সপ্তদশ সংখ্যা ।। দশম ই-সংস্করণ ।। জুন, ২০২১

ভাণ পত্রিকা

সপ্তদশ সংখ্যা ।। দশম ই-সংস্করণ ।। জুন, ২০২১

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

ও মৌলিকা সাজোয়াল

এই সংখ্যায় বিশেষ সহযোগিতা

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) [email protected] ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সূচি

সম্পাদকের কথা

বাংলা ভালো নেই। দেশ ভালো নেই। দেশের মানুষ ভালো নেই। মানুষের শরীর ভালো নেই। মন ভালো নেই। মেজাজ বিগড়ে আছে।অক্সিজেন নেই। ওষুধ নেই। ভ্যাকসিন নেই। হাসপাতালে বেড নেই। বেডে পৌঁছোনোর পয়সা নেই। লাইন করার যোগ্যতা নেই।মন নেই। মনস্তাপ আছে। সরলতা নেই, বক্রদৃষ্টি আছে। রক্ষার দায় নেই। তবু প্রতিশ্রুতির বন্যা আছে।আছে আশঙ্কা ,উৎকন্ঠা, ভয়। মৃত্যু আছে নিষ্ঠুর জীবন-সত্য হয়ে।এগুলোই আছে। নেই এর বাজারে। আর ঝিলিক দেওয়া জোনাকির মতো কিছু আশা আছে। রেড-ভলেন্টিয়ার হয়ে।সেবা আছে। সহায়তা আছে। বন্ধুর জন্য উদ্বেগ আছে। আছে কান্না। আমাদের বাঙালির যা কিছু মান, যা কিছু যশ, – সব ঝড় হয়ে আছড়ে পড়েছে চেতনায়। আমাদের আচ্ছন্ন করছে। সুন্দরবন ভেসে যাচ্ছে। সুন্দরবন ভেসে যায়। মানুষ ভেসে যায়। ডুবে মরে যুক্তি। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি অনির্বচনীয় হুন্ডির দাস হয়ে যায়। মানুষ চাঁদে যায়। মঙ্গল এ জমি কেনে। সমুদ্র দখলে নামে। আর প্রতিবার ঝড় এসে ভেঙে দেয় সালাম- রফিক-রুকুল পাখিরা- পবন আগুয়ানদের বাড়ি। একটা ভাইরাস এসে তুলকালাম বাঁধিয়ে দেয়, লন্ডভন্ড করে দেয় ধরাধাম। বুকের কলজে খুবলে, নিয়ে চলে যায় আমাদের প্রিয়জনকে। ভালোবাসা কে। ভালো থাকা কে। স্বদেশে পরবাসী মনে হয়। একা হয়ে যাই। আমরা একা হয়ে গিয়েছি। কী বলি বুঝিনা। কেন শুনি জানিনা। যা দেখি দেখা হয় না। যা শুনি ভুলে যাই দ্রুত। এভাবে কি চলে। এভাবে কতদিন চলে বলো? গোঁজামিল দিয়ে, গাঁজা কে পরম ভেবে, তাপ্পি আর ওপর চালাকি দিয়ে? আর কতদিন!!কেবল কথার খেলা ও খেলাপি। দেখার বদলে দেখনদারি। চেনার বদলে চেনার ভড়়ং। দয়ার বদলে ‘দয়ার-দোকান’। করুনার বদলে অবান্তর ভাড়ামো । দোয়ার গভীরে অহং এর ভাইরাস। আমাদের গ্রাস করে। শত্রুদের দিকে ধেয়ে যেতে গিয়ে দেখি, নিজেকেই ক্ষতবিক্ষত করে চলেছি আমি। একপক্ষ ভোটে জেতে। একপক্ষ হেরে যায়। একশ্রেণি আয়েস করে। একশ্রেণি ধুঁকে যায়। অথচ আশা ছিল। রবির কিরণ ছিল। চৈতন্যে ছিল নিত্য আনন্দ। নবজাগরণ ছিল। গণতন্ত্র ছিল। ছিল আলোকায়িত আধুনিকতার গৌরব। প্রগতির রথ ছিল। রশিতে টান দিয়ে, কথা ছিল এগনোর। তবু রেশনের দোকানে শত শত ম্লান মুখ‌। অনুদানে এটা-ওটা। ওটাতেই বেঁচে থাকা, কোটি কোটি জীবনের,- কেন?

এ মনস্তাপের মনস্তত্ত্ব কে খুঁজে দেখতে ইচ্ছে করে। কোন নীতি, কোন রাজা, কোন তন্ত্র, কোন মন্ত্র মিলে চলছে এ যন্ত্র। সে অভ্যাস কে, সে যাপন কে, সংস্কৃতি কে চেনার চেষ্টা এ সংখ্যায়। ফেরাতে হাল ফিরুক লাল- সংখ্যাতত্ত্বের যুক্তিতত্ত্বের ধার না মাড়িয়ে বাঙালির মন কেন অনেক প্রশ্ন নিয়েও তৃণমূলের সঙ্গে থাকলো, সে মনস্তত্ত্ব কে বোঝার চেষ্টা করেছেন দেবরাজ কুমার। আর জুলফিকার জিন্না বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহাসিক পর্বান্তর এর ধরণ টিকে চিনতে চিনতে চিনিয়েছে আমাদের। কতো যে প্রাসঙ্গিক টিপ্পনী, বিস্মিত করে।

এছাড়া থিয়েটার-চলচ্চিত্র-নৃত্যকলা নিয়ে নিয়মিত বিভাগে আসরে আছেন- ঋষা নাগ, অজন্তা সিনহা, শ্রীপর্ণা ভট্টাচার্য। বিহু নৃত্য নিয়ে সাম্প্রতিক পড়া একটি বই এর অভিজ্ঞতা লিখেছেন কেকা ত্রিবেদী।

ভালো থাকবেন। ভাণ এর সঙ্গে থাকবেন। পাঠকদের কাছে বিনীত আবেদন, নি-খরচায় এই পত্রিকার কাজ চালিয়ে যেতে বছরে একটি বার আপনাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব। আপনাদের যেকোনও অনুদান আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করবো। নিচে রইলো অ্যাকাউন্ট ডিটেলস। নমস্কার জানবেন।

কোন কালচারে ভর দিয়ে মমতা জেতেন, বামের পালে ফেরে না হাওয়া' আলোচনায় - দেবরাজ কুমার

রাজনৈতিক সংস্কৃতির রূপান্তর: পশ্চিমবঙ্গ দেবরাজ কুমার

রাজনৈতিক হিংসা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নাগরিক অধিকারের সংকোচনের দীর্ঘ পর্ব শেষে ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের বুকে বামফ্রন্ট সরকারের প্রতিষ্ঠা একটি ঐতিহাসিক পর্বান্তর রূপেই ইতিহাসে চিহ্নিত। বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম লক্ষ্যই ছিল গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা।

“… শপথ গ্রহণের পর প্রথম বৈঠকেই বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা রাজনৈতিক আনুগত্য নির্বিশেষে সমস্ত (রাজনৈতিক) বন্দিকে মুক্তি দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। কংগ্রেসি আমলে অপহৃত গণতন্ত্র ও নাগরিক স্বাধীনতার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এই মুক্তি পাওয়া বন্দিদের ১৭০০ জন ছিলেন কংগ্রেস ও বিভিন্ন নকশালপন্থী গোষ্ঠীর নেতা ও কর্মী। … সরকারি কর্মচারীদের ওপর যেসব দমনমূলক নির্দেশাবলি ছিল, সেগুলিও প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো। বিনা বিচারে আটক, বিচারাধীন মামলা—সংবিধানের ৩১১ (২) (গ) ধারায় যে সব সরকারি কর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছিল, তাঁদের প্রাপ্য সমস্ত সুযোগ-সুবিধাসহ চাকরিতে পুনর্বহাল করা হলো। রাজনৈতিক কারণে বরখাস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ফিরিয়ে আনা হলো…… শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারকে এই সরকার প্রতিষ্ঠিত করে।সংগঠন গড়ার অধিকার দেওয়া হয় পুলিস কর্মীদের। … রাজ্যে পঞ্চায়েত ও পৌরসভাগুলিকেও সক্রিয় করে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হলো। দীর্ঘদিন ধরে এইসব স্বায়ত্বশাসিত সংস্থাগুলির নির্বাচন করা হয়নি। এগুলির ক্ষমতাও ছিল অত্যন্ত সীমিত। পঞ্চায়েত আইনকে সংশোধন করে ত্রিস্তর-পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলো। [জ্যোতি বসু, পৃষ্ঠা ৩৪৪-৩৪৫]” এই সব পরিবর্তনের সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে লক্ষণীয় রূপান্তর আসে। এক, অর্ধদশক ধরে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দমবন্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হয় বাঙলা। দুই, গণতান্ত্রিক সভা-সমাবেশ ও ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতির পরিসর বৃদ্ধি পায়। তিন, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘আমরা শুধু রাইটার্স বিল্ডিং থেকে সরকার চালাব না’। সরকারি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মধ্যে এই নীতি প্রতিফলিত হয়। পঞ্চায়েত ও পৌরসভার নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে সমাজের একেবারে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত নির্বাচনী রাজনীতির প্রসার ঘটে এবং সেই সূত্রে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ অনেক বৃদ্ধি পায়।

ছবি : গুগল

চার, ভাগচাষিদের উচ্ছেদ রোধের জন্য ‘অপারেশন বর্গা’–র পাশাপাশি খেতমজুরদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হয়; ভূমি সংস্কারের সূত্রে বড়ো বড়ো কৃষিজমির মালিকের অবলুপ্তি ঘটে। এইভাবে, সদ্যপ্রতিষ্ঠিত বামফ্রন্ট সরকারের শক্তির সামাজিক ভিত্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে ছোটো কৃষক, বর্গাদার ও নিম্নবর্গীয় কৃষকেরা। বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের যে-গ্রামেই যান, শুনতে পাবেন, সেইসব ‘পুরোনো’ দিনের কাহিনি, যখন জমিদার আর বড়োমানুষরা ছড়ি ঘোরাত, যখন গরিবরা আর্থিক উৎপীড়ন আর সামাজিক লাঞ্ছনার শিকার হতেন…’। [বামরাজ, পৃষ্ঠা ২-৩] ‘বামফ্রন্ট আমলে নিম্নবর্গীয়রা একধরনের সামাজিক মর্যাদা পেয়েছেন, যেটা তাঁদের আগে ছিল না’ – এ-কথা স্বীকার করেছেন বামফ্রন্টের ঘোর সমালোচক অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারও। [বামরাজ, পৃষ্ঠা ৪৮-৪৯]। উপরিউক্ত সদর্থক পরিবর্তনগুলির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে একটি ‘নেতিবাচক পরিবর্তন’-ও ক্রমে বামফ্রন্ট জমানার বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছিল। সেটি হল পার্টিতন্ত্রের প্রকোপ বৃদ্ধি ও ‘পার্টি সমাজ’-এর প্রতিষ্ঠা। [‘পার্টি সমাজ’-এর বৈশিষ্ট্য রূপে উল্লেখ করা হয় — ১) পার্টি ভিন্ন অন্য কোনো নাগরিক উদ্যোগ ও প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতি, ২) রাজনৈতিক পরিসরে জাতপাত, ধর্ম, জনগোষ্ঠী প্রভৃতি পরিচিতি-সত্তার উপেক্ষিত ভূমিকা, ৩) সংঘাত ও হিংসার চরিত্র দলীয়, ৪) সামাজিক জীবনে পার্টির ‘নৈতিক অভিভাবকত্ব’, ৫) পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় পার্টির চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ।] পার্থ চট্টোপাধ্যায় ব্যাখ্যা করে বলেছেন:

ছবি : গুগল

“১৯৭০-এর দশকে পশ্চিমবাংলায় দলীয় হানাহানির কথা অনেকের মনে থাকবে। তাতে প্রাণহানি হয়েছিল বিস্তর। দলাদলির হিংসার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। তখন দলতন্ত্র ছিল না, ছিল দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভেতরে গভীর অস্থিরতা। অর্থাৎ দল সেখানে কোনো পাকাপোক্ত শাসনপদ্ধতির অঙ্গ হয়ে ওঠে নি। সেটা ঘটল বামফ্রন্ট শাসনে। … বাম শাসনের গোড়ার দিকে ভূমি সংস্কার, পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং সাধারণভাবে গ্রামাঞ্চলে ভূস্বামীদের সামাজিক প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনের যে ঢেউ বয়ে গিয়েছিল, তাতে পশ্চিমবাংলার গ্রাম সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যায়। এই পরিবর্তন সাধারণভাবে প্রগতিশীল বলেই স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু তার ফলে চিরাচরিত যে প্রতিষ্ঠানগুলি গ্রামসমাজের দৈনন্দিন জীবন নিয়ন্ত্রিত করত,

ছবি : গুগল

অর্থাৎ জমিদার অথবা জাতি পঞ্চায়েত অথবা ধর্মীয় নেতা বা প্রতিষ্ঠান, সেগুলি খুব দ্রুত লোপ পেল, নয়তো ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ল। এই পরিবর্তনকেও নিশ্চয়ই প্রগতিশীল বলতে হয়, কারণ এইসব প্রতিষ্ঠানের সনাতন নিয়ন্ত্রণপদ্ধতি দাঁড়িয়ে ছিল সম্পত্তি কিংবা জাতপাত কিংবা পুরুষতন্ত্র কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠের শাসনাধিকারের ওপর। কিন্তু পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলি ভেঙে পড়ার পর সমাজ পরিচালনার জন্য নতুন কোন প্রতিষ্ঠান কি তৈরি হলো? দেখা গেল, একটি প্রতিষ্ঠানই সমস্ত নিয়ন্ত্রণক্ষমতা গ্রাস করেছে। সেটা হল পার্টি। স্কুল বলুন, ক্লাব বলুন, পুজো বলুন, যাত্রা-থিয়েটার বলুন, সব কিছু পরিচালনার দায়িত্ব নিল পার্টি। [জনপ্রতিনিধি, পৃষ্ঠা ১২-১৩]” পার্থ চট্টোপাধায় অবশ্য মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘পার্টি’ মানে তিনি সব সময় সি-পি-আই-এমকেই যে চিহ্নিত করছেন তা নয়, যে-পার্টির যেখানে আধিপত্য সেখানে তারাই এই পার্টিতন্ত্র তথা পার্টি-সমাজ কায়েম করেছে। তবে যেহেতু সিপিএম-এর শৃঙ্খলা ও সাংগঠনিক নির্দেশমূলক কাঠামোটি ছিল অন্যদের তুলনায় অধিকতর পটু,  তাই তাদের নিয়ন্ত্রণবাদী কাঠামোটি সবচেয়ে নিশ্ছিদ্র হয়েছে। আজ আমরা ফিরে-তাকিয়ে বুঝি, বামফ্রন্ট সরকারের ঘোষিত নীতি ‘ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ’ হওয়া সত্ত্বেও এবং বাম জমানায় নিয়মিতভাবে স্থানীয় নির্বাচনগুলি সম্পন্ন হলেও সমাজের প্রায় প্রতি ইঞ্চিতে পার্টিতন্ত্রের প্রসার যথার্থ গণতন্ত্রের বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। সরকার ও পার্টি সমার্থক হয়ে গিয়েছিল বাম আমলে; এমনকি এ-ও বলা যায়, লোকাল পার্টি অফিসই হয়ে উঠেছিল পঞ্চায়েত বা পৌরসভার বিকল্প প্রতিষ্ঠান। কমিউনিস্ট পার্টির এ-হেন সামাজিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণপদ্ধতিটির উৎস হিসেবে অনেকে লেনিনবাদী সাংগঠনিক পদ্ধতির মডেলটির কথা বলেন। কিন্তু লেনিনীয় মডেলটির উদ্ভব ঘটেছিল বিপ্লববাদী রণনীতির জরুরি প্রয়োজন থেকে। দীর্ঘ বামফ্রন্ট জমানায় দেখা গেল সেই বিপ্লববাদী রাজনৈতিক অনুশীলনের ধারাটি শুকিয়ে গেছে, কেবল পড়ে রয়েছে পার্টির শুষ্ক নিয়ন্ত্রণবাদী কাঠামোটি। এটাই অধঃপতিত পার্টিতন্ত্র। কমিউনিস্ট পার্টি আর বিপ্লব সম্পন্ন করার হাতিয়ার রূপে কাজ করল না, বরঞ্চ তা হয়ে উঠেছিল যাবতীয় সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত বিবাদের মীমাংসাকারী। এক্ষেত্রে ভোট-রাজনীতির নিজস্ব বিবেচনা ও সমর্থকগোষ্ঠীকে তুষ্ট করা প্রধান বিবেচ্য ছিল। কমিউনিস্ট

ছবি : গুগল

কর্মীদের আত্মত্যাগের দীর্ঘ ঐতিহ্য সত্ত্বেও একটানা ক্ষমতাভোগ পার্টির মধ্যে কায়েমি স্বার্থ ও আমলাতন্ত্রের প্রসার ঘটিয়েছিল। সরকারে থাকার দৌলতে এমন অঞ্চলেও পার্টির সাংগঠনিক প্রসার ঘটেছিল যেখানে বাম আন্দোলনের কোনো অতীত ঐতিহ্য ছিল না। শহর ও মফসসলে পার্টি সংগঠনের মজবুত ভিত্তি তৈরি হয়েছিল সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষক সমাজের মধ্যে, যা কমিউনিস্ট রাজনীতিকে শুধুমাত্র একটা ‘ভদ্রলোক’ চরিত্রই দেয়নি, তাদের মধ্যে একটি সুবিধাভোগী স্তরও তৈরি করেছিল। গ্রামাঞ্চলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পার্টি-নেতৃত্বের রাশ চলে গিয়েছিল ছোটো ও মধ্য কৃষকদের কিছু পরিবারের হাতে, যার ফলে ভূমিহীন কৃষক ও খেতমজুরদের স্বার্থগুলি অবহেলিত হতে শুরু করে। এইভাবে গরিব মানুষের মধ্যে বামফ্রন্টের সমর্থন-ভিত্তি ক্রমে আলগা হতে থাকে; তথাপি দীর্ঘদিন বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসীন থাকতে পেরেছিল গ্রহণযোগ্য বিকল্পের অভাবে। এটা ঠিকই, বামফ্রন্ট-বিরোধী ভোটের শতাংশ দীর্ঘ বাম জমানায় কোনোদিনই ৩৫ শতাংশের নিচে নামেনি, কিন্তু বিরোধী-রাজনীতি ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক ও বহুধাবিভক্ত, গ্রামাঞ্চলে তাদের সাংগঠনিক ভিত্তিও পাকাপোক্ত ছিল না। এ-ক্ষেত্রে একুশ শতকে একটা লক্ষণীয় রূপান্তর ঘটেছিল। পার্থ চট্টোপাধ্যায় ২০০৯-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন, রাজ্যস্তরে বামফ্রন্টের অপ্রতিহত প্রভাব সত্ত্বেও ২০০৩ সাল থেকে গ্রামস্তরে সিপিআইএম-এর গণভিত্তি ক্রমহ্রাসমান। ২০০৩-এ গ্রাম পঞ্চায়েতের এক-তৃতীয়াংশ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি কুক্ষিগত করেছিল; ২০০৮-এ অর্ধেকের বেশি বিরোধীদের হাতে চলে যায়। [বামরাজ, পৃষ্ঠা ৭] নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের জমি আন্দোলন এবং তা নিয়ে নাগরিক সমাজের শোরগোল ও মিডিয়ার নিরন্তর সিপিএম- বিরোধী প্রচার ক্রমহ্রাসমান বাম-সমর্থনের প্রক্রিয়াকেই শেষ আঘাত দিয়েছিল। তবে, প্রণব বর্ধন যথার্থই লিখেছেন, বামফ্রন্ট-বিরোধী সার্বিক গণ-অসন্তোষের ব্যাখ্যা শুধুমাত্র জমি অধিগ্রহণ-বিরোধী কৃষক অসন্তোষের মধ্যে খুঁজলে ভুল হবে, ‘এর আরও বড়ো কারণ হল, স্থানীয় জীবনযাপনের সমস্ত দিকের ওপর পার্টির সর্বময় উৎপীড়ক নিয়ন্ত্রণ যেভাবে বসেছিল তার বিরুদ্ধে ব্যাপক ও তীব্র অসন্তোষ’। (বামরাজ, পৃষ্ঠা ২৯)। এই ‘অসন্তোষ’ এতটাই ছিল যে রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে (যা এখন ‘জঙ্গলমহল’ নামে উল্লিখিত হচ্ছে) ‘মাওবাদী’ শক্তির হাতে প্রায় তিনশোর মতো বাম-কর্মীর মৃত্যুও পশ্চিমবঙ্গের গরিষ্ঠ মানুষের মনে বামেদের প্রতি সহানুভূতি জাগাতে পারেনি।

ছবি : গুগল

ফলস্বরূপ ২০১১ সালে রাজ্যে ‘পরিবর্তন’ ঘটল। নানা স্তরের মানুষের বিপুল সমর্থন নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙলার মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হলেন। বামফ্রন্ট সরকারের জমি অধিগ্রহণ নীতির বিরুদ্ধে কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলনে সরকার-বহির্ভূত বামপন্থী সংগঠনগুলিকে ও নাগরিক সমাজের বামমনোভাবাপন্ন একাংশের বুদ্ধিজীবীকে পাশে পেয়েছিলেন তিনি। জঙ্গলমহলে ও নন্দীগ্রামে মাওবাদী শক্তির সমর্থন ছিল তাঁর সঙ্গে। গরিব কৃষক, প্রান্তিক আদিবাসী, অসংগঠিত শ্রমিক, দলিত ও মুসলমান সমাজের ব্যাপক সমর্থন ছিল তাঁর পক্ষে। মমতা নিজেও ছিলেন অতি-সাধারণ পরিবারের মেয়ে; তাঁর জীবনযাপনের ধরন ও কথাবার্তার সঙ্গে পরিশীলিত ভদ্রলোক সত্তা বহুলাংশে খাপ খায় না। এই সব নানা কারণে কোনো কোনো বামপন্থী লেখক মমতার মধ্যে ‘ভদ্রলোক বামপন্থা’-র বিকল্প এক ‘সাবলটার্ন বামপন্থা’-র অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। এই ধরনের চিত্রায়ন কতখানি সঙ্গত, সেই আলোচনায় আসব। কিন্তু তার আগে মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র গরিব ও প্রান্তিক মানুষের সমর্থনই যে মমতার পক্ষে ছিল তা নয়, কমিউনিস্ট-বিরোধী দক্ষিণপন্থী শক্তির যথেচ্ছ সমর্থনও তিনি পেয়েছিলেন। জাতীয় কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টির মতো সর্বভারতীয় দল ছিল তাঁর দিকে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সূতিকাগার রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের অতি-প্রিয় চরিত্র ছিলেন তিনি এবং দীর্ঘ কমিউনিস্ট জমানার অবসান তাদের উল্লসিত করেছিল। দেশের বাইরেকার পুঁজিবাদী শক্তির উচ্ছ্বাসও ছিল চোখে পড়ার মতো। সমাজের তৃণমূল স্তরে বামেদের বিপ্লবী রাজনীতি পথভ্রষ্ট হয়েছিল নিশ্চয়, কিন্তু তাদের চিন্তায় ও তত্ত্বে রয়ে গিয়েছিল মার্কসবাদ-লেনিনবাদের উত্তরাধিকার—ভারতে অর্থনৈতিক উদারবাদ ও কর্পোরেট-নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির তারাই ছিল প্রধান সমালোচক। সুতরাং বামেদের ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত পশ্চিমবাংলা থেকে কমিউনিস্টদের উৎখাত করতে পারলে কর্পোরেট ও বৃহৎ পুঁজির মালিকদের পথের কাঁটা যে অনেকটাই নির্মূল হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বভাবতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই রাজনৈতিক পরিবর্তনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়েছিল এবং হিলারি ক্লিনটন নিজে এসেছিলেন দেখা করতে মমতার সঙ্গে। বি-বি-সি নিউস হেডলাইন করেছিল, “The world’s longest serving elected communist government has been voted out”। বস্তুত, মমতাকে বামপন্থী বা ডানপন্থী রূপে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করার পথে সবচেয়ে বড়ো অসুবিধা হল তাঁর রাজনীতিতে চিরকালই ভাবাদর্শের গুরুত্ব কম, মূলত ভাবাবেগ ও সুবিধা-মতো কৌশল গ্রহণই তাঁর রাজনীতির মূল অবলম্বন। এই কারণে বি- জে-পির মতো হিন্দুত্ববাদী শক্তির সহযোগী হতে তাঁর বাধেনি। লক্ষনীয়, বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে, এমনকি গুজরাটের ভয়ঙ্কর দাঙ্গারও পরে, যখন বি-জে-পির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে জনসমক্ষে ধরা পড়েছে, তখনও তাদের সঙ্গলাভ মমতার কাছে ‘লজ্জাজনক’ বিবেচিত হয়নি। কৌশল মতো কংগ্রেসের সমর্থনও তিনি নিয়েছেন। বস্তুত, প্রাক্‌-২০১১ পর্বে মমতার আপাত অসংলগ্ন রাজনীতির মধ্যে একটি মাত্র অভিন্ন ঐক্যসূত্রই আমরা লক্ষ করি—তা হল তীব্র থেকে তীব্রতম সিপিএম-বিরোধিতা। ২০১১-র পূর্ববর্তী মুহূর্তে যে-নব উপাদানটি যোগ হয়েছিল তা হল তিনি তাঁর সি-পি-এম-বিরোধিতায় কিছু বাম দল ও বাম সংগঠনকে পাশে পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু লক্ষ করে দেখবার যে, বামফ্রন্ট-বিরোধী বামপন্থী শক্তির সমর্থন (যার মধ্যে অসংসদীয় বামেরাও রয়েছে) তাঁর দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলির সঙ্গে দূরত্ববৃদ্ধির কারণ হয়নি। বলা যেতে পারে, অতি-বাম থেকে অতি দক্ষিণপন্থীদের সিপিএম-বিরোধী অভিযানে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এবং যেহেতু ইতিমধ্যে সিপিএম গরিব ও সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তাই গরিব ও প্রান্তিক মানুষের উদ্দীপিত সমর্থনও তাঁর সঙ্গে ছিল। রাজনৈতিক পালাবদল-পরবর্তী জমানায় শাসন-পদ্ধতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পূর্বতন আমলের কিছু ধারাবাহিকতা ও কিছু নতুন প্রবণতা যুক্ত হল। ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছিলেন দলতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সত্যিকারের গণতন্ত্রের সূচনা ঘটাবেন, কিন্তু তার তেমন লক্ষণ দেখা গেল না। পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য সমাজ-বিজ্ঞানীসুলভ অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করে ২০১১- তেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘পার্টি সমাজ’-এর আশু পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই ২০০৯ থেকে যে-সব পঞ্চায়েতে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছে সেখানেও দলতন্ত্রের একই ছবি। তাঁর ভাষায়, ‘অসংগঠিত ব্যবসা-বাণিজ্য এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির সামাজিক প্রতিপত্তির ফল হিসেবে আইন-বহির্ভূত রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, এমনকি বেআইনি বলপ্রয়োগের যে প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেছিলাম [মূল প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য], দলীয় ক্ষমতার সমীকরণ বদলালেও সেই প্রক্রিয়ার বদল হওয়ারও বিশেষ সম্ভাবনা নেই।‘ [বামরাজ, পৃষ্ঠা ১২] পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অনুমানই ঠিক হল, ২০১১-র পরবর্তী কালে দল-বহির্ভুত সাধারণ নাগরিকের ক্ষমতায়নের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। অথচ ‘দলহীন’ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও নাগরিক সমাজের আস্থা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ছিল। মুশকিল হল, সেই গণ-উদ্দীপনা ও নাগরিক আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হল না; রাজ্যে ‘পরিবর্তন’ এনে, নিজেদের সব অধিকার ও দাবি-দাওয়া একজন নেত্রীর সদিচ্ছা ও মহানুভবতার কাছে জিম্মা রেখে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ থেকে তারা আবার ফিরে গেল নিষ্ক্রিয় ‘উপভোক্তা’-র অবস্থানে। আর বুদ্ধিজীবীরা ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া ও সরকারি দাক্ষিণ্যের বিনিময়ে নতুন সরকারের স্তাবকে পরিণত হলেন। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াও নির্ভেজাল স্তুতির পথ বেছে নিল সরকারি বিজ্ঞাপনের আশায়। ফলে, ২০১১-র ‘পরিবর্তন’ গণতন্ত্রের বিকাশের পথে মাইল-ফলক হয়ে উঠতে পারল না। প্রায়োগিক স্তরে যতই বিকৃতি ঘটুক বামফ্রন্ট তত্ত্বগতভাবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নীতি মেনেছিল, কিছু সদর্থক আর্থসামাজিক পরিবর্তনেরও কারণ হয়েছিল; তৃণমূল কংগ্রেসের জমানায় তার বালাই নেই। এই জমানায় সব সিদ্ধান্তই একটি কেন্দ্র থেকে, নেত্রীর মস্তিষ্ক ও মর্জি থেকে নির্গত হয়। এই এককেন্দ্রিক কাঠামোটিতে যেটুকু বাত্যয় ও ফাঁকফোকর চোখে পড়ে তা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণজাত নয়, তা দল হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসের অগোছালো কাঠামোটির জন্যে। এই অগোছালো ভাব কখনও যেমন নৈরাজ্যের কারণ, নিয়ন্ত্রণহীন রাজনৈতিক হিংসার কারণ, তেমনই আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পার্টিতন্ত্রের ফাঁসটাও আলগা রাখে। তার সুফল স্থানবিশেষে স্থানীয় মানুষ ভোগ করে কিছুটা। লক্ষ করা যেতে পারে, বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বামকর্মী ও সংগঠনের প্রতি নয়া জমানা সদয় নয় মোটেই, তাদের প্রতি ‘কেউটে সাপের মতো’ ব্যবহারের নিদান হাঁকা হয়, কিংবা বলা হয় ‘আগামী পঞ্চাশ বছর চুপ’ করে থাকতে, মিথ্যা মামলায় তাদের ফাঁসানো হয়, কিন্তু সাধারণ নির্বিবাদী ‘অ-রাজনৈতিক’ মানুষকে কাছে টানতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ সরকার নিয়েছে। “গণতন্ত্র” মানে যদি সিদ্ধান্তগ্রহণে জনগণের অংশগ্রহণ বোঝায়, মানুষের ‘ক্ষমতায়ন’ মানে যদি স্বনির্ভর হয়ে দাঁড়ানো বোঝায়, তাহলে পরিবর্তন- উত্তর পশ্চিমবঙ্গ নিশ্চয় সেই প্রবণতার ধারে-কাছে নেই; কিন্তু দুর্নীতি, ‘কাটমানি’-র অভূতপূর্ব প্রসার সত্ত্বেও সরকারি সুযোগ-সুবিধা, পরিষেবা ও দাক্ষিণ্য সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে এই সরকারের সাফল্য আমাদের নজর এড়ায় না। [ফেসবুকে জনৈক শ্যামল মুখার্জির একটি বিশ্লেষণ এখানে উল্লেখ করি: “তৃণমূল কি তোলা তুলছে না? তোলা অবশ্যই তৃণমূল তুলছে। কিন্তু তা তো সংখ্যাগরিষ্ঠ গরীব মানুষের থেকে না। তুলছে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের কাছ হতে। হ্যাঁ, গরীবের কাছ থেকেও নিচ্ছে। কিন্তু কি ভাবে? ওই গরীব পরিবারের জন্য কোনো সরকারি স্কিম থেকে কুড়ি হাজারের ব্যবস্থা করে সেখান থেকে পাঁচ হাজার আত্মসাৎ করছে। তাতে তো ওই গরীব পরিবারটির কোন অসুবিধা হওয়ার কথা না।…প্রায় সবাই সরকার থেকে অল্পবিস্তর প্রত্যক্ষ সাহায্য পাচ্ছে। আগেও বাম সরকার দিত, এর থেকে বেশি দিত, কিন্তু সেটা পরোক্ষভাবে, যেমন ভর্তুকি, ফসলের সহায়ক মূল্য ইত্যাদি। সাইকেল বা অনুদানও দিত কিন্তু এইভাবে সকলকে না। ফলে মানুষ আমাদের দিকে (বামফন্টের দিকে) ফিরছে না।“] একদিকে সর্বময় নেত্রীর একনায়কসুলভ শাসন, অন্যদিকে দলীয় শৃঙখলার অভাব—এই দুইয়ের বৈপরীত্য কী-ভাবে নতুন জমানা মোকাবিলা করে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় ২০১১ সালের ওই লেখাটিতে। প্রশ্ন ছিল, সর্বময় নেত্রী কি তৃণমূল কংগ্রেসকে একটি আঁটোসাঁটো শৃঙ্খলাবদ্ধ পার্টিতে রূপান্তরের উদ্যোগ নেবেন, নাকি অন্য কোনো উপায় অবলম্বন করবেন? আমরা দেখলাম এ-ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নেত্রী সহজতর পথটি বেছে নিলেন। এই দুর্বলতা তিনি ঢেকে দেবার চেষ্টা করলেন আমলাতন্ত্রকে ব্যবহার করে—স্থানীয় ‘বিশৃঙ্খল’ নেতার থেকে একজন আমলাকে নিয়ন্ত্রণ করা যেহেতু সহজ। তৃণমূল জমানায় আমরা দেখব, বহু অঞ্চলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা পার্টি নয়, কিছু বিশ্বস্ত আমলাই হয়ে ওঠেন সর্বময় নেত্রীর নির্দেশের বাহন। কোনো কোনো জেলায় পুলিশ প্রশাসক তথা আধিকারিকের হাতেই স্থানীয় পার্টির মূল দায়িত্বভার ন্যস্ত করেন তিনি (২০১১-পরবর্তী কালে জঙ্গলমহলে বিশেষভাবে দেখা গিয়েছিল এই কৌশল)। বিরোধী রাজনৈতিক কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করতে পুলিশ প্রশাসনের ব্যবহারও সেই কৌশলের অঙ্গ। বস্তুত এই জায়গায় পূর্ববর্তী বাম জমানার সঙ্গে তৃণমূলের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রভেদটি লক্ষণীয়। অভিযোগ আছে, বহু অঞ্চলে বাম জমানাতেও স্থানীয় পার্টি-নেতৃত্ব স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করত বিরোধী রাজনীতিবিদদের কোণঠাসা করার উদ্দেশ্যে; তৃণমূল জমানায়ও পুলিশ প্রশাসন একই লক্ষ্যে নিয়োজিত, তবে স্থানীয় পার্টি-নেতৃত্বের বশংবদ হয়ে নয়, সর্বোচ্চ নেত্রীর সরাসরি আস্থায় বলীয়ান হয়ে। অর্থাৎ বাম জমানার মতো লোকাল পার্টি এ-ক্ষেত্রে প্রশাসন বা সরকারের স্থান নিচ্ছে না, বরং প্রশাসন বা সরকারই লোকাল পার্টি হয়ে উঠছে। তৃণমূল জমানার রাজনৈতিক জনসমাবেশের আর একটি নতুন প্রবণতা আইডেন্টিটি পলিটিক্স বা জাতি ও গোষ্ঠী ভাবাবেগকে ব্যবহার, বামফ্রন্ট জমানায় যেটি চাপা পড়ে ছিল বা উপেক্ষিত হয়েছিল। সুমন নাথ ই-পি-ডাব্লু পত্রিকাতে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বাঁকুড়ার আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে ক্ষেত্রসমীক্ষার ভিত্তিতে (২০০৮-২০১৪) তুলে ধরেছেন, জনসমর্থন লাভের লক্ষ্যে তৃণমূল কংগ্রেস কী-ভাবে সি-পি-এম-এর থেকে ভিন্ন ‘পন্থা’ অনুসরণ করেছে সেখানে। সিপিএম-এর কৌশলটি ছিল ‘পার্টি সমাজ’-এর কৌশল – আদিবাসী জনসমাজকে স্থানীয় পার্টি-নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল রাখা। অন্যদিকে টি-এম-সি (তৃণমূল কংগ্রেস)-র কৌশল হল–সাঁওতাল সমাজের চিরাচরিত থাকবন্দি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ব্যবহার করে আদিবাসী সমাজের আনুগত্যলাভ এবং সাঁওতালদের সাংস্কৃতিক উৎসবে ঢালাও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বন্দোবস্ত। ‘মাঝি’ বা গ্রাম-প্রধানেরা গ্রামসভাগুলির সভায় তৃণমূলকে সমর্থনের জন্যে মূলত চারটি যুক্তি উপস্থাপন করত। এক, তৃণমূল তাদের শিকার উৎসবে অর্থসাহায্য করবে এবং প্রত্যেকটি আদিবাসী নৃত্যগোষ্ঠী কলকাতার দুর্গোৎসবে অনুষ্ঠান করার সুযোগ পাবে; দুই, গ্রামবাসীদের পঞ্চায়েতের কাজে লোকাল পার্টির দ্বারস্থ হতে হবে না, ‘মাঝি’-রাই সরাসরি পঞ্চায়েতে তাদের কথা পৌঁছে দেবে; তিন, তৃণমূল কংগ্রেস আদিবাসীদের বিরুদ্ধে মাওবাদী সংশ্রবের ‘মিথ্যা’ মামলাগুলি প্রত্যাহার করে নেবে; চার, পুরোনো বি-পি-এল তালিকা সংশোধন করে নতুন তালিকা প্রস্তুত করা হবে। সুমন নাথ জানিয়েছেন, এই সব সভাগুলিতে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে আলোচিত হত আদিবাসী উৎসব উদযাপনের খুঁটিনাটি, এবং এমন আড়ম্বর ব্যাপ্তি ও উদ্দীপনার সঙ্গে এই উৎসব পালিত হতে শুরু করে যার দৃষ্টান্ত অতীতে ছিল না। বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থও উৎসব মেলা প্রভৃতির পিছনে ব্যয়িত হয়। [ই পি ডাব্লু, ভল্যুম ৫৩, সংখ্যা ২৮, ১৪ জুলাই ২০১৮] গোর্খা, রাজবংশী পরিচিতি-সত্তাকে তুষ্ট করার পথে একই ভাবে নতুন সরকার হেঁটেছে। নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনার বিপুল মতুয়া সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে মতুয়া মহাসংঘের ‘বড়ো মা’-কে পৃষ্ঠপোশকতা ও আনুগত্যের সম্পর্কে বেঁধেছেন মমতা এবং তার ফলে বিগত বছরগুলি মতুয়া ঠাকুরবাড়ি অভূতপূর্ব রাজনৈতিক দড়ি-টানাটানির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের মধ্যস্থতায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আনুগত্যকে চিরস্থায়ী করার অভিপ্রায়ে তাঁদের ভাতা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জমিয়ত উলেমা-ই-হিন্দের সভাপতি সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী ও ফুরফুরা শরীফের পিরজাদা ত্বহা সিদ্দিকিকে ‘তুষ্ট’ করেছেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভাবাবেগের কাছে আবেদন জানিয়েছেন একই ভাবে। রাজ্যের সমস্ত দুর্গাপুজোগুলিকে ৫০,০০০ টাকা অনুদানের মতো অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত নিতে তাঁকে দেখা গেছে। ‘পুরোহিত ভাতা’ চালু করেছেন। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, তৃণমূল কংগ্রেসের এই নীতিগত বাঁকের জন্যেই পশ্চিমবঙ্গে সর্বপ্রথম জাতপাত, ধর্মীয় ও অন্যান্য পরিচিতি-সত্তার রাজনীতি সামনের সারিতে এসে গেছে। কেউ কেউ এ-ও বলে থাকেন, রাজনীতির এই নয়া পরিভাষা ও বাঁক-বদলই ভারতীয় জনতা পার্টির হিন্দুত্ববাদী আইডেনটিটি পলিটিক্সের জমি তৈরি করে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে।[সজ্জন কুমার, দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৫ মে, ২০২১] বামেদের হঠিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বি-জে-পি-র উত্থান অবশ্য আরও গভীর ও বিস্তারিত বিশ্লেষণের দাবি করে। সেই আলোচনায় আপাতত ঢুকব না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে, মিছিল-জনসভার ভাষা-ব্যবহারে, গত দশ-বারো বছরে যে একটা রূপান্তর ঘটে গেছে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। রাজনীতি-অর্থনীতির বিশ্লেষণ, আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ ইত্যাদি এক সময় পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সভা-সমিতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল, এখন তার স্থান নিয়েছে এক অদ্ভুত ‘অ-রাজনীতি’—চপল ডি-জে নাচ, “খেলা হবে”- র মতো গান, চিত্রতারকাদের ’ইন্দ্রজাল’। জনসমর্থন লাভের কৌশল হিসেবে ধর্মীয় মন্ত্রপাঠ কিংবা হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদের নির্লজ্জ উচ্চারণ ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণার প্রকাশ্য উসকানি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। এখন রাজনীতির চর্চা ও অনুশীলনের মধ্যে সমাজ বদলের, আর্থসামাজিক পরিস্থিতির রূপান্তরের কোনো প্রতিশ্রুতি ও আশাবাদ জড়িত নেই। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে উগ্র ফ্যাসিস্ত জমানার পদধ্বনি আপাতত রুখে দেওয়া গেছে বটে, কিন্তু রাজনীতির ধরন ও কর্মসূচির বিদ্যমান ধারাটির বদল না ঘটলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে কতটা স্বস্তি পাওয়া যাবে তা নিয়ে চিন্তার অবকাশ তাই থেকেই যায়। 

সূত্রনির্দেশ

জ্যোতি বসু, যত দূর মনে পড়ে, এন-বি-এ, কলকাতা, ১৯৯৮

প্রাবৃট দাসমহাপাত্র, রাজেশ ভট্টাচার্য (সম্পা), বামরাজ তত্ত্ব ও চর্চায়, চর্চাপদ, কলকাতা,

২০১৩ পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জনপ্রতিনিধি, অনুষ্টুপ, কলকাতা, ২০১৩

Suman Nath, ‘Cultural Misrecognition’ and the Sustenance of Trinamool Congress in West Bengal’, Economic & Political weekly, Vol 53, issue no. 28, 14 July, 2018

Sajjan Kumar, ‘How TMC has eased BJP’s way in Bengal’, The Indian Express, May 15 May, 2021

ইতিহাসের অলিগলিতে কিভাবে কত মোড় ঘুরে আজকে বাঙালি-সংস্কৃতি, বুঝতে সাহায্য করলেন- জুলফিকার জিন্না

বাঙলা, বাঙালি, বাঙালিয়ানা

রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্রমবিকাশ

জুলফিকার জিন্না

(১) ‘ওরে বিহঙ্গ ওরে বিহঙ্গ মোর

এখনি অন্ধ বন্ধ করো না পাখা’
 

পৃথিবীর মানচিত্রে বাঙালি জাতিসত্ত্বার বয়স খুব বেশি নয়। বাংলা ভাষারই উদ্ভব হয়েছে মাত্র বারো’শ বছর আগে। এই বারো’শ বছরের মধ্যে ভাষাভিত্তিক একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাঙালিরা শিল্পে-সাহিত্যে-উৎসবে-পার্বণে-যাপনে-সংস্কৃতিতে যে নিজস্বতাকে সুচিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে সেটাকেই আমরা ‘বাঙালিয়ানা’ বলি। জ্ঞানতত্ত্বের সমৃদ্ধিতে দর্শনে-বিজ্ঞানে-ধর্মে-সমাজসংগঠণে যে স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হয়েছে সেটাকেই সমগ্রভাবে বাঙালির ‘রাজনৈতিক চেতনা’ বলা যেতে পারে। গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ‘মানুষ সমাজবদ্ধ জীব এবং রাজনৈতিক জীব’। আসলে মানুষের সমাজবদ্ধতা কিছু সামাজিক অনুশাসন মেনে চলে, এই অনুশাসনগুলিই সংশ্লিষ্ট সমাজের রাজনৈতিক অভিজ্ঞান, বস্তুত সেই কারণেই সমাজবদ্ধ মানুষমাত্রেই রাজনৈতিক প্রজাতি। সমাজে প্রাধান্যবিস্তারকারী রাজনৈতিক চেতনা মানবসভ্যতার বিকাশ এর সাথে সাথে শাসকের চিন্তাধারার মধ্যে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে এবং অনুশীলিত হয়েছে। পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা গেছে একটা দীর্ঘসময় পর্যন্ত সমাজশাসনের নিয়মগুলিকে শাসকেরা তাদের ধর্ম ও দর্শনচিন্তা দিয়ে সিদ্ধ করেছেন। শাসকের ইতিহাস প্রকৃত অর্থে বাহুবল ও বুদ্ধিবলের ইতিহাস। শাসকের শক্তিসামর্থ্যের থাকে দ্বিবিধ হাতিয়ার, এক-হননক্রীয়ার হাতিয়ার (মিলিট্যান্ট ওয়েপেন্স), দুই- ভাবাদর্শগত হাতিয়ার (আইডিওলজিক্যাল ওয়েপেন্স)। এই দুটি হাতিয়ার পরস্পরের পরিপূরক। একটি সর্বাধুনিক রাষ্ট্রের দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাই সেনাবাহিনীর বন্দুকের নল জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ দিয়ে সিদ্ধ করা থাকে। এই বাংলার রাজনৈতিক চেতনার বিবর্তনরেখাটিও বিভিন্ন কালপর্বের শাসকের বাহুবল তথা হননক্রীয়ার হাতিয়ার এবং বুদ্ধিবল তথা ভাবাদর্শের হাতিয়ার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। তবে এরই পাশাপাশি এই বৃহত্তর বঙ্গভূমিতে অন্ত্যজ এবং প্রান্তিক জনমানসের লৌকিক অনুভূতি রাজনৈতিক চেতনার নির্ধারক হিসেবে থেকে গেছে। লোকায়ত বাঙালির মানবিক দর্শনই তার রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তি। বস্তুত সেই কারণেই শাসকের ভাবাদর্শ রণাঙ্গণে প্রামাণ্য হলেও জনমানসের ভাবাদর্শ অচিন পাখির ডানার ছন্দেই মুক্তির বার্তা লিখেছে।

ছবি : অনুস্কা দত্ত

সুপ্রাচীন কাল থেকে অদ্যাবধি শাসকের মতাদর্শকে শাসিতের মতাদর্শে রূপান্তরের প্রক্রিয়াই সক্রিয় থেকেছে। এই বাংলাতে নানা শাসকের বিজয়-পরাজয়ের উত্থান-পতনের কুহেলিকায় সাধারণ প্রজার জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, তবু কোথাও যেন অন্তস্থিত লৌকিক চেতনার চিরন্তন উপাদান হিসেবে মানব-কল্যাণকামিতাই অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মত সজীব থেকেছে। বাঙালি সংস্কৃতির এটাই হচ্ছে অনন্য বৈশিষ্ট্য। আসলে হাজার হাজার বছর ধরে নানা নৃতাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর পারস্পরিক প্রভাব এবং সমন্বয়ের ফলে গড়ে উঠেছে বঙ্গীয় সংস্কৃতি। এই বাংলায় সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কলঙ্কময় ইতিহাস যেমন আছে, ঠিক তেমনি উদার মানবিক ভাব-আন্দোলনের ইতিহাসও আছে। একটু সতর্ক দৃষ্টিতে লক্ষ করলে এটা বোঝা যাবে যে, শরিয়তি মুসলমান এবং সনাতনী হিন্দুর যাবতীয় উপাচার এই বৃহত্তর বঙ্গভূমে (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ) বাইরে থেকে আরোপিত। হিন্দুধর্মের যাবতীয় গ্রন্থের মৌলিক শিকড় যেমন রয়েছে বৃহত্তর বঙ্গের বাইরে, ঠিক তেমনি মুসলমান ধর্মেরও প্রধান গ্রন্থগুলির( কোরাণ,হাদিস) শিকড় রয়েছে এই ভূগোলের বাইরে। সনাতনী হিন্দু ও শরিয়তি মুসলমানের ধর্মীয় সংস্কৃতির অভ্যাস এই বঙ্গে কিভাবে আরোপিত হলো তার তথ্যপ্রমাণ ইতিহাসে রয়েছে। এই বৃহত্তর ভূখন্ডে দুই প্রতিপক্ষীয় ধর্মীয় শাসকদের জয়-পরাজয়ের ইতিহাসের অবিমিশ্র রসায়নেই তথাকথিত “বাঙালি সংস্কৃতি”র উদ্ভব। আমরা জানি,কিভাবে ইতিহাসের পথ বেয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিজেতা, যেমন – মৌর্য(বৌদ্ধ), গুপ্ত(ব্রাহ্মণ্য), পাল(বৌদ্ধ), সেন(ব্রাহ্মণ্য), তুর্কি(মুসলিম), আফগান(মুসলিম), মুঘল(মুসলিম) একের পর এক এখানে এসে একে অপরকে হটিয়ে স্বীয়

ছবি : গুগল

বংশবিস্তারেই বহুবিধ জাতির সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে। মূলত বহিরাগত আর্য সংস্কৃতি ও ইসলামিক সংস্কৃতির ক্রম- আরোপন এই অঞ্চলের বিশেষ কৃষ্টির বৈশিষ্ট্য নির্মাণে সাহায্য করেছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই দুই সংস্কৃতিই বাইরে থেকে আগত৷ এই অঞ্চলে যারা মূলগতভাবে বাস করত তারা ছিল সেই অনাবিল,অকৃত্রিম ভূমিজ,অস্ট্রিক-দ্রাবিড়েরা। সাংস্কৃতিক রসায়নে এই অনার্য জাতির ভূমিকা অবিসংবাদী৷ এরা না থাকলে ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ও আগত মুসলিমদের সাংস্কৃতিক রসায়ন সম্ভব ছিল না। আসলে বাঙালি সংস্কৃতির ভূগর্ভস্থ রসের উৎসার বিস্তৃত অনার্যক্ষেত্র থেকে উঠে এসেছিল। প্রকৃত অর্থে বাঙালি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এই ভূখন্ডে হাজার হাজার বছরের পুরানো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে। একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, যে খাদ্যাভ্যাসের কারণে বাঙালিদের বলা হয় ‘ভেতো’ বাঙালি, সেই খাদ্যাভ্যাস কিন্তু আর্য-সংস্কৃতি থেকে আসে নি। আর্য অথবা মুসলমানরা এ দেশে ধান আনেন নি, ধানের চাষ এ অঞ্চলে আরম্ভ হয়েছিল অন্তত পাঁচ হাজার বছর আগে। পরে কখনো আর্য, কখনো সেন, কখনো তুর্কি, কখনো আফগান, কখনো মোগল এবং সবশেষে ইংরেজরা বঙ্গভূমি দখল করেছেন, তবু বাঙালিদের ভাত খাওয়ার অভ্যাসে পরিবর্তন হয়নি। ভাত বাঙ্গালীর একটি সাংস্কৃতিক ভিত্তি। বাঙালিরা কোনদিন কোন রেজিমেন্টেড ধর্মাদেশ দিয়ে পরিচালিত হয় নি। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি রেজিমেন্টেড ধর্মগুলির উৎপত্তি-স্থান থেকে বঙ্গভূমি বহু দূরে অবস্থিত ছিল, সেই কারণে এই সব ধর্মের কোনোটাই তার আদি এবং অকৃত্রিম রূপে এ অঞ্চলে পৌঁছায়নি। তদুপরি, এসব বহিরাগত ধর্মের সঙ্গে স্থানীয় ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আচারের সমন্বয় ঘটেছে। এভাবে বঙ্গদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন এবং ইসলাম ধর্ম তাদের মৌলিকত্ত্ব হারিয়ে বঙ্গীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মানবিক ধর্মে পরিণত হয়েছে। তাই এখানে সাম্প্রদায়িকতা শেষসত্য হিসেবে কোনদিনই প্রতিষ্ঠিত হয় নি।

ছবি : গুগল

(২) ‘আমি বাংলাকে ভালোবাসি

আমি তারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি’

বৃহত্তর বঙ্গভূমির জনজাতিদের ধর্মবিশ্বাস কোনদিনই কোন অটল স্থির প্রজ্ঞার উপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। আজ পর্যন্ত ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনাগুলিকে শাসকের পরিকল্পিত প্রয়াসের ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় নি। এই বাংলাভূমি ছিল সবচেয়ে বেশি মুসলমান শাসনের অধীন। কিন্তু সেই মুসলমানত্বের মতাদর্শ যতটা না আরব থেকে আমদানীকৃত কোরাণনির্ভর নির্দেশিকা ছিলো , তার চেয়ে বেশি ছিল ইরানি সংস্কৃতির মুক্তচিন্তার অনায়াস প্রতিফলন। এই প্রসঙ্গে বাঙালির দর্শনচেতনায় ইরানি সংস্কৃতির প্রভাব নিয়ে একটু আলোচনা দরকার। হজরত মহম্মদের পরবর্তী খলিফাদের শাসনকালে আরবরা যেসব দেশ জয় করেছিলেন, সেগুলির মধ্যে ইরানের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। মধ্যযুগের মুসলমান পন্ডিত, দার্শনিক, এবং শাস্ত্রবিদেরা অনেকেই ছিলেন ইরানি। এঁদের মধ্যে দু’একজনের নাম উল্লেখ করলেই ইরানি সভ্যতা ও সংস্কৃতির সম্যক পরিচয় পাওয়া যাবে। ইরানি সংস্কৃতির অন্যতম ব্যক্তিত্ত্বদের মধ্যে রয়েছেন, বীজগণিতের পিতা বলে পরিচিত অঙ্কশাস্ত্রবিদ আল-খওয়ারজমি(৭৮০-৮৫০), পৃথিবীর ইতিহাসে মহান চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত আল-রাজি (৮৫৪-৯২৫), ভারততত্ত্ববিদ দার্শনিক আল-বিরুনি (৯৭৩- ১০৫০), মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ ইবিন সিনা (৯৮০-১০৩৭), সর্ববিদ্যাবিশারদ কবি ওমর খৈয়াম (১০৫০-১১২৩), অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুফি কবি জালালউদ্দীন রুমি (১২০৭- ১২৭৩) প্রমুখ। সমগ্র ভারতবর্ষ তথা এই বাংলায় সুফিবাদের যে চর্চা অব্যাহত ছিল তা আসলে ছিলো ইরানি সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাব। ভারতে কাদিরিয়া এবং চিসতিয়া ঘরানার অনুসারীরাই ছিল সংখ্যাবহুল। এই দুই ঘরানার আদিগুরু যথাক্রমে আবদুল কাদির জিলানি এবং খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি। এঁরা দুইজনেই ছিলেন ইরানের মানুষ। বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (রাজত্বকাল ১৩৪২-১৩৫৭) ছিলেন জাতে ইরানি। তাঁর আগে বখতিয়ার খিলজির সময়ে যে দুইজন ইরানির বাংলায় পা পড়েছিলো তাঁরা হলেন, বাবা কোতোয়াল ইস্পাহানি এবং কাজি রুকনুদ্দিন সমরকান্দি। বোঝাই যাচ্ছে এঁরা ছিলেন কর্মসূত্রে কোতোয়াল এবং কাজি। পরবর্তিতেও সুলতানি ও মোঘল আমলেও অসংখ্যজন ইরানি বংশোদ্ভূত রাজকর্মচারী, কবি, ধর্মতাত্ত্বিক, সুফি এই বাংলায় এসেছেন। বাংলায় সুলতানি শাসনের প্রথমদিকে তিনজন প্রধান সুফি সেখ জালালউদ্দীন তব্রিজী,নূর কুতুব আলম, এবং শরফুদ্দীন আবু তওয়ামা এঁরা প্রত্যেককেই এসেছিলেন ইরান থেকেই। তেরো শতকের ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দীন যাঁর বই ‘তবাকত-ই-নাসিরি’ ছাড়া বাংলার মুসলমান শাসনের আদি-পর্বের ইতিহাস জানাই যেত না, তিনিও ইরানের মানুষ। আসলে এই বাংলার ইসলামে যে উদারনৈতিক চেহেরার সঙ্গে আমরা পরিচিত তা শরিয়ত নির্ভর আরবীয় সংস্কৃতি নয়, তা অনেকটাই সুফিনির্ভর ইরানীয় সংস্কৃতির ফসল। 

মধ্যযুগে সুফিবাদের মতো ভক্তিবাদী দর্শনেরও প্রসার ঘটে এই বাংলায়। হিন্দু সমাজে ভগবৎপ্রেম ও ভক্তিবাদ আশ্রিত বৈষ্ণবধর্ম বিদ্যমান থাকলেও সুফি মতবাদের উদার মানবপ্রেম ও সাম্যনীতির আদর্শ যুক্ত করে চৈতন্যদেব একে একটি নব্য ভাববাদী ধর্মমতের রূপ দেন। মধ্যযুগে বিভিন্ন বর্ণশ্রেণিতে বিভক্ত হিন্দু সমাজে চৈতন্যদেবের এই মতবাদ ছিল কল্পনাতীত। তখন সমাজের উচ্চ কোটিতে ছিল  ব্রাহ্মণ, আর নিম্ন কোটিতে  শূদ্র। ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অধিকারে আকাশ-পাতাল পার্থক্য ছিল। তুর্কি বিজয়ের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের কঠোরতা আরও বৃদ্ধি পায়। এইরকম অবস্থায় চৈতন্যদেব চণ্ডাল,  মুচি, ম্লেচ্ছ,  বৈশ্য,  কায়স্থ, ব্রাহ্মণ সকল বর্ণের মানুষকে কৃষ্ণের প্রেমমন্ত্রে ডাক দিয়ে ঐক্যসূত্রে বাঁধার চেষ্টা করেন। চৈতন্যদেব নিজের জীবনে অনুশীলন করে তবেই সেটাকে অন্যের কাছে অনুসরণযোগ্য করে তুলতেন। চৈতন্যভাগবতে আছে : নবদ্বীপে নগরভ্রমণ উপলক্ষে তিনি প্রথমে তন্তুবায়ের গৃহে যান এবং তার দান হিসেবে নববস্ত্র গ্রহণ করেন। পরে গোয়ালার ঘরে দধিদুগ্ধের মহাদান গ্রহণ করেন। এ ভাবে তিনি গন্ধবণিক, শঙ্খবণিক, মালাকার, তাম্বলী সকলের ঘরে গিয়ে তাদের আন্দোলনের শরিক করেন। তিনি যে জাতিভেদ মানতেন না এবং জাতিচ্যুত হওয়ার ভয়ও করতেন না, এ সব দৃষ্টান্তে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। শ্রীচৈতন্য জাতিভেদের কঠোরতা শিথিল করেন। তাঁর কাছে শাস্ত্রের চেয়ে মানুষের জীবনের মূল্য ছিল বেশি। তাঁর পরিকর-পার্ষদবর্গের মধ্যে ব্রাহ্মণ (রূপ গোস্বামী, সনাতন গোস্বামী,  জীব গোস্বামী),  বৈদ্য (মুরারি গুপ্ত, অদ্বৈত আচার্য), কায়স্থ (রঘুনাথ দাস, নরোত্তম দাস), যবন (হরিদাস), সুবর্ণবণিক (উদ্ধারণ দত্ত), সদগোপ (শ্যামানন্দ দাস) প্রভৃতি বর্ণ বা গোত্রের ব্যক্তিরা ছিলেন। তাঁর প্রেমভক্তিবাদে সমাজের সব স্তরের মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল। সে কালের বর্ণবাদী হিন্দু সমাজের প্রেক্ষাপটে বৈষ্ণবরা এ ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক চেতনার পরিচয় দেন। চৈতন্যদেব একদিকে যেমন বিরাজমান হিন্দু অভিজাতদের ম্লেচ্ছাচার রোধ করেন, অপরদিকে নামসঙ্কীর্তনের মাধ্যমে সর্বসাধারণকে নব্য প্রেমধর্মে সমান অধিকার দেন। এভাবে তিনি উচ্চ ও নিম্নবর্গকে অভিন্ন ধর্মাচরণ ও ভাবাদর্শে পরস্পরের সন্নিকটে এনে এক আত্মীয়ভাবাপন্ন উদার মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। চৈতন্যদেবের ভক্তিবাদের পথ ধরেই ক্রমে বৈষ্ণব, সহজিয়া, বাউল, কর্তাভজা ও সখীভাবকের মতো ধর্মীয় সম্প্রদায় আত্মপ্রকাশ করে। ধর্মসমন্বয়ের পথ বেয়েই পর সত্যপীর/সত্যনারায়ণ এবং দক্ষিণ রায়/বড় খান গাজীর মতো লৌকিক দেবতা নির্ভর সাহিত্য রচিত হয়। এই ধরণের সমন্বয়বাদী সাহিত্য বাঙালিত্বের ধারণাকে পরিপুষ্ট করছিলো। এ রকম এক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ ধর্ম এর আগে কখনও বঙ্গীয় সমাজে ছিল না।

ছবি : গুগল

(৩) ‘বাংলার মাটি বাংলার জল

বাংলার বায়ূ, বাংলার ফল …’

আজও এই বাংলায় নাম পরিচয়ে হিন্দু বা মুসলমান বলে চিহ্নিত হয়েও যাঁরা উদার মানবতাবাদের চর্চাকে যাপনের শর্ত করে তুলেছেন তাঁরা আসলে কেউ সনাতন-হিন্দু বা শরিয়তী-মুসলমানের বিধান মেনে চলেন না। ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখি, খোদ মক্কার বুকে হজরত মহম্মদ যখন খলিফার পদে আসীন হয়েছেন তখন বাংলা শাসন করছেন শশাঙ্ক। তখনও ইসলাম ধর্ম তার সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র চরিতার্থ করতে আরবের বাইরে বেরোতে পারে নি। আরবের বাইরে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটেছিল মহম্মদ পরবর্তী খলিফাদের সময়ে। তাই বলা যায়, এই বাংলার প্রাক-ইতিহাসে ইসলামিক প্রভাব ছিলো না। শশাঙ্কের মৃত্যুর পরবর্তী একশ বছর বাংলায় কোনো স্থায়ী শাসক ছিলো না বললেই চলে। সমগ্র দেশ অভ্যন্তরীণ কলহ- কোন্দলে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন এবং বৈদেশিক আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়েছে। এই অবস্থাটি ইতিহাসের পাতায় ‘মাৎস্যন্যায়’ নামে চিহ্নিত। জনগণের নির্বাচনে গোপাল রাজা নির্বাচিত হন। ইতিহাসের পাতায় তিনিই প্রথম গণতান্ত্রিক রাজা। এই গোপালের নামের সূত্র ধরেই পাল বংশের সূত্রপাত। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পালদের দীর্ঘ শাসন বাংলায় এক ধরনের উদার ধর্মীয় আবহ সৃষ্টি করে। পাল যুগের সামাজিক ও ধর্মীয় পরিমন্ডল সহিষ্ণুতা নীতি এবং পারস্পরিক সহ-অবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং এ মনোভাব বাংলার ইতিহাসে সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলে। শিল্পকলার ক্ষেত্রে বহুবিধ সাফল্যের জন্যও পালযুগ গুরুত্বপূর্ণ। বৌদ্ধ বিহারের স্থাপত্যরীতির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয় পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহারে। এ স্থাপত্যরীতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের পরবর্তী স্থাপত্য কাঠামোকে প্রভাবিত করে। বাংলার পোড়ামাটির ফলক শিল্প এ যুগে চরম উৎকর্ষ লাভ করে। পালদের  ভাস্কর্য শিল্প পূর্ব-ভারতীয় শিল্প রীতির একটা বিশেষ পর্যায় হিসেবে স্বীকৃত হয়। পাল যুগেই বাংলার ভাস্কররা তাদের শৈল্পিক প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হন। বলা বাহুল্য, এই বৌদ্ধধর্মের অনুসৃতিতেই বাংলার অবতলবাসী প্রান্ত্যজ মানুষের মধ্যে এক সহজিয়া জীবনদর্শন গড়ে উঠেছিল যার প্রকাশ আমরা চর্যাপদগুলিতে লক্ষ্য করি। এই সহজিয়া জীবনদর্শন মূলগতভাবে ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী এবং মাটির কাছাকাছি থাকা প্রাকৃতজনের সাধনসঞ্জাত। পরবর্তীতে বাংলার মাটিতে উজ্জীবিত সহজিয়া দর্শনের অভিনব পরিণমণ ঘটেছিল সুলতানি আমলের বাংলার সংস্কৃতিতে। ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিক থেকে চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই বৃহত্তর বঙ্গ আসলে দিল্লী সালতানাতের অধীনে ছিল। চতুর্দশ শতের মাঝামাঝি নাগাদ আফগান (পাঠান) সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারব শাহ্ বাংলার প্রায় সমস্ত অঞ্চল জয় করে খন্ড জনপদগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং এই ভূ-খন্ডে স্বাধীন সুলতানী যুগের সূচনা করেন। বাংলার স্বাধীন সুলতান “শাহী বাঙ্গালা” উপাধী ধারণ করেন। পরবর্তী প্রায় দুশ বছর এই পাঠান সুলতানরা রাজত্ব করেন। এই সব পাঠান সুলতানরা বহিরাগত হলেও এ দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন,কারণ তারা কেউই শরিয়তি ইসলামের চর্চা করতেন না। হুসেন শাহী আমলে বাংলার ভাবজগতে এক অভুতপূর্ব আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। একদিকে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের ফলে উত্তরিত ভক্তিবাদ ও অন্যদিকে মরমী সুফি সাধকদের দ্বারা প্রচারিত আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ বাংলার গোটা সমাজ জীবনকে উজ্জীবিত করে তুলেছিল। গোড়া পত্তন হয়েছিল এক নতুন সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতির যার নিদর্শন সমকালীন বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের নিজস্ব ধারার উৎসার ঘটেছিল এই সময়েই। সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘মহাভারত’ ও ‘ভগবদ গীতা’ প্রথমবারের মত সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়। বস্তুত এই সময়কাল থেকেই বাঙালির জীবনে এই উদার সমন্বয়ধর্মী মানবতাবাদী ধারা প্রবাহিত হতে শুরু করেছিল যার পরিচয় পাওয়া যায় সে কালের কতিপয় তথাকথিত নামপরিচয়ে হিন্দু বা মুসলমান কবিদের রচনায়।

“শুনহ মানুষ্ ভাই

সবার উপরে মানুষ সত্য,

তাহার উপরে নাই”

পনের শতকের বৈষ্ণব কবি চন্ডিদাসের এই অমর বানীতে যেমন আমরা মানবতাবাদের জয়গান শুনতে পাই তেমনি সাতের শতকের অন্যতম কবি আবদুল হাকিম রচিত ‘নূরনামা’য় এক উদার সমন্বয়ধর্মী মতাদর্শের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন,

“য়াল্লা(আল্লাহ) খোদা-গোঁসাই

সকল তান (তাঁর) নাম

সর্বগুনে নিরঞ্জন প্রভু গুনধাম।”

এইভাবেই বাঙালি সংস্কৃতির নিজস্ব ধারা নির্মিত হতে থাকে। এই বৃহত্তর বঙ্গের মানুষের জীবন ধারা ও সংস্কৃতির মধ্যে এমন কতকগুলি ইতিহাস লালিত দিক আছে যেগুলি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সাথে মেলে না। উনিশ শতকের মরমী সাধক ফকির লালন শাহ আসলে আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয়ের সবিশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হতে পারেন।লালনের জাত বিষয়ক শানিত চিন্তার কথা আজ সকলের জানা। জাত-পাত, উঁচু-নিচু, ইতর-ভদ্র, হিন্দু- মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান ইত্যাদি ভেদাভেদকে তিনি অতিক্রম করেছেন। এ সমস্ত ভেদাভেদের উর্ধ্বে উঠে তিনি একীভূত মানব সমাজের কল্পনা করেছেন। জাত-পাত কে তিনি একদমই থোড়াই কেয়ার করেছেন। তাই তো তিনি বলছেন- ‘জাত গেল জাত গেল বলে / একি আজব কারখানা/ সত্য কাজে কেউ নয় রাজি / সবই দেখি তানা নানা’। জাত-ধর্ম পরিচয়ের অসাড়তা প্রমাণের জন্য পাতার পর পাতা থিয়োরি লিখে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা যা করতে পারেন নি। সহজিয়া জীবনদর্শনের মধ্য দিয়ে তার চেয়ে অনেক প্রগাঢ় মানবতার অনুশীলনকে সহজ যাপনসাধ্য করে দিয়ে গেলেন লালন সাঁই।

(৪) ‘স্বদেশেরে চাও যদি তারো ঊর্দ্ধ্বে ওঠো/

কোর না দেশের কাছে মানুষেরে ছোটো’

 ইতিহাসের গতিপথেই একসময় এই বাঙলার প্রবেশতোরণ দিয়েই প্রবল প্রতাপশালী ইংরেজরা প্রবেশ করেন এবং এক দীর্ঘস্থায়ী উপনিবেশ গড়ে তুলে পাশ্চাত্য যুক্তিবোধের আলোকে আধুনিক রাষ্ট্রনীতির অনুশীলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। একটি জনপদের সুদীর্ঘ ইতিহাসের গতিপথে স্বদেশের প্রতি আবেগ এতকাল শুধু একটি  ভূগোলের মৃত্তিকা, জলবায়ূ ও নিসর্গনিষ্ঠ মানুষের যাপনবাস্তবতা দিয়েই নির্ধারিত হয়ে আসছিল। এই প্রথম  একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে স্বদেশপ্রেমের স্থানে জাতীয়তার বোধ প্রতিস্থাপিত হতে শুরু করলো। একদিকে ঔপনিবেশিক ইংরেজদের কার্যকলাপে সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি, আর অন্যদিকে তারই বিরোধীতায় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারণা আরোপিত হতে শুরু করলো এই ভূখন্ডের ভূমিলগ্ন মানুষের উপরে। ক্রমে ভারতবর্ষের অভিজাতবর্গের জাতীয়তাবাদি চেতনার আঘাতে এই বাংলার সংস্কৃতির মৌলিক উপাদানের জনক ভূমিসংলগ্ন প্রান্তিক মানুষের নিজস্ব চেতনা খর্বিত হলো। অনেকেই মনে করেন জাতীয়তাবাদি নেতাদের আদর্শ ও অনুপ্রেরণার স্পর্শ পেয়েই এই বাংলার লোকায়ত জনতার প্রকৃত রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হয়েছিলো। কিন্তু এটাই সর্বপ্রণিধাণযোগ্য প্রকৃত ঘটনা ছিলো না। একটি আধুনিক রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী চেতনার সাথে এই বাংলার ভূমিজ মানুষের স্বভূমিচেতনা ছিলো গুণগতভাবে পৃথক। তাই তথাকথিত বাংলাভাগের পরও দুই বাংলার মানুষের অনুভবময়তার জগতটি অভিন্ন থেকে গেছে। রাষ্ট্রতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের রথচক্রে পিষ্ট হয়েছে বাঙালির কোমল স্বভূমিচেতনা। রাষ্ট্রনির্ধারিত জাতীয়াতাবাদী নির্দেশিকার কবলেই আজ লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে স্বভূমিতেই বিদেশী হিসেবে চিহ্ণিত হয়ে রাষ্ট্রহীন নাগরিক হওয়ার যন্ত্রণার শিকার হতে হচ্ছে ৷ ইতিহাসের মর্মান্তিক গতিপথে বাঙলার নিজস্ব এলাকাকে কেটে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার কুটিল রাজনৈতিক চক্রান্তের ফলে বাঙালী আজ নিজভূমে পরবাসী হয়ে গেছে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে এবং আসামে এনআরসি-র ভয়ে মানুষ আত্মহত্যা করছেন, অথচ কত আগেই ঋত্বিক ঘটক প্রশ্ন তুলেছিলেন, “বাংলার আবার এপার 

ওপার কী?”
 

জুলফিকার জিন্না

বোলপুর, বীরভূম

নাটককার মোহিত চট্টোপাধ্যায় কে স্মরণ করলেন - ঋষা নাগ

মোহিত নাটকে মোহিত

ঋষা নাগ

“…..বিদেশি নাটককে বাংলার ঘরে আনা দোষের কিছু নয়। তাতে আমাদের নাট্যজগৎই সমৃদ্ধ হয়। তবে একটাও মৌলিক নাটকের দেখা নেই। শুধু নির্ভর করতে হবে বিদেশি নাটকের উপর? এ রকম অবস্থা লজ্জাজনক নয়? এই সময় মোহিত চট্টোপাধ্যায় একটার পর একটা নাটক লিখতে শুরু করে….” ( সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) ঠিক এখানেই একটা অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা নাটকের চিরন্তন বয়ে চলার একঘেয়েমি কৃতঋণ থেকে। বাংলা নাট্য জগতের সম্রাট মোহিত চট্টোপাধ্যায়, জন্ম ১৯৩৪ সালের ১ লা জুন বর্তমান বাংলাদেশের বরিশালে। বাবা নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও মা রেণুকা চট্টোপাধ্যায়। পূর্ববঙ্গের বরিশালেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সেখানকার ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে। এরপর সিটি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক হন। মা রেণুকা চট্টোপাধ্যায় কবিতা লিখতেন, তাই কবির ক্ষেত্রে লেখালেখির মূল অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর মা। ‘নাটক লেখার মধ্য দিয়েই একজন কবি আত্মপ্রকাশের সুযোগ পায়’ …. এই ধারণা অবলম্বন করেই তাঁর নাটক লেখার শুরু। মোহিত চট্টোপাধ্যায় প্রথম জীবনে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও, সার্থকতা লাভ করেন নাট্যকার হিসেবে। তাঁর রচিত নাটক গুলি ছিল স্বতন্ত্র ও অন্যরকম। তাঁর স্বরচিত নাটকগুলির মধ্যে নক্ষত্র, থিয়েটার ওয়াকার্স, থিয়েটার কমিউন, চুপকথা, রংরূপ, রঙ্গপট উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তৎকালীন বাংলা থিয়েটারের ছোট বড়ো সমগ্র দলে বিভিন্ন সময়ে নাটক দিয়ে সাহায্য করেছেন তিনি। কখনও থিয়েটারে অভিনয় করেননি বা নির্দেশনা দেননি। ১৯৬৩ সালে তাঁর লেখা প্রথম নাটক ‘কণ্ঠনালীতে সূর্য’। অন্যান্য নাটক গুলি হল ‘নীল রঙের ঘোড়া’, ‘মৃত্যুসংবাদ’, ‘গন্ধরাজের হাততালি’, ‘রাজরক্ত’, ‘গিনিপিগ’, ‘ভূত’, ‘তোতারাম’, ‘তখন বিকেল’, ‘নোনাজল’, ‘গুহাচিত্র’, ‘দাহ’ প্রভৃতি। এগুলি ছাড়াও তিনি আরও অনেক নাটক লিখেছেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন বিখ্যাত চিত্রনাট্যকার। তিনি বহু পুরস্কারে পুরস্কৃত হন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত পুরস্কার, নান্দীকার পুরস্কার, সত্যেন পুরস্কার, দীনবন্ধু পুরস্কার, সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কার প্রভৃতি। তিনি কৃত্তিবাসের নিয়মিত কবি ছিলেন, কবি হিসেবে তাঁর একটি নিদর্শন……

ছবি : গুগল

“বুকের ওপর একটা খবরের কাগজ পড়ে আছে 

লোকটি খবরের কাগজ চাপা পড়ে মরে যায়নি তো?

কাগজের চেয়ে খবরের ওজন কোটিগুণ ভারি!

অথচ গল্পের একটা ফল দেখুন

একটা কথা পর্যন্ত না বলে ধীরে ধীরে রসে ভরে ওঠে।

ভালোবাসা পেলেই না সুন্দর সহজ হাঁটা

ইচ্ছা সুখের ছায়া পড়বে….”

মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের নাট্য প্রযোজনা শুধু কলকাতার মধ্যেই নয় , সারা পশ্চিমবঙ্গ ব্যাপী পরিসর ছিল। হাওড়া থেকে শুধু করে বাঁকুড়া, বীরভূম, কোচবিহার, উত্তর চব্বিশ পরগণা তো বটেই ; পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও দিল্লী, মুম্বাই, বিহার, বাংলাদেশেও তাঁর গ্রুপ থিয়েটার স্বনামধন্য ছিল। তিনি শুধু কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারের নয়, বাংলার ও বহিঃবাংলার বিভিন্ন গ্রাম-শহরের নাট্যকার। ১৯৬০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন ১৫০ টিরও বেশি নাট্যদল। তাঁর নিজস্ব কোনো নাট্যদল ছিল না। নাটকের দৈর্ঘ্য স্বল্প, সমাজের বিভিন্ন অনাচার, অত্যাচার, মিথ্যাচার ধরা পড়ত তাঁর নাটকে। মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের নাটক যেমন জনপ্রিয়তা পেল, পাশাপাশি নাট্যপ্রেমী তরুণ প্রজন্মের ওপর তাঁর আধিপত্য বিস্তার হতে শুরু করেছিল দুরন্তক্রমে। সাহিত্য নিয়ে সিটি কলেজে পড়াশোনার সময়েই তরুণ কবি হিসেবে সাড়া ফেলেছিলেন মোহিত চট্টোপাধ্যায়। পরবর্তীকালে ঝুঁকে পড়লেন নাটকের দিকে, তারপর কবিতার বদলে নাটকই হয়ে উঠল তাঁর ভাবপ্রকাশের স্বচ্ছন্দ হাতিয়ার। পেশায় তিনি ছিলেন অধ্যাপক। অ্যাবসার্ড নাটকের ধারায় এক নতুন মাত্রা যোগ করলেন। বহু পূর্ণাঙ্গ নাটক, অনেকগুলো একাঙ্কিকার পাশাপাশি ছিলেন টিভি ধারাবাহিক এবং চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনাতেও সিদ্ধহস্ত। ‘রাজরক্ত’, ‘মৃচ্ছকটিক’, ‘মহাকালীর বাচ্চা’, ‘গ্যালিলিওর জীবন’, ‘অক্টোপাশ লিমিটেড’, ‘জোছনাকুমারি’, ‘মুষ্টিযোগ’, ‘হারুন উল রশিদ’-এর মতো নাটক, ‘পরশুরাম’, ‘ওকা উরি কথা’, ‘জেনেসিস’-এর মতো চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট তারই সৃষ্টি। তিনি নাটকের জগতে আসার আগে বাংলা থিয়েটারে নাটকের মঞ্চায়ন খুব কম হত। বেশিরভাগই ছিল বিদেশি নাটকের ভাবানুবাদ। প্রচুর মঞ্চসফল মৌলিক নাটক লিখে বাংলা থিয়েটারকে বিদেশি নাটকের ওপর নির্ভরতা থেকে বের করে আনলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের নাম প্রথম সারিতেই থাকবে। তার নাটকের রহস্যপূর্ণ প্রকৃতি, সমালোচকদের তার নাটকগুলিকে বাংলায় “কিমিতিবাদী” (কিম + ইতি) বলে ডাকতে উৎসাহিত করেছিল, যার অর্থ, “এটি কী?” পূর্ণ দৈর্ঘ্য নাটক ছাড়া অন্য, মোহিত চট্টোপাধ্যায় একাঙ্ক নাটক, কাব্য নাটক, নাটিকা (ক্ষুদ্র নাটক) রচনা করেছেন; তিনি অন্যান্য ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় বেশ কয়েকটি নাটক উপযোগী করেছেন, সম্পাদনা করেছেন এবং অনুবাদ করেছেন। তার রাজরক্ত (গিনি পিগ) নাটকটি বাংলা রাজনৈতিক নাটকের ইতিহাসের মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত। বিভাস চক্রবর্তীর পরিচালনায় কলকাতাভিত্তিক থিয়েটার দল থিয়েটার ওয়ার্কশপে প্রথম কলকাতায় এই নাটকটি উপস্থাপিত করেছিল। পরে নাটকটি ভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। দিল্লিতে রাজিন্দরনাথের হিন্দি সংস্করণটি পরিচালনা করেছিলেন; বিখ্যাত অভিনেতা কুলভূষণ খারবান্দা নাটকটিতে অভিনয় করেছিলেন। মুম্বাইয়ে সত্যদেব দুবে নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন এবং অমরেশ পুরী এতে অভিনয় করেছিলেন। অমল পালেকর মারাঠি সংস্করণে অভিনয় করেছিলেন এবং শ্যামানন্দ জলান নাটকটির আর একটি হিন্দি সংস্করণ তৈরি করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে মোহিত চট্টোপাধ্যায় মৃণাল সেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় কোরাস ছবির চিত্রনাট্যের কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি ছবিতে ব্যবহৃত গানের কথাও লিখেছিলেন। পরের বছরগুলিতে তিনি মৃণাল সেনের চারটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন, সেগুলি হল মৃগয়া (১৯৭৬) পরশুরাম (১৯৮০), ওকা উরি কথা (১৯৭৭), জেনেসিস (১৯৮৬)। এই সমস্ত চলচ্চিত্র জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছিল। ১৯৯৭ সালে তিনি দামু চিত্রনাট্য এবং গানের কথা লিখেছিলেন, যা শিশুদের সেরা চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় পুরস্কার এবং অন্যান্য পুরস্কার পেয়েছিল।১৯৮০ সালে মোহিত চট্টোপাধ্যায় তার প্রথম এবং একমাত্র শিশুদের চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন, যেটি ছিল মেঘের খেলা। পরবর্তীকালে তিনি টেলিভিশনেরও বহু জনপ্রিয় ধারাবাহিকেরও চিত্রনাট্য লিখেছেন। আজ মোহিতবাবুর ৮৭ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে তাঁর নাটক রচনায়, শৈলীতে, পরিবর্তনে, বিস্তারে ও প্রভাবে সর্বজনীন ছায়া দৃশ্যমান। ১৯৩৪ এর ১লা জুন যে নাট্যপ্রাণ মহীরুহের জন্মলগ্ন ঘোষিত হয়েছিল, তাঁর নাট্য আবেদনের শাখা-প্রশাখার ঝুরি আজও শেখার শক্ত ধাপ হিসেবে, আশ্রয়শিল্পের ছায়াংশের অভিভাবক। মোড়ঘোরানো যুগান্তরকারী বা নাটকীয় বির্বতনের সাক্ষী নাট্যসাহিত্য হয়েছিল তাঁর হাত ধরে। বাংলার নাটকের ভান্ডারে নিজস্ব মণিমুক্ত জমা করে তাকে অনুবাদমুক্ত করেন, পরবর্তীতে বাংলার নিজস্ব নাটককে বহুবিধ ভাষার মজ্জায় অনূদিত হতে বাধ্য করেন, এখানেই আর্বতনের বির্বতন। তাই আজও সবাই এই সাতাশি তম কালক্ষণের পুনরাবৃত্তিতে মোহিত নাটকেই মোহিত…..

নেটফ্লিক্সে "দ্য হোয়াইট টাইগার" এ সাদা বাঘ ও আদর্শের উত্থান দেখলেন - অজন্তা সিনহা

সাদা বাঘ ও আদর্শের উত্থান

অজন্তা সিনহা

শেষ পর্যন্ত পুরস্কারটা না পেলেও বাফতা (ব্রিটিশ একাডেমি ফিল্ম এওয়ার্ডস)-য় সেরা অভিনেতা ক্যাটাগরিতে তাঁর নমিনেটেড হওয়াটাই আদর্শ গৌরবের জন্য যথেষ্ট বড় ব্যাপার ছিল। বলা বাহুল্য আমাদেরও। এই তালিকায় আদর্শের সঙ্গে ছিলেন হলিউডের কিংবদন্তী অভিনেতা এন্থনি হপকিন্স ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক খ্যাত অভিনেতা। আদর্শের কথায়, “;এটা কি পুরস্কারের চেয়ে কোনও অংশে কম?”; বস্তুত, “দ্য হোয়াইট টাইগার” ছবিতে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, রাজকুমার রাওয়ের মতো তারকা বা মহেশ মঞ্জরেকরের মতো প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা থাকা সত্ত্বেও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিনে আদর্শকেই “স্টার অফ দ্য শো” বলা হয়েছে।

ছবি : গুগল

বলতে দ্বিধা নেই নেটফ্লিক্স-এ ছবিটি দেখার আগে পর্যন্ত আদর্শকে আমিও সেভাবে চিনতাম না। কিন্তু “দ্য হোয়াইট টাইগার”-এর বলরাম হালুই থুড়ি আদর্শকে দেখে যাকে বলে বাকশক্তিরহিত হয়ে পড়ার মতো অবস্থা হলো আমার। স্বীকার করে নিতেই হলো এই তরুণই মনোজ বাজপেয়ী, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি, রাজপাল যাদব, রাজকুমার রাওয়ের যথার্থ উত্তরসূরি। তাঁকে নিয়ে বিস্তারে যাওয়ার আগে “দ্য হোয়াইট টাইগার” নিয়ে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য। বাফতা ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি উৎসবে জায়গা করে নিয়েছে এই ছবি। বিশেষভাবে বলার একাডেমি এওয়ার্ড অর্থাৎ অস্কারে এ ছবির সেরা স্ক্রিনপ্লের (Adopted ) রূপকার হিসেবে “দ্য হোয়াইট টাইগার”-এর প্রযোজক ও পরিচালক রামিন বাহরানির নমিনেশন পাওয়া। প্রসঙ্গত, ২০০৮”র বেস্টসেলার অরবিন্দ আদিগা”র “দ্য হোয়াইট টাইগার” সিলভার স্ক্রিনে আনবার জন্য দশ বছর অপেক্ষা করতে হয় রামিনকে। বইটি প্রকাশের লগ্ন থেকেই একে নিয়ে সিনেমা তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন রামিন। বলা বাহুল্য, তাঁর অপেক্ষা একেবারেই ব্যর্থ হয়নি।

ছবি : গুগল

প্রসঙ্গত, এ ছবির কার্যনির্বাহী প্রযোজক প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। এই জাতীয় সোশ্যাল স্যাটায়ার নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেকটাই বাড়তি মেধা ও পারদর্শিতা প্রয়োজন। তার থেকেও বোধহয় জরুরি আন্তরিক সদিচ্ছা। সেই জায়গাটার জন্য নিঃসন্দেহে কুর্নিশ পাবেন প্রিয়াঙ্কা। ২০২১-এর ৬ জানুয়ারি লাস ভেগাসে “দ্য হোয়াইট টাইগার”-এর প্রিমিয়ার হয়। ১৩ জানুয়ারি আমেরিকার অল্প কয়েকটি মুভি থিয়েটারে এ ছবি দেখানো হয়। শেষে ২২ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক স্তরে “দ্য হোয়াইট টাইগার”-এর স্ট্রিমিং হয় নেটফ্লিক্স-এর পর্দায়। এক তরুণের ফুটপাত থেকে রাজপ্রাসাদে পৌঁছনোর এই কাহিনীর পরতে পরতে রয়েছে সাদা-কালো-ধূসরের বহুমাত্রিক অভিমুখ। আর এইসবের কেন্দ্রে যে, সেই বলরাম হালুয়াইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেই আদর্শ গৌরব রাতারাতি ঝড় তুলে দিয়েছেন ওয়েব দর্শকের হৃদয়ে। একটি অসাধারণ, পূর্ণাঙ্গ সিনেমা হওয়া সত্ত্বেও সিনেমা হল বা মাল্টিপ্লেক্স নয়, আদর্শের এই গৌরবময় বিচরণ যে ওয়েব দুনিয়ায় হলো, তা নিতান্তই প্যান্ডামিক পরিস্থিতির কারণে। নাহলে, হলের দর্শক যে প্রবল আবেগ ও উন্মাদনায় নবীন প্রজন্মের এই অনুপম প্রতিভাকে বরণ করে নিত, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। জামসেদপুরে ১৯৯৪ সালে জন্ম আদর্শ গৌরবের। প্রথম প্রেম ছিল শাস্ত্রীয় সংগীত। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তাঁর সংগীত শিক্ষা শুরু। পরিবারে গানের চর্চা ছিল। ঠাকুমা ভালো গাইতেন। বাবাও ভালোবাসতেন গানবাজনা।

ছবি : গুগল

পরিবারের উৎসাহ ও গুরু চন্দ্রকান্ত আপ্তের ট্রেনিংয়ে এই প্রতিভাধর কিশোর খুব তাড়াতাড়ি স্থানীয় সংগীত অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতাগুলিতে শ্রোতাদের নজর কেড়ে নিতে লাগলেন। ঝাড়খন্ড আইডল-এর ফাইনালিস্ট (২০০৫) আদর্শ ভবিষ্যতে একজন নামী কণ্ঠশিল্পী হবেন এটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু খ্যাত হলেন অভিনেতা হিসেবে। এ প্রসঙ্গে দু”টি কথা। এক, গান তিনি ছাড়েননি। পুরোদমে চর্চায় রয়েছেন এখনও। দুই, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আদর্শ সংগীতের পাশাপাশি থিয়েটার চর্চাতেও পা রাখেন যথাসময়ে। অর্থাৎ গান ও অভিনয় দু”টি জগতেই নিজের প্রতিভা, গুণ, দক্ষতা,একাগ্রতার মাধ্যমে একদিন জায়গা করে নেবেন তিনি,সেই পরিক্রমার প্রস্তাবনা শুরু হয়ে যায় শৈশবেই। এবার সেই যাত্রাপথের আনন্দগান। সাল ২০০৭। বাবা কর্মসূত্রে মুম্বই বদলি হলেন। পরিবারের সঙ্গে আদর্শও এলেন মুম্বই। ওই বছরই দক্ষিণ মুম্বইয়ের বিখ্যাত কালা ঘোড়া আর্ট ফেস্টিভ্যালে সংগীত পরিবেশন কালে সংশ্লিষ্ট শিল্পবোদ্ধা মানুষজনের নজরে পড়েন আদর্শ। সেখানেই প্রথম তাঁকে বলা হয়, অভিনয়ক্ষেত্রেও নিজের প্রতিভা বিকাশের চেষ্টা করে দেখতে পারেন তিনি। সংগীত পরিবেশনকালে এমন কি দেখা গেছে তাঁর মধ্যে,যেখানে তাঁর অভিনয় প্রতিভার ঝলক ছিল, তা বলতে পারবেন উপস্থিত রসিকজন। আমরা এটাই বলবো, তাঁদের চোখ ভুল দেখেনি। নিতান্তই তরুণ আদর্শ সঙ্গে সঙ্গেই রাজি ! আগ্রহের কারণ, টিভিতে দেখা যাবে তাঁকে। যাই হোক, তাঁর অভিনয় জয়যাত্রার সূচনাপর্বটি ছিল এমনই মজাদার ! এরপর “মাই নেম ইজ খান”-এ শাহরুখের ছোটবেলার চরিত্রে কাজ করা ও স্কুলে পড়াকালীন মঞ্চে অভিনয়— সবই প্রায় একইসঙ্গে ঘটছিল আদর্শের জীবনে। তারপর মুম্বইয়ের মিঠিভাই কলেজে ভর্তি হওয়ার পর সেখানকার ড্রামা টিমের সদস্য হলেন আদর্শ। সংগীত তখনও সঙ্গেই আছে তাঁর। এইসময়ই এক এজেন্ট তথা কাস্টিং ডিরেক্টরের মাধ্যমে যোগাযোগ রায়েল পদমসির সঙ্গে। তাঁকে রায়েলের কাছে পোর্টফোলিও পাঠাতে বলেন ওই এজেন্ট। এভাবেই খুলে গেল আর একটি দরজা। রায়েলের থিয়েটার কোম্পানির বিভিন্ন প্রযোজনায় গান গাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ছবিতেও প্লে ব্যাকে সুযোগ পেলেন আদর্শ। কারণ, ততদিনে প্লেব্যাকের জন্যও তৈরি তিনি। একটি বড় মাপের মিউজিক রিয়ালিটি শোয়ের সৌজন্যে সুরেশ ওয়াটকরের মতো গুণী শিল্পী ও গুরুর সান্নিধ্য পেয়েছেন আদর্শ। সেইসূত্রেই প্লেব্যাক গাইলেন “ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট”, “চল চলে”-র মতো ছবিতে।

ছবি : গুগল

আদর্শের অভিনয়ে পাকাপাকি আসাটা ঘটলো জন আব্রাহাম এন্টারটেইনমেন্ট প্রযোজিত “ব্যানানা” ছবিতে। পরিচালনা সাজিদ আলি। এ ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে সুযোগ পান তিনি। এরপর অনুরাগ কাশ্যপের শর্ট ফিল্ম “ক্লিন শেভেন”-এ, এখানে তাঁর বিপরীতে ছিলেন রাধিকা আপ্তে। পরের কাজ অতনু মুখার্জির “রুখ” ছবিতে মুখ্য চরিত্রে, মনোজ বাজপেয়ীর সঙ্গে। এরপর থ্রিলার ছবি “মম”, কাজ করলেন শ্রীদেবীর মতো তারকার পাশে। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, শুরু থেকেই আদর্শের কেরিয়ারগ্রাফ ছিল বেশ ব্যতিক্রমী। একদিকে তাঁর বহুমুখী প্রতিভা। অন্যদিকে বারবার তাঁকে খুঁজে নিচ্ছিলেন মঞ্চ ও পর্দার গুণী ও বোদ্ধা নির্মাতাগণ। আর এভাবেই আদর্শের “দ্য হোয়াইট টাইগার” থুড়ি বলরাম হালুয়াই হয়ে ওঠা। আদর্শ গৌরবের অভিনয় প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উঠে আসে থিয়েটারের কথা। তাঁর পেশাদারি জীবনে সুযোগগুলি আসছিল। তিনি কাজও করছিলেন। কিন্তু এরই সঙ্গে নিজের অভিনয়ের উৎকর্ষতা বৃদ্ধির দিকেও লক্ষ্য ছিল তাঁর। ২০১৬”তে কিছুদিন সব কাজ বন্ধ রেখে এইজন্যই তিনি ভর্তি হন মুম্বইয়ের বিখ্যাত অভিনয় শিক্ষাকেন্দ্র ড্রামা স্কুল মুম্বই-এ। এখানকার শিক্ষা শেষ করে আদর্শ আমাজন প্রোডাকশনের “ডাই ট্রাইং”

ছবি : গুগল

ও টিভিএফ প্রোডাকশনের “হোস্টেল ডেজ”-এ কাজ করেন। তবে, ২০১৮-য় দীপা মেহতার নেটফ্লিক্স সিরিজ একাডেমি নমিনি “লীলা”-য় অভিনয় আদর্শের গ্রহণযোগ্যতা যে অনেকটা বাড়িয়ে দেয়, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তাঁর জন্মগত সঙ্গীত প্রতিভা ও নাটকের শিক্ষা তারুণ্যের শুরুতেই অভিনেতা হিসেবে একটি ব্যতিক্রমী স্থান দিয়েছে আদর্শকে। বলিউডের ভিন্নধারার অভিনেতাদের সঙ্গে এখনই উচ্চারিত হচ্ছে তাঁর নাম। আর “দ্য হোয়াইট টাইগার” আদর্শকে দিয়েছে আন্তর্জাতিক পরিচিতি। এখনও পর্যন্ত যতদূর দেখা গেছে, নিজেকে চূড়ান্ত বিকশিত করার ক্ষেত্রে এতটুকু সমঝোতা করছেন না তিনি। শোনা যায়, বলরামের চরিত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার তাগিদে একমাস একটি চায়ের দোকানে নিজের পরিচয় গোপন রেখে কাজ করেন আদর্শ। এ ছবিতে তাঁর রিয়ালিস্টিক অভিনয় আন্তর্জাতিক স্তরে নজর কেড়েছে এভাবেই। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে এই তরুণ যে আরও চমকে দেওয়ার মতো কাজ করবেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

শিব ও এবং তার তাণ্ডব নৃত্য নিয়ে বিস্তারিত কথা পাড়লেন - শ্রীপর্ণা ভট্টাচার্য

শ্রীপর্ণা ভট্টাচার্য

নটরাজ ও তাণ্ডব নৃত্য

ছবি : গুগল

ভারতীয় নৃত্যে নটরাজ শিবকে নৃত্যের স্রষ্টা বলা হয়। তিনি মহাজাগতিক নৃত্যের স্রষ্টা, সনাতন শক্তির উৎস। পঞ্চক্রিয়ায় তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছেন। এই পঞ্চক্রিয়া হল- সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, তিরোধাম ও অনুগ্রহ । পঞ্চক্রিয়ার অধিদেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, মহেশ্বর ও সদাশিব।

“আঙ্গিকং ভুবনং যস্য বাচিকং সর্ববাত্মায়ম্।

আহার্ঘং চন্দ্রতারাদি ত্বং নমঃ সাত্তিকং শিবম্”।। 

অর্থাৎ, এই ভুবন তাঁর অঙ্গ। তাঁর মুখ নিসৃত ওঁঙ্কার ধব্বনি সমগ্র জগতের শব্দ সৃষ্টির মূলে। চন্দ্র-তারা তাঁর অলঙ্কার ।সেই ত্রিকালজ্ঞ সাত্ত্বিক শিবকে জানাই প্রণাম।নটরাজ বেশে শিবের মূর্তি অত্যন্ত জনপ্রিয়। ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে প্রাচীনকাল থেকেই নটরাজ মূর্তি কল্পনায় একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। কথিত আছে নৃত্য ও সঙ্গীত শিবের সৃষ্টি। তিনিই নৃত্যকলার প্রর্বতক। পৌরাণিক যুগ থেকেই নৃত্য ও সঙ্গীতের সঙ্গে শিবেযোগ বিদ্যমান। এই শিব অর্থাৎ নটরাজ সৃষ্টি ও ধ্বংসের দেবতা । তিনি রজঃ গুনে সৃষ্টি করেন, সত্ত্ব গুনে পালন করেন এবং তমঃ গুনে ধ্বংস করেন।

ছবি : গুগল

নটরাজের দক্ষিণ হস্তের ডমরু সৃষ্টির প্রতীক, ডমরু ধ্বনির সঙ্গে মহাপ্রান পঞ্চভূতের যোগ আছে। বৈচিত্র্যমান বিশ্বের উপাদান পঞ্চভূত।বাম হস্তে অগ্নি ধ্বংসের প্রতীক ।দক্ষিণ হস্তের অভয় মুদ্রা পালনের প্রতীক । এবং বাম হস্তের লতা মুদ্রার অর্থ হল তাঁর চরণে আশ্রয় নিলেই চিরমুক্তি ।পিছনে চক্রাকারে অগ্নিগোলক ওঁ-কারের প্রতীক, বিশ্বের ও বিশ্ববাসীগণের প্রান শক্তির পরিচায়ক। কপালে অর্ধচন্দ্র অর্থাৎ অগ্নি জ্ঞানের এবং শিরে সর্প প্রকৃতি মানে প্রানশক্তির পরিচায়ক এবং জটাজাল নৃত্যের ছন্দে শূন্যে উৎক্ষিপ্ত-গঙ্গা হিমালয় গোমুখের দিকে বাহিত হয়। পদতলে অপস্মর নামক মায়ারূপী দৈত্যকে দলিত করে অর্থ্যাৎ অজ্ঞানকে বিনাশ করে মুক্তি ও শান্তির আলোকদান করেছেন। দৈত্য বা বামন পদ্মপীঠের উপর শুয়ে আছে।তাঁর এক কর্ণে পুরুষ ও অন্য কর্ণে নারীর ভূষণ প্রমান করে তিনি একাধারে পুরুষ ও প্রকৃতি। তবে নৃত্য ছাড়াও ভারতীয় শিল্প, ভাস্কর্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে নটরাজ শিব মূর্তি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত আছে। 

কথিত আছে, নটরাজ শিব একবার তাঁর ভক্তদের পরীক্ষার জন্য ছদ্মবেশে দক্ষিণ ভারতের তিল্লাই নামক স্থানে উপস্থিত হন, এবং উপস্থিত ঋষিদের তর্কে নটরাজ পরাজিত করেন তাঁদের।ঋষিগণ তখন ক্রুদ্ধ হয়ে যজ্ঞ শুরু করেন এবং যজ্ঞাগ্নি থেকে এক বাঘ বার হয়ে শিবকে আক্রমণ করলে শিব তাকে হত্যা করে বাঘের চর্ম পরিধান করে নেন। তখন আবার যজ্ঞ শুরু হয় ।এরপর যজ্ঞ থেকে সাপ বার হয়ে শিবকে আক্রমণ করলে শিব তাকে অঙ্গের ভূষণ করে নেন ।এরপর যজ্ঞ থেকে বামনাকার দৈত্য শিবকে আক্রমণ করলে শিব তাকে ঊর্দ্ধে নিক্ষেপ করেন এবং ভূমিতে পতিত হলে তাকে পদতলে রেখে আনন্দে নৃত্য শুরু করেন। তখন ঋষিগণ তাঁকে চিনতে পেরে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং নটরাজ তাঁদের আশীর্বাদ করে বলেন যে তিনি এইস্থানে আবার আবির্ভূত হবেন।

ছবি : গুগল

ছবি : গুগল

এই স্থানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চিদাম্বরমের বিখ্যাত নটরাজ মন্দির।এছাড়া নটরাজ দৃশ্য এলিফেন্টা গুহাগাত্রে দেখা যায়।

ছবি : গুগল

নৃত্যের প্রথম প্রকাশ তাণ্ডব নৃত্য । নটরাজ শিব এই তাণ্ডব নৃত্যের স্রষ্টা। কথিত আছে ত্রিপুরাসুরকে বধ করার সময় দেবাদিদেব মহাদেব বীর ও রৌদ্র রসের সংমিশ্রণে যে নৃত্য করেন তাই হল তাণ্ডব। আবার শোনা যায়, শিব অঙ্গহার রেচক পিন্ডি সৃষ্টি করে তণ্ডুকে শিক্ষা দেন এবং তণ্ডু সেই নৃত্য কণ্ঠসঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীত সহকারে পরিবেশন করেন।সেই নৃত্যই হল তান্ডব নৃত্য ।বিভিন্ন সময়ে অনুসারে নটরাজের নৃত্যকে সাতটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তা হল- ১) আনন্দ তাণ্ডবঃ-সৃষ্টির আনন্দে নটরাজ শিব যে নৃত্য করেছিলেন সেই নৃত্যই আনন্দ তাণ্ডব। এই নৃত্য শিবের অনুগামীদের রক্ষা করার জন্য। দক্ষিণ ভারতের চিদাম্বরম্ অথবা তিল্লাই মন্দিরের ব্রোঞ্জের মূর্তির মধ্যে ভাস্কর্যের মাধ্যমে অমর হয়ে আছে। এই নৃত্যের মাধ্যমে আত্মিক প্রসন্নতা, মোক্ষ প্রাপ্তি প্রভৃতি ভাব প্রকাশ পায়।

ছবি : গুগল

২)উমা তাণ্ডবঃ- নটরাজ শিব ও উমার দাম্পত্য প্রেম প্রদর্শিত করবার জন্য যে নৃত্য তাই হল উমা তাণ্ডব ।

৩)সন্ধ্যা তাণ্ডবঃ- জীবনসূর্য অস্ত হওয়ার পর অন্ধকাররুপী মৃত্যু জীবনকে গ্রাস করে , সন্ধ্যা তাণ্ডব সেই রূপেরই প্রকাশ ।এতে প্রথমে করুণ রস ও ক্রমে ক্রমে রৌদ্র ভয়ানক ও বীভৎস্য আদি রসের প্রকাশ পায়।

বহু প্রাচীনকালে উল্লিখিত আছে যে তুষারবৃত কৈলাস পর্বতে তিনটি বিশ্বের মাতা স্বর্ণ সিংহাসনে উপবিষ্ট আছেন, যখন তৃতীয় বিশ্ব দিনকে দীর্ঘ কালস্থায়ী এবং রাত্রের আসন্ন অন্ধকারময়তার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে শূলপাণী(শিব)কে স্বর্গীয় ঘটনার জন্য নৃত্য পরিবেশন করতে অনুগ্রহ করেন।

সরস্বতী বীণা বাজাচ্ছেন ,

ইন্দ্র বাঁশী বাদনরত,

ব্রহ্মা ছন্দময়তাল বজায় রাখছেন,

রামভগবতী সঙ্গীত পরিবেশন করেন,

বিষ্ণু ড্রাম বাজাচ্ছেন ,

সকল দেবতা চতুর্দিক ঘিরে স্বর্গীয় বাদ্যযন্ত্রবাদন শ্রবণ করে দেবতার নিকট প্রার্থনা করছেন।

ভগবান মৃদানিপতি নৃত্য প্রদর্শন করছেন।

ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে- এই নৃত্য সকলকে রক্ষা করে।

ছবি : গুগল

৪)গৌরী তাণ্ডবঃ- মহাদেব গৌরীর প্রতি আকর্ষণবশতঃ যে নৃত্য করেছিলেন, তাই গৌরী তাণ্ডব।এই নৃত্যে আদি শক্তির প্রতি সাত্ত্বিক ভাব প্রদর্শিত হয়। এর বোল শ্রুতি মধুর ও অঙ্গ সঞ্চালন মন্থর হয়।

৫)ত্রিপুরা তাণ্ডবঃ- ত্রিপুরাসুরের অত্যাচারে যখন ত্রিজগত প্রপীড়িত তখন অসুরকে বধ করার জন্য শিব যে নৃত্য করেছিলেন তাঁকে ত্রিপুরা তাণ্ডব বলে। অন্ধকারকে নাশ করাই ত্রিপুরা তাণ্ডবের উদ্দেশ্য। এই তাণ্ডবের বোল আড় ও বিয়াড় লয় যুক্ত।

৬) সংহার তান্ডবঃ- নটরাজ শিব একাধারে সৃষ্টি ও সংহারের দেবতা । সংসারে পাপের মাত্রা বেড়ে গেলে ভগবান শিব রূপ ধারণ করে সৃষ্টির বিনাশের হেতু সংহার তাণ্ডব করেছিলেন। তাঁর তৃতীয় নয়ন থেকে নির্গত অগ্নি শিখায় জড় ও জীব সকল ধ্বংস হয়ে নূতনের সৃষ্টি করেন।

৭) কালিকা তাণ্ডবঃ- দেবী চণ্ডীর তৃতীয় নেত্র থেকে সৃষ্ট মহাকালীর দৈত্য নিধনই কালিকা তাণ্ডবের বর্ণিত বিষয়। এর বোল ভীষণতাময়। এটা লাস্য নৃত্যকলার অপূর্ব নিদর্শন।

ছবি : গুগল

বিহু যে একটি গৌরবময় নৃত্য ধারা , পাঠ শেষে জানালেন - কেকা ত্রিবেদী

বিহু : এক গৌরবময় নৃত্য ধারা

কেকা ত্রিবেদী

শর্মিষ্ঠা দে বসুর ২০০৪ সালে প্রকাশিত ‘বিহু’ গবেষণা গ্রন্থটি একাধারে বিহু নৃত্য শৈলী ও বিহু কেন্দ্রিক অসমীয়া লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। বইটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অন্তর্গত লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র দ্বারা প্রকাশিত। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্য অসম যার প্রাচীন ভাষা, লিপি, ধর্মীয় ভাবনা প্রভৃতির সঙ্গে আমাদের যেমন সাদৃশ্য রয়েছে, তেমনি বৈষ্ণব ঐতিহ্য দুই রাজ্যকে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে বেঁধেছে। ঐতিহাসিক কাল থেকে প্রাগজ্যোতিষপুর বা কামরূপের সাংস্কৃতিক বৈভব আমাদের মুগ্ধ করে। অসমের অপরূপ মনোরম সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশ গ্রামীণ, কৃষিনির্ভর সমাজের স্তম্ভ। কৃষিজ, বনজ, খনিজ – প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য অসমীয়া নগর সভ্যতাকে সময়ের সঙ্গে ব্যবসা কেন্দ্রিক করে তুলেছে। বর্তমানে বিহু অসমের জাতীয় উৎসব। কিন্তু বিহু শুধুমাত্র একটি নাচ নয়, সমগ্র উত্তর পূর্ব ভারতের পার্বত্য মঙ্গোলয়েড জনজাতির ফসলকেন্দ্রিক, জীবজগতের সমৃদ্ধি ও উর্বরতার কামনায় পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনমূলক একটি নৃত্য উৎসব। এই নৃত্যগীতের মাধ্যমে যেমন পুরুষ-নারীর জীবনীশক্তি ও সৌন্দর্যের প্রশংসা করে মিলনের নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে তেমনি নারীও পুরুষ জাতিকে সাজসজ্জা ও অলংকারে ভুলিয়ে নাচে গানে মাতোয়ারা করে তোলে। তবে বর্তমানে বিশ্বায়নের প্রভাবে এই নাচের ঐতিহ্য কিছুটা হলেও মলিন। বিশ শতকের শহুরে সংস্কৃতির ছোঁয়ায় গ্রাম্য আদিমতা প্রায় অস্তমিত। যেকোনো সনাতন লোকাচারের মতোই বাণিজ্যিকীকরণের ফলে বিহু নাচ তার স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত। লেখিকার মতে বিহুর রূপকে রক্ষা করে তাকে ঘিরে অপসংস্কৃতির আবহাওয়াকে পাল্টে অসমীয়া সমাজের পূর্ণরূপকে বিকশিত করলে বিহুর আন্তর্জাতিকতা বাড়ে। এই বইটি অসম ও মিজোরামে ক্ষেত্রসমীক্ষা ভিত্তি করে রচিত। বিহু নাচকে কেন্দ্র করে অসমের সুপ্রাচীন গ্রামীণ ঐতিহ্য, তার সঙ্গে জড়িত মানুষের প্রকৃত রূপ ও বিহু নাচের আকর্ষণীয় নৃত্য ভঙ্গিমার ব্যাকরণ এই বইতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণিত রয়েছে। বইটি প্রধানত ১৩টি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম দুটি অধ্যায় বিহু কথার অর্থ, বিহু নাচের উৎস সন্ধান ও নাচকে কেন্দ্র করে উৎসবের বর্ণনা রয়েছে। বিহু আদতে বর্ণহিন্দুদের অনুষ্ঠান‌ নাকি, আদিবাসীদের অনুষ্ঠান তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামতের অংশবিশেষ তুলে ধরে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দেখা যায় এক্ষেত্রে কোন ব্রত উদযাপন হয় না বা পূজা পদ্ধতি না থাকলেও কিছু নিয়ম পালন করা হয়, যার সঙ্গে ঋতু পরিবর্তন ও ফসল উৎপাদনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। চৈত্রসংক্রান্তি বা মহাবিষুবের সময় বহাগ বিহু, কার্তিক সংক্রান্তিতে কাতি বিহু ও মকর সংক্রান্তিতে মাঘ বিহু পালিত হয়। তবে সংস্কৃতায়ন জাত ‘ বিষুব সংক্রান্তি থেকে বিহু এসেছে ’ এমন মতে অনেকেই বিশ্বাস করেন না। বর্তমানে এটি অসমের জাতীয় উৎসব হলেও আদিম সভ্যতা বিকাশের সময় থেকে তা উত্তর অসম, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশ, বাংলাদেশের সিলেট, কাছাড়, মায়ানমার, লাদাখ, ইন্দোনেশিয়া, জাভা, সুমিত্রা, বলিদ্বীপ, চীনের দক্ষিণাংশ অর্থাৎ সমগ্র উত্তর পূর্ব হিমালয়, পার্বত্য উপত্যকা অঞ্চল মঙ্গোলীয় আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত একটি প্রাচীন ঐতিহ্য পরম্পরাগত উৎসব যা আজও বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন ভাবে বেঁচে আছে সর্বত্র। বিহু নাচের পোশাক, সাজসজ্জা, ভঙ্গিমা, বিহু উৎসবের আচার অনুষ্ঠানে অবশ্য কিছু আর্যীকরণের প্রভাব রয়েছে। যেমন গরু বিহুতে গরু পুজো ইত্যাদি। তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ে অসমের বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে বিহু উৎসবকে কেন্দ্র করে সমাজ ও সংস্কৃতির তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে। অসমীয়া সংস্কৃতির দুটি বিভাগ – উত্তর অসম ও দক্ষিণ অসম। উত্তর অসমের মিসিং জনগোষ্ঠী ও দক্ষিণ অসমের বোড়ো গোষ্ঠীর আদি লোকনৃত্যের মধ্যে বিহুর প্রধান অঙ্গভঙ্গিগুলি খুঁজে পাওয়া যায়। বোড়ো জাতির লোকাচার দক্ষিণ ভারতীয় দ্রাবিড় জাতির সঙ্গে মেলে। এদের বৈশাখু উৎসব হল বিহুর সমার্থক। উত্তর অসমের মিসিং জনজাতির বাদ্যযন্ত্রগুলি বেশিরভাগই বিহুতে ব্যবহৃত হয়, যেমন – ঢোল, তাল, কাঁসি, পেঁপা, টকা ইত্যাদি। চতুর্থ অধ্যায়ে কাতি, ভোগালি বা মাঘ ও রঙালি বিহুর বিশদ বর্ণনা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এই তিন প্রকার বিহুতে তিন প্রকার রসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কাতি বিহুতে করুণরস, কার্তিক মাসের সংক্রান্তি তিথিতে পালিত হয়। এটি দরিদ্রতম বিহু, কারণ এ সময়ে কৃষকের ঘরে আকাল ঘটে। তাই আর কোনো অনুষ্ঠান না হলেও ক্রীড়া অনুষ্ঠান হয়। এই বিহুর একমাত্র প্রার্থনা মাঠে লাগানো ফসল যেন সুরক্ষিতভাবে বৃদ্ধি পায়। এইসময় শস্য ক্ষেতে, মাঠে, উঠোনে, ভাঁড়ারে সন্ধ্যায় প্রদীপ দেওয়ার বিশেষ রীতির সঙ্গে গ্রামবাংলায় কার্তিক মাসে আকাশ প্রদীপ জ্বালানোর মিল রয়েছে। ভোগালি বা মাঘ বিহু হল ভোগ ও প্রাচুর্যের বিহু। এই বিহু পালিত হয় পৌষ সংক্রান্তি তিথিতে যেখানে ভেলাঘর তৈরি করে পোড়ানোর রীতি হল দারিদ্র্যকে পুড়িয়ে সুখ-সমৃদ্ধি আবাহনের প্রতীক। ভোগের প্রতীক রাতে ‘ লাওপানি ’ খাওয়া। শীতকালে হওয়ায় পিঠে, নাড়ু, গুড় ও শীতের সবজি দিয়ে ভোগালি উৎসব পালন করা হয়। সন্ধ্যাকালীন মেলা বসে। তবে চৈত্রসংক্রান্তি তিথিতে পালিত হওয়া রঙালি বিহু হল আমোদের বিহু এবং সব থেকে বেশি জনপ্রিয়। নতুন বছরের নতুন ফসল, প্রাণীজগৎ ও শস্যের উর্বরতাকামী এই উৎসবে মানুষ খেয়ে-দেয়ে নেচে-নেয়ে সব রকম ভাবে আমোদ করে। তিনদিন ধরে চলা এই উৎসবে যেমন গরু পুজো হয় তেমনি যুবক-যুবতীরা পছন্দের সঙ্গী খুঁজে পেতে মিলনের নাচ গান করে। বইটির পঞ্চম অধ্যায়ে বিহু নাচের ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক পটভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। প্রাচীন পুরাণ, মহাভারত ও রামায়ণে প্রাগজ্যোতিষ হিসেবে অসমের উল্লেখ রয়েছে। মধ্যযুগের প্রাগজ্যোতিষপুরই কামরূপ নামে পরিচিত ছিল। বর্তমান অসম নামকরণ সম্ভবত ১৯ শতকে ‘শান’ জাতীয় লোকেদের আগমনের ফলে ঘটে। স্বাধীনতার পর ক্রমশ ক্ষুদ্রতর হয়ে পড়ে অসম রাজ্য। বর্তমানে এই রাজ্যটি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, বরাক উপত্যকা, উত্তর কাছার, ও কার্বি অধ্যুষিত পার্বত্য ভূ-ভাগ নিয়ে গঠিত। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাটি অসমকে উত্তর, মধ্য ও নিম্ন তিনটি অঞ্চলে ভাগ করেছে। এখানে সরকারি ভাষা হল অসমীয়া যা ইন্দো এরিয়ান ভাষা, সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত। যদিও বিভিন্ন জাতি-উপজাতির মধ্যে আঞ্চলিক ভাষার তারতম্য আছে। অসমে অনেক প্রকার আদিবাসী আছে, যেমন – রাঙা, বোড়ো, কাছারি, কার্বি, তিওয়া, মিসিং ইত্যাদি। এইসব আদিবাসীদের ইতিহাস এবং নৃতত্ত্ব সম্পর্কে লেখিকা বিশদে আলোকপাত করেছেন। এই প্রসঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতে মঙ্গোলয়েড সংস্কৃতির সঙ্গে দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক সভ্যতার এমনকি আর্য সভ্যতার যোগসূত্র যুক্তিপূর্ণ অনুমান সহ পেশ করেছেন লেখিকা। বিহু প্রকৃতপক্ষে আসলে কাদের নাচ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় দক্ষিণ অসমের কলিতা ও উচ্চ বর্ণের মানুষ অসমের মূল জনজীবন স্রোত থেকে চিরকাল দূরে সরে থেকেছে ও বিহু নাচ উচ্চ বংশের কাছে কোনদিন সমাদর পায়নি। মধ্যযুগে আদিবাসী উপজাতি জনজাতির ওপর শংকরদেবের সৌজন্যে বৈষ্ণব প্রভাবের সূচনা হয়। সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য, নৃত্যগীতেও তার প্রভাব পড়ে। ইংরেজ শাসন কালে পশ্চিমী সভ্যতার ছোঁয়া লাগে। পঞ্চাশের দশক থেকে বিহু দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে লোকনৃত্য হিসেবে বিহুর একটি বিস্তারিত পর্যালোচনা রয়েছে। কালের নিয়মে বিবর্তনের ফলে আদিম জনজাতির লোকাচারের সঙ্গে আর্যধর্মপুষ্ট শাস্ত্রীয় বিধি বিধান যুক্ত হয়ে একটি পবিত্র ও ধর্মভাব মিশ্রিত ভাবের উদয় হয়েছে। বিহু গীতগুলির চরিত্র বিশ্লেষণ করে জানা যায় এর বিষয়বস্তু হল এক শ্রেণির ধর্মনিরপেক্ষ মৌলিক সাহিত্য। প্রকৃতির সৌন্দর্য, নবযুবতীর সৌন্দর্য, স্বভাবজাত প্রবৃত্তি, অতীতের আর্থসামাজিক, ধর্মীয় বিষয় ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। তবে বর্তমানে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলেছে বিহুর স্থান, নৃত্যের ভঙ্গিমা, গীতের বিষয়বস্তু। শহুরে, মধ্যবিত্ত, চাকুরিজীবী অসমীয়া সমাজ বিহুর উপর আজ বিরক্ত। শহরে প্রায় পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুজোর মত বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকেছে বিহু উৎসব। বিহু আজ গ্রামের মাঠ ছেড়ে শহরের প্রেক্ষাগৃহের মঞ্চে প্রতিযোগিতার আকার নিয়েছে। বলিউডের চটুল নাচের প্রভাব থেকে দূরে সরে থাকতে পারেনি এই নৃত্য শৈলী। বিহু নাচের বিভিন্ন মুদ্রা ও ভঙ্গিমা পর্যালোচনা করলে যেমন প্রকৃতি পুরুষের মিলনের ইঙ্গিত পাওয়া যায় তেমনি বৈষ্ণব প্রভাব ও হিন্দু দেবদেবীর ( সরস্বতী, পার্বতী, শিব, নারায়ণ ) মাহাত্ম্য প্রকাশ পায়। বর্তমানে অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা ও বাজার অর্থনীতির প্রভাবে বিহুর হারিয়ে যাওয়া কৌলিন্য ফিরে পেতে তার উৎস সন্ধান, আদিম রূপ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। সেই দিক থেকে বিচার করলে এই অভিসন্দর্ভটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত লেখিকা নিজে নৃত্যশিল্পী হওয়ায় বিহু গীতের স্বরলিপি ও নাচের ভঙ্গিমার সুন্দর ব্যাখ্যা দান করেছেন। তবে সচিত্র বিশ্লেষণ হলে সাধারণ পাঠকের কাছে বেশি বোধগম্য হত। বিহু উৎসবের তিনটি প্রকারভেদ ও তার আঞ্চলিক তারতম্যের নিখুঁত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা খুবই প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। বিভিন্ন গবেষক ও লেখকের উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লিখিত রয়েছে। তবে কখনো কখনো তা অসমীয়া ভাষায় লিখিত হওয়ার পাশাপাশি বাংলায় অনুবাদ করলে সাধারণ পাঠক উপকৃত হতে পারত। অসমীয়া সংস্কৃতির সাজসজ্জা, অলংকার, জীবিকা, ধর্ম, ভাষা, গ্রাম ও শহরের তারতম্য সবকিছু census data দিয়ে যুক্তিযুক্ত ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। উদাহরণসহ দ্রাবিড়, আর্য সভ্যতা, ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব প্রভাব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের বিশ্লেষণ থেকে বর্তমান অসমীয়া সমাজের রাজনৈতিক সমস্যারও কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। বিভিন্ন জাতি ও ভাষার মানুষের মিলন ঘটলেও দেশভাগের ফলে বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙালিদের সঙ্গে অসমীয়াদের সাংস্কৃতিক দূরত্ব ও বাঙালিদের প্রতি অসমীয়াদের সমানুভূতির অভাবের কারণ অনুমান করা যায়। তবে সমগ্র বইটিতে একই শব্দের বিভিন্ন বানানের ব্যবহার ও বাংলা ইংরেজি দুই ভাষাতেই কিছু ভুল বানান, বিভিন্ন অধ্যায়ে একই অনুষ্ঠানের বর্ণনার পুনরাবৃত্তি ও বিষয়বস্তুর বাঁধুনির অভাব পাঠকের স্বতঃস্ফূর্ত পাঠ-প্রবাহকে কিছুটা বাধা দান করে। সবশেষে একথা অনস্বীকার্য যে অসম তথা উত্তর-পূর্ব ভারতের লোকসংস্কৃতি বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে এই বই একটি প্রামাণ্য দলিল। পরবর্তী সংস্করণে বানানের প্রতি আরে‌কটু যত্ন ও সহায়ক গ্রন্থপঞ্জির পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করা হলে সাধারণ পাঠক ও গবেষক প্রত্যেকেই উপকৃত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *