ভাণ পত্রিকা
পঞ্চদশ সংখ্যা ।। অষ্টম ই- সংস্করণ ।। এপ্রিল , ২০২১
সম্পাদক :
সম্পাদনা সহযোগী :
প্রচ্ছদ :
নক্সা পরিকল্পক :
অন্যান্য কাজে :
ভাণ-এর পক্ষে:
ও মৌলিকা সাজোয়াল
কর্তৃক
৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬
( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )
৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) [email protected] ( ই – মেল )
Reg. No : S/2L/28241
সূচি
স্মরণ
এ মাসের প্রতিভা
যামিনী রায়: কবি বিষ্ণু দে এর দৃষ্টি দিয়ে স্মরণ করলেন – শর্মিষ্ঠা
দেখা- শোনা- পড়া তারপর বলা
“আঘাত করবে অত্যাচারীর বাস্তিল দুর্গে” আবারও মঞ্চ কাঁপানো উৎপল দত্তের’ তীতুমীর নাট্য নিয়ে – সোহম দাস
“হীরালাল’ খাঁটি স্বদেশী সিনেমা” মতামত দিলেন – সুমন সাধু
অভিজ্ঞতা
এমাসের নিবন্ধ
‘বিজন ঘরে, নিশীথ রাতে’ বিজন ভট্টাচার্য কে নিয়ে চমৎকার একটি ব্যক্তিগত গদ্য লিখলেন – ময়ূরী মিত্র
বাঙালির দোলের রঙিন দোলাকে নিয়ে – সুজয়কৃষ্ণ চক্রবর্তী
বিষয় বিশেষ
সম্পাদকের কথা
সরগরম বাংলার রাজনীতি। রাজ্যের তখত দখলের লড়াই চলছে। আমি ভালো, তুমি মন্দ” এর স্লোগান উবে গিয়ে নিম্নস্তরের খিস্তিখেউড় এ গমগম করছে চরাচর। জোকাররা চাকরি হারিয়েছেন। সার্কাসের তাঁবু আর পড়েনা এখন। পাড়ার সান্ধ্যকালিন ঠেক থেকে অশ্লীল আলাপের ইন্তেকাল ঘটেছে। বাপ-মাকে ঘন ঘন বদলে ফেলায় লজ্জা-শরমও সুদূর হিমালয়ে সন্ন্যাস নিয়েছে। এখন সবই পাওয়া যাচ্ছে একই ছাদের তলায়। যার পুরোটাই নাকি নামে ‘রাজনীতি’।
বাঙালির রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই দেউলিয়া কালে আমাদের ভাণ এর ‘বিষয়ে বিশেষ’ ও তাই। “বাঙালির রাজনৈতিক সংস্কৃতি”। রাজনীতি, ছোট করে দলীয় রাজনীতি যেহেতু আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করছে সর্বাধিক, তাই সমাজে তার রাক্ষুসে হাঁ গ্রাস করছে আমাদের ধর্ম – সমাজ -সংস্কৃতি। এমনকি ঐতিহ্য ও তার বদলের সূত্র ধরে আমাদের যে নিজস্ব বেশভূষা খাদ্যাভ্যাস প্রার্থনা সংগীত,- সবকিছুকে যেহেতু গ্রাস করে একলা সর্বেশ্বর হতে চায়!- তাই আমরা এটিকে তলিয়ে দেখতে চাইছি এবার।
এ নিয়ে এই পর্বে থাকছে তরুণ অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার মইদুল ইসলামের নিবন্ধ। এবং টলিপাড়ার রাজনীতি ও তার আদর্শহীন পক্ষপাত নিয়ে আমাদের জেরা সামলেছেন বিশিষ্ট অভিনেত্রী উষসী চক্রবর্তী। প্রয়াত নাট্য ব্যক্তিত্ব দেবতোষ ঘোষের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পত্রিকা শুরু হয়েছে।এছাড়াও’ মাসের প্রতিভা’ স্মরণ করেছে অদ্বিতীয় শিল্পী যামিনী রায় কে। আছে তিতুমীর নাট্য দেখার অভিজ্ঞতা। সাম্প্রতিক প্রশংসিত চলচ্চিত্র হীরালাল কে প্রশংসার কারণগুলির খোঁজ আছে এবারের ভাণ এর পাতায়। সংগীত নিয়ে ‘গায়কের গেরো’ এর তৃতীয় কিস্তি রয়েছে যথারীতি। এছাড়াও বাঙালির’ দোল হোলি’ নিয়ে এবং গণ নাট্যর প্রাণপুরুষ বিজন ভট্টাচার্য নিয়ে দুটি চমৎকার গদ্য রয়েছে এবারের সংখ্যায়।
আপনারা ভাল থাকুন। ভান পড়ুন। ভান পড়ান। আমাদের জানান ভাল এবং মন্দ। দুটোই। নমস্কার ও শুভেচ্ছা জানবেন।
স্মরণ
প্রয়াত প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব দেবতোষ ঘোষ( ১৯৩১-২০২১)
দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের নাট্যজীবন তাঁর। পঞ্চাশের দশকে শম্ভু মিত্রের সান্নিধ্যে আসা, ‘বহুরূপী’ নাট্যদলে
যোগদান।অভিনয় করেছেন ‘চার অধ্যায়’, ‘ডাকঘর’, ‘রক্তকরবী’, ‘রাজা অয়দিপাউস’, ‘পুতুল খেলা’,
‘বিসর্জন’, ‘রাজা’ ইত্যাদি অসংখ্য বিখ্যাত নাটকে। দক্ষ হাতে সামলেছেন ‘বহুরূপী’ র সম্পাদকের
দায়িত্ব। ‘বহুরূপী’ ছাড়াও সাম্প্রতিক কালের ‘পঞ্চম বৈদিক’ প্রযোজিত ‘পশুখামার’ নাটকেও অভিনয়
করেছিলেন। শুধু নাটকেই নয় বড় পর্দাতেও তাঁর অভিনয় প্রতিভার সাক্ষর রেখে গেছেন তিনি। সত্যজিৎ
রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহের মতো পরিচালকের পরিচালনায় কাজ করেছেন তিনি।‘অশনি সংকেত’, ‘গুপীবাঘা
ফিরে এলো’, ‘বাঞ্ছারামের বাগান’, ‘খারিজ’ বা ‘সবুজ দীপের রাজা’ চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় চলচিত্রপ্রেমী
মানুষ মাত্রেরই স্মরণে থাকবে। রোলাণ্ড জোফি নির্দেশিত ‘সিটি অফ জয়’ তেও অভিনয় করেন তিনি। কিন্তু
চলচ্চিত্রের চাকচিক্য তাঁকে কখনোই মঞ্চের মায়া থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারেনি। আজীবন থিয়েটারে
নিবেদিতপ্রাণ এই মানুষটির রচিত বইতেও তাই উঠে আসে বিখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব ও নাট্যের আঙিনায়
বহুরূপীর অবদানের কথা। বড়পর্দার মোহ যাকে আকর্ষণ করতে পারেনা, নাটকের মহলাঘরই যাঁদের প্রাণ
বাংলা নাট্যজগতের সেই বিরল আদর্শবান নাট্যব্যক্তিত্বদের অন্যতম দেবতোষ ঘোষ চলে গেলেন গত
২৬ফেব্রুয়ারি, নব্বই বছর বয়সে। বহুরূপীর একটি যুগের যেন অবসান হলো। প্রয়াত শিল্পীর প্রতি ভাণের
পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা ও প্রণাম।
স্মরণের আবরণে মরণেরে যত্নে রাখি ঢাকি'-শর্মিষ্ঠা চ্যাটার্জ্জী
স্মরণের আবরণে মরণেরে যত্নে রাখি ঢাকি’
(যামিনী রায়ের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণ)
শর্মিষ্ঠা চ্যাটার্জ্জী
হৃদয়ে অস্থির পদচারণা রেখে যান যেসব গুণীজনেরা, তাঁরা কত সহজে বসতে পারেন মাটিতেই, কত সহজেই বলতে পারেন – ‘শিল্পী নই গো, আমি হলেম পটুয়া!’ মন থেকে কতখানি সরল, কতখানি উদার হতে পারলে একজন শিল্পী বিদেশের লোভনীয় আহ্বানকে ফিরিয়ে দিয়ে বলতে পারেন, “আমরা গরিব দেশের মানুষ, এত পয়সা খরচ করে ওদের দেশে যাব কেন? ওদের অনেক পয়সা, ওরা এসে আমাদেরটা দেখে যাক।” রঙের প্রাঞ্জলতায়, তুলির টানে, পেন্সিলের আঁচড়ে যিনি বঙ্গভূমির প্রাত্যহিক জীবনযাপন আর নিজস্বতার মেলবন্ধনে বাংলার চিত্রকলাকে দিয়ে গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও ঋদ্ধি, সেই যামিনী রায়ের চিত্রকলার কথা উঠে এল আজ লেখার বিষয়-এ।
১৮৮৭ সালের ১১ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড় গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন যামিনী রায়। বাবা রামতারণ রায়। মায়ের নাম নগেন্দ্রবালা দেবী। কথায় বলে, প্রতিভাবানদের প্রতিভা শৈশব থেকেই অল্পে অল্পে প্রকাশিত হতে থাকে। তার ব্যত্যয় ঘটেনি এখানেও।বাবা রামতারণের থেকে উত্তরাধিকারে পাওয়া শৈল্পিক বোধই হয়তো ছোট্ট যামিনীকে টেনে নিয়ে যেত কুমোরদের ঠাকুর-গড়া দেখতে। ঘরের দেওয়ালে, মেঝেতে, হাতের কাছে যা পেতেন তাই দিয়েই আর পাঁচজন শিশুর মতো এঁকে ফেলতেন বাঘ, পাখি, হাতি, পুতুল। শিশুমনের সারল্য ও কল্পনার বিহারে কোনোদিনই বাধা পড়েনি। তাঁর পরিবারের মানুষরাও হয়তো তাঁর মনোগত ইচ্ছাকে বুঝতে পেরেই মাত্র ষোলো বছর বয়েসেই তাঁকে ভর্তি করান কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে।
বেলিয়াতোড়ের মাঠে ঘাটে খেলে বেড়ানো দিশেহারা মন এবারে এসে পড়ল রঙ-তুলি-শিক্ষার কড়াকড়ির চৌহদ্দিতে। তখন থেকে যাত্রাপথ নিল এক নতুন বাঁক। আর্ট স্কুলে ইউরোপীয় ধাঁচেই চিত্রকলার একাডেমিক শিক্ষা গ্রহণ চলতে থাকে। চিত্রকলায় প্রাচ্য ও প্রতীচ্য – দু’ধরণেরই কলাকৌশলের সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচয় বাড়তে থাকে এই নতুন শিক্ষার্থীর। ইউরোপীয় শিক্ষার স্বাভাবিক প্রভাব দেখা যায় যামিনী রায়ের প্রথম দিকের কাজের মধ্যে। পাশ্চাত্যের বিখ্যাত পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট চিত্রশিল্পী পল সিজান, ভ্যান গ্যঁ, পাব্লো পিকাসো ও গগ্যাঁর প্রভাব রয়েছে যামিনী রায়ের একেবারে প্রথমদিকের কাজে-এ কথা অনেকেই মনে করেন। পোট্রেইট, ল্যান্ডস্কেপ, তৈলচিত্র এঁকেছেন একের পর এক। এবং সাবলীলভাবে ক্লাসিকাল ন্যূড ছবিও এঁকেছেন। নিজগুণে গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের তৎকালীন অধ্যক্ষ অবন ঠাকুরের অন্যতম প্রিয় একজন ছাত্র হয়ে ওঠেন তিনি। গুরু অবনীন্দ্রনাথ কিন্তু পাকা জহুরীর মতোই কাঁচা হীরের পরখ করতে একটুও ভুল করেননি। আর হয়তো সেই কারণেই যামিনী রায়ের চিত্রশিল্পকে স্মরণ করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মিত্র লিখতে পেরেছিলেন –
“পট যায় ঘুরে
অন্ধীকৃত রাত্রির শহরে,
পথে পথে সুগম্ভীর ছায়ার বহর,
ষড়যন্ত্র সঙ্কুল ত্রস্ত কবন্ধের ভীড়।
সুর-রিয়ালিষ্ট কবিতার দেশে।
পিকাসো বা যামিনী রায়ের আঁকা
পথঘাট গাছপালা বাড়ি।”
বিদেশি ঢঙে শিল্পচর্চা করতে করতে একসময় কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠল তাঁর মন। হয়ত ভাবছিলেন, কি যেন নেই ছবিতে! হঠাৎ যেন খেয়াল করলেন তাঁর ছবিতে নেই তাঁর আশেপাশের মানুষগুলি!আশেপাশের মানুষের জীবন, তাদের যাপন, তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজকর্ম, এইসবকিছু তখন তাঁর ছবিতে আসার পথ চাইল। শিকড়ের খোঁজে, মাটির টানে তাই তাঁকে ফিরে আসতে হল এই বঙ্গভূমির উজাড় করে দেওয়া সুধাপাত্রের কাছেই। তাঁর ছবিতে একেবারে প্রান্তিক গ্রামবাংলা থেকে উঠে এলেন দেশীয় সংস্কৃতি, আপন মানুষ, তাদের জীবনযাপন ও পরিচিত প্রকৃতি।
তখনকার দিনে বেশ পরিচিত ছিল কালীঘাটের পট। সেই কালীঘাটের চিত্রকলার ধাঁচকেই মাধ্যম করে যামিনী রায় আঁকতে লাগলেন। কালীঘাটের চিত্রকলার বিষয় ছিল নানা পৌরাণিক ও ধর্মীয় কাহিনি, পশুপাখি, এবং গ্রামের চিরায়ত চিত্র।কালীঘাট মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলের শিল্পীরা নিজেদের রঙে-ঢঙে সেইসব চিত্র আঁকতেন। এই চিত্রের দ্বারা প্রভাবিত যামিনী রায় শুধু যে এই ধাঁচে আঁকলেন তাই নয়, এমনকি জন্মস্থান বেলিয়াতোড়, উড়িষ্যা, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম ইত্যাদি অঞ্চলের শিল্পীদের তৈরি করা অনেক পট সংগ্রহও করেছিলেন তিনি। গ্রামের জীবন, লাঙল চালানো চাষী, কীর্তনীয়া, কিশোরী অথবা গৃহবধূ, বাঁশীবাদক, বাঘ, মাছ, বিড়াল, গাছপালাসহ গ্রাম্য প্রকৃতি বাস্তব থেকে সরাসরি উঠে এলো যামিনী রায়ের চিত্রচর্চায়। বেলিয়াতোড়ের আশেপাশেই বসবাসকারী সাঁওতাল আদিবাসীদেরকে নিয়ে চিত্রকলায় নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। সাঁওতাল রমণীদের নাচ, সাঁওতালদের খেটে খাওয়া জীবনের ছবিও উঠে এসেছে ক্যানভাসে-খাতার পাতায়। তখন থেকেই তাঁর নিজস্ব শিল্পরীতিতে লোকশিল্পের সারল্য, বলিষ্ঠভাব, সমতলীয় রঙ, সুদৃঢ় রেখা উঠে আসতে শুরু করে।
কিছু শিল্পী এমনই নিজস্বতা প্রতিষ্ঠা করতে সফল হন, যে আলাদা করে কে এঁকেছেন, তা দর্শককে বলে দিতে হয়না। যামিনী রায়ও তাঁদেরই মধ্যে একজন, যাঁর কাজ দেখামাত্র চিত্রশিল্পানুরাগীরা বুঝতে পারেন যে, এ আঁকা কার। লম্বা বড় চোখ তাঁর ছবির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, তা সে পুরুষের চোখ হোক, বা নারীর, বা পোষ মানা কোনো বিড়ালের। মোটা দাগের উদার টানে জীবন্ত হয়ে ওঠে সাঁওতাল পটচিত্রগুলি। রঙ নিয়েও নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। তখনকার দিনে রঙ একেবারেই সস্তা ছিল না। তাই ছবি আঁকতে গেলে, রঙ বা সাজসরঞ্জাম কিনতে অনেক নবীন চিত্রশিল্পীকেই ফাঁপরে পড়তে হত। এখানেও রঙের সহজলভ্যতার পথপ্রদর্শক হয়ে এগিয়ে আসেন তিনি। প্রাচীন চিত্রশিল্পীদের দেখানো পথ অনুসরণ করে খুব সহজলভ্য উপকরণ দিয়েই রঙ তৈরি করেন। বিভিন্ন রঙের মাটি, ভুষোকালি, খড়িমাটি, নানা গাছের বর্ণিল পাতার রস থেকে পাওয়া রঙ ব্যবহার করে ছবি আঁকেন। চৌহদ্দির মধ্যে পাওয়া শিক্ষা আর মাটির টানকে এইভাবেই তিনি মিশিয়ে দিতে পেরেছিলেন একে অপরের সঙ্গে।
যামিনী রায়ের অঙ্কিত বহুলপরিচিত চিত্রগুলির মধ্যে কয়েকটির নাম হল ‘সাঁওতাল মা ও ছেলে’, ‘গণেশ জননী’, ‘কীর্তন’, ‘তিন কন্যা’, ‘যিশুখ্রিষ্ট’, ‘কনে ও তার দুই সঙ্গী’ এবং ‘ক্রন্দসী মাছের সাথে দুই বেড়াল’। তাঁর চিত্র ক্রমশই দেশের মানুষদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিটে হয়েছিল যামিনী রায়ের ছবির প্রথম প্রদর্শনী। ‘পরিচয়’ পত্রিকায় তাঁর শিল্পকৃতির আলোচনাও প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে ভারতে আসা ইংরেজ সৈনিক ও অফিসাররা তাঁর ছবি দেখে, পছন্দ করে, ক্রয় করে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যান। এর ফলে তাঁর পরিচিতি আন্তর্জাতিক স্তরেও ছড়িয়ে পড়ে। গ্রাম-বাংলার পটুয়াদের শিল্পকর্মের মতো ধনী-দরিদ্র সবার কাছেই যাতে তাঁর চিত্র সহজলভ্য হয়, তার জন্য তিনি চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর চিত্রের গুণমুগ্ধ বুদ্ধদেব বসু তাঁকে স্মরণ করে লিখেছেন-
“আমরা সবাই প্রতিভারে করে পণ্য
ভাবালু আত্মকরুণায় আছি মগ্ন
আমাদের পাপের নিজের জীবনে জীর্ণ
করলে, যামিনী রায়
… পুঁথি ফেলে তুমি তাকালে আপন গোপন মর্মতলে
ফিরে গেলে তুমি মাটিতে, আকাশে, জলে
স্বপ্ন লালসে অলস আমরা তোমার পুণ্যবলে
ধন্য যামিনী রায়”।
কেবলমাত্র ছবি এঁকেই থেমে থাকেননি তিনি। রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্প সম্পর্কে নিজস্ব মতামতও জানান। এই লেখাটি বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার রবীন্দ্র সংখ্যায় (আষাঢ়, ১৩৪৮) প্রকাশিত হয়। এই ‘রবীন্দ্রনাথের ছবি’ শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়ে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ যামিনী রায়কে লিখেছেন-
“তোমাদের মতো গুণীর সাক্ষ্য আমার পক্ষে পরম আশ্বাসের বিষয়।… আমার স্বদেশের লোকেরা আমার চিত্রশিল্পকে যে ক্ষীণভাবে প্রশংসার আভাস দিয়ে থাকেন আমি সেজন্য তাদের দোষ দিই নে। আমি জানি চিত্র দর্শনের যে অভিজ্ঞতা থাকলে নিজের বিচারশক্তিকে কর্তৃত্বের সঙ্গে প্রচার করা যায়, আমাদের দেশে তার কোনো ভূমিকাই হয়নি। সুতরাং চিত্রসৃষ্টির গূঢ় তাৎপর্য বুঝতে পারে না বলেই মুরুব্বিয়ানা করে সমালোচকের আসন বিনা বিতর্কে অধিকার করে বসে। সেজন্য এদেশে আমাদের রচনা অনেক দিন পর্যন্ত অপরিচিত থাকবে। আমাদের পরিচয় জনতার বাইরে, তোমাদের নিভৃত অন্তরের মধ্যে। আমার সৌভাগ্য, বিদায় নেবার পূর্বেই নানা সংশয় এবং অবজ্ঞার ভিতরে আমি সেই স্বীকৃতি লাভ করে যেতে পারলুম, এর চেয়ে পুরস্কার এই আবৃতদৃষ্টির দেশে আর কিছু হতে পারে না। “
যামিনী রায়কে লেখা আরো একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন-
“ছবি কী-এ প্রশ্নের উত্তর এই যে-সে একটি নিশ্চিত প্রত্যক্ষ অস্তিত্বের সাক্ষী। তার ঘোষণা যতই স্পষ্ট হয়, যতই সে হয় একান্ত, ততই সে হয় ভালো। তার ভালো-মন্দের আর কোনো যাচাই হতে পারে না। আর যা কিছু-সে অবান্তর-অর্থাৎ যদি সে কোনো নৈতিক বাণী আনে, তা উপরি দান।”
দুজন বিশ্ববন্দিত চিত্রশিল্পীর আধুনিক মনোভাবের আদানপ্রদানের সাক্ষ্য বয়ে চলে এই চিঠিগুলি।
সাহিত্যিক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যামিনী রায়কে নিয়ে ইংরেজিতে ‘যামিনী রয় অ্যান্ড দি ট্র্যাডিশন অফ পেইন্টিং ইন বেঙ্গল’ বইটি লেখেন। এছাড়াও তিনি ইংরেজিতেই একটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন যামিনী রায়কে নিয়ে। সেই প্রবন্ধটি সাহিত্যিক বিষ্ণু দে বঙ্গানুবাদ করে পত্রিকায় ছাপার জন্য পীড়াপীড়ি করতেন সুধীন্দ্রনাথকে। মান্না দে’র বিখ্যাত ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানের বেশ পরিচিত দুটি লাইন “কখনো বিষ্ণু দে, কখনো যামিনী রায় এই নিয়ে তর্কটা চলত”। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিষ্ণু দে ও যামিনী রায়ের সখ্যতা ছিল বেশ ভালোই। যামিনী রায়ের বাগাবাজারের আনন্দ চ্যাটার্জী লেনের বাড়িতে অজয় সেনের সাথে প্রথমবার চিত্র প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলেন বিষ্ণু দে। তারপর থেকেই তিনি ছিলেন যামিনীর নিয়মিত দর্শক। যামিনীও প্রায়শই আড্ডা দিতে যেতেন বিষ্ণু দে-র দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে। সেই আড্ডায় কখনো কখনো সঙ্গী হতেন সুধীন্দ্রনাথও। বিষ্ণুর বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন যামিনী। চিঠি চালাচালিও দিব্যি চলত দুজনের। ‘তাই তো তোমাকে চাই’ কবিতায় যামিনী রায়কে স্মরণ করে বিষ্ণু দে লিখেছেন-
“একটিই ছবি দেখি, রঙের রেখার দুর্নিবার একটি বিস্তার
মুগ্ধ হয়ে দেখি এই কয়দিন, অথচ যামিনীদার
প্রত্যহের আসনের এ শুধু একটি নির্মাণ একটি প্রকাশ
হাজার হাজার রূপধ্যানের মালার একটি পলক
যেখানে অন্তত গোটা দেশ আর কাল, একখানি আবির্ভাব”।
১৯৩৪ সালে যামিনী রায় ভাইসরয় স্বর্ণপদক পান। ১৯৫৫ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করে। সেই বছরই ললিতকলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছিলেন তিনি। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করে। জন্মস্থান বেলিয়াতোড়ে তাঁর সম্মাননার্থে গড়ে ওঠে যামিনী রায় কলেজ। সারা বিশ্বে একজন সার্থক বাঙালি চিত্রশিল্পী হিসেবে নিজের অসামান্য সৃষ্টির গুণগুঞ্জন ছড়িয়ে দিয়ে ১৯৭২ সালের ২৪ শে এপ্রিল তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁর চিত্রকলা চিত্রশিল্পের অনুরাগীদের কাছে এক বিরাট বিস্ময় হিসেবে সাক্ষর রেখেছে। আজও আমরা এই ‘মাটির রঙে মাটির কাছাকাছি’ থাকা চিত্রশিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত করি, তাঁর সৃষ্টিকে আমরা নিজেদের হৃদয়ে, মননে, মনীষায় ও আলোচনায় স্থান না দিয়ে থাকতে পারি না।
‘তিতুমীর’, ভালোবাসায় আছো, বিপ্লবেও আছো- সোহম দাস
সোশ্যাল মিডিয়ার চিৎকার-ময় জড়জগতে চোখ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ স্থির হয়ে গেল
চোখ। ডান হাতের যে বুড়ো আঙুল মোবাইল স্ক্রিনকে সচল রেখেছিল, সেই বুড়ো আঙুলও
স্থির। একটি সুদৃশ্য পোস্টার। ইঁট রঙের ব্যাকগ্রাউন্ডে এক শান্ত, প্রত্যয়ী মুখের
চিত্রণ। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ, কপালে বাঁধা লাল গামছা, মুখভর্তি কালো চাপ দাড়ি। সঙ্গে
দুটি বাক্য, উপরে ‘তিতুমীরের শপথ নাও’, নিচে ‘কৃষি আইনকে রুখে দাও’। ২৩ মার্চ
ভগৎ সিং-এর মৃত্যুদিনে বিশেষ কর্মসূচির আহ্বানের উদ্দেশ্যে এই পোস্টার। এক
বিপ্লবীর মৃত্যুদিনে এসে মিশছেন আরেক বিপ্লবী। দুটি মানুষের মৃত্যুর মধ্যে প্রায়
১০০ বছরের ব্যবধান, তাঁদের কর্মক্ষেত্র আলাদা, বিপ্লবের ধারার দিকে দেখলেও
সেখানে পার্থক্যের সূক্ষ্মতা। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লড়াইতে শহিদ হওয়ার
প্রশ্নে কিংবা নব্য ফ্যাসিবাদ-প্রতিরোধী অবস্থানে শিক্ষণীয় লিগ্যাসির প্রশ্নে
দুজনেই অনায়াসে মিলে যান।
‘তিতুমীর’ নাটক নিয়ে লিখতে বসছি যে মুহূর্তে, ঠিক তার মুহূর্তকাল আগেই যেন
কীভাবে এ পোস্টারে চোখ পড়ে গেল আমার। আর সেজন্যেই বুঝি, আকস্মিকতার
আঘাতে এই স্থির হয়ে যাওয়ার ক্ষণ।
উৎপল দত্ত-বিরচিত জনপ্রিয় ‘অ্যাজিটপ্রপ’ নাটকটি আবার মঞ্চে ফিরছে একদল
নাট্যসাধকের হাত ধরে, এ খবর রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল বছর দুই আগে।
নাটকের অন্যান্য বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় পরে আসছি। কিন্তু, আপাতত এটা
বলে রাখা কোনও অত্যুক্তি নয় যে, ‘থিয়েটার ফর্মেশন পরিবর্তক’-এর এই প্রযোজনা
সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য এক উপস্থাপনা – একথা প্রায় সকলেই
মানবেন। এই নাটক একবার দেখলে দর্শক আবারও ঠিক ফিরে আসবেন প্রেক্ষাগৃহের
আঁধারির গর্ভে, সামনের আলোকিত মঞ্চের শিল্পোদ্যমে বিভোর হবেন, তারপর
নাটকের শেষে আপনা থেকেই দুটো হাতের তালুকে সজোরে বাজিয়ে দেবেন। সেই আওয়াজ
যেন সত্যি সত্যিই গিয়ে আঘাত করবে পৃথিবীর সমস্ত অত্যাচারী শাসকের বাস্তিল
দুর্গে – এরকম এক প্রকট বিশ্বাস দর্শকের মনে অনায়াসে জাগিয়ে তুলতে পেরেছে
‘তিতুমীর’। এমন এক আশ্চর্য শক্তিই এই নাটকের অন্যতম সাফল্য।
উপস্থাপনার ক্ষেত্রে খুব সামান্য কিছু জায়গায় কিছু ছোটোখাটো বদল ছাড়া উৎপল
দত্তের মূল টেক্সট পুরোটাই অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে। প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টার এই নাটক।
আয়োজন দেখলে সততই বোঝা যায়, সমস্ত কিছুর পিছনে রয়েছে দীর্ঘ সময়ের ভাবনা
এবং গবেষণা। মঞ্চসজ্জার কথাই যদি ধরি। নাটক দেখতে ঢুকেই দর্শকের চোখে পড়বে মঞ্চ জুড়ে
তৈরি করা বাঁশের ভারা, মই, বাঁশের ঢাল। দর্শক আঁচ করতে পারবেন, আর কিছু পরেই
এই মঞ্চে দাপিয়ে বেড়াবে কিছু নির্ভীক নাট্যযোদ্ধা। অসাধারণ এক আলোকসজ্জা
তাদের দেবে যোগ্য সঙ্গত। কখনও সেই নাট্যযোদ্ধারা উঠে আসে ব্যালকনিতে,
প্রেক্ষাগৃহকে ভরিয়ে তোলে আলোর খেলায়। সে আঁচে স্পষ্টই এক বেপরোয়া উৎসবের
গন্ধ লেগে আছে। নাট্যবিনোদনের উৎসবের সঙ্গে সেখানে মিলে যাচ্ছে বিপ্লবের
উৎসব কিংবা প্রতিরোধের উৎসব। উপস্থাপন-শৈলীর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে নাটকের
কাহিনিক্রম। নাটকের দৃশ্যান্তর ঘটতে থাকে, তবু কেল্লা স্থির। মঞ্চশিল্পের এটাই
এক মজা। সেখানে এই স্থবিরতা সত্ত্বেও দর্শকের সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ সংযোগের
পরিসর বৃহৎ। একটা বিশেষ সময়ের পরে তাই দর্শকের হয়তো মনে হতে পারে, বাঁশের
কেল্লা আসলে বুঝি ক্ষমতাহীন এক প্রতিবন্ধকতা। তার হাঁটাচলার ক্ষমতা নেই। সে
বুঝি টেনে ধরে বিপ্লবী-মানসকে। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার কাহিনি বাংলার ঘরে ঘরে
কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই বাঁশের কেল্লার নির্মাণ-ভাবনার মধ্যেই যে লুকিয়ে
থাকা সীমাবদ্ধতা কিংবা তিতু ও তাঁর বিপ্লবী সঙ্গীদের নিয়তি, সমালোচকের দৃষ্টিতে
সেই বিশ্লেষণটুকু এখানে স্পষ্ট করা হয়েছে সরাসরি।
পোশাক নির্বাচনের বিষয়েও যতটা সম্ভব নিখুঁত পারিপাট্যের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুরুব্বিদের পোশাক যেরকম
হত, সেই ধরনের সাবেকি পোশাকই ব্যবহার করেছেন অভিনেতারা। এছাড়া, সেই সময়ের
প্রচলিত চুল বা দাড়ির বাহারি স্টাইলকেও অনুসরণ করা হয়েছে অত্যন্ত সচেতনভাবে।
আবার স্থানীয় যেসব শাসক চরিত্রদের দেখা যাচ্ছে, তাদের পোশাকের ক্ষেত্রে অদ্ভুত
বৈচিত্র্য। পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণ রায়ের ক্ষেত্রে চেকনাই ধুতি-পাঞ্জাবি, গোবরা
গোবিন্দপুরের জমিদার রতিকান্ত রায়ের যুবক পুত্র তথা ভারপ্রাপ্ত জমিদার দেবনাথ
রায় ইংরেজ পোশাক পরে, সাহেবি কেতায় চলাফেরা করেন, সাহেবের মতো বন্দুক চালিয়ে
প্রজাদের দমিয়ে রাখতে ভালোবাসেন। আবার চুতনার জমিদার বৃদ্ধ বাহাদুর-উল-মুলক্
মনোহর রায় ভূষণ বাহাদুরের পরণে মুঘলাই পোশাক, তিনি সাহেবের কুঠিতে এলেও
নিজের শরাব ছাড়া অন্য কিছু খান না। তিন বয়সের তিন জমিদারের তিন ধরনের পোশাক
বা কেতার ব্যবহার আসলে যেন এক বদলাতে থাকা সময়কালকেই চিহ্নিত করছে।
এবার আসা যাক অভিনয়ের কথায়। দু’পক্ষের চরিত্রাভিনেতারাই মোটামুটি নির্দিষ্ট
পরিসর পেয়েছেন অভিনয়ের ক্ষেত্রে। গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে যাঁরা অভিনয় করেছেন,
আলাদা করে তাঁদের সকলের নাম বলতে যাওয়া এখানে কিঞ্চিৎ অসম্ভব। অনর্থকও
বটে, কারণ সেক্ষেত্রে কয়েক সেকেন্ডে বা কয়েক মিনিটের রোল পাওয়া অভিনেতাদের
সমান-গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে কোথাও যেন খাটো করে দেওয়া হয়। নাটকটি সার্বিক
অভিনয়টিই এত প্রাণশক্তিতে ভরপুর যে, প্রত্যেক অভিনেতারই আসলে যেন সমগ্র
নাট্য-ভাস্কর্যটির এক-একটি কারুকার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বলা যায় ক্রফোর্ড পাইরনের কথা। সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেসিডেন্ট জেনারেল
তিতুমীরের প্রধান শত্রু সে-ই, কিন্তু তার সঙ্গে তিতুমীরের কখনও মুখোমুখি দেখা হয়
না। পাইরন বাকপটু, সারাদিন ডুবে আছেন প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের মোহে, কিন্তু নিজের
এলাকাকে নিজের দখলে রাখতে তার চেয়ে নিষ্ঠুর আর কেউ নেই। কেমন নির্লিপ্তির
সুরে সে তার ধামাধারী জমিদার ও দারোগাকে নির্দেশ দেয় – ‘তিতুকে, তিতুর স্ত্রী
মৈমুনাকে ও তিতুর পুত্র গওহরকে ওখানেই খুন করে চলে আসবেন।’ সে যেমন
ভক্তিভরে উচ্চারণ করে বিপ্রদাসের পদ, সেই তারই মুখ দিয়ে বার হয় – ‘প্রত্যেক
নারীর মধ্যে একেকটি বেশ্যা বাস করে।’ সে সাজন গাজীর গান শোনে নিয়মিত, কিন্তু
অত্যন্ত ধূর্তের মতো সাজনকেই ব্যবহার করে তিতুমীরকে শেষ করার জন্য। শেষ
যুদ্ধের আগে তিতুমীরের তার উদ্দেশ্যে বলতে থাকে – ‘বুজুর্গ লোক, পণ্ডিত শুধু
পুরোণো কিতাব পড়ে – আর তলে তলে আস্ত একটা জাতির খাদ্য, স্বাধীনতা, ইজ্জৎ,
ইমান সব কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র করে।’ তিতুর গলা তখন চড়ে গেছে রাগে, কেঁপে উঠেছে
সুতীব্র ঘৃণায়। প্রিয় পাঠক, আপনি কি মিল পাচ্ছেন বর্তমান সময়ের কোনও এক
নেতার, যিনি কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ আওড়ান?
স্বৈরাচারীর রুদ্ধদ্বার কক্ষে মুক্তকণ্ঠকে দমিয়ে রাখতে কী ধরনের আলোচনা চলে,
পাইরনের গৃহে জমিদার ও ইংরেজদের নিয়মিত বৈঠকের যে আবহ, সেখানে অনেকটাই
সেই আভাস পাওয়া যায়। আবার তিতু যখন নিজের কর্মসূচি স্থির করছেন, সেখানে
বিপ্লববাদের নানা দ্বন্দ্ব এসে জর্জরিত করছে তাঁকে। তিনি হাজার হাজার মানুষের
বাঁচার নিঃশ্বাস, তাদের রক্ষাকর্তা এবং অভিভাবক। কিন্তু ফকির মিসকিন শাহ এসে
যখন তাঁকে তাদের সম্রাট করতে চান, তিতু ভয় পান। কারণ, দিনের শেষে তিতুও একজন
মানুষ। তিনি যতই বলুন ‘হিংস্র হয়ে ওঠো’, তাও তিনি শিশু মধুসূদনকে দেখলে নিশ্চিত
মৃত্যু-খাদের সামনে দাঁড়িয়েও মুহূর্তের জন্য ভুলে যান রক্তের কথা। বাঁশের কেল্লার
মধ্যেকার দৃশ্যগুলিতে মাঝে মাঝেই এক ছোট্টও মেয়ের ছুটতে থাকা সেই জীবনকেই
প্রমাণ করে দেয় বারবার। এর জন্য নির্দেশনার বিশেষ প্রশংসা প্রাপ্য। মিসকিন শাহ
যখন তাঁকে প্রস্তাব দেন পালিয়ে বাঁচবার, তিতু বিলাপের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করেন।
তিনি যে কাঁটার মুকুট পরতে চাননি। তাঁর গড়া যে বাঁশের কেল্লা শতাব্দীর পর শতাব্দী
ধরে পড়ে পড়ে লাথি-খাওয়া মানুষকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাবে, সেই বাঁশের কেল্লা আসলে
যে তাঁকে বন্ধনে জাপটেছিল। বিপ্লবীর যে বন্ধন থাকতে নেই।
তবু তিতুমীরকে দেখলে এক অদ্ভুত মায়াভরা ভালোবাসা আসে। সে ভীরুতায় পরিপূর্ণ এক
অত্যাচারীর ঘাড় ধরে যখন বলে ‘আপনি এত বেগে পালান যে স্পষ্ট কিছুই দেখা যায় না’,
তখন তাকে ভালো লাগে। যখন সে বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে বলে ওঠে ‘তবে হবে
যোদ্ধা তৈরী হবে। হাসিনাকে দেখে, গোলাম মাসুমকে দেখে, এই বৃদ্ধদের দেখে…’, ভালো
লাগে তাকে। মির নিসার আলি হয়েছিলেন হজরত আলি, সেখান থেকে তিতুমীর, মানুষের
ভরসা। এই ‘তিতুমীর’-ও হয়ে উঠল এক সুতীব্র চিৎকার, কৃষক-শ্রমজীবী মানুষের
আন্দোলনের চিৎকার, ফ্যাসিবাদী শোষণকে ছুঁড়ে ফেলার চিৎকার, আর, আমাদের
মতো যারা অনেক ভেবেও সেই নিরাপদ আশ্রয় খুঁজি, সেই ভীতু মানুষদেরও চিৎকার।
‘আমাদের নিজেদের স্বার্থে খাঁটি স্বদেশি সিনেমা’ - সুমন সাধু
একদিকে কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক ফাদার ল্যাফো বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য
আনিয়েছেন একটি বায়োস্কোপ। অন্যদিকে স্টিফেন্স নামে এক ইংরেজ ভদ্রলোক কলকাতার স্টার থিয়েটার
মঞ্চে বায়োস্কোপ দেখাতে শুরু করেছেন। বায়োস্কোপের আগমন সম্পর্কে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে ছাড়া
হয়েছে হ্যান্ডবিল। বলা হচ্ছে, “পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য! বায়োস্কোপ! আসুন! দেখুন! যাহা কেহ কখনও
কল্পনাও করেন নাই, তাহাই সম্ভব হইয়াছে। ছবির মানুষ, জীব-জন্তু জীবন্ত প্রাণীর ন্যায় হাঁটিয়া ছুটিয়া
বেড়াইতেছে…।”
অন্যান্যদের মতো বায়োস্কোপ দেখে বিস্মিত হলেন হীরালাল সেনও। বিশদে জানার জন্য নিজেই চলে গেলেন
স্টিফেন্স সাহেবের কাছে। কিন্তু ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে হীরালালের সামনে মুখ খুললেন না
সাহেব। তাতে অবশ্য দমে গেলেন না হীরালাল। বিদেশ থেকে বায়োস্কোপের যন্ত্রপাতি জোগাড় করে এনে তা
দেখাতে শুরু করে দিলেন। এবং কালক্রমে হয়ে উঠলেন বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রাণপুরুষ।
সখের ফটোগ্রাফি থেকে সিনেমা তৈরির কাজে মেতে গিয়েছিলেন তরুণ হীরালাল। নিজেকে আত্মনিয়োগের কাজটি
ছিল ভয়ংকর। স্যার সুরেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বিরোধী বক্তৃতার কিছু ছবি তুলেছিলেন
হীরালাল। খবর চলে গিয়েছিল ব্রিটিশদের কাছে। মতিলাল সেই খবর পৌঁছে দিয়েছিল গোপনে। এরপরেই ঘটে যাবে
চরম বীভৎস ঐতিহাসিক ঘটনাটি। হীরালাল সেনের ছবির গুদামে আগুন লাগানো হবে। এতদিন ধরে যা ছিল
‘দুর্ঘটনা’, পরিচালক অরুণ রায় তাই-ই সত্যি বলে প্রকাশ করবেন।
কে এই অরুণ রায়? ‘হীরালাল’ ছবির পরিচালক। কিছুদিন আগেই ছবিটি মুক্তি পেয়েছে। চিত্রনাট্যও তাঁর। নিখুঁত
গবেষণার মাধ্যমে ঘটনা পরম্পরায় তিনি এঁকেছেন তাঁর হীরালাল-কে। ইতিহাসকে বিকৃত না করে। খুবই দক্ষতার
সঙ্গে তুলে এনেছেন কয়েকটি ঐতিহাসিক সত্য। যার জন্য অরুণবাবুর কাছে ঋণী থাকা উচিত বাংলা চলচ্চিত্র
মহলের৷ আগেও দুটি ছবি বানিয়েছিলেন, ‘এগারো’ আর ‘চোলাই’। ‘চোলাই’ ছবিটিকে রিলিজ করতে দেওয়া হয়নি
নানা রাজনৈতিক কারণে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তাঁর এই তিনটি ছবিই ভীষণভাবে রাজনৈতিক। সেই কারণে
আলাদাভাবে নজর কেড়েছেন অরুণ রায়।
ছবিতে তথ্যের খুঁটিনাটির ভ্রান্তি আছে কি নেই সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। তার চাইতেও বড়ো কথা পরিচালক
অবিমৃষ্যকারী বাঙালির হয়ে কাজটি করলেন। কয়েকটি কথা না বললেই নয়, পুরোনো কলকাতার আমেজ তেমন
পাওয়া যায়নি ছবিতে। কিছু মিছিল দেখতে অবাস্তব লাগে। পুরো ছবির কালার টোন যেন ফ্যাকাসে। সাম্প্রতিক
বাংলা ছবির এই এক সমস্যা, সাউন্ড এবং কালারে আলাদা করে কেউই খরচ করতে চান না। কালার প্যালেটের
বাইরে যদিও হীরালাল ছবির সাউন্ড বা শব্দভাবনা ভালো লেগেছে। ময়ূখ ও মৈনাকের আবহ একেবারে মানানসই।
ভালো লেগেছে অনুষ্কা চক্রবর্তীর হেমাঙ্গিনী, তন্নিষ্ঠা বিশ্বাসের কুসুম, অমরেন্দ্রনাথের চরিত্রে অর্ণ
মুখোপাধ্যায় এবং মতিলালের চরিত্রে পার্থ বিশ্বাসকে। আলাদা করে বলতে হবে হীরালালের চরিত্রে অভিনেতা
কিঞ্জল নন্দর নাম। ঐতিহাসিক হীরালালকে তিনি প্রাণ দিয়েছেন। সিনেমা-শেষে তাঁর অভিনীত চরিত্রের পাশে
দু-দণ্ড জিরিয়ে নেওয়া যায়। এতটাই গুরুত্বপূর্ণ অভিনয় করেছেন কিঞ্জল। আশা করব, ভবিষ্যতে এরকম
অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের অংশ হবেন তিনি। হারিয়ে যাবেন না। ঠিক যেমন আশা করব পরিচালক অরুণ রায়
হারিয়ে যাবেন না। বাংলা ছবির দুর্দশার দিনে তাঁদের প্রয়োজন আছে। তাঁরা প্রযোজক পাবেন না, ডিস্ট্রিবিউটার
পাবেন না, সিনেমা হল পাবেন না, হয়তো তেমন দর্শকও পাবেন না; কিন্তু যে জেদটা থাকবে তা বাংলা ছবির
ইতিহাসে অধ্যায় হয়ে থেকে যাবে। থেকে যাবে যুগের চিহ্ন হয়ে। হীরালাল তো আসলে একজন কেউ নন, ২০২১
সালেও কত কত শিল্পীর কাজ মানুষের কাছে পৌঁছায় না। তবুও বাঙালি স্বপ্ন দ্যাখে। লড়াই করে। যেমনটা এক
শতাব্দী আগে করেছিলেন হীরালাল সেন। বাংলা চলচ্চিত্রের জনক। আমাদের শপথ নিতে হবে, এই মানুষগুলোকে
আমরা যেন না ভুলি। অরুণ রায় এবং তাঁর টিম-কে কুর্নিশ।
গায়কের পবিত্র কর্তব্য কি শুধুই শ্রোতার মন যোগানো? - গায়কের গেরো"
আত্মপক্ষ: গায়ক আর শ্রোতার মধ্যে একটা পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক থাকা উচিৎ। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। শিল্পীদের দূর আকাশের তারা মনে হচ্ছে না আর। তাদের এখন ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো যাচ্ছে। কমেন্ট বক্সে ইচ্ছে করলে কাছা খুলে নেওয়া যাচ্ছে। তাই দূরত্ব থেকে আসা সমীহটা চলে গেছে।
সব মানুষ তো সমান হয় না। অনেকে অতি অভদ্র হয়। অনায়াসেই সৌজন্যের বেড়া টপকাতে পারে। এই লেখার “আমি” হচ্ছে তেমন এক অতি অভদ্র, মুখফোড় গায়ক। তার শ্রোতাদের প্রতি তেমন শ্রদ্ধাটদ্ধা নেই। সে নিজেকে নিয়ে সদা সচেতন, সিরিয়াস। মাঝেমাঝে খানিকটা আত্মপ্রচারমুখী। এই “আমি” চরিত্রটা কাল্পনিক কিনা সেটা নিশ্চিতভাবে জানতে পারলে বলে দেব। বাকি সব চরিত্রই ঘোর বাস্তব।
তৃতীয় পর্ব
সমকালীন অনেক কণ্ঠশিল্পীকে নিয়ে কিঞ্চিৎ পরিহাস করে আনন্দ পান যে শ্রোতারা, তাঁদের অনেকের একটা সাধারণ বক্তব্য আছে। সেটা হল – “এদের তো নিজেদের একটাও তেমন বলার মতো গান নেই। সব তো পুরনো গান গেয়েই নাম করছে।”
ঠিকই তো। ক’টা সমকালীন ভাল বাংলা গান সম্পর্কে শ্রোতারা তেমন করে জানতে পারছেন? কতজন শিল্পী নিজের গান গেয়ে উজ্জ্বল হচ্ছেন? দূর্ভাগ্যজনক সত্যিটা হল এই যে, বেশিরভাগ সেই “নামটুকুও” করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
তা বলি, নিজের গান গেয়ে আমাকে যদি কারুর মনোযোগ পেতে হয়, তাহলে সেই লোকটারও তো আমার গানটা শোনার মতো মন থাকতে হবে, নাকি! চেনা গানের মোহ থেকে সারা জীবন বেরোতে না পারলে আর কী হবে! জলসায়, টেলিভিশনে, এফ.এম স্টেশনে, এমন কী ঘরোয়া আসরেও কিছু কায়মনোবাক্যে স্থূল শ্রোতা শুধু চেনা গান, হিট গান শুনতে চান।
আমি অবাক হয়ে যাই। মানুষ অন্য লোকের থেকে শুনে বা ছবি দেখে অচেনা জায়গায় বেড়াতে যায়; নতুন রেস্তোরাঁয় গিয়ে অচেনা খাবার খায়; অচেনা পাড়ায় ফ্ল্যাট কেনে; অচেনা রিক্সাওয়ালার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করে; মোটামুটি অচেনা মানুষকে বিয়ে করে, এবং বিচ্ছিন্ন না হয়ে, সারা জীবন কাটিয়ে দেয়। কিন্তু অচেনা গান হলেই ফোন বের করে হোয়াটসঅ্যাপ করে, বা উঠে চা খেতে বা বাথরুম করতে যায়।
তা সত্ত্বেও গায়কের পবিত্র কর্তব্য হল শ্রোতার মন যোগানো। তাঁর যা ভাললাগে তাই শোনানো। আমার যা করতে ভাললাগবে, সেটা আমি খানিকটা ভাল করে করব। অন্তত যা করতে ভাললাগেনি তার চেয়ে তো ভাল করব বটেই। স্কুলে ইতিহাস পড়তে ভাললাগত না, ফেল করতাম। ভূগোল ভাললাগত। স্কুল থেকে ফিরে প্রথমেই ভূগোলের হোমওয়ার্ক করতাম। প্রশংসিতও হতাম। এই একটা সহজ সত্যি মানতে আমাদের খুব কষ্ট। অন্য কারুর ভাললাগা গিলে আমাকে পেট ভরাতেই হবে। আমার ভাললাগার সঙ্গে সেটা কোনওমতে মিলে গেলে আমার পিতৃপুরুষ উদ্ধার হবেন।
শ্রোতার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখি। এই চেনা গানের মোহ আসলে চেনা সুরের নস্টালজিক টান। কারণ সাধারণত চেনা লিরিক বলে কিছু হয় না। অতি স্মরণীয় গীতিকবিতারও চার লাইনের বেশি কেউ খাতা না দেখে গাইতে পারে না। গায়করাই পারে না, শ্রোতাদের থেকে তো প্রত্যাশা করাই দুরাশা।
এখনকার একজন খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী একবার একটা সাক্ষাৎকারে আরেকজন কণ্ঠশিল্পীকে বলছিলেন একটা অভিজ্ঞতার কথা। তিনি একটা জলসায় গাইছেন। শ্রোতারা একেবারে মেতে গেছেন। খুব নাচানাচি চলছে। এমন সময় গানের মাঝে তিনি নাকি উইংসে চলে এলেন। সহযোগী যন্ত্রশিল্পীরা খুব খানিক বাজিয়ে কিছুটা সময় কাটালেন। তারপর কণ্ঠশিল্পী আবার মঞ্চে ফিরে আগে গেয়ে দেওয়া লাইন আবার গাইলেন। নাচের কিন্তু বিরাম নেই। যাঁরা নাচছেন তাঁরা কি আসলে কিছু শুনছেন?
আজকাল গান শোনা একটা আনুষঙ্গিক কাজ। গান আমরা শুনি গাড়ি চালাতে চালাতে, বা রান্না করতে করতে, বা অঙ্ক কষতে কষতে। সব ক্ষেত্রেই অন্য কাজটা বেশি মনোযোগ দাবি করছে। ফলে যা হবার তাই হয়েছে।
চেনা সুরে নতুন কথা বসিয়ে গেয়ে দিলে ক’জন খেয়াল করবে মাঝে মাঝে দেখতে ইচ্ছে করে। করেই ফেলব এটা এবার কোনও এক জলসায়।
"বিজন ঘরে, নিশীথ রাতে'-ময়ূরী মিত্র
কিছুকাল ধরে মন করছে নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য্যকে নিয়ে কিছু বলি | এমন নয় যে ওঁর লেখা পড়ে একেবারে থরথর করে উঠেছি | আবার এমনও নয় কৃষক বা মানুষের খিদে তেষ্টা নিয়ে কেবল ইনিই এইমাত্তর নাটক লিখে উঠলেন | তবুও কোথাও না কোথাও নাট্যকার হিসেবে বিজনবাবুর জাত ঢুঁড়ে বেড়ানোয় একটা তাড়া আসে আমার ভেতর থেকে |
আসলে থিয়েটার দিয়ে মানুষের খোঁজ নেয়া আর মানুষকে খবর করে থিয়েটার করা — দুটো যেন কেমন মিহি গোলতাল পাকায় বিজনে | আর থিয়েটারে এই মণ্ড পাকিয়ে দেয়াটাই বড় দুষ্প্রাপ্য | এ সে — দুকালেই |
বিজনকে নিয়ে আমার জোর ধাক্কা খাওয়া কিংবা একগলা জিজ্ঞাসার শুরু তাঁর ‘অবরোধ’ নাটকটি পড়তে বসে | এটিই ছিল আমার পড়া বিজনবাবুর প্রথম নাটক | শ্রমিক সমস্যা ও পুঁজি অর্থনীতি নিয়ে বিজনের এই একটিই নাটক | খেয়াল পড়ছে নাটকটি পড়তে বসে আমি যত না থমকে যাচ্ছিলাম , মনে হচ্ছিল , নাটকটি লিখতে বসে নাট্যকার অবশ হয়েছেন তার চেয়েও বেশি | সবচেয়ে বড় কথা নাটকটা লেখায় নাট্যকারের ইচ্ছেই বলুন আর আবেগই বলুন — টের পাচ্ছিলাম না মোটে | ‘অবরোধ’এ বিজনবাবুর ভাবখানা এমন —‘ লিখতে বলেছে তাই লিখছি | নতুবা যা দেখিনি তা লিখতে ভারী ঠেকা পড়েছে আমার |’
খুব সম্ভব — এই যা দেখিনি তা লিখবো না এবং লিখবো না তো লিখবই না — বিজনের এই নাছোড় দেমাক , এই ফাটাফাটি বদদিমাগ আমায় মাতোয়ারা করেছে | বিজন তাঁর সমান ও সমসাময়িকদের ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলেন এই দেখার গরিমায় | ভঙ্গিমায় | একশব্দে — দর্শনে | তবে কি সেকালের বাকি নাট্যকারেরা জীবনকে দেখতে জানতেন না? নাকি তাঁদের দেখায় শুদ্ধ ভাবটিই আসছিলো না ? বিজনবাবুর সঙ্গে বাকিদের দেখার ফারাক কোথায় ? ফারাক অবশ্যই দেখার চোখ , আন্দাজ আর দেখার বিষয়ে মন দেওয়ায় | বিজনবাবু দেখতে চেয়েছেন যা দেখতে তাঁর মন চেয়েছে – দরকার মনে হয়েছে দেখার | নাটকেও দেখিয়েছেন, জীবনে যা ঘটা অব্যর্থ বা স্বাভাবিকভাবেই যা ঘটবে সেই সব বিষয় | ‘এটাই তো ঘটা উচিত ভাই ,কমিউনিস্ট নাট্যকারের শেষের মতোই তো করতে হবে আমার নাটক ‘ —এই বেফালতু চরকি কাটা বিজনের দস্তুর নয় | ভেবে দেখুন,হিসেবমত বিজনের পক্ষে চোখ কান বুজে নাটকে একের পর এক টানা উচিত ছিলো আরো আরো দুঃখী অভাজনকে | অথচ ‘জবানবন্দি’ ‘নবান্ন’ এবং ‘গোত্রান্তর’ তিনটি নাটকেই বিজন বাছলেন এমন মানুষকে , যাঁরা ওপার বাংলায় নয় কিছু ভূমি নয় কোনো একটা ভব্য পেশা নিয়ে ছিলেন |
দেশভাগ সবাই দেখছিলেন | বিজন কিন্তু দেশভাগ ও সমসাময়িক দুরবস্থার সঙ্গে সঙ্গে পাখির চোখে ছেঁকে নিচ্ছিলেন নতুন অর্থনৈতিক শ্রেণি ও তদ্ভূত নতুন অর্থব্যবস্থার সম্ভাবনা , সূত্রগুলোকে | আরো একটি টাটকা শোষণক্রিয়ার বেসামাল ঠিকরে ওঠাটাকে | দুই দুঃখী মানুষের গরিব হওয়ার পরিমাণ ও পরিস্থিতির ফারাক কী করে আর গুরুত্বহীন থাকে তাঁর কাছে ? ব্যক্তিজীবনের এই ভেদগুলো ,দুখদরদের এই রিনরিনে সব তফাৎ কী করে অজানিত থাকে এক ধীমান নাটককারের কাছে ! তাই বিজনের নাটকে ওপারের সম্ভ্রান্তের এপারের বস্তিবাসীর দুখে ভোগে লীন হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক | সঙ্গত | অন্যরকম কিছু হলে সেটাই হতো অনাসৃষ্টি | বিজন দেখাতে চেয়েছেন , নাটক লিখে একজন অর্থবানকে যেমন শেখানো উচিত হতদরিদ্রকে কিভাবে বুকে তুলতে হয় ঠিক তেমনি করেই একজন গরিব হতভাগাকেও তো বোঝানো যেতে পারে অপেক্ষাকৃত সম্পদশালীকে কখনো সখনো বন্ধু করে নিলে খুব মন্দ হয় না | দুপক্ষের সামান্য সহজতায় সমাজতন্ত্রের ভিটে মাটি চাটি হয় কিনা কিংবা কোন ন্যায়বোধে সমাজতন্ত্রের শিক্ষেটা কেবল ধনীদের জন্যই বরাদ্দ থাকে, দেশের ভালো মন্দের প্রশ্নে শাসকের বিরুদ্ধে দাহ জন্মালে , এগোতে গরিব বড়লোক একে অপরে ঠিক কতটা আগুপিছু করবেন, জীবনের এইসব অঙ্গাঙ্গী বাড়তিটুকুকে দেখায় বিজন বরাবর সাফমাথার |
বড়ো কম নাট্যকার আছেন যিনি নিজের জীবন বিশ্বাস ও কাজের জায়গাটাকে মেখে একসা করে ফেলতে পারেন | আর যখন তিনি এটা করে ফেলেন, করে ফেলায় অনায়াস হন তখন তিনি নিজে যেমন পরিতোষ পান, ভাগ পান পাঠকরাও | অথচ আমরা বিজন পাঠে নিজেদের সন্তোষের এই দিকটিকে স্রেফ ধুলোয় মিশিয়ে দিলাম | কেবলি ভেবে মরলাম , আরে ! এতো সোজা মানুষ ! দেখিই না আর একটু খুঁচিয়ে ! যদি অন্তর্বিরোধের তলানিটাও উঠে আসে ? যদি নাট্যকারের হৃদয়ের সবখানটায় ছড়িয়ে পড়া দিনের আলোটাকে একটু অসমান করা যায় ! আসমান এর উল্টোবাগে হাঁটানো যায় বিজনকে!
হয়েছে কী —নিজে আমরা স্ববিরোধতায় এতোই দফারফা যে শিল্পের সিধে ভাবটা আর মোটে বরদাস্তই হয় না | বিজন যত গোঁ ধরেন ,যত সৎ হতে থাকেন, ততই তাঁকে ধরে ঝাঁকানোর নেশা চড়ে আমাদের | আরে বাপ রে বাপ ! প্রগতিশীল অথচ কোনো রকম ambiguity ই নেই ?যাহ এ আবার হয় নাকি??? বিজন বিরামহীন সত্য বলেন | আর তাঁর সত্যকথনের অস্বস্তিতে আমাদের কপাল চড়চড় করে | সত্যগোপনের স্বস্তি না পেয়ে বিজনকে অনবরত মূল্যায়নে আঘাত করি | আবার কী মজা কী মজা ! ফের সেই পাশ মুড়ি বিজনেরই পানে | আর তখন সেই যে সেই তালগাছটা ? এক পায়ে দাড়িয়ে ! উঁকি দেয় আকাশে !
বিজনের কিতাব পুরানা |
অক্ষর চিনি অমানিশায় |
বসন্ত রাগ - সুজয়কৃষ্ণ চক্রবর্তী
উত্তর গোলার্ধের বসন্তকে নিয়ে সারাা পৃথিবীতে উন্মাদনা রয়েছে যা দেখা যায় প্রাচীনকাল থেকে। শীতের তুষারাবৃত কাল শেষ হয়ে গেলে বসন্ত আসবে এই অপেক্ষায় মানুষ থাকতো। ভারতবর্ষে সেই জন্যই বসন্ত উৎসব মানুষের উৎসব ছিল। বসন্ত উৎসবের সঙ্গে বর্ষ গণনার একটা যোগ আছে। ভারতে বৈদিক কালের জ্যোতিষে সৌর মাস গণনার সঙ্গে চান্দ্র মাস গণনার একটা সামঞ্জস্য বিধান করা হতো। সেই হিসাবে ঐ বসন্তকালেই সায়ন মহাবিষুবের দিনটি আসে ( ২১শে মার্চ বর্তমানে ) যাকে Virtual Equinox Day বলা হয়। আজও আমাদের দেশের শকাব্দ গণনার সূত্রপাত ঐ দিন থেকে। মুখ্যত বর্তমান ভারত সরকারের সায়ন রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ পঞ্জিকার ১লা চৈত্র এর পরদিন থেকে শুরু হয়। প্রাথমিক কালে বর্ষায় বৎসরারম্ভ হতো। সেই থেকেই বর্ষাকাল কথাটি এসেছে, তার পরে, হেমন্তে বর্ষারম্ভের চিহ্নটি রয়ে গেছে মাসের নাম যেখানে অগ্রহায়ণ হয়েছে অগ্রহায়ণের পরে বর্ষারম্ভ বসন্তে। স্মৃতির কালে ঋতু কালের মধ্যে বসন্তকেই প্রধানতম ও প্রথমতম বলা হয়েছে। বসন্তকে শ্রেষ্ঠ ঋতু হিসাবে বর্ণনা করার চিহ্ন বহু স্মৃতি সম্মত শাস্ত্র এবং কাব্যের মধ্যে রয়েছে। বস্তুত Equinox Day এবং বসন্ত কালীন প্রথম পূর্ণিমাটির একটি সংযোগ একদা ছিল। এখন ক্রমশ সেই দিনগত ঐক্য আর নেই। চান্দ্র হিসাব অনুসারে দোলপূর্ণিমা একদিনে আর মহাবিষুব অন্যদিনে চলে গেছে। শুধু চান্দ্র মাসের ধারায় ঋতু চক্রের ধারণা অক্ষত রয়ে গেছে।
বসন্ত কাল জুড়ে সেময় বেশকিছু উৎসব চালু ছিল মাঘী শুক্লা পঞ্চমীকে বসন্ত পঞ্চমী বলার কারণও তাই। কোনো কালে সৌর মাঘেই Equinox দিবস ছিল। মাঘ ফাল্গুনে পার্থক্য কম। মলমাসের কার্যকারণে মাঘের তিথিগুলি তখন বসন্তকাল কথায় ও কাজে সমান হয়ে যায়। যদিও উত্তর ভারতে বসন্ত পঞ্চমী তিথিটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আলাদা। মাঘী শুক্লা পঞ্চমী নয়। ঐ তিথি মূলত দ্রীপঞ্চমী। ঐ দিন লক্ষ্মী দেবীর পুজার কথা থাকলেও সরস্বতীই বিশেষ ভাবে ঐ দিন পূজিতা হন। এর পরে অবশ্যই দোল পূর্ণিমার সঙ্গে স্মার্ত যোগাযোগ। কখনো কখনো সৌর ফাল্গুনে এসে পড়ে।
তখন বসন্ত কাল কথায় ও কাজে সমান হয়ে যায়। নদীরুপা সরস্বতী জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী ঐ বসন্ত কালেই মাঘী পঞ্চমীতে পূজিতা হন। এর পরে অবশ্যই দোলপূর্ণিমার সঙ্গে সমার্ত যোগাযোগ খুজতে বলবো। সরস্বতী পূজার দিন উত্তর ভারতে কোথাও কোথাও হোলি গানের সূচনা হয়। কোথাও কোথাও এ-বাংলায় সরস্বতীকে আবীরও দেয়া হয়। কিন্তু বসন্তকালে আরও দুটি চান্দ্র তিথি দেখা যায় সেগুলি পরপর। মদন ত্রয়োদশী এবং মদন চতুর্দশী জুড়ে প্রাচীন কালের একটি বিশেষ প্রধান যোগ্য উৎসব চালু ছিল। এইটিই ছিল প্রাচীন মদন মহোৎসব। মদন মহোৎসবের কথা বিভিন্ন কাব্যে নাটকে রয়েছে। বসন্ত কালে মদনের এই পূজার সঙ্গে ফার্টিলিটি কাল্ট’এর সরাসরি সংযোগ ছিল। বলতে গেলে আসমুদ্র হিমাচল এবং উৎসবে মেতে উঠতো। কিন্ত এ উৎসব ক্রমশ কালগর্ভে হারিয়ে গেছে মদন ভষ্মের মতো। আজ কেবল স্মৃতি শাস্ত্রের পাতায় বসন্তের সেই মিলন মহোৎসবের শেষাংশ রচিত হতো দুই দিনে; এর সূত্রপাত দোলপূর্ণিমার আগের দিনে। যে দিন চাঁচর বা বহূৎসব হয়ে থাকে। তারপর এক চান্দ্র মাস জুড়ে চলতো এই প্রেমের মহোৎসব। প্রাচীন ভারতে যেখানে সমাজে ছিল চূড়ান্ত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সেখানে গুপ্ত বা গুপ্ততর যুগে এই উৎসব অবাস্তব ছিল না। তাছাড়া মৌর্যপূর্ব ভারতের থেকে অষ্টম নবম শতাব্দী পর্যন্ত সমাজের একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন চৌষট্টি কলা পার দর্শিনী বারবণিতারা। তাদের ভূমিকা এই উৎসবে ছিল মুখ্য। কারণ তারাই ছিলেন মদনের পূজারিনী। যাক সেকথা । উৎসবের ক্রম ক্ষীয়মানতার অন্যতম কারণ অবশ্যই সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন। মুক্ত সমাজ ক্রমশ নানা নীতির পাশেও আবদ্ধ হল। ফলে উৎসবের মুখ্যাংশের অবলুপ্তির পর রয়ে গেল তার সূচনাপর্বটি যেটি আজকের দোলযাত্রা।
২ স্মার্ত রঘুনন্দন তার তিথি তত্ত্বে লিখেছেন ফাল্গুন পৌর্ণমাসং দোলযাত্রামাহ কৃত্য চিন্তামণৌ ব্ৰহ্মপুরাণম্ নরো দোলাগতং দৃষ্টা গোবিন্দং পুরুষোত্তমম্। ফাল্গুন্যাং সংযতো ভূত্বা গোবিন্দস্যং পুরং ব্রজেৎ।। স্বন্দপুরাণীয় পুরুষোত্তম মাহত্ম্যোনত্রিংশাধ্যায়ে ফাল্গুন্যাং কুৰ্য্যাদ্দোলায়াং মমভূমিপ। এছাড়াও বিষ্ণুপুরাণে ঐ দিনগুলিতে সংযতাহার এবং কোনোরকম সম্ভোগ করায় নিষেধ জানানো হয়েছে। বলা বাহুল্য কৃষ্ণ ভাবনা প্রকাশ হওয়ার পরেরকার এই সব ধারণা । কিন্তু ফাগ বা আবীর নিয়ে দোলোৎসবের যে বিবরণ আমরা সর্বত দেখতে পাই তাতে কৃষ্ণ ভাবনার চাইতে পূর্ববর্তীকালীন প্রাচীনতর উৎসবের আভাসই পাওয়া যায়। এখনও হতে পারে প্রাগার্য সমাজে এই উৎসবের ধারা ছিল। যা কালান্তরে পরবর্তী বৈদিক যুগে সাংস্কৃতিক ভাবে বসন্তোৎসবের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
নন্দকিশোর কৃষ্ণের দোলযাত্রার ধারাতেই এখনকার দোল পূর্ণিমা বিষয়ক উৎসবের ধারা। তবে এই দোলযাত্রার সূচনা বেশ কিছু কাল পরেই। কারণ ক্লাসিকাল সংস্কৃত সাহিত্য বা শ্রীমদ্ভাগবতে এর উল্লেখ নেই। যদিও চাঁচরের সঙ্গে কেউ কেউ হোলিকা দহন, কেউ কেউ মেট্রাসুর বধের গোপ বালক কৃষ্ণের কাহিনিকে মিলিয়ে নেন। যাই হোক একটা উৎসতো আছেই। হোলিকা দহনের কাহিনিতে হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে তারই ভগ্নী হোলিকা প্রজ্জ্বলিত অগ্নিতে বসেন। সেই অসুর কন্যা হোলিকার ক্ষমতা ছিল অগ্নিতে দগ্ধ না হওয়ার। কিন্তু যাকে দগ্ধকরার জন্য অনল প্রজ্জ্বলিত হলো সেই প্রহ্লাদ অক্ষত থাকলেও হোলিকা নিজেই দগ্ধ হলো। সেই কাহিনিও যেমন আছে তেমনি মেট্রাসুর বধাভিনয় কৃষ্ণলীলায় আছে। লতাপাতা পরিকীর্ণ একটি কুটিরে (বুড়ির ঘর পোড়া বা নেড়া পোড়া) জীবন্ত পিষ্টকময় বা ক্ষীরময় একটি মেষ – মেট্র – মেড়া – নেড়া কে রেখে ওঁ বিষ্ণু রুদ্র সমুদ্ভুত মহাশন হুতাশন। মেষমন্দির দাহেই’ত্র সমুদ্ভুত শিখো ভব।। প্রদক্ষিণেন ধাবন্তং কৌতুকাৎ সহ বিষ্ণুনা। প্রদক্ষিণং দক্ষিণাগ্নে কুরু কৃষ্ণ বিশেষতঃ।। এইটিই সেই চাঁচর উৎসব। পর দিন শুরু হয় দোলোৎসব। দোলমঞ্চ নির্মান পূর্বক তাতে আরোহন করিয়ে দেব বিগ্রহের পূজা হবে। এখানে গোবিন্দের পূজা করে দোলে বিগ্রহ স্থাপন করে তার পর ফল্গুৎসব বা আবীর দ্বারা গোবিন্দের অর্চনা করতে হয়। নারয়ণং জগন্নাথং বৈকুষ্ঠণ্ঠং পুরুষোত্তমম্। লীলয়া খেলয়া দেবং গোপীভিঃ পরিবরিতম্।। জগন্নাথাচ্যুতানন্ত জগদানন্দ বর্ধক। ফল্গুক্রীড়াভিরেতা ভিস্ত্রাহিমাং ভব-সাগরাৎ।। জয় গোপীমুখাম্ভোজ মধুপান মধুব্রত। ফল্গুক্রীড়াভিরেতাভি স্ত্রাহিমাং ভব-সাগরাৎ। এই সমস্ত মন্ত্রে গোবিন্দকে ফল্গু বা আবীর নিবেদন করার কথা বা করতে হয়।
৩ বসন্তের রঙ লাল – কালিদাস বসন্ত বর্ণনা করেছেন অকাল বসন্ত বর্ণনায় কুমার সম্ভবে। বালেন্দু বক্ৰান্যবিকাশভবাদ্বভূঃ পলাশানতি লোহিতানি। সদ্যো বসন্তেন সমাগতানাং নখক্ষতানীব বনস্থলীনাম্।। অর্থাৎ অল্প অল্প বিকশিত পলাশ ফুলের লাল কোরক গুলিতে (শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া বা তৃতীয়ার) বাল চন্দ্রের মতো বোধ হচ্ছে। যেমন বনস্থলী নায়িকা বসন্তের সমাগমে সর্বাঙ্গে নখক্ষতচিহ্ন (উদ্দাম কামের চিহ্ন) নিয়ে প্রকাশ হয়েছে। লগ্ন দ্বিরেকাঞ্জন ভক্তিচিত্রং মুখে মধুশ্রীস্তিলকং প্রকাশ্য। রাগেন বালারুণ কোমলেন চূত প্রবালোষ্ঠ মলঞ্চকার।। অর্থাৎ মধুশ্রী (বসন্তের সৌন্দর্য লক্ষ্মী)র নয়নে যেন ভ্রমরের কজ্জ্বল এবং পুষ্প তিলকের আলপনা (ভক্তি চিত্র) মুখ মণ্ডলে বিরাজমান। বালসূর্যের রক্তরাগে কোমল আম্রমুকুলগুলিরঞ্জিত হওয়ায় বোধহলো প্রবাল রাগে বসন্তলক্ষ্মী নিজ ওষ্ঠাধর রাঙিয়েছেন।
এরকম বেশ কয়েকটি শ্লোক উদ্ধার করা যায়। এই প্রকৃতির রক্তরাগ সদৃশ বর্ণ বসন্তের জ্ঞাপক। প্রাচীন সাহিত্যে হোলী খেলার নিদর্শন তেমন ভাবে না থাকলেও বসন্তের রঙ আসলে ফাল্গুনেরই উন্মাদনার প্রকাশ এবিষয়ে সন্দেহ নেই। গীত গোবিন্দে জয়দেবের রচনায় প্রথম সর্গের দুই গানে বসন্ত বর্ণনা আছে। ‘সামোদ দামোদোর’ পর্বের প্রথম গান। ললিত লবঙ্গ লতা পরিশীলন কোমল মলয় সমীরে। মধুকর নিকর করম্বিত কোকিল কুজিত কুঞ্জ কুটীরে। বিরতি হরিরিহ সরস বসন্তে। নৃত্যতি যুবতি জনেন সমং সখি বিরহি জনস্য দূরন্তে।। অর্থাৎ এই বসন্তে মলয় পবন ললিত লবঙ্গলতার আলিঙ্গনে কোমল হয়েছে এবং ভ্রমর গুঞ্জন মিশ্রিত কোকিল কুজনে কুঞ্জকুটির মুখরিত হয়েছে। হে সখী, বিরহী জনের পক্ষে অত্যন্ত পীড়া দায়ক এই সরস বসন্তে হরি বিহার করছেন এবং যুবতী জনের সঙ্গে নৃত্যরত হয়েছেন। জয়দেবের এই কাব্যে হরির দোলযাত্রার বিশদ বিবরণ কিছু নেই কিন্তু বসন্ত বর্ণনার প্রবল উচ্ছাস রয়েছে যথেষ্ট। মহাকবি কালিদাসের কাব্যের অতুল সৌন্দর্য না হলেও শৃঙ্গার রসান্বিত রাধাকৃষ্ণ লীলা বসন্তের মোড়কে এই ধরণের সাহিত্যের সৃষ্টি সম্ভারকে সমৃদ্ধ করেছে। তবে প্রকৃত অর্থে দোলে রঙের হোলিখেলা সাহিত্যে এসেছে মধ্যযুগে। হ্যাঁ ইতিমধ্যে অবশ্য তার সঙ্গে রাধাকৃষ্ণ লীলার বিরাট সংযোগ তৈরি হয়েছে। এরই ধারায় মৈথেলী কোকিল বিদ্যাপতি লিখেছেন – নব বৃন্দাবন নবীন তরুগণ। নব নব বিকশিত কুল।। নবীন বসন্ত নবীন মলয়ানিল মাতল নব অলিকুল ।। বিহবই নওল কিশোর কালিন্দী পুলিন কুঞ্জ নব শোভন নব নব প্রেম বিভোর।। নবীন রসাল মুকুল মধু মাতিয়া নব কোকিল কুল গায়। নব যুবতী গণ চিত উন মাতয়ে নব রসে কাননে ধায়।।। বসন্ত ঋতুর সঙ্গে হোলি খেলার এই মেল বন্ধন যে কয়েক শত বৎসরের তা নির্ণয় করে দেয় আদি মধ্য যুগে রচিত এই পদগুলি। নওলকিশোর কৃষ্ণের হোলি খেলার আরো বিবরণ পাওয়া যায়। জ্ঞানদাসের এই পদে — মধু বনে মাধব দোলত রঙ্গে। ব্রজ বণিতা ফাগু দেই শ্যাম অঙ্গে।। কানু ফাণ্ড দেয়ল সুন্দরী অঙ্গে। মুখ মোড়ল ধনি করি কত ভঙ্গে।। ফাগু রঙ্গে গোপী সব চৌদিগে বেড়িয়া। শ্যাম অঙ্গে ফাগু দেই অঞ্চলি ভরিয়া।। ফাগু খেলইতে ফাগু উঠিল গগনে। বৃন্দাবন তরুলতা রাতুল বরণে।। ষোড়শ শতকে উদ্ধব দাস নামক আর এক বৈষ্ণব কবির লেখায় হোলি খেলার চিত্র ধরা পড়েছে দারুণ সুন্দর ভাবে – ঋতুরাজ ব্রজ সমাজ হোরি রঙ্গে রঙ্গিয়া। নাগরিবর হোরিরঙ্গ উৰ্মত চিত শ্যামসঙ্গ নাচত কত ভঙ্গিয়া।। অন্য একটি পদে রঙ খেলার বিষদ বিবরণ রয়েছে – বৈঠল শ্যাম সঙ্গে মধুমঙ্গল সুবল সখাদিক সাথে। রাধা ললিতাবিশাখা আদি সহচরি পিচকারি করি নিল হাতে।। কানুক পিচকারী যবহি বরিখত একহি শত শত ধারে। সহচরি মেলিরাই যব ডারত কত কত শত একবারে।। বহুবিধ রঙ্গ অঙ্গ সব ভীগত আঁচরে মোছত মুখ। জিতলু জিতলু ভাষি হাসি দেই করতালি ক্ষণে ক্ষণে বাড়ত সুখ।। আরো বেশ কিছু পদে এই বাসন্তিক দোলোৎসবের বা রঙ খেলার বিবরণ পাওয়া যায়। কিন্তু এসবই যে মদনমহোৎসব বা সেই প্রাচীন ভারতের কামক্রীড়ান্বিত অসাধারণ মিলন মেলারই অঙ্গ সেকথা কবিরা বিস্মৃত হননি। জ্ঞান দাস লিখছেন – আওত রে ঋতুরাজ বসন্ত। খেলত রাই কানু গুণবন্ত।। তরুকূল মুকুলিত অলিকূলধাব। মদনমহোৎসব পিককুলরাজ। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথও অসংখ্য বসন্তের গান লিখেছেন। অন্যান্য গীতিকারেরাও লিখেছেন। বসন্ত রাগে আগে প্রাচীন গান গুলি গাওয়ার রীতি ছিল। মুখ্যত জয়দেবের পদ বা বৈষ্ণব কীর্তন ও বসন্ত রাগে গীত হতো। উচ্চাঙ্গ সংগীত ও এই রাগকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। মিলনের ঋতুর জন্য এই রাগ চিহ্নিত । আর এই রঙ এসেছে মুখ্যত প্রকৃতি যেমন করে রঙ বাহারে নিজেকে সাজায়, পরাশে কিংশুকে অশোকে শিমূলে আম্রমুকুলে চারিদিক রক্তাভ হয়ে ওঠে সেই ধারায় মানুষও মিলনের এই ঋতুতে ফাগের রঙে রঞ্জিত করতে চেয়েছে নিজেকে। এখানেই রঙ, রাগ ও হোরিখেলার তাৎপর্য।
তৃণমূল সংস্কৃতি - মইদুল ইসলাম
সাম্প্র শক্তি দিল্লিতে সরকার গড়েছে আর আমাদের বাংলাকে
লুটছে। আমাদের দল তিনমুল বাংলা আর বাংলায় থাকা সব
মানুষের জন্য লড়ছে দাদা। কথাগুলো শহরের এক বস্তি
অঞ্চলের তৃণমূল করা এক পার্টি কর্মীর। দিল্লিতে চাষি
ভাইয়েরা আমাদের জন্য লড়াই করতেসে আর বাংলায় দিদি
আমাদের জন্য আসে। কথাগুলো দক্ষিণ বাংলার এক খুদ্র
চাষির যিনি তৃণমূল দলটি বুথে দাঁড়িয়ে করে। এই কথাগুলো
শহরের মধ্যবিত্ত ভদ্রসমাজ বুঝবেন না। তারা উপরে
উল্লেখিত দুই তারকা পার্টিকর্মীর উচ্চারণ নিয়ে টোন-
টিটকিরি করবেন। তারা তৃণমূল স্তরের মানুষের ভাষা,
ব্যাকারন এবং বানান নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করবেন। ঠিক যেমন
একজন লড়াই করা সংগ্রামী জননেত্রীর উচ্চারণ নিয়ে তারা
হাসা-হাসি করেন। কিন্তু তাতে তৃণমূল স্তরের মানুষের কিছু
যায় আসে না। উল্টে ওই টোন-টিটকিরি এবং হাসা-হাসির ফলে
তাদের মধ্যে এক ধরণের রাগ তৈরি হয় শিক্ষিত, জটিল এবং
ভদ্র মধ্যবিত্তর উপরে। ওই তৃণমূল স্তরের মানুষ রাগ করে
যে এতদিন ভদ্র সমাজ তাদের দাবিয়ে রেখেছিল। শিক্ষা এবং
কর্মসংস্থানের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতাও কুক্ষিগত করে
রেখেছিল। এবার পালা এসেছে তাদের উচিৎ শিক্ষা দেবার।
সকলের জন্য যদি ভোট হয় তাহলে শিক্ষাগত যোগ্যতা ভোটের
জন্য কোনও মাপকাঠি হতে পারে না। তাই তারা জোট বাঁধে
স্লোগান দিয়ে ‘মা-মাটি-মানুষের’ জন্য। কথাগুলো একটি নবীন
প্রজন্মের গ্রাম্য স্কুল শিক্ষকের।
গবেষণার জন্য সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা
বলতে হয়। উপরের তিন ব্যাক্তি হয় তৃণমূলের কট্টর সমর্থক
অথবা সক্রিয় কর্মী। তিন নম্বর ব্যাক্তি মধ্যবিত্ত। আরও
পরিষ্কার করে বললে সরকারি চাকরির গ্রাম্য মধ্যবিত্ত।
তৃণমূল এবং মধ্যবিত্তর সম্পর্ক জটিল। এই সম্পর্ক
১৯৮০র দশক থেকে শুরু যখন আজকের তৃণমূল নেত্রী তথা
বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ১৯৮৪ সালে যাদবপুর লোকসভা
থেকে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। বাংলায় একটি রক্ষণশীল
মধ্যবিত্ত যেমন আছে তেমন একটি প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত
আছে। ১৯৮০র দশকে যখন তৃণমূল নেত্রী কংগ্রেস রাজনীতি
করতেন তখন থেকে রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত কংগ্রেস পার্টি কে
ভোট দিত। অন্যদিকে প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত বামফ্রন্ট কে
ভোট দিত। যাদবপুর কেন্দ্র থেকে জেতার পর সেই সময়ের
কংগ্রেসের যুবনেত্রী এমন এক মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
ডকটরেট ডিগ্রী লাভ করার দাবি করলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়
কখনও ছিল না। জাল ডিগ্রী লাভ করার জন্য কলকাতার একটি
ইংরেজি পত্রিকা তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। বাচ্চাবেলায়
দাদুর কাছে শুনেছিলাম কে যে ওনাকে বুদ্ধি দিয়েছিল যে বিদেশী
ডকটরেট ডিগ্রী লাভ করলে নাকি যাদবপুরের মতো আঁতেল
লোকসভা আসনে ওনার জনপ্রিয়তা বাড়বে। সেই সময়
প্রগতিশীল বাঙালি মধ্যবিত্ত খেপে লাল। এক বস্তিবাসি
বাংলা মিডিয়ামে পড়া এক মহিলা আবার জ্বাল ডিগ্রী নিয়ে
আমাদের উপরে খবরদারি করছে। এই ছিল তখনকার শিক্ষিত
বাঙালির মধ্যবিত্তর একটি অংশের মনোভাব। এলিট
প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা তখন সরকারি স্কুলে বাংলা মাধ্যম
নিয়ে পড়ার জন্য সোচ্চার।
সেই আশির দশকে বাংলা ছবির দুরবস্থা পরিষ্কার। তার মধ্যে
প্রগতিশীল মধ্যবিত্তর সবথেকে জনপ্রিয় নায়ক সৌমিত্র
চট্টোপাধ্যায় চুটিয়ে ছবি করছেন। আশির দশকে পাড়ার মোড়ে
অন্তত বার দুই খিদ্দা-কে বা তপন সিংহের ‘আতঙ্ক’ (১৯৮৬)
ছবির মাস্টার মশাই কে হলুদ ট্যাক্সি তে বসে থাকতে
দেখেছিলাম। দূর থেকে তারকা অভিনেতা কে বাচ্চাবেলায়
দেখতাম আর বড়রা বলত ‘ওই দেখ, সৌমিত্রর কীরকম ফর্শা
লাল টকটকে চেহারা।’ তারপর সেই আশির দশকে দূরদর্শনে
ছবি দেখে বুঝেছিলাম যে যিনি খিদ্দা, যিনি মাস্টার মশাই
তিনিই আবার ফেলুদা, আর তিনিই অপু। কয়েক বছর আগে এক
গুণী ইতিহাসবিদ যিনি নাটকও করেন, তাঁকে বিরক্ত হয়ে
জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘আচ্ছা ওনার কি এত টাকার দরকার যার
জন্য বাজে সিনেমা আর শেষে হনুমান চালিশার বিজ্ঞাপন
করতে হয়’? ভদ্রলোক হেসে উত্তর দিয়েছিলেন ‘তোমরা তো
তার সংসারের খবর রাখ না। টাকার প্রয়োজন আছে’। ১৯৫০
থেকে ১৯৭০এর দশক পর্যন্ত বাংলা ছায়াছবির একমেভ
দ্বিতিয়ম তারকা বলতে যখন উত্তম কুমার ঠিক সেই সময়
ইন্টেলেকচুয়াল অভিনেতা বলতে তখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
ছাড়া আর অন্য অভিনেতার নাম মনে করা যায় না যার প্রজ্ঞা
এবং সাবলীল অভিনয় বাঙালি মনে রেখে দেবে। কারণ তিনি এক
ভিন্ন ধরনের নায়ক। কিন্তু বুদ্ধিজীবী মার্কা ও বুদ্ধিদীপ্ত
ছবি ছাড়া সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অসংখ্য পপুলার ঘরানার ছবি
করেছেন যা গ্রাম-মফফস্বলের সাধারণ মানুষ টিকিট কেটে
সিনেমা হলে দেখতে গেছেন। তিনশোর উপরে ছবি, তার সঙ্গে
চুটিয়ে নাটক এবং এক কালে একটি স্বনামধন্য পত্রিকা
সম্পাদনা করেছেন। এহেন কর্মযোগী মানুষ বাংলা আর হয়ত
পাবে না। কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রথমে তৃণমূলের
সঙ্গে দুরত্ব স্থাপন করেন। ২০১১ সালের নির্বাচনের পরে
তৃণমূল পরিচালিত সরকার তাঁকে এক সরকারি পুরস্কার দিতে
চায়। তিনি গ্রহণ করলেন না। পরে আবার তিনি সরকারি
পুরস্কার গ্রহণ করলেন। মৃত্যুর আগে আবার তিনি
সিপিআই(এম)-এর এক পত্রিকায় বামফ্রন্ট কে সমর্থন
করলেন। এই দোলাচল তৃণমূল দল এবং তার সংস্কৃতির সঙ্গে
একভাবে বাম মনভাবপন্ন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির
দোলাচল বলা জেতে পারে।
তৃণমূল সংস্কৃতি কে বুঝতে গেলে ১৯৮০র দশক কে আরও
গভীরভাবে বুঝতে হবে। একদিকে ১৯৮৬ সালে যখন আতঙ্ক
ছবির মাস্টারমশাই আছেন আবার অন্যদিকে ‘হোপ ৮৬’ নামক
জলশা আছে যখন জ্যোতি বাবুর সামনে কোমর দুলিয়ে নাচ
হচ্ছে আর রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত এবং প্রগতিশীল
মধ্যবিত্তদের একাংশ নাক সিটকচ্ছেন। বলছেন বাম নেতা
সুভাষ চক্রবর্তী কি সব অপসংস্কৃতি বাংলায় আমদানি
করছেন। পরবর্তী কালে সুভাষ চক্রবর্তী, শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
এবং রুপা বাগচীর বিরুদ্ধে আবার প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত
গালিগালাজ করছেন যে কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা-নেত্রী হয়ে
তারা কেন ধর্মস্থানে যাচ্ছেন। কিন্তু ভোটের বালাই যে বড়
বালাই। নাস্তিক সেজে আপনি ভোট চাইতে পারবেন না। তৃণমূল
স্তরের মানুষ, মধ্যবিত্ত মানুষ, উচ্চবিত্ত মানুষ সবাই ধর্ম
মানে। তাই ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জন্য হোক বা ভোট
রাজনীতির পপুলার আবেদনেই হোক ধর্মীয় পরিচিতির মোড়ক
ও ধর্মীয় সুড়সুড়ি মার্কা অভিনয় করতেই হয় আর কি! তাই
আজ যারা তৃণমূল সংস্কৃতি কে পুজা কেন্দ্রিক একটি ক্লাব
কালচার বলে ঠাট্টা করে তারা বামফ্রন্টের কিছু নেতা-নেত্রী
দের তৃণমূল সংস্কৃতির কথা কিন্তু বেমালুম ভুলে যান।
তৃতীয় বিশ্বের দেশে লুম্পেন প্রলেতারিয়াত বলে যে শ্রেণিটি
আজ ক্রমশ বাড়ছে সেখানে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ আর বাদ
যায় কই। কিন্তু যেটা আজ গুরুত্বপূর্ণ তা হল উন্নত দেশেও
এই শ্রেণিটি বাড়ছে চাকরির অভাবে। আরও পরিষ্কার করে
বলতে গেলে শিল্পকেন্দ্রিক কারখানা না হবার ফলে বা
শিল্পকেন্দ্রিক পুঁজিবাদ গড়ে না ওঠার ফলে। এই বিশাল
অংশের মানুষ কে আজ তৃণমূল স্তরের মানুষ বলা যায় এবং
যাদের সংস্কৃতি কে তৃণমূল সংস্কৃতি ছাড়া আর কি ভাবে
চিহ্নিত করা যায়! হেগেল এবং মার্ক্স এই শ্রেণিটি সম্পর্কে
উৎসাহী ছিলেন না। হেগেলের সমাধান ছিল যে লুম্পেন
প্রলেতারিয়াত কে নতুন কলোনিতে পাচার করে দিতে হবে।
ইউরোপে আধুনিক শিল্পকেন্দ্রিক পুঁজিবাদ কে রক্ষা করার
জন্য এই লুম্পেন প্রলেতারিয়েতের কোনও প্রয়োজন নেই।
মার্ক্সের কাছেও মূলত লুম্পেন প্রলেতারিয়াত একটি পরজীবী
শ্রেণি যা পুঁজিবাদের বিকাশের জন্য অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু
হেগেল এবং মার্ক্স অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপের
পুঁজিবাদের সময়ের কথা বলছেন। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই
লুম্পেন প্রলেতারিয়াত ভারত তথা বাংলার রাজনীতির রন্ধ্রে
রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। কারণ রাজনীতি ছাড়া তার অন্য উপায়
আর কি বা আছে? সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই
লুম্পেন প্রলেতালিরাত আজ ঢুকে পড়ে নিত্যদিনের রাজনীতির
ভাষা পরিবর্তন করে দিচ্ছে। ভদ্র সমাজের কাছে তা আজ
তৃণমূল সংস্কৃতি কিন্তু সেই সংস্কৃতি কে কোনও একটি বিশেষ
দলের সঙ্গে যুক্ত করলে ভুল বিশ্লেষণ হবে। ভারত তথা
বাংলার সমাজের মধ্যে এই শ্রেণি আজ ক্রমবর্ধমান। ভারত
তথা বাংলার রাজনীতির অপরাধিকরন এই শ্রেণির রাজনীতিতে
প্রত্যক্ষ যোগদান করার ফল। বড় পুঁজি এই শ্রেণি কে বাদ
দিয়ে রাজনীতির চালিকাশক্তি হতে পারে না। তাই কি তৃণমূল
সংস্কৃতি আর কি বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী সংস্কৃতি সেই
বিভেদ করার সময় আজ ভারত তথা বাংলার রাজনীতিতে
অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে এই শ্রেণিটির তীব্র রাজনৈতিক
আকাঙ্খার জন্য। রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রসঙ্গে একটি কথা
আজ নির্দ্বিধায় বলা চলে। ভাষা দূষণ চলছে, চলবে। তৃণমূল
সংস্কৃতির ভাষায় ‘আপনাদের মতো দু-চার পিস মধ্যবিত্ত
অধ্যাপক কি বলছেন তাতে রাজনীতির কারবারিদের কি বা এসে
গেল’।
ইন্টারভিউঃ ঊষসী চক্রবর্তী
ভাণঃ যে কোনো একজন জনপ্রিয় অভিনেতা তাঁর ইম্প্যাক্ট পাওয়ার অনেক বেশী, কারণ তাঁর
পপুলারিটি। কিন্তু এটা কি শুধু পপুলারিটি নাকি এর ভেতর পেনিট্রেট করবার অন্য কোনো ধরণের
ইমোশনাল তারিকা আছে?
ঊষসীঃ আমি একবার গ্রিসে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে অ্যাম্পিথিয়েটার দেখার সময় যা পৃথিবীর
আদিম থিয়েটার আমাদের গাইড আমাদের বলেছিলেন, অভিনেতাদের বলা হত শয়তানের দূত। কারণ
তাঁরা একই মঞ্চে একবার রঙ মেখে মানুষকে হাসাতেন আবার সেই মঞ্চেই কাদাতেন। এটা
শয়তানের দূত ছাড়া কেউ পারে না। অ্যাস অ্যান অ্যাক্টর এটাকে আমি খুব কমপ্লিমেন্ট হিসেবে
নিয়েছিলাম। কারণ অ্যাক্টর হিসেবে আমার এইটুকু ক্ষমতা তো আছে যেখানে আমি তাঁদের উপর
ইম্প্যাক্ট তৈরি করছি। এই যে ক্ষমতা অভিনেতাদের আছে যা অনেকটা সহজাত ক্ষমতা বা
ট্যালেন্ট, এইটা কিন্তু রাজনীতিবিদরা ব্যবহার করেন।
ভাণঃ এর তো একটা পার্সিয়াল বিষয় আছে। মানে, আমরা যদি খুব ইন্টেলেকচুয়ালি বিষয়টিকে না
ভেবে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র যেমন ৭০-৮০’এর দশকে তরুণ মজুমদার হতে পারে বা পরবর্তীতে স্বপন
সাহা, অঞ্জন চৌধুরী বা হরনাথ চক্রবর্তীও হতে পারেন। তো এদের সিনেমার ক্ষেত্রে যে ধরণের
এথিক্স বা মোরালিটির একটি যে জায়গা তৈরি করা হয় যেমনঃ মিডিল ক্লাস, নিম্ন মধ্যবিত্ত,
বাঙালিয়ানার দৃঢ় বিশ্বাস, পারিবারিক মূল্যবোধের জায়গা; সেখানে দাঁড়িয়ে সবসময় কি রঞ্জিত
মল্লিক বেশি গৃহিত হবে নাকি বিপ্লব চ্যাটার্জিও হবে? এর মধ্যে কী কোনো রহস্য আছে?
ঊষসীঃ আমার মনে হয় যে পপুলারিটির কথা যদি আপনি বললেন সেখানে হিরোদের গ্রহনযোগ্যতা
অনেক বেশি হবে। মানে আমি যেমন একটা নেগেটিভ চরিত্র করি, কাল যদি আমার মনে হয় সক্রিয়
রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করবো এই চরিত্র করতে করতে তাহলে মানুষজন কিন্তু আমায় ভালোমতো
নেবেন না। বিপরীতে যে প্রধান বা মূল চরিত্রে অভিনয় করছে তাঁর গ্রহনযোগ্যতা অনেক বেশি।
ভাণঃ আচ্ছা এটা কি প্রমাণ করে না যে আসলে এটা একটা মেজরিটি লেভেলের ম্যাচুয়িরিটির
প্রচন্ড অভাব যেটা কিনা বড় পলিটিক্সে প্রভাব ফেলে যায়?
ঊষসীঃ কার মানুষের না রাজনীতির?
ভাণঃ মানুষের। তার মানে আমরা দেখলাম যে জনগণ একটা মানুষ যাকে অ্যাপারেন্টলি দেখে ভোট
দিচ্ছে। নাকি এটার পিছনে ভালোর প্রতি যে আমাদের স্বাভাবিক মোহ সেটাই কাজ করে?
ঊষসীঃ লোকের ম্যাচুয়িরিটি নিয়ে কথা বলা ঠিক নয়। কাজেই আমি বলতে পারবোনা যে তাঁরা
ম্যাচিয়র না ইম-ম্যাচিয়র কারণ এটা খুব জাজমেন্টাল শোনাবে কিন্তু হ্যাঁ ভালোর প্রতি যে
আকর্ষণ সেটা তো অবশ্যই কাজ করে।
ভাণঃ তাই জন্যই কি কান্তি গাঙ্গুলি দেবশ্রী রায় কাছে হারে?
ঊষসীঃ দেখুন এখানে ব্যক্তি কান্তি গাঙ্গুলি বা ব্যক্তি দেবশ্রী রায় নয়, এটা একটা হাওয়ার
ব্যাপার। তখন সেই সময় ইলেকশন যখন হয়েছে তখন হাওয়াতো বামেদের দিকে ছিল না। তাই
ব্যক্তি মানুষ এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। কোন দল, কোন পালে হাওয়া সেটা বুঝতে হবে।
ভাণঃ আজকের সেলেবদের রাতারাতি তারকা থেকে দেশের সেবক বনে যাওয়ার হাস্যকর চেষ্টা
পলিটিক্সকেই তাচ্ছিল্য করছে নাকি?
ঊষসীঃ আমার মনে হয় শুধু সেলিব্রেটিদের পলিটিক্স করা নিয়ে তাচ্ছিল্য নয়, পলিটিক্স করা
নিয়েই একটা তাচ্ছিল্য শুরু হয়েছে গোটা সমাজে। কারণ আমরা আমাদের ছোটবেলা থেকে পলিটিক্স
বিষয়টাকে সিরিয়াস বিষয় ভেবেছি। কিন্তু এখন নায়ক-নায়িকারা শুধু পলিটিক্স করছে সেটা
তাচ্ছিল্যের ব্যাপার তা নয় সামগ্রিক ভাবে যে কোনো পলিটিশিয়ানরাও এমন এমন কাজ করেছেন
বিগত কিছু দশকে যে পুরো ব্যাপারটাই ছেলেখেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ সমাজে এখন সকলে মনে
করেন ভালো লোকেরা রাজনীতি করেন না। এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে সেলিব্রেটিদের
পলিটিক্স করা। প্রথমত আপনি যেটা বললেন অনেক সেলিব্রেটিকে আমরা দেখেছি এখানে
রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়, কিন্তু দক্ষিণে যত বেশি অভিনেতা-অভিনেত্রী ধারাবাহিক ভাবে
পলিটিক্স করেছেন বাংলায় ঐ চলটা যে বিরাট মাপের ছিল তা না। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন
দেখতাম সেইসব সেলিব্রেটিরাই রাজনীতি করছেন যাঁদের পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড আগে থেকেই
ছিল। যাঁরা মাঠে-ময়দানে নেমেছেন, বা যাঁদের রাজনীতি নিয়ে কিছু বলার ছিল সারাজীবন ধরে। তখনও
ব্যাপারটা এতোটা হাসাহাসির পর্যায়ে যায়নি, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে কোনোরকম পলিটিক্যাল
ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়া বা যাঁদের কোনোরকম সামাজিক কাজে দেখা যায়নি তাঁরাই আজ হঠাৎ করে
এম.এল.এ বা এম.পি হওয়ার দৌড়ে নেমে পড়েছেন। দ্বিতীয়ত, পলিটিক্সটাই খুব সিরিয়াসনেস
বহির্ভূত একটা হাসির পর্যায়ে চলে গেছে। যেখানে যে খুশি নেতা হতে পারেন বা যা খুশি হতে পারে।
ভাণঃ সেলিব্রেটির কথাটা আলাদা করে বলার একটাই কারণ, সেলিব্রেটি শব্দটির মধ্যে
পপুলারিটির গপ্পোটি লুকিয়ে আছে এই জনমানসে প্রভাব তৈরি করার ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক
তিনিও পপুলার হতে পারেন কিন্তু সেটি একটি কনফাইন্ড জোনে। কিন্তু সেলিব্রেটি মানে তাঁকে কত
মানুষ চেনে বা কোন কোন কর্নার থেকে তাঁকে চেনে কীভাবে রিলেট করে সেটা কিন্তু সেলিব্রেটি
নিজেই আইডিয়া করতে পারে না। এই জিনিসটাকে যখন আমি হাতিয়ার করছি অর্থাৎ আমি যখন
আমার এই সেলিব্রেটি সত্তাকে সেলিব্রেশন মোডে নিয়ে যাচ্ছি সেই নিয়ে জনতার কোনো আপত্তি
নেই। কিন্তু যখন দেখা যাচ্ছে যে এইটাকে হাতিয়ার করে কাজ করছি, যেমন দেশ গড়া, রীতিনীতি
নির্ধারণ, সেই কাজটা করবার জন্য আমি এটাকে খুব বেআব্রু ভাবে ব্যবহার করছি। সেই কারণে
দেখা যাচ্ছে একজন খুব বড় মাপের ডাক্তার বা ঐতিহাসিক বা একজন মনোবিদ তিনি কিন্তু দ্রুত
আসেননা এর মধ্যে। এবার আসেননা কথাটা দুভাবে হতে পারে – হয়তো তাঁর ম্যাচুয়িরিটি অনেক
বেশি বা কম অথবা ওঁর দুম করে এতো মানুষকে নিয়ন্ত্রন করবেন বলে আশা করেন নি। এই বিষয়ে
আপনার কী মত?
ঊষসীঃ এলেও আমরা হয়তো সেটা নিয়ে অতো বেশি চর্চাও করিনা। এমনকি জানতেও পারি না।
পপুলার ফেসের তো আবার একটা অন্য ভ্যালুউ আছে যে কেউ এলেই আমরা সঙ্গে সঙ্গে জানতে
পারি, রিয়েক্ট করি, কমেন্ট করি। এখন তো সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে আমরা আবার অতি রি-
অ্যাক্টিভ হয়ে গেছি- মানে অন্তত সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাই পপুলার ফেস রাজনীতিতে এলে কিন্তু
নাড়াচাড়াও বেশি হয় সমাজে। সেটা কিছু খারাপ ব্যাপার না। অনেক সময় এটাও হয় যে, যেসব
সেলিব্রেটিদের আমরা খারাপ জনপ্রতিনিধি হবেন বলে মনে করেছিলাম বা কোনো পলিটিক্যাল
ব্যাকগ্রাউন্ড নেই সেরকম জনপ্রতিনিধি – তাঁরা কাজ শেষবধি কিন্তু খারাপ করেন না। অনেক
সময় ভালো করেন, সবাই যে খারাপ তা নয়। কিন্তু এটা তো একটা সিরিয়াস কাজ, শো-বিজনেজও
একটা সিরিয়াস কাজ যেখানে সাধারণ মানুষকে এন্টারটেইন করা হয় সেটাও খুব সিরিয়াস কাজ।
কিন্তু এই কাজে তো মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলি সরাসরিভাবে যুক্ত আছে ; অন্ন-বস্ত্র-
বাসস্থান-চাকরি। তাই এইকাজে একটি অন্য মাত্রার সিরিয়াসনেস দরকার।
ভাণঃ আপনি জীবনে যে জায়াগায় পৌঁছেছেন সেই জায়গায় তো আপনার কাছেও বিভিন্ন ধরণের
প্রার্থী হওয়ার অফার এসে পৌঁছেছে। কারণ আজকের যে বারবেলাতে এসে পড়েছি আমরা সেখানে
তো বিভিন্ন মহল থেকে টোঁকা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেখান থেকে দাঁড়িয়ে আমরা আপনার কোনো
সিদ্ধান্ত দেখিনি। পলিটিক্সকে কি সেলিব্রেটিরা ব্যবহার করছেন নাকি রাজনীতি বা
রাজনীতিবিদরাও সেলিব্রেটিদের ব্যবহার করছেন?
ঊষসীঃ এতো অনেকটা ডিম আগে না মুরগি আগের মতো প্রশ্ন। কারণ, দুপক্ষই দুপক্ষকে ব্যবহার
করছে। একপক্ষ তার ফেসটাকে ব্যবহার করছে অপরপক্ষ পলিটিক্সে একবার জিতে গেলে তার যে
সুযোগ-সুবিধা-ক্ষমতা ব্যবহার করছে। এটা আমার মনে হয় মিয়চুয়্যাল। সবাই সবাইকে ব্যবহার
করছে। আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি আমি রাজনীতি সচেতন একজন ব্যক্তি। কিন্তু আমার মনে
হয়েছে যেহেতু আমরা রাজনীতিকে ছোটবেলা থেকে খুব সিরিয়াস বিষয় হিসেবে বুঝে এসেছি তাই
যতক্ষণ না আমি পুরোপুরি নিজেকে নিবেদন করতে পারছি রাজনীতিতে বা কমিটমেন্ট করতে পারছি
তার আগে অব্দি আমার তেমন কোনো ইন্টারেস্ট নেই। কারণ আমার ধারণা হয়েছে রাজনীতি করতে
গেলে প্রচুর সময় দিতে হয়। কিন্তু সেই ধারণা আমার কমেও যাচ্ছে, কেটেও যাচ্ছে। কারণ বহু
মানুষ হাফ-হার্টেড কাজ করে, দু-নৌকায় পা দিয়ে চলছেন।
ভাণঃ তার মানে আমিতো সেলিব্রেটি, দল আমাকে সেলিব্রেটি হিসেবেই কাজে লাগাচ্ছে। তাহলে
আমার এই যে ওজন, আমার ফেম, আমার পপুলারিটিটা, এটা যেহেতু আমি তাকে নিবেদন করছি,
তাকে আমি সাপোর্ট করছি, যেমনঃ আমার নাম অমুক, আমি যেহেতু আমার ইমেজকে দলকে
ব্যবহার করতে দিচ্ছি তাই একজন সাধারণ কর্মী বা রাজ্য কমিটির সদস্যেদের সমতুল আমি কাজ
করবো না। কিন্তু এই বাজারেও, এই ইন্ড্রাস্ট্রিতে, চট করে কিন্তু আমরা দেখছি না যে একটা
সময় অনিল চ্যাটার্জির মতো মানুষ বা বিপ্লব চ্যাটার্জির মতো মানুষ বা সম্ভবত অনুপ কুমারও
একটা সময় – তো এঁরা সকলেই এসেছেন বাম রাজনীতি তে এবং বাম রাজনীতিতে অনেকদিন ধরে
ছিলেনও, কিন্তু তারপরে “ রাজনীতি যে একটি সিরিয়াস বিষয়, কমিটমেন্ট না থাকলে যত বড়ই
অভিনেতা হই না কেন সেটা সম্ভব নয় ” আপনার কথা অনুযায়ী যা আমরা মেনে নিলাম কারণ
রাজনীতি করাটাই একপ্রকার বালখিল্যতা সেটাই যেন জনমানসে প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু
তৎসত্ত্বেও, আপনি চাইলে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতেই পারেন, মূল প্রশ্নটি হল,
কোনো বাম দলের তরফ থেকে কি এখনও অব্দি এরম ডাক আসে? মানে যে কোনো বাম দল হতে
পারে। বা কেউ কি ভাবে বাম দলে যেতে? যদি ভাবে তাহলে কেন ভাবে? কেনই বা ডাকে? ডাকা উচিত
কিনা? আর যদি না ডাকে তাহলে এখানে বাম দল কোথায় আলাদা হয়ে যায়?
ঊষসীঃ আমার মনে হয় যাঁরা খুব ভুঁইফোঁড় মানে যাঁদের রাজনীতির কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড নেই,
যদিও এটি নেগেটিভ অর্থে বলিনি, তবুও, তাঁরা কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে ক্ষমতার কিন্তু একটা
সম্পর্ক ভেবে নেয়। যে রাজনীতি করবো ক্ষমতার জন্য। যেখানে আমিও পাওয়ার স্ট্রাকচারের
একটি অঙ্গ হয়ে উঠবো। দেখুন, বামেরাতো এখন ক্ষমতায় নেই, বাম দলে তাঁরাই আগ্রহী হবে যাঁরা
আদর্শগত ভাবে নিবেদিত, এইটুকু মনে জোর আছে যে আমি যদি বিরোধীপক্ষ করি আমার কাজ
নাও থাকতে পারে তবুও করবো। কিন্তু এই লোকগুলো সমাজে খুব কম।
প্রতিলিপিকর : পার্থ হালদার