ত্রয়োদশ সংখ্যা ।। ষষ্ঠ ই- সংস্করণ ।। ফেব্রুয়ারী ২০২১

ভাণ পত্রিকা

ত্রয়োদশ সংখ্যা ।। ষষ্ঠ ই- সংস্করণ ।। ফেব্রুয়ারী ২০২১ ​ ​

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

ও মৌলিকা সাজোয়াল

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) [email protected] ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সূচি

২৬ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব নিয়ে - সিদ্ধার্থ মাইতি

 
 
 

সিদ্ধার্থ মাইতি

 
 
 
 
 

ন তারিখ সকাল না বেলা এগারোটা শিশির মঞ্চ,অতিমারি সতর্কতায় বিলম্বিত কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আসল ছবি দেখা শুরু! দু ঘন্টা আগে নন্দন এক এ ফেলিনি শতবার্ষিকী শ্রদ্ধাঞ্জলির সূত্রপাত হয়েছে।

 

Highways of Life নিয়ে আগাম খবর ছিলো ভালো ছবি,অমর মাইবামের ব্যক্তি জীবনের পিতৃভূমি মণিপুর ইম্ফল নিজের জীবন! তায় সহ চিত্রগ্রাহক বিবেক পাল আমার অন্তরঙ্গ সহযাত্রী.. সাকুল্যে কুড়ি জন দর্শক! হ্যাঁ Highways of Life একটি অবিশ্বাস্য জীবন গাথা। আহা এমন ছবি করে কেউ জীবনের যাবতীয় বর্ণ ভঙ্গী উথাল চড়াই এবং তারপরও জীবন। ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য হাই ওয়ে মণিপুরের রক্ত সংবহন তন্ত্রের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। যাবতীয় আন্দোলন সেই হাইরোড বারংবার দীর্ঘ অবরোধে। হাইওয়ে ট্রাক ড্রাইভারদের ছারখার জীবনগাথা মণিপুরএর এক ভিন্ন ধারাবিবরণী! ভালো ছবি দেখে ফুরফুরে।

 

Highways of Life ২৬ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ভারতীয় প্রামাণ্য চিত্র পুরস্কার পেলো। ১৫ ই জানুয়ারি সন্ধে ছ’টায়!

 

কবি অধ্যাপক কিরগিজস্তানের ছবিটি দেখবেন, ডেলিগেট কার্ড হাতে আসতে আসতে কিরগিজস্তান হারাতে হবে। শাম্বালা! শিশু দাদু অগাধ প্রকৃতি ও তার পবিত্র মাতা আলোকিত বাইসন… এবং পিতার দূরত্ব.. পিতা কে!! এই বিপুল অপার বৈভবময় প্রকৃতির রক্ষাকর্তা!! লোভী অরণ্যখেকো স্বাভাবিক আচরণের বাবুদের ক্রমাগত বিপণন পণ্য, টিভি যেমন, পৌঁছে দেওয়া ও সেবক নিয়োগ! জনজাতি পারম্পরিক লোকগাথা সংস্কার ও বিশ্বাস বা উলটো বিশ্বাস এবং সংস্কার নির্মাণ প্রতিনির্মাণে ফেরে।

 

চনমনে দুরন্ত শিশু শাম্বালা আমাদের মোহিত করে রাখে! শাম্বালা কিরগিজ ভাষায় a glow emitting baby)! কি বাংলা করি! দ্যুতি বিচ্ছুরক শিশু। নাহ জুৎসই লাগছে না। কিন্তু যে শিশুর অবয়ব দেখি তার অস্তিত্বের গভীরে বিশ্বাস — সেই আলোকিত নীল গাই তাদের গোষ্ঠীর শেষ শিশুটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে সে আসবেই। সেই স্বর্গীয় নীল গাই লোভী হিংস্র জঙ্গল বিনাশী মানুষের আয়োজনে শিকার হয়ে যায়! সাম্বালার বিশ্বাস তার অঞ্চলের উচ্চতম চূড়ায় উঠে প্রার্থনা করলে সব সংকট ঘুঁচে যাবে।।ছবি জুড়ে ক্ষয়িষ্ণু গোষ্ঠীর বেদনা যন্ত্রণা লোভ আর তার সমান্তরালে শাম্বালার হারিয়ে যাওয়ার ঝর্ণা নদী নদীর পাড়ের নুড়ি পাথর আর উত্তুঙ্গ পাহাড়ের বুক পিঠ জুড়ে অরণ্য! আরটিকপাই সুইনদুকভের প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছবি( ২০২০)আমাদের স্তব্ধ করে বিদীর্ণ করে এবং শাম্বালার স্বপ্নের সহযাত্রী করে তোলে। শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার নিয়ে গেলেন সুইন্দুকভ তাঁর প্রথম ছবিতে!

 

বান্দার ব্যান্ড ইরানের ছবি। আমরা যে ইরানি ছবি জেনে এসেছি কিরিওস্তামি, মাখমলবাফ ( পিতা কণ্যা দুজনেই) জাফর পানাহি, মাজিদ মাজিদি এবং আরও নাম আসে তার চলন উপাখ্যান নির্মাণ শৈলীর থেকে বেরিয়ে এক অন্যতর ভাষার আমাদের দেখালেন মানিজে হেকমত! তাঁর তৃতীয় ছবি। ছবির নামেই ব্যান্ডের উল্লেখ মানে গান এবং গান। কিন্তু এই বান্দার ব্যান্ড তেহরানের উদ্দেশে রওয়ানা হয় গর্ভবতী মাহলা, তাঁর স্বামী এবং অন্তরঙ্গ বন্ধু কে নিয়ে। পথে তুলে নেবেন বাকি সদস্যদের। প্রবল বর্ষণে বিধ্বংসী বন্যা। পথ হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। বন্যাত্রাণের শিশুখাদ্য থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন পৌঁছে দেওয়ার শর্তে পথ ছাড়ে অবরোধের জনতা। এক নারী সদস্যের খোঁজে যেতে যেতে সব হারানো আর্তনাদ দীর্ণ বস্তিতে এসে হাজির হয় তারা। মাহলা নিজের আকুলতায় তার সঙ্গীত সঙ্গীকে খুঁজে পায় এক সর্বস্ব খোয়ানো নারীর চেহারায়। ধ্বসে যাওয়া রাস্তার অকল্পনীয় বাধা পেরোতে পেরোতে আমরা দেখি প্রাচীন অট্টালিকার বিধ্বস্ত অবশেষ। দলের গিটার শিল্পীর সন্ধানে এগিয়ে তারা অকূল সমুদ্রের মতো জল দেখে! ভেসে যাচ্ছে গিটার তিরতিরে জলস্রোতে। প্রগাঢ় এক শূন্যতায় বিলাপে হারিয়ে যায় মাহলা ও তার স্বামীর একমাত্র পুরুষ সঙ্গী।

 

তার গানে rain coming down as sowrds.. চমক লাগে। সব পথ হারিয়ে যায় সঙ্গীত সমারোহে পৌঁছনোর তবু আশা জাগে। তবে এ বন্যা কি শুধুই বন্যা নাকি ইরানের আজকের অবস্থা!!! এতো নিপুণ নির্মাণে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের উপাখ্যান মানিজে হেকমত দেখালেন! এবারের উৎসবের শ্রেষ্ঠ ছবির শিরোপা পেয়েছে বান্দর ব্যান্ড। সালাম মানিজে! সামিরা মখমল বাফের পর ইরানি সিনেমার মহিলা পরিচালক আপনার কাজে আমাদের প্রত্যাশা বাড়ে।

 

ভারতীয় শ্রেষ্ঠ স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবির পুরস্কার পেয়েছেন উজ্জ্বল পাল।তাঁর Dusk ছবির জন্য।। ২৩ মিনিটের ছবি যে কতোটা সংলাপ হীন বাঙ্ময় হয়ে উঠতে পারে না দেখলে জানা যেতো না। দেহবৃত্তির নারীদের নিয়ে ছবি অপ্রতুল নয়। তবে Dusk এক অনবদ্য ন্যারেটিভ। উজ্জ্বল সাবাশ।

 

এখানেই থামি।

 

বহু ছবি নিয়ে কথা বাকি রইলো

 

 

 
 

মতামত [email protected]

গায়কের গেরো' কে চেনাতে নামলেন সঙ্গীত শিল্পী - স্নিগ্ধদেব সেনগুপ্ত

 
 
 

স্নিগ্ধদেব সেনগুপ্ত

 
 
 
 
 

-গায়কের গেরো-

 

 

 

আত্মপক্ষ: গায়ক আর শ্রোতার মধ্যে একটা পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক থাকা উচিৎ। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। শিল্পীদের দূর আকাশের তারা মনে হচ্ছে না আর। তাদের এখন ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো যাচ্ছে। কমেন্ট বক্সে ইচ্ছে করলে কাছা খুলে নেওয়া যাচ্ছে। তাই দূরত্ব থেকে আসা সমীহটা চলে গেছে।

 

 

 

সব মানুষ তো সমান হয় না। অনেকে অতি অভদ্র হয়। অনায়াসেই সৌজন্যের বেড়া টপকাতে পারে। এই লেখার “আমি” হচ্ছে তেমন এক অতি অভদ্র, মুখফোড় গায়ক। তার শ্রোতাদের প্রতি তেমন শ্রদ্ধাটদ্ধা নেই। সে নিজেকে নিয়ে সদা সচেতন, সিরিয়াস। মাঝেমাঝে খানিকটা আত্মপ্রচারমুখী। এই “আমি” চরিত্রটা কাল্পনিক কিনা সেটা নিশ্চিতভাবে জানতে পারলে বলে দেব। বাকি সব চরিত্রই ঘোর বাস্তব।

 

 

 

 

 

*প্রথম পর্ব*

 

 

 

এই এক হয়েছে। শ্রোতারাই নাকি শিল্পীর ভগবান! আহা গো! ভক্ত-ভগবানের কী রেশিও!

 

 

 

তা গায়ক হয়েছি যখন, ভগবানের বাণী শুনতে হয়। শ্রোতাতন্ত্রে যদি গানরাজ্য চলত, তাহলে তার চেহারা কেমন হত সেটা মাঝেমাঝে দেখতে ইচ্ছে করে।

 

 

 

বড়োরা ছোটদের ভাল চান, আর শ্রোতারা গায়কের – এটা সবাই ধরেই নিয়েছে। কিন্তু ভাল চাইলেই যে ভাল হয় না, এটা ভুলে গেছে। ভুলে গেলেই সুবিধে, তাই ভুলে গেছে। যে ভাল চাইছে, তার ভাল মন্দ বিচার করবার মতো বিবেচনা থাকবে, এটা তো একটা পূর্বশর্ত হিসেবে ধরে নেওয়া যায় না। মানুষ কি সাধারণত বুদ্ধিমান, বিবেচক হয় নাকি? উল্টোটাই তো সাধারণত হয়। এবার, এরা যখন বলে দেয় গায়কের কী করা উচিৎ, তখন বিপর্যয়ের সম্ভাবনাটাই প্রবল হয়ে ওঠে।

 

 

 

আমাকে অনেকে বলেছেন “তোমার গান যে কী ভাল লাগে…! কিন্তু তুমি এত গম্ভীর হয়ে গান করো কেন গো! একটু হাসতে কী হয়?”

 

যত বলি আমার দাঁতগুলো বিচ্ছিরি, এরা নাছোড়। এক প্রবাসী আত্মীয়কে একবার বললাম – “আমি আজ বারো বছর হল বিবাহিত। এখনও হাসব?” তিনি চোখ পাকিয়ে বললেন “একদম বৌমার নামে সবসময় বদনাম দেবে না বলে দিচ্ছি।”

 

 

 

এত জবাবদিহি করবার থেকে গানের মাঝেমাঝে ফিক করে একটু হাসা সোজা – এই ভেবে অনেকেই হাসে, আমি জানি। কিন্তু অপাত্রে হাসিদান করব কেন? এই কি শিল্পীর প্রিন্সিপাল? আমি না একজন নীতিবাজ গায়ক! নিজেকে সবসময় সিরিয়াসলি নিয়ে থাকি। গান করবার সময় গাম্ভীর্যের মোড়কে সেই আত্মসিরিয়াসনেসটাই ঝলকে ওঠে। কাজেই নিজের ওকালতি তো একটু করতেই হয়।

 

 

 

আচ্ছা, কেউ কখনও লতা মঙ্গেশকরকে বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে গান গাইতে গাইতে এক গাল হাসতে দেখেছেন? প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখটা দেখলে তো মনে হত পুতুল। যেন কোনও আবেগই প্রকাশ করতে জানেন না। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বা সুবিনয় রায় কি খুব হেসে হেসে গান করতেন? মেহদি হাসান বা জগজিৎ সিং এর মুখে আমরা গান গাওয়ার সময় গাম্ভীর্য ছাড়া অন্য কোনও অভিব্যক্তি দেখেছি কি? এখনকার শিল্পীদের কারুর নাম করলাম না। সিরিয়াস লোকেদের ডিপ্লোম্যাটিক থাকতে হয় তো। তবে আছেন অনেকেই, যাঁরা অকারণে হাসেন না। আসল কথা হল, আমরা তেমন গাইতে পারি না। পারলে আর হাসি-কান্না নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না।

 

 

 

আর কেউ কেউ আছেন, যাঁরা হাসলেও লোকে দেখে বুঝতে পারে না। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মনে নেই? সেই যে “কান্দস ক্যান্?” এর উত্তরে – “কান্দুম ক্যান্, আমার মুখটাই ওর’ম!”…। মোক্ষম!

 

 

 

শুনেছি রিয়েলিটি শো-তে “গ্রুমিং”-এর সময় হেসে হেসে গাওয়ার ওপর খুব জোর দেওয়া হয়। মাইরি বলছি, গানের মধ্যে অকারণ দন্তবিকাশ দেখলে গা জ্বলে যায়।

উদয়শঙ্করের নৃত্য ধারার ধারণা দিলেন - শ্রীপর্ণা ভট্টাচার্য্য

 
 
 

শ্রীপর্ণা ভট্টাচার্য্য

 
 
 
 
 
 
 
 

কল্পনার উদয় শংকর।

 
 
 

উদয় শঙ্কর চৌধুরী ভারতীয় শাস্ত্রীয় এবং উপজাতীয় নৃত্যের উপাদানগুলির সাথে সমন্বয় ঘটান, যা পরবর্তী কালে ভারত,ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জনপ্রিয় ঘটে। এই শিল্পীর জন্ম হয় রাজস্থানের উদয়পুরের শংকর পরিবারের জমিদার বংশে ১৯০০ সালের ৮ই ডিসেম্বর। জন্মস্থানের নামানুসারে তাঁর নাম হয় উদয়।তার বাবা পন্ডিত শ্যাম শঙ্কর ছিলেন বাংলাদেশের যশোর জেলার অধিবাসী। পন্ডিত শ্যাম শঙ্কর যখন ঝালাওয়ারের মহারাজার ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে কাজ করছিলেন তখন উদয় শঙ্করের জন্ম হয়। তার পিতা, পন্ডিত শ্যাম শঙ্কর ছিলেন শিল্পবোদ্ধা প্রাজ্ঞজন।তার কাছে নৃত্যকলা ছিল একাধারে শিল্প এবং পুজা ও উপাসনা। শিল্পী উদয় সহজাতভাবে চিত্রকলা ও নৃত্যকলার প্রতি অনুরাগী হন। ১৯১৮ সালে শিল্পী উদয়কে মুম্বাইয়ের জে জে স্কুল অব আর্টস এবং পরে গান্ধর্ব মহাবিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠনো হয়। এর পর তিনি উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য লন্ডনের রয়েল কলেজ অব আর্টস্ এ যান।সেখানে তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন রোদেনস্টাইন। এখানে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নানান তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করেন। সেখানেই বিখ্যাত রুশ ব্যালেরিনা অ্যানা প্যাভলভার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। তাঁর কাছ থেকে নৃত্যের নানা কৌশল শেখেন ও পরে তাঁর সাথে ‘রাধাকৃষ্ণ’ এবং ‘হিন্দু বিবাহ’ নামক দুটি অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ করেন। এরপর তিনি কথাকলি নৃত্যের শিক্ষা শুরু করেন গুরু শংকরণ নাম্বুদি কাছে। তারপর তিনি তাঁর দল গঠন করে অ্যালিস বোনারের সহযোগিতায় ১৯৩০ সালে প্যারিসে যান, নৃত্যের সঙ্গিনী হিসাবে ছিলেন সিমকী, বিষ্ণুদাস শিরালী ও অন্যান্য শিল্পীগণ ।এঁদের নিয়ে সৃষ্টি করেন ইন্দ্র, টেম্পল ডান্স, ওয়েডিং ডান্স, স্প্রিং ডান্স, পেজেন্ট ডান্স, ও আরও অন্যান্য। ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত ইউরোপ ও আমেরিকা উদয় শঙ্কর চৌধুরীর প্রযোজনায় নৃত্যকলা মঞ্চস্থ হয়।তারপর তিনি ভারতে ফিরে এলে কলকাতার টাউন হলে তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই সময় নৃত্যকে কেউ ভালো চোখে দেখত না তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে শান্তিনিকেতনে নৃত্যকে সম্মানের আসনে বসানোর চেষ্টা করছিলেন সেই কারণেই শিল্পী উদয় শঙ্করের কাজেও তিনি নিজে খুব খুশি হলেন এবং তাঁর পাশে থেকে তাঁর শিল্পস্বত্ত্বাকে সম্মানের আসনে বসানোর চেষ্টাও করলেন। কবি রবি ঠাকুর শিল্পী উদয়কে আমন্ত্রণ জানান তাঁর দল নিয়ে শান্তিনিকেতনে আসার। শিল্পী উদয় তাঁর আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে যান ও তাঁর শিল্পসত্তার নির্দশন রাখেন তাঁর নৃত্যের শৈল্পিক কলার মাধ্যমে।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

মিস্টার অ্যান্ড মিসেস এল্ডহার্স্টের সহযোগিতায় ১৯৩৯ সালে উত্তরপ্রদেশের আলমোড়ায় শিল্পী উদয় শংকর চৌধুরি “উদয়শংকর ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টার” (uday shankar Indian cultural center) নামে একটি নৃত্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এই প্রতিষ্ঠানে শিল্পী উদয় শংকরের গুরু শংকরণ নাম্ব্রুদি পাদ নৃত্য শিক্ষা দিতেন। এছাড়া বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যাক্তিরাও যেমন আলাউদ্দিন খাঁ, গুরু কান্ডাপ্পা পিল্লাই, আমুবি সিং, রামগোপাল, সাধনা বোস, বিষ্ণুদাস সিরলী, গোপীনাথ প্রমুখ। এঁনারা নৃত্য প্রতিষ্ঠানটি সুপ্রতিস্থিত করার জন্য নানা ভাবে সাহায্য করেছেন।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

১৯৪২ সালে ৮ই মার্চ অক্ষয় কুমার নন্দীর কন্যা ও নৃত্যসঙ্গিনী অমলা নন্দীর সঙ্গে উদয় শংকর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহের পর নৃত্য প্রতিষ্ঠানেই সৃষ্টি হয় ‘শিব-পার্বতী’, ‘কিরাত অর্জুন’, পুরুষ ও প্রকৃতি, নৃত্যদন্দ র মতো নৃত্যকলা। এছাড়া সেই সময়ের সামাজিক সমস্যা নিয়ে শিল্পী উদয় শংকর সৃষ্টি করলেন ‘রিদম অব লাইফ’ এবং ‘লেবার অ্যান্ড মেশনারি’। পরে উদয় শংকর INDONESIA ও MALABAR এ গিয়ে শ্যাডো থিয়েটার দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সৃষ্টি করেন ছায়ানৃত্য রামলীলা। ১৯৪৪ সালে এই নৃত্য প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে যায়।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

এরপর উদয় শংকর তাঁর জমানো সমস্ত অর্থ ও শ্রম দিয়ে তৈরি করলেন ১৯৪৮ সালে ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র যা শুধুমাত্র বাদ্যযন্ত্রের দ্বারা অভিনিত ‘কল্পনা’ চলচ্চিত্র। সেই চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণে স্বয়ং উদয় শংকর ও তাঁর স্ত্রী অমলা শংকর ছিলেন এবং ছিলেন তাঁর শিক্ষার্থীরা।

 
 
 
 
 
 

১৯৪২ সালে তার প্রথম সন্তান,আনন্দ শংকর জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৫৫ সালে, তার কন্যা মমতা শংকর জন্মগ্রহণ করেন।পুত্র,আনন্দ শংকর খুব অল্প বয়সে গান গাওয়ার আরম্ভ করেছিলেন এবং একজন সঙ্গীতজ্ঞ এবং সুরকার হন। অন্যদিকে, কন্যা,মমতা শংকর নৃত্য ও অভিনয় শিখে , একজন বিখ্যাত অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী হয়ে ওঠেন। ১৯৪৮ সালে উদয় লিখেছিলেন, ‘কল্পনা’,তারই দ্বারা নির্মিত এবং পরিচালিত, ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র মূলত শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী প্রধান চরিত্রে। তার স্ত্রী প্রধান চরিত্রটি করেন। যদিও চলচ্চিত্রটি বক্স অফিসে ভাল না করলেও, এটি পরে অনেক সমালোচক ও চলচ্চিত্র প্রেমীদের দ্বারা স্বীকৃত এবং প্রশংসিত হয়, যা ২০০৯ সালে ডিজিটাল পুনঃস্থাপন করা হয়।

 
 
 
 
 
 

১৯৫৭ সালে ‘লর্ড বুদ্ধ’ রঙিন ছায়ানৃত্য সৃষ্টি করেন।

 

১৯৬৫ সালে কলকাতায় উদয়শংকর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন।

 

১৯৬৬ সালে সৃষ্টি করেন ‘প্রকৃতি আনন্দ’ নৃত্যনাট্য, এই নৃত্যনাট্যে তিনি বুদ্ধের ভূমিকায় নিজেকে তুলে ধরেন সকলের সামনে।

 

১৯৬৮ সালে জীবনের শেষবারের মতো আমেরিকা সফরে যান এবং ২৫শে নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এবং পরে সুস্থ হয়ে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। এরপর ১৯৭০ সালে তাঁর শেষ সৃষ্টি ‘শংকরস্কোপ’, যা রঞ্জিতমলের প্রযোজনায় তৈরি হয়েছিল। এর ঠিক ৭ বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৭ সালের ২৬ শে সেপ্টেম্বর তাঁর জীবনাবসান ঘটে।

 
 
 
 
 
 
 
 

তাঁর প্রাপ্ত বহু পুরস্কার তাঁর জীবনের শৈল্পিক সত্ত্বাকে সমৃদ্ধশালী করে তুলেছিল, সেগুলি হল-

 

১৯৬০ সালে, “সঙ্গীত নাটক একাডেমী পুরস্কার”, তিনি ‘ক্রিয়েটিভ ডানস’ সৃষ্টির জন্য এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার লাভ করেন।

 

১৯৬২ সালে, “সঙ্গীত নাটক একাডেমী ফেলোশিপ”,এটি ন্যাশনাল একাডেমী অব মিউজিক, নাচ ও ড্রামা কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ সম্মান। এই পুরস্কারটি তার জীবদ্দশায় কৃতিত্বের জন্য উদয়শঙ্করকে দেওয়া হয়।

 

১৯৭১ সালে, পদ্মবিভূষণ, ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার লাভ করেন।

 

১৯৭৫ সালে, দেসিকোটটাম পুরস্কার,বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মানে সম্মানিত।

 
 
 

উদয়-ইয়ুথ উৎসবঃ-

 

১৯৮৩ সালে, উদয়ের ছোট ভাই ও কিংবদন্তী পন্ডিত রবি শংকর নতুন দিল্লিতে একটি বড় উৎসব পালন করেন যা চার দিন ধরে চলে। অনুষ্ঠানটি “উদয়-ইয়ুথ উৎসব” নামে পরিচিত এবং অনেক বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী ও সঙ্গীতশিল্পীকে আকর্ষণ করে। উৎসবে উদয়শঙ্করের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন এবং অর্কেস্ট্রার সঙ্গীত প্রদর্শনী হয়, যা গঠিত করেন কিংবদন্তি সেতার পন্ডিত রবি শংকর নিজে।

 
 
 
 
 
 
 
 

উদয় শংকর নৃত্য উৎসবঃ-

 

২০০০ সাল থেকে শুরু হয় উদয় শংকরের নৃত্য উৎসব অনুষ্ঠান।প্রত্যেক বছর ৮ই ডিসেম্বর থেকে ৮দিন ব্যাপী চলে এই অনুষ্ঠান।দেশের বিভিন্ন ধরনের নৃত্য প্রদর্শিত হয় । প্রতিভাবান ও উদিয়মান শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন এই উৎসবে।আর দর্শক হিসাবে থাকেন দেশ বিদেশের বহু নামি গুণী শিল্পীগণ ও শৈল্পিক প্রিয় মানুষজন।

 
 
 
 
 
 
 

বাবাক আনভারির বিখ্যাত চলচ্চিত্র নিয়ে কথা তুললেন - রিয়া চক্রবর্তী

“একটা সময় ছিল যখন আমি খুব ভাবতাম…”

 

(‘2+2=5, Two plas two equals five’) নামের ছোট্ট একটা ছবি নিয়ে অল্প কিছু কথা) ।।

 
 
 
 
 
 
 
 

রিয়া চক্রবর্তী

 
 
 
 
 

“বন্দুকের নলের সামনে

 

মানুষকে হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করে ওরা।

 

কবরের সামনে নিয়ে গিয়ে গুলি করে ফেলে দেয়

 

আর পা দিয়ে

 

মাটি চাপা দিতে থাকে।

 

রাস্তার পাশের দেওয়ালগুলি

 

রক্তে ভিজে যায়

 

যেহেতু মানুষগুলি জবাব চেয়েছিল।”

 

 

 

‘ওরা’ কারা বলুন তো? মানচিত্রের কোন্ সীমান্তে থাকে ‘ওরা’? কেন মানুষকে এভাবে প্রশ্নের বিনিময়ে মৃত্যু ছুঁড়ে দেয়? প্রশ্নগুলোও কী সত্যি সত্যি কবরে চলে যায়, বুলেট বেঁধা মানুষগুলোর সাথে? হয়তো যায় না! যায় না হয়তো… যদি যেত, তাহলে এই লেখা লিখতে হতো না। বাবাক আনভারি-কেও এমন একটা ছ’মিনিট তিপ্পান্ন সেকেন্ডের ছবি বানাতে হতো না। ছবির নাম ‘2+2=5’

 

ক্ষমতার উগ্রতার যেমন কোনও দেশ হয় না, বিপ্লবেরও তেমন কোনও সীমাবদ্ধ ভাষা হয় না। এই ছবি তাই কোন্ দেশের কথা বলছে, সেটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ এটাই যে এ আমাদের বড্ড চেনা একটা ছবি। যখন আমরা প্রতিদিন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি, যখন গণতন্ত্র জেলে পচে মরছে, যখন মানুষের থেকেও বড় হয়ে ওঠে তার ধর্ম, তার দল, তখনই তো এইসব ছবির জন্ম হয়।

 

একটা ক্লাসরুমের মধ্যেই গোটা গল্পটা ধরে যায় তার বিশ্বব্যাপী ক্ষোভকে সঙ্গে নিয়ে। ক্লাস শুরুর আগে হেডস্যারের ভাষণ, নাকি নিদান ভেসে আসে জানি না, তবে জানি এই সুরে কারা যেন জাতির উদ্দেশ্যে থেকে থেকেই কথা বলে ওঠে রেডিও-র ওপার থেকে। বড় হতে হতে ক্রমে বুঝেছি এসব কথা কেবলই কথার কথা (কেবলই মিথ্যে কথা)। যাঁরা এসব কথার বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণসহ মুখ খোলে, তাঁরা সবাই একদিন হঠাৎ হারিয়ে যায়। আবার দিন ঘুরে আসে। ভাষণ শুরু হয়। মিডিয়া বিকোয়, মানুষ বিকোয়, সাধুর বেশে সঙ্ঘ বিকোয় আর বিকোয় ভয়। সব সময় নজর রাখছে কেউ আমার প্রতিদিনের চর্চায়। ‘ওরা’ ইতিহাসকে ভেঙে নতুন অবয়ব দিচ্ছে, ‘ওরা’ দেশের নতুন সংজ্ঞা দিচ্ছে, ‘ওরা’ মাটি খুঁড়ে আল্লা আর ঈশ্বরের মোরগ লড়াই দেখছে। আর অসংখ্য লাশ ভেসে যাচ্ছে বুকে প্রশ্নচিহ্ন বেঁধে। ছাত্রসমাজকে ‘ওরা’ ভয় পাচ্ছে। ‘ওরা’ ইউনিভার্সিটিতে ঢুঁ মেরে দেশদ্রোহী খুঁজছে। সাহিত্য, শিল্পের কণ্ঠরোধ করতে চাইছে। সারাদিন মিডিয়ায় চোখ রাখলে, কান পাতলে আপনি খুঁজে পাবেন বানানো গপ্পের অন্তহীন এপিসোড আর মগজধোলাইয়ের ঘন্টাখানেকের কোনো শো। আপনার ভাবনাকে ‘ওরা’ এভাবেই আফিমে চুবিয়ে রাখছে। ধনতেরাসে মগ্ন আপনি এতদিনে ভুলে গেছেন লক্ষ্মী আর কুবেরের অবস্থানগত পার্থক্য। ভুলেছেন জন্মদিনের পায়েস, ভুলেছেন আপ্রাণ নিজের ঐতিহ্যকে। অথচ এমন এক শিকড়হীন, অতীতবিহীন বর্তমানে দাঁড়িয়ে এতটুকুও কষ্ট হচ্ছে না আপনার, দম আটকে আসছে না একটুও। ‘খান’ বলতে আমির – শাহরুখ – সালমনকে পেরিয়ে ক’জন কাফিল খানকে মনে রেখেছে বলুন তো? কেন শিশুদের বাঁচানোর বিনিময়ে তাঁকে জেলে যেতে হয় – এ প্রশ্ন তুলেছেন ক’জন? ক’জন আমরা খোঁজ রেখেছি গুলি খাওয়া সৎ সাংবাদিক, কিংবা মাথা না-বিকোনো কোনও কবির, অথবা আন্তর্জাতিক সেমিনারে দেশের আসল অবস্থা তুলে ধরার অপরাধে বন্দি নব্বই শতাংশ দৈহিকভাবে পঙ্গু কোনও অধ্যাপকের? কেন এসব বলছি? কারণ আমরাও মানুষ থেকে ক্রমে তোতাপাখি হয়ে যাচ্ছি। দাঁড়ে বসে ঘাড় নেড়ে নেড়ে যোগ করছি দুইয়ের সাথে দুইকে। তারপর প্রবল উল্লাসে পাঁচকে খুঁজে পাচ্ছি আজীবন। কিন্তু বিশ্বাস করুন এরম যদি চলে তবে খুব নিকট কোনও ভবিষ্যতে আমাদের সন্ততিরা জানবেই না যে দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ করে চার পাওয়ার হক্ তাদের ছিল। কোথাও কোনও সূত্র ছিলো যা আপামর মানুষের জন্য খাটে। রাষ্ট্র ভেদে যার বদল ঘটে না। আসলে এই ছবি মনে করিয়ে দেয় হীরক রাজ্যের উদয়ন পণ্ডিতের পাঠশালাকে। ফুলকিগুলোকে ছত্রভঙ্গ করলেই যে বিপ্লব থামানো যায় না, তারা চুপিচুপি দাবানল বয়ে আনে, রাষ্ট্র এ কথা আমাদের ভোলাতে চাইছে সর্বক্ষণ। কিন্তু উদয়নরা যদি ভয় পায়, উদয়নদের বিবেক যদি বিকিয়ে যায় তবেই তৈরি হবে ‘2+2=5’-এর ফর্মুলা। আসলে এই ছোট্ট ছবির বিরাট গুমোটটা আপনার মনে কম্পাসের কাজ করবে। নিজে ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন আপনি এই প্রশ্নের সামনে এনে আপনাকে দাঁড় করাবে। এবং আপনি জানেন প্রতিবিম্বের দিকে আঙুল তুললে তা আসলে নিজের দিকেই তোলা হয়। তাই এই ছবি আপনাকে শান্তি দেবে না। পিছু ছাড়বে না। দেওয়ালের দিকে আরও ঠেলে দেবে, যাতে আপনি এবার অন্তত ঘুরে দাঁড়াতে শেখেন।

 

 

 

 

 

( লেখার শুরুতে ও শিরোনামে ব্যবহৃত পংক্তিগুলি তামিল কবি রুদ্রমূর্তি চেরান-এর লেখা। বাংলায় অনুবাদ করেছেন শৌভিক দে সরকার।)

 

 

 

 

 

(বাবাক আনভারি ইরানের চিত্র পরিচালক। ১৯৮২ তে তেহরানে তাঁর জন্ম। শর্ট ফিল্মের জন্য তিনি BAFTA পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলি হলো – ‘Under the Shadow’ , ‘Wounds’ । আমাদের আলোচ্য এই শর্ট ফিল্মটি তিনি ২০১১ সালে নির্মাণ করেন।)

 
 
 

লোকসংস্কৃতি ঠিক কোন্ সংস্কৃতি তত্ত্বতালাশ করেছেন- সৌগত চট্টোপাধ্যায়

লোকসংস্কৃতি ঠিক কোন্‌ সংস্কৃতি

 
 
 
 
 
 
 
 

সৌগত চট্টোপাধ্যায়

 
 
 

অধ্যাপকঃ বাংলা বিভাগঃ রামসদয় কলেজ

 

অতিথি অধ্যাপকঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

 
 
 

জাতীয়তাবোধ পৃথিবীর প্রায় সব দেশের লোকসংস্কৃতি চর্চার প্রথম পর্বে সক্রিয়

 

ছিল। এ কথা ঠিকই, কিন্তু নিছক স্বাজাত্যবোধের স্ফূরণই যে ‘লোকসংস্কৃতি চর্চা’

 

নয়, সে কথা বুঝতে আমাদের অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। ‘Folk’ বা ‘লোক’

 

বলতে গোটা আঠারো ও উনিশ শতকের বিশ্ব মূলত গ্রামীণ অশিক্ষিত বা কৃষিজীবী

 

মানুষকেই বুঝেছিলেন। ‘আদিবাসী সংস্কৃতি’ এবং ‘লোকসংস্কৃতি’ যে আলাদা, এমন

 

ধারণাও বিদ্যমান ছিল। ‘লোকসংস্কৃতি’ বলতে মূলত তারা বুঝতেন— শ্রেণি ভিত্তিক

 

গ্রামীণ অঞ্চলের সংহত সমাজে বসবাসকারী নিরক্ষর কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের

 

নৈর্বক্তিক পরিশীলিত মৌখিক ঐতিহ্যকে।

 

কাকে বলে ‘সংহত সমাজ’

 

এর উত্তর ছিল এইরকমঃ নির্দিষ্ট ঐতিহ্য বা সংস্কৃতিকে আশ্রয় করে যে

 

সমাজ ‘গোষ্ঠীবদ্ধ’। গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ তিনিই, যার হয়েছে ‘গোষ্ঠীচেতনা’। এই

 

চেতনা প্রকাশ পায়, নির্দিষ্ট যে গোষ্ঠীতে তার বাস, সেই গোষ্ঠীর অন্তর্গত

 

মানুষের সঙ্গে তাঁর দৈনন্দিন যাপনের অভিন্নতায়।

 

ঠিক এমনই গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের দেখা নাকি কিছুটা মিলেছিল কিছুটা উন্নততর

 

সমাজে এসে। সমাজ তখনও পুরোপুরি কৃষিভিত্তিক হয়নি। কিছু মানুষ শিকার, সংগ্রহ

 

ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে পশুপালনকেও তাদের জীবিকা করে নিয়েছিলেন। কেউ কেউ

 

কৃষিকে নির্ভর করেও নিজেদের জীবিকার সংস্থান করতে শুরু করেছিলেন। তুলনায়

 

অগ্রবর্তী এই স্তরের সংস্কৃতিই ‘আদিবাসী লোকসংস্কৃতি’ নামে পরিচিত।

 

আদিবাসীরা আদিম মানুষের উত্তরসূরী রূপে কথিত হয়। কিন্তু ডঃ মযহারুল ইসলাম

 

লিখেছেনঃ

 

দেশে দেশে বিভিন্ন সমাজ ও দল যখন একটি স্তর থেকে আরেকটি স্তরে উন্নীত

 

হয়েছে তখন উন্নয়নের পথে সে তার সঙ্গে এনেছে প্রত্যেক স্তরের সৃষ্টিকে। সেই

 

সৃষ্টি যেমন বস্তুগত তেমনই অ-বস্তুগত, যেমন সংস্কৃতিগত তেমনই সমাজগত। যুগ

 
 
 

ও সমাজস্তরের পরিবর্তনে তার সংস্কৃতিতে ফলত নেমে এসেছে রূপান্তর।

 

ফোকলোরের মধ্যে এ সৃষ্টিকর্ম বস্তুতে ও ভাবে, শিল্পে ও সাহিত্যে, আচারে ও

 

বিশ্বাসে, উৎসবে ও সংস্কারে নানাভাবে রূপায়িত। একদিক থেকে দেখতে গেলে তাই

 

ফোক তারাও যারা সুদূর আদিম কালে সংস্কৃতির বীজ বপন করেছিলেন ১ , যদিও

 

আদিম মানুষ ‘ফোক’ নন। কারণ আদিম কালে ‘গোষ্ঠী’ সেভাবে প্রকট হয়নি।

 

লোকসংস্কৃতি কিন্তু ‘গোষ্ঠীকেন্দ্রিক’ সংস্কৃতি।

 

Primitive Lore হয়, কিন্তু Primitive Folklore হয় না।

 

তাহলে ‘Folklore’ বলতে আমরা ঠিক কী বুঝবো?

 

উনিশ শতক পর্যন্ত লোকসংস্কৃতিবিদদের ধারণা ছিল নিম্নবিত্ত গ্রামীণ

 

পরিবেশের কৃষিজীবী মানুষরাই শুধু ‘লোক’, তাদের সংস্কৃতিই ‘লোকসংস্কৃতি’। এই

 

ধারণা বলবৎ ছিল , যখন ফোকলোর ‘Popular Antiquity’ এবং ‘Popular

 

Literature’ নামে পরিচিত ছিল তখন থেকেই। তারপর বিশ শতকের তিনের দশক

 

পর্যন্ত সেই ধারণা পুরোদস্তুর বিদ্যমানও ছিল। রাশিয়ার বস্তুবাদী তাত্ত্বিকদের

 

হস্তক্ষেপেই প্রথম শোনা গেল লোকসংস্কৃতি ‘শ্রমজীবী’ মানুষেরও সংস্কৃতি।

 

তারপর আমেরিকার প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতিবিদ অ্যালান ডান্ডেস স্পষ্ট ঘোষণা

 

করলেন—

 

‘লোক’ হল একটি গোষ্ঠী বা বর্গের অন্তর্গত একজন সদস্য, যার থাকবে একটি

 

নির্দিষ্ট ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি, যাকে তিনি একান্ত ‘নিজেদের’ বলে মানবেন। এই

 

ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি যেমন পরম্পরা সূত্রে প্রাপ্ত হতে পারে, তেমনই হতে পারে

 

বড়ো আকারের একটি জাতিও। কিন্তু তারা নিশ্চয় জানবেন তাদের ঐতিহ্যের মূল

 

সূত্রগুলি। তাতেই তৈরি হবে তাদের গোষ্ঠীচেতনার ভিত্তি। ২

 

একটি বড়ো গোষ্ঠীতে আবার নানান উপবর্গও থাকতে পারে এবং থাকেও। যেমনঃ

 

বাঙালি জাতির ফোকলোরে কৃষক যেমন আছেন, তেমনই আছেন মজুর ও কারিগরেরা।

 

কিংবা আরো কেউ কেউ। এরা আবার হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান ভেদে পৃথক। নিশ্চয়ই

 

সকলের ফোকলোর এক নয়। তবে তাদের সকলের মাতৃভাষা যে বাংলা তা বলাই

 

বাহুল্য। কিন্তু তা বলে কি সকলে একই রকম বাংলা ভাষায় কথা বলেন? নিশ্চয় তা

 

নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বাঙালি আর পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের

 

বাঙালির মাতৃভাষা নিশ্চয়ই একরকম নয়। তাই যখন বলা হয় লোকসংস্কৃতি সংহত

 

জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, তখন ‘সংহত’ শব্দটিতে আপত্তি ওঠে, উঠতে পারে। পারে

 

এইজন্য— একই গোষ্ঠীর অন্তর্গত হওয়া সত্ত্বেও ধর্ম-ভাষা-পেশা ইত্যাদির

 
 
 

নিরিখে তাদের মধ্যে বিভেদ যথেষ্ট। তবে প্রত্যেক স্বতন্ত্র গোষ্ঠীর মানুষই

 

স্বতন্ত্রভাবে ‘ফোক’ এবং এইরকম প্রত্যেক গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বাঙালি

 

জাতির সংস্কৃতি ‘বাঙালি ফোকলোর’ -এর অন্তর্গত সন্দেহ নেই।

 

এখন কথা হল, ‘গোষ্ঠীভিত্তিক’ এই যে সংস্কৃতি তাতে কি ব্যক্তির কোনো স্থান

 

নেই? অবশ্যই আছে। ছড়া-প্রবাদের স্রষ্টা তো কোনো না কোনো একজন ‘ব্যক্তি’।

 

লোকশিল্পের কারিগর তো কোনো না কোনো একজন ‘মানুষ’। কিন্তু কথা হল,

 

‘ব্যক্তি’ থাকলেও তিনি ডুবে যান ‘দল’এ। সমষ্টির সৃষ্টি বলেই আসে

 

লোকসংস্কৃতির মান্যতা।

 

গোষ্ঠীবদ্ধতা লোকসংস্কৃতির সবচেয়ে বড়ো সূচক। তার সৃষ্টি গ্রামে না নগরে, তা

 

পরিশীলিত না অপরিশীলিত, লিখিত না মৌখিক, পরম্পরাবাহিত না একান্ত

 

সাম্প্রতিক, — এসব প্রশ্ন অবান্তর। ‘গ্রামীণ’ বা ‘নাগরিক’ যে কোনো লোকেই যে-

 

কোনো সময়ে ‘ফোক’। যেহেতু পেশা-ভাষা-ধর্ম ইত্যাদির ভিত্তিতে আমরা সবসময়ই

 

কোনো না কোনো গোষ্ঠীতে বিচরণ করি। তাই আজ আর স্বতন্ত্রভাবে কোনো

 

‘লোকসমাজ’ এর কল্পনা করা যায় না। ‘লোকসমাজ’ থাকলে একটি ‘অ-লোকসমাজ’ও

 

আছে ধরে নিতে হবে। দুটি সমাজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব কি বাস্তবে দেখানো সম্ভব?

 

আবার একই ব্যক্তির একাধিক গোষ্ঠীতে বিচরণ করার ঘটনাও সমানভাবে সত্য।

 

যেমনঃ একজন ছৌ মুখোশ নির্মাতা একই সঙ্গে ‘সাঁওতাল’ এবং ‘কারিগর’ — দুটি

 

গোষ্ঠীর অন্তর্গত। ‘Non Folk’ বা অ-লোক বলে তাই কেউ নেই। তবে ‘Non

 

Folklore’ অবশ্যই আছে। কারণ আমরা সকলে কোনো না কোনো অর্থে ফোক বলে

 

গণ্য হলেও আমাদের অভিব্যক্তি (Expression) মাত্রেই ফোকলোর হয়ে যায় না।

 

অবশ্যই সেই অভিব্যক্তিতে আসতে হবে ‘যে গোষ্ঠীতে আমার বাস’ অথবা ‘যে

 

গোষ্ঠীর হয়ে তা রচিত’ তার স্বীকৃতি। Ben Amos বিশ শতকে ‘লোকসংস্কৃতির’ নতুন

 

সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বললেন, তা গোষ্ঠীর অন্তর্গত শিল্পিত সংযোগ অথবা

 

গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সংযোগ প্রক্রিয়া। ৩

 

গোষ্ঠীকেন্দ্রিক এই সংস্কৃতিকে অবশ্যই বিচার করতে হবে গোষ্ঠী বিশেষের

 

সামাজিক অবস্থান ‘Context’ ভিত্তিতে। সেই ‘Texture’, বা যে শৈলীতে ওই

 

নির্দিষ্ট সংস্কৃতিটি গড়ে উঠেছে তার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ‘Context’ ছাড়া এইসব

 

বিচার করাই অর্থহীন। নির্দিষ্ট কোনো লোককথার তাৎপর্য ঠিকঠাক বোঝা যাবে

 

না, যে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীতে তার উদ্ভব, সেখানে উপস্থিত না হলে। ‘গম্ভীরা’

 

বোঝা যাবে না তার পরিবেশে গিয়ে উপনীত না হলে। ‘Context’ ছাড়া ‘Text’ এবং

 

‘Texture’- এর কোনো মূল্যই নেই। লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্যের বিচার-

 
 
 

বিশ্লেষণে তাই ‘Contextual Methodology’ বা ‘পরিবেশ প্রসঙ্গ বিচার পদ্ধতি’র

 

আজ এতো গুরুত্ব! পরবর্তীকালে অবশ্য এই পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো

 

একটি ধারণা, যার নাম— ‘অভিকরণতত্ত্ব’। এতে বলা হচ্ছে,— যে ‘Context’-কে

 

আমরা এত গুরুত্ব দিচ্ছি, সেই ‘Context’ বা পরিস্থিতিও তো নিয়ত পরিবর্তনশীল।

 

ফলে বদলে যেতে পারে ‘Text’ এবং ‘Texture’ ও। বারংবার ‘পর্যবেক্ষণ’ তাই জরুরি।

 

লোকসংস্কৃতির আজ স্পষ্ট তিনটি পরিসর— ‘আদিবাসী লোকসংস্কৃতি’ (

 

Tribal Folklore ), ‘গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি’ ( Rural Folklore ) এবং ‘নাগরিক

 

লোকসংস্কৃতি’ ( Urban Folklore )। দীর্ঘকাল অবধি আমরা ‘লোকসংস্কৃতি’ বলতে

 

‘আদিবাসী’ এবং ‘গ্রামীণ’ লোকসংস্কৃতিকেই বুঝে এসেছি, ‘নাগরিক লোকসংস্কৃতির’

 

চর্চা শুরু হল এবং ক্রমশ বাড়লো বিশ শতকের ছয়-সাত দশকে এসে। ডঃ সৌমেন সেন

 

লিখেছেনঃ

 

ওই সময় থেকে, বিশেষত পাশ্চাত্যে, শিল্পাঞ্চলে, আবাসন এলাকায়, হাটে-

 

বাজারে এমনকি শিল্প মহল, বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বর ইত্যাদি বলয়ে যে নতুন-নতুন

 

কিংবদন্তি, রঙ্গকথা, ছড়া-প্রবাদ, বাগধারা ইত্যাদি তৈরি হল এবং কীভাবে

 

গণমাধ্যম – পর্যটন শিল্প – বিজ্ঞাপন ইত্যাদিতে লোকসংস্কৃতির প্রয়োগ ঘটলো,

 

সে-সব বিষয়ে চর্চা ক্রমশ বিস্তৃত হল। যিনি এই বক্তব্যে সবচেয়ে এগিয়ে গেলেন

 

তিনি জার্মানের লোকসংস্কৃতিবিদ হার্মান বসিংগার। তিনি ঘোষণা করলেন,

 

প্রযুক্তির জগৎ এবং লোকসংস্কৃতির জগতের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। তিনি

 

হারিয়ে যাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার তত্ত্ব বাতিল করে সম্প্রসারণের কথা বললেন।

 

আমেরিকায় উদ্ভূত হল ‘পাবলিক ফোকলোর’-এর ধারণাও। ৪

 

ইতিপূর্বে ১৯৬২ সালে জার্মান লোকসংস্কৃতিবিদ হ্যান্স মোজার প্রস্তাব

 

করেছিলেন ‘Folklorism’ তত্ত্বটি। তারও আগে রাশিয়ায় প্রস্তাবিত হয়েছিল

 

‘Folklorism’ -এর ধারণা। এসব ধারণা বা তত্ত্ব ঘোষণা করেছে লোকসংস্কৃতি

 

পাল্টাচ্ছে অহরহ। কোনটা আসল কোনটা নকল— এসব প্রশ্ন না তুলে বরং আজ

 

সেই পরিবর্তিত ঐতিহ্যকে বিচার করা জরুরি। ‘ফোকলরিজম’ -এর তত্ত্ব সেই

 

ধারণা বা উপলব্ধিরই লব্ধ ফল। কোনো সংস্কৃতিরই ঘাঁটি বা বিশুদ্ধ রূপ বলে কি

 

সত্যি কিছু হয়? রেজিনা বেনডিক্সের লেখা ‘In Search of Authenticity: The

 

Formation of Folklore Studies’ বইটি এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ

 

বলে আমি মনে করি।

 
 
 

লোকসংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে তাই আতঙ্কের কিছু নেই। যুগে যুগে তার স্বরূপ

 

বদলেছে, বদলেছে তার সংজ্ঞাও। ভবিষ্যতেও বদলাবে। কোনো সংস্কৃতিই স্থবির

 

নয়। ইতিহাস যেমন ‘অতীতের প্রবাহমাত্র নয়, ধারাবাহিকও নয়’, দেশকালের

 

সীমাহীনতায় তার নানা ছেদ, তেমনিই ‘সংস্কৃতিও’ সময়ের নির্মাণ। সময় বদলানোর

 

সঙ্গে সঙ্গে তার রূপান্তর স্বাভাবিক। তবু তারও মধ্যে কিছু থেকে যায় যা

 

সংস্কৃতির ‘মৌলিক’ চরিত্র। একটি লোককথা যতই না কেন পরিবর্তিত হোক, তার

 

মৌলিক চরিত্রের কিন্তু কোনোই পরিবর্তন হয় না। লোকসংস্কৃতির চর্চার

 

ক্ষেত্রে এই কথাটি মনে রাখতে হবে।

 

সূত্রপঞ্জিঃ

 

১। মযহারুল ইসলাম, ‘ফোকলোর পরিচিতি ও পঠন-পাঠন’, বাংলা একাডেমি, ঢাকা,

 

১৯৮৩, পৃঃ ৮৮।

 

২। Dundes, Alan, ‘Interpreting Folklore’, Bloomington: Indiana University

 

Press, 1980, P: 6-7.

 

৩। Ben-Amos, Dan, ‘Toward a Definition of Folklore in Context’, Journal

 

of American Folklore 84, 1971, P: 17.

 

৪। সৌমেন সেন, ‘লোকসংস্কৃতি তত্ত্ব-পদ্ধতি’, অঞ্জলি পাবলিশার্স, কলকাতা,

 

২০১২, পৃঃ ৮০ দ্রষ্টব্য।

অভিনয়-অভিনেতা আর দর্শকের দূরত্ব ঘোচানোর কাজ চালিয়েছিলেন বাদল সরকার ' - শান্তনু সরকার

বাদল সরকার ও তাঁর ‘থার্ড থিয়েটার’: কিছু প্রাথমিক কথা।

 
 
 
 
 
 
 
 

শান্তনু সরকার

 
 
 

শুরুতেই জানিয়ে রাখি, এ লেখা বাদল সরকার সম্পর্কে কোনো গভীর আলোচনা নয়।

 

তাঁর কাজের রূপরেখা নতুনদের কাছে উপস্থাপন মাত্র।

 

যে তথ্যগুলো সাধারণত সকলেই জানে তবুও যা দিয়ে একটা লেখা শুরু করা দস্তুর

 

সেগুলো প্রথমে বলে নেওয়া যাক। বাদল সরকারের জন্ম ১৯২৫ সালে। পিতৃপ্রদত্ত

 

নাম সুধীন্দ্রনাথ সরকার। তিনি ছোটবেলা থেকেই নানাভাবে নাটক চর্চার সঙ্গে

 

যুক্ত ছিলেন। সেই সূত্রে ছোট নাটিকা রচনা করলেও সে অর্থে তাঁর প্রথম নাটক

 

হিসেবে ‘সলিউশন এক্স’ কেই বলা উচিৎ। তাঁর নিজের কথায়-‘একটা হাসির ছবি

 

দেখেছিলাম, নাম ‘মাঙ্কি বিজিনেস’… সেটাই সম্বল করে লিখে ফেললাম ‘সলিউশন

 

এক্স’, বলা চলে এইটাই আমার প্রথম নাটক। সিন্ডারেলা, শিবরামের গল্প,

 

বিরিঞ্চিবাবা, আগুন — এগুলোকে ধরছি না। সেটা ১৯৫৬ সাল।’

 

‘থার্ড থিয়েটার’ ভাবনায় পৌঁছোবার আগে প্রথমে তাঁর রচিত মঞ্চ নাটক নিয়ে একটি

 

সংক্ষিপ্ত খতিয়ান নেওয়া যেতে পারে। ‘সলিউশন এক্স’ এর পরে তাঁর রচিত দ্বিতীয়

 

নাটক ‘বড়ো পিসিমা’ ১৯৫৯ এ লেখা যার প্রযোজনা হয় নিজেদেরই সংস্থা ‘চক্র’র

 

মাধ্যমে ১৯৬০ সালে। এরপর ১৯৬৩ অবধি একের পর এক লিখে চলেছেন—

 

‘শনিবার’, ‘রাম শ্যাম যদু’, ‘সমাবৃত্ত’ (তাঁর একমাত্র ক্রাইম নাটক যা ছাপা হয়নি)

 

‘এবং ইন্দ্রজিৎ’, ‘সারারাত্তির’ প্রভৃতি নাটক। ১৯৬৫ সালে লিখলেন ‘বাকি

 

ইতিহাস’, তখন কলকাতাতে ‘শৌভিক’ প্রযোজনা করছে ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’, যে

 

প্রযোজনা তাঁর ভালো লাগেনি। সে সময় তিনি লিখেছিলেন ‘ বাঘ’ নামে একটি নাটক। এ

 

সময়ে কর্মসূত্রে তিনি ছিলেন নাইজেরিয়া। সেখানে থাকাকালীন তাঁর শেষ লেখা নাটক

 

‘পাগলা ঘোড়া’, যার ‘মঞ্চ-সফল’ প্রযোজনা করেছিল ‘বহুরূপী’। ‘বহুরূপী’র হয়ে তিনি

 

তাঁর লেখা নাটক ‘প্রলাপ’এর নির্দেশনাও দিয়েছিলেন, যদিও মাত্র একটি

 

প্রযোজনাই হয়েছিল এ নাটকের।

 

পরবর্তীতে তিনি প্রয়োজন অনুভব করলেন নিজস্ব নাটকের দলের, তৈরি হল

 

‘শতাব্দী’, নিজেদের নাট্য দল। ‘শতাব্দী’র প্রথম অভিনয় যদিও ১৯৬৮ সালে ২৩শে

 

জানুয়ারি ফারাক্কাতে। নাটক ‘কবি কাহিনী’। এরপর ‘শতাব্দী’র পক্ষ থেকে ১৯৭২

 

পর্যন্ত একের পর এক নাটক লিখে গেছেন যার মধ্যে বেশ কিছু আবার ‘মঞ্চ-সফল’

 
 
 

নাটক। ১৯৭২ এ গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা ‘আবু হোসেন’ এর এক ভিন্ন নাট্যরূপ যা

 

নিয়েছিলেন প্রসেনিয়াম মঞ্চের বাইরে প্রথম ‘নিরীক্ষা- নাটকের’ অভিনয়ের জন্য।

 

সত্ত্বেও প্রসেনিয়াম মঞ্চ থেকে এ সময়ে বেরিয়ে আসে ‘শতাব্দী’।

 

এরপর ‘শতাব্দী’র জন্য মঞ্চ নাটক হিসেবেই গৌরকিশোর ঘোষের গল্প

 

অবলম্বনে ‘সাগিনা মাহাতো’র কথা ভাবেন, কিন্তু পরে বদল করে তিনি এটিকে বেছে

 

নিয়েছিলেন প্রসেনিয়াম মঞ্চের বাইরে প্রথম ‘নিরীক্ষা- না’ অভিনয়ের জন্য।

 

এ তো গেল বাদল সরকারের মঞ্চ নাটক থেকে ‘থার্ড থিয়েটার’-এর সংক্ষিপ্ত

 

গতিপথ। এবার তাঁর এই ‘থার্ড থিয়েটার’-এর সম্পর্কে সংক্ষেপে

 

হঠাৎ কেন এই সরে আসা, কেনই বা তিনি এই নতুন ধারার প্রয়োজন অনুভব

 

করলেন? ‘থার্ড’ বা তৃতীয় যখন বলা হচ্ছে তা নিশ্চয়ই ‘ফার্স্ট’, ‘সেকেন্ড’ বা

 

প্রথম, দ্বিতীয় থিয়েটার বলে তাঁর মতে কিছু আছে, সেগুলি তবে কী, এ বিষয়ে

 

সংক্ষেপে তাঁর ভাবনা কিছু লেখা যাক।

 

প্রথমটি অর্থাৎ ‘ফার্স্ট’ থিয়েটার, তাঁর মতে দেশজ লোকনাট্য, অর্থাৎ

 

ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে লোকনাট্যের যে বিভিন্ন রূপ প্রচলিত আছে সেগুলি।

 

উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করছেন, উত্তরপ্রদেশে ‘নৌটঙ্কি’,কর্ণাটকে

 

‘যক্ষগান’, তামিলনাড়ুতে ‘থেরুকুটু’ প্রভৃতি ছাড়াও মহারাষ্ট্র, গুজরাট, কেরালায়

 

টিকে থাকা নানা লোকনাট্য'র কথা। তাঁর মতে বহুদিন ধরে প্রচলিত এই লোকনাট্যের

 

ধারাগুলো প্রবল জনপ্রিয় হলেও যে বিষয়বস্তু নিয়ে অভিনীত হয়ে চলেছে, তা মূলত

 

পরিত্যাজ্য।

 

লোকনাট্য আজও গ্রামাঞ্চলে জনপ্রিয়, কিন্তু সে লোকনাট্যের বিষয়বস্তু

 

প্রধানত পিছিয়ে থাকা অথবা প্রতিক্রিয়াশীল মূল্যবোধে ভারাক্রান্ত। দেবদেবীর

 

অতিলৌকিকতা অথবা রাজারাজড়ার উপাখ্যান সেখানে। অর্থাৎ এ জীবনে না

 

খেতে পাওয়া বা ক্ষমতাশালী’র অত্যাচার সহ্য করা- সবই ঈশ্বরের লীলা বা

 

পূর্বজন্মের কর্মফল বলে ধরে নিয়ে সহ্য কর, পরলোকে বা পরজন্মে মুক্তি আছে।

 

এই লোকনাটক গুলিতে ‘রাজা’ বা শাসক সমপর্কে যে ভাবনা প্রোথিত করা হয়েছে, তা

 

অনেকটা এরকম- রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি, রাজভক্তি পরমধর্ম, সুতরাং রাজা

 

খারাপ হলে একমাত্র পথ হল ভালো রাজা আনা। সেই কাজটাও ঈশ্বর করবেন,

 

প্রজাদের কিছু করবার নেই। এছাড়া সতীসাধ্বী স্ত্রী ও সর্বংসহা মাতার

 

উজ্জ্বল চিত্র এঁকে এ দেশের মেয়েদের প্রকৃত অবস্থা অর্থাৎ, পুরুষপদানত,

 

বাধ্যতামূলক নিকৃষ্ট যাপন, গৃহবন্দীত্ব, সামাজিক ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক

 
 
 

নিষ্ক্রিয় অবস্থান গুলিকে অনেক সময়েই সুন্দর মোড়কে ঢেকে রাখা হয় এ

 

নাটকগুলোতে।

 

অর্থাৎ মূলত দার্শনিকভাবে প্রগতি বিরোধী বা সাধারণ ব্যাপক মানুষের স্বার্থের

 

পক্ষে এই নাটক অবস্থান নেওয়ার বদলে বিষয়গতভাবে টিকে থাকা সমাজ

 

ব্যবস্থার বা ক্ষমতাসীনের পক্ষে এই নাটক অবস্থান নিচ্ছে বলে তিনি এই

 

নাট্যরূপ বা লোকনাটককে বা এর বিষয়বস্তুকে ‘ফার্স্ট’ বা প্রথম ধারার নাটক

 

বলছেন। যে ধারা থেকে তাঁর মতে সরে আসাই কাম্য।

 

‘দ্বিতীয়’ ধারার নাটক বলতে তিনি বোঝাচ্ছেন ঔপনিবেশিকতা সূত্রে

 

প্রাপ্ত নাট্য ধারাকে। যে ধারা মূলত শহরের মধ্যবিত্ত দ্বারা পরিপুষ্ট। তাঁর মতে

 

সেই ধারাটিও পরিত্যাজ্য। তিনি আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে, গ্রামের

 

লোকনাট্য’র তুলনায় শহরের থিয়েটারের বিষয়বস্তু ভিন্ন ভাবে নির্মিত হয়েছে।

 

সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীরা ও অন্যান্য সুবিধাভোগীরা

 

শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিল। তাদের পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই ক্রমে জমির আয় ও

 

অন্যান্য এই ধরণের আয় থেকে বঞ্চিত হয়ে সম্পূর্ণভাবে চাকরির ওপর

 

নির্ভরশীল, এক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্ম দিয়েছে এবং সেই শ্রেণীকে পুষ্ট

 

করেছে। কখনো সে মধ্যবিত্ত ক্রমে নিম্নবিত্ত হয়েছে। পরবর্তীতে নিজেদের

 

মুক্তির প্রয়োজনই সংগ্রামের পথে তাদের নিয়ে গেছে। এ সময়ে এসে শ্রমিক-

 

কৃষকের সংগ্রামের সঙ্গে এখন আর তাদের স্বার্থগত বিরোধ নেই। সেই কারণে এই

 

শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে প্রগতিশীল মূল্যবোধ ও ভাবধারার প্রকাশ

 

ঘটেছে। কিন্তু তাসত্ত্বেও এই প্রতিযোগিতামূলক সমাজ ব্যবস্থায় মধ্যবিত্তের

 

একান্ত চেষ্টা থেকেছে সর্বদাই নিজেকে আর এক ধাপ উপরে তোলার। এই ক্ষুদ্র

 

স্বার্থ তাকে বৃহত্তর স্বার্থ সম্বন্ধে অন্ধকারে রাখে, তাই সমাজের আমূল

 

পরিবর্তন ঘটিয়ে সামগ্রিক মুক্তির পথে না গিয়ে সে অন্যকে ডিঙিয়ে একা একা

 

উপরে উঠবার চেষ্টায় ব্যাপৃত হয়। ফলে শহরের থিয়েটারে প্রগতিশীল ভাবধারার

 

প্রকাশ যতই হোক, মধ্যবিত্ত দর্শকের মনে বড়োজোর একটা মানসিক উত্তেজনা

 

ওঠে, বিবেকের তুষ্টি ঘটে,সমাজপরিবর্তনে বিশেষ কোন সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে

 

না মধ্যবিত্ত। ফলে, দার্শনিক বোধের জায়গা থেকেই তিনি একটি বিকল্প

 

থিয়েটারের রূপের কথা ভেবেছিলেন, যা এই দুটির কোনটিই নয়। এখান থেকেই তাঁর

 

‘থার্ড থিয়েটার’ এর ভাবনা।

 

‘থার্ড থিয়েটার’ এই নামটি যদিও আমরা পৃথিবীর অন্যত্র থিয়েটার চর্চায় এর

 

আগেই ব্যবহৃত হতে দেখেছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থিয়েটারের প্রেক্ষিতে ‘রবার্ট

 
 
 

ব্রুস্টাইন’ বিশ শতকের ছয়ের দশকের মাঝামাঝি এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছেন।

 

ব্রুস্টাইন এর মতে, তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত থিয়েটারের মধ্যে

 

মূলত দুটি ধারার প্রাধান্য ছিল। একটি ধারা হল ‘excessive lightness’, যেটাকে তিনি

 

কোনোরকমভাবে গভীরতাহীন মূলত ফূর্তির জন্য রচিত কমেডির ধারাকে

 

বোঝাচ্ছেন। আরেকটি ধারা তাঁর মতে ‘excessive heaviness’, অর্থাৎ যে থিয়েটার

 

মূলত বুদ্ধিজীবীদের জন্য। গম্ভীর বা দার্শনিক নাটক। তাঁর মতে এই দুটি ছাড়াও

 

দুর্বল ভাবে হলেও তৃতীয় একটি ধারা ছিল। যাকে তিনি বলছেন-‘থার্ড থিয়েটার’।

 

‘fortunately, America has a third theatre, supported primarily by the

 

young, which combines the youthful properties of intensity, exuberance

 

and engagement’

 

উল্লেখ্য তিনি সেখানে তৎকালীন সময়ের এই ধারা বোঝাতে জুলিয়েন বেক ও জুডিথ

 

ম্যালিনা’র থিয়েটার কে বোঝাচ্ছেন।

 

এছাড়াও ‘থার্ড থিয়েটার’ শব্দটি পাচ্ছি Eugenio Barba র লেখাতে। তাঁর কাছে 1 st

 

Theatre — ‘the commercial and subsidized theatre’,

 

2 nd Theatre — ‘the established avant garde theatre’,

 

3rd Theatre — যা ,মানুষের জীবনের সারসত্যকে উপলব্ধির মধ্য দিয়ে দর্শকের

 

মধ্যে প্রোথিত করে দিতে চায়।

 

বাদল সরকার প্রস্তাবিত ‘থার্ড থিয়েটারে’ অবশ্য এর থেকে আলাদা। যদিও উক্ত

 

দুটি ধারার সঙ্গেই তাঁর সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল।

 

এছাড়া পোল্যান্ডে গিয়ে তিনি Growtoski র, ‘Towards a poor theatre’ দেখেন।

 

তাঁর Theatre laboratory তে গিয়ে প্রযোজনা দেখেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলে থিয়েটার

 

বিষয়ে উদ্দীপিতও হন। গ্রতস্কি ছাড়াও তিনি জুলিয়েন বেকের পাঠানো ‘Life of the

 

Theatre’ দ্বারা প্রভাবিত হন। তিনি শেখনার দম্পতির আমন্ত্রণে ‘দি

 

পারফরমেন্স গ্রুপ’ এর কাজ দেখতে আমেরিকা ও কানাডাতে তাঁদের ‘ওয়ার্কশপ’

 

পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হন।

 

বিশ্ব থিয়েটারের নানা নিরীক্ষা মূলক ধারার সঙ্গে তাঁর পরিচয় থাকলেও, তাঁর

 

প্রস্তাবিত ‘থার্ড থিয়েটার’ এগুলির থেকে অনেক জায়গাতেই আলাদা। তাঁর মতে

 

একটি বিশেষ সময়ে, বিশেষ অবস্থায় একটি বিকল্প থিয়েটারের প্রয়োজন হচ্ছে

 
 
 

এমন কিছু ব্যক্তির যারা টিকে থাকা লোকনাট্য বা প্রচলিত থিয়েটার মাধ্যমগুলির

 

মধ্যে দিয়ে নিজেদের কথাটা সময় অনুসারীভাবে বলতে পারছে না।

 

তিনি এই থিয়েটারের রূপকে শুধু একটি নতুন ধরনের নাট্যশৈলী হিসেবে দেখতে

 

চাইছেন না। তাঁর ভাবনা অনুযায়ী, থিয়েটারের প্রাথমিক উৎস ও ভিত্তি হল কিছু

 

মতাদর্শগত অবস্থান। যেমন কী বলতে চাই, কেন বলতে চাই, কাকে বলতে চাইছি

 

এসব প্রশ্ন। ফলে বোঝাই যাচ্ছে এই থিয়েটার আসলে একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির

 

প্রকাশ, একটি দর্শন, একটি আন্দোলন। তাঁর ভাবনায়-‘এই থিয়েটার গবেষণাগারে

 

প্রসূত একটি অভিনব নাট্যশৈলী নয়, পথে -ঘাটে পরীক্ষিত, যুগের ও সমাজের

 

প্রয়োজনে গড়ে ওঠা এক বিস্তীর্ণ আন্দোলন এই নাটকের ভিত্তি…… নাট্যশিল্প

 

বিক্রি করে যাদের খেতে হয় অথবা বিক্রি করে যারা সমৃদ্ধ হতে চায়, তাদের জন্য

 

এ থিয়েটার নয়, ‘Art for Art sake’ দের জন্যও এ থিয়েটার নয়। যে কোনো শিল্পই

 

কোনো না কোনো মতাদর্শের পক্ষে দাঁড়ায়’।

 

এই থিয়েটারের রূপ আলোচনা করতে গিয়ে তিনি প্রধান তিনটি বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত

 

করেন,

 

১.‘ফ্লেক্সিবল’ বা নমনীয়তা, অর্থাৎ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন অবস্থায় এ

 

থিয়েটার করা যাবে।

 

২. ‘পোর্টেবল’ বা সহজে বহনক্ষম, অর্থাৎ এই থিয়েটার নিয়ে সহজেই এক জায়গা

 

থেকে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া যায়। অর্থাৎ দর্শককে মঞ্চে এসে অভিনয় দেখতে

 

হবে এমন কোনো কথা নেই, প্রয়োজনে থিয়েটারকেই দর্শকের কাছে যেতে হবে।

 

‘ইনেক্সপেন্সিভ’ অর্থাৎ সুলভ বা কম খরচ সাপেক্ষ। অর্থাৎ এই থিয়েটার টাকার

 

ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল নয়। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা’র বিনিময় এর উপর

 

দর্শকের এই থিয়েটার দেখতে পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করবে না।

 

এই বৈশিষ্টগুলি ছাড়াও তিনি এই থিয়েটারের রূপ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে

 

‘রিচুয়াল’ এর প্রসঙ্গ আনেন। আদিম ‘রিচুয়াল’ গুলিই যে বর্তমান নাটকের আদিরূপ

 

এ বিষয়টি সাধারণভাবে গৃহীত। প্রসঙ্গক্রমে তিনি থিয়েটারের সঙ্গে রিচুয়াল এর

 

ঘনিষ্ট সম্পর্কের কথা বলেন। তবে তিনি যে রিচুয়ালের কথা বলেছেন সেটি কোনো

 

অলৌকিকতায় বিশ্বাসী গোষ্ঠীর সংস্কারজাত রিচুয়াল নয়। অলৌকিকতা বাদ দিয়েও

 

রিচুয়ালের অন্যতম দুটি অঙ্গ হল উদ্দেশ্য প্রণোদিত ক্রিয়া এবং অভিনেতা ও

 
 
 

দর্শকের যৌথ অংশগ্রহণ। তিনি রিচুয়াল এর এ দুটি অঙ্গকে ‘থার্ড থিয়েটার’এ

 

গ্রহণ করার কথা বলেছেন।

 

নাটককে দর্শকের কাছে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি আবার দুটি রূপের উল্লেখ

 

করেছেন। যখন বন্ধ ঘরে নির্দিষ্ট সংখ্যক দর্শকের সামনে অভিনয় হচ্ছে তখন

 

তিনি এটিকে বলছেন ‘অঙ্গনমঞ্চ’। অর্থাৎ থিয়েটার যেখানে প্রসেনিয়ামের চালু

 

মঞ্চ ছেড়ে অঙ্গনে নেমে আসছে। যেখানে দর্শক এবং অভিনেতার অবস্থান একই

 

তলে। যেখানে অভিনেতারা দর্শকের তুলনায় ভিন্ন তলে বা উপরে অবস্থান করছে না।

 

যেখানে অভিনেতা এবং দর্শকের অভ্যস্ত দূরত্বটাকে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে তলের

 

ভিন্নতাকে ভেঙে দিয়ে। আরেকটি রূপকে তিনি বলছেন ‘মুক্তমঞ্চ’ যেখানে খোলা

 

জায়গায় অভিনয় হচ্ছে, যেখানে দর্শক সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়। একশ বা এক হাজার যা

 

খুশি হতে পারে। থিয়েটার সেখানে মঞ্চের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেয়েছে।

 

এই ধরণের নাটকের ভাষা কি হবে তা নিয়েও তিনি দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। শুধু

 

চর্চাই নয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দর্শক-অভিনেতার সংযোগ স্থাপনে নতুন

 

নাট্য ভাষার উদ্ভাবনও ঘটিয়েছেন। যার মূল কথা, সমাজ নির্দিষ্ট ক্ষমতা

 

কাঠামোর অধীনে থাকা চিহ্ন ব্যবস্থা ভিত্তিক সংযোগ সম্পর্কের উপর সম্পূর্ণ

 

নির্ভর না করে সে সংযোগ সম্ভাবনাকে কিভাবে আরও সমৃদ্ধ, ব্যাপক, সর্বজনীন

 

করা যায় তা। এর প্রয়োজনে তিনি তথাকথিত অর্থহীন শব্দ, শারীরিক অঙ্গভঙ্গি

 

বা বিভিন্ন প্রতীক ব্যবহার করেছেন তাঁর নাটকে। এ প্রসঙ্গে তিনি নাটকের ভাষার

 

বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করে দেখান কীভাবে ন্যাচারালিস্টিক থিয়েটারের সময়

 

থেকে মুখের ভাষাই সংযোগ স্থাপনের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠলো। তার মতে সভ্যতা

 

বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ যত জটিল হয়েছে, মানব সমাজে পারস্পরিক ভাব

 

বিনিময়ে স্পর্শের ব্যবহারের বদলে ধীরে ধীরে মুখের শব্দ নির্ভর চিহ্ন ব্যবস্থা বা

 

সংকেতের ওপর অতিনির্ভরতা তৈরি হয়েছে। শরীরের অন্যান্য অংশের সঞ্চালন যেন

 

শুধু মুখের ভাষাকেই জোরালো করবার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজ

 

ব্যবস্থায় ‘সভ্য’, ‘সংস্কৃত’, ‘মার্জিত’, নাগরিকের প্রধান লক্ষণ যেন প্রবল

 

উচ্ছাসেও পরিমিত মাথা নাড়া। এর অন্যথা হলেই সমাজের চোখে হেয় হতে হয়। তৃতীয়

 

থিয়েটার এই কৃত্রিম ভাষা ব্যবহার থেকে মুক্তির কথা বলে। এখানে মুনজের ভাষার

 

সঙ্গে শরীরের ভাষা আলাদা করেই ভাব বিনিময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। শুধুমাত্র

 

মুখের ভাষাকে স্পষ্ট করাই এখানে শরীরের ভাষার কাজ নয়।

 

বাদল সরকারের থিয়েটারের এই যে নিরীক্ষা, এই যে অবস্থান, সেটি কিন্তু হঠাৎ

 

করে গ্রহণ করা কোনো অবস্থান নয়। ‘থার্ড থিয়েটার’ শিকড় হীন কোনো ভাবনা

 
 
 

নয়। আমরা যদি নিরীক্ষামূলক থিয়েটারের প্রেক্ষিতে বাদল সরকারের থিয়েটার

 

বিষয়ক ভাবনা প্রসঙ্গে আলোচনা করি, তাহলে বলা যায়, শুধু আমাদের দেশে

 

বিচ্ছিন্নভাবে নয়, থিয়েটার নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা সারা পৃথিবী জুড়েই নানা

 

সময় চলেছে। রিচুয়ালের সঙ্গে যুক্ত অভিনয় ক্রিয়া (পারফরমেন্স) থেকে বর্তমান

 

থিয়েটারের সময়কাল পর্যন্ত থিয়েটারের বিষয়বস্তুই শুধু নয়, অভিনয় রীতি এবং

 

অভিনয় উপস্থাপন পদ্ধতিরও ঘটেছে নানা পরিবর্তন। রেনেসাঁসের প্রভাবে

 

থিয়েটারে শুধু বিষয়বস্তু নয়, উপস্থাপন রীতি বা নাট্য মঞ্চের ধারণাতেও ঘটেছে

 

নানা পরিবর্তন। মধ্যযুগ পর্যন্ত যে মঞ্চ ধারণা ছিল তার বদলে প্রসেনিয়াম

 

আর্কের আবির্ভাব, থিয়েটার করার জন্য আলাদা জায়গা তৈরি বা পুঁজিবাদী

 

সভ্যতার দর্শন অনুযায়ী দর্শকের অর্থনৈতিক অবস্থান অনুযায়ী নাট্য আলয়ে

 

নতুন বসার ব্যবস্থা হয়েছে। তবে বিশ শতকের দুটি বিশ্বযুদ্ধ শিল্প সংস্কৃতির সব

 

ধারাতেই নানা ধরনের পরিবর্তন এনেছিল। আসলে বিশ্বযুদ্ধ মানুষের মনন জগতে

 

এমন অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল যে পুরনো বিশ্বাসের জগতে মানুষ আর আস্থা রাখতে

 

পারছিল না। এই সময় ‘ আভা গার্দ’ ( Avant Garde) থিয়েটারের শুরু। যে থিয়েটার

 

আন্দোলন বাস্তববাদী থিয়েটারের ধারাকে অস্বীকার করে থিয়েটারের নতুন

 

উপস্থাপন রীতি নিয়ে ব্যাপক নিরীক্ষা শুরু করে।

 

এ প্রসঙ্গে বোধ হয় প্রথম নাম করতে হয় ‘মেয়ারহোল্ড’ (Vsevold Meyerhold)

 

এর। তিনিই প্রথম পুরোনো ধারার বাস্তববাদী থিয়েটারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা

 

করে থিয়েটার নিয়ে নানা নিরীক্ষামূলক কাজ শুরু করেন।‘ঘোস্ট’ প্রযোজনাতে প্রথম

 

মঞ্চের সামনের পর্দা ব্যবহার করা থেকে শুরু করে থিয়েটারে সংলাপের

 

আধিপত্যের বিরোধী ছিলেন তিনি। অভিনয়কে তিনি শুধু মঞ্চের মধ্যে সীমাবদ্ধ না

 

রেখে অর্কেস্ট্রা পিটের কিছু অংশকেও তিনি অভিনয়ের কাজে লাগাতে শুরু করেন।

 

তিনি তাঁর অভিনেতাদেরকে প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত দর্শকদের মাঝে গিয়ে অভিনয়

 

করার নির্দেশ দিতেন। মঞ্চের নির্দিষ্ট পরিসরকে ভেঙে ফেলা বা অভিনেতা-

 

অভিনেত্রীদের সঙ্গে দর্শকদের নতুন ধরনের সম্পর্ক তৈরির মধ্যে দিয়ে তিনি

 

পুরোনো বাস্তববাদী থিয়েটারের ভাষাকে অনেকটাই ভাঙতে সক্ষম হন।

 

এই ধারাবাহিকতাতেই যারা পরবর্তীতে নিরীক্ষামূলক থিয়েটারকে এগিয়ে নিয়ে

 

গেছেন বা থিয়েটারের নতুন ভাষা নির্মাণে সচেষ্ট থেকেছেন। এঁদের মধ্যে

 

উল্লেখযোগ্য হলেন, Vaktanghov, Antonin Artaud, Okholopkov, Jerzy

 

Grotowsky, Julian & Judith Beck, Allan Kaprow, Chaikin, Peter Brook

 

প্রমুখ।

 
 
 

পুরোনো মঞ্চের ধারণাকে ভেঙে দিয়ে Okholopkov দর্শকের মাঝে এমনভাবে তাঁর

 

থিয়েটার উপস্থাপন করেন যাতে দর্শকরাও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে

 

প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ফেলে। অভিনয় প্রাঙ্গনকে তিনি কখনো গোল, কখনো

 

চতুষ্কোণ কখনো আবার ষড়ভুজের আকৃতি দেন। তিনি থিয়েটার প্রাঙ্গনকে এমন

 

একটা জায়গাতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন যেখানে দর্শক এবং অভিনেতা-

 

অভিনেত্রীর হাতে হাত মিলিয়ে একাত্ম হতে পারবে।

 

গ্রটস্কির কথা আগের লেখা হয়েছে। বাদল সরকার তার প্রযোজনা দেখেছিলেন।

 

‘রিয়ালিস্টিক থিয়েটার’ এর বিরুদ্ধে গ্রতস্কি’র বক্তব্য ছিল যে সিনেমা এমনভাবে

 

বাস্তবতাকে উপস্থাপন করতে পারে যা কখনোই থিয়েটারের পক্ষে সম্ভব নয়, ফলে

 

সিনেমা বা টেলিভশন আবিষ্কারের পরে থিয়েটারের এমন কিছু খোঁজা উচিত, সিনেমায়

 

যার উপস্থাপন করা সম্ভব নয়।

 

বিশ শতকের ছয়ের দশক ছিল আমেরিকার ইতিহাসে এক বিশেষ সময়পর্ব। নিউক্লীয়

 

অস্ত্রবিরোধী আন্দোলন, ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন, সমকামী আন্দোলন,

 

অন্যদিকে হিপিদের উত্থানের মধ্যে দিয়ে সে সময় আমেরিকান সমাজেও

 

সার্বিকভাবে এক বিকল্প পরিসর খোঁজার প্রবণতা তৈরি হয়েছিল। থিয়েটারের

 

ক্ষেত্রেও এই বিকল্প পরিসর সৃষ্টির তাগিদেই নতুন প্রযোজনা পদ্ধতি। তাঁদের

 

কাজের সঙ্গেও বাদল সরকারের সরাসরি পরিচিতি ছিল।

 

এই তথ্যগুলি এখানে উল্লেখের যে উদ্দেশ্য তা হল এটা বলতে চাওয়া যে সারা পৃথিবী

 

জুড়েই থিয়েটারের নতুন উদ্দেশ্য খোঁজার একটা প্রচেষ্টা বিশ শতকের মধ্যবর্তী

 

প্রায় পুরো সময় ধরেই লক্ষ্য করা যায়। এবং এই খোঁজের যে মিলের জায়গা তা হল

 

প্রত্যেকেই দর্শকের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের একটা চেষ্টা চালাচ্ছিলেন।

 

পুরোনো ধরনের প্রযোজনাতে দর্শকদের সঙ্গে অভিনেতাদের যে দূরত্ব, সরাসরি

 

সংযোগের অভাব, তাকে প্রত্যেকেই ভেঙে ফেলতে চাইছিলেন। এই ধারাবাহিকতাতেই

 

আমাদের দেশে বাদল সরকারের এই প্রচেষ্টা, যা এই দেশেও ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি

 

করেছিল। তৈরি হয়েছিল ‘থার্ড থিয়েটার’এর ধারায় অসংখ্য থিয়েটার দল, যাদের

 

কেউ কেউ এখনও কাজ করে চলেছে।

দলা দলা ভয়কে জয় করে আসছে নতুন থিয়েটার- ইন্দুদীপা সিনহা

আমার কাজের মাঝে মাঝে

 
 
 
 
 
 

ইন্দুদীপা সিনহা

 
 
 

ফিরে যাও কেন ফিরে ফিরে যাও

 

প্রাক-কোভিড পূর্বজন্মকালীন সময়ে আমরা আপাত সুখে কালাতিপাত করছিলাম। রঙ্গমঞ্চ ছিল, রঙ্গমঞ্চের সাম্রাজ্যবাদ ছিল, আর আমরা জলে-স্থলে-কত ছলে মায়াজাল গাঁথছিলাম।প্রাত্যহিক অভ্যাস এমন আকণ্ঠ মিশেছিল শরীরে, আমরা সাধারণত রঙ্গমঞ্চের মায়াকাননকেই ধ্রুব বলে জানতাম। আমরা, প্রজেক্ট প্রমিথিয়ুস, 2016 সালে নির্মিত একটি সংগঠন। আমাদের নৃত্য ও নাট্য প্রযোজনা নিয়মিত মঞ্চায়ন হয়ে থাকে। এখনো পর্যন্ত আমাদের প্রযোজনাগুলি হল :

 

●কোড রেড (থিয়েটার অলিম্পিকে অভিনীত)

 

●যারা জেগে থাকে

 

●রং রসিয়া

 

● অর্ধেক জীবন

 

●উত্তরাধিকার

 

●একটি সহজ খুনের গল্প

 

●মেটামরফোসিস

 

●বাসবদত্তা

 

●পুনরুত্থান কাব্য

 
 
 
 
 
 
 
 

শহরকেন্দ্রিক থিয়েটার যাপনের ক্ষেত্রে যারা বিকল্প পরিসর বা স্থাননির্ভর অভিনয়ের অভ্যাস জারি রেখেছিলেন, তাদের ক্ষেত্রেও কিন্তু বিষয়টি মূলত নিরীক্ষামূলকই ছিল। শহরের মধ্যে কয়েকটি কৃষ্ণকক্ষে নিয়মিত অভিনয় হয়ে চলেছিল। কিন্তু তা কখনোই মূল ধারার থিয়েটারের প্রত্যঙ্গ হিসাবে চর্চিত ছিল না। নতুন কোন পারফরম্যান্স স্পেস নির্মাণের স্বপ্ন ছিল কারোর কারোর, তা সে শহরকেন্দ্রিক হোক বা শহর বহির্ভূত। কিন্তু আমাদের এই সব স্বপ্ন-ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষারা আবৃত হয়ে ছিল প্রাত্যহিক অভ্যাসের ইট-কাঠ-পাথরে। বহমান জীবন আমাদের সেই অবকাশ দেয়নি, যাতে আমরা নিজস্ব স্বপ্ন বা ইচ্ছাযাপনের বাস্তবিকতাকে লালন করতে পারি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার নিজের একটি শহর বহির্ভূত পারফরম্যান্স স্পেসের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ছিল। বর্ধমান জেলার গ্রাম দেবীপুরে আমার পৈতৃক বাড়ি এবং বাড়ি সংলগ্ন একটি মন্দির আছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, 1844 খ্রিস্টাব্দে নির্মিত টেরাকোটার এই মন্দিরটি বাংলার অন্যতম একটি উল্লেখযোগ্য মন্দির। 120 ফুট উচ্চতার এই লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরটি তার নিজস্ব ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্বের কারণে আমাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গর্বের বিষয়বস্তু। এই মন্দিরের অনবদ্য গঠনশৈলী, মন্দির সংলগ্ন প্রাচীন কিছু স্থাপত্য এবং লালমাটির মন্দির-প্রাঙ্গণ – চিরকালই এই স্থানকে এক অতুলনীয় আকর্ষণের কেন্দ্র হিসাবে নির্মাণ করে তুলেছে। লোকমুখে প্রচলিত গল্প কথা, টুকরো টুকরো ইতিহাস, মন্দির সংলগ্ন জমিদার বাড়ির লোকপরম্পরা একে এক আশ্চর্য রূপকথায় পর্যবসিত করেছিল। কিন্তু সেই ঘটি-না ডোবা তাল-পুকুরে মন্দির এবং আনুষঙ্গিক পরিসরের অযত্নলালিত বর্ণহীন চেহারা আমাকে দীর্ঘকাল ধরে ভাবিয়েছে। এবং ভাবনাচিন্তা আমাকে জানিয়েছে যে মানুষের নিয়মিত যাতায়াত, ইতিহাস সচেতনতা এবং শিল্পকলাচর্চাই পারে এই স্থানকে পুনরুজ্জীবিত করতে। সেই প্রচেষ্টাতেই ছোট ছোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্থানীয় মানুষদের যুক্ত করে ওই জায়গায় আমরা শিল্পকলাচর্চা শুরু করি। নাচ-গান-থিয়েটার ইত্যাদির মাধ্যমে ওই অসামান্য মন্দির প্রাঙ্গণ আবার প্রাণ ফিরে পেতে লাগলো। শুধুমাত্র ধর্ম – ইতিহাস বা পুরাতত্ত্বের কারণেই নয়, শিল্পচর্চার কারণেও মন্দির প্রাঙ্গণে মানুষের যাতায়াত বাড়তে শুরু করলো। পরিত্যক্ত প্রাঙ্গণ, মৃতপ্রায় স্থাপত্য, অযত্নলালিত ইতিহাসের পরিমার্জন হতে লাগল প্রতিনিয়ত। নতুন ইতিহাস রচনার এই শৈশবেই আমাদের ব্যক্তিগত- আর্থসামাজিক- রাজনৈতিক-সামগ্রিক প্রেক্ষাপট আমূল বদলে দিল এক আপাতঅজানা জীবাণু।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

বিরস দিন বিরল কাজ

 

আমাদের সমকালীন মানুষদের একটা সাধারন আক্ষেপ ছিল যে আমরা তেমন কোন বড় বিপর্যয় দেখিনি। মহামারী-মন্বন্তর-মহাযুদ্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি। সে সাধ মিটলো। আমরা এক অনিবার্য অনির্দিষ্ট অরক্ষিত ভবিষ্যতে যাত্রা করলাম। প্রতিনিয়ত প্রাণহানির আশঙ্কার সঙ্গে লড়াই করতে করতে আমরা বদলে যেতে লাগলাম। চিরতরে। সামাজিক দূরত্ববিধি মেনে চলতে চলতে আমাদের অন্তরাত্মা সংকুচিত হয়ে যেতে লাগল, বিমর্ষ হয়ে পড়লো, আমরা এক অনিবার্য স্থবিরতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়লাম। পেশাগত ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্ন মৃত্যু-মিছিলের অভিজ্ঞতা আমার কারুবাসনাকে বিক্ষত করছিল প্রতিপলে। সভা-সমিতি- মিটিং-মিছিল -জমায়েত সব বন্ধ হয়ে যাবার প্রভাব আমাদের আরও দ্রুত স্থাণু করে দিল। শিল্পচর্চার মূলে এই তীব্র কুঠারাঘাত আমাদের শিল্পী হিসাবে এবং মানুষ হিসাবে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিল। বেঁচে থাকার লড়াই আমাদের শিল্পচর্চার মনকে প্রান্তিক করে দিল।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

খেলা ভাঙার খেলা

 

তালাবন্দি সময় একদা ক্ষীণ হয়ে এলো। কিন্তু আমাদের মরচে পড়া অভ্যাস আর কিছুতেই আগের চেহারায় ফিরে যেতে পারল না। রঙ্গমঞ্চের দরজা আমাদের কাছে নানারকম ফিতের ফাঁসে আটকে থাকলো। রকমারি স্বাস্থ্যবিধির কারণে, তা সে যুক্তিসংগত হোক বা না হোক, দর্শক ও শিল্পীর মধ্যে গঠিত নব্যস্বাভাবিক যোজনদূরত্ব কোনভাবেই কমিয়ে আনা সম্ভব হলো না। দীর্ঘদিন শিল্পচর্চা বন্ধ থাকার ফলে অর্থনৈতিকভাবেও শিল্পদুনিয়া এক অপূরণীয় ক্ষতির মধ্যে কোনমতে ভেসে রইল। দীর্ঘ অনভ্যাসের ফলে মুখোমুখি বসিবার সম্পর্ক ক্ষীণ হলো। আন্তর্জালিক শিল্পচর্চার সম্ভার আড়ে বহরে বেড়ে উঠতে লাগলো আর তার সঙ্গে তাল মেলাতে মেলাতে আমরা সমষ্টিবিচ্ছিন্ন হতে লাগলাম। নব্যস্বাভাবিক বিচ্ছিন্নতায় আমাদের লক্ষ বছরের যূথজীবনের প্রতিবর্ত আহত হয়ে চলল প্রতিদিন। সামগ্রিক শিল্পযাপনের অভ্যাস দিকনির্দেশ হারাতে লাগলো ক্রমশ।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

নতুন করে পাব বলে

 

এই আপাত অনভিপ্রেত অবকাশ কিন্তু আমাদের সেই বিরল সুযোগ দিয়েছিল, যাতে আমরা নিজেদের জীবন ও যাপনকে সামগ্রিকভাবে পুনর্মূল্যায়ন করতে পারি। আমাদের সম্মিলিত শিল্পযাপনের গতিমুখকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতে পারি। শিল্পের লক্ষ্য যদি হয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকা, তাহলে করোনাউত্তরকালের রঙ্গমঞ্চের অবস্থান কিন্তু তার বিপ্রতীপে। শিল্পচর্চাকে মাধ্যম করে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টাই কিন্তু আমাদের প্রাণিত করে বিকল্প স্থানে পারফরম্যান্সের সুযোগ খুঁজে নিতে। করোনাকালের অবকাশে শহরে ও শহরের বাইরে বেশ কিছু নতুন জায়গা গড়ে উঠতে পারল। স্বাস্থ্যবিধি মেনে জনসমাগমের বিষয়টি কারুশিল্পীদের প্রাণিত করলো স্বল্পসংখ্যক দর্শকের মধ্যে নিজেদের কাজ উপস্থাপিত করতে। রোগভীতি বা সংক্রমণের আশঙ্কার থেকেও বড় প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে লাগলো দীর্ঘ সময় সমষ্টি জীবনে না বাঁচার অভ্যাস এবং সুরক্ষার নামে সন্দেহের বাতাবরণে নিজেদের যাপনকে জারিত করার বাধ্যতা। আমি তারে পারি না এড়াতে। মাথার মধ্যে বিপ বিপ করে চলা সেই বোধ নিয়ে শুরু হয় আমাদের জেহাদ। মারীপরবর্তী অভিযোজিত সমাজে শুরু হয় আমাদের ভিন্নতর শিল্পসংগ্রাম। অন্য ছায়াপথে।

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

আমরা শুনেছি ওই

 

এক পা এক পা করে শুরু হয়েছে আমাদের লড়াই। মানুষের কাছে শিল্পচর্চার মাধ্যমে পৌঁছানোর লড়াই। মারীপরবর্তী বিপন্ন মানুষকে শিল্পসৃষ্টির মাধ্যমে নতুন প্রাণশক্তি সঞ্চারের লড়াই। যাপনের মধ্যে দিয়ে কারুকর্মীদের নতুন করে বেঁচে ওঠার লড়াই। নতুন নতুন জায়গায় নানা ছোট বড় উপস্থাপনার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রাণ ফিরে পাচ্ছে আমাদের শিল্পযাপন। সেই শিল্পান্তরে সংযোগ বাড়ছে, আদান-প্রদান বাড়ছে, দলা দলা জমে থাকা ভয়-আড়ষ্টতা-একাকিত্ব ক্রমে ক্ষীণ হচ্ছে।

 

কোন নূতনেরই ডাক।

 

মাভৈঃ। চরৈবেতি।

 
 
 
 
 
 
 

পথেই নাটকের রাহুমুক্তি অভিজ্ঞতায় বুঝলেন - সৈকত ঘোষ

 
 
 

সৈকত ঘোষ

 
 
 
 
 

রবীন্দ্র ভারতীতে নাটক নির্দেশনার নিয়ে পড়াকালীন এবং মিনার্ভা রেপার্টরির দীর্ঘ চারবছর থাকার সুবাদে খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলাম ক্ষমতার থিয়েটারের অর্থ ,উদভ্রান্তের মত খুঁজে বেড়িয়েছি পরবর্তীতে কিভাবে থিয়েটার করবো ? এরকম টালমাটাল অবস্থাতে অনেকটা অনুপ্রাণিত করেছে ,পিস কাটার , ব্রেখট,অগাস্তো বোয়াল,উৎপল দত্ত , সফদার হাশমির লেখা এবং জীবন , ছাত্রজীবনে প্রত্যক্ষ রাজনীতির করার সুবাদে বুঝতে পেরেছিলাম ‘রাজনীতি হলো একটা লড়াই, প্রতিকূল একটা শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে পরাভূত করাই হলো লক্ষ্য। রাজনীতি হলো ক্রমান্বয়িক গতিশীলতা, প্রতিকূলতাকে পরাজিত করেও তাকে এগিয়ে যেতে হয়। রাজনীতি হলো একটি বিজ্ঞান, যার একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে, পদ্ধতি আছে।’ আপনাদের নিশ্চয় মনে পড়বে ‘অত্যাচারিতের নাট্যে’র মুখবন্ধে তুলে ধরা বোয়ালের বিখ্যাত তর্ক: “সব থিয়েটারই রাজনৈতিক। কারণ, মানুষের সব কর্মকাণ্ডই রাজনৈতিক, আর থিয়েটার তাদেরই একটি। যারা থিয়েটারকে রাজনীতি থেকে আলাদা করতে চায়, তারা আসলে আমাদেরকে ভুলের মধ্যে নিক্ষেপ করতে চায়। আর এটিও একটি রাজনৈতিক কৌশল , মিনার্ভাতে থাকাকালীন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি এইসময় দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলা খুব প্রয়োজন, সেখান থেকে তৈরি হয় পাঁচটি রাজনৈতিক অনুনাটক একসাথে পাঁচ এর পাঁচালী,সেখানে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের পোকা মাকড়ের কুটুম থেকে আমার নির্দেশনার কাজ শুরু করি, পরবর্তীতে ১৬ পাতা, উন নয়ন, পিকনিক দ্যা ব্যাটল ফিল্ড, হাত্যারে,আজব দেশ কী গজব কাহানীয়া সর্বসাকুল্যে পাঁচটি নাটক নির্দেশনার সুযোগ পেয়েছি,এই নাটকগুলোর মাধ্যমে প্রচেষ্টা করেছি আমাদের সময়ের কথা সরাসরি বলার , প্রথম এবং শেষ উদ্দেশ্যে ছিল এই অন্ধকার সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রেক্ষিত তুলে ধরা , এই সব প্রশ্নের সন্ধানে প্রথমে hypokrites বর্তমানে uncurtained দলের নির্দেশনার কাজে যুক্ত ,সরাসরি শাসকের চোখে চোখ রেখে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে,ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে নাটক করতে গিয়ে সফদার হাশমির “হাত্যারে” নাটকটির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন হয়, বারবার মনে পড়ে, আনন্দ পটবর্ধন কবিতা লিখেছিলেন সফদারের স্মৃতিতে ‘বাবরি মসজিদ ভাঙতে তুমি দেখো নি তুমি দেখো নি তার পরের হিংসা আর ঘৃণাকে তুমি রামাবাঈ আর অন্যান্য দলিতের মৃত্যু দেখো নি পরমাণু বোমার জন্য দেশের আকুলতা তুমি দেখো নি ২০০২ এ গুজরাটের সাম্প্রদায়ীক হিংসা তুমি দেখো নি প্রতিবেশি পাকিস্তানে তালিবানের উৎপত্তি তুমি দেখো নি আর এখানে তুমি হত্যাকারীর রাজ্যাভিষেক দেখো নি আমরা যারা এখনো বেঁচে রয়েছি তারা এগুলো সব দেখেছি কিন্তু তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না।’ সফদার হাশমির অনুপ্রেরণায় আমাদের দল uncurtained সরাসরি রাস্তাতে নেমে হাত্যারে নাটকটি গত তিনবছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র বিশেষ করে দাঙ্গা কবলিত অঞ্চলে পরিবেশিত করে চলেছে , দর্শকদের, উচ্ছ্বাস ভালোবাসা আমাদের প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করছে,সাহস দিচ্ছে,আমাদের বিশ্বাস রাস্তাই একমাত্র রাস্তা। বর্তমান সময়ে মিনিমালিস্টিক অ্যাপ্রচে নাটক করার জন্যে যে যে মাধ্যমগুলো আছে আমরা প্রত্যেকটা মাধ্যমকে এক্সপোলর করি লক্ষ্য একটাই আমাদের রাজনৈতিক ভাষ্য মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে। ক্রমবর্ধান বাজার সর্বস্য পরিস্থিতিতে ইন্টিমেট স্পেস থিয়েটার একটি উল্লেখযোগ্য বিকল্প রাস্তা , এই বিশেষ অপেক্ষাকৃত ছোট স্পেস টার কথা মাথায় রেখেই আমরা ১৬ পাতা এবং উন নয়ন করেছিলাম, প্রতিনিয়ত পরীক্ষামূলক পারফর্মেন্সের ভাষ্য গড়ে তোলা এবং দর্শকের সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন আমাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্যে ছিল,এই পরীক্ষামূলক চর্চার মাধ্যমে দর্শকদের সাড়া আমরা পেয়েছি বিপুল পরিমাণে,দাদা দিদির ক্ষমতায়নের সময়ে ইন্টিমেট স্পেস থিয়েটার হয়ে উঠছে বড়ো বড়ো হলগুলির প্রতিস্পর্ধার নাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা গলির একচিলতে কোণায় যদি থিয়েটার হয় সেই স্পেস্টুকুও পারফর্মারদের কাছে অত্যন্ত ইন্টিমেট এবং রাজনৈতিক চর্চার কেন্দ্র এবং বিকল্প পথ।

 
 
 
 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *