অষ্টাদশ সংখ্যা ।। একাদশ ই-সংস্করণ ।। জুলাই, ২০২১

b040b0_6999307813ee4c89ab80f7f676a4e6fa_mv2

ভাণ পত্রিকা

অষ্টাদশ সংখ্যা, একাদশ ই-সংস্করণ, জুলাই, ২০২১

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

ও মৌলিকা সাজোয়াল

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) [email protected] ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সূচি

সম্পাদকের কথা

স্মরণ

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: এক মহৎ-সঙ্গ কথা’ তাঁর পুরুলিয়া পর্বের স্মৃতিচারণায় – অনুপ মুখোপাধ্যায়।

জন্ম- মাসের প্রতিভা:

বিজন ভট্টাচার্য: যার নাটকই জীবন, জীবনই নাটক, – মনে করালেন দেবহূতি সরকার।

বিষয় বিশেষ:

এ বঙ্গে ‘সংস্কৃতি’ এর রাজনৈতিক ব্যবহার’ এর কল- কায়দার সন্ধান দিলেন- সুমন নাথ।

বিশ্বায়ন ও ক্রমে উচ্ছন্নে যাওয়া দেশজ সংস্কৃতি নিয়ে জরুরি আলাপ সারলেন- সুদেষ্ণা মিত্র।

চলচ্চিত্র

এযাবৎকালের সেল্যুলয়েডের ফেলুদা’র পাশ-ফেলের যুক্তি সাজালেন- সুকন্যা সাহা।

বিশেষ নিবন্ধ:

‘লাল পাখি হলুদ বনে’ অভিনয় নিয়ে ব্যক্তি অনুভূতির গদ্য আঁকলেন ময়ূরী মিত্র।

পালা- পার্বন:

সম্পাদকের কথা

এ এক আজব দেশ। যেখানে জীবনদায়ী ভ্যাকসিন নিয়ে জালিয়াতি হয়। জালিয়াতের মঞ্চ আলোকিত করে থাকে পলিটিকাল পাওয়ার। নায়ক নায়িকারা রাতারাতি এম. এল. এ, এম. পি বনে যান। মস্ত সমস্ত বাতেলা মারেন। রাতের আঁধারে দল বদলান। স্টারডাম মোটা কড়িতে বিকোয়। নিজের চূড়ান্ত স্বার্থপর আর অশালীন লোভ কে দেশের ভালো, দশের মঙ্গল বলে বিরক্তিকর ঘ্যানঘ্যান করেন। শিল্প ছেড়ে দলদাস সুলভ খেউড়ের অভিনয়ে মত্ত হন। হ্যাঁ অভিনয়। সবিনয়ে বলতে পারি, দলের প্রতিও এদের ভালোবাসা নেই। ক্ষমতার জন্য মমতা কেবল। নতুন সিনেমা নেই, নাটক নেই, গান নেই, কাব্য নেই,— সে নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তাও নেই এদের। ভাবটা এমন, ক্ষমতার বাজারে টিকে থাকলে, ওসব শিল্প-সাহিত্য পেতে কতক্ষণ!? গরিবের পেটে ভাত নেই। বাজারে যাবার পয়সা নেই। জীবন জীবিকার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু মিডিয়ায় এসব পাবেন না। দেশে যেন চাষী নেই, শ্রমিক নেই, জেলে নেই, তাঁতি নেই। শুধু অশোভন পরকীয়ার চতুর্থ শ্রেণীর গল্প আছে। নোংরামো আছে। অসভ্যতা আছে। কার বৌ পালালো, কার বৌ পালাতে পারে। কোনটা শরীরী আর কোনটা অশরীরী প্রেম— এই নিয়ে নিরন্তন প্রলাপে বাজার ঢালছে লক্ষ-কোটি। আর ছেঁড়া চটি পরে বি. এ পাশ হাঁকছে ‘সবজি চাই, মাছ চাই, ফল চাই বাবুরা’। এ এক অসহনীয় দেশ। এখানে রেড ভলেন্টিয়ার্স দের পক্ষে একলাইন লিখতে আঙুলে বাত ধরে। কিন্তু নায়িকার ছেলের পিতার সন্ধানে প্রবন্ধ লেখা হয়। সন্ধ্যা নামলে কারো মদ, কারো আরো গাঢ় নেশা— সিরিয়ালের। ঢুলুঢুলু চোখে কেউবা নতুন ভোরের কাব্য পড়ে। কিন্তু আঁধার কাটে না।

‘বিষয় বিশেষ’ এর পলিটিকাল কালচার নিয়ে দুটো প্রবন্ধ আসলে এই অবনমন কে দেখায়। এই উচ্ছন্নে যাওয়ার কারণ সন্ধান করে অধ্যাপক সুমন নাথ ও অধ্যাপিকা সুদেষ্ণা মিত্রের দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ।

এছাড়া রয়েছে নিয়মিত বিভাগ। বিজন ভট্টাচার্য জুলাই-জাতক। সেকথা মনে রেখে নিবন্ধ লিখেছেন দেবহূতি। রয়েছে সদ্য প্রয়াত বাঙালির গর্বের পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কে নিয়ে, পুরুলিয়া পর্বের ছায়াসঙ্গী অনুপ মুখোপাধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিচারণ। অভিনয় নিয়ে এক নিজস্ব অনুভবের গদ্য লিখেছেন ময়ূরী মিত্র। ভারী চমৎকার তার ভাবের আদল। সেল্যুলয়েডের ফেলুদা নিয়ে পূর্বাপর মূল্যবান আলাপ করতে করতে নিজের বিবেচনা হাজির করেছেন সুকন্যা। দিনাজপুর থেকে কলেজ ছাত্রী স্নিগ্ধা, বিধানের সঙ্গে লিখে পাঠিয়েছে সেখানকার দাপটকালীর লোককথা। আর সুমন জানিয়েছেন তার সাম্প্রতিক উৎপল পাঠের অভিজ্ঞতা।

‘ভাণ’ পত্রিকা নিয়মিত চলছে এই অনিয়মের দুনিয়ায়,— এ কম আহ্লাদের কথা নয়। আপনাদের ভালোবাসায় এমনটি সম্ভব হচ্ছে। আপনাদের আন্তরিক নমষ্কার জানায় ‘ভাণ’!

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: এক মহৎ-সঙ্গ কথা' তাঁর পুরুলিয়া পর্বের স্মৃতিচারণায় -অনুপ মুখোপাধ্যায়।

লেখক : অনুপ মুখোপাধ্যায়

‘আমার বুকের ‘পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই, শুধু তার স্বাদ

তোমারে কি শান্তি দেবে?

আমিও চলে যাবো- তবু জীবন অগাধ

তোমারে রাখিবে ধরে সেইদিন পৃথিবীর পরে,

আমার সকল গান তোমারে লক্ষ্য ক’রে l’

বুদ্ধদার চলে যাওয়ার পর কেবলই কবিতার এই শব্দ গুলো অনুরণিত হচ্ছেl বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কে নিয়ে কিছু লেখা বড় দুষ্কর। এই রকম মাপের খুব কাছের মানুষ কে ঘিরে স্মৃতির কোলাজ তাঁর অনুপস্থিতিতে বড্ড অস্বস্তিতে ফেলেছে। এই ধরনের ব্যক্তিগত প্রকাশ ভঙ্গিমা, পাঠকদের কারো কারো কাছে একঘেয়ে, ক্লান্তিকর ঠেকতে পারেl এই সময় আত্মকথন চিৎকৃত স্বরে অন্যকে শোনানোটাই যেন রেওয়াজ হয়ে l সেটাও খুব অস্বস্তিকর।

বুদ্ধদার সঙ্গে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরের সম্পর্কl সত্তরের দশকের শেষদিকে এ রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবাদলের সঙ্গে সঙ্গে শিল্প সংস্কৃতি জগতেও বদল ঘটেছিলl নব্যধারার সিনেমা নির্মাণে সেদিন যাঁরা সামনের সারিতে ছিলেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাঁদের অন্যতম। সেসময় জেলা মফস্বলে ও সিনেসোসাইটি আন্দোলন তুঙ্গে l বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবির সঙ্গে পরিচয় সেই আন্দোলনের সুবাদেইl হঠাৎই একদিন হাজির হয়েছিলাম তাঁর সেলিমপুরের বাড়িতে l কোন পূর্ব নির্ধারিত এপয়েন্টমেন্ট ছাড়াইl তাঁর কথাবার্তা শুনে সেদিন যে মুগ্ধ হয়েছিলাম, তা বলার কোন অবকাশ নেই। জীবনের যাত্রাপথে তাঁর স্পর্শ লাভে যে ধন্য হয়েছি তা বলাই বাহুল্য l তখন তো আমার বাড়িতে ফোন নেই, অগত্যা ভরসা পত্রালাপl সেসময় মফস্বল থেকেই মহানগরী তে যাওয়ার সুযোগ হত কালে-ভদ্রেl ১৯৯৮ সালের কোন একদিন তাঁর চিঠি এলো ডাকযোগে। জরুরি প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ। দরকারটা ছিল সিনেমারl তিনি তাঁর নতুন ছবি ‘বাঘ বাহাদুর’ নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছেনl বুদ্ধদার ইচ্ছে পুরুলিয়ার ভার্জিন লোকেশনে এই ছবির শ্যুট করারl আমায় ছবির চিত্রনাট্য পড়তে দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন পুরুলিয়ায় উপযুক্ত লোকেশন পাওয়া যাবে কি না? সম্মতি জানাতেই বুদ্ধদা নির্ধারিত দিনে পুরুলিয়ায় পৌঁছেছিলেন। সেই পাঁচ বছর বয়সে পুরুলিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পর প্রথম পুরুলিয়ায় এলেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন তাঁর একসময়ের সহযোগী পরিচালক তথা তাঁর অনেকগুলি ছবির সংগীত নির্দেশক বিশ্বদেব দাশগুপ্ত। সম্পর্কে তাঁর সহোদর। মনে পড়ে সন্ধ্যেবেলায় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমরা সেদিন অযোধ্যা পাহাড়ে পৌঁছেছিলাম l ছিলাম CADC-এর অতিথিশালায়। তখন তো তেমন থাকার জায়গা নেই পাহাড়। শহরের অবস্থাও তথৈব। আজকের মতো হোটেলের তেমন রমরমা ছিলনা সেদিন। ছবির লোকেশন পছন্দ হলেও অন্যান্য লজিস্টিকের কারণে এ ছবির শুটিং শেষ পর্যন্ত পুরুলিয়ার পরিবর্তে উড়িষ্যায় স্থানান্তরিত হয়l তবে লোকেশন বাতিল হলেও, আমি জড়িয়ে থাকলাম বুদ্ধদার কাজের সঙ্গে। উড়িষ্যায় গিয়ে বোঝা গেল, কী কারনে তিনি লোকেশন হিসেবে পুরুলিয়ার কথা ভেবে ছিলেন। প্রাকৃতিগত সাদৃশ্যই এর বড় কার। এ ছবির নির্মাণ পর্ব এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা। সে অর্থে প্রথম কোন ছবিতে সক্রিয় অংশ নেওয়া। তাও বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মতো পরিচালক। শতাধিক লোকজন নিয়ে ইউনিট l সবকিছু হচ্ছে একবারে ঘড়ি ধরে l কখনো ভোর তো কখনো রাতবিরেতেও ছবির শ্যুট চলছে সমান তালে l এ এক বিপুল কর্মযজ্ঞ। জ্যান্ত বাঘ নিয়ে শুটিং। প্রযুক্তিগত কোনো কৌশল না নিয়ে একেবারে হাড়হিম করা দৃশ্য। পবন মালহোত্রা, অর্চনা, বাসুদেব রাও, রাজেশ্বরী রায়চৌধুরী, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় সবাই যেন এখানে শিক্ষার্থীl বুদ্ধদার ভঙ্গিমা শিক্ষক সুলভ নয় l কিন্তু প্রতিটি দৃশ্যগ্রহণ যেন সেলুলয়েডের পাঠদান পর্ব। সিনেমার এ এক নতুন পাঠোদ্ধার l প্রযুক্তি, লেন্সের ব্যবহার তার সঙ্গে লোকেশন, অভিনেতার কম্পোজিশন, অভিনয় রীতি সব মিলিয়ে এ এক নতুন রসায়ন। সাহিত্যের ভাষার চেয়ে সিনেমার ভাষা যে স্বতন্ত্র, সেটা প্রথম উপলব্ধি করলামl

ছবি : গুগল

গোটা ইউনিটের পরিবেশটাই আলাদা l পরিচালক, চিত্রগ্রাহক, অভিনেতা কেউ কারো থেকে বিচ্ছিন্ন ননl কোনো ব্যবধান নেই কারোর l সবাই একটি ভালো ছবি তৈরির স্বপ্নে যেন বুঁদ হয়ে আছেন l ঐ সেটে বসেই কাজের ফাঁকে কতধরনের আড্ডা হত l গান, কবিতা, রাজনীতি সবকিছুর হাত ধরে সিনেমার পাঠ গ্রহন ছিল বড় প্রাপ্তি l শুটিং থেকে হোটেলে ফিরে পরের দিনের প্রস্তুতি l কোন ভুল হয়ে থাকলে তাকে শুধরে নেওয়ার পরিকল্পনা করতেন পরিচালক l কঠোর শৃঙ্খলায় বাঁধা থাকতো ইউনিটের প্রতিটি কাজকর্ম l এখানে এসেই দেখলাম বুদ্ধদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আরেক বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক বিপ্লব রায়চৌধুরী, শুটিং-এর তদারকি করছেন বন্ধুত্বকে ভালোবেসে l সিনেমাকে ভালোবেসে lএমন উদাহরণ কি খুব মেলে? এসবই শিল্প আর জীবন চর্চায় প্রয়োজনীয় আহরণ l সিনেমার যাত্রাপথে নিয়মিত পথিক না হয়েও, এরপর বুদ্ধদার সঙ্গে যোগাযোগটা থেকেই গেল l লেখালেখি, সাক্ষাৎকার গ্রহন, কবিতা সংগ্রহের মতো নানা কাজের সূত্র ধরে তাঁর সান্নিধ্যের অভাব হয়নি আমার জীবনে l ততদিনে আমার বাড়িতে ফোন এসেছে l বুদ্ধদা ফোন করে বললেন, “ সমরেশ বসুর ‘উরাতিয়া’ গল্পটি পড়েছো? পড়ে ফ্যালো l এটা নিয়েই পরের ছবি l তুমি বলো, এরকম লোকেশন পাবো কিনা? ” এরপর কলকাতায় ডাক পড়লো l তাঁর বাড়িতে যেতেই চিত্রনাট্যের খসড়া পড়তে দিলেন l ততদিনে আমারও বয়সের বেলা বেড়েছে খানিকটা l তখন আমি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে সারা জেলা চষে বেড়াই l আমার বাসভূমিকে চেনা জানার চোখ আর পরিধি বেড়েছে l

বুদ্ধদা বলতেন, “ তোমার চোখ ই হচ্ছে আসল l তুমি চোখ দিয়ে যা দেখছো সেটাই তো ফ্রেম l আমার কাছে ইমেজতো সেভাবেই ধরা পড়ে । ” আমিও ছবির প্রয়োজনীয় লোকেশন দেখা শুরু করলামl

সম্ভবত ৯৯-এর ডিসেম্বরের শেষে বুদ্ধুদেব দাশগুপ্তের ছবি নিয়ে রেট্রোস্পেক্টিভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল l উদ্যোক্তা ছিলেন তৎকালীন সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া l বুদ্ধদা আর তাঁর প্রধান সহকারী অরুণ গুহঠাকুরতা এসেছিলেন ঐ উৎসবে অংশ নিতে l তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল কাশীপুর বনবাংলোয় l আমার ডাক পড়লো সেখানে l ওখান থেকেই একেবারে হাড় কাঁপানো শীতে ভোর বেলায় আমরা বেরিয়ে পড়লান লোকেশনের সন্ধানে l দুদিনে জেলার বহু জায়গা চষে ফেললাম বটে, তবে ছবির বহু প্রয়োজনীয় জায়গা যে এখনো মেলেনি!বুদ্ধদা বললেন, “ গন্ধ পাচ্ছি, হবে l ” সে যাত্রায় একটা তালিকা দিয়ে গেলেন l সেই মতো এবার আমার প্রস্তুতি নেওয়ার পালা l মাসখানেক পর আবার এলেন l এবার সঙ্গী পরিচালকের সেই সহকারী বিশ্বদেব দাশগুপ্ত l জঙ্গল, রেল গেট, চার্চ, গ্রাম, মেঠো রাস্তা, হাইওয়ে সব পছন্দ, কিন্তু তখনো দুষ্প্রাপ্য ছবির মূল লোকেশন l একটা টিলা l যেখান হবে কুস্তির আখড়া l পাশ দিয়ে চলে গেছে রেল লাইন l দুএকটা দেখা হয়েছে বটে, যেন পেয়েও পাচ্ছিনা l বুদ্ধদা আমাকে চিঠিতে যেভাবে ছবি এঁকে বার্গম্যান এর ছবির রেফারেন্স দিয়েছিলেন, সেই দিগন্ত জুড়ে প্রান্তর, টিলা… l সেসব যেন পেয়েও পাচ্ছিনা l দুদিন খুঁজে বেড়ানোর পর বুদ্ধদার কলকাতায় ফেরার কথা, খানিকটা বিফল মনোরথ হয়েই l আমারও মন খারাপ l এবারো হলনা বোধহয় l ফস্কে গেল l শেষ বিকেলে হাইওয়ে দিয়ে পুরুলিয়ায় ফিরছি l শহরে ঢোকার কুড়ি কিলোমিটার আগে মূল রাস্তা থেকে দূরে একটা উঁচু-নিচু ঢালের রেখাচিত্রে চোখ গেল আটকে গেল l বুদ্ধদা গাড়ি থামাতে বললেন l বললেন, “ চলো ওখানটায় নিয়ে চলো l ” গ্রামের অপরিচিত এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা দিয়ে মিনিট পনেরো পর গন্তব্যে পৌঁছালাম l বুদ্ধদার সারা মুখে তখন তৃপ্তির হাসি l বললেন,“ পেয়ে গেছি l সব পেয়ে গেছি l এখানেই সব হবে l কতবার এই লোকেশনের ধার কাছ দিয়ে গেছি l কিন্তু নজরে পড়েনি l ” বুদ্ধদার অনুসন্ধিৎসু চোখে এবার ধরা পড়লো l বুদ্ধদারা সেদিন আর কলকাতায় ফিরে গেলেন না l লোকেশন খুঁজে পাওয়ার আনন্দে সেদিন আমরা হুইস্কি খেয়ে, আড্ডা দিয়ে সেলিব্রেট করলাম l ‘উত্তরা’র শুটিং এর আগে বেশ কয়েকবার এসেছিলেন পরিচালক l আর প্রতিবারই যেন নতুন মাত্রা পেয়েছে তাঁর এই নির্মাণ সফর l প্রতিবারই ছবির চিত্রনাট্যে বদল ঘটেছে l কখনো নতুন দৃশ্যের জন্ম হয়েছে, কখনোবা নতুন চরিত্রের প্রবেশ ঘটেছে l এই ছবিতে পাদ্রির চরিত্রটি তো এভাবেই এসেছিল l লোকেশন খোঁজার সময় সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হয়েছিল উড়িষ্যায় একটি চার্চে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনা l আবার বাগাল মেয়েটি এবং তার শাশুড়ির দুঃখ বৃত্তান্ত তো, লোকেশন খুঁজতে গিয়ে এক বৃদ্ধার মুখ থেকে শোনা তার জীবন কথা l বাস্তবের নানান ঘটনাবলি, চরিত্ররা এভাবেই জায়গা করে নিয়েছে তাঁর বিভিন্ন ছবিতে l তাঁর একটি ছবিতে আদর্শকে আঁকড়ে থাকা এক শিক্ষকের চরিত্র আমার এক বন্ধুর আদলে গড়ে ওঠা l শুধু প্রাক-নির্মাণ পর্বেই না, শুটিং চলাকালীন সময়েও বিভিন্ন দৃশ্যের জন্ম হয়েছে এভাবেই বাস্তব আর পরা-বাস্তবের সংমিশ্রনে l সে বাসের মধ্যে মানুষের সঙ্গে গরু, ছাগল, মুরগির সহাবস্থানই হোক, কিংবা গাঁয়ের হাটে নতুন বর-বৌ-এর ষ্টুডিওতে ছবি তোলা, অথবা সাইকেলের রডে বসে ছাগলের সওয়ার হওয়া,— সবই এসেছে এই জনপদের লৌকিক জীবন থেকে l ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ ছবির গাধাটিও এসেছিল এভাবেই l একটি মেলায় গাধার কৌতুক মিশ্রিত আজব কান্ড দেখেই, ছবির চিত্রনাট্যে তাকে জায়গা দেওয়া হয় l বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবির অসংখ্য চরিত্রকে যাঁরা প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁরা অনেকেই পুরুলিয়ার স্থানীয় শিল্পী l সে অর্থে তাঁরা ফিল্মের কোনো পরিচিত মুখ নন l এই দলে স্থানীয় নাট্য দল কিংবা লোকসংস্কৃতির সাথে যুক্ত শিল্পীরা যেমন ছিলেন, তেমনি যাঁরা অভিনয়ের অ আ ক খ জানতেন না, তাঁদের দিয়েও অবলীলায় অভিনয় করিয়ে চরিত্র গুলোকে বিশ্বস্ত করে তুলেছেন তিঁনি l তাঁর কাছে চরিত্র নির্বাচনে চেহারাটা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ l তাই বহু নন-এক্টরকে দিয়েও উচ্চ মানের অভিনয় করিয়ে নিয়েছেন l এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে ‘উত্তরা’ ছবিতে পোস্ট-অফিসের এক দৃশ্যে এক বৃদ্ধ, যিনি অন্যের চিঠি লিখে দেন l এই মানুষটি বাস্তবে ছিলেন দলিল লেখকের পেশায় নিযুক্ত l তাঁকে দিয়েই অসাধারন অভিনয় করিয়ে নিয়েছিলেন পরিচালক l এই ছবিতেই এক বৃদ্ধা পিসির একটি চরিত্র ছিল l এই চরিত্রের জন্য তথাকথিত কোন পেশাদার অভিনেত্রীকে তাঁর পছন্দ হচ্ছিল না l অনেককেই বাতিল করলে। শেষ পর্যন্ত, বিখ্যাত ঝুমুর শিল্পী, যিনি নাচনি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, সেই সিন্ধুবালা দেবীকে দিয়ে এই চরিত্রে অভিনয় করালেন বুদ্ধদা l এই প্রসঙ্গে একটি মজার ঘটনা না বললেই নয় l শ্যুটিংয়ের কয়েকদিন আগে বুদ্ধদা সিন্ধুবালা দেবীকে দেখে সম্মতি দিয়েছেন l নির্দিষ্ট দিনে তিনি উপস্থিতও হয়েছেন শুটিং এর জন্য l শর্ট এর আগে ওনাকে দেখে তো পরিচালকের চোখ কপালে ওঠার যোগাড় l বুদ্ধদা বলছেন, “ কে ইনি? চেহারা তো বদলে গেছে l চেনা যাচ্ছেনা l ” একমাথা পাকা চুলের জায়গায় কালো কুচকুচে চুল নিয়ে হাজির অভিনেত্রী l আসলে সিনেমায় এই নাচনি শিল্পী তার পাকা চুল দেখাতে রাজি নন l অবশেষে অনেক বুঝিয়ে মেকআপ ম্যান দেবী হালদারের চেষ্টায় মুশকিল আসান হয়েছিল l অভিনয় প্রসঙ্গে বুদ্ধদা বারবার বলতেন সিনেমার অভিনয় আর থিয়েটারের অভিনয়ের যে সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান, তা অভিনেতাকে বুঝতে হবে l থিয়েটারের বহু বিশিষ্টরা তাঁর ছবিতে অভিনয় করে যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন l বুদ্ধদার নির্দেশ সিনেমার অভিনয়ে নাটক করা যাবেনা l তাঁর ছবিতে বিজন ভট্টাচাৰ্য, সুব্রত নন্দী থেকে অশোক মুখোপাধ্যায়, সুনীল মুখার্জী, মাসুদ আখতার, মণিদীপা রায় ,অনসূয়া মজুমদারদের অভিনয় বড় প্রাপ্তি l আবার তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবির নায়ক নায়িকারাও তাঁর ছবিতে অভিনয় করে সোনা ফলিয়েছেন l তিনি বলতেন বাণিজ্যিক ছবির অভিনেতারাও খুবই শক্তিমান এদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারলে পরিচালকের পরিশ্রম লাঘব হয় l তাঁর ছবিতে মিঠুন থেকে তাপস পাল, প্রসেনজিৎ, ঋতুপর্ণার অভিনয়ে সে কথারই প্রমান মেলে l এঁদের অনেকেই জাতীয় পুরস্কার বিজেতা l উনি যখন কোন অভিনেতাকে অভিনয় করে দেখাতেন, তখন অভিনেতার দুর্বলতা ধরিয়ে দিতেন l যাঁরা অনুসরণ করেছেন তাঁরা ফল পেয়েছেন l তাঁর ছবিতে লোকেশনও যেন একটা চরিত্র l অনেকেই ভাবেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের পুরুলিয়ায় জন্মস্থান বলেই, বারবার এখানে এসেছেন ছবি বানাতে l এটা খুবই বোকা বোকা ভাবনা l ছবির প্রয়োজনেই তাঁর পুরুলিয়ায় আসা l ওনার কথায় পুরুলিয়ায় ছবি বানানোর উপযোগী জায়গা l বিভিন্ন ঋতুতে তার রূপ বদলায়, রং বদলায় l ক্যামেরা পাতলেই যেন ফ্রেম তৈরী l স্টুডিওতে সেট ফেলে ছবি করা তাঁর পছন্দ ছিলনা l আউটডোরে ছবি তৈরী করতে তিনি পছন্দ করতেন l ‘দূরত্ব’ থেকে ‘উড়োজাহাজ’-এ এই সত্যতার প্রমান মেলে l তাঁর ছবিতে লোকেশন যেভাবে ধরা পড়েছে, তা থেকেই বোঝা যায় লোকেশনের গুরুত্ব l বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের আগে পুরুলিয়াকে তেমন ভাবে লোকেশন হিসেবে কেউ গুরুত্ব দেননি l সে অর্থে তিনিই যেন পুরুলিয়াকে নতুন করে আবিষ্কার করলেন। তারপর বাংলাতো বটেই, মুম্বাই থেকেও চলচ্চিত্র পরিচালকদের নজর পড়েছে পুরুলিয়ার দিকে l

‘উত্তরা’ থেকে ‘মন্দ-মেয়ের- উপাখ্যান’, ‘জানালা’, ‘ত্রয়োদশী’, রবীন্দ্র কবিতার চিত্রায়ন, ‘ওহ’, কিংবা ‘টোপ’ সর্বত্রই লোকেশন তার নিজস্ব চরিত্র নির্মাণ করেছে l

তাঁর বিভিন্ন ছবিতে ব্যবহৃত ঘর, বাড়ি, রাস্তা, রেললাইন, জঙ্গল, স্টেশন, স্কুলবাড়ি, পুকুর, নদী, জলাধার, জীবনযাত্রা সব যেন মিলেমিশে একাকার l এসব খুঁজে পেতে কত মানুষের আবেগ আর ভালোবাসাকে আশ্রয় করতে হয়েছে, তা ভাবলে অবাক হতে হয় l এই দেশে এসব প্রাকৃতিক সম্পদের তেমন গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা নেই l তাই তথাকথিত উন্নয়নের প্যাঁচে সে সব সম্পদ বেমালুম নষ্ট হচ্ছে রোজ l রাষ্ট্রের কোন দায় নেই এসব সম্ভারকে রক্ষা করার l

ছবি : গুগল

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবিকে ঘিরে বিপুল কর্মকান্ড সংগঠিত হত l সিনেমার পর্দায় যে সামান্য দৃশ্যটুকু দেখি, তা নির্মাণে কত মানুষের শ্রম, মেধা, আবেগ ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে তার কোন হিসেব নেই l এসব করতে গিয়ে কত না মজাদার ঘটনার সাক্ষী থেকেছি l ‘উত্তরা’র শুটিং চলছে একটি গ্রামের বাইরের মাঠে l কাছেই একটি মন্দির l হাজারো লোকের ভিড়ে গিজগিজ করছে চত্বর l এরই মধ্যে একটা উড়ো চিঠি এলো বুদ্ধদার হাতে l চিঠিতে লেখা মন্দিরের জাগ্রত দেবী স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন এক গ্রামবাসীকে, শ্যুটিংয়ের জন্য তাঁর শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে l সুতরাং, ছাগ বলি দিয়ে দেবীর পুজো করতে হবে l এটাই কয়েকদিন গোটা ইউনিটের কৌতূকের বিষয় হয়ে উঠলো l কিন্তু বেচারা ভক্তদের মনের সাধ সে যাত্রায় মেটেনি l আবার শ্যুটিংয়ের দরকারে হাইওয়ের উপরের কালী মন্দিরকে সরিয়ে দেওয়ায় এক ভণ্ড সাধু বেজায় ক্ষেপে ছিল আমাদের ওপর l শেষমেশ ঐ সাধুকে কিছু দক্ষিনা দিতে হয়েছিল আমাদের l এইরকম বেশ কিছু কৌতুক মিশ্রিত ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন সময় l আবার অতি উৎসাহী জনগনের উৎসাহের আতিশয্যে আমাদের শুটিং ভেস্তে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে l একবার শহর সংলগ্ন একটি গ্রামে আমরা পৌঁছতেই সেখানে মানুষের ঢল নামলো l বিরক্ত পরিচালক ততক্ষনাৎ লোকেশন প্যাক-আপের ঘোষণা করলেন l ‘উত্তরা’ ছবিতে গ্রামের মানুষের বাইস্কোপ দেখার একটি দৃশ্য ছিল l আমাদের জুনিয়ার আর্টিস্টদের সঙ্গে স্থানীয় উৎসাহী জনগণ মিশে গিয়ে, শুটিংকেই ভেস্তে দেয় l কেননা অপেশাদার শিল্পী অনেকসময় অদ্ভুত আচরণ করে বসে l ভিড়ের দৃশ্যও কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্ত শুটিং দেখতে আসা জনগনের নির্দেশকের নির্দেশ শোনার কোন দায় নেই l ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে l পরে আবার ঐ দৃশ্যটি শ্যুট করা হয় l তখন ফিল্মে শ্যুট হতে খরচ হত বিস্তর l

পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ছিলেন কাজের ব্যাপারে খুবই খুঁতখুঁতে প্রকৃতির l তাঁর ছবিতে শেষ বিকেলের ম্যাজিক্যাল আলোর ভূমিকা ফিরে ফিরে এসেছে l সেই মুহূর্তকে ক্যামেরা বন্দি করতে চলতো যুদ্ধকালীন তৎপরতা l তারই মধ্যে কিছু ভ্রান্তি থেকে যেত কোনো কোনো দিন l সেসব ফেলে দেওয়া ছাড়া কোন গত্যান্তর ছিলনা পরিচালকের।

তাই ‘উত্তরা’র চার্চ পোড়ানো কিংবা ‘জানালা’ ছবির শেষ দৃশ্য দুবার শ্যুট করতে হয় পরিচালককে l ছবির এডিটিং পর্বের পরেও পুনরায় শ্যুট করেছেন পুরোনো দৃশ্যের l সিনেমার সঙ্গে তিনি আপোষ করতে চাননি l

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবি মানেই দীর্ঘদিনের শুটিং সিডিউল l মাসাধিক সময় ধরে শুটিং চলতো l প্রতিদিন সবার কাজ না থাকলেও, লোকেশন ছেড়ে তাঁদের যাওয়া যাবেনা l সবার জন্যই এক নিয়ম l একদিনের কাজ হয়ে হয়তো কয়েকদিনের বিরতি, তবুও থাকতে হবে l টালিগঞ্জ এর এক প্রতিষ্ঠিত নায়ক বিরতি চলাকালীন কলকাতা ফিরতে চেয়েছিলেন অন্য কাজের জন্য l অসন্তুষ্ট পরিচালক তাঁকে তাঁর ছবির কাজ থেকেই বিদায় নিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন l শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাঁর ছুটি মেলেনি l এ ক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি, ছবির চরিত্র নির্মাণে, অভিনেতার চরিত্রের মধ্যে যাপন একটি বড় প্রক্রিয়া l এই প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে গিয়ে অভিনেতা অন্য কিছু করলে চরিত্র নির্মাণ ব্যাহত হয় l তাঁর বিশ্বাস, এতে ছবি ক্ষতিগ্রস্ত হয় l পরিচালক হিসেবে তিনি আপোষের পথে হাঁটেননি l

এভাবেই তাঁর সাহচর্যে ঋদ্ধ হয়েছি নানাভাবে l শুধু যে শিল্প চর্চায় সমৃদ্ধ হয়েছি তা নয়, আমার ব্যক্তি জীবনে, পারিবারিক জীবনেও তাঁর প্রভাব অনেকখানি l আমার কিঞ্চিৎ থিয়েটার চর্চাকে উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন বরাবার l আমাদের ‘অন্যচোখে’র নাট্যউৎসবে উপস্থিত থেকে আমাদের উজ্জীবিত করেছেন l

তিনি আমাদের মেধা-মনন উজাড় করে দিয়ে গিয়েছেন দুহাত ভরে l সে অর্থে তিনি আমাদের শিক্ষক l কিন্তু আমরা গ্রহন করতে পেরেছি কতটুকু? এই সভ্যতা, সংস্কৃতি যতদিন থাকবে আমাদের তাঁর নির্মিত ছবি গুলোর কাছে বারে বারে ফিরে যেতে হবে— নিজেদের জীবনবোধে উদ্দীপ্ত হতে, নিজেদের সংকটকে চিনে নিতে l

‘ওর কাছে গিয়ে বসলে ছায়া নেমে আসবে মনে হয়

ও দেবে না নেবে?

ও কি আশ্রয়, না কি আশ্রয় চায়?

আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যায় ওই এক মেঘের মতো মানুষ

ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আমিও হয়তো কোনদিন

হতে পারি মেঘ ‘ l

বিজন ভট্টাচার্য: যার নাটকই জীবন, জীবনই নাটক, - মনে করালেন দেবহূতি সরকার।

লেখক : দেবহূতি সরকার

‘নবান্ন’, ‘দেবীগর্জন’, ‘জীয়নকণ্যা’ র মত একাধিক নাটকে বাংলা নাটকের ভাষাকে বলা যেতে পারে বদলে দিয়েছিলেন তিনি। গণনাট্য আন্দোলনের অন্যতম প্রতিভূ নাটক ‘নবান্ন’এ গ্রাম বাংলার নিরন্ন মানুষের জীবনের নাট্যরূপ দান করেছিলেন শুধু নয়– সারাজীবনই তিনি খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের দলিল রচনা করে গেছেন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য।

রচিত নাটকের মতোই বিজনের জীবনও বিচিত্রপথগামী। কয়েকটি আশ্চর্য সাক্ষাৎকার থেকে আমরা বিজনের সেই ঘটনাবহুল জীবনের গল্প জানতে পারি। তাঁর জন্ম অবিভক্ত বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার খানখানাপুর গ্রামে, ১৯১৫ মতান্তরে ১৯১৭ সালের ১৭ জুলাই। তাঁর পিতা ক্ষীরোদচন্দ্র (মতান্তরে) ক্ষীরোদবিহারী ভট্টাচার্য ছিলেন স্কুল শিক্ষক। মা সুবর্ণপ্রভা ছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের বোন। বিজনের ছাত্রজীবনের প্রথম দশবছর খানখানাপুরেই কাটে। তারপর পিতার কর্মসূত্রে বসিরহাট, সাতক্ষীরা, মেদিনীপুর, আড়বেলে ইত্যাদি নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন আড়বেলিয়া জে. ডি. হাইস্কুল থেকে।

ছবি : গুগল

নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য

বিজনের ছোটবেলায় বাড়িতেও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। বাবা ছিলেন সাহিত্য-সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ। বাড়ীতে শেক্সপিয়ারের চর্চা ছিলো, এমনকি ঘরোয়া অভিনয়ও হতো। বাবা, মা, ভাই, বোনেদের সঙ্গে বিজনও অংশ নিতেন অভিনয়ে। দশ বছর বয়েসে যখন মানেও বুঝতেন না ভালো করে , তখন থেকেই শেক্সপিয়ার মুখস্থ বলতে পারতেন। পরে যখন মানে বুঝে পড়েছেন তখন তেমন আকৃষ্ট হননি। তাঁকে আকর্ষণ করতো গ্রামবাংলার লোকনাট্যের জগৎ। পুজোর সময় মন দিয়ে শুনতেন গ্রাম্য থিয়েটার, যাত্রাপালা, কথকথা, ঢপের গান। নিজের কথকথা করতেন তখন। গ্রামের সাধারণ অতিদরিদ্র নিম্নবর্গের মানুষের জীবন যাপন, তাদের ভাষা, জীবীকা, তাদের আমোদ প্রমোদের ধরণ এসবই মারাত্মক আকর্ষণ করতো বিজনকে। বাড়ির যাবতীর শাসন, নিষেধ অমান্য করে জেলেপাড়া, কুমোড়পাড়ায় পড়ে থাকতেন তিনি। মিশতেন টুনো, মালো, সাপুড়েদের সঙ্গে। আউল-বাউল-ফকিরদের আখড়ায় তাঁর ছিলো প্রায়ই আসা যাওয়া। এইসব লোকায়ত মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না দৈনন্দিনের জীবন যুদ্ধের সঙ্গে মিশে ছিলো তাঁর ছোটবেলা। কলকাতায় চলে আসার পরেও তিনি যোগাযোগ রেখে গেছিলেন এই মানুষদের সঙ্গে। বিজনের নাটকজুড়ে যেসব চরিত্রেরা ঘুরে বেড়ায় তারা আসলে বিজনের চোখে দেখা এই জীবন্ত মানুষগুলির শিল্পরূপ বললে ভুল হয় না।

ছবি : গুগল

সেই ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই বিজন সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে। অসহযোগ, আইন অমান্য ইত্যাদি আন্দোলনের সময় তিনি নান জায়গায় ঘুরে আন্দোলন সংগঠন করেছেন, বিদেশী দ্রব্য বর্জন, বিলিতি জিনিস পুড়িয়ে ফেলে প্রতিবাদ – এসব কাজও জোর কদমে করেছেন তিনি। এর পরবর্তীতে রাজনৈতিক মতাদর্শের বদল ঘটলেও আজীবন বিজন ছিলেন এক আদ্যন্ত রাজনীতি সচেতন মানুষ। তাঁর প্রতিটি নাটকেই তার প্রকাশ ঘটেছে।

১৯৩০ সালে বিজন কলকাতায় চলে আসেন এবং এই শহরের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে যুক্ত হন। বোর্ডিং এ থেকে আশুতোষে পড়ার সময়ে অভিনয় করেন ‘চিরকুমার সভা’ ও ‘শেষরক্ষা’ নাটকে। তাঁর গান ও আবৃত্তি শুনে নজরুল বিজনকে আহ্বান করেন তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে। এই সময়ই লবণ- আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয় এবং বিজন সেই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন, ফলে বি.এ. পড়াতেও তাঁর ছেদ ঘটে। জনহিতকর কাজের টানে কলকাতায় আসার পর তিনি দক্ষিণেশ্বর বেলুড়মঠেও যাতায়াত করতেন। ১৯৩৪-১৯৩৫ সালে বিজন যোগ দেন ছাত্র ফেডারেশনে। তখন বিজন ও তাঁর বন্ধুদের ‘অনামী চক্র’ নামে একটা সাহিত্য আড্ডা ছিলো , প্রতি শনিবার সেখানে আসতেন মন্মথ সান্যাল, সুবোধ ঘোষ, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য প্রমুখেরা। তিরিশের দশকের শেষদিকে বিজন কিছুদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় বছরখানেক চাকরি করে, ৪০-৪১ সাল নাগাদ সে চাকরি চেড়েও দেন। এই সময়েই শুরু হয় তাঁর গল্প লেখা। একের পর এক গল্প প্রকাশিত হত থাকে ‘আনন্দবাজার’, ‘অরণি’, ‘অগ্রণি’ ইত্যাদি পত্রিকায়। সত্যেন মজুমদার সম্পাদিত ‘অরণি’ পত্রিকার ‘সহযাত্রী’ ছদ্মনামে অন্যান্য লেখাও লিখতেন তিনি।

তিরিশের দশকের শেষ দিক থেকে সচেতন ভাবে মার্কসীয় দর্শনচর্চা শুরু করেন বিজন। আনন্দবাজার পত্রিকার রেবতী বর্মণের লেখা মার্কবাদ বিষয়ক একটি বইএর বিজনের লেখা সমালোচনা পড়ে মুজফফর আহমেদ তাঁকে ডেকে পাঠান। এরই মাঝে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বিজন। ১৯৩৯ সালে ঝোড়ো জীবনযাপনের ফল হিসেবে টি.বি. ধরা পরে তাঁর। ঢেঁকি যেমন স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে তেমনই অসুস্থতাকালীন হসপিটাল জীবনেও থেমে থাকেনি বিজনের প্রতিবাদ ও নাট্যচর্চা। এক বছর যাদবপুর টি.বি. হাসপাতালে থাকার সময় হাসপাতালের ভেতরেই গড়ে তোলেন ‘রিক্রিয়েশন ক্লাব’ আর ‘পেশেন্টস ইউনিয়ন’। রোগীদের ভালো পথ্যের দাবীতে হাসপাতাল কতৃপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন যেমন গড়ে তোলেন তেমনই আবার রোগীদের দিয়ে নাটকের অভিনয়ও করান, নিজেও অভিনয় করেন। দুটি নাটক- ‘চিকিৎসাসংকট’ আর ‘বিরিঞ্চিবাবা’। বিজনের কথায় “ঐখানেই প্রথম নাটক করি”। এই নাটক করাতে গিয়ে ছেলে এবং মেয়েরা যাতে একসঙ্গে অভিনয় করতে পারে তাই কতৃপক্ষের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে শেষ পর্যন্ত অনুমতিও জোগাড় করেছিলেন তিনি।

১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির হোলটাইমার হিসেবে যোগ দেন বিজন। সেই উত্তাল সময়ে একদিকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কমিউনিস্ট পার্টি ফ্যাসিবিরোধী জনযুদ্ধের লাইন গ্রহণ করে। সক্রিয় আন্দোলনের অংশ হিসেবে স্থাপিত হয় ‘ফ্যাসী বিরোধী লেখক শিল্পী সঙ্ঘ’। বিজন ছিলেন তার একনিষ্ঠ সংগঠন থেকেই ১৯৪৩ সালের মে মাসে জন্ম হয় ‘ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ’( আই পি টি এ) –এর। পার্টি থেকে নতুন নাটক লেখার জন্য তরুণ লেখকদের মধ্যে প্রচার চালানো হচ্ছিলো। এই প্রচারে সাড়া দিয়ে বিজন লিখলেন ‘আগুন’। মন্বন্তরের প্রথম পর্যায়ে খাদ্য বণ্টন ব্যবস্থার অসাম্য নিয়ে লেখা এই নাটক। নাটকটি ‘অরণি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গণনাট্য সঙ্ঘের প্রযোজনায় ‘আগুন’ প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৯৪৩ সালেই নাট্যভারতী মঞ্চে। ১৯৪৩ এই বিজন রচনা করলেন ‘জবানবন্দী’ নাটক, প্রকাশিত হলো ‘অরণিতে’, আই পি টি এ-র প্রযোজনায় স্টার থিয়েটারে অভিনীত হলো ১৯৪৪সালে। এর পরেই বিজন লিখলেন তাঁর যুগান্তকারী নাটক ‘নবান্ন’। মাত্র ৯দিনে। মন্বন্তরের রূঢ় বাস্তবের জীবন্ত দলিল এই নাটক, মঞ্চস্থ হলো ১৯৪৪এর ২৪ অক্টোবর শ্রীরঙ্গম মঞ্চে, গণনাট্য সঙ্ঘের প্রযোজনায়। বিজন নিজেও অসামান্য অভিনয় করলেন প্রধান সমাদ্দারের চরিত্রে। বাংলা নাটকের ধারায় প্রতিবাদী, শ্রেণি সংগ্রাম সচেতন নাটকের এর নতুন ধারার সূত্রপাত হল ‘নবান্ন’এর মাধ্যমে।

এরপর বেশ কিছুদিন বিজনের সৃষ্টিকর্মে ছেদ পরে। তার কারণ ১৯৪৬ এ পার্টির সঙ্গে ঘটা মতাদর্শগত সংঘাত। এই সংঘাতে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। সংসারীও হন এই ১৯৪৬এই। বিবাহ করেন মহাশ্বেতা দেবীকে, ১৯৪৮ জন্মালেন একমাত্র সন্তান নবারুণ। পার্টি ও আই পি টি এ-র সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শ গত দূরত্ব আর কাটেনি বরং বাড়তেই থাকে, ’৪৮ সালে গণনাট্য সঙ্ঘ ত্যাগ করেন বিজন।

‘জীয়নকন্যা’ গীতিনাট্যটি লেখা হয়েছিলো দেশভাগের আশঙ্কায়, মাত্র ১৮ দিনে। এই নাটকটি রেডিও প্রোডাকশন হয় ১৯৪৭। আর ’৫০ একবার মাত্র মঞ্চ প্রযোজনা হয়। বিজন সেই প্রযোজনায় লোকনাট্যের ধরণকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। শ্রমিক আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে এইসময়েই লিখছেন ‘অবরোধ’ নাটক। লিখছেন ‘মরাচাঁদ’ একাঙ্ক।জীবিকার প্রয়োজনে দুবছর বম্বের শিল্পজগতের সঙ্গে যুক্ত হলেও বিজনের স্বাধীন মন সেখানে প্রাণের আরাম পায় নি, ফলে আবারও কোলকাতায়।

কলকাতায় ফিরে বিজন তৈরি করলেন ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’ নামের নাট্য সংস্থা। পরবর্তী কুড়ি বছর তিনি ছিলেন এই থিয়েটারের নাট্যকার, পরিচালক, প্রযোজক আবার অভিনয়ও করেছেন।মঞ্চস্থ করেছেন একের পর এক নাটক ‘কলঙ্ক’, ‘মরাচাঁদ’, ‘গোত্রান্তর’, ‘ছায়াপথ’, ‘মাস্টারমশাই’, ‘দেবীগর্জন’, ‘গর্ভবতী জননী’। শোষিত, নিপিড়িত, সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের অধিকার আদায় করে নেওয়ার লড়াই-এর কথাই শিল্পীর নিজস্ব ভাষায় নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে এইসব নাটকে। ‘দেবীগর্জন’ লেখার সময় থেকেই গ্রেট মাদারের তত্ত্ব বিশেষভাবে স্থান পেয়েছিলো তাঁর মনে।

‘ক্যালকাটা থিয়েটর’ ছেড়ে ১৯৭০ সালে তিনি গড়ে তুললেন ‘কবচকুণ্ডল’ নাট্যদল। প্রযোজনা করলেন ‘কৃষ্ণপক্ষ’, ‘আজ বসন্ত’, ‘চলো সাগরে’। বিজনের এই পর্বের নাটকে মার্কসীয় চেতনার পাশাপাশি লোকায়ত ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, ভারতীয় ও লোকায়ত দর্শন প্রকটভাবে উঠে এসেছে। তবে এক অস্তিবাদী জীবন-সংগ্রাম চেতনার দায়িত্ব শেষ অবধি পালন করে গেছেন নাট্যকার বিজন।নাটকের সঙ্গে বিজনের আত্মিক যোগ আক্ষরিক অর্থেই আমৃত্যু- ১৯৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারী মারা যাচ্ছেন তিনি, আর তার আগের দিন রাতেও অভিনয় করছেন ‘মরাচাঁদ’ নাটকে। আজীবন বিজন যা বিশ্বাস করে এসছেন তাই বলতে চেয়েছেন তাঁর নাটকে। তাঁর যাপিত জীবন আর তাঁর নাট্যজীবনকে আলাদা করে দেখতে গেলে তাই ভুল থেকে যাবে সেই দেখায়। বিজন ভাট্টাচার্যের ক্ষেত্রে তাঁর নাটকই জীবন, জীবনই নাটক।

পশ্চিমবঙ্গে সংস্কৃতির রাজনৈতিক ব্যবহার - সুমন নাথ

প্রাবন্ধিক : সুমন নাথ

অনেকের কাছেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি ব্যাপারটা কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো। রাজনীতি রাজনীতি, সংস্কৃতি সংস্কৃতি, এমনটাই বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত আমরা। বাড়ির ছেলে মেয়েকে আমরা রাজনীতি করতে বারণ করি কিন্তু ক্লাবে ২৫শে বৈশাখে পাঠিয়ে দিই – “বাবা বাছা, গানটা, কবিতাটা করে আয়”। গানে কবিতাতে রাজনীতি নেই এই বিশ্বাসে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ গড়পড়তা সংস্কৃতি বলতে বুঝে এসেছেন ২৫শে বৈশাখে রবীন্দ্রজয়ন্তী, বছরে একটা বইমেলা, আর এলিট লোকের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গিয়ে সিনেমা চর্চার ভান করা। দেশের সংস্কৃতির পীঠস্থান ধরে নিয়ে (কেউ বলেনি কিন্তু, এমন কোনও খেতাব এই শহর কোনোদিন পেয়েছে বলে শুনিনি) বাঙালি কাগজের বই, পর্দার বই- মানে সিনেমা আর রবি ঠাকুর নিয়ে দিব্য দিন কাটিয়েছে ২০১১ পর্যন্ত।

ছবি : গুগল

নন্দন, রবীন্দ্রসদন এই সংস্কৃতির রাজধানীর রাজভবন কিংবা রাইটার্স ধরে নেওয়া ছিল এক সহজাত প্রবৃত্তি। আর তার সঙ্গে অন্য সকল প্রকার সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিকে কিঞ্চিত খাটো করে রাখা ছিল একটি বহমানতা। ২০১১ সালের পরেই যে নতুন সরকার এলেন, তাঁরা এই বাঙালি-র সংজ্ঞার মধ্যে বহুদিনের সযত্নে লালিত–পালিত উচ্চমার্গের সংস্কৃতি (high culture), যা কিনা রেসিজম এর সামান্য বিটনুন, এবং অবজ্ঞার অসামান্য চাট মশলা সহযোগে সংস্কৃতি নামক তন্দুরির সঙ্গে পরিবেশিত হচ্ছিল তাকে ধাক্কা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একদল সুপ্রতিষ্ঠিত, স্বনামধন্য সমাজ বিশ্লেষক তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে subaltern খুঁজে পেলেন।

ছবি : গুগল

এই subaltern জমি দালালী করে, কাট মানি খায়, মিথ্যেকথা বলে, সি পি আই এম কতৃক সুপ্রতিষ্ঠিত মারপিটের সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই subaltern প্রাসাদ বানায়, যে কোনো রকমের আন্দোলনকে দমিয়ে দিতে চায় কিন্তু তবুও এরা subaltern। এই সমাজ গবেষকের দল প্রান্তিক লেখকের মিথ্যে ও ভুলে ভরা লেখাকে সযত্নে তুলে ধরেন বিশ্বের আঙিনায়। সে সব নাকি subaltern সংস্কৃতির মণিমুক্ত। তো, এই লেখাটা আমাকে পেয়েছে এই পুরো ঢপবাজিটাকে একটু নেড়ে চেড়ে দেখার জন্য। মোটের ওপর এটুকু বোঝা যায় যে সংস্কৃতিকে সংস্কৃতি বলে জানতে অভ্যস্ত আমরা, তা আমরা মানি বা না মানি সততই ক্ষমতার আশেপাশে বিচরণ করতে পছন্দ করে। মানে এই ধরুন, কদিন আগে যে সকল লোকজন dover lane এ বসে গান শুনতে শুনতে না ঢুললেই তাঁকে সংস্কৃতিবান বলে ভাবা প্র্যাকটিস করেছিল তারাই এখন subaltern শুনে বুঝে বেশ তৃপ্ত। অতি সম্প্রতি এই ২০২১ সালের গেল গেল রব তোলা ভোটের আগে আবার subaltern হিন্দুত্ব নিয়ে বেশ লাফালাফি দেখা গেছিল এসব কী? একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক।

ছবি : গুগল

এই ধরুন বইমেলা, film festival, উৎসবের মত করে মে দিবস নভেম্বর বিপ্লব উদযাপন ইত্যাদি যে সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক মান্যতা দেয় তা একটি আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার প্রয়াসের অংশ। এই ধরনের প্রয়াস যেমন এক বামপন্থী সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক করতে চায়, তেমনি এর বাইরে পড়ে থাকা অগণিত লোকসংস্কৃতিকে অচিরেই low culture এ রুপান্তরিত করে ফেলে। এই ট্র্যাডিশন দীর্ঘমেয়াদী স্তরে, একটি বিশেষ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক নির্ভর সংস্কৃতির জন্ম দিতে পারে, যা পশ্চিমবঙ্গবাসী দেখেছে। বামপন্থী রাজনীতি খুব সহজেই দুর্গাপূজার মত পপুলার সংস্কৃতিকেও ব্রাত্য রেখেই শাসন চালাতে পেরেছে।

ছবি : গুগল

এর মূল কারণ হলো একটি পৃথক সাংস্কৃতিক ভাষা এবং ভাষ্য তৈরি করা এবং একটি শক্তপোক্ত সংগঠন বামেদের ছিল। এই সংগঠনকে ভিত্তি করে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাজ্য জুড়ে আবর্তিত হতো তা অচিরেই সমস্ত low culture এবং চিরায়ত সামাজিক মাধ্যমগুলিকে অবদমন করে ফেলেছিল। ফলত, সর্বত্র রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহনে পার্টির সংগঠন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে নিত। মানে কে আবাস যোজনার বাড়ি পাবে, কাকে বিয়ে করে সেই বাড়িতে থাকবে এবং কাকে কাকে নেমন্তন্ন করবে সেটা প্রায়শই পার্টি ঠিক করে দিত। যদি সমসায়িক রাজনীতিকে সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখি, তাহলে একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে, ঠিক এই ফাঁক দিয়েই বিরোধী রাজনৈতিক সংস্কৃতির উদ্ভব, পরিণতি এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন। রাজনৈতিক পালাবদলের বহু আগেই কলকাতার সমস্ত পূজা উদ্যোগ তৃণমূলের heavyweight নেতাদের হাতে চলে এসেছিল। সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির সতত পরিবর্তন এই সময় থেকেই। অর্থাৎ dover lane যাইনা, শুধুই টুনির মা ভালো লাগে তার মানে এই নয় যে আমাদের সংস্কৃতির কোন মূল্যই নেই। কতকটা এমনই একটি কথা শুনে চমকে গেছিলাম ২০১০ সালে বাঁকুড়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামের আমারই এক সমবয়স্ক আদিবাসী ছেলের সরকার পরিবর্তন হলে দাবি ছিল তাঁদের সংস্কৃতির প্রতি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। অভিমান ঝরে পড়ে সে ছেলের গলায় “শুধু তোমাদের নাচগান, তোমাদের রবীন্দ্রসঙ্গীত? আর তোমরা আমাদের চিনেছ শিলাজিত দিয়ে!” “তা বটে,” আর একটা বিড়ি ধরাতে ধরাতে আমি হোঁচট খাই। অনেক দূরে নদী বাঁধের পাশ থেকে একটা মাদল বুঝি বাজছিল সেদিন। ঠিক তার দু বছর পরে মানে ২০১২ সালে দেখলাম মকর সংক্রান্তির মেলার আমূল পরিবর্তন। সংক্রান্তি, শিকার উৎসব সর্বত্রই পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিজেদের স্টল সাজিয়েছেন। দারুণভাবে সরকারি বিভিন্ন স্কিমের প্রচার, সচেতনতা বৃদ্ধির শিবির এবং মেলার জন্য অর্থ সাহায্য সবই চলছে। বাঁকুড়া পুরুলিয়ার মত জায়গায় সাঁওতালি নাচের প্রতিযোগিতা শুরু হল বৃহৎ আকারে আর বিজয়ীদের সুযোগ মিললো শহরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিজেদের সংস্কৃতি কে তুলে ধরার। গুশকরায় যে ডোকরা গ্রাম অন্ধকার এক বস্তির মত পড়ে ছিল, সেখানে তৈরি হল কমিউনিটি সেন্টার। ঝাঁ চকচকে প্রবেশ তোড়ন। একই ভাবে পটচিত্র গ্রামের মধ্যেই শুরু হল প্রশিক্ষণ কর্মশালা, museum। যাত্রা উৎসব, মাটি উৎসব, দুর্গাপূজা carnival ঠিক যতটা শহুরে লোকের মনে নতুন ধরনের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল নির্মাণ শুরু করেছে, তেমনই আগের একটি বেশ elite ক্লাস সংস্কৃতিকে প্রশ্ন করেছে, ভেঙ্গে দিয়েছে।

 

ছবি : গুগল

এই নতুন ধরনের যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল নির্মিত হল পশ্চিমবঙ্গে তা অনেকের কাছে subaltern, অনেকের কাছে lumpen বাজি, অনেকের কাছে গেল গেল সব গেল কাছা খুলে যাওয়া অবস্থা। কিন্তু কেউই এই নব্য কলেবরে সজ্জিত সংস্কৃতির ক্ষমতাকে অস্বীকার করবার ক্ষমতা রাখেন না। প্রশ্ন উঠতে পারে, এইভাবে সংস্কৃতির রাজনৈতিক ব্যবহার করা কেন? কী এমন দরকার পড়ল? এর উত্তর খুঁজতে হলে সবার আগে এটা মানতে হবে যে ২০১১ সালের আগেও সংস্কৃতির রাজনৈতিক ব্যবহার ছিল, বেশ জোরালো ভাবেই ছিল। কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকে সংস্কৃতি রাজনীতির একটি মূল প্রকরণ হয়ে উঠল কিভাবে? এর একটি প্রধান কারণ তৃণমূলের সংগঠন তৈরির প্রতি অনীহা। বামেদের যে সাংগাঠনিক ভিত্তি তৈরি হয়েছিল সে সব ভেঙ্গে ফেলে এক নতুন ধরনের সামাজিক মাধ্যম তৈরি করার চেষ্টা তৃণমূলের ছিল না, বরঞ্চ, স্থানীয় প্রভাবশালী এবং স্থানীয় সংগঠনগুলির রাজনৈতিক ব্যবহারই একমাত্র বিকল্প হিসেবে উঠে আসতে থাকে। তৃণমূল স্তরের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলি। যে সকল প্রকল্পে একসঙ্গে অনেকের উপকার করা যায় না, সেগুলি কাকে দেওয়া হবে এবং কে বাদ যাবে তার সুচারু বণ্টন এক কঠিন পরীক্ষা, বিশেষত গ্রাম পঞ্চায়েতে। যে পার্টি সেখানে সহমত নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা নিত, সেই জায়গায় একজন বা কয়েকজন মাতব্বর দিয়ে খুব বেশিদিন চলা যায় না। জনমানসে অসন্তোষ তৈরি হওয়া খুব স্বাভাবিক। অথচ সংগঠন গড়ে উঠছে না। অতএব সংস্কৃতি কে ব্যবহার করা হয়ে গেল একটি সুস্পষ্ট বিকল্প। তথ্য ও প্রযুক্তি দফতরের অর্থ বরাদ্দ বেড়ে ২০১৬-২০১৭ সালেই ২০১১ সালের তুলনায় ৫ গুণ হয়ে যায়।

ছবি : গুগল

ছন্দ পতনের শুরু ইমাম ভাতা দেওয়া থেকে। দুর্গাপূজা এবং মহরম একসাথে হওয়ায় বিসর্জন বন্ধ করা থেকে সূচনা হলো একটি নতুন ধরনের সাম্প্রদায়িক-রাজনৈতিক প্রতিরোধ। সাম্প্রদায়িকতার যে গোপন কিন্তু দুর্নিবার বীজ রয়ে গেছে এ রাজ্যের মানুষের মনের গভীরে তা নিয়ে শুরু হলো এক কদর্য খেলা। যে জাদু বলে সমাজে উচ্চাসনে বসে থাকা শিক্ষিত মানুষ অবলীলায় বলে ফেলেন যে মোল্লাগুলো হেলমেট পরে না কিংবা মাস্ক পরে না, তা শিহরিত করে। একইভাবে শিক্ষিত মুসলমান মানুষ চলে যান মজলিসে, মাথা নাড়েন যখন হুজুর বলে ওঠে মূর্তি পুজা যারা করে তাঁরা শত্রু! রাজ্য জুড়ে শুরু হয় ধর্মীয় হানাহানি। দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হয় শিল্পাঞ্চলে, সীমান্ত অঞ্চলে। ঠিক যে জায়গায় তৃণমূল নজর দেয়নি, অর্থাৎ সংগঠন তৈরি করা, সেখানেই সংগঠিত হয় বিজেপি। প্রায় অপ্রতিরোধ্য তাদের গতি। লোকসভা ২০১৯ এই একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বিরোধী দল হিসেবে উঠে আসছে এবং এই উত্থান অবশ্যই ধর্মীয় রাজনীতির বিমানে চেপে। এই উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে একাধিক invented traditions উঠে আসল যেমন রাম নবমী, হনুমান জয়ন্তী, বিশালাকার জন্মাষ্টমী ইত্যাদি। এর মধ্যে রামনবমী এবং হনুমান জয়ন্তী কে কেন্দ্র করে সংগঠিত হল দাঙ্গা এবং প্রানহানি। আর.এস.এস এবং বিজেপির পাতা ফাঁদে তৃণমূল পা দিল এবং competitive communalism এর সূচনা ঘটলো। রাজ্যে এক অভূতপূর্ব হিংসা, হানাহানি, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং ঘৃণার সংস্কৃতি দানবাকারে বাড়তে লাগলো। ২০২১ এর নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গবাসী যে ভাবে বিজেপিকে আটকালো তাতে আহ্লাদিত হবার কিছু নেই। মূলত বিজেপি বিরোধী ভোটের কেন্দ্রীকরণ হয়েছে তৃণমূলের ভাঁড়ারে। তৃণমূলের service delivery কেন্দ্রিক রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন শেষ রক্ষা করতে পেরেছে। কিন্তু বিধানসভায় এই মুহূর্তে যে দুটি দল থাকছে, তাঁরা দুজনেই সাংস্কৃতিক প্রকরণকে যে কোনো উপায়ে রাজনৈতিক ব্যবহারে পিছপা হন না। Indian Secular Front এর একমাত্র প্রতিনিধি রয়ে গেলেন বাম ও কংগ্রেসের তরফ থেকেও। সে অর্থে দেখলে, এই মুহূর্তে একটি হিন্দুত্ববাদী দল ৩ থেকে আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৭৭ এ নিয়ে গেলেন, একটি বহুলাংশেই শরিয়তি ইসলামিক মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত দল ০ থেকে ১ হলেন আর বাম-কংগ্রেস বিধানসভা থেকে বাইরে থেকে গেলেন। সংস্কৃতির সুচারু ব্যবহার থেকে ধীরে ধীরে বাংলার মানুষ যে অনেক উদগ্র ব্যবহার আগামী দিনে দেখবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বঙ্গবাসী এবারে dover lane এর সঙ্গে সঙ্গে চাপাতি, ত্রিশুল দেখার জন্য তৈরি হন, কিংবা স্কুল থেকে শুরু করুন সহাবস্থানের প্রচার। সংস্কৃতি থাকবে, রাজনৈতিক ব্যবহার যেমন–যেমন দরকার তেমন–তেমন হবে, সাধের বাংলা থাকবে তো?

বিশ্বায়ন ও ক্রমে উচ্ছন্নে যাওয়া দেশজ সংস্কৃতি নিয়ে জরুরি আলাপ সারলেন - সুদেষ্ণা মিত্র।

GLOBALIZATION AND DETERIORATING POLITICAL CULTURE:

INDIA AT THE CROSSROADS

প্রাবন্ধিক : সুদেষ্ণা মিত্র

Political culture is the most popular discourse of all times. It is one of the most debated aspects of our political lives. Political culture basically describes how culture impacts politics. Every political system is embedded in a particular political culture. Its origin as a concept goes back to Alexis de Tocqueville, but its current use in political science generally follows that of Gabriel Almond. Following Almond’s definition, we can describe political culture as being composed of attitudes and orientations which people in a given society develop towards objects within their political system. Political culture is not entirely action-oriented. It also implies only ideas and beliefs about political actions and not the actions as such.” It refers not to what is happening in the world of politics, but what people believe about those happenings. And these beliefs can be of several kinds: they can be empirical beliefs about what the state of actual political life is: they can be beliefs as to goals or values that ought to be pursued in political life: and these beliefs may have an “expressive or emotional dimensions.”

In order to point out the difference between political culture and other psychological categories, Lucian Pye opines that political culture is the product of both the collective history of the political system and the life histories of the individuals who currently make up the political system. Gabriel Almond and Sydney Verba did an extensive study of political culture covering a few countries of Europe and America and concluded with a classification of political culture. But the major foci of this paper are Indian political culture and its relation with the process of globalization and the resultant changes, if any, due to globalization.

Now a few words need to be mentioned here about globalization or its process. GLOBALIZATION-The World Public Sector Report, 2002: Globalization and the State defines Globalization as’ increased and intensified flows between countries. These flows are ofgoods, services,  capital, ideas, information and people which produce national cross border integration of a number of economic, social and cultural activities.

1. In fact being multi-disciplinary phenomenon globalization offers varied meanings. Globalization stands for a host of numerous economic, technological, political, and ecological processes. In the twenty-first century, due to globalization, the world has witnessed a major transformation in political, social, and cultural spheres across the globe. According to Britton, ‘globalization is viewed as a whirlwind of relentless and disruptive change which leaves governments helpless and leaves a trail of economic, social, cultural and environmental problems in its wake.

2. Broadly speaking it can be suggested that ‘though the word globalization (as a synonym to privatization and liberalization) is more often used in its economic sense of removing trade barriers and state controls on widely the unification of peoples, cultures and various fields.

3. Globalization is multi-dimensional-number of worlds taking shape. A network of connection is all around and that is globalization is all about. Allen discussed different types of globalization among which two of them are relevant for this paper, although others are interconnected- that is, cultural globalization and political globalization. Basically, culture and politics are more influenced by the phenomenon of globalization. The influence is widespread, touching various aspects and consequencing evolution of culture, political culture awakening, formation of new politico-cultural identity due to increase in human mobility, weakening subcultures, expansion of western consumerism, etc are some of the pros and cons of globalization.

Political globalization triggers at continuous erosion of a nation state’s power whereas cultural globalization refers to homogenization and hybridization of worldwide culture. As already stated the main focus of the study here is Indian political culture at the crossroads.

The rest of the paper will try to concentrate on how Indian political culture has adopted globalized culture.

GLOBALIZATION AND INDIAN POLITICAL CULTURE– The analysts of Indian political culture have resisted themselves from depending on western methodology as they are inadequate for so many diversities. The scholars of Indian political culture can aptly be classified as classifiers, thematizers, and constructivists with their emphasis on forms and idioms of India’s political culture, consistent themes of political culture with special mention of a few human attributes, peculiar to India and politics of culture in India respectively to focus on how different political cultures evolved or disappeared. In the backdrop of such an analytical tradition, India faced globalization. In India, out of globalization, a few things ushered in like free trade, international competitiveness, choice of industries, netizenship, communication media with growing awareness of interconnectedness and interdependency. A peculiar hybrid culture has started reshaping us to make us fit into the a’ global village’. Globalization is after all a phenomenon and a process by which the world becomes a ‘global village’. Though globalization, liberalization, and privatization are three important elements of New Economic Policy (NEP) globalization alone has caused enormous economic integration with the world economy through reduction of export duties, foreign investment, the flow of foreign technology and skills. With these are added liberalization and privatization along with the resultant higher rate of per capita income, aiming at full employment, self-reliance, and reduction of inequalities and poverty. On the one hand, it has created high purchasing power of the people, but on the other, it also has spread a false notion of prosperity and growth. But the needs of the bulk of the people have been neglected. Local manufacturers and workers have been replaced by big business houses. Ithas created a new  type of consumerism that has changed the political culture of the country drastically. Rural poor have been affected, the rural agrarian economy has been affected, marginal or small-scale farmers are to adopt themselves with a new type of needs of the society.

All these have contributed to a sea change in India’s political culture. Since the 1990s right from the onset of globalization people’s attitude towards society, political institutions, their handling of political rights, usages, languages used in politics have witnessed a sea change putting India at a crossroads. The mode of relationships among people, between people and politicians has been transformed along with the transformation of the economy. The phrase like political courtesy has disappeared as the nature of the public mind has changed. The new mode of consumerism has made people more need-oriented and need also has increased with a resultant increase in political corruption. The so-called market economy has created a good market in the political field as well. Following Rajni Kothari, we can aptly analyze this. Rajni Kothari made a good analysis of India’s political culture in his book Politics in India (published in 1970). He falls in the category of thematizer so far as Indian political culture is concerned. He identifies the themes of India’s political culture about which he himself admits that they are ‘analytical generalizations that are ‘unproved’ and are bound to be ‘gross’ and are not applicable to all types of history and all sections of India’s society. But the specific political culture that has emerged after globalization can be aptly explained with the help of his thematic forms. Kothari basically develops four gross themes- tolerance of ambiguity, an image of fragmented, dispersed, and intermittent authority, a close relationship between ideology and politics, and patterns of trust and distrust in collective undertakings.

First comes the tolerance of ambiguity which is unique to India which has created an enormous amount of accommodativeness and is also marked by huge eclecticism. Indian society can tolerate varied types of value premises and doctrinal positions which has resulted in ideological flexibility and which probably has helped the globalized market economy to delve into Indian political culture because as per Kothari this tolerance has led to results such as low morale of collective orientation, excessive submissiveness or an attitude of despair or taking every action as pointless. Masses have accepted the changes without much resistance. Next comes the theme of dispersed and intermittent authority. Taking authority as an arbitral is deep-rooted in Indian culture. Authority’s attitude or control or way of dispute resolution is acceptable to everyone and this gives the political authority to manipulate the masses or popular sentiments or to redirect the mindset towards them. We can here cite the instance of demonetization policy. It was nobody’s choice but was imposed on us. On a positive note, this notion of authority has allowed it to become a catalyst of change. The third theme is the close relationship between ideology and politics. This relationship emerges out of political elites’ self-proclaimed image of ‘morality inducer’. “ As a result, Indians look upon their politicians as moral men, as exhorters, sermonizers and makers of promises. Promises are often not kept and masses forget that very conveniently and these professional lapses are widely accepted. The fourth variant is patterns of trust and distrust in collective undertakings. Unquestionable trust is often found in charismatic leadership but distrustfulness is often found in the modern political field. If we look at the chronology of events in Indian politics we can easily come to the conclusion that notion like political morality is on the descent so far as Indian politics is concerned. The coming and going or floor-crossing of MLAs and MPs before and after the election is just the perfect proof. Insensitiveness of political decision-makers or public policymakers towards the needs of the masses is also a matter of concern here. Following Kothari even if we underestimate this analysis as not a universal one but still these characteristics of Indian political culture have made it easier for the globalized culture to penetrate.

CONCLUSION: Attempts to improve the economic conditions through globalization have already been made in our country. Liberalization has ushered in. But along with globalization, a particular political culture is on the rise which is qualitatively deteriorated. Basically, this is a kind of imposed one to suit the changing needs of the time. The kind of soft adaptive political culture that India has inherited basically is helping our political authority to do this. Globalization has both positive and negative impacts on countries.

এযাবৎকালের সেল্যুলয়েডের ফেলুদা'র পাশ-ফেলের যুক্তি সাজালেন-সুকন্যা সাহা।

লেখক : সুকন্যা সাহা

ফেলুদার গল্প পড়তে বা দেখতে বসলে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। আসলে সেই ১৯৬৫ সালের ‘সন্দেশ’ এ আবির্ভাবের পর থেকেই বাঙালির আদি ও অকৃত্রিম সুপারহিরো বলতে এই চারমিনার ফোঁকা গোয়েন্দা ভদ্রলোকই ছিলেন। অন্তরঙ্গে এবং বহিরঙ্গে আপাদমস্তক বাঙ্গালিয়ানায় মোড়া, জিনিয়াস স্রষ্টার চারিত্রিক ধার ও ভার নিয়ে গল্প উপন্যাস মিলিয়ে ৩৫ খানা রহস্যের সমাধান করে আপাতবিশ্রামে আছেন। “আপাত” শব্দটা বললাম কারণ, শার্লক হোমসের গল্প এবং চরিত্র নিয়ে যেভাবে নতুনতর এবং নতুন স্তরে পর্দায় কাজ হচ্ছে, তার খানিক আঁচ বা ছোঁয়াচ ফেলুদাতেও এসে যাওয়াটা সময়ের দাবিতেই গ্রাহ্য। অথচ কোনো বিশেষ কারণে বাংলা ভাষাভাষী পরিচালকরা ফেলুদাকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ঝুঁকি নেন নি বা নেওয়ার সাহস পান নি। ভয় পাওয়ার কারণ খুঁজতে আতস কাঁচ নিয়ে পোয়ারো হওয়ার প্রয়োজন নেই। আদপে বাঙালি মাত্রেই কিছু না কিছু ফেলুদা পড়ার অভিজ্ঞতা থাকে। বাংলার ঘরে ঘরে পড়ুয়া মা মাসিমার মধ্যেও এক একজন ফেলু-বিশেষজ্ঞ বর্তমান। প্রতি সফল বা বিফল পরিচালকের ইচ্ছে জীবনে অন্তত একটা ফেলুদা কাহিনিকে চলচ্চিত্রায়িত করার। তাই এই চরিত্রে নতুনত্ব আরোপ করতে গেলেই কূপমণ্ডূক বাঙালি অন্তরে “গেল গেল” রব ওঠা অসম্ভব নয়। তবে যার যাই যোগ্যতা বা সামর্থ্য থাকুক, সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায় ছাড়া কেউ সাধারণত সহজে ফেলুদা করার সুযোগ পান না। এর কারণ সুধী দর্শকের কাছে অজ্ঞাত।

ছবি : গুগল

আজকাল মানুষ বই বিশেষ পড়ে না, এটা বাস্তব সত্য কিন্তু সিনেমা তো দেখে। তবে বই পড়ানোর জন্য উপায় ফেঁদেছেন প্রকাশকরা। সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায়ের স্মার্ট সুললিত সাহিত্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইংরেজি এবং হিন্দিতেও কমিক্স ও অনুবাদ সাহিত্যের মাধ্যমে সবাইকে গিলিয়ে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা চলছে। বাংলায় কমিক্স করলেও সত্যজিৎ-এর সাহিত্যের মুন্সিয়ানা সামাল দেওয়া যায় না। তাকে ইংরেজি করলে কী হয় বলা বাহুল্য। হয়তো এই ভিন্ন ভাষায় ফেলুদার ছবি ব্যর্থ হওয়ার অতিনির্মম উদাহরণ আমরা দেখেছিলাম ১৯৮৫ এর ‘কিসসা কাঠমুন্ডু কা’ সিনেমায়। মনে রাখতে হবে তখন সত্যজিৎ স্বয়ং বহাল তবিয়তে জীবিত রয়েছেন। তাই সন্তানের ব্যর্থতার পুরো দায় তিনি এড়িয়ে যেতে পারেন না। তবে হিন্দি ফেলুদার কাস্টিং এবং বাঙালি মননে ফেলুদার ভাবমূর্তির পার্থক্যটা তিনি বিলক্ষণ বুঝতেন বলেছিলেন “যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা ফেলুদার গল্প পড়ে বড় হয়েছে, তারা কখনই শশী, মোহন আগাসে এবং অলংকারকে মেনে নেবে না”। পরিচালক সন্দীপ রায় পরে এই ছবিটি নিয়ে বহু আক্ষেপ করেছেন। তার কথায় –“শশীর মুখ বা অভিনয় ফেলুদার সঙ্গে মোটামুটি মানানসই হলেও, যেটা একেবারেই বেমানান ছিল, সেটা তার স্থূল চেহারা। সত্যি কথা বলতে, সত্তরের দশকের শশীর চেহারাটাই বোধহয় ফেলুদার পক্ষে ঠিকঠাক হত”। অন্য একটি আঞ্চলিক ভাষায় নিজেকে প্রদোষ মিত্তিরের বদলে প্রদোষ মিটার বলা ছিপছিপে ফেলুদার বদলে মেদবহুল ফেলুকাকুকে দেখার জন্য বাঙালি দর্শক আদপেই প্রস্তুত ছিল না।

ছবি : গুগল

হতাশ পরিচালকের এতই খারাপ লেগেছিল যে পরবর্তীকালে সেই ছবিটিকে আর বড় পর্দায় বা ছোট পর্দায়  প্রদর্শনের কথা ভাবেন নি।

ফেলুদা বলতেই আমাদের সামনে সত্যজিতের আঁকা সাদাকালো স্কেচগুলো এসে দাঁড়ায়। পর্দায় তাদের আনতে গেলে বাস্তবের সঙ্গে সেই ছবির ফারাকটা সবসময় কোনো না কোনওভাবে একটা তুলনার আকার নেয়। কোনো জনপ্রিয় চরিত্র সিনেমায় আনতে গেলে সঠিক কাস্টিং প্রায় অর্ধেক কাজ সেরে দেয়। আর ভুল কাস্টিং করা ছবি ভাল বা খারাপ যাই হোক না কেন, সেটা বিক্রয়যোগ্য হয় না বা সোজা কথায় দর্শক খায় না। পরিচালক যদি পাঠকের কল্পনার সঙ্গে অভিনেতাকে খানিক হলেও মিলিয়ে দিতে পারেন আর সঙ্গে যদি অভিনয়টাও করিয়ে নিতে পারেন তাহলেই লালমোহনবাবুর লেটেস্ট উপন্যাসের মতই “সেলস লাইক হটকচৌরিস” হতে বাধ্য। তাহলে এবার মোটামুটি দেখে নেওয়া যাক, পর্দায় ফেলুদার চরিত্র সৃজনে কোন শিল্পীদের আনা হয়েছে। ফেলুদার স্রষ্টা স্বয়ং সত্যজিৎ রায় মাত্র দুটো ছবি করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে আশ্রয় করে। ‘সোনার কেল্লা’ (১৯৭৪) এবং ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ (১৯৭৯) কিশোর গোয়েন্দা সিনেমার অন্যতম সেরা মানিক হিসেবে বাংলা সিনেমাপ্রেমীদের অন্তরের সিন্দুকে স্থান করে নিয়েছে। ঠিক যা বলছিলাম, সঠিক অভিনেতা নির্বাচন এবং পরিচালকের অসামান্য পরিমিতিবোধ ছবিদুটিকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল কিন্তু কাস্টিং কি একেবারেই নিখুঁত ছিল? সৌমিত্র যত বড়ই অভিনেতা হোন না কেন, ফেলুদার চেহারার সাথে তার সাদৃশ্য না থাকলে এবং ম্যানারিজম রপ্ত করতে না পারলে কোন অভিনয়ই ধোপে টিকত না। কিন্তু সত্যজিৎ-এর বর্ণনায় ফেলুদার চেহারার যে টাফনেস, সেটা সৌমিত্রর চেহারায় প্রায় অনুপস্থিত ছিল। বরং ফেলুদার সেরেব্রাল, বুদ্ধিদীপ্ত রূপটা দিয়ে এই খামতির বাউন্সারটা সৌমিত্র তুখোড়ভাবে ডাক করে গেছেন। স্বয়ং উত্তম কুমার তো অনেক বড় অভিনেতা ছিলেন। তাকে কি আমরা স্বপ্নেও কোনোদিন ফেলুদা হিসেবে ভাবতে পেরেছি? পারব না। অথবা জীবনের প্রথম ছবিতেই জাতীয় পুরস্কার পাওয়া মিঠুন চক্রবর্তী। ‘মৃগয়া’ হয়তো এক বিশাল অভিনেতার জন্ম দিয়েছিল কিন্তু বাঙালিমননের প্রদোষ মিত্তিরের ছায়া থেকেও তিনি যে শত যোজন দূরে। আসলে পাঠক এবং সত্যজিৎ-এর দর্শক হিসেবে ফেলুদার চরিত্রের যুগ যুগ ধরে বুনে চলা যে মানচিত্র সেখানে খাপ খাওয়ানো বড়ই মুশকিলের কম্মো। যাইহোক, সত্যজিৎ নিজেই সন্তোষ দত্ত মারা যাওয়ার পর আর ফেলুদা বানালেন না। সন্তোষবাবুকে তার এতটাই নিখুঁত জটায়ু বলে মনে হয়েছিল যে ‘সোনার কেল্লা’ ছবির পর তার গল্পের ইলাস্ট্রেশনেও জটায়ুরূপে সন্তোষ দত্তকেই আমরা দেখেছি। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, ফেলুদা বা তোপসের চরিত্র কিন্তু তার ইলাস্ট্রেশনে বদলান নি। তাই কেন যেন মনে হয়, সত্যজিৎ-এর কোনো “খটকা” লাগলে তিনি অন্য ফেলুদা হয়তো খুঁজে নিতেন, কিন্তু অমন জটায়ু পাবেন না বলে আর ঝুঁকি নিলেন না।

ছবি : গুগল

তাছাড়া কাস্টিং এ কমপ্রোমাইজ করা তার ভীষণ অপছন্দ ছিল। নিজের অন্যতম পছন্দের চরিত্রে কোনো সমালোচনার আঁচড় ফেলতে দেবেন না বলেই হয়তো পরিচালক সত্যজিৎ রায়, লেখক সত্যজিৎ-এর আবেগ এড়িয়ে গিয়ে চরম সিদ্ধান্ত নিলেন। এরপর বাবার ব্যাটন ধরলেন সন্দীপ রায়। বাপ, ঠাকুরদার উত্তরাধিকারে পাওয়া যথেষ্ট প্রজ্ঞা এবং সত্যজিৎ-এর সহকারী হিসেবে প্রায় সমস্ত ছবিতে থাকার অভিজ্ঞতা তাকে হয়তো করে তুলতে পারত বর্তমান যুগের এক অনবদ্য পরিচালক। কিন্তু বিখ্যাত পিতার ছায়া থেকে বেরনোর অনীহা এবং ঝুঁকি নেওয়ার ভয় তাকে অর্গলমুক্ত হতে দিল না। প্রতিভার অভাব ঢেকে দেওয়া যায় প্রচেষ্টায়। সত্যজিৎ- এর মত জিনিয়াস একজনই জন্মান কিন্তু জিনিয়াসের অক্ষম অনুকরণে মহৎ শিল্প সৃষ্টি হয় না। এবার আসা যাক মূল বিষয়ে অর্থাৎ ফেলুদার চরিত্রচিত্রণে সন্দীপ রায়ের ফিল্মোগ্রাফি। তার যথেষ্ট সুযোগ ছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক ফেলুদা এবং অন্যান্য কাস্ট নির্ধারণ করার। কিন্তু সেটা করেন নি বা সত্যিই বাংলার অসংখ্য অভিনেতাদের মধ্যে নিখাদ ফেলুদার রসদ কারোর মধ্যে পান নি। সত্যজিৎ-এর করা শেষ ফেলুদা থেকে সন্দীপের ‘বাক্স রহস্য’এর মধ্যে দূরত্ব দীর্ঘ সতেরো বছর। তার বেশিরভাগ ছবিতে ফেলুদার চরিত্রে এলেন একজন দুর্দান্ত চরিত্রাভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী। অভিনয় আর আয়ত্ত করা ম্যানারিজম দিয়ে চরিত্রের গভীরে ঢুকে পড়ার অদ্ভুত মুন্সিয়ানা আছে সব্যসাচীর। সেটা তিনি যথাসাধ্য কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু ওই চেহারা ! হাজার প্রচেষ্টা স্বত্বেও ফেলুদার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ তার নেই বা চেহারার সঙ্গেও তার মিল আছে একথা প্রবল সমর্থকও বলবেন না। তাই সৌমিত্রর ফেলুদাই এখনও আট থেকে আশির কাছে “আসল” ফেলুদা। কিন্তু মাঝের সতেরো বছরে বা ২০০৩ এর ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ করার সময় পর্যন্ত তার কাছে সময় ছিল সত্যজিৎ-এর ভাবনাকে সম্মান জানিয়ে একজন নতুন ফেলুদা খুঁজে বের করার বা নিখুঁত কাস্টিং করার কিন্তু তিনি করেন নি। সব্যসাচী নিজে বারংবার তদ্বির করে ফেলুদা হতে পেরেছেন অর্থাৎ ফেলুদার কাস্টিং এর কৃতিত্ব বা ব্যর্থতা কোনটাই পরিচালকের নয়। এটা সন্দীপ রায় নিজেই লিখেছেন তার ‘বাক্স রহস্য-টাফ ফেলুর পয়লা টক্কর’ প্রবন্ধে। সময়, স্বাধীনতা এবং সুযোগ তিনি ব্যবহার করতে পারেন নি এটা কঠিন বাস্তব। কিন্তু আমাদের আলোচ্য হল ফেলুদার চরিত্রায়ন। সেক্ষেত্রে সব্যসাচী ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’র কিঞ্চিৎ খামতি ঢেকে দিয়ে ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’তে(২০০৭) অনেকটাই পরিণত ফেলুদা হতে পেরেছেন। কিন্তু তারপরের কোনো ফেলুদাতেই দর্শককে প্রথাগত রহস্যজালে নিমগ্ন করতে পরিচালক ব্যর্থ হয়েছেন এবং অভিনেতা সব্যসাচীও সেই ফাঁদে পড়ে হাবুডুবু খেয়েছেন। দূরদর্শনের জন্য তৈরি সিরিজগুলির কথা তো বাদই দিলাম। নির্মাণ অসম্ভব দুর্বল হলে দুঁদে অভিনেতারই বা কি করার থাকে? পরবর্তীকালে আরও চারটি ছবি সন্দীপ রায় করেছেন সব্যসাচী চক্রবর্তীকে নিয়েই। সেগুলি যথাক্রমে ‘টিনটরেটোর যীশু’, ‘গোরস্থানে সাবধান’, ‘রয়াল বেঙ্গল রহস্য’ এবং শেষ ফেলুদা ছবি ‘ডাবল ফেলুদা’তে।ফেলুদা হিসেবে অভিনয়ে সব্যসাচী যতবার নিজেকে উন্নততর রূপে প্রমাণ করছিলেন ঠিক ততবারই ফেলুদার থেকে তার চেহারার সাযুজ্য আরও যোজন দূরে চলে যাচ্ছিল। শেষের দিকে দর্শক বয়স্ক এবং স্ফীত মধ্যপ্রদেশের ফেলুকে আর হজম করতে রাজি হয় নি বলেই পরিচালক এযাত্রা ক্ষান্ত দিয়েছেন। তবে ২০১৪ সালে কম বয়েসী ফেলুদা না পেয়ে উপায়ান্তর না দেখে একটা মৃদু চেষ্টা হয়েছিল ‘বাদশাহী আংটি’ছবিতে আবির চট্টোপাধ্যায়কে ফেলুদা করে। আবির ইতিমধ্যেই পর্দায় ব্যোমকেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছেন। আবার তাকেই ফেলুদার কাস্টে নির্বাচিত করার মধ্যে কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। হয়তো চিরকালের মতই সঠিক অভিনেতা খোঁজার পরিশ্রমের বিনিময়ে আবিরের স্টার ভ্যালুই তার পছন্দ ছিল। তাছাড়া আবির অভিনয়ে সৌমিত্র বা সব্যসাচীর পদবাচ্য হওয়ার যোগ্য নন অথবা তৈরি হওয়ার সেই সময় তিনি পান নি তাই এই ছবিতে আমরা ফেলুদাকে পেলাম না। বরং বহু গোয়েন্দার একটা ককটেল পেলাম। সুতরাং বলা চলে সব্যসাচী নিজ অভিনয় গুণে সন্দীপবাবুকে বহুবার বাঁচিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। পরিচালক জীবনের সায়াহ্নে এসে এবার হয়তো তার সময় হবে নতুন ফেলুদা খুঁজে নেওয়ার।

ছবির তালিকা আপাতত শেষ। আর ফেলুদা নিয়ে যা কাজ হয়েছে সবটাই টিভি বা প্রধানত ওয়েব সিরিজে। ১৯৭৯ র পরে দূরদর্শনে দুটি গল্পের সিরিজে ফেলুদার ভূমিকায় আবার নামতে দেখি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। গল্পদুটি ছিল ‘গোলকধাম রহস্য’ এবং ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’। দুটোই ধারালো গল্প কিন্তু তাদের সঠিক তারে বেঁধে ফেলার মত পরিচালক ছিলেন না বিভাস মুখোপাধ্যায়। বয়সজনিত কারণে চেহারা বাধ সাধলেও সৌমিত্র তার অভিজ্ঞতা দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছেন। বাকি ভয়ংকর খারাপ কাস্টিং এবং জঘন্য পরিচালনা তাকে নিশ্চয়ই পরে অনুশোচনা করতে বাধ্য করেছিল যে কেন তিনি এমন চিত্রনাট্যে কাজ করতে গেলেন। এরপর ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দূরদর্শন এবং ই-টিভির জন্য ৩ টি পৃথক সিরিজে ১০টি গল্প নির্মান করেন সন্দীপ রায়। জটায়ুর চরিত্রে রবি ঘোষ, অনুপ কুমার থেকে বিভু ভট্টাচার্য রা বারবার পাল্টে গেলেও ফেলুদা কিন্তু ছিলেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। বস্তুত সেই সময় থেকেই সব্যসাচী নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছিলেন প্রদোষ মিত্তিরের ভুমিকায় এবং যথেষ্ট ভাল ফেলু হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। নয়তো বিভাস ভট্টাচার্য মশাই কৃত গল্পগুলির থেকে উন্নততর তেমন কিছুই পেশ করতে পারেন নি পরিচালক। উৎসাহি পাঠক চাইলে ইউটিউব খুলে দেখে নিতে পারেন। কিন্তু বলতে পারি আশা করলে বিমর্ষ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

এরপর জাম্প কাটে সতেরো বছর পরে ২০১৭ তে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় হলেন ফেলুদা । বাংলাদেশের আড্ডাটাইমস নামক একটি ওটিটির জন্য তৈরি হল ৩ টি গল্প ‘শেয়াল দেবতা রহস্য’, ‘গোলকধাম রহস্য’ এবং ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’। এই প্রথম কেউ সাহস করল গল্পগুলোকে প্রথাগত পিরিয়ড ড্রামার মধ্যে না রেখে বর্তমানে হাজির করতে। বলাবাহুল্য এর অনুপ্রেরণা অবশ্যই বিবিসির দুনিয়া কাঁপানো ওয়েব সিরিজ “শার্লক”। যেখানে বেনেডিক্ট কুম্বারব্যাচ বিংশ শতকের নব্য শার্লক হিসেবে ২২১বি বেকার স্ট্রিটের বাসিন্দাকে আবার নতুন করে দর্শকাসনের রাজপাট ধরিয়ে দিয়েছেন অর্থাৎ চরিত্রের গঠন এবং চলন মায় পোশাক-পরিচ্ছদও একই থাকবে কিন্তু সময়টা পাল্টে যাবে। তার সঙ্গে বদলাবে ব্যবহার্য জিনিস এবং গ্যাজেটস। পরমব্রতর চেষ্টাকে কুর্নিস করতেই হয় কারণ এর আগে এই সাহস স্বয়ং লেখক- সন্তানেরও হয় নি। পরমব্রতর পর্দায় লালিত শিক্ষিত ইমেজের সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয় দর্শকের ভাল লেগেছে। তবে প্রেক্ষাপট হিসেবে বালিগঞ্জের বাড়ি থেকে সটান ঢাকার রাস্তায় রহস্য উন্মোচনটা হয়তো একটু চোখে লেগেছে। সেটা অভ্যাসের ব্যাপার। কারণ রবার্ট ডোহার্টির ‘এলিমেন্টারি’ সিরিজে জনি লি মিলার তো শার্লককে আমেরিকায় এনে বাজীমাত করেই দেখিয়েছেন। লক্ষণীয় যে, মিলারের চেহারায় কোনান ডয়েলের শার্লকের কণামাত্র চোখে পড়ে নি, আবার বিবিসি কিন্তু কুম্বারব্যাচের লুকস নিয়ে কোন ঝুঁকি নেয় নি।সত্যি বলতে কি দেখে মনে হয়েছে এই সিরিজে পরমব্রত পুরো ফেলুদা হতে চান নি। তাছাড়া তার চেহারাতেও টাফনেসের ভীষণ অভাব এবং গড়পড়তা নরম বাঙালির ছাপ। অর্থাৎ অনেক বাঙালির মধ্যে থেকেও চেহারায় যে ফেলুদা অনন্য, সেই ব্যাপারটাই নেই। বুদ্ধিদীপ্ত চাউনি, চলন, বলার ভঙ্গি, সিগারেট খাওয়ার কায়দা এসব অভিজ্ঞ অভিনেতারা রপ্ত করতে পারেন; কিন্তু চেহারায় ধার ও ভার দুইই থাকতে হয়। সেটা ওনার নেই বা ছিল না। আর তার অভিনয়ে বারবার নিজস্ব ম্যানারিজম এসে যাওয়ায় কখনও বেশ ফ্রেশ লেগেছে আবার কখনও ক্লিশে লেগেছে। তাই মিলিয়ে মিশিয়ে ফেলুদার এই আধুনিক অবতারটিকে অন্য প্রেক্ষাপটে পেশ করার প্রচেষ্টা অবশ্যই প্রশংসনীয়। অনেকেই হয়তো জানেন না যে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ‘নয়ন রহস্য’ গল্পটি নিয়ে বায়োস্কোপ নামক একটি নতুন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ৩ টি এপিসোড করা হয়। ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আহমেদ রুবেল। চেহারা থেকে ম্যানারিজম কিছুই চরিত্রের সঙ্গে মানায় নি। সমস্ত কাস্টিং এবং পরিচালনা অতীব নিম্নশ্রেণীর। অন্য জিওগ্রাফিক্যাল লোকেশনে যাওয়ার কোনো ব্যাখ্যা নেই। এমনকি যা দিয়ে খানিকটা উতরে দেওয়া যেত সেই অভিনয়ের কথা উল্লেখ না করাই শোভনীয়।

তবে আশা মরিতে মরিতেও মরে না। ২০২০ সালে পরিচালক সৃজিত চট্টোপাধ্যায় আবার আড্ডাটাইমস ওটিটিতে নিয়ে এলেন ‘ফেলুদা ফেরত’ ওয়েব সিরিজ। গল্পের নাম ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’। ওয়েব সিরিজের দাবি মেনে কাহিনি বেশ স্লথ। পাঠ্য গল্পের প্রতি অত্যন্ত আনুগত্য দেখানো হয়েছে। বড় সিনেমার মত বাজেট অবশ্যই কোন আঞ্চলিক ভাষার ওটিটি প্ল্যাটফর্মে থাকে না। কিন্তু, পরিচালক সৃজিত আসল কাজটা করে দিয়েছেন ফেলুদা এবং জটায়ু দুই মুখ্য চরিত্রে সফল কাস্টিং করে। প্রারম্ভিক ট্রেইলর দর্শনে ফেলুদার চরিত্রে টোটা রায়চৌধুরীকে নেওয়াটা ঝুঁকির মনে হচ্ছিল। কিন্তু চাবুক চেহারায়, প্রদোষ মিত্তিরের ম্যানারিজম ঘেঁটে ফেলে সৌমিত্র বা সব্যসাচীর জুতোতে পা গলাতে তার মোটেও অসুবিধে হয় নি। এই প্রথম মনে হল কোন পরিচালক সত্যজিৎ-এর বইয়ের স্কেচগুলিকেও পর্দায় ফ্রেমে হাজির করতে পেরেছেন। এমনকি বড় মুখ করে বলতে গেলে, সত্যজিৎ-এর সোনার কেল্লার পরে ফেলুদাকে এত মানানসই এর লাগে নি। মগজাস্ত্র ছাড়াও লেখকের বর্ণনে ফেলুদা অ্যাথলেটিক শরীরের অধিকারী এবং মার্শাল আর্টে সুদক্ষ। যা সত্যজিৎ-এর ছবির ফেলুদা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যেও দর্শক পান নি এবং সেই অ্যাথলেটিক ফেলুদার আক্ষেপ এই প্রথম কোনো ফেলুদার মধ্যে দর্শক মেটাতে পেরেছেন। অভিনয়ে কিঞ্চিৎ জড়তা স্বত্বেও টোটা এই চরিত্রের প্রতি যত্নবান ছিলেন। অর্থাৎ অন্যান্য ফেলুদাদের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে সৃজিতের কাস্টিং এক্ষেত্রে প্রায় দশে আট পেতেই পারে। আমরা যতই ফেলুদার চরিত্রচিত্রন নিয়ে আলাদা করে গবেষণা করি না কেন, এর সমাপ্তিরেখা টানা মুশকিল। কারণ সিনেমা আর পাঠ্য- এই দুটি মাধ্যম নিতান্তই আলাদা। বই ভীষণভাবে ইন্ডিভিজুয়াল কনসেন্ট্রেশন দাবি করে। অপরদিকে সিনেমা মাধ্যমটি একটি সমষ্টিগত কাজ যা চলতি ভাষায় টিমওয়ার্ক। যেখানে ক্যামেরার সামনে ফেলুদা হয়ে দাঁড়ানোর সঙ্গে আরও হাজারটা ফ্যাক্টর এসে দাঁড়ায়। সেসব ছেঁকে কখনই শুধু প্রদোষ মিত্রকে আলাদা করে নেওয়া যায় না। সময় বদলে যায়, পরিচালক বদলান। অর্থ যেখানে নিয়ন্তা, সেখানে দায়বদ্ধতার ওজনটাও অনেক বেশি থাকে। কেউ প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারেন, কেউ পারেন না। কোন ফেলুদা হঠাৎ করেই ক্লিক করে যেতে পারে, আবার কাউকে শত চেষ্টাতেও চরিত্রের আসনে বসানো সম্ভব হয় না। ফেলুদা অন্তত বাংলায় এমন শক্তিশালী ও জনপ্রিয় একটি চরিত্র, তাতে যেই অভিনয় করুন না কেন, দর্শকের কৌতূহল চিরকাল বজায় থাকবে। শুধু আক্ষেপ থেকে যায়, হিন্দি ভাষায় দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়রা যদি ফেলুদা করার স্বাধীনতা পেতেন তাহলে হয়তো চরিত্রটি নিয়ে সার্থক গবেষণার সুযোগ হত।

' লাল পাখি হলুদ বনে' অভিনয় নিয়ে ব্যক্তি অনুভূতির গদ্য আঁকলেন ময়ূরী মিত্র।

লেখক : ময়ূরী মিত্র

 ★ এক 

রাস্তা দিয়ে লম্বা লম্বা শিসের ডাক ডেকে ছুটে যাচ্ছে বাস গাড়ি। লোকজনে থিকথিক। তার মাঝে হুট বলতে চোখ উল্টে মরে গেল লোকটা। একদম দমাশ করে।  সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে দেখলেন অভিনেতা। মৃত্যুদৃশ্য। মৃদুমন্দ বেদনা বা উথাল পাতাল বিহ্বলতা—কিচ্ছু হলো না তাঁর। সত্যি বলতে অচেনার বিপর্যয় কতটুকুই বা বিব্রত করে পাশের দর্শককে! দর্শককরূপী আরেক অচেনা মানুষকে। তো হলো কী— নিজের ভেতরে অনুভবের অভাব বুঝে অভিনেতা অস্থির হলেন। মানুষের মৃত্যুতেই যদি minimum শোক না হয় কেমন করে মঞ্চে গাঁথবেন মানুষের গাথা? দৌড়লেন নাট্যগুরু স্তানস্লাভস্কির কাছে। 

নিজের empty হৃদয়টাকে বারকয়েক ঝাঁকিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করলেন স্লাভস্কিকে — আপনি যে বলেছিলেন মঞ্চে দুঃখ দেখাতে গেলে বাস্তবের দুঃখে নিজেকে খানিক খেলিয়ে নিতে হয়। ওই ধেড়ে দামড়া লোকটার মরণ দেখে আমার তো বিরক্তিই আসছে। যাই বলুন—হঠাৎ মরে গিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে লোকটা খুবই কাণ্ডজ্ঞানহীনের কাজ করেছে। এছাড়া আর কিছুই মনে আসছে না আমার। এইটুকু অনুভব নিয়ে মঞ্চে এবার কী করব আমি?

স্লাভস্কি নিরুত্তেজ। নাট্যশিক্ষক তিনি। শেখাবার প্রখর বাসনাকে সবসময় শিক্ষার্থীর সামনে প্রকাশ করলে অনেকসময় তর্কই বাড়ে — তত্ত্ব প্রসারিত হয় রাবারের মতো। মাঝখান থেকে অভিনেতার দর্শন মন ও অনুভব থেকে সরে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। স্লাভস্কি তাই হয়তো কিচিরমিচির হেসে কেবল বললেন— কাল একবার যেও ঐ রাস্তায়। আর হ্যাঁ—যাওয়ার সময় রাস্তাটা ভালো করে খেয়াল করতে ভুলো না। 

ক্রমশ মেজাজ হারাচ্ছেন অভিনেতা।—- কেন কাল আবার কী হবে! আরেকটা মরবে নাকি? তাহলেও তো ঐ এক–একই—একই—হবে আমার। আরেকটা অচেনা মরবে। আরেকটু বিরক্তি বাড়বে। তারপর সে বিরক্তি ভরা মনে মঞ্চে ফোটাতে হবে বেদনা! নাহ! এতো বড় ঝামেলা!

বলেও গেলেন কিন্তু অভিনেতা। ফিরেও এলেন। —-আজ তো রাস্তা শুনশান। আহা! কাল যেন বড়ো গাড়ির ভিড় লেগেছিল। “– — বলে চলেছেন অভিনেতা আর মস্কো থিয়েটারের আচার্য দেখছেন অভিজ্ঞতা বলতে বলতে আজ যেন বড়ো শান্ত নম্র হয়ে যাচ্ছেন তাঁর বদমেজাজি শিষ্যটি। কেবল একটি স্তব্ধ রাস্তার বর্ণনায় নিজেকেও যেন খেয়াল করছেন না এতকালের extremely selfconscious অভিনেতা।

পরপর সাতদিন একই রাস্তায় চলাচল চলল অভিনেতার। ঠিক সাতদিন বাদে কাঠফাটা দুপুরে ঐ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বড়ো ভারাক্রান্ত লাগছে যেন হৃদয়! অভিনেতা ভেবে চলেছেন একমনে —আহা! জীবন কী অনির্দিষ্ট! সাতদিন আগের দিনটা আজ আর কই? সেদিন যে ছিল আজ সে নেই। কোথাও নেই। আজ রাস্তায় অন্য যাত্রী। অন্য যানে চলেছে সে।  জীবন মৃত্যুর gap খুঁজে না পেয়ে অভিনেতা এবার ছুটছেন মঞ্চের দিকে। ওহ একটি মানুষের চলে যাওয়া এত মহীয়ান? তার দুহাতের মুঠোয় ঝরছে কত কষ্ট কত হর্ষ। সে কষ্টের কত রঙ! সে হরষের এত আভরণ!

খুঁজতে খুঁজতে হন্যে হয়েছেন অভিনেতা। প্রস্তুত। মঞ্চে নামবেন।

আরো খুঁজতে হবে যে।

হ্যাঁ — মঞ্চে। 

মঞ্চেই।

ছবি : গুগল

★ দুই 

জোড়া গাঢ় লাল শাড়ি দেখেছিলাম একবার! একবারে একই quantity ও একই shade এর দুটি লাল। লালের নিখুঁত পরিমিতির মধ্যে একটির সাথে আরেকটির তফাৎ কেবল তাঁতীর একটি ভুলে। একটি ভুলভাল বুননে। কী করে যেন একটি লাল শাড়িতে আচমকা দুটো হলুদ সুতোর ফিতে পাড় বোনা হয়ে গিয়েছিল। হলুদের এবড়োখেবড়ো রেখায় মনে হচ্ছিল — বোনার সময় কোনো pre-plan ছিল না শিল্পীর। ছিল না বলেই হলদি পাড় কোনো কোনো জায়গায় ফিকেও হয়ে গেছিল। ফুটছিল এক নতুন রঙ। হলুদচন্দন। আর সুমহান লাবণ্যে ভরেছিল ভুল হলুদে গাঁথা লাল শাড়ি। একই লাল ভেঙে চুরচুর হয়েছিল দুটি স্বতন্ত্র বর্ণে।

মাথাখারাপ হয়েছিল অভিনেতা ময়ূরীর। কিনেছিল সে ওই আলুথালু লালটাই। যেখানে হলুদ এসে আচমকা ফিচলেমি করেছে মাত্তর এট্টুখানি জমিতে। হ্যাঁ গো। ১৪ হাত রাঙা শাড়িতে হলদে ফিতে মাত্র এক আঙ্গুল। কী তারও কম! অথচ গরিমাখানা দ্যাখো একবার!

 থিয়েটারের নন্দনই বলুন আর দর্শনই বলুন —- অনেকটা ঐরকম। মঞ্চের কোনো একটা জায়গায় একটি নধর ফোঁকর তৈরি হওয়া কি অভিনেতার শরীরে অল্প মোচড় —– কিংবা ধরুন অনেকক্ষণ চলতে থাকা আবহে হঠাৎ একটা বেকায়দা tune যে কীভাবে নিমেষে বদলে দেয় নাটকটাকে! নির্দেশক বা অভিনেতা কেউই ধরতে পারেন

ছবি : গুগল

না। দু মিনিট আগেও বুঝতে পারেন না — কাঁচের গুলি সাইজের সুন্দর সার বেঁধেছে তাঁর নাটকে!  

ভেবে দেখুন একবার। আকাশে চোখ তুলে একবার দেখুন ভ্রমণলিপ্সু পাখিগুলো —ওই যে —ওইইই যে! পাকসাট দিচ্ছে পাশাপাশি। তারা চলে পাশে পাশে কিন্তু ডানা নাড়ায় যে যার নিজের মতো। অচেনা বোলতানে। 

Yes। ঠাস লালের শাড়ি বদলে ভুলের হলুদ ছোঁয়া শাড়ি গায়ে মঞ্চে নেমেছিলাম প্রথম শো এ। ভুল কস্টিউমেই অচেনা কোনো দর্শকের বেতালা খুশি পুলক জাগিয়েছিল আমার মনের সর্বাঙ্গে। নির্দেশক মনোজ মিত্র ভ্রু কুঁচকেও finally মুচকি হেসেছিলেন।

Darling Audience! Just Luv u baby!

'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু,দাপটে' বহুদূর' দিনাজপুরের বিখ্যাত 'দাপট-কালী'এর গল্প শোনালেন - বিধান,স্নিগ্ধা

লেখক : বিধান

লেখক : স্নিগ্ধা

দিঘির শীতল বাতাসের সঙ্গে দেবীর মাহাত্ম্য অনুভব করলে আধ্যাত্মিক ভয়ে শরীর রোমহর্ষক হয়। এমনই অনুভব হবে হিলি ব্লকের, ধলপাড়া পঞ্চায়েতের চকদাপট এলাকার দাপটকালী মাতার মন্দিরে পৌঁছালে। ঐতিহাসিক নিদর্শন থেকে বর্তমানের গল্পকথা,। সবমিলিয়ে কালীশক্তির উপাসনায় এক রোমাঞ্চকর অনুসন্ধিৎসা গড়ে তোলে। মাতৃ আরাধনার রীতি-নীতি থেকে পুণ্য অর্জন, সবটাই আনকোরা।

লোকমুখে প্রচলিত, কয়েকশো বছর পূর্বে শ্রী নদীর জলে ভেসে এসেছিলো দাপটকালী মাতার ‘মুখা’ (মুখ আকৃতি বিশেষ,স্থানীয় নাম ‘চামুণ্ডা’)। সেসময় নদীর জল থেকে সেই ‘মুখা’; (চামুণ্ডা) তুলে নিয়ে পূজার্চনা শুরু করেছিলেন ধলপাড়া এলাকার কোনও এক ব্যক্তি। তারপর থেকে পুজো হয়ে আসছে দাপটকালী মাতার। আবার ইতিহাস গবেষকরা বলেন, সুপ্রাচীন পাল বা সেন আমল থেকেই দাপটকালী মাতার পুজো প্রচলিত ছিলো। মন্দির প্রাঙ্গণে উদ্ধার হওয়া ইটের নির্দশন থেকে তার প্রমাণ মেলে। আবার মন্দিরে বেশ কয়েকটি পাথরের মূর্তি থেকেও তার উল্লেখ পাওয়া যায়।

প্রত্যেক বছর চৈত্র সংক্রান্তি তিথিতে দাপটকালী মাতার বাৎসরিক পুজো অনুষ্ঠিত হয়। ৯ দিন ধরে চলে মায়ের বাৎসরিক পুজো। চৈত্র সংক্রান্তি তিথির ৯ দিন পূর্বে ঘট প্রতিস্থাপনের মধ্যদিয়ে মায়ের পুজোর সূচনা হয়। তান্ত্রিক মতে মায়ের পুজো অনুষ্ঠিত হয়। একজন ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও একজন দেবাংশী, মায়ের পুজো করেন। মায়ের পুজোর জন্য, ‘বিষহরি’ তালে নিজস্ব ঢাকের বাজনা রয়েছে। দাপটকালী মাতা মন্দিরে ‘চামুণ্ডা’ রূপে পূজিত হন।

ছবি : গুগল

মায়ের বাৎসরিক পুজোয় ‘ভক্ত’-এর (পূজার্চনার বিশেষ রীতি) প্রথা রয়েছে৷ মূলত পুরুষেরা সাতদিন, পাঁচদিন, তিনদিনের ‘ভক্ত’(নিয়মানুবর্তী) থাকেন। ওই দিনগুলিতে উপোস থেকে মায়ের পুজোয় অংশগ্রহণ করেন তারা। মানতপ্রার্থী মহিলারা চুল ছেড়ে মাথায় গোবর, আলতা, সিন্দূর, দুধ দিয়ে ঠাকুরের গায়ে আলপনা দিয়ে মানত অর্পণ করেন।পুণ্যার্থীরা মাথায় করে বাঁশের ডালায় ফলফলান্তি এনে,তা দিয়ে মায়ের কাছে পুজো নিবেদন করেন। মায়ের পুজোয় পাঠাবলির রীতিও রয়েছে।

মায়ের পুজোয় উল্লেখযোগ্য হলো- পৈতা পরিধান পর্ব, খাঁপর পুজো, শ্মশান খেলা, বাসলিকালীর পুজো, বুড়াকালীর পুজো, নাগর ভাঙা। দেবীর গর্ভগৃহের মূল পুজো অনুষ্ঠিত হয় চৈত্র সংক্রান্তি তিথির দুপুরে। মায়ের সেই পুজো মধ্যাহ্নে সম্পন্ন করতে হয়। রাত্রিতে মায়ের বিসর্জনের পুজো অনুষ্ঠিত হয়।

 

ছবি : গুগল

প্রবীণেরা বলেন- কয়েক দশক পূর্বে পুজোর সময়, মন্দিরের পার্শ্ববর্তী দিঘি থেকে ভেসে উঠতে দেখা যেতো এক কাসার থালা। পুজোর সামগ্রী, দ্রব্যাদি পূর্ণ থাকতো থালায়। পুজোর পরে সেই থালা দিঘিতে ভাসিয়ে দিতে হত। আবার গ্রামের কোনও মানুষের কোনও প্রয়োজনে দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে মায়ের কাছে প্রার্থনা করলে, প্রয়োজনীয় সামগ্রী কাসার থালায় করে ভেসে উঠত।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে, অনিয়মের কারণে মায়ের রোষে পড়ে সেনারা। দুইজন সেনা জওয়ানকে সাপে কামড়ায়। মন্দিরে উপস্থিত তেঁতুল গাছ থেকে সেই সাপ সেনা জওয়ানদের শরীরে পরে ও তারপরে তাদের দংশন করে। তারপর থেকে সৈনিকদের তরফে মন্দিরে পূজার্চনা শুরু করা হয়। যুদ্ধজয়ের জন্য মানতও করেন তাঁরা। মুক্তিযুদ্ধ জয় করে ফিরে যাবার সময় তাঁরা টিন দিয়ে মায়ের মন্দির নির্মাণ করে দেন।

দাপটকালী মাতা ছাড়াও বিকটকালী মাতা বলেও এই মায়ের পরিচয় পাওয়া যায়। দাপটকালী মাতার নাম থেকেই ধলপাড়া পঞ্চায়েতের দুটি গ্রামের নামকরণ হয়েছে। চকদাপট ও কিসমতদাপট গ্রাম দুটির নাম মায়ের নাম থেকে অনুসৃত। কালক্রমে মায়ের দৃষ্টিনন্দন মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে বর্তমানে। তারসঙ্গে আরও ৯টি ছোটো মন্দির নির্মিত হয়েছে।

ঐতিহাসিকতা থেকে মাহাত্ম্য, আধ্যাত্মিকতা থেকে কালী চেতনার প্রসার, রোমহর্ষক পর্যটন থেকে পুণ্য অর্জনের বিশ্বাস- এসবের সূত্রেই চির ঐতিহ্যবাহী ত্রিমোহিনীর দাপটকালী মাতার মন্দির।

উৎপল দত্তের সুবিখ্যাত " চায়ের ধোঁয়া' র জাত চেনালেন - সুমন দে।

লেখক : সুমন দে

সাহিত্যিকেরা fictional চরিত্রের সঙ্গে কারবার করতে করতে যখন হাঁপিয়ে ওঠেন তখন সেই কল্পিত পরিস্থিতির বাইরে বেরিয়ে তাদের মনের দুর্দমনীয় স্বীকারোক্তিগুলিকে প্রকাশ করতে তারা তৎপর হন। “;নিরব সাহিত্য কখনোই সাহিত্য-পদবাচ্য হতে পারে না”; – এই কথায় বিশ্বাসী সাহিত্যিকেরা তাদের হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা সাহিত্যচেতনাগুলিকে কখনোই পর্দার আড়ালে রাখতে পারেননি। এটা তাদের মজ্জাগত অভ্যেস। কিন্তু সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিষয় হল এই স্বীকারোক্তিগুলিকে তারা কীভাবে পাঠকমহলে প্রস্তুত করছেন। আমরা বঙ্কিমচন্দ্রের মত প্রাতঃস্মরণীয় উপন্যাসিককে দেখেছি উপন্যাস ছেড়ে নিজের কথা সরাসরি প্রবন্ধের মাধ্যমে বলতে। তেমনই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়- সহ প্রথম সারির সাহিত্যিকেরা অনুরূপ কাজ করেছেন। নাটককার উৎপল দত্তও নাটকের চেনামহল থেকে বেরিয়ে এসে গদ্যের সাহায্য নিলেন। তাঁর বেশ কয়েকটি গদ্য-সংকলনের মধ্যে অন্যতম হল “;চায়ের ধোঁয়া”;। এই গদ্য-সংকলনটি ভিন্নস্বাদে প্রস্তুত করা হয়েছে। তাঁর একাধিক সত্তাগুলিকে তিনি বাঁধলেন একেকটি চরিত্রে এবং আড্ডার মাধ্যমে তাদের একটি ফ্রেমে এনে হাজির করলেন। এই গদ্য-সংকলনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “;পঞ্চভূত”; প্রবন্ধ-সংকলনের মিল পাওয়া যায়, যেখানে এমনই এক আড্ডার পরিবেশ সৃষ্টি করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সত্তাগুলিকে স্বতন্ত্র আদর্শ ও যুক্তির মাধ্যমে বেঁধে শিল্পিত প্রকাশ ঘটালেন।

আসলে রবীন্দ্রনাথ ও উৎপল দত্ত দুজনেই বাঙ্গালীর আড্ডা-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। বাঙালির এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে তাঁরা তুলে ধরলেন লেখায় এবং তাদের মনের nonfictional কথাগুলিকে fictional রূপ দিলেন। এই প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের “আগন্তুক” চলচ্চিত্রের একটি বিশেষ দৃশ্যের কথা মনে পড়ে যায় যেখানে রবি ঘোষ ও আগন্তুক-রুপি উৎপল দত্তের মধ্যে বাঙালির আড্ডা-সংস্কৃতি নিয়ে কিছু চমৎকার কথোপকথন আমরা পাই। সেখানে উৎপল দত্ত বাঙালির আড্ডায় পরনিন্দা-পরচর্চার বাহুল্য দেখে আড়াই হাজার বছর আগের গ্রীসের আখড়ার প্রসঙ্গ তুলে আনেন। সেখানে শরীর চর্চার পাশাপাশি মনের চর্চাকেও প্রধান্য দেওয়া হতো। এই concept-টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জুভেনাইল বলেছেন- “;Mens sana in corpore sano.”; অর্থাৎ sound mind in a sound body। এথেন্সের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীগুণীরা সেই আখড়ায় যোগ দিতেন এবং দর্শন, সাহিত্য, রাজনীতি, গণিত ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক হত। আমরা “;Republic”; কিংবা “;Poetics”; ঘাটলে যেরকম ‘dialogue’ লক্ষ করি তা আসলে ওই আখড়ারই অনুকরণে লেখা। অর্থাৎ পরনিন্দা-পরচর্চা নয়, সেই আড্ডা হতো ‘highest level of mind’- এর পর্যায়ে। উৎপলবাবু এটিকেই পাথেয় করে বাঙালিত্বের ছাঁচে ফেলে তার মনের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকা থিয়েটারের উন্নতিকরণের পন্থাগুলিকে বাইরে এনেছেন এবং সেইসঙ্গে উঠে এসেছে রাজনীতি, সাহিত্য, সঙ্গীত ও চিত্রকলা। এককথায় চায়ের ধোঁয়া গদ্য-সংকলনটিকে ‘রঁদেভু’-এর বাঙালি সংস্করণ বলা যায়।

সমাজের অবক্ষয়গুলি যে ধ্বংসস্তুপ তৈরি করেছিল, সেই ধ্বংসাবশেষ থেকে ফিনিক্সের সন্ধান করেছে উৎপল দত্তের নাট্য-সম্ভারগুলি। তাঁর নাট্য-মানসসম্পর্কে তিনি বলেছেন -“; what the theatre means to me for the last forty years, it has meant a weapon of political propaganda.”; – এই ‘political propaganda’ কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে উজ্জ্বলতা দান করে না, বরং তারা শোষিত শ্রেণীর মুক্তির তরে গণঅভ্যুত্থানকে অধিকমাত্রায় প্রতীকায়িত করে, যা তৎকালীন রাজনৈতিক থিয়েটারের অনিবার্য প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। আর এই কর্মযজ্ঞের শরিক হয়েছিলেন উৎপল দত্ত। “;চায়ের ধোঁয়া”; গদ্য-সংকলনে একটি বিশেষ সময়ের কথা উঠে আসে, যখন প্রগতিশীল বামমনস্ক নাটককারেরা গণনাট্য সংঘের আশ্রয়ে আশায় বুক বেঁধেছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা বুঝতে পারে যে, party guideline-কে অনুসরণ করলে তাদের শিল্পীসত্তাকে বিকিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবেনা। তারই পরিণতি-স্বরূপ বেশ কয়েকজন থিয়েটারকর্মীরা গণনাট্য থেকে বেরিয়ে এসে তৈরি করেন ‘নবনাট্য সংঘ’ সেখানে রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও শিল্পবোধ -দুটোই অক্ষুণ্ন থাকার কথা বলা হয়। উৎপলবাবু সেই সংগঠনের শরিক হয়েছেন এবং এই গদ্যের মাধ্যমে নবনাট্যের প্রতি তাঁর যে একান্ত আস্থা আছে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাই ‘ভূমিকার পরিবর্তে’ অংশে তিনি বলেছেন – “;অভিনেতারা বিচিত্র জীব, আবেগের ব্যবসায়ী। আবেগবশে অনেক কটু কথা বলেছি, অতিশয়োক্তিও করেছি। আবার এও ঠিক নাট্যযুদ্ধে যারা কাটা সৈনিক তাদের পক্ষে আবেগহীন হওয়াই বা কি করে সম্ভব?”; -আর এই আবেগের উৎসারনের জন্যই তিনি আড্ডার পরিবেশকে কেন্দ্রে রেখে সেই আড্ডায় উত্থাপন করেছেন একাধারে নাটকের সাহিত্যিক ও প্রায়োগিক মূল্যবোধ।

প্রত্যেকটি শিল্পীর দায়িত্ব থাকে তাঁর শিল্পকর্মের সঠিক চালচিত্র তৈরি করার, থিয়েটারী ভাষায় একে বলা হয় ‘দর্শকদের গান তৈরি করা’ – আর এই গদ্য- সংকলনের প্রথম গদ্য “খুন-জখম” তেমনই কান তৈরি করার মতো গদ্য, যেখানে উৎপলবাবু নিজের আদর্শ ও এই গদ্য-সংকলনটি কোনদিকে বাঁক নিতে চলেছে তা বুঝিয়ে দিলেন। নাট্যকার চরিত্রটির কথায় “;সমাজ একটা যুদ্ধক্ষেত্র”; আর সেই যুদ্ধক্ষেত্রের জন্যই শিল্পী বারেবারে নাটককে ‘weapon of political propaganda’ হিসেবে ধারণ করেন। “শেক্সপিয়ার ও ইবসেন”; প্রবন্ধে সরাসরি যুদ্ধের কথা না এলেও একটা আধিপত্যবাদের প্রচ্ছন্ন ছায়া এসে পড়ে, যা যেকোন শিল্পকর্মের মূল্যাঙ্কনেও যথেচ্ছাচার করতে পারে। তারই বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে উৎপলবাবুর প্রত্যেকটি সত্তা। “;জনপ্রিয়তা ও আলমগীর”; গদ্যে আমরা পরিচালক চরিত্রের হঠাৎ আগমন দেখতে পাই, যিনি নাট্যকারের একতরফা ভাবনাগুলির বিরোধিতা করে গদ্যে আলাদা দৃষ্টিকোণ যোগ করেন। নাট্যকারের নাটকের পাতা থেকে মঞ্চের দিকে যাত্রার পথটি মসৃণ নয়, আর এই যাত্রায় একজন পরিচালক যে কীভাবে নাট্যকার ও দর্শকদের মাঝে সংযোগ স্থাপন করে সেই পথের সন্ধান দিয়েছেন পরিচালক। “;জনপ্রিয়তা ও হ্যামলেট”; গদ্য সেই একই পথের সন্ধান দেওয়া হয়েছে, তবে এই পথ শেক্সপিয়ারের সময়ের লন্ডনের সেই মধ্যবিত্ত গলিপথ, যাকে মাথায় রেখে শেক্সপিয়ার নাট্যরচনা করেছেন। পরিচালক সেইসব বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্যে তাঁর মোক্ষম বাণটি ছুড়লেন, যারা চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় নিজেকে নিমজ্জিত করে দর্শকদের চাহিদাকে ভুলে যান।

অন্যদিকে আমরা থিয়েটারের প্রায়োগিক দিক নিয়েও বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিতর্ক পাই। যেমন নাটকের আঙ্গিক নিয়ে আলোচনায় পরিচালক চরিত্রটি পরিষ্কার করলেন যে আঙ্গিক বিষয়টি অলংকারের বাহুল্য নয় বরং নাটকের সাহিত্যিক মূল্যবোধের প্রাণ পাখিকে ঘিরে যে দেহ রচিত হয়েছে তারই নামান্তর। গদ্যের শেষে পরিচালক এও নির্দেশ করে গেলেন যে, পৃথিবীজুড়ে নাট্য-শিল্পের রেশ এবার অভিনেতা কিংবা নাট্যকারকে কেন্দ্রে রেখে আবর্তিত হবে না। সেই ব্যাটনটি এবার সমাজ বহন করবে। এই কথাটির সমর্থনে পরিচালক ব্রেখটের একটি মূল্যবান উক্তি করেন -“;The theatre is not the servant of dramatist, but of society”;। অনুরূপভাবেই “;দৃশ্যসজ্জা”; “;আলো”; গদ্যে উৎপলবাবু আধুনিক থিয়েটারের স্তম্ভ হিসেবে দৃশ্যসজ্জা ও আলোকে সামনে রেখেছেন এবং অতীতে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি বিষয়কে আধুনিক নাটকের অন্যতম সোপান হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে উঠে এসেছে নবনাট্য সংঘের নেপথ্যে থাকা বেশ কিছু স্তম্ভের নাম, যথা- খালেদ চৌধুরি, সতু সেন ও তাপস সেন; যারা নেপথ্যে থেকে আধুনিক বাংলা থিয়েটারকে একাধারে বিজ্ঞানমনস্ক ও শিল্পনির্ভর করে বিশ্বের থিয়েটার মানচিত্রে একটা স্থায়ী আসন দিতে পেরেছিলেন। এছাড়াও “;সংগীত ও অভিনয়”;, “;বাস্তব ও বাস্তবোত্তর”; এবং “;থিয়েটারের ভাষা”; গদ্যগুলি সাধারণ পাঠকের মনে থিয়েটার-মনন তৈরি করতে সাহায্য করে।

আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে এই গদ্য-সংকলনে প্রদর্শিত প্রত্যেকটি চরিত্রই আসলে শিল্পীর একেকটি সত্তা, যার মধ্যে আপাতবিরোধ থাকলেও শেষমেশ তারা মিলিত হন আধুনিক থিয়েটারের মিলনক্ষেত্রে। উৎপল দত্ত একাধারে নাট্যকার, নাট্য-পরিচালক ও অভিনেতা। আমরা গদ্যে এই তিনটি সত্তার মধ্যে সরাসরি বিতর্ক লক্ষ করি। এছাড়াও দার্শনিক ও ভাষাবিদ চরিত্র-দ্বয় অনুঘটক হিসেবে কাজ করে, এবং মূল চরিত্রদের যুক্তিকে আরো তথ্যপূর্ণ করে তোলে কিংবা বিতর্কে প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে বাঁক সৃষ্টি করে।

থিয়েটার-নবিশদের পক্ষে এই গ্রন্থটি অত্যন্ত জরুরী। উৎপল দত্ত নিজের সময়ে প্রাতঃস্মরণীয় থিয়েটারকর্মী ছিলেন এবং অভিনয়শিল্প তাকে নাম ও খ্যাতি এনে দিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু থিয়েটার আমাদের শেখায় “;the show must go on”; – সেই কথা মতোই বর্তমানের আদর্শ ও স্বপ্নের ব্যটনটি যে তিনি উত্তরসূরিদের হাতে সফলতার সঙ্গে হস্তান্তর করতে পেরেছেন তার প্রমাণ এই গদ্য সংকলনটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *