ষোড়শ সংখ্যা ।। নবম ই- সংস্করণ ।। মে, ২০২১

ভাণ পত্রিকা

ষোড়শ সংখ্যা ।। নবম ই- সংস্করণ ।। মে, ২০২১

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

ও মৌলিকা সাজোয়াল

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) [email protected] ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সূচি

“খেলা হবে” ” টুম্পা সোনা” আর “জয়শিরাম’- ভোট বাজারে তিনটে শব্দের অর্থ খুঁজলেন – শুভনীল চৌধুরী

“রাজনৈতিক কালচার” বিষয় টা কি? তত্ত্ব তালাশ করলেন – পিকু দাশগুপ্ত

সত্যজিৎ স্মরণ

সত্যজিতের ছবিতে মধ্যবিত্তের নীতি নৈতিকতার সন্ধান চালালেন – গৌরাঙ্গ দণ্ডপাট

বিষয় চলচ্চিত্র: সত্যজিতের মর্জিমহল থেকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের দিকে যাত্রা’ লিখেছেন – সুমন দে

গান

“এখানে শ্রোতারা শোনে আড়ি পেতে” গায়কের গেরো”এর চতুর্থ এবং শেষ পর্বে এসে বললেন – স্নিগ্ধদেব সেনগুপ্ত

শিল্প

রাজনীতির সংস্কৃতি ও সংস্কৃতির রাজনীতি - শুভনীল চৌধুরী

 
 
 
 
 

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে আমার বিশেষ কোনো দক্ষতা নেই। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলতে যা বোঝে তার বেশি কিছু বোঝার ক্ষমতা আমার নেই, সেই দাবিও আমার নেই। তবু সম্পাদকমশাই-এর অনুরোধ অনেক চেষ্টা করেও ফেলতে পারলাম না। অতএব, এই নিবন্ধ।

 
 
 

লিখতে হবেই, আর এড়ানো যাবে না—এই কথা যখন বুঝতে পারলাম, ভাবতে শুরু করলাম কী নিয়ে লেখা যায়। সংস্কৃতি নিয়ে আমার জ্ঞান তো প্রায় শূন্য। এই ভাবনার মাঝে পাশের রাস্তা দিয়ে তৃণমূলের মিছিল গেল। মিছিল নয়, যেন দুর্গা পুজোর ভাসান! ‘খেলা হবে, খেলা হবে’-তারস্বরে ডিজে মাইকে গান বাজছে আর উদ্দাম নৃত্য করছে একদল যুবক। রাজনৈতিক সংস্কৃতি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে কী রূপ নিয়েছে বুঝতে আর বাকি থাকল না। ‘খেলা হবে’ ক্ষীণতর হওয়ার পরে আবার কম্পিউটারের সামনে বসলাম। আলস্যের আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ভাবলাম একবার ফেসবুক দেখি। খুললাম। সেখানে দেখলাম বামপন্থীরা কোনো একটি বিধানসভা আসনের জন্য মনোনয়ন জমা দিতে যাচ্ছে। সঙ্গে তারস্বরে বাজছে, ‘টুম্পা সোনা’ এবং সঙ্গতে উদ্দাম নাচ। বুঝলাম বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে টুম্পা সোনার হাত ধরে বিপ্লব এসেছে। এর কয়েকদিন পরে বাবুল সুপ্রিয়-র রোড শো-এর মুখোমুখি হতে হল। দেখলাম টালিগঞ্জের বুকে গেরুয়া পরিহিত কিছু যুবক ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিতে দিতে বাবুলের হুড খোলা গাড়ির পেছনে হাঁটছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির আঙিনায় আমাদের পশ্চিমবঙ্গে ধর্ম এসে ঢুকে পড়েছে।

 
 
 
 
 
 
 
 

রাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতির নিশ্চিতভাবেই আরো বহু দিক রয়েছে। কিন্তু এই বিধানসভা নির্বাচনে সর্বাধিক নজরে পড়েছে এই তিনটি নতুন উপাদান—‘খেলা হবে’, ‘টুম্পা সোনা’ এবং ‘জয় শ্রীরাম’।

 

তৃণমূল, বামপন্থী অথবা বিজেপি প্রত্যেকেই তাদের রাজনৈতিক স্লোগান বা গান ইত্যাদির সমর্থনে একটি আপাত অকাট্য যুক্তি দেয়—‘মানুষ আজকাল এটাই চাইছে’। এই কথা বলার পরে মনে হয় যেন আর কোনো তর্ক চলে না। মানুষ যদি মনে করে টুম্পা সোনা শুনবে আর ‘খেলা হবে’-র সঙ্গে নাচবে, তবে আর কী বলার থাকতে পারে? থাকে, যদি উদ্দেশ্য এটা হয় যে মানুষকে তার দৈনন্দিন পুঁজিবাদের পাঁকে নিমজ্জিত জীবন থেকে উত্তরণ করব। পুঁজিবাদের থেকে উত্তরণ বিষয়টি খুব কঠিন, ভোটের সময় চলে না। অতএব এই যুক্তিও কেউ মানবেন না। তবু ‘মানুষ আজকাল এটাই চাইছে’ এই যুক্তিটি অন্তত বামপন্থীদের মানায় না। তৃণমূল ও বিজেপি-র ক্ষেত্রে মানায়।

 
 
 

তৃণমূল একটি রাজনীতিবিহীন, আদর্শবিহীন রাজনৈতিক সমষ্টি যা একটি ব্যক্তিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতি-র নামে সমাজের যা পাঁক, তাকে বাঁচিয়ে শুধু নয়, তাকে আরো বাড়তে দিয়ে সর্বাধিক জনসমর্থন আদায় করাই এই দলটির লক্ষ্য। সমাজে মানুষ যখন সমষ্টিগতভাবে বাঁচে তখন সেই মানুষের মধ্যেই নানান মতাদর্শ কাজ করে যা সমাজের স্বতঃস্ফু্র্ততা এবং ক্ষমতার বিকর্ষণে তৈরি হয়। এই সমাজেই পর্ণোগ্রাফি আছে, অকথ্য গালি-খিস্তি আছে, জাতি ভেদাভেদ আছে, সাম্প্রদায়িক মানসিকতা আছে। যে কোনো প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতাকেই তৃণমূল চ্যালেঞ্জ জানায় না, কারণ তার সে দায় নেই। অতএব, রাজনৈতিক শহীদ মঞ্চে ‘পাগলু ডান্স’-এর সঙ্গে নাচ, তৃণমূলেই শোভা পায়। তাতে তৃণমূলের যে কোনো ক্ষতি হয়, তা নয়, একথা প্রমাণিত। কিন্তু সংস্কৃতির নামে গোঁড়া, বস্তাপচা টেলি-সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকারা বিদ্বজন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, সিনেমার নায়ক-নায়িকারা কোনো রাজনৈতিক শিক্ষা ছাড়াই রাতারাতি সাংসদ বা বিধায়ক হয়ে যান। সমাজের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক পচন রয়েছে, তাকেই পুঁজি বানিয়ে তৃণমূলের যাত্রা। তাই একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে তাদের স্লোগান হয়ে ওঠে, ‘খেলা হবে’। রাজনীতি যে খেলা নয়, মানুষের জীবনের সঙ্গে তা সম্পৃক্ত, বহু মানুষের বাঁচা-মরা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্য-বাসস্থান যে রাজনীতি দ্বারাই নির্ধারিত হয়, এই মৌলিক কথাটি হারিয়ে যায়। তৃণমূলের ভোট কৌশলী তাই অনায়াসেই বলতে পারেন যে ‘খেলা হবে’ একটি যুদ্ধনাদ (War cry) যা তাদের কর্মী বাহিনীকে উজ্জীবিত করে। খেলা হওয়ার পরে কী হবে, খেলার ফল কী হবে, খেলার পরে জনগণের কী লাভক্ষতি হবে তা এই যুদ্ধনাদের দাপটে হারিয়ে যায়। সঙ্গে মেশে গানের সুর, রাস্তায় নাচে যুবক-যুবতীরা—‘খেলা হবে’। রাজনীতি বর্জিত রাজনৈতিক স্লোগানের উদাহরণ দিতে হলে আগামী প্রজন্ম ‘খেলা হবে’-কে সামনের সারিতে রাখবে।

 
 
 

বিজেপি-র অবশ্য এ্যাজেণ্ডা অন্য। তারা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটি নতুন সংস্কৃতি আমদানি করতে চায়, যার চাষ তারা করেছে উত্তর ভারত তথা হিন্দি বলয়ে। রামের নামে রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে নতুন। হিন্দুত্ব এবং সাম্প্রদায়িকতার যেই আখ্যান বিজেপি তৈরি করেছে গোটা দেশে তারই অঙ্গ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানের আমদানি। শুধু তাই নয়। উত্তরপ্রদেশ তথা অন্যান্য রাজ্যে রামনবমীকে কেন্দ্র করে যে ডিজে-রা গান তৈরি করেন, তার অধিকাংশই তীব্রভাবে পুরুষতান্ত্রিক এবং সাম্প্রদায়িক। উত্তেজক সুরের সঙ্গে বিভিন্ন ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক স্লোগানকে মিশিয়ে হিন্দুবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার এক চূড়ান্ত উত্তেজনা তৈরি করে এই গানগুলিকে। পশ্চিমবঙ্গেও রামনবমীকে কেন্দ্র করে নিকট অতীতে যে সাম্প্রাদায়িক উত্তেজনার ঘটনাগুলি ঘটেছে সেখানেও এইধরনের ডিজে গান বাজানোর খবর আছে, বিশেষ করে মুসলমান অঞ্চলে। মন্দিরের সংখ্যা বৃদ্ধি, হিংস্র হনুমানের মুখ বিভিন্ন জায়গায়, বিজেপি-র ঝাণ্ডার পাশেই হিন্দু গেরুয়া ঝাণ্ডা আজ তাই স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। এই স্বাভাকিতা আসলে হিন্দু নামক একটি পরিচিতি সত্ত্বার নির্মাণ যা বিজেপিকে ভোটের বৈতরণী পার করার উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি বা শহুরে যে মধ্যবিত্ত সংস্কৃতি এতদিন পরিচিত ছিল, সেই সংস্কৃতির পাশেই বা তাকে প্রতিস্থাপন করে হিন্দুত্ববাদী এক উগ্র সংস্কৃতির জন্ম দিতে চায় আরএসএস-বিজেপি। বাম বা তৃণমূল সংস্কৃতির আঙিনায় বিশেষ কোনো সৃজনশীল হস্তক্ষেপ করেনি। তাদের রাজনৈতিক স্লোগানগুলিও তামাদি হয়ে গেছে বা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। এই দুই শূন্যতাকে ভরাট করার কাজ বিজেপি করেছে। ‘জয় শ্রীরাম’ তাই পশ্চিমবঙ্গেও স্বাভাবিকতা পেয়েছে।

 
 
 

বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গে এক বিকল্প সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল। সেই সংস্কৃতি বিরাজমান সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে রসদ সংগ্রহ করেও তাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল। যেমন ধরা যাক সলিল চৌধুরীর বিখ্যাত গানের এই কথাগুলি,

 

“আজ নয় গুন গুন গুঞ্জন প্রেমে

 

চাঁদ-ফুল জোছনার গান আর নয়

 

ওগো প্রিয় মোর, খোল বাহুডোর

 

পৃথিবী তোমারে যে চায়”

 

মূলধারার গান, কিন্তু এই মূলধারার গানের মধ্যেই নিহিত রয়েছে মূলধারার একটি সমালোচনা বা critique , যা বলছে মূলধারার প্রেমের গান পেড়িয়ে পৃথিবীর দিকে হাত বাড়াতে হবে। বামপন্থী চেতনায় সম্পৃক্ত না হলে সলিল চৌধুরীর পক্ষে এই গান লেখা সম্ভব হত না। মূলধারার মধ্যে বামপন্থী চেতনাকে সম্পৃক্ত রাখার মতন শিল্পীর আজ অভাব রয়েছে। এর কারণ জটিল। প্রথমত, সেই যুগের বামপন্থীরা যেই দিনবদলের স্বপ্ন মানুষকে দেখিয়েছিলেন, যেই আন্দোলন তাঁরা করেছিলেন, তার পরিণামে অসংখ্য মেধাবী শিল্পী, সাহিত্যিক, চিত্রকর, নাট্যকার, পরিচালক, বামপন্থী ভাবধারায় দিক্ষিত হন। এটা কাকতালীয় নয় যে সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, জর্জ বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ঋত্বিক ঘটক, বিজন ভট্টাচার্য, বা অন্যান্যরা বামপন্থী হয়েছিলেন। সেই সময়ের মেধাবী শিল্পীর মনেই বাম ধারা বইত, কারোর ক্ষেত্র সেই ধারা জাহ্নবী, কারোর ক্ষেত্রে বা ছোট নদী। তবু ধারাটি মনকে সিঞ্চন করত এক নতুন ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষায়। আজ বামপন্থী আন্দোলনের সেই জোয়ার আর নেই। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, চীনের পুঁজিবাদী ঝোঁক, পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের নবউদারবাদের সঙ্গে আপোস, সব মিলিয়ে বাম রাজনীতি নতুন দিনের স্বপ্ন মানুষের মনে জাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই বামেদের সংস্কৃতির জগতটাও দখল নিয়ে নিয়েছে টেলি-সিরিয়াল বা ফিল্মের মধ্যমেধার নায়ক-নায়িকারা, যারা এমনকি ব্রিগেডে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যানের যা করার কাজ, সেই অনুষ্ঠান সংযোজনার কাজটিরও ভার পেয়ে যাচ্ছেন। কেন? না মানুষ নাকি এটাই চাইছে।

 
 
 
 
 
 
 
 

এই আলোচনার সন্দর্ভে হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের কথা মনে পড়ে গেল। গল্পটি সবার জানা। গোরা নিজেকে একজন খাঁটি সনাতনী হিন্দু ব্রাহ্মণ মনে করেন। তিনি হিন্দু ধর্মের সর্বাধিক গোঁড়া এবং অন্ধবিশ্বাসগুলিকে নিজের জীবনে স্থান দিয়েছেন, একাগ্র চিত্তে তা মেনে চলেন। জাতপাত ব্যবস্থা, মুসলমানদের সঙ্গে দূরত্ব, ব্রাহ্মদের বিরোধিতা, নারীদের অধিকার বিষয়ে তাচ্ছিল্য-অবজ্ঞা-বিরোধিতা সবই তিনি করে চলেছেন। কোন যুক্তিতে? না, আমার দেশের অধিকাংশ মানুষ এই আচারগুলিতে বিশ্বাস করে, আমার দেশের অধিকাংশ মানুষ যা বিশ্বাস করে, যেই আচার পালন করে তা যদি আমি পালন না করি তবে দেশের মানুষের আপনজন হয়ে উঠব কী করে? তা যদি না হয়ে উঠতে পারি তবে তাদের সেবা করব কী করে? গোরা-র এই যুক্তির একটা জোর আছে। বলা যেতে পারে আজকের বিজেপি-ও মৌলিকভাবে এই যুক্তি দিয়েই তাদের হিন্দুত্ববাদের প্রচার ও প্রসার করে। দেশের মানুষের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে, তাদের সমস্ত আচার-নিয়ম-কানুন-ধর্মকে তাচ্ছিল্য করে দেশের মানুষের মন জয় করা যায় না। কিন্তু তাই বলে সমাজের যে নিকৃষ্টতম মূল্যবোধ তাকে আঁকড়িয়ে ধরে কি দেশের মানুষের সেবা করা যায়, না করা উচিত? উপন্যাসের একদম শেষ লগ্নে এসে গোরার বোধদয় হয়। সে বলে,

 
 
 

“আমি যা দিন-রাত্রি হতে চাচ্ছিলুম অথচ হতে পারছিলুম না, আজ আমি তাই হয়েছি। আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান খৃস্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন। দেখুন, আমি বাংলার অনেক জেলায় ভ্রমণ করেছি, খুব নীচ পল্লীতেও আতিথ্য নিয়েছি–আমি কেবল শহরের সভায় বক্তৃতা করেছি তা মনে করবেন না–কিন্তু কোনোমতেই সকল লোকের পাশে গিয়ে বসতে পারি নি–এতদিন আমি আমার সঙ্গে সঙ্গে একটা অদৃশ্য ব্যবধান নিয়ে ঘুরেছি–কিছুতেই সেটাকে পেরোতে পারি নি। সেজন্যে আমার মনের ভিতরে খুব একটা শূন্যতা ছিল। এই শূন্যতাকে নানা উপায়ে কেবলই অস্বীকার করতে চেষ্টা করেছি–এই শূন্যতার উপরে নানাপ্রকার কারুকার্য দিয়ে তাকেই আরো বিশেষরূপ সুন্দর করে তুলতে চেষ্টা করেছি! কেননা, ভারতবর্ষকে আমি যে প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি–আমি তাকে যে অংশটিতে দেখতে পেতুম সে অংশের কোথাও যে আমি কিছুমাত্র অভিযোগের অবকাশ একেবারে সহ্য করতে পারতুম না। আজ সেই-সমস্ত কারুকার্য বানাবার বৃথা চেষ্টা থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে আমি বেঁচে গেছি”

 
 
 

অর্থাৎ, গোরার এক নতুন উপলব্ধি হয়, সে এক নতুন তত্ত্বের পথে পা বাড়ায়, যা উপস্থিত জাতি-ধর্ম দ্বারা খণ্ডিত ভারতবর্ষের বাইরে এক নতুন ভারতীয় পরিচিতির নির্মাণ করে। এই উপলব্ধি আসা মানেই এই নয় যে ভারতের মধ্যে যে বিভিন্ন পশ্চাদপদ ধর্মবিশ্বাস ও আচার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তার মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। গোরার মধ্যে এই বিশ্বাস এক নতুন সম্ভাবনার জন্ম দেয়। আমরা ভাবতেই পারি এই নতুন ভারতীয়তার তত্ত্ব ও সংজ্ঞাকে ভর করে গোরা আবার ফিরবে মানুষের মধ্যে এবং তাদেরকেও তাঁর নিজের এই ভাবনার দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য আবেদন করবে। মানুষের উপস্থিত চেতনার স্তর থেকে উন্নততর চেতনার দিকে অগ্রসর করায় ব্রতী হবে গোরা, যেই কাজ বামপন্থীদের মৌলিক কর্তব্য।

 
 
 

আমাদের আলোচ্য বিষয়ের ক্ষেত্রে গোরার এই উত্তরণের গুরুত্ব এখানেই যে সমাজে বিদ্যমান যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল রয়েছে তাকে পরম ধরে নিয়ে সেই পরিধিতেই বামপন্থীরা নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখলে তাদের আর তৃণমূলের মধ্যে কোনো তফাত থাকে না। সমাজের বিদ্যমান জনজীবনের জনপ্রিয় ছবিগুলিকে পরম সত্য ধরে নিলে বামপন্থীদের মস্ত বড়ো ভুল হয়ে যাবে। টুম্পা সোনা গানটি ইউটিউবে কোটি কোটি মানুষ দেখেছেন মানে এই নয় যে সংস্কৃতির কষ্টিপাথরে তা পাশ হয়ে গেছে। তাই যদি হত তবে জর্জ বিশ্বাসের গানগুলি আমাদের ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া উচিত। বামপন্থীদের গোরার মতন উত্তরণের তত্ত্বে পৌঁছতে হবে। তার মানে এই নয় ভোটের সময় কিছু গম্ভীর তত্ত্ব কথা মানুষকে শোনাতে হবে। কিন্তু আজ ফেসবুকে ‘টুম্পা সোনা’কে তত্ত্বায়িত করার যে উদগ্র বাসনা বামপন্থী কর্মীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে তা দেখে মনে হয় সংস্কৃতির নামে এক বিক্রিত জনপ্রিয় রুচি যা লুঙ্গি ডান্স এবং টুম্পা সোনাকে গানের মর্যাদা দেয়, তা বামপন্থীদের মনেও পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে। সমস্যাটা এখানে।

 
 
 

জনপ্রিয় সংস্কৃতি মানেই তা খারাপ বা জনপ্রিয় সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণ বর্জন করার কথা এখানে বলা হচ্ছে না। সলিল চৌধুরীও জনপ্রিয় ছিলেন, কিন্তু তিনি হানি সিংহ ছিলেন না। এই তফাতটা বামপন্থীরা না করতে পারলে আর কে করবে? সমস্যা হল জনপ্রিয়তার ধারণাটি বামপন্থীদের ফলিত রাজনীতির সম্পূর্ণ বাইরে চলে গেছে। ‘হেই সামালো ধান হো’-গানটির মতন না হলে সব গান ফালতু হয়ে যাবে এমন কথা পাগলেও বলছে না। কিন্তু যা জনপ্রিয় হচ্ছে তার সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দিকটি না বুঝলে বামপন্থীদের চলে না। পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতের শ্রমজীবি জনতার সামনে আজ সুস্থ সংস্কৃতির আকাল দেখা দিয়েছে। তাদের জীবন আজ দুর্বিসহ। রোজ খেটে বাড়ি ফিরে তারা রবীন্দ্রনাথ পড়বেন বা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবেন এই আশা করা বাতুলতা। ঠিক এখানেই বাজারের ভূমিকা। বাজার জানে যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের রসাস্বাদন করতে হলে শ্রোতার একটা প্রাথমিক শিক্ষা লাগে, যা ‘টুম্পা সোনা’ বা ‘লুঙ্গি ডান্স’-এর ক্ষেত্রে লাগে না। এই গানগুলি চটুল সুরে কোমড় দোলানোর জন্য তৈরি। গানের ভাষা ও সুর মানুষকে শুধু উত্তেজিত করতে পারে, কিন্তু কোনো সাংস্কৃতিক ব্যঞ্জনা তৈরি করতে পারে না। তাই এই গানগুলি হিট হলেও, এগুলি আর যাই হোক সঙ্গীত নয়। বামপন্থীদের প্যারোডি হয়ত তাদের বক্তব্য বহু মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছে কিন্তু তা প্রোথিত রয়েছে শ্রমজীবি মানুষের সংস্কৃতির একটি বিকৃত ধারণায়। নারীবাদিরা ‘টুম্পা সোনা’ নিয়ে যে আপত্তিগুলি তুলেছেন সেগুলি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমার আপত্তি এই গানটিকে মাধ্যম করা নিয়ে এবং তাকে তত্ত্বায়িত করে বলা যে শ্রমজীবি মানুষের সংস্কৃতির অনুসারী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস নিয়ে। এমনকি এই অবধিও বলা হয়েছে যে এই গান নিয়ে যারা আপত্তি জানাচ্ছেন সবাই এলিট সম্প্রদায়ের লোক।

 
 
 

আসলে শ্রমজীবি মানুষের সংস্কৃতি আছে না নেই, থাকলে তার রূপ কেমন? এই সমস্ত ধারণা বা বিতর্কগুলি বামপন্থী রাজনীতির পরিসর থেকে বিতারিত হয়েছে। অবশ্যই শ্রমজীবি মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখছেন,

 

“নিম্নবিত্ত শ্রমজীবির সংস্কৃতিচর্চার উৎস হল তার জীবিকা। তাঁর শ্রমের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন বলে তাঁর সংস্কৃতিকে উপরি-কাঠামোর পর্যায়ে ফেললে ভুল করা হবে। সংস্কৃতিচর্চা তাঁর কাছে কেবল মনোরঞ্জনের ব্যাপার নয়। কৃষক যখন গান করেন তখন মন হাল্কা করার উদ্দেশ্যে করেন না। গান না-করলে তাঁর শ্রম অব্যাহত রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় বলেই তাঁকে গাইতে হয়। শরীরের সঙ্গে গানও তাঁকে জমিতে খাটতে সাহায্য করে”।

 

 

 

তিনি আরো বলছেন,

 

“লেখক ও শিল্পীর হাতে নিম্নবিত্ত শ্রমজীবির সংস্কৃতি উঁচুদরের শিল্পে পরিণত হয়। উত্তর ভারতের লোকগীতির সুর বড় বড় শিল্পীর হাতে বিবর্তিত হয়ে রাগ-রাগিণীর পর্যায়ে উঠেছে। লোকের মুখে মুখে প্রচলিত কাহিনি অবলম্বনে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যগুলো”।

 
 
 

অতএব, নিম্নবিত্ত শ্রমজীবির সংস্কৃতি মাত্রেই তা ত্যাজ্য নয়। বরং নিম্নবিত্তের শ্রম, তাদের যাপন থেকে উঠে আসা গানে যে প্রাণ রয়েছে সেটাই মানব সংস্কৃতির আদি রূপ। বামপন্থীরা সেই শ্রমজীবিদের মাঝখানে এখন আর নেই। তাই মূলধারার গানে অথবা চাষির ঘরের গানের মধ্যে বামপন্থী অনুরণন আর খুব বেশি দেখতে পাওয়া যায় না। এই নির্বাচনে ‘টুম্পা সোনা’ গানের মধ্যে দিয়ে যা মানুষের সংস্কৃতি বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে, তা আদৌ শ্রমজীবি মানুষের জীবনসম্পৃক্ত সংস্কৃতি নয়। কিন্তু কোনটা শ্রমজীবি মানুষের সংস্কৃতি তা জানতে হবে। তা না জেনে বলিউডের তৃতীয় শ্রেণির গানকে নকল করে বামপন্থীরা প্যারোডি বানিয়ে তা নিয়ে প্রচার করলে ভোট পাওয়া যাবে কি না জানি না, তবে তা যে সংস্কৃতির বিচারে উত্তীর্ণ নয় তা বলাই যায়। আসলে তা মধ্যবিত্ত মধ্যমেধার সংস্কৃতির জনপ্রিয় রূপ। মনে রাখতে হবে গানটি জনপ্রিয় হয়েছে, তার মানেই এই নয় যে গানের রচয়িতা পার্টি ভোট পাবে।

 
 
 
 
 
 
 
 

উপসংহার

 

শেষে আগে বলা কথাগুলি একটু গুছিয়ে নেওয়া যাক। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে নতুন কিছু উপাদান যোগ হয়েছে তার মধ্যে মিল একটাই। সমস্ত দল ‘মানুষ এটাই চায়’-এই যুক্তিতে তাদের রাজনৈতিক স্লোগান এবং গান তৈরি করেছেন। তৃণমূলের রাজনীতির মধ্যেই এই জনপ্রিয়তাবাদী ঝোঁক রয়েছে। আবার বিজেপি এক নতুন সংস্কৃতি মানুষের মধ্যে তৈরি করার চেষ্টা করছে যা হিন্দুত্ববাদের দ্বারা পুষ্ট। বামপন্থীদের এই রাজ্যে বেনজির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকলেও তারা যেই সংস্কৃতির থেকে ধার নিয়ে ‘টুম্পা সোনা’ গানটি তৈরি করেছেন তা শ্রমজীবি মানুষের সংস্কৃতি হতে পারে না। শুধু তাই নয়, মানুষ চাইছে, অতএব আমরা যা করছি তা ঠিক, এই মানসিকতা মানবমুক্তি ও উত্তরণের পথে বাঁধা ছাড়া আর কিছুই নয়। যদি সত্যিই বামপন্থীদের মানুষের কাছে পৌঁছতে হয় তবে তাদের জীবনযাপন ও নিত্যনৈমিত্তিক সংস্কৃতি চর্চার জগতে ঢুকতে হবে। একটি নির্বাচনে ‘টুম্পা সোনা’ গান হলে মহাভারত অশুদ্ধ যেমন হয় না, তেমনই একে জনগণের দাবি বলে চালানোটাও ঠিক নয়। যদি সত্যিই বামপন্থীরা লোকসংস্কৃতির জগতে ঢুঁ মারেন তবে অনেক মণিমুক্ত পাবেন যা দিয়ে তাদের রাজনীতি সার পাবে আগামীর গাছের জন্য। যেমন তারা পেয়ে যেতে পারেন এই গান,

 
 
 
 
 

মানুষ হয়ে মানুষ মানো

 

মানুষ হয়ে মানুষ জানো

 

মানুষ হয়ে মানুষ চেনো

 

মানুষ রতনধন

 

করো সেই মানুষের অন্বেষণ।

রাজনৈতিক কালচার" বিষয় টা কি? তত্ত্ব তালাশ করলেন - পিকু দাশগুপ্ত

THE CULTURE OF POLITICS : RETHINKING POLITICAL CULTURE

 

By Piku Das Gupta

 

Associate Prof. WBES

 
 
 
 
 
 
 
 

Much of the politics that happens around us, takes place in our heads: it is actually shaped by our ideas, values and assumptions about how essentially society should be organized and our expectations regarding it. At the end of the day, what we believe about our society may be more important than the reality of its power structure. Perception may not only be more important than reality, practically, perception may be reality. Herein comes the vital role played by Political culture. People’s beliefs, symbols and values, their attitude towards the political process, their view of the regime in which they live all give legitimacy to their system. Political thinkers through the ages have acknowledged the importance of attitudes, values and beliefs. All of them play a vital role in promoting the stability and survival of a regime.

 
 
 

Interest among political scientists in the idea of political culture emerged in the 1950s and 1960s as new techniques of behavioral analysis. The classic work in this respect was Almond and Verba’s “The Civic Culture” (1963) which used opinion surveys to analyze political attitudes and democracy in five countries- The USA, The UK, West Germany, Italy and Mexico. Although interest in political culture somewhat faded in the 1970s and 80s , the debate has been re- vitalized since the 90s in an effort in the East European countries to construct democracies out of the ashes of Communism and the growing anxieties in mature democracies such as the USA. However, there is also a persistent debate about whether or not political culture is shaped by the ideas and interest of elite groups. This is in a way linked to the views of mass media and the extent to which government can now manipulate political communication.

 
 
 

Culture in its broadest sense is the way of life of the people. Political scientists however, use the term in a narrower term to refer to the people’s psychological orientation. Political culture is the “pattern of orientations” to political objects such as parties, government, the Constitution, expressed in beliefs, symbols and values. Political culture differs from public opinion in that it is fashioned out of long-term values rather than simply people’s reactions to specific policies and problems. Almond and Verba set out to identify the political culture that most effectively upheld democratic politics. They identified three general types of political culture: a) participant culture, b) subject culture, c) parochial culture.

 
 
 

A participant political culture is one in which citizens pay close attention to politics and regard popular participation as both desirable and effective. A subject political culture is characterized by more passivity among citizens, and the recognition that they have only a very limited capacity to influence government. A parochial political culture is marked by the absence of a sense of citizenship, with people identifying with their locality rather than the nation, and having neither the desire nor the ability to participate in the politics. Although Almond and Verba accepted that a participant culture came closest to the democratic ideal, they argued that the “Civic Culture” is a blend of all three in that it reconciles the participation of citizens in the political process with the vital necessity for government to govern. Democratic stability is underpinned by a political culture that is characterized by a blend of activity and passivity on the part of the citizens, and a balance between obligation and performance by the part of the government.

 
 
 

In their initial study, (1963) Almond and Verba concluded that UK came closest to the civic culture exhibiting both participant and subject features. In other words, while the British thought that they could influence government, they were also willing to obey authority. Almond and Verba’s later study (1980) highlighted a number of shifts, notably decline in national pride and confidence in the UK and the USA, which contrasted with a rise in civic propensities in Germany. The civic-culture approach to the study of political culture and values has however been widely criticized. In the first place, its model of the psychological dispositions that make for a stable democracy is highly questionable. In particular the emphasis on passivity and the recognition that deference to authority is healthy has been criticized by those who argue that political participation is the very crux of democratic government. Almond and Verba suggested a “sleeping dogs theory” of democratic culture that implies that low participation indicates broad satisfaction with governments, which politicians in turn will be anxious to maintain. On the other hand, when less than half the adult population bothers to vote, this could simply reflect widespread alienation and ingrained disadvantage. Second, the civic-culture thesis rests upon the unproven assumption that political attitudes and values shape behavior, and not the other way round. In short, a civic culture may be more a consequence of democracy than its cause. If this is the case, then political culture may provide an index of the health of democracy but it cannot be seen as a means of promoting stable democratic rule. Finally Almond and Verba’s approach treats political culture as homogeneous. In doing so, it pays little attention to political subculture and tends to disguise fragmentation and social conflict. On the other hand, the radical approaches to political culture highlights the significance of social divisions such as those based on class, race and gender.

 
 
 
 
 
 
 
 
 

Gabriel Almond

 
 
 
 
 

Political Culture: Legitimacy and Political Stability

 

Legitimacy broadly means rightfulness. Legitimacy therefore confers on an order or command an authoritative or binding character, thus transforming power into authority. Political philosophers treat legitimacy as a moral or rational principle, the grounds on which governments may demand obedience from the citizens. Political scientists usually see legitimacy in sociological terms: that is, as a willingness to comply with a system of rule regardless of how this is achieved. Following Weber, this view takes legitimacy to mean a “belief” in legitimacy that is a belief in the “right to rule”. In modern political debate, legitimacy is usually understood less in terms of moral obligations and more in terms of political behavior and beliefs. In other words, it addresses not the question of why people “should” obey the state, but the question of why they “do” obey a particular state or system of rule. What are the conditions or processes that encourage them to see authority as rightful and therefore underpin the stability of a regime? Herein political culture, legitimacy and stability of a political system becomes inter-twined.

 
 
 

The classic contribution to the understanding of legitimacy as a sociological phenomenon was provided by Max Weber. His first type of political legitimacy is based on long established customs and traditions. In effect, traditional authority is regarded as legitimate as it has “always existed”. It has been sanctified by history because earlier generations had accepted it. Weber’s second form of legitimate domination is charismatic authority. This form of authority is based on the power of an individual’s personality. Charismatic authority operates entirely through the capacity of a leader to make a direct and personal appeal to the followers as a form of hero or a saint. Weber’s third type of legitimacy, “legal-rational” authority links authority to a clearly and legally defined set of rules. He said that legal-rational authority is the typical form of authority operating in most modern states.

 

Although Weber’s classification of types of legitimacy is still seen as relevant it also has its limitations. First, in focusing on the legitimacy of a political system, it tells us little about the circumstances in which political authority is challenged as a result of unpopular policies or a discredited leader. If legitimacy helps to ensure political stability and the survival of a regime, when legitimacy collapses the result is likely to be either a resort to repression or far-reaching political change. Change is one of the most important features of political life. Whether change marks progress or decay, growth or decline, it is the product of one of the two processes: Evolution or Revolution.

 

Two broad implications for the democratization process flew from this entire framework. First the congruence thesis assumes that regime stability and effective government are more likely if the political culture is congruent with the regime form. Thus, one reason why autocratic governments exist is because they occur in societies where the citizens tolerate or even expects an autocratic rule. Moreover, if we assume that the political culture is embedded in a network of social relations, traditional norms and socioeconomic conditions, the cultural change will occur very slowly. Autocratic governments endure when there is a parochial and subject culture. Progress towards political modernization is likely to occur slowly and requires profound change in a nation’s political culture. Second, the civic culture has a constrained view of the values of the ideal democratic citizen. The civic culture is an allegiant participant culture. The ideal citizen respects political authority and accepts the decision of the government. There is limited room for political dissatisfaction, questioning authority, civil disobedience.

 
 
 
 
 
 

Sidney Verba

 

There is relevance and utility of political culture as a complex tool for studying the relationship between the individuals(citizens) and polities (state). In the contemporary world context and under highly unstable and volatile political evolutions, polities and their geo-political context need to be approached in their very complexity in order to understand the role individuals as well as whole societies play in polities dynamic evolutions. A key issue in approaching the relationship between the citizens and the state in a democracy basically concerns the ways in which individual citizens achieve an update their political attitudes towards political objects, namely structures, incumbents and policies which describe state institutional structures. A true challenge has been to prove whether the citizen’s political cognitions, values , beliefs and attitudes have a role to play in the operation of the state, thus explaining the emergence of complex political phenomenon like political instability. Political culture has proved its decisive role in shaping the forces able to drive polity dynamics by means of political participation collective action and political attitudes. The sense of efficacy or competence is a key “political attitude”.

সত্যজিতের ছবিতে মধ্যবিত্তের (অ) নৈতিকতা - গৌরাঙ্গ দণ্ডপাট

 
 
 
 
 

বেঁচে থাকলে একশো তে পড়তেন। সত্তরে ই ইতি টেনেছেন জীবনের। তবু তাঁর বাঁচা থামলো না। জীবনের সত্যান্বেষণে যে সোনা মানিকের সন্ধান পেলেন, তাই তাঁকে অমরতা দিল। সিনেমা যতদিন বাঁচবে সত্যজিতের মৃত্যু নেই ।

 

বাংলা ছায়াছবির তিনি যে প্রাণপুরুষ, প্রধান হোতা, একথা উল্লেখের জন্য আজ আর নিবন্ধ ফাঁদতে হয় না। তাঁকে মহান প্রমাণ করার কোনো প্রয়োজন দেখি না। বরং জীবনকে চিনতে , তার লীলা রহস্যের হদিস পেতে , বড় শিল্প এবং মহৎ শিল্পীর সন্ধান পেতে, আমাদের নিজেদের জন্যই বার বার তাঁর ছবির কাছে যাওয়া দরকার।

 

মহৎ শিল্পী মানেই যে সারা কর্মজীবন প্রশ্নহীন থাকেন এমন নয় , বরং মাঝে মাঝে মহৎ প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হয় তাঁকে। সত্যজিতের বেলাতেও তাই হয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে ও তা করতে হয়েছে। তর্ক টা মূলত ছবির উৎকর্ষতা নিয়ে ততটা নয়, সত্যজিৎ যে ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক অভিভাবক ;একথা তার জীবৎকালে ই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তর্ক টা তার ছবি আরো কতদূর যেতে পারতো , আরো কত কী বিষয় করতে পারতো, তা নিয়ে। শিল্প সমালোচনার এই ধারা বহু শিল্পীর পছন্দ হবার কথা নয়। সত্যজিতের ও হয়নি। সৃষ্টির ভেতর থেকে বিশ্লেষণ আসুক। মোটের ওপর সত্যজিতের প্রত্যাশা ছিল তাই। তাঁর ছবিতে মৃণাল সেনের শ্রেনি চেতনা নেই অথবা ঋত্বিকের দেখানো অসহনীয় বাস্তবতা, সত্যি কি এই অভিযোগে সত্যজিত কে বোঝা সম্ভব ! ?নাকি প্রতিভাবান ঋত্বিক যখন বলেন” ভারতবর্ষে ছবির মাধ্যমটিকে যদি কেউ বোঝেন তবে তিনি হচ্ছেন সত্যজিত রায়” এই প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে কথা শুরু করা উচিত আমাদের। এক মহৎ শিল্পী কে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমরা যেন হৃদয় কে মুক্ত রাখতে পারি।

 

একই সময়ে তিন প্রতিভাবান পরিচালক তিনটি পৃথক পথের যাত্রী হবেন এটা খুব আশ্চর্যের বিষয় নয়। বাংলা সাহিত্যের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেলাতেও একই কথা খাটে। একই সময়ে এক দেশে এক জাতি এক ভাষার ক্ষেত্রে যদিও বা তুলনা চলে, সত্যজিতের ছবিতে বার্গম্যানের মতো ঈশ্বর মৃত্যু যৌনতার অভাব নিয়ে অভিযোগ হাস্যকর ঠেকে। বার্গম্যানের ছবি তে কেন সত্যজিতের জীবন দর্শন নেই, এও তেমনি হাস্যকর চাহিদা। সত্যজিত স্বয়ং সম্পূর্ণ ভাবে আমাদের অনেক কিছু দেন , সে পাওয়া মহৎ পাওয়া , একথার স্বীকৃতি দিয়ে আরো পাওয়া, অতৃপ্তির কথা তোলা যায়, যেতে পারে।

 
 
 
 
 
 
 
 

মজা করে কিনা জানিনা দেশে’ পাঠানো নিবন্ধে সত্যজিত যুক্তি দিয়েছিলেন, অনেকে মনে করেন পথেরপাঁচালী ই তাঁর শ্রেষ্ঠ ছবি, যাকে সত্যজিত অতিক্রম করতে পারেননি। সমালোচনার প্রভাব পড়েছিল পথেরপাঁচালী বেরোনোর পর। কেননা ওটি ওঁর প্রথম ছবি। এই সূত্র ধরে সত্যজিতের প্রশ্ন ” তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে- তাহলে কি সমালোচনার প্রভাব আমার শিল্পের পক্ষে কল্যাণকর হয়নি ?” দায়িত্ব জ্ঞানহীন সমালোচনা, যা কেবল নিজের পান্ডিত্য কে প্রকাশ করতে গিয়ে ,ছবির থেকে দূরে গিয়ে অনধিকার চর্চা করে; তার প্রতি সত্যজিত মোটেও সদয় ছিলেন না। ছবি ও দর্শকের মধ্যে সেতুবন্ধন সমালোচনার প্রধান কাজ হবে এই ছিল তাঁর বিশ্বাস।

 

তবু সমালোচনা থেকে মুখ ফিরিয়ে সন্ন্যাসীর নৈর্ব্যক্তিকতা নিয়ে কাজ করে যাওয়া শিল্পীর পক্ষে অসম্ভব। (কেউ কেউ আড়ালে রাখলেও সংবেদনশীলতা ছাড়া শিল্পী হতে পারে না।) রবীন্দ্রনাথ ও পারেননি। কল্লোল যুগের কালি ছোড়াছুড়ির মধ্যে তিনিও জড়িয়ে পড়েছিলেন। সত্যজিতের পক্ষেও পুরোপুরি উপেক্ষা করা অসম্ভব হয়েছিল। এই বাধ্যত জড়িয়ে পড়া, আমাদের বিবেচনায় ভালো ফল ফলিয়ে ছিল সাহিত্যে, ছবিতে। কল্লোল উত্তর কালে এক অন্য রবীন্দ্রনাথ যেমন, সত্তর দশকের সময় থেকে অন্য সত্যজিত। এই দুই মহান স্রষ্টা নিজের নিজের পথে যে বদল আনলেন, তার জন্য সময় এর সঙ্গে সঙ্গে সমালোচকদের ও কিছু মূল্য প্রাপ্য বৈকি! সত্যজিতের ছবিতে মানবতাবাদ নিয়ে কথা হয়েছে বেশি। মানবতার রকম ফের খুঁজতে কখনো রবীন্দ্রনাথ কখনো আন্তন চেকভ এর মতো মহৎ শিল্পীর সঙ্গে তুলনা এসেছে। কারো কারো কাছে তাঁর ছবির মানবতা নিছক ভাববাদী মানবতা! আমরা এই নিবন্ধে এ নিয়ে আলোচনা করছি না। বরং সমাজ দেশ কালের প্রতি সত্যজিতের দায় নিয়ে যে কথাগুলো ওঠে, সেই অনুযোগ গুলি যাচাই করতে চাইছি। দেখতে চাইছি যে শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্তের ওপর তার ছবি , সাহিত্যের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি; সেই নাগরিক মধ্যবিত্ত তাঁর ছবিতে কীভাবে এলো, সত্যজিতের এদের প্রতি ঠিক কী মনোভাব পোষণ করেন শেষাবধি!

 
 
 
 
 
 
 
 

দুই

 

সত্তরের দশকে এসে সত্যজিতের ছবিতে নাগরিক মধ্যবিত্তের নানা বয়ান উঠে আসতে থাকে। বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে যুঝতে গিয়ে মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত বাঙালি কে হোঁচট খেয়ে পড়তে হচ্ছিল। একদিকে একটা চূড়ান্ত রেডিক্যালিজম অন্যদিকে ভয়ঙ্কর আপোষ। বেঁচে থাকার জন্য লড়াই অথবা টিকে থাকার জন্য আপোষ – এই ছিলো তরুণ প্রজন্মের বিকল্প। সত্যজিতের কলকাতা ট্রিলজি বিষয় হিসেবে এই বাস্তব কে বেছে নেয়। প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০) এর নায়ক সিদ্ধার্থ ব্যবস্হার ব্যভিচার কে চিনতে পারে, প্রতিবাদ করতে চায়, কিছু দূর এগিয়েও ফিরে আসে।’সীমাবদ্ধ'(১৯৭১)এর নায়ক শ্যামলেন্দু সাফল্য পেয়েও আরো সাফল্য , আরো ক্ষমতার ফাঁদে পড়ে চক্রান্তকারী মন্দ মানুষে রূপান্তরিত হয়। আর ১৯৭৫ এর জনঅরন্য এ সোমনাথ একজন বিবেকবান মানুষ হয়েও জীবনের প্রয়োজনে এমন আপোসের পথে যায়, যেতে হয়; যা সে কল্পনা করেনি। খান তিনেক পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনার পর চূড়ান্ত মন্দা বেকারি ও বিবেকহীন তথাকথিত স্বাধীন রাষ্ট্র কে দেখে একটা বড় অংশের যুব সম্প্রদায় বুঝেছিল, ইংরেজ বিদায় হয়েছে বটে, কিন্তু মুশকিল আসান দূর অস্ত। গরিব ও মধ্যবিত্তের বহু অধিকার এখনও অপ্রাপ্ত। মৃত্যু উপত্যকার বাস্তব কে মেকি জাতীয়তাবাদ দিয়ে বেশি দিন ঢেকে রাখা যায়না। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি'(১৯৬৮) তে এই মধ্যবিত্ত যুবাদের একটা নৈতিকতার সঙ্কট আঁকা হয়েছিল প্রচ্ছন্নভাবে। যারা ছবিটিতে এসব খুঁজে পান না, তারা ছবিটির সবটুকু গ্রহণে অপারগ। খবরের কাগজ পোড়ানোর প্রতীকী নাগরিক মধ্যবিত্ততা কে ধ্বংস করার কৌতুককর ঘটনায় যার শুরু তা যেন নাগরিক যুবকদের অন্তর্গত আজন্ম লালিত শহুরে হাওয়া এসে নিভিয়ে দেয়। নইলে সেই চার যুবক যারা জঙ্গলে হারিয়ে যেতে এসেছিল ,তারাই নগর সংস্কৃতির বাহক একটি পরিবারের সান্নিধ্যে এসে কী অবলীলায় শহুরে আদব কায়দা লজ্জা শরমের জগতে চলে যায়! সত্যজিত ,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর রোমান্টিক জগতকে ভাঙেন। ছবির ভাষা তেই। দেখান, এই জঙ্গলী মাতলামো, জনজাতির সান্নিধ্য, চার যুবকের বদ্ধমূল নাগরিক ‘মধ্যবিত্ত বোধ ‘কে টলাতে পারে না। এ কেবল উপরিতলের রোমান্টিসিজম। বোহেমিয়ানিজম এখানে বড়জোর শৌখিন বাউন্ডুলেপনা। অরণ্য তাদের ব্যাডমিন্টন, মেমরি গেম, মাও থেকে অতুল্য ঘোষ নিয়ে নাগরিক অর্থহীন কচকচানি থামিয়ে দিতে পারে না। মধ্যবিত্ত , মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ থেকে আলাদা হতে পারে না। সে এক অন্য বিপ্লবের গল্প। অরণ্যের কয়েকটি দিনরাত্রি তেও তা অধরা থেকে যায়।

 

এই একই সময়ে ‘মহানগর’ ছবিতে কলকাতার নিম্নবিত্ত পরিবারের নিখুঁত চিত্র পাই। অনেকের কাছে এ নিছক একটি নারী মুক্তির গল্প হলেও আমাদের বিশ্বাস এ ছবি তার থেকে অনেক বেশি কিছু। বাড়িতে মা, সঞ্চয় হীন রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টার বাবা, অবিবাহিত বোন , স্ত্রী এবং পুত্র সন্তান – সবাই নির্ভর করে নায়কের রোজগারের ক’টা মাত্র মাসকাবারি টাকার ওপর। স্ত্রী, যার ভূমিকায় মাধবী মুখোপাধ্যায়, চাকরি করতে স্বামীর অনুমতি চান, বহু কষ্টে তা মিললেও স্কুল মাস্টার শ্বশুর মশাই তা পারেন না। অথচ অর্থাভাবে নিজেকে বৃদ্ধ অপাংক্তেয় অবহেলিত ভেবে প্রতিষ্ঠিত ছাত্র দের দোরে দোরে সাহায্য চান। ফলে এ কেবল ঘরের বৌ এর বাইরের জগতে পদার্পণ এর গল্প নয়। পূর্ব প্রজন্মের বাবা, এ প্রজন্মের স্বামী কে একটা কাঠঠোকরার সমানে ঠুকরে চলার গল্প। অথচ স্বামীর ব্যাঙ্ক ফেল করায় বৌমা যখন একমাত্র রোজগেরে, শাশুড়ি মাছ না দিয়ে ভাত খাওয়াতে পারেন না বৌমাকে। স্ত্রী কে চিনতে পারেন না স্বামী। শ্বশুর মশাই কথা বন্ধ করে দেন বৌমার সঙ্গে। আর বৌমা তার অফিস বান্ধবীর গিফ্টেড

 

লিপস্টিক মাঝে মাঝে অফিসে লাগিয়ে, বাড়ি ফেরার আগে মুছতে ভোলে না। এমন হাজারো ডিটেলিং সত্যজিত স্বভাব সিদ্ধ মুন্সিয়ানা তে যুক্ত করে দেন। উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি তেও চাকরিও যে শেষ পর্যন্ত রাখা গেল না তার কারণ একটা ‘অন্যায় ‘। সে অন্যায় অফিস কর্তৃপক্ষের । যদিও সরাসরি নায়িকার প্রতি নয়, বরং অন্যায় ছাঁটাই এ নায়িকার কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব আর অতিরিক্ত প্রাপ্তিযোগ ঘটতো , তবু সে চাকরি প্রত্যাখ্যান করে। বিপন্ন সময়ে ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিয়ে এবার স্বামী স্ত্রী একসঙ্গে চাকরির খোঁজে মহানগরের ভিড়ে মিশে যায়, ভীষণ যন্ত্রণার মাঝেও জীবনের জয়গান বেজে ওঠে।

 

সীমাবদ্ধ তে নায়ক শ্যামলেন্দু ( বরুন চন্দ) ভালো ছাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল পিটার্স কোম্পানি তে। বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, দামি আসবাব, গাড়ি, স্ত্রীর পার্লার , রেসের মাঠ,বিলিতি ক্লাব, পার্টি থ্রো এর চক্কর থেকে সে যেমন বেরোতে পারে না, তেমনি তার মনের আরামের কারণ হয় সম্ভ্রান্ত মনের শ্যালিকা ( শর্মিলা ঠাকুর) , স্ত্রী বা তথাকথিত বিলিতি আদব কায়দা জানা অন্য কেউ নয়। সে প্রানের আনন্দ খুঁজে পায় পাহাড়ের বোর্ডিং স্কুল থেকে পাঠানো ছোট্ট সন্তানের আদুরে চিঠিতে। এই দ্বৈততা তাকে ছিঁড়ে খায় । উন্নতির নেশা, ক্ষমতার নিশিডাক সে প্রত্যাখ্যান করতে পারে না বলেই রুচি শিক্ষা মেধা সৌন্দর্যের থেকে শ্যামলেন্দু দূরে সরে যায়। শ্যালিকার প্রত্যাখ্যান তারই প্রতীক হয়ে আসে।

 

জন অরণ্য এর নায়ক সোমনাথ ( প্রদীপ) দালাল শব্দটির চাপ নিতে পারেনি, সৎ সজ্জন যুক্তিবাদী মধ্যবিত্ত পিতার সন্তান হিসেবে কষ্ট হবারই কথা। বাজারে সেদোলে বোঝা যায় দালালির মর্ম। বাঙালি নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবিকার সন্ধানে সেখানে গিয়ে পড়লো। বিশুদা রুপী উৎপল দত্ত অবশ্য ইংরেজি মিডলম্যান বলে কাজ টা সোজা করে দিয়েছিলেন। বৌদি ( লিলি চক্রবর্তী) বলেছিলেন, নাম টা যখন তুমি দাওনি, তাহলে এতো ভাবা কেন? ওর পরামর্শ ছিল, প্রায় সীমাবদ্ধ এর শ্যামলেন্দুর কায়দায় প্রতিষ্ঠিত দাদার( দীপঙ্কর) থেকে দালাল শব্দের একটা সংস্কৃত প্রতিশব্দ জেনে নেওয়ায়, কেননা তাতেই সব শুদ্ধ কিনা! বিদ্রুপ অন্যভাবে এসেছিল মিঃ মিত্তির রূপী গ্রেট রবি ঘোষের কাছ থেকে। গোয়েঙ্কার অর্ডার পেলে একবছরের চিন্তা যায়, হোটেলের কক্ষে একটি মহিলা ভেট হিসাবে পাঠাতে হবে সেই গোয়েঙ্কা কে। গোয়াঙ্কা কে? গাড়িতে লিফট দিতে গিয়ে যিনি বলেছিলেন মদ তার চলে না , বাড়ি ফিরতে রাত করেন না! সোমনাথ ও রণে ভঙ্গ দিতে চায়।মহানগরের আরতি( মাধবী মুখোপাধ্যায়) এর মতো প্রত্যাখ্যান করতে চায় এই নৈতিক আপোস কে। কিন্তু পারে না শেষ পর্যন্ত। স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠিত এজেন্ট মিঃ মিত্তির বুঝিয়ে দেন এটাই বাস্তব, এটাই ভবিতব্য। নৈতিকতার কোড গুলো বদলে ফেলতে হবে। প্যাকাল মাছের মতো কাদা ধুয়ে ফেলতে হবে। নৈতিক টানাপোড়েনের মূল্য বাজার দেবে না। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবে। তুমি বাতিল হয়ে যাবে।মিঃ মিত্তির সোমনাথ ব্যানার্জি কে নিজের সাফল্যের কথা মনে করিয়ে দেন। মনে করিয়ে দেন সোমনাথের আয় অফিসের পিয়নের চেয়ে কম। বুঝিয়ে দেন, সোমনাথের লড়াই করে মরার দম নেই , গায়ে গতরে খেটে গ্রাসাচ্ছাদন করবার মুরোদ নেই। দাদার মতো কোম্পানির বড় অফিসার হওয়ার মতো রেজাল্ট নেই। সঞ্চয় বলতে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া মূল্যবোধ, বাজারে যার মূল্য শূণ্য। এই মরালিটি বাজারের নিজের পক্ষেও বিপজ্জনক। তিন তিনটা জায়গায় সোমনাথ মিঃ মিত্তির এর সঙ্গে ভেট যোগ্য মেয়ে খোঁজে। সে এক আশ্চর্য জার্নি। মাত্র একটা দিনের অভিজ্ঞতা।অথচ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা কে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে দিচ্ছে জীবনের কঠিন বাস্তবতা। সে বাস্তবতা নিষ্ঠুর ও অসহনীয় হয়ে ওঠে যখন কনা ওঠে ট্যাক্সি তে। কনা , প্রিয় বন্ধু সুকুমারের বোন। সুকুমারের অসহায় পরিবার কে সে দেখেছে। কনা মেয়ে, কনা গ্র্যাজুয়েট নয়। তাই তাকে খানিক বেশি নামতে হয়। প্যাকাল মাছের মতো পাক না মেখে তার চলে না। অর্ডার টা পায় সোমনাথ। চিন্তিত আদর্শবাদী বাবা খুশি হন। ফল দেখে খুশি হবার সময় এটা। পথ বিচারের সময় নয়। সে রদ্দি মারা পুরনো মূল্যবোধ আজ বাতিল !

 
 
 
 
 
 
 
 

তিন

 

মৃত্যুর ঠিক আগের দুটি বছরে (১৯৯০-৯২) সত্যজিত তিনটি ছবি বানান। গণশত্রু, শাখাপ্রশাখা এবং আগন্তুক। ১৯৮৪ তে ঘরে বাইরে এর শুটিং চলার মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়েন। গণশত্রু এর সময়ও ভগ্ন স্বাস্থ্য তাঁর। তবু শেষ তিনটি ছবিতে নাগরিক মধ্যবিত্তকে আরো নতুন প্রশ্ন চিহ্নের মধ্যে দাঁড় করান। আমাদের সভ্যতা আধুনিকতা নিয়ে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তোলেন। আধুনিকতার পোশাক, সে কেবল পচাগলা বাস্তব টা কে ঢেকে রাখার জন্য, অনৈতিকতা কে সহনশীল করে তোলার জন্য।ছবি তিনটি এরকম কথাই ভাবিয়ে তোলে। চলচ্চিত্রের সত্যজিতিয় ভাষার তুলনায় ‘গণশত্রু ‘বেশ দুর্বল বলে সিনেমা-ভাবুক রা মন্তব্য করেছেন। কিন্তু ইবসেনের নাটকের ভারতীয় করনের কাজটি দুরন্ত করেছেন সত্যজিত। কাহিনী বুননের কিছু ফাঁক ফোকর নজরে এসেছে ঠিকই। কিন্তু সমাজ রাজনীতি ধর্ম কুসংস্কার এর বিশ্রী ক্ষতিকর ককটেলের পুরোভাগে থেকেছে তথাকথিত প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত, এই মূল্যবান কথাটা সত্যজিত বের করে এনেছেন। এ পোড়া দেশ বিজ্ঞান কে কতগুলো যান্ত্রিক উন্নতি ভাবে বড়জোর। বিজ্ঞান বোধ, যুক্তি বোধ, ইতিহাস বোধের চেয়ে ঢের বেশি বড় ধর্মীয় আবেগ, ধর্মীয় বিশ্বাস – সে যতই অন্ধ হোক না কেন! গ্যালিলিও পারেননি তথাকথিত মধ্যযুগে। আর গণশত্রু তে ডাক্তারবাবু ও পারেননি ১৯৯০ এর বিশ্বায়ন ঋদ্ধ আধুনিক সময়ে। সময় বদলেছে, তন্ত্র বদলেছে, কিন্তু ক্ষমতার ভাষা , ক্ষমতার আধিপত্য? সত্যজিত দেখান বাঙালি মধ্যবিত্তের একটা মন কুসংস্কারে, অন্য মন প্রগতিতে। ক্ষমতা তন্ত্রের চুঁইয়ে পড়া ক্ষমতা চেটে বাঁচে মধ্যবিত্ত। যেকোনো বিদ্রোহ তার পক্ষে স্ববিরোধ। ডাক্তার বাবু আমাদের আদর্শ হয়েও , গভীর সঙ্কটে ডাক্তারবাবু রূপী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এর চোখে মুখের ভয় উদ্বেগ আশঙ্কা টেনশন আমাদের ও গ্রাস করে। চাকুরী চলে যাওয়ার ভয়, অপমানিত হবার ভয় , সম্মান খোয়ানোর ভয়, হামলার ভয়, সরকারি চক্রান্তে ফেঁসে যাওয়ার ভয় ! মধ্যবিত্ত হেরে যায়, হেরে চলে।

 

আগন্তুক’ কে এসে দেখি সভ্য আধুনিক কালচারড মধ্যবিত্ত সঙ্কীর্ণতা‌র গর্তে পড়ে কী নিদারুণ ভাবে হাস্যস্পদ আর নাস্তানাবুদ হচ্ছে নিজের বিবেকের কাছে। কমফোর্ট জোনের বাইরের দুনিয়াটাকে সে বিন্দুমাত্র গ্রহণ করতে পারে না আর। আগন্তুক সন্দেহ জনক ‘জালি দাদু’ সন্দেহ হীন ‘ভালো দাদু’ হয়ে গৃহের মায়া কাটিয়ে অনির্দিষ্ট সুদূরের আহ্বানে ,দ্বিতীয়বার গৃহত্যাগ এর কালে নাতি কে মনে করিয়ে দিয়েছেন, কিছুতেই কূপমন্ডূক হওয়া যাবে না। মধ্যবিত্তের শ্রেনী বেষ্টনীর কূপমন্ডূকতা মধ্যবিত্তের অভিশাপ। আলোকায়নের যে আধিপত্য যুক্তি বিজ্ঞান আধুনিকতার নামে, সভ্য অসভ্য এর বাইনারি নির্মাণ করছিল, আগন্তুক রূপী মামা ( উৎপল দত্ত) তাকে জোরালো প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। আধুনিকতার গর্ব অহং দম্ভের বদলে এবার আমাদের জনজাতির জীবন যাত্রা থেকে শিখতে হবে। ভাঙতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিভাজনের রাজনীতি কে। জীবন সায়াহ্নে সত্যজিতের হয়ে আগন্তুক ছবির মামা রূপী উৎপল আমাদের এই পরামর্শ দিয়ে যান।

 
 
 
 
 
 
 
 

চার

 

শাখা প্রশাখা’ তে দুই প্রজন্মের কাছে নৈতিকতার দুটি পৃথক ধরণ তৈরি হয়ে গেছে। নৈতিকতা হাজারো ব্যাখ্যান ও অলিগলি খুঁজছে। চার ভাই এর তিন ভাই এর নৈতিকতার তিন ব্যাখ্যা দিয়েছে। মেজ ভাই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নৈঃশব্দ্য ও একটা ব্যাখ্যা বটে। সুর সঙ্গীতের সৌন্দর্যের জগত , তার নৈতিকতা কে সুন্দর করেছে। বড় ভাই হরিসাধন ও সেজো ভাই দীপঙ্করের নৈতিক অবস্থান চোরা গলির চোরা মাল। সে স্বীকৃতি দিয়েও, কে উনিশ কে বিশ, সে কূট তর্কে মেতেছে তারা। যদিও মোটের ওপর দুজন ই স্বীকার করে নিয়েছেন, একালে সাকসেসফুল হতে গেলে নৈতিকতার ঘ্যানঘ্যানানি ছাড়তে হবে। ছোটো ভাই রঞ্জিত মল্লিকের দ্বিধা যদি তাদেরও থাকতো , এমন গাড়ি বাড়ি ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স রেসের মাঠ এর জীবন তারা পেতেন না। শাখা প্রশাখা এর প্রথম দর্শনে পিতার প্রজন্ম কে প্রশ্নহীন ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল বলে ভালো লাগেনি। কাঞ্চনজঙ্ঘা তে যেমন পূর্ব প্রজন্মের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল , শাখা প্রশাখা তে তা নেই। কিন্তু শেষ দৃশ্যে নাতি যখন দাদুর কাছে এক নম্বরি, দু নম্বরির সঙ্গে দাদুর কি তিন নম্বরি না চার নম্বরি জানতে চায়; তখন তা যেমন আর প্রশ্নহীন থাকে না। তেমনি নাতির কল্পনার মতো আমাদেরও ধোঁয়াশা থেকে যায় চল্লিশ পঞ্চাশ ষাটের সফল বাঙালির নৈতিকতার চেহারা !

 

পরের পর ছবিতে সাফল্য-অসাফল্য, আধুনিকতা- অনাধুনিকতা, নগর সংস্কৃতি- গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে, কখনো পাশাপাশি রেখে পড়তে চান। যাকে খাঁটি বলে ধরে নিচ্ছি তা ঠিক কতটা খাঁটি কতটা ভাওতা সত্যজিত বুঝে নিতে চান। এবং এই পর্যায়ের ছবিগুলো তে সত্যজিত পক্ষ নিতে আর দ্বিধা করেন না। সীমাবদ্ধ তে শ্যামলেন্দুর সাফল্যের পাশে প্রায় কিছু নয় শর্মিলার পক্ষে থাকেন সত্যজিত। দেখনদারির বদলে জেতান রুচি কে। প্রতিদ্বন্দ্বী এর শেষাংশ অনেকের মতে দিকভ্রান্ত মনে হলেও চাকরির খোঁজে পরাজিত নায়ক সিদ্ধার্থ বালুর ঘাটে পৌঁছে সেই ছোটবেলার পাখির ডাক ফিরে পায়। এক আপাত পরাজয় ( কলকাতা ছেড়ে যাওয়া) বড় কিছুর আয়োজন ( পাখির ডাক) কে সূচিত করে। জন অরণ্য তে নায়ক এত বড় অর্ডারের সাফল্যেও মুষড়ে থাকে। আগন্তুক এ সন্দেহ সংশয় কে পুড়িয়ে ধূপের গন্ধ পাওয়া যায় মমতাশঙ্করের কান্নায়। শাখা প্রশাখা ‘ য় বাবা স্বান্তনা খুঁজে পান ‘অসফল’ ছেলের কাছে। সাফল্য-অসাফল্য নিয়ে সত্যজিতের ভাবনা ও কম আগ্রহের বিষয় নয়। যারা শহুরে সফল তারা কেউ ই বামপন্থী নন। বস্তুত রাজনীতি নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান নেওয়া যে সাফল্যের পথে বাধা, এই টুকু রাজনৈতিক জ্ঞান তাদের আছে। কোনো সাকসেসফুল মানুষের কাছে নৈতিকতার কোনো দৃঢ়মূল শেকড় নেই। সেটি না কাটলে সাকসেস ধরা দেয় না। কোনো সামাজিক সাংস্কৃতিক দায় ও এদের নেই। এদের লক্ষ্য এক মুখিন । কৃত্রিম কতগুলো চিহ্ন এর দ্বারা এরা চিহ্নিত হতে চান। মায়া দয়া আবেগ অনুভূতি এসবে লাগাম না পরালে সাকসেস অধরা থেকে যায়। অন্যদিকে তথাকথিত অসফল সীমাবদ্ধ এর শর্মিলা, প্রতিদ্বন্দ্বী এর ধৃতিমান, শাখা প্রশাখা এর প্রশান্ত, গণশত্রু’র ডাক্তার বাবু, এবং তার মেয়ে, থিয়েটার লিটল ম্যাগাজিন চালানো জামাই,আগন্তুক এর মামা – এদের পাশে এসে দাঁড়ান সত্যজিত। এই অসফল রাই ভবিষ্যত- এমন একটা নোট দেন। এতে তো বামপন্থী দের খুশি হবার কথা। হীরক রাজার দেশে বা সদগতি এর কথা না হয় নাই তুললাম। একটা জরুরি পর্যবেক্ষন দিয়ে লেখাটির ইতি টানা যাক। আমার উল্লেখ করা চলচ্চিত্র গুলির মধ্যে সত্যজিত তিনটি প্রজন্ম কে নিয়ে আসেন বারবার। অন্তত দুটি প্রজন্ম। নায়ক, নায়কের পিতা, নায়কের সন্তান। মহানগর আগন্তুক শাখাপ্রশাখা এর কথা মনে করুন। একটা সত্যজিতের সময়, একটা তার আগের আর একটা তার পরের। পিতার নৈতিকতা খানিক ধোঁয়াশার মধ্যেও তুলনায় এগিয়ে ছিল। তার সময়ের নাগরিক মধ্যবিত্তের নৈতিকতার অবক্ষয় শুরু। আর এই যে আগন্তুক এর , শাখা প্রশাখা এর বাচ্চারা বাবাদের নব্য নৈতিক ( চরম সুবিধাবাদী) ভাষণ শুনতে শুনতে বড় হলো; তারাই তো পরবর্তী সময়ে দ্বিধা হীন অনৈতিক হলো। এ প্রজন্মের অনৈতিকতা, দ্বিধা হীন। সে কথা বাঙলা ছবিতে কে দেখাবে?তিনি যেই হোন তাঁকে তাঁর নিজের নৈতিক অবস্থান কে ভাসমান করলে চলবে না। তেমন কাউকে কি দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট করে?

 
 
 
 
 
 
 

পূর্বে ‘ আরেকরকম ’ পত্রিকায় প্রকাশিত।

বিষয় চলচ্চিত্র : সত্যজিতের মর্জি মহল থেকে বিশ্ব-চলচ্চিত্রের দিকে যাত্রা - সুমন দে

 
 
 
 
 

 

“He aims to capture both what is unique in the Indian experience and that which is universal.”

 

-Audrey Hepburn

 

ভারতবর্ষে কোন দ্রব্য বিক্রি হতে যতটা সময় লাগে, আবেগ বিক্রি হতে তার সিকিভাগও সময় লাগে না। আবেগ-তাড়িত ভারতীয়দের চায়ের আড্ডা থেকে শুরু করে ঘরের শোকেসে রাখা কোনো সৌখীন শখের পিছনে সেই আবেগ কাজ করে। বিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে সিনেমার আকস্মিক আবির্ভাব প্রমান করলো যে এই আবেগের কোন নির্দিষ্ট সীমারেখা হয় না। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করে মূল আলোচনায় প্রবেশ করছি।

 

 

 

বোম্বাইয়ের রাস্তায় এক খেলনা বিক্রেতা জোরে জোরে হাঁক দিচ্ছিল “নিয়ে যান,নিয়ে যান ফালকে খেলনা!” সেই সময় ভারতীয় সিনেমার জনক দাদাসাহেব ফালকে তাঁর নামে তৈরি খেলনা দেখে আগ্রহভরে সেই বিক্রেতার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এর নাম ফালকে খেলনা কেন?” বলাবাহুল্য সেই সময়ে দাদাসাহেব সবেমাত্র ইংল্যান্ড থেকে ফিরেছেন। তিনি ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন তাঁর তৃতীয় সিনেমা ‘সাবিত্রী সত্যবান’-এর screening-এর জন্য। এবং সেই থিয়েটারেই দুজন ইংলিশ চলচ্চিত্র-প্রযোজক তাঁকে ইংল্যান্ডে থেকে সিনেমা তৈরি করার প্রস্তাব দেন। বদলে তাঁকে দেওয়া হবে মোটা অংকের মূল্য এবং ইংল্যান্ডের নাগরিকত্ব। তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। যাইহোক, ফালকের সেই প্রশ্নে বিক্রেতাটি বলে, “এই খেলনাটি স্থির নয়, চলমান যেমন ফালকে আমাদের চলমান ছবির সঙ্গে আলাপ করিয়েছেন”। -ভারতীয় সিনেমার উজ্জ্বল ভবিষ্যত এবং তার আশেপাশে গজিয়ে ওঠা আবেগের মস্ত বড় পাহাড় সম্পর্কে একটা আভাস মেলে এই ছোট্ট ঘটনাটির দ্বারা।

 

 

 
 
 

বাংলাদেশের থিয়েটার রসিকদের কাছে এই আবেগের জায়গাটি এত সহজে তৈরি হয়নি, যতদিন থিয়েটারের ভাষা থেকে সিনেমার ভাষা ও শিল্প রীতির স্বতন্ত্র মেরুকরণ করে সত্যজিৎ রায় বাঙালির শিল্পবোধের কেন্দ্রবিন্দুতে উপস্থিত হলেন। ব্রিকবেক কলেজের অধ্যাপক এবং সত্যজিৎ-গবেষক চন্দ্ক সেনগুপ্ত সত্যজিতের জীবনী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছেন যে তাঁর শিল্পবোধের বৈচিত্র এমনকি তাঁর সিনেমার গভীরে প্রবেশ করার জন্য সত্যজিতের আর্থসামাজিক, ঐতিহাসিক, এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে জানা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে তাঁর ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ প্রবন্ধ-সংকলনটি সত্যজিৎ-অনুগামী তথা সিনেমা-প্রিয় মানুষদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ-স্বরূপ। যেখানে আমরা তাঁর চলচ্চিত্র অভিজ্ঞতা, সেই অভিজ্ঞতা-জাত খুঁটিনাটি যান্ত্রিক ও শিল্পগত দিক, চলচ্চিত্রের ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ এবং সর্বোপরি তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কীভাবে সার্বজনীন হয়েছে এবং দেশ-কালের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ববোধ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে তার হদিস পাই।

 
 
 

 

সিনেমা তৈরির পিছনে একদিকে যেমন কাজ করে শিল্পচেতনা আবার অন্যদিকে যন্ত্র ও অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা। থিয়েটারের মত সিনেমায় দর্শক ও অভিনেতাদের সরাসরি যোগ স্থাপন হয় না, তাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ায় বেশকিছু যান্ত্রিক ব্যাপার, তাই সত্যজিতের এই প্রবন্ধ সংকলনে এমনই কিছু প্রবন্ধের হদিশ পাই যা সিনেমার সেই যান্ত্রিক ব্যাকরণ ও তার বিবর্তনের কথা বলে।

 

 

 

‘সিনেমার ভাষা : একাল সেকাল'(১৯৬৯) প্রবন্ধে সত্যজিৎ এই বিশেষ দিকটিকে বলেছেন প্রয়োজন মেটানোর দিক বা functional দিক, যা আর্টের অন্য পিঠে আঠার মত সেঁটে আর্টের দিকটিকে সমৃদ্ধ করে। উক্ত প্রবন্ধে তিনি সিনেমার ভাষা এবং সেই ভাষার বিবর্তনের কথাও বললেন, যেখানে লুমিয়ের, গ্রিফিথ ও পুদভকিনের মত বিশ্ববরেণ্য পরিচালকেরা ক্যামেরার ভাষা অর্থাৎ বিভিন্ন Angle ও কাহিনীর সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ চলচ্চিত্রায়নের মাধ্যমে দৃশ্যায়নের ভাষাকে নিরন্তর ঘষামাজা করেছেন আবার বাস্টার কীটন কিংবা চ্যাপলিনের মত অভিনেতারা স্বতন্ত্র অভিনয় রীতির মাধ্যমে অভিনয়ের ভাষা অর্থাৎ এক্সপ্রেশন, অভিব্যক্তি, সংলাপ বলার ভঙ্গি -প্রভৃতির মাধ্যমে নিরন্তর অভিনয়ের ভাষায় বৈচিত্র আনার চেষ্টা করেছেন। এই সমস্ত কিছুর সাহায্যেই একটা গোটা সিনেমা আকৃতি ও ভাষা দুইই পায়। functional দিকের পর আসে সিনেমার আর্টের দিক। এই প্রবন্ধ সংকলনের অন্তর্ভুক্ত ‘বাংলা চলচ্চিত্রের আর্টের দিক’(১৯৬০) প্রবন্ধে ‘বাংলা সিনেমা’ কথাটির মধ্যে প্রাদেশিক রূপ থাকলেও ‘আর্ট’ কথাটির মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্বজনীন সিনেমা-শিল্পের হদিশ দিয়েছেন। চলচ্চিত্রের ব্যাকরণ বলে, সিনেমা একটা যৌথ শিল্প। ক্যামেরার পেছনের কারিগর ও শিল্পী এবং ক্যামেরার আগে থাকা শিল্পীদের যৌথ প্রচেষ্টার ফল-স্বরূপ। কিন্তু এর শিল্পৎকর্ষটি ঠিক কোথায়? ভালো গল্প মানেই কি ভালো সিনেমা? থিয়েটারে অভ্যস্ত বাঙ্গালীদের চলচ্চিত্র বিষয়টি বুঝতে এবং তার অর্থ গ্রহণ করতে এই সব দ্বিধায় পড়তে হয়েছিল। বর্তমানে বাঙালির চলচ্চিত্র ভান্ডারে একটা অস্কার আসার পর হয়তো সিনেমার ভালো-খারাপ বিচার করার ক্ষমতা ও সুযোগ বাঙালিরা পায় কিন্তু আজও কি এই দ্বন্দ্ব থেকে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে বাঙালিরা? এই প্রশ্নটিই উস্কে দেয় সত্যজিতের এই প্রবন্ধটি।

 

 

 
 
 
 
 
 

এই প্রসঙ্গে উঠে আসে সমালোচকের কথা। বাংলা সিনেমার পতনের পরেও বাঙালিরা থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, তা শুরুর দিকের বাংলা সিনেমাগুলি দেখলে বুঝবো, তবে কি বাংলা সিনেমার দর্শক ও সমালোচক সিনেমার গুনাগুন বিচার করবে সেই থিয়েটার-সুলভ দৃষ্টি দিয়ে, নাকি এর জন্য একটি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন? আবার সিনেমার ক্ষেত্রে সমালোচকের দায়িত্ববোধ কী হওয়া উচিত এ প্রসঙ্গেও সত্যজিৎ এমন একটি দামী কথা বললেন যা সিনেমা উপান্তে গজিয়ে ওঠা কয়েকটি সস্তা দরের সমালোচকদের শিক্ষণীয়। তিনি বলেছেন, পরিচালক যেহেতু দর্শকদের থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে সিনেমাটি তৈরি করেন, সেহেতু সমালোচকের দায়িত্ব পরিচালকের সঙ্গে পা মিলিয়ে তার মূলসূত্রটি দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া, এই দায়িত্ববোধগুলো সত্যজিৎ বেশ কয়েকবার বাংলা ও বিশ্ব সিনেমার সমালোচকদের কাছে তুলে ধরেছেন। কারণ তাঁর বেশ কিছু সিনেমা সমালোচকদের প্রশ্নবানে বিদ্ধ হয়েছে। তা ‘অপুর সংসার’-এ চিত্রনাট্য ও মূল উপন্যাসের মধ্যে মৃদু অমিল নিয়েই হোক কিংবা ‘চারুলতা’ ও রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ -এর মধ্যে অমিল নিয়ে ঘোরতর আক্রমণই হোক। এর উত্তরও তিনি দিয়েছেন যা এই প্রবন্ধ সংকলনেই আছে। সাহিত্যের বর্ণনামূলক রীতি ও চিত্রনাট্যের সংলাপ-ধর্মী রীতির যে সীমাবদ্ধতা ও খুঁটিনাটি -তা আমাদের আগে বুঝতে হবে। থিয়েটারে এর আগেও হয়তো বাঙালিরা উপন্যাসের নাট্যরূপান্তর দেখেছে কিন্তু সিনেমার চিত্রনাট্য সেখানে কোথায় আলাদা তা সত্যজিৎ বোঝালেন।

 
 
 

 

আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে সিনেমার জন্ম-লগ্ন থেকে বর্তমান সময় অবধি যে বিবর্তন আমরা লক্ষ করি, তার পিছনে কাজ করে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট। এই বিবর্তন সত্যজিতের প্রবন্ধেও ধরা পড়ে। বিশ্বচলচ্চিত্রের রূপরেখা তৈরি করা ও তাকে এক সুতোয় বাঁধা সহজ নয়। সত্যজিৎ এই বিষয়টি জানতেন তাই শুধুমাত্র সিনেমার ভাষা ও আঙ্গিকগত যেসব বিবর্তন গোড়ার দিক থেকে বর্তমান সময় অবধি লক্ষ করা যায় তাকেই কেবলমাত্র ধরার চেষ্টা করেছেন।

 

 

 
 
 
 
 
 

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কোন বৃহৎ ঐতিহাসিক গাধা রচনা করা সত্যজিতের উদ্দেশ্য ছিল না, বিবর্তনের আভাস দিয়ে তিনি চলচ্চিত্রের জন্ম লগ্ন থেকে বর্তমান সময় অবধি যাত্রাপথের landmark -গুলিকে চিহ্নিত করেছেন। যেমন এই সংকলনটির প্রথম প্রবন্ধে তিনি সিনেমার ভাষার বিবর্তনকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন, পরিচালকের ভাষা ও অভিনেতাদের ভাষা। যেমন আমেরিকায় Slapstick কমেডির দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে একদিকে তিনি বাস্টার কীটন ও চ্যাপলিনের অভিনয় রীতিকে সামনে নিয়ে এলেন এবং প্রথম দিকে এই ধরণের বিশেষ সংরূপকে ক্যামেরাবন্দি করার গুরুত্বপূর্ণ অ্যাঙ্গেলের আবির্ভাব ‘tracking shot’-এর উদ্ভবের হদিশও দিলেন। অন্য একটি প্রবন্ধে তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার সিনেমার বিবর্তনের ইতিহাসকে ধরতে গিয়ে লেলিন-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যুগ –এই দুই ভাগে ভাগ করে সিনেমার মধ্যে যে মূল্যবোধগত পার্থক্য তৈরী হয়েছিল তা বলেছেন। জার শাসনে রাশিয়ান সিনেমার ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি ধীরে ধীরে কমিউনিস্ট শাসনে এসে পার্টির গাইডলাইনের আওতাভুক্ত হল – এই বিষয়টি রাশিয়ান চলচ্চিত্রের রুপরেখাকে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে। বাংলা সিনেমা অবশ্য জন্মলগ্নে রাষ্ট্রের নয় বরং থিয়েটারের শাসনাধীনে ছিল। বাংলা সিনেমার প্রথম দিকের থিয়েটার-সুলভ অতিনাটকীয় সংলাপ পরিবেশন কিংবা মঞ্চসজ্জার ভঙ্গিতে শিল্পীদের অবস্থান – প্রভৃতি দেখলেই বোঝা যায়। চল্লিশের দশকে বিমল রায় কিংবা নির্মল দে’র হাত ধরে বাংলা সিনেমার পরিবর্তনের ফলে বাঙ্গালীদের সিনেমার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবেই বা পাল্টালো তারও হদিশ পাব।

 
 
 

 

এই প্রবন্ধ সংকলনটি যেন বিচিত্র স্বাদের সমাহার। একদিকে তিনি সিনেমার বিশ্ব-বোধ নিয়ে আলোচনা করেছেন, আবার অন্যদিকে ডাইরি-ধর্মী রচনার মত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলিকেও তুলে ধরেছেন। ফরাসি দেশে বসে বিশ্ববরেণ্য পরিচালকের সঙ্গে আড্ডা থেকে শুরু করে বোড়াল গ্রামের সুবোধদার দাওয়ায় বসে আড্ডা দেওয়া – এইসব বিচিত্র অভিজ্ঞতাগুলিকে শব্দে ধরে রেখেছেন তিনি। সিনেমা তৈরির পিছনে তাঁকে যেসব পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তা যেন আরো বেশি রোমাঞ্চকর। যেমন ইন্দির ঠাকরুন চরিত্রের খোঁজ করতে গিয়ে চুনিবালা দেবীর আবিষ্কার। সিনেমার শুরুতে সত্যজিৎ জনসমক্ষে বলেছিলেন এই চলচ্চিত্রে কোনরকম মেকআপ বা মেকী বিষয়ের ব্যবহার করা হবে না – এই প্রতিশ্রুতিই বাংলা চলচ্চিত্রে চুনিবালা দেবীর আবির্ভাব ঘটালো। তাঁর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কিংবা বোড়াল গ্রামের সুবোধদার সঙ্গে সিনেমার কোনো প্রত্যক্ষ সংযোগ না থাকা সত্ত্বেও যে হূদ্যতা গড়ে উঠেছিল তা কাজের অতিরিক্ত আনন্দ। আবার কাশীর রমনিরঞ্জনের বিচিত্র চরিত্র প্রত্যেক সিনেমা-প্রিয় কৌতুহলী মানুষকে রোমাঞ্চিত করে যারা সিনেমার পিছনের বিচিত্র কাহিনীগুলিকে জানার চেষ্টা করে রন্ধ্রে রোমাঞ্চ অনুভব করে। আমরা এই সংকলনে বিনোদদা অর্থাৎ বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎ পাই, যিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের অধ্যাপক। দৃষ্টিশক্তি-রোহিত এই শিল্পীর অন্তরের শিল্প-দৃষ্টিকে সত্যজিৎ খুঁজেছিলেন।

 
 
 

 

সত্যই যেন শিল্পীর মর্জি মহল নিঃসৃত অভিজ্ঞতাগুলি কিভাবে বিশ্বজনীন রূপ লাভ করল তারই দৃষ্টান্ত এই প্রবন্ধ-সংকলনটি। গ্রন্থপাঠ মাত্রই পাঠকের কাছে তা একটি যাত্রার সমান। এই বইটিও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এই যাত্রার সঙ্গে আরেকটি বিশেষ উপাদান যুক্ত হয়েছে যা বইটির প্রত্যেকটি পরতে অনুভব করেছি। আমরা জানি সত্যজিৎ রায় অসাধারণ চিএশিল্পী এবং ইলাস্ট্রেটর হিসেবে স্বতন্ত্র পরিচয় লাভ করেছিলেন। এই বইয়ের অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেকটি প্রবন্ধ যেন সত্যজিতের ভাষার ইলাস্ট্রেশন, যা শিল্পীর চিত্রপট থেকে পাঠকের চিওপটে প্রবেশ করে সত্যজিতের স্বর্ণোজ্জ্বল সিনেমা তথা বিশ্ব চলচ্চিত্রের cinematic যাত্রাকে চোখের সামনে তুলে ধরে।

"এখানে শ্রোতারা শোনে আড়ি পেতে" গায়কের গেরো"এর চতুর্থ এবং শেষ পর্বে এসে বললেন - স্নিগ্ধদেব সেনগুপ্ত

গায়কের গেরো

 
 
 
 
 
 
 
 

 

 

আত্মপক্ষ: গায়ক আর শ্রোতার মধ্যে একটা পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক থাকা উচিৎ। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। শিল্পীদের দূর আকাশের তারা মনে হচ্ছে না আর। তাদের এখন ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো যাচ্ছে। কমেন্ট বক্সে ইচ্ছে করলে কাছা খুলে নেওয়া যাচ্ছে। তাই দূরত্ব থেকে আসা সমীহটা চলে গেছে।

 

 

 

সব মানুষ তো সমান হয় না। অনেকে অতি অভদ্র হয়। অনায়াসেই সৌজন্যের বেড়া টপকাতে পারে। এই লেখার “আমি” হচ্ছে তেমন এক অতি অভদ্র, মুখফোড় গায়ক। তার শ্রোতাদের প্রতি তেমন শ্রদ্ধাটদ্ধা নেই। সে নিজেকে নিয়ে সদা সচেতন, সিরিয়াস। মাঝেমাঝে খানিকটা আত্মপ্রচারমুখী। এই “আমি” চরিত্রটা কাল্পনিক কিনা সেটা নিশ্চিতভাবে জানতে পারলে বলে দেব। বাকি সব চরিত্রই ঘোর বাস্তব।

 

 

 

চতুর্থ পর্ব (শেষ পর্ব)

 

 

 
 
 
 
 
 

শ্রোতাদের মন যোগাতে এত কিছু! যা গাইতে একেবারেই ইচ্ছে করছে না, তা গাইতে হবে। ইচ্ছে না করলেও অকারণে হাসতে হবে। গাইব বলে ঠিক করে রাখা ভাল গান “লোকে খাবে না” বলে তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। গবেট বেচুবাবুদের কথায় গুরুত্ব দেওয়ার ভাণ করতে হবে। অল্প থেকে মাঝারি দক্ষতায় অনেকরকম গান গেয়ে নিজেকে “ভার্সেটাইল” সাজানোর নাটক করতে হবে। এই করে করে গায়করা এমন অবস্থা করে ছাড়ল, যে শ্রোতারাও বিশ্বাস করতে শুরু করল যে তারা গুরুত্বপূর্ণ।

 

 

 

একবার ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্সে স্বর্গীয় বিলায়েত খান সাহেবের সম্ভবত শেষ বাজনার আসর। আমি, নেহাতই স্কুলের ছাত্র, সেই আসরে উপস্থিত। ওস্তাদজী দরবারি বাজাচ্ছেন। মেজাজে উপচে পড়ছে নজরুল মঞ্চ। এমন সময় দুই সহৃদয় শ্রোতা বসার জায়গা নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে একে অন্যকে দোষারোপ করতে শুরু করলেন। শীতের রাত জাগতে হচ্ছে বলে কথা। ওঁদের পেটে সামান্য পানিও পড়েছিল হয়ত। দু’চার বাক্যের মধ্যেই উচ্চস্বরে ঝগড়া শুরু হল। উচ্চস্বর মানে একেবারে সেতারের আওয়াজ ছাপিয়ে যাওয়া উচ্চস্বর। ওস্তাদজী বাজনা থামিয়ে দিলেন। মাইক্রোফোনে বললেন – “আপ এইসা মত কিজিয়ে। আপহী কে লিয়ে তো বজানে আয়ে হ্যায়! স্টেজ পে মেরে পাস আকে ব্যায়ঠ যাইয়ে।”

 

 

 

ওই শব্দবন্ধটা নিয়ে এখন আমাদের আলোচনা – “আপহী কে লিয়ে…”। বিলায়েত খান সাহেব বলে কথা! তাঁর বাজনা শ্রোতাদের জন্য? তাঁর নিজের জন্য নয়? আবার, এও ঠিক যে, শ্রোতাদের জন্য হলে কি আর নিজের জন্য হতে নেই? যা নিজের, তাই তো ভরসা করে সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়। সুতরাং এই দোটানার কোনও সমাধান নেই। উপমহাদেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা সাধক শিল্পীও যখন প্রকাশ্যে শ্রোতাদের এত গুরুত্ব দিলেন, তখন শ্রোতারা নিজেদের কেউকেটা মনে করবে না কেন?

 

 

 

এবার এর উল্টোদিকের একটা গল্প বলি, যেটা আমি প্রথম পড়ি স্বর্গীয় কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লেখায়। এটা পুরনো ভারতের গল্প। সম্রাট আকবরের মনে হল তাঁর সভাগায়ক তানসেন এমন গান করেন! না জানি তানসেনের গুরু কেমন গাইবেন! তিনি তানসেনকে তলব করে ওঁর গুরুর গান শুনতে চাইলেন। তানসেন বললেন – “জাঁহাপনা, এটা তো বড় দুঃসাধ্য কাজ! আমার গুরু তো কাউকে গান শোনান না। উনি নিজের গান কেবল ঈশ্বরকেই নিবেদন করেন। সে জিনিসের ভাগ অন্য কাউকে দেন না।”

 

 

 

এরপর আকবর কি তপোধন সংলগ্ন জঙ্গলের গাছের আড়ালে লুকিয়ে সেই গান শুনেছিলেন? আমরা একটা মুঘল মিনিয়েচার পেন্টিঙে দেখি ভিক্ষুক বেশে স্বামী হরিদাসের সামনে বসে আছেন রাজবেশে তানসেন। সম্ভবত দু’জনেই গাইছেন। আর আড়ালে দাঁড়িয়ে… হ্যাঁ, বসে নয়, দাঁড়িয়েই… শুনছেন সম্রাট আকবর।

 

 

 

পরম্পরা বলছে, ভারতীয় সংগীত শ্রোতার জন্য নয়। কোনও আধাত্মিক সাধনার পথ, কোনও আত্ম-উপলব্ধির রাস্তাই কখনও শ্রোতার জন্য হয় না। এখানে শ্রোতারা শোনে কেবল আড়ি পেতে। যেমন আকবর শুনছিলেন। আড়ি পেতে থাকা কানগুলোকে টাকা-পয়সা বা যশলোভে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ফেললে গায়কের গেরোই উপস্থিত হয়। আর কিছু হয় না বোধহয়।

তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বিনোদনের নিয়ন্ত্রক শক্তি কারা ? -- জানালেন - অজন্তা সিনহা

নীতিপুলিশি না রাজনীতি ?

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

ওভার দ্য টপ ( Over the top/OTT) মিডিয়া সার্ভিস। সাম্প্রতিককালে বিপুল পরিমাণে আলোচিত এক মাধ্যম। কি এই সার্ভিস, না, যেখানে কেবল, ব্রডকাস্ট বা স্যাটেলাইট টেলিভিশন প্ল্যাটফর্মের চিরাচরিত ব্যাবস্থা ছাড়াই সরাসরি ইন্টারনেটের মাধ্যমে দর্শক দরবারে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। নেটফ্লিক্স, আমাজন প্রাইম, ডিজনি হটস্টার, সোনি লিভ, হইচই থেকে ফেসবুক বা ইউটিউব চ্যানেল এভাবেই কোটি কোটি দর্শকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই দুনিয়ার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে যাওয়ার পর কেটে গেছে বেশ কয়েকটি দিন। জেন ওয়াই থেকে তাদের ‘দাদু’প্রজন্ম সকলেই এই পরিষেবার উপভোক্তা আজ।

 
 
 

এই পর্যন্ত পুরোটাই কালের ও প্রযুক্তির গতি-প্রকৃতির নিয়মে চলমান একটি অধ্যায়। বেশ কয়েকটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সংস্থা তাদের পসরা নিয়ে বিনোদন বাজারে বিকিকিনির জন্য হাজির। উপভোক্তারাও খুশি এবং তৃপ্ত। উপাচারে রয়েছে সিরিজ, সিনেমা, সিটকম, চ্যাট শো, মিউজিক বা ডান্স ইত্যাদির আয়োজন। মোদ্দা কথা মনোরঞ্জনের বিপুল সম্ভার। ভাষার দিক থেকে তাদের সামনে প্রচুর অপশন—বাংলা, হিন্দি থেকে দেশের প্রায় সব ভাষা এবং ইংরেজিতে প্রচারিত অনুষ্ঠান। ইংরেজি অর্থাৎ, তার মাধ্যমে আবার সারা বিশ্বের আরও অনেক ভাষার শো। সেসবের কিছু নতুন করে এই নয়া মাধ্যমে স্ট্রিমিংয়ের জন্যই বানানো। কিছু পুরোনো টিভি সিরিজ। নতুন ও পুরোনো সিনেমা। সব মিলিয়ে দর্শকের প্রাপ্তি পরিপূর্ণ।

 
 
 

তাহলে সমস্যাটা কোথায় ? হঠাৎ করে এই স্ট্রিমিংয়ের উপকরণ বা বিষয়বস্তু নিয়ে খবরের বাজার এত গরম কেন ? কেনই বা এই আইনি কোন্দল বা নতুন আইনের প্রবর্তন। হ্যাঁ, একথা আজ সবারই জানা, এবছর ফেব্রুয়ারিতেই কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ প্রবর্তিত নতুন Intermediary Guidelines and Digital Media Ethics Code আদতে OTT মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়।

 
 
 
 
 
 
 
 

আমাজন প্রাইমে প্রদর্শিত ‘তাণ্ডব’ সিরিজ নিয়ে বিষয়টি তুঙ্গে উঠলেও তলে তলে এই নীতিপুলিশির আইনি চক্কর চলছিল বহু আগে থেকেই। হঠাৎ হঠাৎ কোনও একটি সিরিজ বা সিনেমা নিয়ে সমাজের রামা-শ্যামা থেকে সেলিব্রিটিকুল হয় টুইট করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে বা আদালতে মামলা ঠুকে দিচ্ছে, এমনটা অহরহ শোনা যাচ্ছিল। তাদের অভিযোগ, এমন কিছু এই মাধ্যমে স্ট্রিমিং হচ্ছে, যা সমাজের পক্ষে হানিকারক। ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, নারী নির্যাতন, নারী ও শিশুপাচার এসবে সমাজের এযাবৎকাল কোনও ক্ষতি হয়নি। কিছু প্রাপ্তবয়স্ক সিরিজ, প্রাপ্তবয়স্ক দর্শক দেখলেই সমাজ অধঃপাতে চলে যাওয়ার এই থিওরি স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষ বানায়। আর দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই একবিংশ শতকেও তাদের প্রচুর অনুগামীও জুটে যায়।

 
 
 

এই অনুগামীরা প্রকাশ্য রাস্তা থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার অলিগলি কাঁপিয়ে হুঙ্কার ছাড়ে। ‘তাণ্ডব’-এর ক্ষেত্রে এ ঘটনা মারাত্মক আকারে ঘটেছে। এর আগে ‘স্যাক্রেড গেমস’, ‘মির্জাপুর’ বা ‘দিল্লি ক্রাইম’, ‘লাইলা’ ইত্যাদি নিয়ে গুঞ্জন ছিল। সেই মৃদু গুঞ্জন আজ গর্জনে পরিণত। সত্যি বলতে কি, বিরুদ্ধবাদীদের জনসমর্থন আইনের ধারকবাহকদের সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে, না, আইনের থুড়ি সমাজের রক্ষকরাই নিবিষ্টভাবে এই জনসমর্থন তৈরি করেছে, তা নিয়েও ধন্দ আছে।

 
 
 
 
 
 
 
 

মজা হলো, এদেশে আইন সমাজকে না সমাজ আইনকে নিয়ন্ত্রণ করে বা করবে, তা নিয়ে গোড়া থেকেই ধারণাটা যথেষ্ট স্বচ্ছ নয়। এতদিন এই অস্বচ্ছ ধারণা বা প্রক্রিয়ার মধ্যেও কিছুটা স্বাধীন, উদার, মুক্তচিন্তার গমনাগমন ছিল। বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে তার রূপরেখা দেখেছি আমরা। প্রসার ভারতীর আনুকূল্যে বড় ও ছোটপর্দায় আগেই মুক্তচিন্তা প্রতিহত করার তীব্র চেষ্টা দেখা গেছে। সেখানে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আজ স্পষ্ট। বাকি ছিল স্ট্রিমিং, অর্থাৎ OTT মাধ্যম। এবার সেখানেও সেন্সরের কাঁচি। সমাজের কে কি দেখবে, সেটা এখন ঠিক করবে কর্তৃপক্ষ।

 
 
 
 
 
 
 
 

গত কয়েকবছর ধরে এদেশে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে যে শক্তি, তারা নিছক গোঁড়া বা রক্ষণশীল নয়। এটা তাদের বাইরের আবরণ মাত্র। আসলে তারা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে, নিজেদের শক্তি জাহির করার উদ্দেশে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। OTT স্ট্রিমিংয়ে বিষয় নির্বাচন বা পরিবেশন পদ্ধতিতে তাদের নাক গলানোর ব্যাপারটাও তাই। এর ফলে বেশ কিছু ভালো সিরিজ বা সিনেমা দর্শন থেকে বঞ্চিত হবে ভারতীয় দর্শক। ইতিমধ্যেই কাঁচি চালিয়ে ‘তান্ডব’-কে যে চেহারা দিতে বাধ্য হয়েছে নির্মাতারা, তা কহতব্য নয়।

 
 
 

প্রসঙ্গত, ‘তান্ডব’ নিয়ে এত জ্বালাপোড়ার কারণ বুঝতে রকেট সায়েন্স পড়ার দরকার পড়ে না। কেন্দ্রীয় সরকার যে কোনও উদারপন্থী ভাবনাকেই শত্রুজ্ঞানে দেখে, একথা আজ সর্বজনবিদিত। বিরুদ্ধাচরণ বরদাস্ত করা হয় না। প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহু সৎ, সাহসী সাংবাদিক হয় মৃত, নয় ভীত। মেনস্ট্রিম মিডিয়ার পর এখন OTT-র ওপরেও নেমে আসছে নিয়ন্ত্রণের খাঁড়া।

 
 
 
 
 
 
 
 

নির্মাতা, নির্দেশক, স্পনসরদের একটি বিরাট শ্রেণী এই মুহূর্তে দুশ্চিন্তায়। সে সাংবাদিক সম্মেলনে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী যতই বলুন, নতুন Intermediary Guidelines and Digital Media Ethics CodeIntermediary Guidelines and Digital Media Ethics Code

 

আইনকে সরকারপক্ষের মতোই OTT মাধ্যমও স্বাগত জানিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, তেতোর ওপর মধু মাখানোর মতো কিছু বিবেচ্য বিষয় আলোচনাস্তরে রেখে দেওয়া হয়েছে এরপরও। কিন্তু যেখানে খোদ দেশের সুপ্রিম কোর্ট বলছে, এই সিরিজগুলির মধ্যে বহুজায়গায় এমন দৃশ্য রয়েছে, যা পর্নোগ্রাফির সমতুল্য। সেখানে কি সমঝোতা হতে পারে, বোঝাই যায়। যেটা হলো মাঝখান থেকে, অনেকেরই নির্মিত সিনেমা বা সিরিজগুলি আর প্রদর্শিত হবে কিনা, প্রশ্নের মুখে। তাঁরা তো তথাকথিত ওই ‘পর্নো’দৃশ্য রেখেই সিরিজগুলি বানিয়েছেন।

 
 
 
 
 
 
 
 

সবশেষে নিন্দুকেরা যা বলছে, এই কান্ড নিছক নীতিপুলিশি নয়। এক সম্রাটের বিশাল সিন্দুকে ভারতের অর্থনীতি থেকে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যাবস্থার চাবিকাঠি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তুলে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে স্ট্রিমিংয়ের দুনিয়াতেও তাদেরই একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করার প্রস্তাবনা নয় তো এই নিয়ন্ত্রণ ?!

Gottfried Mentor-এর সঙ্গে ছ'মিনিট ছত্রিশ সেকেন্ড ।। রিয়া চক্রবর্তী

 
 
 
 
 
 
 

 

 

সেই কতও কতোদিন ধরে খেলাটা চলছে তো চলছেই, একই নিয়মে। কিন্তু আমাদের কিছুতেই ক্লান্তি আসছে না। সব জেনে, বুঝে, বিতর্ক ও বিশ্লেষণকে পার করে আবারও আমরা ঘুঁটি সেজে অপেক্ষা করছি খেলাটা শুরু করার জন্য। যতক্ষণ সেটা শুরু না হচ্ছে ততক্ষণ শুধু সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে যেতে হবে। ব্যাস। এইটুকুই।

 

আজকে যে ছ’মিনিট ছত্রিশ সেকেন্ডের ছবিটা নিয়ে কথা বলবো, তাতে এই খেলাটাকে ধরে ফেলার, খেলার কথা আছে। ঐটুকু পরিসরে পরিচালক ইতিহাসের একটা সূত্রকে প্রমাণ করেছেন। অ্যানিমেশনে তৈরি একটা শর্ট ফিল্ম। নাম : ‘Oh Sheep!’ ; পরিচালক একজন বছর চল্লিশের ফ্রান্সের বাসিন্দা ; নাম : Gottfried Mentor.

 

আমার দেশে, এই সময় দাঁড়িয়ে, যতবার আমি সব বোঝার পরেও, অন্য অন্য তথ্যের স্তূপে ঢুকে এই ছবিটার কথা ভুলে যাবো, ততবার আমি এই ছবিটাকে ফিরে ফিরে দেখতে চাই। কী এমন আছে এই ছবিটায়, যার ভিত্তিতে এমন সব কথা পাঠককে শুনতে হচ্ছে? কিচ্ছু না। কটা ভেড়ার গল্প। আর আছে তাদের দু’জন মালিক।

 

একদিন হলো কী, দুই মালিক তাদের নিজের নিজের ভেড়াদের নিয়ে মাঠে এলেন। কিন্তু মালিকরা পরস্পরকে দেখে খুশি না হলেও, ভাড়ার দল কিন্তু ভারি খুশি। একসাথে খেলায় মেতে উঠতে যাবে যাবে করছে, ঠিক এমন সময় মালিকদের হুংকার। আসলে ভেড়ারা এক হয়ে গেলে দু’জন মালিকের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাবে কিনা। যতক্ষণ ভেড়া, ততক্ষণই মালিকানা।

 

তাই লাঠি আর হাতুড়ি দিয়ে বেড়া বেঁধে ভেড়াদের আলাদা রাখা হলো। যাক্ বাবা, এবার নিশ্চিন্ত! ভেড়ার দৌড় বেড়া অবধি – এ কথা কে না জানে। কিন্তু গোল বাধলো জানেন। দু’পাশের ভেড়ারা মাথা দিয়ে গুঁতিয়ে ভেঙে দিল সেই কাঠের বেড়া। মিলে গেল আবার। একে অপরকে পেয়ে সে কী আনন্দ।

 

এবার মালিকরা কাঁটাতার বাঁধলেন। যার দুই প্রান্তে দুই দল ভেড়া। হুঁ হুঁ বাবা! এবার? কাঁটাতারের এপার থেকে ওপারে তারা মুখ ঢুকিয়ে পরস্পরকে ছোঁয়। তাদের চোখে ব্যথা সব কথা বলে যায়। না না, দর্শক, এটা কোনও দেশভাগের প্রতীকী কথা নয় শুধু। এমন অসংখ্য কাঁটাতার আমাদের চারদিকে। তা একদিন হলো কী, একটা বেয়াড়া ভেড়া কাঁটাতার টপকে ওপাশে যাওয়ার জন্য মস্ত এক লাফ দিলো। কিন্তু সফল হতে পারলো না। কাঁটাতারে আটকে, মরে ঝুলে রইলো। (বেশ কয়েক বছর আগে এক কিশোরীর গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ যেমনভাবে ঝুলে ছিল ভারত-বাংলাদেশের কাঁটাতারে, তেমনি আর কি!) কিন্তু এই চেষ্টাটা একটা কাজ করলো। মালিকের মনে ভয় ধারালো। এভাবে যদি ভড়াগুলো মরতে থাকে, তাহলে মালিকের চলে কী করে?

 

তাই এবার তারা পাথরের উপর পাথর গেঁথে দেওয়াল তুলে দিলো। বিমর্ষ ভেড়ার দল পরস্পরের কণ্ঠস্বর শোনে। কিন্তু দেখতে পায় না কেউ কাউকে। আবার একদিন সব অসহ্য হয়ে উঠলো। ভেড়ারা আবার আগের মতো ঢুঁশিয়ে ভেঙে দিতে চাইল দেওয়াল। আহত, রক্তাক্ত, নিহত হয়ে পড়ে রইলো তারা। দেওয়াল ভাঙলো না। কটা ছুটকো পাথর খসে পড়লো শুধু। কিন্তু এভাবে যদি ভেড়ারা ক্ষতবিক্ষত হয়, তাহলে মালিকের (বা রাষ্ট্রের) ব্যবসা যে মার খাবে। এবার তাই আবার আলোচনায় বসলো দুই মালিক।

 

এবার এক্কেবারে জব্বর প্ল্যান! ভেতর থেকে ভাঙতে হবে ওদের। ওদের এই ভালোবাসাটাকে ঘেন্নায় রূপান্তরিত করতে হবে। তাহলেই কেল্লা ফতে! এবার তারা করলো কী, কাঁচি দিয়ে ভেড়াদের লোম কেটে, দুটো ভিন্ন রকমের ডিজাইন করে, তারা এক এক পক্ষকে চিহ্নিত করে রাখলো। তারপর বেড়া, কাঁটাতার, পাথরের দেওয়াল সব উধাও।

 

আর এখান থেকেই মারাত্মক হয়ে উঠলো খেলাটা। ভেড়ারা একে অপরের দিকে ছুটে এসে পরস্পরকে আদর করতে গিয়ে দেখল- আরে! এ আবার কে? একে তো চিনি না! আমার গায়ের কারুকাজের সঙ্গে ওর গায়ের কারুকাজ তো মিলছে না!

 

এবার তারা পরস্পরকে আঘাত করতে থাকলো। অপরকে মেরে শুইয়ে দিলো চিরদিনের মতো। এভাবে তারা সবাই একদিন মরে গেল।

 

এই অবধি এসে আমার মনে পড়ছে ধর্মের কথা, গুজরাট দাঙ্গার কথা, রাম মন্দিরের কথা, ইমাম ভাতার কথা, দলিত আর উচ্চবর্ণের কথা… কতও কতও কথা। সবই তো ঐ কারুকাজের খেলা, তাই না পাঠক? আমি বুঝতে পারছি, এ প্রশ্নের উত্তরে আপনি সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ছেন। তার মানে আমি ও আপনারা সবাই বুঝতে পেরে গিয়েছি সবটা। তাহলে ধরে নিতেই পারি ভিন্ দেশের এক পরিচালক সারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশের কথাকে মিলিয়ে দিয়ে আমাদের অ্যাকিলিস হিল-টাকে চিনিয়ে দিয়ে গেলেন। এবার তাহলে আর কোনও দাঙ্গা হবে না, ফ্রিজে গরুর মাংস পেয়ে কাউকে পিটিয়ে মারা হবে না, গোধরা কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি হবে না, কোনও পাদ্রীকে শিশুপুত্র সহ বন্ধ গাড়িতে পুড়িয়ে মারা হবে না… হবে না… হবে না… হবে না…

 

হাঃ! এমনটা যদি সত্যিই, সত্যি হতো! আমরা যদি এমন জ্ঞানপাপী না হতাম! তাহলে…

 

 

ধর্মের অন্ধতার বিপরীতে যুক্তির আলো '- টেনথ্ প্ল্যানেট এর " গ্যালিলিও" দেখে লিখলেন - দেবহূতি সরকার

গ্যালেলিও

 
 
 
 
 
 

ধর্ম আর বৈজ্ঞানিক সত্যের মধ্যে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রচারে যখন ধর্মের পাল্লা ভারী হয়ে উঠছে ভারতবর্ষে, সত্য অপেক্ষা প্রচার বড় হয়ে উঠছে ক্রমাগত, তখন ‘টেনথ প্ল্যানেট’ নাট্যদলের এক ঝাঁক তরুণ তুর্কী তৃপ্তি মিত্রের অন্তরঙ্গ মঞ্চে অভিনয় করল ব্রেখটের বিখ্যাত নাটক’গ্যালিলিও’, ধর্মের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুক্তির জয় যে নাটকের মূলধন। শম্ভু মিত্র গ্যালেলিওর অভিনয় বাংলা থিয়েটরের জগতে কিংবদন্তি হয়ে আছে, কিছু বছর আগে অঞ্জন দত্ত অভিনয় করেছিলেন দক্ষতার সঙ্গে। এমন একটি বহুল আলোচিত নাটক ও বিখ্যাত প্রজোযনা আবার অভিনয় করার যে সাহস লাগে তা এই নাট্যদল অর্জন করতে পেরেছে দেখে ভালো লাগলো। বিশেষত অন্তরঙ্গ স্পেসে নাটকটির পরিকল্পনা সহজসাধ্য ছিলো না।

 
 
 
 
 
 

সমালোচক : দেবহূতি সরকার

 
 
 
 
 

নাটকটিকে সাম্প্রতিক এর সঙ্গে মিলিয়ে দিতে নির্দেশক শরণ্য দে ব্যবহার করেছেন গানের। একদল কোরাস এর গান দিয়েই নাটক শুরু হয়। গানের কথা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া চাপগুলির স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে চায়। এর পরেও কোরাস কয়েকবারই এসেছে এবং প্রতিবারই প্রশ্ন তুলেছে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে।গ্যালিলিওর আবিষ্কারের কারণে যখন মেয়ের বিয়ে ভেঙে যায় তখন মেয়েটির ব্যক্তিগত যন্ত্রণার প্রকাশ হিসেবেও গানের ব্যাবহার ভালো লাগে। সঙ্গীতায়োজন এই নাটকের অন্যতম বড় সম্পদ তবে লালন ফকিরের গানটি ব্যাবহারের ক্ষেত্রে আরো একটু ভাবনার প্রয়োজন ছিলো বলে মনে হয়।

 

অন্তরঙ্গ স্পেসে মঞ্চসজ্জা ছিমছাম- দুটি টুল আর একটি মই। এইটুকুকে ব্যবহার করেই অভিনেতা অভিনেত্রীরা বোঝাতে চেষ্টা করেছেন সমস্ত দৃশ্যকে, গ্যালিলিওর ঘরই হোক বা বাইরেই হোক। সবসময় যে তা খুব স্পষ্ট হয়েছে এমন কথা বলা যাবে না। একটি সাইনবোর্ড থাকে যা বারবার বদলে যায় দৃশ্যান্তরে। ভাবনাটি ভালো তবে নতুন কিছু নয়।

 
 
 
 
 
 
 
 

নাটকটির নাট্যদ্বন্দ্ব এবং সংলাপ এতটাই আবিষ্ট করে রাখে যে হয়ত শুধু পাঠ করে গেলেও দর্শক উঠতে পারবে না। কিন্তু অভিনয়ের ক্ষেত্রে আরো অনেক অনুশীলনের প্রয়োজন আছে বলেই আমাদের মনে হয়। গ্যালিলিওর চরিত্রে পরিচালক চেষ্টা করেছেন ঠিকই কিন্তু আবিষ্কারের আনন্দ বা চার্চের চাপে নতিস্বীকার এর পর ভেঙে পড়া এক বিজ্ঞানীর মানসিক দ্বিধা বাইরে থেকে আরোপিত মনে হয়, চরিত্রের গভীর থেকে উঠে আসা নয়। বয়স্ক গ্যালিলিও আন্দ্রেইর কাছে যখন ভয়ের স্বীকার করে তখন বদলে যাওয়া গলা কানের কাছে আবেদন আনে মনে নয়। বিশেষত সেই বিখ্যাত সংলাপ দুর্ভাগা সেই দেশ যেখানে বীরের প্রয়োজন হয়, উচ্চারণের জন্য চরিত্রের নাটকের মধ্যে চরিত্রটির যে ক্রম উত্তরণের প্রয়োজন ছিলো তা অনুপস্থিত। তুলনায় সমুদ্রনীল আন্দ্রেই চরিত্রটিকে সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। নারী চরিত্রের মধ্যে গ্যালেলিওর মেয়ের ভার্জিনিয়ার চরিত্রটিতে অনুরিনা মুখার্জী একদম শেষে বাবার সমব্যাথী হিসেবে কিছুটা পরিণত অভিনয়ের চেষ্টা করেছেন। প্রথম দিকে প্রেমিকার চরিত্রে আরো অনুভূতি আনার প্রয়োজন আছে।স্বল্প পরিসরে সাম্বদীপ চৌধুরী ও অভিজিত সরকার ভালো অভিনয় করেছেন। তবে কোরাসের দলগত অভিনয় খুবই প্রশংসনীয়। তারা নাটকটির গতির অন্যতম সহায়ক। আলোর ব্যবহার উল্লেখের দাবী রাখে। তবে পোশাক পরিকল্পনা নিয়ে আরো একটু ভাবার প্রয়োজন আছে। হয় পিরিয়ড ড্রামার উপযুক্ত পোশাক ব্যবহার করা হোক বা একেবারেই সাধারণ পোশাক। অন্তরঙ্গ জায়গার অভিনয়ে যেহেতু দর্শক ও অভিনেতার দূরত্ব থাকেনা বললেই চলে, তাই গ্যালিলিওর হাতে পাঁচটি রত্ন দেওয়া আঙটি বড়োই চোখে লাগে।

 
 
 
 
 
 
 
 

এটি ছিলো নাটকটির প্রথম অভিনয় আশা করি পরবর্তীতে তাঁরা ত্রুটিবিচ্যুতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন। বিখ্যাত নাটক অভিনয়ের সাহস যখন দেখিয়েছেন তখন সেই দায়িত্ব পালনের জন্য আরো অনুশীলন তাঁরা করবেন। পরবর্তী অভিনয় ১৮এপ্রিল তপন থিয়েটারে, নির্দেশক বললেন সেদিন তারা এপিক থিয়েটরের কথা মাথায় রেখে সমস্ত প্রেক্ষাগৃহটি জুড়েই অভিনয় করবেন। আশাকরি তখন অভিনয়ের আরো সূক্ষ মাত্রা আমরা দেখতে পাবো। সব মিলিয়ে টেন্থ প্ল্যানেট এর গ্যালিলিও এই সময়ের নাটক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। দলগত ভাবে তাদের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই।

 
 
 
 
 
 
 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *