

থিয়েটার করেও এটা বুঝতে পারিনি যে এইরকম একটা বাঁক থিয়েটারে আসবে। আর

 

কিছু না হোক থিয়েটার বেঁচে থাকবে। মারা যাবে না। সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে

 

পারবে।

পারফর্মেন্সের ভাষাঃ ‘অল্টারনেটিভ’-এর সন্ধান

 
 
 
 
 

শ্রাবস্তী ঘোষ

 
 
 

ছোটবেলাতে শহরে যে থিয়েটারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, সেখানে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা থাকতেন মঞ্চের ওপরে, তাঁদের ওপরে চলত আলোর কারুকাজ। তাঁদের উল্টোদিকে মঞ্চের নিচে চেয়ারে বসে থাকেন দর্শক। দর্শকের গায়ে মঞ্চ থেকে আলোর ছোঁয়া এসে লাগে, মূলত থাকে অন্ধকার। সেই আলো- আঁধারির মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান চলে পারফর্মার ও দর্শকের মধ্যে। একসময় স্থান পরিবর্তন হল আমার। দর্শকের অন্ধকারে ঢাকা চেয়ার ছেড়ে মঞ্চের আলো সরাসরি এসে লাগল গায়ে। মঞ্চের ওপর থেকে তুলনামূলক নিচে বসে থাকা গাঢ় অন্ধকারের নিস্তব্ধতা মোহিত করত আমাকে, সে নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু, আমার নিজের মনে হতে লাগল, এইরকম বিশাল মঞ্চ, সুন্দর আকুইস্টিক, আলো-অন্ধকারের খেলার বাইরে অন্য কোন ভাষা প্রয়োজন আমার নিজের কথা বলার জন্য। দর্শক আর পারফর্মারের মাঝের এই দেওয়ালকে ভাঙার যে কথা বারেবারে বলে এসেছেন বাখতিন থেকে গ্রটস্কি- এই প্রয়োজন আমি নিজেও খানিক অনুভব করছিলাম নিজের কাজ তৈরি করতে গিয়ে।

 
 
 

এইসময়েই আমার নিজের কাজ তৈরি হয়, ‘লেটস নট হুইস্পার’। পারফরমেন্সের পরিভাষায় যদিও এটি ‘থিয়েটার’ নয়, ‘পারফরমেন্স আর্ট’। পারফর্মেন্সটি ঘটে ঘরের একটি কোণায়, মাটিতে। দর্শক বসেন মাটিতেই পারফর্মারকে, মানে আমাকে ঘিরে। কোন কোন পারফর্মেন্সে দর্শককে অনুরোধ করা হয়, তাঁদের মোবাইলের আলো দিয়ে পারফর্মেন্সটি দেখতে। ঘরের মধ্যে কয়েকজন মানুষ ও আমি একসঙ্গে একটা মুহূর্ত যাপন করি- একে অপরের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দে, নিস্তব্ধতার গুঞ্জনে, জামাকাপড়ের খসখসে নড়াচড়ার মধ্যে দিয়ে। এই পুরো বিষয়টিতে বেশ কটি ঘটনা ঘটে। প্রথমত, দর্শক আর আমার মধ্যের আদানপ্রদান ঘটে সরাসরি, আলোর ব্যবহার, মধ্যেকার ব্যবধান- পারফর্মেন্সের ভাষা যে বদলে দেয়, সে কথা বলাই বাহুল্য। এক্ষেত্রে যে দর্শক আর পারফর্মারের মধ্যেকারের দূরত্ব কমে তাইই নয়, দুজন দর্শকের মধ্যেও প্রত্যক্ষ আদানপ্রদান চলে। প্রসেনিয়ামের অন্ধকারে, প্রেক্ষাগৃহের বিশালতা, আরামদায়ক চেয়ার দর্শকের মনোরঞ্জনের সঙ্গে সঙ্গে যে দর্শককে ভাবায়, সেকথা অস্বীকার করি না, তবে এক্ষেত্রে দর্শকের সরাসরি অংশগ্রহণ যে থাকে না, তা বলতেই হয়। শুধু আমার পারফর্মেন্স নয়, সার্বিকভাবে দেখতে গেলে, অল্টারনেটিভ স্পেস দর্শকের সরাসরি অংশ নেওয়ার কথা বলে। সেখানে দর্শক-অভিনেতার প্রত্যক্ষ পারস্পরিক আদানপ্রদানে পারফর্মেন্স তৈরি হয়। এক্ষেত্রে দর্শক নিজেও পারফর্মার, যাকে অগস্ত্য বোয়াল বলেন, ‘স্পেক্টঅ্যাক্টর’। এককভাবে দেখার (individual viewing) সঙ্গে সঙ্গে সমবেতভাবে দেখার ( collective viewing) অভিজ্ঞতা হয় এই অলটারনেটিভ থিয়েটার স্পেসে।

 
 
 

একইভাবে অন্য অভিজ্ঞতা হয় পারফর্মারের ক্ষেত্রেও। ‘লেটস নট হুইস্পার’-এর কথাই বলি এক্ষেত্রে। collective viewing-এর আঁচ লাগে পারফর্মারের গায়েও। অনেকগুলো চোখ সামনে থেকে একটি পারফর্মারকে দেখছে। দর্শক তখন আর পারফর্মারের কাছে অন্ধকারে ঢেকে থাকা ইলিউশান নয়। আমি, একজন পারফর্মার, একজন মেয়ে, এবং অনেকগুলো চোখের সামনে বসে আছি একটা ঘরের মধ্যে। যেখানে সামনের সকলে মিলে একসঙ্গে আমাকে দেখছে। দর্শকের দৃষ্টি তখন আমার কাছে সরাসরি এসে পৌঁছে যাচ্ছে, মাঝখানে অন্ধকার-দূরত্ব কোন কিছুর ব্যবধান নেই আর। 

 
 
 

বাংলা থিয়েটার বা বিশ্ব থিয়েটারের ইতিহাস বলে প্রসেনিয়ামের বাইরে নতুনভাবে কথা বলার জন্য, ছক ভাঙার জন্যই বারেবারে অন্য মাধ্যমের খোঁজ হয়েছে থিয়েটারে। তাই, এরা কখনও ‘থার্ড থিয়েটার’, আবার কখনও ‘অল্টারনেটিভ’ নাম নিয়েছে। ইতিহাস বারেবারে এই দুধারার মধ্যে লড়াইয়ের কথা বলে। বাংলা থিয়েটারের ক্ষেত্রেও তাই; প্রসেনিয়াম বড়ো, অভিজাত। কিন্তু, আমার নিজের মনে হয়, দুটি অন্য ভাষা, দুটি আলাদা কথা বলার মাধ্যম, শুনতেও হয় তাই অন্যভাবে। তাই সরাসরি আমার কাছে দু’ধারার মধ্যে কোন বিরোধ নেই। আমার পারফর্মেন্সে দর্শকের উপস্থিতিতে সেইদিন, সেইসময় তৈরি হয়। সেই মুহূর্তে দর্শক যদি না চান ফোনের আলো জ্বালাতে, অবশ্যই পারফর্মেন্স ঘটবে সম্পূর্ণ অন্ধকারে। অর্থাৎ, ইংরিজির ‘হায়ারআরকি’ নেই এখানে পারফর্মার আর দর্শকের মধ্যে। 

 
 
 

আমার থিয়েটারের ভাষা চারদিকের দেওয়ালবিহীন এক খোলা মাঠ। সেখানে সরাসরি দেয়া-নেয়া আছে, একসঙ্গে ভাবনা আছে। এখানে পারফর্মেন্স শুধু মনোরঞ্জন নয় তাই, পারফর্মেন্স দর্শক ও

 

পারফর্মারের মধ্যে জন্ম নেওয়া একটা ঘটনা, যা সেইদিনের, সেই মুহূর্তে তৈরি হয় দর্শকের সরাসরি

 

অংশগ্রহণের মাধ্যমে। কখনও ঘর, কখনও রাস্তা, পারকিং জোন- এইসবের মধ্যে থিয়েটারের জন্ম হয়,

 

নতুন ভাষার খোঁজ তাই অবিরাম চলতে থাকে।

মঞ্চ ও অমঞ্চের রঙ্গকথন

 
 
 
 
 
 
 

সরিৎ দত্ত

 
 
 

কথা হচ্ছিলো বিকল্প থিয়েটার নিয়ে । এবং, প্রথাগতভাবেই, বিতর্ক, অবশ্যম্ভাবী । প্রথমত, বিকল্প শব্দটি । এই

 

শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই একটা সত্য আড়াল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, যে, আমরা থিয়েটার এর প্রকৃত

 

অবস্থান হিসাবে ধরেই নিচ্ছি একটা প্রসেনিয়ম, একদিক খোলা মঞ্চ, আলো, শব্দ, সবমিলে একটা মায়া…

 

দ্বিতীয়ত, সামগ্রিকভাবে শব্দবন্ধটা, "বিকল্প থিয়েটার "…. তাহলে তার উদ্দেশ্য কি প্রকৃত থিয়েটার থেকে পৃথক?

 
 
 

খুলে কই…

 
 
 

থিয়েটারে অভিনেতা ও দর্শকের মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র স্থাপন সম্ভব? দুজনের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া সম্ভব? দর্শক কি

 

নাট্যানুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে? নিষ্ক্রিয় দর্শককে কি সক্রিয় করা যায়? অভিনেতা ও দর্শকের

 

মধ্যেকার স্থানিক দূরত্ব ঘোচানো কি সম্ভব? প্রসেনিয়াম মঞ্চ, আলো, আবহসঙ্গীত, স্লাইড প্রজেকশন, সাউন্ড

 

এফেক্ট, পোশাক, দৃশ্যপট, মঞ্চোপকরণ যাদের সম্ভব নয়, তাদের জন্য নাট্যাভিনয় কি সম্ভব নয়? এরপরও, বিপুল

 

সমারোহের বাইরেও থিয়েটার ‘গণমাধ্যম’ হয়ে উঠতে পারে।  আসলে অভিনেতা ও দর্শকের জীবন্ত উপস্থিতি ছাড়া

 

থিয়েটার অসম্পূর্ণ। মঞ্চের অসমতলীয় অবস্থান থেকে সরে এসে, একটি নির্দিষ্ট পরিশীলিত ঘরে অভিনয়

 

অনুষ্ঠানকেই অন্তরঙ্গ থিয়েটার বলা সঙ্গত? মঞ্চোপযোগী সমস্ত উপাদান-উপকরণ নিয়ে, শুধুমাত্র সমতলীয় দর্শক

 

সংস্থাপন হলেই অন্তরঙ্গতা তৈরি হয় এ প্রশ্ন বহুদিনে।

 
 
 

প্রথাগত থিয়েটারে অর্থাৎ প্রসেনিয়াম থিয়েটারে কি অভিনেতা, অভিনয়ক্রিয়া এবং দর্শকের মধ্যে সম্পৃক্তিকরণ

 

(প্রক্সিমিটি) গড়ে তোলা একেবারেই সম্ভব নয়? ত্রিমাধ্যমের পারস্পরিক সম্পৃক্ত হয়ে থাকাই কি অন্তরঙ্গতার এক

 

ও একমাত্র বিচার্য? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি বহুবার। বহুবার এমন মনে হয়েছে, একাডেমি কিংবা

 

রবীন্দ্রসদনের শেষ রো-তে বসে কোনও নাট্যপ্রযোজনার কার্টেন কলের পরেও নিভৃতে কেঁদেছি একা একা। হয়তো

 

সেই নাটকের শেষ দৃশ্য এমনভাবে ছুঁয়ে গেছে, এমনভাবে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে গেছে, বুঝতেই পারিনি

 

কখন নাটক শেষ হয়েছে! এমনই অন্তরঙ্গ হতে পেরেছি সেই নাট্যের সাথে, সেই অভিনেতার সাথে। কিন্তু, সবটাই

 
 
 

ঘটেছে আমার একান্ত ব্যক্তিসত্ত্বায়। অন্ধকারে, মঞ্চ থেকে অনেকদূরের অসমতলে বসে, আমার ব্যক্তিগত চোখের

 

জলটাও থেকে গেছে আমারই কাছে। নাটকের শেষে মনে হয়েছে, ঐ যে-মানুষটার চরিত্র ‘সহৃদয় হৃদয়সংবাদী’র

 

মতো আমার হয়ে গেছে, যাই তাকে গিয়ে প্রচন্ডভাবে জড়িয়ে ধরি, উজাড় করে দিই, সমর্পণ করি নিজেকে।

 

আমার ‘বড়ো আমি’- টাকে কাছে এনে দেবার জন্য, ভিতরের সমস্ত তাপ-উত্তাপ বিনিময় করি তার সাথে। কিন্তু

 

সম্ভব হয় কি? হতে পারে কি? সম্ভব নয়, জানি। আসলে সেই অভিনেতা আর আমার( দর্শকের) স্থানিক দুরত্ব

 

থেকেই তৈরি হয়ে যায় বোধ, মনন আর হৃদয়ের মধ্যকার হাজার যোজন দূরত্ব। যে অভিনয় স্কিল আমাকে মুগ্ধ

 

করেছে, তা আসলে জাস্ট একটা পারফর্মেন্স ছাড়া আর কিছুই না। ফলত, নাটকের শেষে আমার উক্ত হর্ষ,

 

বেদনা, ক্ষোভ, অভিমান, ক্রোধ কিংবা ভালোবাসা- সবই তার (অভিনেতা) কাছে অনুভূতিহীন, মূল্যহীন, উত্তাপহীন

 

একটা অনাগ্রহের চর্চা ব্যতীত কিছুই নয়। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন জাগে, এই  অন্তরঙ্গতাও তো আসলে একধরনের

 

ফ্যান্টাসি। সিনেমা হল থেকে  আসার সময় যে সুখানুভূতি, তার সাথে এই অন্তরঙ্গতার কোনও পার্থক্য নেই। দুটো

 

ক্ষেত্রেই ক্ষণিকের অন্তরঙ্গ হবার একটা চূড়ান্ত ফ্যান্টাসি।

 
 
 

কিন্তু অপর দিকে নন-প্রসেনিয়ামের আঙিনায় অভিনেতা – দর্শক একাত্ম হতে পারে অতি সহজেই। যে আমি

 

একাডেমি বা রবীন্দ্রসদনে প্রসেনিয়ামের নাটক দেখে মনের মুগ্ধতা আর অভিনেতার সাথে স্থানিক দূরত্বকে সঙ্গী

 

করে অন্তরঙ্গ হবার বদলে একটা চূড়ান্ত ফ্যান্টাসি নিয়ে বাড়ি ফিরি সেই আমিই আবার কখনও  শিয়ালদার

 

লোরেটো-হাউসে কখনও নাকতলার নিরঞ্জন সদনে আবার কখনও বা বাংলা একাডেমির সামনের চাতালে

 

দর্শকাসন থেকে সরাসরি উঠে গেছি ‘মিছিল’-এর জনতায়, কখনও বা হয়ে গেছি ‘মুক্তধারা’র শ্রমিক – গ্রামবাসীর

 

অভিনেতা হিসেবে। আবার পরমুহূর্তেই ফিরে গেছি নিজের দর্শকাসনে। এখানে তো কোনো অসুবিধা হয়নি

 

অভিনেতার সাথে একাত্ম হতে, অন্তরঙ্গ হতে। অন্তরঙ্গ থিয়েটার আসলে একটা মনন-কে আশ্রয় করে নির্মিত হয়।

 

Audience-Performer-Space-Togetherness, — এই সমন্বয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হয় অন্তরঙ্গ থিয়েটারকে। এক নিবিড় অনুশীলন এর ভিত্তি। স্পষ্ট বিশ্বাস, স্পষ্ট বিষয় এবং স্পষ্ট সাংস্কৃতিক ভিত্তি নিয়েই অন্তরঙ্গ নাটকের পথ চলা। আসলে, থিয়েটার বরাবর-ই সময়ের কাছে দায়বদ্ধ। সময়ের দাবি মেনেই তাকে নতুন আঙ্গিকে, নতুন দর্শনে প্রকাশিত হতে হয়েছে বারবার। তাই, অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের মতোই, থিয়েটারেরও একটা স্পর্ধা আছে। প্রথাগত যা কিছু, তাকে সে ভাঙতে চায়, বদলাতে চায়। বিকল্পের সন্ধান, সে করবেই। আর এই বিকল্পের খোঁজ মানে আসলে বিষয় অনুসন্ধান, আর তার সাথে পূর্বে কথিত Audience-Performer আর Space- এর অনুসন্ধান। এই Togetherness-এর সাথে হৃদয়ের তাপ-উত্তাপ আদান-প্রদানের খোঁজ, এই থিয়েটারের

 

পাথেয়। ফলে, বিকল্প অনুসন্ধানে অন্তরঙ্গ তো হতেই হবে।  অন্তরঙ্গ না হলে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা অসম্ভব।

 

বিকল্প মানেই সে অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট -এর বাহক, নতুনের দিশারী।

 
 
 

কিন্তু সমস্যা অন্যতর ।

 
 
 

এই যে এতক্ষণের বলা পরীক্ষা নিরীক্ষা, বিকল্প থিয়েটার সম্বন্ধে এতো বিস্তার, এর কতটা নোতুন এক্সপেরিমেন্ট

 

এর ফসল? আমার তো মনে হলো, এই প্রয়োগ পদ্ধতি আমাদের লোকশিল্পে অনেক প্রাচীন…

 

পাঠক, গ্রামে কীর্তনের আসর দেখেছেন? ভাসানের গান? শয়লা? গ্রামের ভিতরে একটা আটচালা, দর্শকের একই

 

উচ্চতায় , একই আলোয়, কেবল অভিনয়ের জায়গাটুকু দড়ি দিয়ে ঘেরা, অভিনেতারা কোনো মেকআপ বা

 

সাজপোশাক ছাড়া, কিন্তু কি অসামান্য ইম্প্রোভাইজেশন!!!

 
 
 

তাহলে এই যে শাহরিক এক্সপেরিমেন্ট, এ আর বিকল্প কোথায় হলো!

বিকল্প থিয়েটার বিষয়ক একটি প্রস্তাব

 
 
 
 
 

আমরা এখন কথায় কথায় ‘ থিয়েটার করি’, ‘ থিয়েটার দেখি’- বলে থাকি যেখানে সঠিকটা ‘ নাট্য’ একথা বলতে পারিনা তার কারণ প্রবল হাসাহাসি ও কৌতুকের ভয়ে। নাটক ও নাট্য এই দুই এক নয়। প্রথমটি সাহিত্যের এবং অপরটি তার রূপায়ণে। অর্থাৎ বাংলা ভাষায় নাট্য ও নাটকের যে প্রভেদ তা হলো মূলত প্রকাশভঙ্গি। আরো সহজ করে বলতে গেলে, ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে নাট্যের চিহ্নবিজ্ঞানী Tadeusz Kowzan তাঁর The sign in the Theatre; An Introduction to the Semiology of the Art of the Spectacle নামক বইটিতে তেরোটা উপাদানের (word, tone, Mime, Gesture, Movement, Make-up, Hairstyle, Costume,props,Decor, Lighting,Music,Sound Effects) মাধ্যমে গড়ে ওঠে নাটক থেকে নাট্য। উপরিলিখিত উপাদান গুলি উপস্থাপক ও অভিনেতার আওতায় আসার পরে লিখিত নাটকের মধ্যে না থেকে তা নাট্যে পরিণত হয়েছে। এখানে আরো একটা কথা বলা প্রয়োজন যে, ছাপাখানা আবিষ্কারের পূর্বে মধ্যযুগে মূলত মঙ্গলকাব্য বেশিরভাগ পৌঁছত মানুষের কাছে কথক ও উপস্থাপকের মারফত, লিখিত আকারে নয়। তাই অনেক সম্বোধন পদ মৌখিক সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য হিসেবে পাওয়া যায়। লিখিত সাহিত্য হিসেবে তৈরি হয়নি তখনো।

 

ফিরে আসা যাক কাউজানের তেরোটি উপাদান সম্বন্ধে। অনেকে আবার দুটি উপাদান যুক্ত করতে চেয়েছেন এই তালিকায় — একটা হল চিত্রক্ষেপণ বা projection, অন্যটি হল নাট্যাভিনয়ের স্থান। যাই হোক, তেরোটি উপাদানের কাজ গুলি হলো প্রাথমিকভাবে নাটকের স্থান কাল – পাত্র ঠিকমতো ফুটিয়ে তোলা এবং পোশাক রূপসজ্জায় প্রকাশ পাবে প্রয়োগকারীর দৃষ্টিভঙ্গি। অন্যদিকে, শিল্পীরা বাস্তবতার শর্তকে মেনে নাও চলতে পারেন। ধরা যাক কোনো অভিনেতা তার বাস্তবের সম্ভাব্যতাকে পুরোপুরি না মেনে, তাকে অতিক্রম করে নিজের ব্যাখ্যাও মিশিয়ে দিতে পারেন। হুবহু বাস্তবের মেনে চলা থেকে তাঁকে কোনো ক্ষণে বেরিয়ে আসতেই হয়।

 

অর্থাৎ যে কোনো শিল্পই বাস্তবের নকল নয় তা হলো পুনর্নির্মাণ, থিয়েটার তার অন্যথা হবে কেনো।

 

নাট্য ও ছবির ব্যাপারে বাস্তবকে হুবহু মেনে চলার একটা রক্ষনশীল দাবি ওঠে। তার কারণ হয়তো চোখে দেখার পৃথিবী যদি কোনোভাবে ঘেঁটে যায়, তাহলে অদীক্ষিত শিল্প উপভোক্তা বিপন্নের সামনা সামনি হন। প্রাচীন দেবদেবীদের মূর্তিতে আছে নানা ধরনের বিমূর্ততা কিন্তু ছবির কাছে তবু দীর্ঘদিন ধরে যা চোখে দেখা যায় তাকে মেনে চলার দাবি জানিয়ে আসা হয়েছে। প্রাচীন মধ্যযুগে শিল্প যে ছলের মধ্যে দিয়ে ছিল, সেখানে মূর্তি বা ছবির মধ্যে দিয়ে একটা পরিচিত ধারণাকে তুলে ধরা হত। তবে আধুনিক যুগে আধ্যাত্মিক ধারণা নেই আর। সেই কারণে ইয়োরোপীয় বাস্তবতাবাদ চোরা প্রতিক্রিয়ার ছবির কাছ থেকে অনেকে হুবহু বাস্তবতা প্রত্যাশা করে থাকেন। নাট্য সম্পর্কে Eric Bently – বিখ্যাত মন্তব্য মনে পড়বে আমাদের — A impersonates B while C looks

 

on. অর্থাৎ শুধু রূপের দিক থেকে নয়, তার প্রকাশভঙ্গির দিক থেকেও তাকে অন্য মানুষ হয়ে উঠতে হবে। আর এই প্রকাশভঙ্গি যেটা সে নিজে হয়তো বাস্তবে বেঁচে থাকার তাগিদে করে উঠতে পারেনি, তাকে হয়তো করতে হচ্ছে। ধরা যাক চোর ধরা পড়লে যেমন ভাবে সাধারণ মানুষ মারতে থাকে তার মধ্যে একজন লোক এসে দু- তিন ঘা কষিয়ে দিল, ব্যক্তিগত জীবনে সে হয়তো আরশোলা মারতেও ভয় পায়। সুতরাং, নাট্য হল একটা ছলনার জগৎ, ধরে নেওয়ার জগৎ। প্রাচীন নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে ইজিপ্টের পিরামিড নাটকের কথা হোক বা গ্রিক নাটকের অন্যদিকে প্রাচীন সংস্কৃত নাট্যের কথা হুবহু দেখানোর কোনো চেষ্টাই সেখানে করা হয়নি কখনোই।

 
 
 
 
 
 
 
 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধে বাস্তবকে ভেঙ্গে ফেলাটাই রেওয়াজ তার কথা বলেছেন।

 

পরবর্তীকালে যদিও তার ব্যবহার কম বেশি রয়েছে। তবুও, ‘আঃ, উপরেতে উঠে এলে বায়ু যেন অনেক নির্মল লাগে, লাগে না তোমার ?' একথায় আপনি শুধু ধরে নিলেন না, বিশ্বাস করলেন চাঁদ বণিকের পালায় লখিন্দর বেহুলাকে নিয়ে ওই সা৺তালি পাহাড়ের চূড়ায় বাসরঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

 

নাটক অভিনয়ের ইতিহাসে এরকম বহু উদাহরণ আছে যেখানে, নাট্যের শিল্পকে বজায় রাখার জন্য কতোটা ত্যাগের মুখোমুখি হতে হয়। যেমন, শম্ভু মিত্র তাঁর বহুরূপীর তিনজন সামনে সারির অভিনেতাকে (কুমার রায়, দেবতোষ ঘোষ, শান্তি দাস) দিয়ে কোরাসের একটি অংশ ‘ রাজা অয়দিপাউসের’ মহলা প্রায় সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত বিরতিহীন রিহার্সাল করিয়েছিলেন। মনের মতো হচ্ছিল না বলে। শেষে তৃপ্তি মিত্র এসে বকেঝকে উদ্ধার করলেন তাদেরকে। এখানে প্রশ্ন কি খুঁজেছেন শম্ভু মিত্র ওই তিন লাইনের মধ্যে? উত্তরে দেবতোষ ঘোষ বলেছিলেন শম্ভুদা চাইছিলেন, ওই তিনটি লাইন শোনার সঙ্গে সঙ্গে যেন দর্শকের মনে তার সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের ছবি ভেসে ওঠে। এই হল নাট্যের সব চাইতে জোরের জায়গাগুলি।

 
 
 

এবার আসা যাক নাট্য সাহিত্যের অন্য এক দিক নিয়ে, শাইলকের সাম্রাজ্যবিস্তার নামে শাহজাদ ফিরদৌসের একটা উপন্যাস আছে আমরা অনেকেই পড়েছি। সেখানে একজন ভোগ করার উপাদান পাবার জন্যে এমনকী নিজের অতীতকেও বেচে দিয়েছিল। দিনের শেষে সূর্যাস্তের সময় তার বাবা তাকে প্রশ্ন করেন, সে তো তাহলে তার বাবা মাকেও বিক্রি করে দিয়েছে। এই প্রসঙ্গ আনার কারণ হল, তরুনতর নাটকের মাথারা সুমন, কৌশিক বা ব্রাত্য বসু এনাদের মতো মানুষজন এমন কিছু কিছু মন্তব্য করছেন, যা ইতিহাসের পরম্পরা অস্বীকার করা যায়। যেমন সুমন আনন্দবাজারে এক মন্তব্য করেছিলেন যে, কাঁধে ঝোলা নিয়ে লোকাল ট্রেনে চড়ে থিয়েটার করার দিন শেষ হয়ে গেছে। অঙ্গণমঞ্চে দলগুলি , তাদের মধ্যে বাদল সরকার তার শতাব্দী ত আছেই, সেই সঙ্গে আছে পথসেনা বা আয়নার মতো বেশ কিছু দল, তাঁরা কাঁধে ঝোলা নিয়ে লোকাল ট্রেনে চড়ে নাটক করতে যান। সে ইতিহাস কি মানুষ ভুলে যেতে পারে? এছাড়া নাট্যমুখ – এর কোনো এক সংখ্যায় যাঁরা টিকিটের দাম

 

বাড়াতে চান না থিয়েটারে তাদেরকে কৌশিক সেন বলে দিলেন তাঁদের টিকিট বিক্রি হয়না বলেই এইসব কথা বলছেন প্রভৃতি নানা বক্তব্যে একটা গোটা নাটকের দশককে অস্বীকার করেছেন বিশিষ্ঠ এই মানুষেরা। বাংলা থিয়েটার এখন কিছু কিছু আধিপত্যের নিয়ন্ত্রণে। যার ফলে থিয়েটারের আদর্শ এবং স্বাধীনতাকে গলা টিপে মারার ষড়যন্ত তে সামিল। গ্যালিলিও কে নিয়ে লেখা তাঁর বিখ্যাত নাটকে ব্রেখট দেখিয়েছিলেন কেমন করে বলবান ক্ষমতাবানরা নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে কাজে লাগায় ভয় দেখিয়ে, লোভ দেখিয়ে মানুষকে বশ করাতে। এরকম নানান কুরুচিকর মন্তব্য বাংলার নাটকের কিছু বিশিষ্টজনেরা করে থাকেন।

 
 
 

থিয়েটারের উত্তরসূরি হিসেবে গণনাট্য থেকে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল পরে তা ছয়ের দশকে আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে স্থাপিত দ্য গ্রুপ থিয়েটারের আদলে গ্রুপ থিয়েটার নামে চাতার তলায় সমবেত হল। গণনাট্যের প্রত্যক্ষ রাজনীতিমুখিতা থেকে শিল্পীদের মনে অতৃপ্ত তৈরি হচ্ছিল, আরও নানা ধরনের সমস্যা ছিল। পরে মূল আদর্শবাদী এই মানুষগুলি রাজনৈতিক ভাবে সংগঠন থেকে বেরিয়ে আসলেও সামাজিক দায়িত্ববোধ জায়গা থেকে নিজেদের সরিয়ে আনলেন না। কারণ বাদল বাবু, বিজন বাবু এবং উৎপল দত্তের ভাবনা চিন্তার জগৎ একেবারে আলাদা।পৃথক হওয়ার সত্ত্বেও দর্শকরা এই আদর্শমুখিতা শ্রদ্ধা করতেন, ভিড় করে আসতেন বিশ্বাস নিয়ে।

 

অন্যদিকে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল থিয়েটারে । যেমন, কাগজের বিজ্ঞাপন, প্রেক্ষাগৃহে ভাড়া

 

প্রভৃতিতে। কিছু উদাহরণ দিলে তা স্পষ্ট হবে, ধরা যাক অ্যাকাডেমি অভ ফাইন আর্টসে একটা চালু

 

প্রযোজনার অভিনয় করতে এখন কমপক্ষে পেক্ষাগৃহ ভাড়া লাগে ১৩,৫০০ টাকা, বিজ্ঞাপন(আনন্দবাজার) ৩ সেমি একটি ৪৫০০ টাকা, আবহ যিনি বাজাবেন তাঁর পারিশ্রমিক ১২০০ টাকা, আলোকসম্পাতকারীর

 

পারিশ্রমিক ৩০০০ টাকা, রূপসজ্জাকর ১০০০ টাকা, মঞ্চসজ্জার জিনিসপত্র গুদাম থেকে আমার খরচ গাড়ি ভাড়া ২৫০০ টাকা( দূরত্ব অনুযায়ী), চা জলখাবার (সদস্য সংখ্যার উপর নির্ভর করে, তিরিশ জনের দল হলে) ১৫০০ টাকা। মোট ২৭,০০০ টাকা। দুই প্রহরের প্রমোদে এই টাকার সংখ্যা উড়ে যায়। এই বড়ো অঙ্কের টাকা খুব সাধারণত বেশি দলের ক্ষমতায় বর্তায় না। যার টাকা বেশি, অথবা মাসল পাওয়ার তার ক্ষমতাও বেশি সবার ক্ষমতা একই স্তরের নয় এটাই স্বাভাবিক। থিয়েটারের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলো, নাট্যকর্মীরা পরিবর্তনের জন্য লড়ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের সরকার বদলের পর জহর সরকার নাটকের দলগুলি অনুদান পেতে সাহায্য করেছিলেন। তারাই সাহায্য পেলেন যারা কাছের লোক হতে পেরেছিলেন। কোন দেবতাকে তুষ্ট করতে

 

পারা যায় তার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছিল। ন্যায় নীতি আদর্শ এখন তলানিতে ঠেকেছে কেউ মাথা ঘামায় না।

 

গুটিকয়েক মহাশক্তিধর অভিনয়শিল্পী ছাড়া তার বাইরে যাঁরা এই গতেই থিয়েটার করে যাচ্ছেন তাদের অবস্থা কী? অল্পস্বল্প অনুদানের টাকা আছে হয়তো, আর আছে সুমন বাবু, ব্রাত্য বাবু, দেবেশ বাবুর মতো নাটক করার ইচ্ছে, তাঁদের নাটক দেখতে দর্শক ভিড় করে না। খরচসাপেক্ষ থিয়েটারে বিপরীতে অন্য ধরনের নাটক করার কথা বলেছেন কেউ কেউ। সাতের দশকে বাদল সরকার বেশি গুরুত্ব পেয়েছেন। কিন্তু, যে দেশে এখনও পর্যন্ত থিয়েটারকে প্রসেনিয়মকেই বোঝেন, সেক্ষেত্রে কোথাও গিয়ে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। প্রেক্ষাগৃহ আলোকসজ্জা থিয়েটারে শেষ কথা নয় একথা জানা দরকার। বাদল সরকার যেভাবে থিয়েটারকে বিকল্প পথের দিশা দেখিয়েছিলেন, তা অস্বীকার করা যাবে না। সর্বোপরি বলা দরকার, ঠান্ডা ঘরে দুশো পাঁচশো টাকা দিয়ে টিকিট কেটে অ্যাকাডেমি ইত্যাদি জায়গায় যারা যেতে পারেন না, তাঁদের কথা ভেবে থিয়েটার করার উদ্যোগ নিয়ে চলেছেন অনেকে। যে কোনো খোলা জায়গায় হতে পারবে অভিনয় ক্ষেত্র, সামান্য কিছু পয়সা দিয়ে, বা যাদের যা মনে হবে সেরকম টাকা দিয়ে যাবেন অভিনয় শেষে। এবং আলো বাড়ানো কমানোর দরকার নেই, দর্শক ঠিক বুঝে নিতে পারেন কখন দৃশ্য শেষ হল। মনে রাখা দরকার অ্যাকাডেমি, রবীন্দ্র সদন ইত্যাদি এলাকার বাইরে একটা বড়ো দেশ আছে, সেখানকার মানুষের মনে থিয়েটার সম্পর্কে চাহিদাও আছে। সমাজের নানা কাজে লাগতে পারে এই নাট্য। অন্তর্মুখ যেমন পরিকল্পনা করেছে, স্কুলে যে যে বিষয়ে পড়ানো হয় সেই নিয়ে নাটক তৈরি করা হবে।স্কুলে তাঁদের ছাত্র ছাত্রীদের সামনে অভিনয় হবে। কলকাতার বাইরে, গ্রামের দিকে অভিনয় শেখার প্রবল চাহিদা আছে। নাট্য শুধু বিনোদনের, পয়সা ওয়ালা মানুষদের জন্য না হয়ে সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষের জন্যে হয়ে উঠতে হবে সদর্থক এক হাতিয়ার। অন্ধকারের মধ্যেও ক্ষীণ এক আলো দেখা যাচ্ছে। সেই পথের দিশারী আমরা।

 
 
 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *