চতুর্দশ সংখ্যা || সপ্তম ই – সংস্করন || মার্চ ২০২১

ভাণ পত্রিকা

চতুর্দশ সংখ্যা || সপ্তম ই- সংস্করন || মার্চ ২০২১

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

ও মৌলিকা সাজোয়াল

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) [email protected] ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সূচি

সম্পাদকীয়

সাম্প্রতিকী

লিটল ম্যাগাজিন মেলার সংস্কৃতি ২০২১ – গৌতম মন্ডল

এ মাসের প্রতিভা

মাধবী মুখোপাধ্যায় : এক নক্ষত্রের কথা – সোমনাথ লাহা

দেখা-শোনা-পড়া তারপর লেখা

নাটক সাবিত্রীবালা:কালা সমাজের কানে বোবার সশব্দ চিৎকার – বিনয়ী গোরা

আমাকে অনুপ্রাণিত করেন পঙ্কজ ত্রিপাঠী” ব্যক্তি ও অভিনয় জীবনকে পরখ করে লিখলেন – অজন্তা সিনহা

সুশান্ত সেন এর বই “পুতুল নাচ”এর ইতিকথা তুলে ধরলেন – শুভজিৎ বারিক

 এমাসের নিবন্ধ

“নাটকের নির্মাণ হয় দর্শকের কল্পনা ও চেতনার রঙ্গমঞ্চে” লিখলেন – শরণ্য দে

অভিজ্ঞতা- অনুভব

একসঙ্গে বসে মেহেদি হাসান আর শচীন দেব বর্মন কি শোনা উচিত?”কথা পাড়লেন – স্নিগ্ধদেব সেনগুপ্ত

ইতিহাস ও স্মৃতির পথ দিয়ে নানা মঞ্চের সন্ধান চালালেন – অমর চট্টোপাধ্যায়

তমলুকের রঙ্গন নাট্যদলের অভিনব পার্বণ নিয়ে গল্প শোনালেন – অনুপম দাসগুপ্ত

সম্পাদকীয়

সানন্দে ভাণ-এর ১৪তম সংখ্যা এবং সপ্তম ই-সংস্করণ প্রকাশ পেতে চলেছে। প্রয়োগ কলা (পারফর্মিং আর্ট) এবং সংস্কৃতি চর্চা-কে বিষয় করে ভাণ-এর স্বতন্ত্র পথচলা। এ বাধাহীন ভাবে সম্ভব হয়ে অনেক সম্ভাবনার জন্ম দিচ্ছে মূলত আপনাদের কারণে। একা একা যেমন বিয়ে করা যায় না। অভিনয় করা যায় না। তেমনি পত্রিকা, পাঠক ছাড়া অকল্পনীয়। সংযোগ তার মূল কথা। প্রতি সংখ্যায় যে নতুন করে কিছু কিছু পাঠক ভাণ এর পাতায় চোখ রাখছেন এই আমাদের মস্ত প্রেরণা। আসছে পুজোয় মাসিক সংস্করণের জরুরি এবং যোগ্য লেখা গুলির একটি ছাপা সংকলন আপনাদের হাতে তুলে দেবো, একথাও আমাদের বিলক্ষণ স্মরণে আছে।

 

 

 

এবারের ভাণ এ ‘এমাসের প্রতিভা’ বিভাগে সু-অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়-কে নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছেন সোমনাথ লাহা। সাম্প্রতিকে সদনের মাঠে আয়োজিত লিটল ম্যাগাজিন মেলা ও তার সংস্কৃতি নিয়ে ছোট্ট কিন্তু প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন “আদম” পত্রিকার সম্পাদক গৌতম মন্ডল। সাবিত্রী বালা’এর মঞ্চ দেখে তার দেখাটুকুকে বিশ্লেষণ করেছেন বিনয়ী গোরা। সেলুলয়েডের প্রখ্যাত অভিনেতা পঙ্কজ ত্রিপাঠীর অভিনয় ও ব্যক্তিসত্তার মিলিত এক গদ্য লিখেছেন অজন্তা সিনহা। গায়কের গেরো’এর দ্বিতীয় পর্যায় নিয়ে কথামতো উপস্থিত আছেন সঙ্গীত শিল্পী স্নিগ্ধদেব সেনগুপ্ত। তবে ধ্রুপদী সঙ্গীত নিয়ে অরিত্র দের তৃতীয় কিস্তিটি বের করা গেল না। সম্প্রতি অরিত্রর পিতৃ বিয়োগ হয়েছে। ভাণ পরিবারের তরফ থেকে আমাদের আন্তরিক সমবেদনা রইল অরিত্রর জন্য। মিনিমালিজম-কে মনে রেখে ভারতীয় থিয়েটারের ধরণ ও প্রয়োগ কৌশল এর ঔচিত্য নিয়ে একটি চমৎকার আলোচনা করেছেন শারণ্য দে। অন্য একটি নিবন্ধে অভিনেতা প্রয়োগ শিল্পী অমর চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি ও ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে খুঁজে চলেছেন নানা মঞ্চ অথবা না-মঞ্চ। তমলুকের রঙ্গন নাট্যদলের অভিনব পার্বণ নিয়ে লিখেছেন অনুপম দাসগুপ্ত। আর ‘বই পড়া’ বিভাগে সুশান্ত সরকারের “পুতুল নাচ” পড়ে পুতুল ও তার নাচের ইতিকথার সন্ধান দিয়েছেন শুভজিৎ বারিক।

 

পরের এপ্রিল সংখ্যা থেকে নিয়মিত বিভাগের সঙ্গে “বিষয় বিশেষ” হিসেবে আসতে চলেছে “বাঙালির রাজনৈতিক সংস্কৃতি”। ভাণ-এর সঙ্গে থাকুন। পড়তে থাকুন। প্রিয়জনদের পড়াতে থাকুন। ভালোলাগা-মন্দলাগা জানাতে থাকুন আমাদের। আসন্ন দোলের রঙ যেন মর্মে লাগে এই বাসনা।

 

লিটল ম্যাগাজিন মেলা ও সাহিত্য উৎসব ২০২১

লিটল ম্যাগাজিন মেলা ও সাহিত্য উৎসব ২০২১

 

গৌতম মণ্ডল, সম্পাদক, আদম

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

কলকাতা বইমেলা তো বটেই অন্যান্য বইমেলাতেও আমরা নিয়মিত যাই,কবিতা নিয়ে নানান পাগলামিতে মেতে

 

থাকি,স্টল দিই। একারণে বইমেলাগুলি আমাদের কাছে খুব প্রিয় একটা ব্যাপার। এবছর জানুয়ারি ফেব্রুয়ারিতে

 

আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা না হওয়ায় আমরা অনেকেই মুষড়ে পড়েছিলাম। তবে আমাদের ক্ষতে কিছুটা

 

মলমের কাজ করেছে লিটল ম্যাগাজিন মেলা ও সাহিত্য উৎসব। তিনবছর পর ওকাকুরা ভবন-প্রাঙ্গণ থেকে

 

মেলা ফিরে এল পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রাঙ্গণে। লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক এবং কবি ও লেখক

 

এমনকি পাঠকরা একারণে এবার খুব খুশি। খুশি, কেননা খুব সহজেই বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে আসা যায়।

 

তাছাড়া এখানের পরিবেশ সাহিত্য সংস্কৃতির অনুকূল। এবার মেলায় আমন্ত্রণ জানানো থেকে স্টল বন্টন–

 

পুরো ব্যাপারটা খুব দক্ষতা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে সামলেছে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি কর্তৃপক্ষ। স্টল

 

নির্মাণ এবং স্টল বিন্যাসও ছিল দেখার মতো। মেলায় ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো। এবার মেলায় একটা

 

প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।পাঁচটি তারার তিমির। এই পাঁচ তারা হলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত,দেবেশ

 

রায়,সুধীর চক্রবর্তী, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অরুণ সেন। প্রদর্শনীটি ছিল দেখার মতো। এটা দেখতে

 

অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থাতেও এসেছিলেন নবতিপর শঙ্খ ঘোষ।

 
 
 
 
 
 

মেলার পাঁচদিনেই একতারা মুক্ত মঞ্চ,পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি সভাঘর ও জীবনানন্দ সভাঘরে ছিল নানান

 

ধরনের অনুষ্ঠান।কবিতাপাঠ,গল্পপাঠ,সেমিনার। মেলাটা যে কোনোভাবেই আকাদেমি নন্দন প্রাঙ্গণ ছাড়া অন্য কোথাও

 

সফলভাবে করা সম্ভব নয়,আশা করি,তা অনুধাবন করতে পেরেছেন আকাদেমি কর্তৃপক্ষ। তবে সবকিছুই যে

 

মসৃণভাবে হয়েছে তা পুরোপুরি বলা যায় না। সরকারের উদ্যোগে লিটল ম্যাগাজিন মেলা করার প্রস্তাব যিনি

 

প্রথম দিয়েছিলেন সেই সন্দীপদা,কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন মেলা লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্রের প্রাণপুরুষ

 

সন্দীপ দত্তকে এবছর মেলাতে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। মেলা যখন আকাদেমি প্রাঙ্গণ থেকে ওকাকুরা ভবনে

 

চলে গেল সেসময় প্রায় সব সম্পাদকই এর বিরোধিতা করেছিলেন। প্রতিবাদীদের একটা অংশ মেলা বয়কট করে

 

অন্যত্র মেলা করার সিদ্ধান্ত নেন।বিগত তিনবছর তাঁরা অন্যত্র মেলা করেওছিলেন।কিন্তু এবছর যখন মেলা

 

আকাদেমি প্রাঙ্গণে ফিরে এল তখন সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও এঁদেরকে– যাঁরা মেলাটা ফিরিয়ে আনার

 

জন্য আন্দোলন করেছিলেন তাঁদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি কর্তৃক

 

আয়োজিত লিটল ম্যাগাজিন মেলা ও সাহিত্য উৎসবের একটা বড় আকর্ষণ পুরস্কার প্রদান।অনেকগুলি

 

বিভাগে মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুরস্কার দেওয়া হয়।এটাই রীতি। শুরুর দিন থেকে প্রতিবছর তা দেওয়া

 

হয়েছে।কিন্তু এবছর কোনো অজ্ঞাত কারণে সেগুলো দেওয়া হয়নি। তবে এসব সত্বেও মেলাটা যে আকাদেমি

 

প্রাঙ্গণে হয়েছে,তার জন্য আমরা প্রত্যেকে খুশি।আমরা চাই, আমাদের প্রাণের মেলা লিটল ম্যাগাজিন মেলা

 

প্রতিবছর এখানেই হোক– আকাদেমি-নন্দন প্রাঙ্গণে।

 
 
 
 
 
 
 

মাধবী মুখোপাধ্যায় : এক নক্ষত্রের কথা

 
 
 

সোমনাথ লাহা

 
 
 

মাধবী কানন মনের আনন্দে দোলনায় দোল খেতে খেতে ‘ফুলে ফুলে ভরে ঢলে’ গাইছেন নায়িকা। বাংলা সিনেমার এই আইকনিক দৃশ্যটি আজ‌ও সিনেপ্রেমী দর্শকদের মনের মণিকোঠায় সমানভাবে উজ্জ্বল। আর সেই নায়িকা… তিনি স্বর্ণযুগের বাংলা ছবির এক অন্যতম নক্ষত্র। এতক্ষণ অবধি পড়ে পাঠকরা সহজেই বুঝতে পেরেছেন কার কথা বলা হচ্ছে। ঠিকই ধরেছেন। তিনি বাংলা ছবির ‘চারুলতা’ মাধবী মুখোপাধ্যায়। তবে বাস্তবে এই ‘চারু’-র চলার পথটা মসৃণ ছিল না। ছিল সংগ্রামের। আত্মনির্ভরশীল হ‌ওয়ার পাঠ তাঁকে নিতে হয়েছিল ছোটবেলা থেকেই। ১৯৪২ এর ১০ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্ম মাধবী মুখোপাধ্যায়ের। বাবা শৈলেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও মা লীলাদেবীর দ্বিতীয় সন্তান তিনি।প্রথম সন্তান কন্যা হ‌ওয়ায় তাঁর মা চেয়েছিলেন পুত্র সন্তান। তাই ছোট থেকেই মাধবীকে পড়ানো হতো ছেলেদের পোশাক। ছোটমাসি তাঁর নাম দিয়েছিল টুকটুক। দাদু ডাকতেন টুকানবাবু বলে। ছোটবেলা তাঁর কেটেছে ঢাকুরিয়ার ভাড়াবাড়িতে। তারপর একটু বড় হতেই বদলাতে হলো ঠিকানা। মুসলিম মহল্লা রাজাবাজারে বাবা-মা, দিদি মঞ্জরীর সঙ্গে থাকতে শুরু করা। তবে তারপর দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে সংসার ভাগ‌ও হয়ে গিয়েছিল তাদের। বাবা -মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ দেখতে হয়েছে তাঁকে। এরপর এ বাড়ি ও বাড়ি, এ পাড়া সে পাড়ায় কষ্টের দিন গুজরান। সংসারে আয় বলতে ছিল লীলাদেবীর গানের টিউশন। তারপর দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর আর্থিক অনটনের সংসারের হাল ধরতে মা লীলাদেবীর হাত ধরে পাঁচ বছরের মাধুরী( তখনও তিনি মাধবী হননি) পা রাখল প্রফেশনাল থিয়েটারের মঞ্চে। শ্রীরঙ্গমে নাট্যগুরু শিশির ভাদুড়ির কাছে আত্মনির্ভর হ‌ওয়ার শিক্ষা পেল ছোট মাধুরী। যোগেশ চৌধুরীর নাটক ‘সীতা’-র হাত ধরেই তাঁর মঞ্চাভিনয়ের শুরু। সেখান‌ই পাওয়া সরযূবালাদেবী, প্রভাদেবীর সান্নিধ্য। তারপর প্রভাদেবী তাকে নিয়ে যান মিনার্ভায়। সেখানে ছবি বিশ্বাসের পরিচালনায় ‘ধাত্রী-পান্না’ নাটকে পান্নার ছেলে কনকের চরিত্রে অভিনয়। ছোট মাধুরীর মাসিক ২৫টাকা বেতনে সেই কাজের শুরু। এরপর নরেশ মিত্রর পরিচালনায় ‘আত্মদান’ নাটকে অভিনয়। ভারতীয় দর্শনের উপর ভিত্তি করে তৈরি সেই নাটকে ‘মাৎসর্য’ ও ‘বৈরাগ্য’ এই দুই চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। বিবেকের চরিত্রে অভিনয় করতেন ‘কিন্নরকন্ঠী’ সীতাদেবী। ‘লোভ’ করতেন শ্যাম লাহা এবং ‘জ্ঞান’ এর ভূমিকায় কৃষ্ণ চন্দ্র দে। বলা বাহুল্য এই নাটকে অভিনয় করার সুবাদে কৃষ্ণ চন্দ্র দে-র কাছে গান শেখার হাতেখড়ি হয় ছোট্ট মাধুরীর। এরপর ছোট্ট মাধুরীর শিশু শিল্পী হিসাবে চলচ্চিত্রে অভিনয়ে পদার্পণ। শ্যাম লাহা তাঁকে নিয়ে যান সাহিত্যিক-পরিচালক প্রেমেন্দ্র মিত্রর কাছে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের পরিচালনায় ‘কাঁকনতলা লাইট রেলওয়ে’ ছবির হাত ধরে সেলুলয়েডে কাজ শুরু তাঁর। তারপর প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘দুই বেয়াই’, ‘সেতু’ ছবিতে অভিনয়। পুরোদস্তুর নায়িকা হিসেবে কাজ শুরু করেন তপন সিংহর ছবি ‘টনসিল’ থেকে। এরপর মাধুরীর অভিনয় জীবনে আসে বাঁক। পরিচালক মৃণাল সেনের ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’-এ অভিনয় শুরু করার আগেই ছবির ছবির দুই প্রযোজক বিজয় চ্যাটার্জি ও ভোলা রায় তাঁর নাম পরিবর্তন করার প্রস্তাব দেন। মৃণাল সেন করেন নতুন নামকরণ। মাধুরী পাকাপাকি ভাবে হয়ে যায় মাধবী।

 
 
 
 
 
 

মাধবী মুখোপাধ্যায়

 

 

 

নাম পরিবর্তন করার বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মাধবী মুখোপাধ্যায় বলেছেন,”নাম পাল্টানোর বিষয়টা তখন আমার কাছে বড় ব্যাপার ছিল না। বড় কথা ছিল সংসার চালানো।” এই ছবিতে ‘মালতী’ চরিত্রে করার ক্ষেত্রে বা বলা ভালো চরিত্র হয়ে ওঠার জন্য তাঁকে সাহায্য করেছিলেন মৃণাল সেনের স্ত্রী গীতা সেন। তারপরে মাধবী সুযোগ পান আরেক যশস্বী পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের ছবি ‘সুবর্ণরেখা’-তে। ছবিতে তাঁর অভিনীত চরিত্র ‘সীতা’ বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। তবে মাধবীকে সীতা হয়ে ওঠার জন্য ইগোতে ধাক্কা দিতে কুন্ঠাবোধ করেননি ঋত্বিক। কখনো তাঁকে তাতিয়ে দিতে বলেছেন ‘তোমাকে দিয়ে হবে না। আমি রমাকে(সুচিত্রা সেন) নিয়ে নেব’। আবার কখনও তাঁকে বলেছেন ‘ তোমায় লং শটে সূতিকার মতো দেখায়। ক্লোজ-আপে ভালো লাগে না’ -র মতো কথা। তারপরেও নিজের প্রতিভার গুনে সীতা চরিত্রটিকে পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন মাধবী। এরপর তিনি ডাক পান আরেক বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে। সত্যজিতের অন্যতম ছবি ‘মহানগর’-এ মাধবী অভিনীত চরিত্র ‘আরতি’ ছবির ভরকেন্দ্র। এই চরিত্রটি তাঁর অভিনয় জীবনে অন্তত মাত্রা যোগ করে। তারপর সত্যজিৎ যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাহিনি ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে ‘চারুলতা’ তৈরি করেন তাতে চারুলতার চরিত্রে তিনি বেছে নেন মাধবীকেই। এরপর ‘কাপুরুষ’ ছবিতেও তিনি নেন মাধবীকে। মাধবীকে নিয়ে সত্যজিতের পথের পর ছবি করার মাঝেই এই দু’জনকে ঘিরে ফিল্মি পত্র-পত্রিকায় ও কাগজে শুরু হয় নানা গুঞ্জন। তবে নিজের আত্মসন্মান ও ব্যাক্তিত্বকে বজায় রেখে তার থেকে বেরিয়ে এসেছেন মাধবী। সুচিত্রা-সুপ্রিয়া-সাবিত্রী র মতো অভিনেত্রীদের পাশে নিজের অভিনয় দক্ষতায় একটা আলাদা জায়গা মে করতে পেরেছিলেন মাধবী তাই নয়, বরং তিনিই সেই সময়ে একমাত্র অভিনেত্রী তথা নায়িকা তিনি সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক এই ত্রয়ীর সঙ্গে কাজ করেছেন। এর বাইরে যেমন পূর্ণেন্দু পত্রীর সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি, তেমনই তরুণ মজুমদারের ‘গণদেবতা’-তেও কাজ করেছেন। নায়িকা হয়েছেন উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে। উত্তম কুমারের সঙ্গে ‘থানা থেকে আসছি’, ‘শঙ্খবেলা’,’ছদ্মবেশী’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘বিরাজ বৌ’ এর মতো ছবির পাশাপাশি উত্তমকুমারের পরিচালনায় ‘বনপলাশীর পদাবলী’ ছবিতে কাজ করেছেন মাধবী মুখোপাধ্যায়। আবার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে’চারুলতা’, ‘কাপুরুষ’, ‘পরিশোধ’ এর মতো একাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। এর পাশাপাশি ‘সুবর্ণলতা’, ‘বিন্দুর ছেলে’ -র মতো ছবিতেও মাধবী মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় দাগ কেটে গিয়েছে দর্শকদের মনে। ‘দিবারাত্রির কাব্য’ ছবিতে অনন্য অভিনয়ের সুবাদে তিনি পান জাতীয় পুরস্কার। তবে এতোকিছু প্রাপ্তির পরেও অমায়িক মাধবী মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য,”সেই পাঁচ বছর বয়স থেকেই অভিনয়ের পথে চলা শুরু করেছি। চলতে চলতেই এসব প্রাপ্তি ঘটেছে আমার জীবনে।” এহেন মাধবী মুখোপাধ্যায় বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম অভিনেতা নির্মল কুমারের সঙ্গে। দুই কন্যা রয়েছে তাঁর। অভিনয়ের পাশাপাশি ছবিও পরিচালনা করেছেন মাধবী মুখোপাধ্যায়। চিত্তরঞ্জন ঘোষের লেখা ‘আত্মজা’ ছবির হাত ধরেই পরিচালনায় পা রাখেন মাধবী। এছাড়াও ছোটপর্দায় ‘নিষ্কৃতি’ নামে একটি ধারাবাহিক‌ও পরিচালনা করেছেন তিনি। এখনও সমানভাবে কাজ করে চলেছেন বড়পর্দা ও ছোট পর্দায়। তবে তারপরেও লেক গার্ডেন্সে দোতলার ফ্ল্যাটে একাকী থাকেন তিনি। নির্মলকুমারের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়নি তাঁর। কিন্তু আত্মসন্মানকে বজায় রেখে একাই থাকেন এখনও তিনি। যদিও স্বামীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ রয়েছে। সম্প্রতি মাধবী পা দিলেন ঊন‌আশিতে। আশির দিকে অগ্রসর হয়েও মাধবী মুখোপাধ্যায় আজ‌ও সমানভাবে উজ্জ্বল। চারুলতার ঔজ্জ্বল্যে এতটুকু ভাঁটা নেই। বরং রয়েছে জেদ। ভালো কাজের খিদে। আর নিজের সাধ্যটুকু নিয়ে মানুষের সেবা করার চেষ্টা। এই নিয়েই বিরাজমান মাধবী মুখোপাধ্যায়। বাংলা চলচ্চিত্রের এক অন্যতম নক্ষত্র।

 
 

নাটক সাবিত্রীবালা:কালা সমাজের কানে বোবার সশব্দ চিৎকার

 
 
 

বিনয়ী গোরা

 
 
 

নাটকের নাম সাবিত্রী বালা।পূর্ণাঙ্গ নাটকই বলা চলে। নাটকের সারা অঙ্গ জুড়ে অদ্ভুত ব্যথা। সাবিত্রী বালার অঙ্গে অঙ্গে সুরতরঙ্গ কেবলই বেদনায় বেজে চলে। দুমড়ানো মুচড়ানো কষ্টে , অসহনীয় চাপা আতঙ্ক আর অভিমানে সাবিত্রীবালা হয়তো বোঝে শরীর থেকে মনটাকে আলাদা করতে হবে। কিন্তু কী আশ্চর্য মন কে ছুঁতে গিয়ে সে নিজের শরীরটাকে কন্ডুলী পাকিয়ে ধরে। এ দুইকে আলাদা করা যায় না যে! গভীর সে যাতায়াতের বাইরে তার যা কিছু সবই কি ধর্ষণ নয় ? যন্ত্রনায় একেবারে চুরমার তার চিন্তা , মাথা ভর্তি স্নায়ুর উদ্বেগ। ফলত তার দৃষ্টি হয়েছে আচ্ছন্ন।সাবিত্রী বালার এ পৃথিবীতে কিছু চাওয়ার নেই,পাওয়ার নেই, দেওয়ার নেই, একটা বাক্যও বলবার নেই কাউকে। শুধু কতগুলো এলোমেলো শব্দ, শব হয়ে যাওয়া সমাজের কানে যেন বা বৃথাই পৌঁছে দিতে চায় নাটকের শেষে। দর্শকদের অসাড় করে এলোমেলো শব্দের তালে তার শিব সুলভ নড়ে ওঠা আমাদের আগামীর গল্প শোনায়। শত চেষ্টার পরেও তার অসাড় হয়ে যাওয়া জিভ আছন্ন হয়ে যাওয়া বোধ অর্থপূর্ণ বাক্য তৈরি করতে পারে না। তার শেষত এই নির্বাক থেকে যাওয়াই সাবিত্রী বালার সবচেয়ে বড় শিল্পাকর্ষণ।

 
 
 
 
 
 
 
 

অনেকে যেমন উঁচু দরের অভিনয় করেছেন এনাট্যে তেমনি কেউ কেউ বড্ড নভীশ। মাধে মধ্যে তাল কেটেছেন। অনেক দলকেই প্রযোজনার প্রয়োজনে জেনে বুঝেই একাজ করতে হচ্ছে। মঞ্চ টি বড্ড ছিমছাম। একটি অসমাপ্ত প্রতিমার আদল নাটকের মূল সংকটটি কে ধরে রাখে পূর্বাপর। আলোর যাতায়াত টি চমৎকার। তবে নাটকের ডায়লগ কখনো কখনো অতিরিক্ত দীর্ঘ। বক্তব্যের ভারে কিছুটা ভারী , এবং সে জায়গা গুলিতেই কিছুটা অনাটকীয়, প্রেডিকটেবল এবং দীর্ঘ। তুলনায় প্রকাশ ও গ্রন্থনার কয়েকটি জায়গা বেশ ভালো। নাটকের আলো ভেবে দিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় জয় সেন। দেব চৌধুরী ভেবেছিলেন আবহ। কাজলশম্ভু শরীর বিভঙ্গ সৃষ্টিতে মন লাগিয়েছিলেন। এঁদের কাজ ভালো। সাবিত্রীবালার নাম ভূমিকায় সুচরিতা বড়ুয়া চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় মর্মস্পর্শী। তিনিই পালাকার ,তিনিই প্রধান প্রয়োগকর্তা। তাঁর আন্তরিক এই প্রযোজনা আরোও বহু দর্শকের নজরে আসুক। এই কামনা।

 
 
 
 
 

আমাকে অনুপ্রাণিত করেন পঙ্কজ ত্রিপাঠী" ব্যক্তি ও অভিনয় জীবনকে পরখ করে লিখলেন - অজন্তা সিনহা

 
 
 

অজন্তা সিনহা

 
 
 
 
 

অনুপ্রাণিত করেন এন এস ডি’র এই প্রাক্তনী

 
 
 

পঙ্কজ ত্রিপাঠিকে আমি প্রথম লক্ষ্য করি ‘চিল্লার পার্টি’ ছবিতে একটি ছোট চরিত্রে, এক মন্ত্রীর

 

ব্যক্তিগত সহকারী। অল্প কয়েকটি দৃশ্য, সামান্য সংলাপ—তাতেই মাত ! মনে পড়ছে কি অসাধারণ শরীরী

 

অভিনয় ! সচরাচর এই জাতীয় চাকরি যারা করে, তাদের মধ্যে চাটুকারিতা, হীনমন্যতার লক্ষণগুলি আচার-

 

ব্যবহারে ঘন ঘন প্রকাশ পায়। পঙ্কজ অসামান্য দক্ষতায় সেই বিষয়টি ফুটিয়ে তোলেন। এরপর তাঁকে আরও

 

অনেক বেশি বেশি দেখতে পাব পর্দায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র চিত্রনে, আমার এই সাধ পূর্ণ হয়নি। কারণ, বলিউড

 

তো বলিউডই ! পঙ্কজের মতো ‘বহিরাগত’দের সেখানে সহজে জায়গা হয় না।

 

ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার এই প্রাক্তনীর ফিল্মি সফর শুরু (হিন্দি ছবি / তার আগে একটি কন্নড় ছবিতে

 

কাজ করেন ) ২০০৪-এ, ‘রান’ ছবিতে একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। তারপর বিশাল ভরদ্বাজের

 

‘ওমকারা’, সেখানেও তাঁকে খেয়াল করে না কেউ। হিসেবমতো, প্রথম তিনি নজর কাড়ার সুযোগ পান অনুরাগ

 

কাশ্যপের ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’ সিরিজে, ২০১২’তে, একটি নেগেটিভ চরিত্রে কাজ করে। প্রসঙ্গত,পঙ্কজ

 

অভিনয় করেছেন ৬০টির বেশি ছবি ও সেই একই সংখ্যক টিভি সিরিজে। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলি

 

হলো ‘মিথ্যা’,’শৌর্য’, ‘অপহরণ’,’মশান’, ‘বরেলি কি বরফি’,’ফাকরে’,’নিউটন’,’স্ত্রী’। এর মধ্যে ‘নিউটন’ ও

 

‘স্ত্রী’তাঁকে যথার্থ ফুটেজ দেয় এবং পঙ্কজ তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন। এছাড়া, সোনি টিভি’র ‘পাউডার’-এ

 

ড্রাগ কিং নাভেদ আনসারির চরিত্রে পঙ্কজের অভিনয় ভোলেনি ছোটপর্দার দর্শক। তবে, সাম্প্রতিককালে

 

পঙ্কজের সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসার কারণ নিঃসন্দেহে পরপর ওয়েব দুনিয়ায় আসা দু’দুটি দুর্দান্ত

 

ক্রাইম সিরিজ—‘মির্জাপুর’ ও ‘স্যাক্রেড গেমস’।

 
 
 
 
 
 
 
 

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেগেটিভ চরিত্রগুলিকে পর্দায় জীবন্ত করে তুললেও, আদতে নিপাট ভদ্রলোক এই

 

অভিনেতা। আদ্যন্ত পারিবারিক বন্ধনে বিশ্বাসী পঙ্কজ তাঁর উত্থানের মুখ্য কৃতিত্ব দেন স্ত্রী মৃদুলাকে।

 

বলিউডে জায়গা করে নেওয়ার কঠিন লড়াইয়ের দিনগুলিতে মৃদুলা সম্পূর্ণ ভাবে তাঁর পাশে ছিলেন। চাকরি করে

 

সংসার চালিয়েছেন। যাতে পঙ্কজ নিশ্চিন্তে তাঁর অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন পূর্ণ করতে পারেন। একটি

 

সাক্ষাৎকারে পঙ্কজ বলেছেন, “আজও, আমরা একে অপরের পরিপূরক। থাকবোও চিরকাল। আমি শুটিং শেষে

 

বাড়ি ফিরতেই অভ্যস্ত। কোনও তথাকথিত ‘সোশ্যাল লাইফ’ নেই আমার। ফিল্মি পার্টিতে সচরাচর যাই না।

 

বন্ধুবান্ধব যারা, তারাও যে সবাই ইন্ডাস্ট্রির তা নয়। যে হোটেলে কাজ করতাম, পাটনা গেলে আজও সেখানে

 

যাই। পরিচিতদের সঙ্গে দেখা করি। ভালো লাগে।”

 
 
 
 
 
 
 
 

এন এস ডি, ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা ! অভিনয়ক্ষেত্রে আজও দেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নাম । এখানে

 

সুযোগ পাওয়ার জন্য তামাম স্বপ্ন দেখা তরুণকুল অপেক্ষা করে। এই এন এস ডি’তে পঙ্কজের এন্ট্রি, সেও

 

যেন এক সিনেমার গল্প। কি ছিল তাঁর জীবনযাপন, কোন পটভূমিতে এই মহার্ঘ দরজা নিজের জন্য খুলে ফেললেন

 

তিনি একদিন, শুনুন পঙ্কজের নিজের মুখেই। “অভিনয় করবো এমন কোনও স্বপ্ন দেখার কথা ভাবতেই পারতাম

 

না সেদিন। নিম্নবিত্ত এক কৃষক পরিবারের ছেলে আমি। তেমন লেখাপড়া শেখার সুযোগও পাইনি। বারো ক্লাস

 

পাশ করেছি। ক্ষেতের জন্য একটি ট্রাক্টর কেনা খুব দরকার। কিন্তু বাবার কাছে টাকা নেই। তখন বাবা

 

বললেন, তাহলে শহরে যাও, ডাক্তারি পড়ো। ডাক্তার হতে পারলে আর্থিক কষ্ট দূর হবে। পরে ট্রাক্টর কেনা

 

যাবে। তো, ডাক্তার তো হতে পারলাম না, পাটনায় এসে অ্যাক্টর হয়ে গেলাম।”

 
 
 
 
 
 
 
 

ওঁর কথায়, জীবনে কোনও কোনও সময় না পাওয়াটা আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। সে সময় ট্রাক্টর কেনার পয়সা ঘরে

 

থাকলে পঙ্কজের আর গ্রামের বাইরে আসা হতো না। বাইরে আসার দিন থেকেই অবশ্য কঠোর সংগ্রাম।

 

সেদিনের স্মৃতি উদ্বুদ্ধ করে তাঁকে আজও, বার বার জানিয়েছেন পঙ্কজ। গ্রাম থেকে প্রতিদিন ভোরে ৭

 

কিলোমিটার পথ হেঁটে স্টেশনে পৌঁছতে হতো ট্রেনে পাটনা আসার জন্য। এদিকে ডাক্তারি পড়ার সুযোগও তো

 

ক্ষমতার বাইরে। সেখানেও তো পয়সা, প্রভাব ইত্যাদির খেলা। শেষে শেফের ট্রেনিং নিয়ে পাটনার এক হোটেলে

 

কাজ শুরু করলেন। সারাদিন কাজ, সন্ধ্যায় থিয়েটার। জীবনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো তখনই। আর অন্য

 

এক লড়াইয়েরও শুরু।

 

এন এস ডি’তে প্রবেশের জন্য আরও ছয়-ছয়টি বছর অপেক্ষা করতে হলো পঙ্কজকে। সেখানে ভর্তির ন্যূনতম

 

যোগ্যতা স্নাতক। তাঁর তো সেই ডিগ্রি নেই। ভর্তি হলেন কলেজে। তিন বছর পর স্নাতক হয়ে আবার চেষ্টা।

 

ভাগ্যে শিকে আর ছেঁড়ে না। কিন্তু হতাশ হননি। লড়ে গেছেন। এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন,”আমার

 

সামনে তখন অনুপ্রেরণা নাসিরুদ্দিন, ওম পুরি, অনুপম খেরের মতো অভিনেতা। এঁরা সকলেই এন এস ডি’র।

 

অভিনয় যদি শিখতে হয়, এখানেই। আর প্রত্যাখ্যান ? তার জন্য তো শৈশব থেকেই প্রস্তুত আমি। হ্যাঁ, বাবার

 

সমর্থন পেয়েছিলাম। ওঁর শুধু একটাই প্রশ্ন ছিল, এখান থেকে পাশ করে চাকরি মেলে তো ? আমি আশ্বস্ত

 

করেছিলাম এই বলে, যে, সরকারি চাকরি পাব,শিক্ষকতা করার সুযোগ থাকবে। কলেজ তো বটে ! কিছু তো শিখছি!

 

জানি না সামনে কি আছে তখন। এটা জানতাম, কিছু একটা করবোই। আমার সরল সাদাসিধে বাবা সেকথা বিশ্বাস

 

করেন। পরিবারে একজন শিক্ষক, মন্দ কি !”( হাসি)

 

ছয় বছর পর এন এস ডি’র দরজা খুললো। পঙ্কজ তাঁর স্বপ্ন পূরণের প্রথম ঘাটটি পার হলেন। পঙ্কজের বাবা

 

নিশ্চয়ই আজ ছেলেকে নিয়ে যথেষ্ট গর্বিত। সারা দেশের সিনেমা,টিভি ও ওয়েবদুনিয়ার দর্শক আজ চেনে

 

বিহারের সেই অজগ্রামের ছেলেটিকে। তাঁকে নিয়ে নিঃসন্দেহে গর্বিত এন এস ডি’ও। হতাশ করেননি পঙ্কজ।

 

নাসির-ওমের ব্যাটন যোগ্য হাতেই পড়েছে, আজ তা প্রমাণিত।

 

আমাদের এই কলম মূলত ওয়েবসিরিজ কেন্দ্রিক। সিনেমা-টিভিতে পঙ্কজের অভিনয় স্বীকৃতি পেলেও,

 

‘মির্জাপুর’ ওয়েবসিরিজ যে তাঁর অভিনয়ের এক অন্য অভিমুখ খুলে দিয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই

 

সিরিজের জন্য (আই রিল) সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন তিনি ২০১৯’এ। কলীন ভাইয়ার চরিত্রে

 

পঙ্কজের অভিনয় এককথায় আন্তর্জাতিক মানের, একথা এখন দায়িত্ব নিয়েই বলা যায়। নেটফ্লিক্স,

 

আমাজন প্রাইম, ডিজনি হটস্টারের কল্যানে আমরা সবাই এখন এই পরিমাপটি করতে সক্ষম। ‘মির্জাপুর’এর

 

দুটি সিজনেই তিনি কামাল করা অভিনয় করেছেন। কার্পেট ব্যবসার আড়ালে ড্রাগচক্র চালায় অন্ধকার দুনিয়ার

 

বেতাজ বাদশা কলীন ভাইয়া। নেগেটিভ রোলকেও কতটা বুদ্ধিদীপ্ত, বিশ্বাসযোগ্য ও আকর্ষণীয় করে তোলা

 

যায়, পঙ্কজের অভিনয়ের মুন্সিয়ানায় তা প্রতিভাত এখানে, প্রতি পর্বে, দুটি সিজনেই। উত্তরপ্রদেশের

 

অপরাধ দুনিয়ার নিখুঁত চালচিত্র ‘মির্জাপুর’-এর তৃতীয় সিজনের ঘোষণা হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। টানটান এই

 

গ্যাংস্টার ড্রামায় কলীন ভাইয়া থুড়ি পঙ্কজ ত্রিপাঠির উপস্থিতি নিয়ে কোনও সন্দেহ রাখছেন না ওয়েব

 

দুনিয়ার দর্শক।

 

প্রতিষ্ঠা, জনপ্রিয়তা কোথাও আচ্ছন্ন করেনি এই চরম বাস্তববাদী অভিনেতার মননকে। সম্প্রতি এক

 

সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমার অভিনয় যদি আমার সহ অভিনেতাদের মধ্যে হীনমন্যতা বোধ জাগিয়ে তোলে,

 

তাহলে আমি বরং নিজের অভিনয়ের মান নামিয়ে আনবো।” নিজের কাজের প্রতি কতটা নিয়ন্ত্রণ থাকলে একজন

 
 
 

শিল্পী একথা বলতে পারেন, বুঝতে অসুবিধা হয় না। তারই সঙ্গে ধরা পড়ে তাঁর ভাবনা ও চেতনার ব্যাপ্তি,

 

উদারতা ও পরিণতমনস্কতা। প্রসঙ্গত,এদিন সাংবাদিক মহোদয়ের প্রশ্ন ছিল, “শুনেছি,আপনি সেটে থাকলে

 

আপনার সহ অভিনেতারা নাকি আত্মবিস্বাস হারিয়ে ফেলে। এটা কি সত্যি ?” সাংবাদিকরা এই জাতীয় প্রশ্ন

 

করেই থাকে। বিশেষত বিনোদন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে চমক ও বিতর্ক সৃষ্টির এটা চিরন্তন পন্থা। আমি নিজে

 

দীর্ঘদিন বিনোদন সাংবাদিকতায় থেকে এসব দেখতে ও শুনতে অভ্যস্ত। ফিল্মি তারকারা বেশিরভাগ সময়েই

 

এতে সাধারণত বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখান। প্রতিক্রিয়ার আবার জবাবী প্রতিক্রিয়া। চাপানউতর শুরু। অর্থাৎ

 

সাংবাদিকের উদ্দেশ্য সফল। কিন্তু পঙ্কজের ক্ষেত্রে সেটা হলো না। উনি হেসে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে যেটা

 

বললেন, সে তো আগেই বলেছি।

 
 
 
 
 
 
 
 
 

শোনা যায়,সেটে যাওয়ার পর পরিচালকরা নাকি পঙ্কজকে স্ক্রিপ্ট হাতে ধরিয়ে বলেন, উনি নিজের মতো শট

 

দিতে পারেন। এটা কি সত্যি ? জবাবে বিনয়ী পঙ্কজ,”আসলে ওঁরা আমার ওপর ভরসা করেন। যদিও আমি

 

ডিরেক্টরস অ্যাক্টর। একটা কথা বলতে পারি, নিজের অভিনয়ের কৃতিত্ব দেখানো নয়, আমি চেষ্টা করি

 

প্রতিটি দৃশ্য যেন উপভোগ্য হয়। ছবির বার্তা যা-ই হোক, তার প্রকাশভঙ্গি নিরস হলে দর্শক দেখবে না।

 

আমি সেকথা মাথায় রেখেই পুরো বিষয়টাকে মজাদার করার চেষ্টা করি।” ওঁর সহ অভিনেতা তো বটেই, পরিচালক

 

থেকে স্পটবয়, সকলেই পঙ্কজের গুণমুগ্ধ এই কারণেই। আদতে পঙ্কজের মতো গুণী ‘বহিরাগত’রা যে বলিউডের

 

রক্তমাংসের শরিক হয়েছেন, তা ইন্ডাস্ট্রির জন্যও যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শহর-

 

গ্রামের, এমনকী প্রত্যন্ত অঞ্চলের নতুন প্রতিভারাও সাহস ও বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে আসবে তো পঙ্কজের

 

মতো অভিনেতাদের দেখেই। পরিপুষ্ট হবে ভারতের অভিনয় জগৎ। আর দর্শকের প্রাপ্তির ঘর ? সেখানে তো

 

শুধুই তৃপ্তির জোয়ার !

সুশান্ত সেন এর বই "পুতুল নাচ"এর ইতিকথা তুলে ধরলেন

 
 
 
 
 

পুতুল নাটক

 

–সুশান্ত সরকার

 
 
 
 
 
 
 
 

নাটকের উৎসার যেমন লোকজীবন ও সমাজ থেকে, এবংপর নাটক সমাজ পরিপোষনের বদান্যতায়

 

বিভিন্ন বিভায় ও মাত্রিকতায় বিভাসিত পরিতাপের হলেও সত্য, পুতুলনাচ তথা পুতুল নাটক একই

 

লোকজ উৎসভূমি থেকে উৎসারিত হয়েও, অপরাপর বহু আচরিত লোকজ ধারার মতো

 

পড়িপোষন, লালন ও ভোক্তাদের অবহেলায় অপসৃয়মান প্রায়। এমনকি বাস্তবে কিছু কিছু

 

বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাতি লোক সাহিত্য ও সংস্কৃতি স্পর্শিত মাত্র। সেরকম পুতুলনাচ একই ভাবে

 

অবহেলিত। আরো বিস্ময়ের দিক যে, পৃথিবীর সবথেকে প্রাচীন ঐতিহ্যগত লোকজ সংস্কৃতি

 

হিসেবে পুতুলনাচ বা নাটক এর মূল্যায়নে, সংজ্ঞায় বাঙালি নৃজতি গোষ্ঠী সেখানেও অনিহাগ্রস্ত।

 

আত্মসচেতন বাঙালি সেপথে এখনও অগ্রসর একেবারে হননি বলাটা ভুল হবে, তবে তা

 

প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য। তবে এই পথে আশার আলো আসবে একদা এই বলে আমি

 

আমার আলোচ্য শুরু করছি পুতুলনাচ বা পুতুলনাটক প্রসঙ্গে।

 

পৃথিবীর প্রায় সমস্ত সভ্য দেশেই এক সুপ্রাচীনকাল থেকে বিচিত্রভাবে পুতুলনাচ প্রচলিত।

 

ইউরোপের লিখিত ইতিহাসের বিবরণে পাওয়া যায় — খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে ইউরোপে পুতুলনাচ

 

বা পাপেট্রি প্রচলিত ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশেও পুতুলনাচের ইতিহাস আরো প্রাচীন।

 

খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে রচিত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পুতুলনাচ বৃত্তির পরিচয় লক্ষ্যনীয়।

 

এছাড়াও গ্রিস, চেকোশ্লোভাকিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে কখনও শিক্ষা কখনও রামায়ণের

 

ছায়াতে পুতুলনাচ হয়েছে। আমরা সবাই জানি পুতুলনাচের সংজ্ঞায় – পুতুল নামক অচেতন জড়

 

পদার্থটিকে যখন কোনো মানুষ অভিনয়ের মাধ্যমে কিছু দর্শকের সামনে উপস্থিত করে, তখন তাকে

 

‘ পুতুলনাচ’ বলে। এবং তার সাথে যে মানুষ পুতুলকে যখন তুলে ধরেন এবং মানুষের মতোই পুতুলগুলোর

 

হাসি কান্না, আনন্দ- বেদনা, রাগ – অভিমান চরিত্র অনুযায়ী পোশাক পরিচ্ছেদ, এবং বিচিত্র

 

উপকরণের সাথে উঠে আসে সেই বিষয়কে পুতুলনাচ বলে।

 

এর উদ্ভব খানিক মতান্তর রয়েছে। পুতুলনাচের সাথে ‘ নৃত্য’ শব্দটি সংযুক্ত এবং বৈশিষ্ট্যগত

 

দিক থেকেও অভিনয় সমৃদ্ধ নাট্য ধারার বাহক। অনুমান করলে অসঙ্গত হবে না, নাটকের

 

উদ্ভবের আগেই পুতুলনাচের উদ্ভূত হয়ে পরস্পরকে প্রভাবিত করে থাকবে। অতঃপর দুটি

 

সাংস্কৃতিক মাধ্যমের মধ্যে সাদৃশ্য বা সমধর্মিতা সক্রিয় ভাবে বিদ্যমান। প্রাচীন নাট্য

 

ধারার মূল উৎস কৃষিভিত্তিক সমাজের উর্বরা শক্তির দেবোৎসবকে ঘিরে। এই উৎসবকে

 

কেন্দ্র করে যেসব নৃত্য – গীত- অভিনয় তাকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত — স্থাবর,

 

দ্বিতীয়ত — জঙ্ঘম। প্রথমটি কোনো স্থবির দেববিগ্রহে সামনে সংগঠিত হতো। যখন

 

দেবমাহাত্ম্যগীতি দীর্ঘ হয় তখন দ্বিতীয় অর্থাৎ পাঞ্চালিকা ( Puppet) বলা হয়। পাঞ্চালি

 

কথার অর্থ – কাঠ, কাপড়, হাতির দাঁত, চামড়া ইত্যাদি নির্মিত পূত্তলিকা বা পুতুল। সুতরাং

 
 
 

নাটকের সাথে পুতুলনাচের সম্পর্ক অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সংস্কৃত সাহিত্যে

 

✓নৃত ধাতুজাত নাটক শব্দটি তৎসমরূপে আজো গ্রাহ্য এবং অর্থ বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় —

 

যাবতীয় নাট্যকার্য অর্থাৎ অভিনয়। এ অর্থে নৃত্যগীত ও অভিনয় কার্যকে পুতুল দিয়ে

 

সম্পন্ন করলে তাকে পুতুলনাচ বলা অহেতুক নয়। সুতরাং পুতুলনাচ লোকজ সংস্কৃতির ঐতিহ্য

 

এবং প্রকান্তরে নাট্যকর্মও (Puppet theatre) বটে।

 

পুতুলনাচ প্রসঙ্গে প্রাচীনত্বের কিছু কিছু উল্লেখ এসে পড়েছে। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ

 

শতকে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে কুহক, প্লাবক প্রভৃতি সম্প্রদায় ছিল যাদের বৃত্তি ছিল

 

পুতুলনাচিয়ের। প্রাচীন অলংকারশাস্ত্র কাব্যদর্পণে নাটকের যে চতুঃষষ্টি কলা উল্লিখিত হয়েছে,

 

তার মধ্যে সাতাশতম কলা — সূত্র ক্রীড়া, অর্থাৎ ‘সূত্র সঞ্চালন দ্বারা পূত্তলিকাদি চালন’,

 

সহজ কথায় পুতুলনাচ। অন্যদিকে মহাভারত, মহামতি পতঞ্জলির উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষ্যনীয়।

 

বাংলাদেশের পুতুলনাচের ঐতিহ্য তাই সুদীর্ঘকাল জুড়ে। সুতরাং প্রভাব বিস্তার করেছে অনেকাংশ। ‘

 

শ্রীশ্রীচৈতন্যভাগবত’ গ্রন্থে ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীবৃন্দাবন দাস ঠাকুর পুতুলনাচের

 

জনপ্রিয়তার পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করেছেন — ‘ কাষ্ঠের পুতলি যেন, কুহকে

 

নাচায়।’ ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণদাস কবিরাজ ‘ চৈতন্য চরিতামৃত’ গ্রন্থে আদিলীলায় ৯ম

 

পরিচ্ছেদে উল্লেখ করেছেন — ‘ কাষ্ঠের পুতলি যেন, কুহকে নাচায়।’ অর্থাৎ, বিশ শতকের

 

আধুনিক শিল্পকলা হিসেবে এবং একবিংশ শতকে পুতুলনাচ বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় লোকজ সংস্কৃতি

 

রূপে সমাদৃত ও স্বীকৃত হয়ে চলেছে।

 

এখন প্রশ্ন পুতুলনাচকে পুতুলনাটক না বলে পুতুলনাচ বলা হবে কেন? এই প্রশ্নের মীমাংসা

 

করতে গেলে অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে যে বৈদিক ও সংস্কৃতে ✓নৃৎ ধাতুটি থেকে নৃত্য বা

 

নাচ শব্দটির উদ্ভব। ঋকবেদে নৃত্য শব্দটি পঞ্চমবেদ বা নাট্যবেদ হিসেবে পাওয়া গেলেও ভরত

 

মুনির নাট্যশাস্ত্রে ✓নৃৎ ধাতুজাত নাচ শব্দটি অভিনয় অর্থেই ব্যবহার হয়। বস্তুত ✓নৃৎ ধাতুটি

 

মৌলিক ধাতু নয়। নৃ শব্দ থেকে উৎপন্ন এবং প্রত্ননাম ধাতু। নাচের প্রধান তিনটি অঙ্গ হল —

 

অঙ্গহার, করেন ও নাট্য। ললিত অঙ্গভঙ্গির নাম অঙ্গহার, দুই বা তিনটি অঙ্গভঙ্গি একসাথে

 

করলে করন এবং আরো অনেকগুলো একসাথে করলে নাট্য। সুতরাং পুতুল নাটকের অভিনয়

 

প্রক্রিয়াটির সাথে অভিন্ন অর্থে নাচ শব্দটি সমন্বিত হয়ে পুতুলের নাট্য ক্রিয়ার সাথে অভিনয়

 

কলা হিসেবে প্রচলিত হয়েছে — এমন কথা বলা যেতে পারে।

 

পুতুলনাচের পুতুলগুলো নিশ্চল — অভিনয় করে না। তাদের অভিনয় — ক্রিয়ার সাথে নৃত্যের

 

সম্পর্ক আছে। অর্থাৎ নেচে নেচে অভিনয় করে। পুতুলকে যে ব্যক্তি অভিনয় করান, তিনি

 

সংলাপ অনুসারে অঙ্গভঙ্গির সাথে সাথে পুতুলগুলো চলাফেরা যন্ত্রের তালের সাথে ও নৃত্যের

 

ছন্দময়তায় অভিনয় সম্পন্ন করেন। আর যেহেতু পুতুল অভিনয় করে নাচিয়ের নাচের তালের সাথে

 

নেচে নেচে তাই একে পুতুলনাচ বলা অযৌক্তিক নয়। অন্যদিকে ছন্দায়িত দেহভঙ্গিমা

 

অভিব্যাক্তিকে দৃশ্য করে, আর পুতুলের ক্ষেত্রে দেহভঙ্গিমার সাথে সংলাপ সেই অভিব্যক্তিকে

 

দৃশ্য ও শ্রাব্য উভয়ই করে তোলে। তাই পুতুলনাচ নাম হলেও প্রকারান্তরে পুতুলনাচ অভিনয় শিল্প।

 
 
 

সঙ্গে মঞ্চ, পুতুলগুলির অভিনয় ক্রিয়া, চরিত্র অনুযায়ী পোশাক পরিচ্ছেদ, সাজ সজ্জা পুতুলনাচে

 

অভিনয় শৈলী স্থাপন করে যা মানুষের মতোই হাসি কান্না আনন্দ বেদনা ইত্যাদি অভিব্যক্তির

 

অভিনয় করে।

 

কোনো কোনো সমালোচক পুতুলনাচকে লোকসংস্কৃতির সাথে বিশেষ সম্পর্কযুক্ত মনে করেন না।

 

কিন্তু, লোকজীবন আচরিত এবং লোকপরম্পরা প্রচলিত এই সংস্কৃতিকে যদি লোকসংস্কৃতি বলে

 

বিবেচনায় আনা যায়, তাহলে পুতুলনাচ অবশ্যই লোকসংস্কৃতির অঙ্গীভূত। পুতুলনাচে আখ্যানসমূহ

 

নানান সামাজিক, ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক জীবনবোধ নিয়ে। বিশেষ করে ‘ রামায়ণ’,’ মহাভারত’,

 

কৃষ্ণলীলা এছাড়া মঙ্গলকাব্য,লৌকিক, প্রেম কাহিনী রয়েছে। এর মধ্যে অনেক কাহিনী পৃথক

 

ভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ঐতিহাসিক কাহিনীকে ভিত্তি করে নেতাজি সুভাষ, তিতুমীরের বাঁশের

 

কেল্লা পুতুলনাচ গ্রাহ্য করেছে। বর্তমানে সময়ের দাবিকে মাথায় রেখে বাদ্যযন্ত্রের বিপুল

 

পরিবর্তন এসেছে পুতুলনাচে। দর্শক মহলকে টানার জন্য ঢোল, খোল, কাঁসি, সানাই দোতারা কে

 

সরিয়ে রেখে তবলা, হারমোনিয়াম, বেহালা কর্নেটের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। প্রতিনিয়ত

 

প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে অন্যান্য সাংস্কৃতিক অঙ্গিকসমুহের সাথে। বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বিপুল

 

প্রয়োগ এই রেষারেষি থেকে থিয়েট্রিক্যাল আঙ্গিক গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে

 

সবথেকে প্রাচীনতম ঐতিহ্যের শিল্প।

 

পুতুলনাচ পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অনুসারে চার ভাগে বিভক্ত করা যায়। লাঠিরপুতুল,তারের পুতুল,

 

বেনীপুতুল ও ছায়াপুতুল। কিন্তু চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ছায়া পুতুলের নাম উল্লেখ হলেও

 

বিশ্লেষিত হয়নি। অর্থাৎ প্রচলিত দিক থেকেও পুতুল নাচ তিনটি প্রকারেরই হয়।

 

তারের পুতুলনাচ বলতে সুতোয় টানা পুতুলনাচের কথাই বলা হয়েছে। জীবিকা নির্বাহের জন্য

 

অনেকাংশে পেশা হিসেবে বেছে নেন অনেকেই। পুতুল গুলো মাথা থেকে কোমর বা তার সামান্য নিচু

 

অংশ পর্যন্ত শোলা জমিয়ে পুতুলের অবয়ব তৈরি করে। উচ্চতায় দুই আড়াই ফুট হয়ে থাকে। নাচিয়ের

 

হাতে যোগ চিহ্ন আকারের একটা চারমুখো লাঠির সঙ্গে বেঁধে গানের সুরে, তালে পুতুলগুলো নাচিয়ে

 

থাকেন। বিশেষত যাত্রাপালাকে অবলম্বন করে গড়ে তোলা হয়। ও লোকজ যাত্রা পৌরাণিক,

 

সামাজিক এবং ঐতিহাসিক কাহিনী ব্যক্ত হয়ে থাকে তারের পুতুলনাচে।

 

লাঠি পুতুলনাচ হল লাঠিপুতুলকেই ডাঙের পুতুল বা দণ্ড পুতুল। ডাঙ শব্দের অর্থ দণ্ড।অর্থাৎ

 

লাঠি। যে পুতুলকে লাঠি বা দণ্ডের সাথে নাচানো হয় মঞ্চে সেই শ্রেণীকে লাঠি পুতুলনাচ বলে। লাঠি

 

পুতুল যারা নাচান তাদের বলে প্লেয়ার। বিশেষত যে সমস্ত মঙ্গলকাব্য সেগুলো লাঠি পুতুলনাচের

 

বিষয়। মূলত দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা অঞ্চলে বিশেষ ভাবে লক্ষ্যনীয়। কিছু কিছু দল যাদের নাম

 

পশ্চিম বাংলায় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে সরস্বতী পুতুলনাট্য সমাজ, স্বপনপুরী পুতুলনাট্য

 

সমাজ ইত্যাদি। বাংলাদেশেও এরকম অনেক নাম এই ঐতিহ্য কে টিকিয়ে রেখেছে অক্লান্ত

 

পরিশ্রমে।

 
 
 

বেনীপুতুলনাচ বা দস্তানা পুতুলনাচ হল দুই বা তার বেশি ছোট ছোট পুতুলকে যখন জনসমক্ষে দুই হাতের

 

আঙ্গুলের সাহায্যে নাচানো হয়। সেগুলোই বেনীপুতুলনাচ। হাতের পাঁচটি আঙ্গুলের মধ্যে ঢুকিয়ে

 

নাচানো হয় তাই এর নাম ইংরেজিতে Glove বাংলা পরিভাষায় দস্তানা। তারাপদ সাঁতরা এই শ্রেণীকে

 

হাতনাচনা পুতুলনাচ বলে উল্লেখ করেছেন। বিশ্বের বিশেষ করে জার্মানি, জাপান,রাশিয়া,

 

ব্রাজিল, সুইডেন, হাঙ্গেরি এই পুতুলনাচের প্রচলন রয়েছে। কোনো সমালোচক বলেছেন যে এটি

 

পুতুলনাচের মধ্যে সবথেকে প্রাচীনতম পুতুলনাচ।

 

ছায়াপুতুলনাচের প্রচলন বাংলাদেশ পশ্চিম বঙ্গের কোথাও নয়। বর্তমান ভারতবর্ষের কেরালা

 

রাজ্যে ছায়াপুতুলনাচের সংখ্যাই বেশি। পাশ্চাত্যে যে পুতুলনাচ নাটক হিসেবে প্রচলিত এই নাট্য

 

আঙ্গিকে মানুষ যখন পুতুলের মতো সেজে মঞ্চে অবতীর্ণ হয় অথবা সেই পুতুলরূপ মানুষের

 

ছায়াকে আলোয় প্রতিফলন পর্দায় প্রতিবিম্বিত করে পুতুলনাচের ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ১৯৬১

 

খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকায় peter schumann ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে জাতীয় আন্দোলন সৃষ্টি করার

 

জন্যে প্রতিষ্ঠা করেন The Bread and Puppet Theatre। এই নাট্য প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি মানুষের

 

কাছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের দৃশ্যগুত ভাবে ছায়াপুতুলের মাধ্যমে তুলে ধরার প্রয়াস করতো। সুতরাং

 

সমাজ সংস্কারক, রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে এই চায়াপুতুল নাচ ব্যবহার হতো।

 

পুতুলনাচের প্রত্যেকটি ধারা বাকি অন্যান্য শিল্পের সাথে সার্থক মিলন ঘটেছে সে বিষয়ে সন্দেহ

 

নেই। এবং প্রত্যেকটি শিল্প মাধ্যমের একত্র ব্যাখ্যা পরিপূর্ণ করে গড়ে উঠেছে পুতুলনাচ। তবে

 

আধুনিক সময়ে এই মাধ্যম কোথাও গিয়ে রেষারেষির কবলে পরেছে। লোকজ সংস্কৃতির যে অন্যতম

 

উদাহরণ আজ মানুষের আড়ালে চলে যাচ্ছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়কে

 

পুতুলনাচের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হচ্ছে, যায় ফলে লোকজ সংস্কৃতির ধারাটি একটা সময়ে

 

গিয়ে আগের মতো স্থানে থাকছে না খর্ব হচ্ছে। নানান দল বন্ধ হচ্ছে, টিকিটের যথাযথ

 

মূল্য উঠছে না। নাচিয়েরা অন্য কাজে ব্রত হচ্ছেন। তবে আশার কথা থেকেই যায় বাংলাদেশ

 

পুতুলনাচ বেশ খানিকটা দূরে এগিয়েছে। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে পাপেট বা ফিগার ফেস্টিভ্যাল

 

১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বরে কোলকাতায় আন্তর্জাতিক পুতুলনাচ প্রদর্শনী টিকিয়ে রেখেছে

 

আমাদের সবচেয়ে প্রাচীন এই ঐতিহ্য কে সবার মধ্যে। সবের মধ্যে টিকে থাকার এই লড়াইয়ে

 

আমরা যাতে এই বিষয়কে শিল্পশ্রেনীর ভাগ থেকে আলাদা না করে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা

 

করি তাহলে আমাদের অধ্যায়টি বিচ্যুতি হবে না।

 

উল্লেখযোগ্য ভাবে রাজা হরিশ্চন্দ্র, নিমাই সন্ন্যাস, প্রভৃতি নতুন পুতুলনাচের পালা দক্ষিণ

 

বাংলা বিশেষ করে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে সুতোয় টানা পুতুলনাচের দল গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন

 

করেছে। দুঃখের কথা রচয়িতার নাম জানা যায়নি।

 
 

"নাটকের নির্মাণ হয় দর্শকের কল্পনা ও চেতনার রঙ্গমঞ্চে" লিখলেন - শরণ্য দে

 
 
 

শরণ্য দে

 

 

 

মঞ্চের উপরে এক অভিনেতা এসে দাঁড়ালো – উপরের দিকে তাকিয়ে বললো, ” ওই দেখো চাঁদ ” – ওই

 

প্রেক্ষাগৃহে বসে থাকা প্রত্যেকটি লোক সেই চাঁদ দেখতে পারবে, এবং মজার ব্যাপার হলো প্রত্যেক লোক

 

তাঁর নিজের মতো করে সে চাঁদ দেখবে – তাঁর নিজের কল্পনা, নিজের অভিঘাত অনুযায়ী, এবং হয়তো সেই

 

একি দর্শক ওই নাট্যটির অন্য আর এক শো তে অন্য আরেক রকমের চাঁদ দেখবে । মোদ্দা কথা দাঁড়ালো

 

নাটক মঞ্চে নির্মাণ হয়না, নির্মাণ হয় দর্শকের কল্পনা এবং চেতনার রঙ্গমঞ্চে, যেটা মঞ্চে হয় সেটা

 

একটা উপাদান ওই কল্পনাকে প্রজ্জলিত করবার কিন্তু ওটাই আসল নয় । এবং থিয়েটারের এটাই হলো মূল

 

শক্তি – রবীন্দ্রনাথের কথা ধার করে বলতে গেলে – যা আছে তা দিয়ে যা নেই সেটা সৃষ্টি করা । থিয়েটার

 

হলো “জীবত শিল্প ” কারণ এই মুহূর্তের বেঁচে থাকা, মুহূর্তের আদান প্রদান, মুহূর্তের অভিঘাত – এ সবই

 

ক্ষণস্থায়ী । এটার কোনো রেকর্ডিং হয়না, সঠিক রূপে সংরক্ষন হয় শুধু দর্শকের কল্পনা এবং চেতনাতে ।

 

এই মূল সত্যটাই ভুলে বসেছে ভারতীয় মূল ধারার থিয়েটার । সমস্যাটার শুরু ইউরোপের Realism আর

 

Naturalism এর অন্ধ অনুকরণের জন্য । Ibsen যখন ন্যাচারালিস্টিক থিয়েটার লিখছেন – সেটা এক

 

অর্থে ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক দাবি । Doll’s House এর যে পুরুষতন্ত্রের সূক্ষ শোষণ নীতির বিরুদ্ধে

 

গলা তোলা – তাঁর জন্য হয়তো এই বাস্তববাদী রিপ্রেসেন্টেশনের দরকার ছিল – কিন্তু তাঁর সময় ফুরিয়ে

 

এসেছিলো । Brecht থেকে Brook সবাই রিয়ালিসম থেকে বেড়িয়ে এসেছে । এবং কি স্টানিসলাভস্কি, যাকে

 

রিয়ালিস্টিক থিয়েটার শৈলীর দিকপাল হিসেবে ধরা হয়, শেষ জীবনে রিয়ালিসম থেকে বেড়িয়ে আসে । এর

 

কারণ কি?কারণ হয়তো অনেক খুঁজে পাওয়া যেতে পারে – সামাজিক রাজনৈতিক – কিন্তু Art এর দৃষ্টিকোণ

 

থেকে দেখতে গেলে রিয়ালিসম আসলে থিয়েটারর জন্য একটি শৃঙ্খলা ছাড়া আর কিছুই নয় । রবীন্দ্রনাথ

 

এটিকে বলেছেন, ” পাশ্চাত্য বর্বরতা ” ।

 

সমগ্র এসিয়ার ক্লাসিকাল ও ফোক থিয়েটার যদি পর্যবেক্ষণ করা হয়, দেখা যাবে যে রিয়ালিসম কখনো

 

থিয়েটারের অঙ্গই ছিলোনা । ভারতীয় থিয়েটারের মূল ক্ষমতাই হলো স্বল্প সামগ্রী দিয়ে বৃহৎ ছবি আঁকা

 

কল্পনার চিত্রপটে । ধরা যাক এক কুড়িয়াট্টম শিল্পী যখন মহাভারতের যুদ্ধের বর্ণনা করে কিংবা একটা

 

পান্ডবনী শিল্পী যখন অভিমন্যুর মৃত্যুর শোক উজ্জাপন করে – মঞ্চে না থাকে রথ, না অস্ত্র, না যোদ্ধা –

 

শুধু থাকে এক শিল্পী এবং তাঁর অভিনয়ের ক্ষমতার জোরে তৈরী হয় ভিন্ন দৃশ্য, দৃশান্তর, ঘাত প্রতিঘাত

 

বিভিন্ন অনুভূতির চলচিত্র – এবং এই সব কিছুই তৈরী হয় দর্শকের কল্পনায়, দর্শকের চেতনার অন্তরালে

 

। Grotowtski বলেছিলেন শুধু একটি অভিনেতা ও একটি দর্শক লাগে নাট্য নির্মাণের জন্য । Grotowski

 

ভারতীয় উপমহাদেশের থিয়েটার থেকে নিয়েছিলেন এই মিনিমালিসমের প্রয়োজনীয়তা , কিন্তু আমরা

 

নিজেদের থিয়েটার প্র্যাক্টিসেই আমাদের দেশের থিয়েটারের কথা ভুলে গেছি – যা আছে তা হলো ফাঁপা

 

রিয়ালিমের অনুকরণ – যেই রিয়ালিসম কে ইউরোপ বর্জন করে দিয়েছে বহুকাল আগে ।

 

মিনিমালিসম কে আপন করাটা রাজনৈতিক ভাবেও খুব দরকারি । একটি তৃতীয় বিশ্বর নাগরিক আমরা, একটি

 

তৃতীয় বিশ্বর থিয়েটার শিল্পী – যে দেশে এখনো সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার চাহিদা মেটাতেও বহু লোক অপারগ ।

 

সেই দেশের থিয়েটারের আঙ্গিক কেমন হবে? থিয়েটারের ফর্ম কেমন হবে? আমরা কনটেন্ট নিয়ে অনেক

 

মাথা ঘামিয়েছি, IPTA এর পরে আমরা দেখেছি গ্রুপ থিয়েটারে কিভাবে প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার গল্প,

 

অপরিসীম লড়াই জায়গা করে নিয়েছে – কিন্তু ফর্ম নিয়ে মাথা ঘামাবে কে? বাদল সরকার বলেছেন

 

কনটেন্টই ফর্মের জন্ম দেয়, কিন্তু বাংলা থিয়েটারে তা হলো কোই? এক লক্ষ টাকার সেট ব্যবহার করে

 

তাঁর উপরে না খেদে পাওয়া মানুষের দূঃখের কথা বলা একই সাথে ironic এবং হাস্যকর বিলাসিতা ।

 

Minimalism কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের থিয়েটারের মূল ফর্ম, কারণ এই হতভাগা গরিব দেশের আদর্শ কখনো

 

Broadway এর বিশাল বিলাসবোহুল সেট হতে পারেনা – আমাদের দেশের আত্মা থেকে বেড়িয়ে আসা যে

 

minimal theatre technique এবং প্রয়োগ, সেটাই এই দেশের আদর্শ ফর্ম, এবং থিয়েটারের একমাত্র

 
 
 

শক্তি । রাজনীতি কখনোই শুধু কন্টেনটে সীমাবদ্ধ থাকতে পারেনা, সেটা তাহলে সেই শিল্পের ব্যর্থতা,

 

রাজনীতি শিল্পের কনটেন্ট এবং ফর্ম দুটোকেই প্রভাবিত করবে, সেটাই আদর্শ হওয়া উচিত । ধরা যাক

 

নবারুণ ভট্টাচাৰ্যর কথা । উনি কিন্তু শুধু নিজের রাজনীতি কে কন্টেনটে ব্যবহার করছেননা । ওনার

 

কনটেন্ট যেমন প্রচন্ড ভাবে anti elitist, একই ভাবে ফর্ম এবং ভাষা ও উপন্যাস শৈলীর bourgeoisie

 

complacency এবং hegemony কে সজোরে ধাক্কা মারে, এবং এখানেই শিল্প হয় উঠে প্রাসঙ্গিক এবং

 

গুরুত্বপূর্ণ ।

 

Minimalism আর একটি বড়ো কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয় দাঁড়ায় কারণ থিয়েটার নামক শিল্পটা কে না চাইতেও

 

ফিল্মের সাথে পাল্লা দিতে হয়, এবং যথারীতি সে পাল্লায় ব্যর্থ হয় – তাঁর একটা বড়ো কারণ হলো

 

রিয়ালিসমের দাসত্ব । একটি ফিল্ম যতটা রিয়ালিস্টিক হতে পারে, থিয়েটার পারেনা – মানে যদি একটি ঘর

 

আমি ক্যামেরাতে বন্দি করি সে যতটা রিয়েল হবে, একটি মঞ্চকে যতই TV, ফুলের টব আর জানলা দিয়ে

 

সাজাক – সেটা মঞ্চই থাকবে, ঘরের রিয়ালিটি তাতে থাকবে না । এটা কি থিয়েটারের লিমিটেশন? একেবারেই

 

না । এটা থিয়েটারের শক্তি যে সিনেমার মতো সব কিছু দেখাতে হয়না – দুটি অভিনেতা যদি দুটি কিউবে বসেও

 

চা এর কাপ নিয়ে কথা বলে, সেটা দর্শকের কল্পনাতে একটি ঘর হিসেবে ফুটে উঠবে । যদি realism এর

 

যুদ্ধে চলচিত্রের সাথে লড়তে হয়, ব্যর্থতা তো সুনিশ্চিত – এ অনেকটা যেন সচিন কে বলা ফুটবলে

 

মারাদোনা কে হারিয়ে দেখাও। খুব দুঃখ লাগে যখন ক একজন নাম করা পরিচালকদের সাথে কথা বলে বুঝি যে

 

তাড়াও থিয়েটারের ফিজিক্যাল লিমিটেশন কে আর্টের লিমিটেশন ধরছে । আসলে এই ভাবনা থিয়েটারের যে

 

বিস্তৃত ব্যাপকতা তাকে ক্ষুদ্র করে তলে, এর থেকে সৃষ্টি হয় হীনমনতা এবং হীনমনতা দিয়ে মহৎ শিল্প

 

সৃষ্টি হয়না । আমি যে কথাটা শুরুতেই বলেছি ওটা আবার বলবো – থিয়েটার তৈরী হয় দর্শকের কল্পনার

 

রঙ্গমঞ্চে – এই সহজ বৈজ্ঞানিক সত্যটা যদি অস্বীকার করা হয় আর কলোনীয়াল হ্যাং ওভারের জন্য

 

রিয়ালিসমের দাসত্ব করতে হয়, তাহলে এ শিল্পের মৃত্যু খুব শীঘ্রই ঘটবে । সিনেমা একটি objective

 

reality এর শিল্প ও থিয়েটার হচ্ছে subjective reality এর শিল্প । পুরোনো উদাহরণটা ঝালিয়ে নিলে বলতে

 

হয় – অভিনেতা মঞ্চে চাঁদ বললে দর্শক নিজের মতো করে চাঁদ টা দেখে নেয়, কিন্তু সিনেমাতে অভিনেতার

 

বলার পরেও একটি চাঁদের শট রাখতে হবে । এটা কিন্তু আসলে সিনেমার লিমিটেশন যে সে দর্শকের কল্পনা

 

ব্যবহার করতে অপারগ, এই মিডিয়ামে সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু থিয়েটারের এখানেই ক্ষমতা কিন্তু আমরা

 

তা বুঝতে চাইছিনা । “সেট দেখিয়ে চমকে দেবো ” এই মানুষিকতা নিয়ে কাজ করে শুধু ক্ষমতা ও টাকার

 

আস্ফালনই হচ্ছে, শিল্প তাতে বাঁচচে কোই?

 

আসলে আমাদের মুক্তি আমাদের শিকড়ে । Grotowski, Brook, থেকে Richard Schechner সবাই

 

minimalism এর শিক্ষা নিয়েছে সাউথ এশিয়ান থিয়েটার থেকে, কিন্তু এই Colonial hegemony আমাদের

 

মাটির থিয়েটার থেকে করে তুলেছে বিচ্ছিন্ন । আমি বলছিনা আধুনিক থিয়েটার হবে একটি কুড়িয়াট্টম

 

পারফরমেন্স কিংবা একটি গম্ভীরা – আমাদের চেতনাতো আধুনিক হতেই হবে, আধুনিক সমাজের সামাজিক

 

ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তো থাকতেই হবে কিন্তু মূল কথা হলো ফর্ম হতে হবে মিনিমাল। আমাদের শিকরড়ের

 

থিয়েটারের আঙ্গিকে যে মুক্তি আছে সেটাকে যত্নে লালন করতে হবে কারণ ওখানেই লুকিয়ে আছে

 

ব্যাপকতা । স্টানিসলাভস্কি কিংবা Brecht এর সাথে আমাদের রবীন্দ্রনাথের “রঙ্গমঞ্চ”প্রবন্ধটিও

 

বারবার করে পড়া উচিত । আমাদের শকুন্তলা করতে গেলে মঞ্চে সত্যি কারের রথ তুলে দিতে হয়না,

 

দুশমন্তের মৃগয়া দৃশ্যতে । এই ঐপোনিবেসিক দাসত্ব থেকে বেড়িয়ে, নতুন থিয়েটারের ভাষার অনুসন্ধান

 

করতেই হবে, না হলে কিন্তু একই গোলোকধাঁধাতে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয় যেতে হয় ।

একসঙ্গে বসে মেহেদি হাসান আর শচীন দেব বর্মন কি শোনা উচিত?"কথা পাড়লেন - স্নিগ্ধদেব সেনগুপ্ত

গায়কের গেরো – দ্বিতীয় পর্ব

 

 

 

আত্মপক্ষ: গায়ক আর শ্রোতার মধ্যে একটা পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক থাকা উচিৎ। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। শিল্পীদের দূর আকাশের তারা মনে হচ্ছে না আর। তাদের এখন ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো যাচ্ছে। কমেন্ট বক্সে ইচ্ছে করলে কাছা খুলে নেওয়া যাচ্ছে। তাই দূরত্ব থেকে আসা সমীহটা চলে গেছে। সব মানুষ তো সমান হয় না। অনেকে অতি অভদ্র হয়। অনায়াসেই সৌজন্যের বেড়া টপকাতে পারে। এই লেখার “আমি” হচ্ছে তেমন এক অতি অভদ্র, মুখফোড় গায়ক। তার শ্রোতাদের প্রতি তেমন শ্রদ্ধাটদ্ধা নেই। সে নিজেকে নিয়ে সদা সচেতন, সিরিয়াস। মাঝেমাঝে খানিকটা আত্মপ্রচারমুখী। এই “আমি” চরিত্রটা কাল্পনিক কিনা সেটা নিশ্চিতভাবে জানতে পারলে বলে দেব। বাকি সব চরিত্রই ঘোর বাস্তব। দ্বিতীয় পর্ব আচ্ছা, শচীন তেণ্ডুলকর উইকেট কিপিং করতে পারেন কিনা, সেই নিয়ে আপনি কোনওদিন মাথা ঘামিয়েছেন? মেসির গোলকিপিং-দক্ষতা পরীক্ষা করা হয়নি বলে তাকে বিশ্বসেরা বলতে কুন্ঠিত হয়েছেন কি? কখনও কোনও চাইনিজ রেস্তোরাঁতে গিয়ে সেখানকার শেফ মুড়িঘণ্ট ভাল রাঁধেন কিনা খোঁজ নিয়েছেন? কিন্তু, গায়ক হলেই মুশকিল। আপনাকে হতে হবে “ভার্সেটাইল”। এর কোনও লক্ষ্যভেদী বাংলা নেই। একজন ভার্সেটাইল কণ্ঠশিল্পীকে “মঙ্গলদীপ জ্বেলে” দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করতে হবে। তারপরে “অ্যায়সি লাগি লগন”, “আমার ভিতর বাহিরে”, “পেয়ার কা পেহলা খত”, “দমাদম্ মস্ত কলন্দর”, “মেরা কুছ সামান”, “মিলন হবে কতদিনে”, “জীবনে কী পাব না”, “লুঙ্গি ডান্স”… ইত্যাদি মোটামুটি দক্ষতায় গাইতে হবে। তারপর হয়তো গুছিয়ে কোমর বেঁধে “দো ঘুঁট মুঝে ভী পিলা দে” দিয়ে সমবেত মাতালমণ্ডলীকে নাচিয়ে শেষ করতে হবে। এর মধ্যে ক্লাসিকালের ওজন বইতেও যে তিনি সক্ষম, সেটা প্রমাণ করতে মাঝারি দক্ষতার তান-সরগমের ফোয়ারা ছুটিয়ে “বাজে গো বীণা” বা “লাগা চুনরি মে দাগ” বা “জোছনা করেছে আড়ি” যাবে আসবে। এক-আধবার সম-ফাঁক উলটে যাবে, কিন্তু তার জন্য কেউ “মনে কিছু লিবেন না”। বিয়েবাড়িতে লোকজনকে দূর থেকে খেতে দেখবেন কখনও মন দিয়ে। দেখবেন কেমন অনায়াসেই ঘোরতর গরমিলের খাদ্যবস্তু লোকে কিছু না ভেবেচিন্তে গিলে যাচ্ছে। কড়াইশুঁটির কচুরি ঢেকে যাচ্ছে পাতুরির কলাপাতায়। “নবরত্ন কারির” ঝোল গড়িয়ে বিরিয়ানির চালের তলায় সেঁধিয়ে যাচ্ছে। অথচ কারুর কোনও বিকার নেই। গানের অনুষ্ঠানে শ্রোতাও প্রধানত এঁরাই। নিঃসংকোচে পান্নালাল দিয়ে গুলাম আলী মেখে গিলে নেবেন। শেষপাতে হানি সিং এর চাটনিতে টাকনা দেবেন। এই চাহিদা যাঁরা পূরণ করতে পারেন, তাদেরই বলে “ভার্সেটাইল”। পৃথিবীতে এই একটিই পেশা আছে – কণ্ঠসংগীতশিল্পী – যাঁদের থেকে এমন প্রত্যাশা করা হবে। রিয়েলিটি শোতে বিচারকরা কোনওদিন বলবেন না যে ভীমসেন যোশী বা নির্মলেন্দু চৌধুরী বা দেবব্রত বিশ্বাস বা এলভিস প্রেসলি বা এম. এস. সুব্বলক্ষ্মী বা আবিদা পারভীন “ভার্সেটাইল” নন। এটা তো বলবেনই না যে, সাধারণত কেউ ভার্সেটাইল হন না। প্রত্যেকের একটা নিজের পাড়া থাকে – নিজের দাপটে বিচরণ করবার এক একটা ক্ষেত্র থাকে। তাঁরা “লতাজী” আর “রফি সাহাব”-এর উদাহরণ দেবেন। তাতে মানুষের নিয়ম আর ব্যতিক্রম গুলিয়ে যাবে। আর সবাই ভাববে “এক্সপার্ট” যখন বলছে, তখন ভার্সেটাইল না হওয়াটা নিশ্চয়ই একটা খামতি। শ্রোতারা, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জিগেস করুন আপনারা নিজেরা ভার্সেটাইল কিনা। ক’দিন একসঙ্গে বসে মেহেদী হাসান আর শচীন দেববর্মণ শুনেছেন? শোনা যায় কি? শোনা উচিৎ কি? শুনলে কার প্রতি সুবিচার হত? উত্তর সবাই জানেন। কেউ ভাবা প্র‍্যাকটিস করেন না বলে ওই ভার্সেটিলিটির প্রত্যাশা দানা বাঁধতে থাকে। একটু ভাবতে কী হয়! শুধুই চন্দ্রমুখী আলুর দাম পড়ল কিনা, আর ছেলে আজ টিউশনে গেল কিনা… এই ভেবেই জীবন কাটবে? ভাবনাটাকে একটু বহুগামী করুন না। একটু “ভার্সেটাইল” হন।

ইতিহাস ও স্মৃতির পথ দিয়ে নানা মঞ্চের সন্ধান চালালেন অমর চট্টোপাধ্যায়

 
 
 

অমর চট্টোপাধ্যায়

 

 

 

ভাড়া করা চেনা স্টেজে থিয়েটার করার সময় চিন্তা কম হয় কিন্তু বাইরে কোথাও গেলে ভাবনা আসে স্টেজটা কেমন ? মাপ ঠিক থাকবে তো ? চারটে উইং, অন্তত তিন ফুট এ্যপ্রোন থাকবে বলেছে , পাবো তো? হরেক ভাবনা ভীড় করে। এমন মঞ্চ যদি না-ই হয় !! নিজের কথা বলি প্রথমে – – “এবার যেতে হবে রে । আর খাস না।” সারা দুপুর সবুজ ঘাসে চড়েছে একাদশী। সাথে আমি, সবুজ আম – আমলকী গাছের নীচে নীচে । মেঘের চাদরে ভেসে চলে যাই মার কাছে । আবার ফিরে আসি। বিকেল হল, ফিরতে হবে পিসিমার বাড়ি । পঞ্চাশের মধ‍্যভাগে বিশ্বভারতীর এলাকায় এত ব‍্যারিকেট ছিল না। আজ বুধরার । ক্লাস ছুটি । ভোরে উপাসনা মন্দিরে গান শুনেছি। সন্ধের সময় যাব লাইব্রেরীতে। কিছু না কিছু হবেই । ফেরার সময় পিসিমা দেবে কিছুমিছু – ঠোঙা ভরা বাদাম ভাজা । হাতে মোড়া তেকোনা ঠোঙা । দশটির বেশি চিনে বাদাম ধরে না তাতে। শালবীথি থেকে একধাপ উঁচুতে লাইব্রেরীর বারান্দা। সঙ্গীত ভবনের দাদা দিদিরা প্রতি বুধবার কিছু না কিছু করবেই । বারান্দার সামনে শাল বীথির পরে মাঠ । তারপরে ঘন্টাঘর। এই মাঠ আর শালবীথি জুড়ে তখন বসন্ত উৎসব হত। লাইব্রেরির সামনের মাঠে আসন পেতে বসে পরতাম। পিসিমাও বসত আসন পেতে। ক্লাসে বা জলসায় সবাই আসন হাতে আসত । এভাবেই দেখে ফেলেছি গুরুদেবের প্রায় সবকটা নাটক। এই তো গত বছর ১ লা বৈশাখে শান্তিনিকেতনে চণ্ডালিকা দেখলাম। লাইব্রেরী মাঠে এখন একটা উঁচু বেদী তৈরী হয়েছে। চারিদিক খোলা । প্রসেনিয়ামের গন্ধ এখনও ঢোকেনি আশ্রমে । রসভঙ্গ হয়েছে কোথাও এমন তো মনে হল না। * * * * * * ষাটের দশকের প্রথম ভাগ । আমি পড়ি ক্লাস সিক্সে , বার্ণপুর মাল্টিপারপাস হাই স্কুলে যার সাথে আমার পূর্বস্মৃতি কখনোই মেলেনি। পুজোর ছুটিতে পিসিমা আসতেন শান্তিনিকেতন থেকে সপরিবারে। এমনি এক ছুটিতে আমার শান্তিনিকেতনের স্মৃতি হাতরে বের করলাম নাটক ‘ টাকডুমাডুম’। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর লেখা। দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র সত‍্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী ছিলেন বিদুষী মহিলা। ঠাকুরবাড়ির ‘ বালক ‘ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক জ্ঞানদানন্দিনী বাড়ির অন্দরমহলে আটকে থাকেন নি। যাক এ অন‍্য প্রসঙ্গ, অন‍্য কোন দিন। দাদা, দিদি ভাই বোন সবাইকে বললাম টাকডুমাডুমের কথা। পূজোয় নাটক হবে, সে কী আনন্দ ! রিহার্সাল শুরু হল। নাটকের সরঞ্জাম জোগাড় চলতে থাকল পাশাপাশি। মার থেকে আলতা, বড়দির কাছ থেকে পেলাম ফেস পাউডার আর পাতা কাজল( তখন ঘরে কাজল পাতা হ’ত)। ভূষোকালির দায়িত্ব কালিকাকার । জ‍্যাঠামশাই কাঠের নরুন আর বনস্পতির গোল টিন দিয়ে ঢোল বানিয়ে দেবেন। মনোহরকাকু নারকেল ঝাঁটা দিয়ে শেয়ালের লেজ বানাবে আর সবাইকে পোষাক পরিয়ে দেবে।বলা বাহুল্য যে পরিচালক আমি। ষষ্ঠীর দিন শান্তিনিকেতন এলো বার্ণপুরে। আমাদের আর‌ও আনন্দ, পিসেমশাই তো আমাদের বন্ধু ! সত্যি, বিশ্বভারতীর নামকরা শিক্ষক ছোটদের মাঝে অনায়াসে ছোট হয়ে যেতেন। নাটকে আলো দেবার দায়িত্ব তাঁর, সহকারী মনোহরকাকু। নবমীতে নাটক। সকাল থেকে সবাই ব‍্যস্ত,এমনি এমনি। সে এক রৈ রৈ ব‍্যাপার।বার্ণপুরে কোম্পানির কোয়ার্টারটা ছিল রাস্তার ধারেই। রাধানগর রোড। রাস্তার দিকে কোয়ার্টারের সামনের বারান্দা। বড়সড়ো । এটাই মঞ্চ । রাস্তা আর বারান্দার মাঝে ১০-১২ ফুট ফাঁকা জমি– অডিটোরিয়াম। দর্শকের অভাব কি ! একান্নবর্তী সবাই । মা,বাবা,ঠাকুমাকে ধরে বাড়িতেই তো কুড়ি জন। শেষের দিকে আমার রাসভারী বাবাও উৎসাহী হয়ে পরলেন। থিয়েটার যে তাঁর‌ও রক্তে ! ধুতি, শাড়ি, চাদর ,ওড়নায় ঘিরে বেশ রং চঙে মঞ্চ তৈরী হয়ে গেল পিসেমশাইয়ের আশ্রমিক অভিজ্ঞতায়। সমস‍্যা হল আলো নিয়ে। বারান্দায় একটি মাত্র বাল্ব বাকেটে ঝুলছে তাতে যথেষ্ট আলো হচ্ছে না। বাবা বাল্ব বদলে দিলেন , পিসেমশাই আর মনোহরকাকুর হাতে দিলেন পাঁচ ব‍্যাটারী টর্চ। দরকারে এগুলো স্পট লাইটের কাজ করবে। নাটক করব সবাইকে নিমন্ত্রণ করতে হবে না ! ভাই বোনেরা বেরিয়ে পরলাম বাড়ি বাড়ি। কচি কাঁচারা গেলে কোন্ পাষণ্ড মুখ ফিরিয়ে নেয় ! চরম উত্তেজনায় শুরু হয়ে গেল নাটক। আমার পেছনে প‍্যান্টের সাথে খেজুর পাতার ঝাঁটা বেঁধেছে মনোহরকাকু , ওটা শেয়ালের লেজ। তার ওপরে দুপাট্টা ধুতি হাঁটুর ওপর পর্যন্ত। সারা গায়ে মুখে কালো – সাদার রংবাহার। মঞ্চে কোন উইং নেই। দু পাশেই কাপড় টানা। আমরা ঢুকছি বেরিয়ে যাচ্ছি তার নীচ দিয়ে গুঁড়ি মেরে যেন শেয়াল তার গর্ত থেকে বাইরে আসছে বা কুমোর তার অন্দর থেকে দাওয়ায় আসছে। অক্লান্ত মনোহরকাকু আর পিসেমশাই পাঁচ ব‍্যাটারী জ্বালিয়েই রেখেছে মুখের ওপর। চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গেল নাটক , আমার এক ভাই ‘ অজু ‘ আর চাপতে পারল না ছুটে চলে গেল দর্শকদের মাঝখান দিয়ে রাস্তায়। হাল্কা হয়ে ফিরে এলো। উপায় না দেখে বাবা ঘোষণা করে দিলেন ” এই সময়টুকুকে আপনারা বিরতি হিসেবে ধরে নিন “। আবার শুরু হল , যথাসময়ে শেষ হল নাটক। ১১ বছর বয়সে সেই আমার প্রথম নাটক- সেই শুরু। পুরো ছুটিটা এই আনন্দে মশগুল ছিলাম আমরা। ঠাকুমা তো বলেই ফেললেন -” মৈন‍্যার পোলা তো – – -” মনি আমার বাবার ডাক নাম। ছোট ছোট পা গুলোর তখন ওজন কত ! অপেরার আঙ্গিকে করা জ্ঞানদানন্দিনীর এই নাটক এখনও মনে পরে– ” নাকের বদলে নরুন পেলাম/ টাক ডুমাডুম ডুম/ নরুনের বদলে হাঁড়ি পেলাম/টাক ডুমাডুম ডুম/ হাঁড়ির বদলে টোপর পেলাম/ টাক ডুমাডুম ডুম / টোপরের বদলে ব‌উ পেলাম/ টাক ডুমাডুম ডুম, টাক ডুমাডুম ডুম।” * * * * * * কলেজ জীবন কোলকাতায়। তখন থেকে শহরতলীর বাস। চাকরির প্রথম ১০-১২ বছর কটেছে দূরে দূরে মেসে । কিন্তু থিয়েটারকে আমি সবসময় পাশে পেয়েছি । শহরতলীর নোটো আমি। পয়সা কোথায় নাটকের দলে ? পকেট হাতরে পেরিয়ে এলাম তিনকুড়ি দশ। হল ভাড়া করে থিয়েটার করা এই তো সবে। যখন যে জায়গা পেয়েছি ব‍্যবহার করেছি। স্কুলের বারান্দা , বন্ধ করখানার গেটের সামনেটা , রাস্তার মোড় , শ্রমিক বস্তির উঠোন অথবা সব্জির বাজার– অসুবিধে মনে হয়নি কোথাও । যাঁরা দেখেছেন তাঁদের বোঝানো গেছে যা বলতে চাই। আর কী চাই ! নিজের থেকে বুঝেছি , চিরাচরিত মঞ্চ না পেলে থিয়েটার হবে না এই ধারণা সত‍্যি নয়। হ‍্যাঁ, এটা ঠিক যে কাজটা করার জন‍্য একটা জায়গা দরকার সেটা দর্শকদের এক‌ই তলে হতে পারে অথবা তাদের থেকে উঁচুতে বা নীচে। ইম্ফলে থিয়েটার করেছি –যেখানে দর্শকাসন গ‍্যালারীর মত –অভিনয় নীচে হচ্ছে , অনেকটা অ্যম্পি থিয়েটার। কারো অসুবিধে হয়নি । আসলে প্রযোজনাকে সাজিয়ে নিতে হয় মঞ্চের মানানসই করে। চিরাচরিত মঞ্চের চিরাচরিত সজ্জা এখানে বিরম্বনা । ********* এতক্ষন নিজের কথা বললাম এবার পিছিয়ে যাই, ব‌ই -এর থেকে বলি । গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেডেব সাহেব ১৭৯৫-৯৬ তে এখনকার এজরা স্ট্রিটে তাঁর তৈরী মঞ্চে ইংরেজী নাটকের অনুবাদ করিয়ে ‘ কাল্পনিক সংবদল ‘ নামে বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। একেই প্রথম বাংলা মঞ্চনাটক ধরা হয়। এর আগেও বাংলায় অভিনয় হোত । বা‌ংলার গ্রামে গঞ্জে রাসলীলা, কেষ্টযাত্রা ইত্যাদি অনেক আগেই জুড়ে গেছে আমাদের বিনোদন অঙ্গনে। এ সবই অভিনয় নির্ভর । ষোড়শ শতকের চৈতন‍্যদেব শুধু ধর্মপ্রচারক ছিলেন না অনেক বেশী ছিলেন সমাজ -সংস্কারক ,একজন সুপন্ডিত। নৃত‍্য – গীত এবং অভিনয়েও নিপুণ ছিলেন। চৈতন‍্যদেবের সময়কাল ১৪৮৬ থেকে ১৫৩৪ । ষোড়শ শতকে তিনি শান্তিপুরে ‘দানলীলা’ অভিনয় করেন। কোন মঞ্চ নির্দিষ্ট ছিল না । অধ‍্যাপক মন্মথমোহন বসু লিখছেন ” এই অভিনয়ে তিনি স্বয়ং শ্রীরাধিকার, অদ্বৈতাচার্য শ্রী কৃষ্ণের, নিত‍্যানন্দ বড়াই বুড়ির , শ্রীবাসবাদি কতিপয় সখীর, কমলাকান্তাদি কতিপয় সখার, গৌরীদাস সুবলের এবং নরহরি মধুমঙ্গলের ভূমিকা গ্রহন করেন। ভাগিরথী তীরে অভিনয় হয়। সখীরা প্রকৃত গাভী ল‌ইয়া চরাইতে যান। নদীর ধারে একটি কদম্ববৃক্ষ ছিল, সেটিকেও অভিনয়কার্যে ব‍্যবহার করা হয় । দধিদুগ্ধ লুণ্ঠনাদি ব‍্যাপার‌ও ঠিকমত দেখান হ‌ইয়াছিল। . . . ” (বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ) ১৮৩৫ সালে শ‍্যামবাজারে শ‍্যামসুন্দর বসুর বাগানবাড়িতে ওনার নটকের দল ‘বিদ‍্যাসুন্দর’ নাটক অভিনয় করে। নির্দিষ্ট কোন মঞ্চ ছিল না । ” তাহাতে প্রত‍্যেক দৃশ‍্য পরিবর্তনের সঙ্গে দর্শকদিগকেও স্থান পরিবর্তন করিতে হ‌ইত । বকুল বনে উপবিষ্ট সুন্দর বা মালিনীর গৃহ দেখিবার জন‍্য দর্শক দিগকে সতন্ত্র সতন্ত্র স্থানে যাইতে হ‌ইত। তথায় তাহাদিগের জন‍্য আসন প্রস্তুত থাকিত। ” প্রযোজনাটি নিয়ে এই কথাগুলো শ্রী যোগীন্দ্রনাথ বসু লিখেছেন তাঁর ‘মাইকেল মধুসূদনের জীবনী’তে। আর‌ও কাছে তাকানো যাক । বিংশ শতকে বেলজিয়ামের কবি ও নাটককার মরিস মেটারলিংক ১৯০৯ সালে সেক্সপিয়রের ম‍্যাকবেথ্ প্রযোজনা করেন বিনা মঞ্চে। এই অভিনয় হয়েছিল তাঁর ফার্ম হ‌উসে। ফার্মের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছিলো দৃশ‍্যপট। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রসেনিয়াম ছাড়াই থিয়েটার সফল হয়। বাংলার বিভিন্ন পার্বনের অনুষ্ঠান বা যাত্রা পালা বাদ দিলেও বিনা মঞ্চে পরিকল্পিত দৃশ‍্যপটে অভিনয় করছি প্রায় পাঁচশ বছর এবং ধারাবাহিক ভাবে। এই নাট‍্যরীতির নাম হয়ত স্থান , কালে বদলে বদলে যাচ্ছে। থিয়েটার একটা মাধ‍্যম এটা সবাই স্বীকার করছেন। সব মাধ্যমের মত এর ব‍্যবহারের পেছনেও নির্দিষ্ট দর্শন কাজ করে– সেই সময়ের সেই থিয়েটার সে ভাবেই চলে। তাই দখলের লড়াই জারি থাকে। সচেতন থাকতে হয় থিয়েটার কর্মীকে।

তমলুকের রঙ্গন নাট্যদলের অভিনব পার্বণ নিয়ে গল্প শোনালেন - অনুপম দাসগুপ্ত

রঙ্গন পার্বণ – ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুনত্বের মেলবন্ধন

 
 
 

আমরা রঙ্গন, তমলুকের একটি ছোট্ট নাট্যদল। বিগত ১৬ বছর

 

ধরে ধারাবাহিকভাবে নাট্যচর্চা ও অনুশীলনে রয়েছি। এই ১৬ বছরে

 

আমাদের আয়োজনে ছোটখাটো নাটকের অনুষ্ঠান হলেও

 

নাট্যোৎসবের আয়োজন আমরা এর আগে কখনও করিনি। ২০১৮

 

সালের গোড়ার দিকে তমলুক রাজবাড়িকে ঘিরে আমাদের একটি

 

নাটকের পরিকল্পনা মাথায় আসে, একটা বিষয়, যেটাকে এই

 

স্পেসটাকে ব্যবহার করে প্রয়োগ করলে অন্যকিছু হতে পারে, শুরু

 

হয় রিসার্চ, পড়াশুনো, অনুশীলন।

 
 
 
 
 
 
 
 

পাশাপাশি আমাদের এই নাটকের

 

পরিকল্পনা দু-একজনকে জানাতেই তারা উৎসাহী হয়ে ওঠে,

 

আমাদের মাথাতেও উস্কে ওঠে কিছু নাট্যদল, যারা অল্টারনেটিভ

 

স্পেসে ভালো কাজ করছেন। তাদেরকে এনে ফেলা যায় এই

 

ঐতিহাসিক অতিপ্রাকৃত স্পেসে। আমরাও কিছু শিখতে পারবো আর

 

এই অঞ্চলের দর্শকরাও একটা নতুন ধারার থিয়েটারের সাথে

 

পরিচিত হবে। এইভাবে দু-চারজনকে বলতে বলতে শেষপর্যন্ত ৮ টা

 

প্রযোজনা, ২ দিনের উৎসব, প্রায় ১০০ জন নাট্যজনে মুখরিত হয়ে

 

ওঠে তমলুক রাজবাড়ি প্রাঙ্গণ গত ৮ এবং ৯ ডিসেম্বর, ২০১৮। এই

 

অঞ্চলে আরও অনেক নাট্যোৎসব হয়, কিন্তু সবই মঞ্চ

 

নাটকের। এইরকম মঞ্চের বাইরে অন্য পরিসরে, খোলা আকাশের

 

তলায় , প্রকৃতির সান্নিধ্যে নাট্যোৎসব তমলুকে কেন গোটা

 

মেদিনীপুর জেলাতেও সম্ভবত সম্ভব। এর সাথে তমলুক রাজবাড়ির

 

ঐতিহাসিক স্থানমাহাত্ম্য, আমাদের কাজ – “মানুষের মানচিত্র”,

 

যা ইতিহাস ও সবসময়কে মেলানোর একটা নিরীক্ষা, সবটা মিলিয়েই

 
 
 

অত্যন্ত সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয় আমাদের প্রথম বছরের

 

আয়োজন- রঙ্গন পার্বণ।

 
 
 
 
 
 
 
 

এ বছরের অপ্রত্যাশিত সাফল্যের পর আমরা পরের বছর ২০১৯ এর

 

১৪,১৫ ডিসেম্বর দ্বিতীয়বার রঙ্গন পার্বণের আয়োজন করি।

 

এবারেও ৮ টি নাট্যদল অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও থাকে গান,

 

আবৃত্তি, মূকাভিনয় ও কবিতার কোলাজ।

 

দুই বছরেই সকালবেলা মুক্তমঞ্চের সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে

 

আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়। অংশগ্রহণ করেন বিশিষ্ট

 

নাট্যব্যক্তিত্ব শ্রী প্রবীর গুহ, হিরণ মিত্র, সলিল সরকার,

 

অংশুমান ভৌমিক, সুপ্রিয় সমাজদার, অভীক ভট্টাচার্য, শোভন

 

গাঙ্গুলী প্রমুখ।

 
 
 
 
 
 
 
 

মুক্তমঞ্চের এইধরনের অনুষ্ঠানে কোনো প্রবেশমূল্য রাখা হয়না।

 

তাই গত দুই বছরেই বিপুল দর্শক সমাগম হয়। তবে আমাদের বিশাল

 

কোনো ব্যাঙ্কিং, গ্রান্ট বা ফান্ডও নেই। পুরো আয়োজনটাই চলে

 

স্থানীয় মানুষদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, অনুদান, কিছু

 

বিজ্ঞাপন আর শুভানুধ্যায়ীদের সাহচর্য্যে। দুই বছর পর পর

 

সফলভাবে অনুষ্ঠান করার পরেও আমরা কিছু অর্থনৈতিক

 

সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হয়েছি। আবার দর্শক ও পারফর্মাররা একই

 

অনুভূমিক তলে অবস্থান করার ফলে দর্শকদের একটা দৃশ্যমানতার

 

অসুবিধে হচ্ছে। হাফ সার্কেলে চেয়ার বসিয়ে দিলেও দীর্ঘদিনের

 

অভ্যাসবশত দর্শকেরা আবার পারফরম্যান্স স্পেস থেকে সরে

 
 
 
 
 
 

সোজা সোজা বসছেন। ভবিষ্যতে এই ব্যাপারে আমাদের পরিকল্পনা

 

প্রয়োজন।

 
 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *