ঊনবিংশ সংখ্যা ।। দ্বাদশ ই-সংস্করণ ।। আগস্ট, ২০২১

ভাণ পত্রিকা

ঊনবিংশ সংখ্যা ।। দ্বাদশ ই-সংস্করণ ।। আগস্ট, ২০২১

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

ও মৌলিকা সাজোয়াল

সূচি

 

সম্পাদকের কথা

 

স্মরণ

সদ্যপ্রয়াত দিলীপ কুমার কে ‘সাগিনা মাহাত’ রূপে স্মরণ করলেন-  শুভজিৎ মুখোপাধ্যায়

 

বিষয় বিশেষ

সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক তর্জা: কালচারের গোড়ায় পৌঁছোতে চাইলেন-  প্রতীপ চট্টোপাধ্যায়

 

রাজনৈতিক হিংসা বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ কেন ? ভাবতে বসলেন-  বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

আমাদের হতে চাওয়া ‘আমি’ কে ফিরিয়ে দেয় তাঁর ছবি’ অনুভব করলেন-  অণ্বেষা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: এক ছবির কবি’ লিখলেন-  সোমনাথ লাহা

 

চলচ্চিত্র

থ্রিলার প্রেমি দর্শকদের মুগ্ধ করে ‘ মেয়ার অফ ইস্টটাউন’ জানালেন-  অজন্তা সিনহা

 

গান

কীর্তনের সুরে মিনে করা কয়েকটি রবীন্দ্র গান: প্রথম পর্বেই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা পাড়লেন-  কবিতা চন্দ

 

পাঠকের চোখে

সম্পাদকের কথা

রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে আমরা যখন বিশেষ বিষয় হিসেবে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রতিমাসে পরপর চেপে চলেছি, তখনই সারা দেশজুড়ে বিজেপি বিরোধী ঐক্যের হাওয়া উঠেছে। এ হাওয়া আমাদের ধারণায় সুখকর। তবু হাওয়ার সঙ্গে কায়ার পার্থক্য আমরা মালুম করতে পারি। অন্যদিকে বাম রাজনীতি তার সিদ্ধান্তহীনতা এবং দোলাচলতার রোগটিকে ক্রনিক করে তুলেছে। ভোট রাজনীতির নিত্যনতুন কৌশল আদতে এক মৌষল পর্ব রচনা করেছে। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যে আত্মবিশ্বাস দরকার, তেমন কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। শোনার অভ্যাস এখনো যথারীতি শোনানোর খবরদারির কাছে হার মেনে চলেছে। এক গভীর এবং সূক্ষ্ম আত্মরতির প্রাবল্যে দৃষ্টি ক্ষীণ।

ঘরোয়া পরিসরে অনেক কথা, তুলনায় কাজ কম। দেশের বাম আন্দোলনের এই ক্ষতি, শুধু বিশেষ বাম দলের ক্ষতি বলে বিবেচিত হতে পারে না। দেশের নীতি নির্ধারণে অনেকখানি প্রভাব পড়বে এতে। মানুষের দারিদ্রতা নিরাপত্তাহীনতা এবং অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে পপুলিস্ট রাজনীতি গেড়ে বসেছে।সেই সুযোগে মাথাচাড়া দিচ্ছে ব্যক্তিপূজার বাড়বাড়ন্ত। কথা বলা, লিখে ফেলা, প্রশ্ন তোলা, নিজের অনুভূতিটুকু প্রকাশ করাও নিরাপদ নয়। ক্ষমতা,- অন্যমত, ভিন্নকথা শুনতে প্রস্তুত নয়। আর বেঁচে থাকাটাই যখন আশ্চর্য বলে মনে হয় সাধারণ জনতার,- তখন সাংবিধানিক অধিকার গুলিকে মনে হয় সৌখিন সামগ্রী। সেটাই কাজে লাগায় দুর্বৃত্ত দেশদ্রোহী রাজনীতিক। ফলে আমাদের বাংলা অথবা ভারতবর্ষ মোটেও সুখকর অবস্থার মধ্যে নেই। ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে।

অশিক্ষা ও অপসংস্কৃতি চাষ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মদতে। এ বড় সুখের সময় নয়।নানাভাবে নানা ফরম্যাটে এর বিরুদ্ধে আমাদের স্বর তুলতে হবে। ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য। কঠিন সময়ে ভালো কিছু করে যাওয়াটাই একটা লড়াই।ভাণ তার সীমিত সাধ্যে সে কাজটি করে যাবার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে চলেছে। প্রতিমাসে বেরুচ্ছে ভাণ এর ই- সংস্করণ। অক্টোবরে পুজোর মাসে নির্বাচিত প্রায় পঞ্চাশটি লেখা নিয়ে আসছে ছাপা পুজো সংখ্যা। ভালো সংস্কৃতির প্রসারে নিজেকে যত্নবান করে তুলতে চায় ভাণ। কেননা ভাণ বিশ্বাস করে, মানুষের কালচার, সমাজ-ধর্ম এবং রাজনৈতিক কালচার অনেক বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। ভালো সিনেমা- ভালো নাটক- ভালো গান- ভালো বই , সেই কাজটিকেই উসকে দেয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বিষয় করে দুটি পৃথক নিবন্ধ লিখেছেন অধ্যাপক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অধ্যাপক প্রতীপ চট্টোপাধ্যায়। অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায়, গণতন্ত্রের এতো বুলি কপচানোর পরেও বাঙালির ধারাবাহিক রাজনৈতিক হিংসার মূল খুঁজতে চেয়েছেন। অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় বুঝতে চেয়েছেন আজকের রাজনীতির অসূয়া এবং তর্জা প্রেমের কারণ! শুধু উষ্মা বীতরাগ ঘৃণা এবং বিপক্ষকে হেয় করার অশ্লীল ফূর্তির বিষাক্ত মন টিকে চিনতে চেয়েছেন তিনি।

এছাড়াও রয়েছে নিয়মিত বিভাগ। সদ্য প্রয়াত দিলীপ কুমার কে সাগিনা মাহাতো এর মধ্য দিয়ে স্মরণ করেছেন শুভজিৎ। অধ্যাপক কবিতা চন্দ কীর্তন নিয়ে কয়েকটি পর্ব জুড়ে লিখবেন। এ মাস থেকে তার সূচনা হলো। কীর্তনাঙ্গের রবীন্দ্রগান তাঁর এপর্বের বিষয়। অন্যদিকে সদ্য প্রয়াত ছবির কবি, পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কে নিয়ে চমৎকার দুটি গদ্য লিখেছেন সোমনাথ লাহা আর অণ্বেষা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাম্প্রতিক একটি বিখ্যাত থ্রিলার নিয়ে তাঁর যুক্তিগ্রাহ্য মুগ্ধতার কথা লিখেছেন সাংবাদিক প্রাবন্ধিক অজন্তা সিনহা। তরুণ নাট্যভাবুক পরিচালক সৌরিক সামন্ত, সমুদ্র গুহের প্রতিরোধের নাটক এর একটি চমৎকার পাঠ প্রতিক্রিয়া রেখেছেন।

আমরা এখন পুজোর ছাপা সংকলনের কাজে ব্যস্ত। ২০২০-২১ এর নির্বাচিত লেখার সংকলন হাতে, ডাকযোগে পেতে হোয়াটসঅ্যাপ করুন ৮৩৩৫০৩১৯৩৪। অথবা মেল করুন [email protected]এই ঠিকানায়। ভালো থাকুন। ভালো রাখুন। আমাদের পাশে থাকুন। আন্তরিক নমস্কার।

সদ্যপ্রয়াত দিলীপ কুমার কে 'সাগিনা মাহাত' রূপে স্মরণ করলেন - শুভজিৎ মুখোপাধ্যায়

শুভজিৎ মুখোপাধ্যায়

সাগিনা চেঁচিয়ে উঠল, ‘ভাইও, সাথীও­­…’

সাগিনা’র কথা বলতে গেলে দ্বন্দ্ব আসে মনে। এই দ্বন্দের ঘোরে আমাদের খুঁজে বার করতে হয় এক অতীতকে। যে অতীত বিশ্বাসের, লড়াইয়ের। বিশ্বাসঘাতকতার, লড়তে লড়তে মরে যাওয়ার। মৃত্যু মৃত্যুই। এর কোনো কম্পেনশেশন হয়না। তাকে কোনো তাত্ত্বিক মোড়ক না দেওয়াই ভালো। বিশেষ করে যখন সাগিনা’রা মারা যায়। রূপদর্শী তাঁর গল্পে সাগিনার মৃত্যু দেখালেও তপন সিংহ তা করেননি। বরং সাগিনা তাঁর প্রিয়তম বন্ধুর মৃতদেহের সামনে আজীবন লড়াইয়ের শপথ নিচ্ছে সিনেমার পর্দায়। সাগিনা’র মৃত্যু মেনে নেওয়া যায়না। কারণ সাগিনা আমাদের বঞ্চনার প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর। ও আমাদের বেঁকে যাওয়া মেরুদণ্ডে শিরশির করে বয়ে চলা ঠাণ্ডা হাওয়া। আমাদের ইনকিলাব। সাগিনা, সাগিনা মাহাতো।

১৯৪২-৪৩ সালের শ্রমিক আন্দোলনের হাতেখড়ি হয়েছিল ১৯২০-২২ সালের খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সিলেটের চারগোলা উপত্যকার চা-বাগান ছেড়ে দল বেঁধে শ্রমিকরা চলে যেতে লাগলে তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে ২১ সালের মে মাসে ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে ও চাঁদপুর স্টিমার সার্ভিসের কর্মচারীরা ধর্মঘট শুরু করে। এরপর ১৯২৭ সাল থেকে একে একে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠিত হতে আরম্ভ করে অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন কল-কারখানায়। আমাদের দেশের চা-বাগান গুলোতে যে সমস্ত ইউনিয়ন সে সময় সংঘটিত হয়েছিল প্রত্যেকটিই কমিউনিস্ট পার্টির মদতে ও মতাদর্শে পরিচালিত হত। প্রধানত ছোটনাগপুর থেকে উঠে আসা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্য থেকেই চা-বাগানের শ্রমিক নিয়োগ করা হত। স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান কর্মী থাকলেও এই ছিন্নমূল আদিবাসীদেরই কেউ কেউ হয়ে উঠত মজদুর নেতা। যেমনটা এ আখ্যানে সাগিনা।

আমাদের মনে আছে নিশ্চয়ই, পরিচালক তাঁর গল্পের পটভূমি বোঝাতে গিয়ে লিখেছেন ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি অধ্যায়’ –এর কথা। ক্ষমতালোভী শাসক দের বিরুদ্ধে বিশ্বজোড়া সংগ্রাম একদিকে, অন্যদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অন্তিম নাভিশ্বাসের ঘূর্ণ্যাবর্তে জন্ম নিচ্ছিল নতুন ভারত। সেই ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে উঠে এল রেল কারখানার শ্রমিকেরা। আর তাঁদের নেতা সাগিনা। ‘শ্রমিক নেতা’ বলতে কাগজে-কলমে যেমন ছবি ফুটে ওঠে সাগিনা মোটেও তেমন ছিল না। ওঁর স্বভাব ছিল ‘রবিনহুড’। মার কা বদলা মার, খুন কা বদলা খুন। আদ্যপান্ত মাতাল, অপরিণামদর্শী। এই সাগিনা পড়ালেখা করা, সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখা কলকাত্তা-র বাবুদের নজরে পড়ল। সাগিনাও চেয়েছিল বন্ধুর মতো তাঁর কেউ হাত ধরুক, তাঁকে পথ দেখাক। তবে হয়ত বুঝতে পারেনি ওদের পথ ভিন্ন। সাগিনাও অন্য অনেকের মতো স্বপ্নে দেখত হাসপাতাল, স্কুল, পেট ভরা ভাত আর শ্রমিকের সম্মান। ওঁর উচিৎ ছিল নিজস্ব ক্ষমতা দিয়েই সব আদায় করা। কিন্তু সাগিনাও বৃহত্তর সমাজ বদলের দ্বিধাগ্রস্ত লড়াইয়ে নিজেকে শরিক করে ফেলল। আদতে সেই রাজনীতিটার দরকার ছিল একটা লড়াইয়ের মুখ, যাকে শিখণ্ডী করে মানুষের বিশ্বাস কুড়োতে পারে। ফলে মানে না বুঝেও সাগিনা আওড়ে যেত ‘দাস ক্যাপিটাল’, ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’-র অমৃতবাণী। যেমনটা উপরওয়ালাদের নির্দেশ থাকত আর কী!

অমন দুর্বোধ্য যত শব্দ সাগিনা ব্যবহার করেছে তত ওঁর প্রিয় সাথীদের থেকে দূরে চলে গেছে। তত্ত্ব আর সাধারণ জীবন যে কতটা আলাদা তা যখন সাগিনা বুঝতে পেরেছে তখন ওঁর পিছনে কেউ নেই। না পার্টি না সাথীরা। এতদিন যারা সাগিনার ‘কামরেড’ ছিল তারা তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বলছে। তাঁদের চোখে সে অপরাধী। ‘হত্যাকারীর পরিচালিত বিচারালয়ে’ বিচারের আগেই সে দোষী সাব্যস্ত। রশা প্রস্তুত, প্রস্তুত ফাঁসুড়ে। গৌরকিশোর ঘোষ তাঁর গল্পে রহস্যাবৃত মৃত্যুদিয়ে সাগিনার চ্যাপ্টার ক্লোজ করলেও তপন সিংহ তাঁর সিনেমায় দেখিয়েছেন উত্তরণের পথ। বলা যেতে পারে গল্পের সাগিনা’র মৃত্যুর পর থেকে সিনেমার সাগিনার এন্ট্রি। জনতা ঘেরা বিচার সভায় ক্ষমতার আকাঙ্খায় উন্মাদ এক স্বৈরাচারের সামনেও সে অকুতোভয়। কেবল ‘ছোটা ছোটা বাচ্চালোকের’ ভুখা পেটকে সে ভয় করে। সে বুঝতে পেরেছে যে স্রোতে সে ভেসেছিল তা ঠিক ছিল না। স্বীকার করতে তাঁর বাধে না। জীবনে ওঁর কোনো সমাজনীতি নেই, অর্থনীতি নেই। রাজনীতিতো নেইই। গৌরকিশোর ঘোষ তাঁর গল্পের সঙ্গে সিনেমাটির তুলনামূলক আলোচনা করেছিলেন। তাঁর মতে, “ গল্পটা এত ভালো সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শুধু লেখার দোষে একটা ভালো গল্প হয়ে দাঁড়াল না। অথচ এই গল্পেই আমি প্রথম আমার জীবনের অভিজ্ঞতাকে মেলে ধরতে চেষ্টা করেছিলাম। সত্যকে অনেক স্পষ্ট করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। সাগিনার চরিত্রে যে একটা ভাব ছিল, দুর্দান্ত নেতৃত্ব ছিল, যৌন্তৃপ্তিতে তাঁর কোনো বাছবিচার ছিল না, তাঁর বিচার বিবেচনা বাহ্য জগতের শৃঙ্খলার ধার ধারেও না, মদের নেশা তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখত এবং মারদাঙ্গায় সে পিছপা হত না, এই সব নিয়েই সাগিনা ছিল অতিবিশ্বস্ত এবং স্নেহপরায়ণ বন্ধুএবং একটা নিটোল মানুষ; এই ব্যাপারটা আমার গল্পে যতটা গভীরতা নিয়ে ফুটে ওঠা উচিত ছিল বলে আমার মনে হয়েছে, আমার গল্পটায় ঠিক তেমনভাবে এই চরিত্রটা ফুটে ওঠেনি।

আমার এই গল্প নিয়ে তপন সিংহ যে ফিল্মটা করেছিলেন… অভিনেতা দিলীপকুমার আশ্চর্য দক্ষতায় আমার খামতি মিটিয়ে দিয়ে সাগিনার চরিত্র অনেকটা কাছাকাছি চিত্রিত করে তুলেছেন। মজা এই যে, সাগিনার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় আমারই ছিল। তপন বা দিলীপ তাকে চোখেও দেখেননি। সৃষ্টি যে কোথায় কেমনভাবে হয় সেটা আমার কাছে রহস্যই থেকে গিয়েছে।“ (জিজ্ঞাসা, পূর্বোক্ত, পৃ ১১৩)

এই রহস্যের কোনো কুল-কিনারা নেই। তবুও কিছু কথা বলা যায়। ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমায় দিলীপকুমার হিরো নন বরং চরিত্রাভিনেতা। মেথড অভিনয়ের এ এক অনন্য সংযোজন। ওঁর গলায় কণ্ঠী থেকে শুরু করে চেহারার গড়নে আদিবাসী সমাজের ছাপ, যাতে কারখানার শ্রমিকের দুর্গন্ধময় যাপনের চিত্র। আপনভোলা এই চরিত্রের কথা বলার ধরণ, নেশাতুর হেঁটে চলা আর শেষ পর্যন্ত দাঁত চেপে লড়ে যাওয়া যেভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তা বিস্ময়ের। সাগিনা’র চরিত্রে যে মেঠো রুক্ষতা দরকার ছিল তা রোম্যান্টিক হিরোর নয়। বরং দিলীপকুমারের স্বরে যে সাইলেন্স ছিল তা এক্ষেত্রে অনেক জরুরী ছিল বলে মনে হয়। এ সকলই আমার নিজস্ব ধারণা। আর সর্বোপরি নির্দেশক তপন সিংহ এর কথা বলা যায়। পুঁজিবাদের শোষণ এবং একই সাথে বিশেষ একটি মতবাদকে শেষ পর্যন্ত মানুষের বিচারালয়ে প্রত্যাখ্যান করার যুগলবন্দী সম্ভবত তিনিই দেখাতে পারেন। তাই হয়তো বাঙালী দর্শক ঋত্বিক – সত্যজিৎ – মৃণাল –এর সারিতে তপন সিংহ কে রাখতে লজ্জা পায়।

তবুও ইতিহাসের পাতায় সত্যিকার এক প্রান্তিক মানুষের, খেটে খাওয়া মানুষের উত্থানের গল্প বলার এই ‘সাগিনা মাহাতো’-র কথা থেকে যাবে। যেমন ভাবে থেকে যাবে সেই সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখা শিক্ষিত মানুষগুলোর বিশ্বাসঘাতকের কথা। অথবা সাগিনা নামক এক পাহাড়ী বিছের কথা, যে নির্দ্বিধায় বলতে পারে – ‘ভোলে ভালে মুরক মজদুর প্যাঞ্চা সওয়াল বুঝে না, শুধু পেটের সওয়াল বোঝে…’ অথবা তাঁর স্বীকারোক্তি – ‘হ্যাঁ খারাপ কাজ করেছি। অনেক খারাপ কাজ। আরে শালা সারা দুনিয়া খারাপ কাজ করে।‘ হিমালয়ের কোল ঘেঁষা খোলা মাঠে চিত হয়ে পড়ে থাকা দীর্ঘদেহীর শরীরে তাঁরই অন্তরঙ্গ পরিজনদের আঘাতের চিহ্ন, যে আঘাত তাঁর চিন্তা-চেতনাকে পুনর্জন্ম দিতে পারল। অথবা শুকনা ফরেস্টে রেলে কাটা দেহটা সযত্নে আঘাতের চিহ্নগুলোকে লালন করে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়ল।

তবুও সাগিনা উঠে দাঁড়াবে। সমস্ত মজদুরকে এক করে নিয়ে আবার একটা মিটিং হবে পাহাড়ের কোলে। চারিদিকে স্লোগান উঠবে ‘শ্রমিক ফ্রন্ট জিন্দাবাদ’। ভেসে আসবে এক কামরেডের শেষ কথা – ‘তৈরি হও সাগিনা, সত্যিকারের লড়াইয়ের জন্য তৈরি হও…’ আর সাগিনা তাঁর আর্তনাদ চেপে তাঁর সাথে হয়ে যাওয়া ধোঁকাবাজীর প্রতিশোধ নিতে চিৎকার করে উঠবে – ‘ভাইও, সাথীও …‘

সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক তর্জা:কালচারের গোড়ায় পৌঁছোতে চাইলেন - প্রতীপ চট্টোপাধ্যায়

প্রতীপ চট্টোপাধ্যায়

রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনায় সাধারণভাবে দু-ধরনের সংস্কৃতির কথা বলা হয়- ক্রিয়াশীল সংস্কৃতি এবং নিষ্ক্রিয় সংস্কৃতি| সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে আলোচনায় মতাদর্শভিত্তিক বাম রাজনীতির নির্বাচনী অবক্ষয় এবং আবেগের আত্মিকতাভিত্তিক জনমোহিনী রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর আলোকপাত করা হয়| নিষ্ক্রিয় বা নিষ্পৃহ রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে যখন ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন করানোর চেষ্টা হয় সেই সময় রাজনৈতিক তরজা এক গুরুত্বপূর্ণ আধার হিসাবে সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের গণ-মাধ্যমে এবং পৌর সমাজে উপস্থিত| এই নিবন্ধ রাজনৈতিক সংস্কৃতির তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট থেকে সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আত্মিকতার বিবর্তনে রাজনৈতিক-তরজার গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তার বিশ্লেষণের একটি প্রচেষ্টা|

রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলতে রাজনীতির প্রতি সমাজের ধারণা, বিশ্বাস, এবং দৃষ্টিভঙ্গির ও আচার-আচরণের অভ্যাসের সংমিশ্রনকে বোঝানো হয়| রাজনৈতিক সংস্কৃতি সমাজের মধ্যে থেকে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামো এবং রাজনৈতিক দল ও তার নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গির ঐতিহাসিক বিবর্তনকে নির্ভর করে| অর্থাৎ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ঐতিহাসিক, তুলনামূলক এবং বিশ্লেষনধর্মী বিষয় যা একটি নির্দিষ্ট সমাজের নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতালব্ধ| তাই রাজনৈতিক সংস্কৃতি কখনো খুবই ক্রিয়াশীল হয় যখন রাজনীতিকে সমাজ পরিবর্তনের আধার হিসেবে দেখা হয় আবার এই সংস্কৃতি অন্য সময়ে খুবই নিষ্ক্রিয় ও নিস্পৃহ হয়ে পড়ে যখন পরিবর্তনের আধার হিসেবে রাজনীতির আশা পূরণে ব্যর্থ হয়ে ক্ষমতার অন্ধগলি থেকে পরিচালিত হতে থাকে|

ক্রিয়াশীল বা সক্রিয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নিষ্ক্রিয় বা নিস্পৃহ রাজনৈতিক সংস্কৃতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মতাদর্শভিত্তিক| অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শের রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে সমাজের যে অংশের মানুষরা সেই দলকে সমর্থন করে তারা সরকারের সবকিছু সমর্থনে সক্রিয় হয় এবং সরকারের বিন্দুমাত্র বিরোধিতায় থাকে নিষ্ক্রিয়| আর সমাজের সেই অংশ যারা এই নির্দিষ্ট মতাদর্শের দলকে বিরোধিতা করে তারা সরকারের সবকিছুর বিরোধিতায় থাকে সক্রিয় কিন্তু সরকারের কোনোকিছুকে সমর্থনযোগ্য মনে করে না এবং তাই সমর্থনে থাকে তারা নিষ্ক্রিয় বা নিস্পৃহ| তাহলে দেখা যাচ্ছে ক্রিয়াশীল ও নিষ্ক্রিয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ বা একই বৃন্তের দুটি কুসুমসম| এখানে মনে রাখা দরকার পশ্চিম দুনিয়ার দেশগুলিতে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে এতো জটিলতা, রং বদলানো বা দ্বিমুখীতা নেই| সেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হলো পৌর-সমাজ যা রুচিশীল উদারবাদী মানসিকতার দ্বারা গঠিত এবং সরকার ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম এবং সরকার পরিচালনের মূল আধার হিসেবে পরিষেবা প্রদানের কাজকেই বোঝানো হয় এবং সেখানে মুক্ত মনে সরকারকে সমর্থন বা বিরোধিতা করা হয় ব্যক্তি-নাগরিকের রাজনৈতিক মতাদর্শের উর্ধে উঠে এবং অন্ধ-বিরোধিতা বা অন্ধ-সমর্থনের জায়গায় দেখা যায় গঠনমূলক বিরোধিতা বা গঠনমূলক সমর্থন| অর্থাৎ বিরোধিতা করলে আলোচনার মাধ্যমে সরকারকে ভালো কাজ করার রূপরেখা প্রদান এবং সমর্থন করলেও সরকারকে আরো ভালো পরিষেবা প্রদানের নতুন দিক আলোকিত করা| পশ্চিম দুনিয়ায় এইটাই ছিল রাজনৈতিক সংস্কৃতির চিত্র বিংশ-শতাব্দী অব্দি| কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে পশ্চিম দুনিয়ার সমাজ যত বেশি মিশ্রিত সমাজ হয়ে উঠছে অভিবাসী এবং শরণার্থীদের নিয়ে ততো বেশি রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যেও আসছে হিংসা এবং অস্থিরতা| পশ্চিমী রাজনৈতিক সংস্কৃতি হারাচ্ছে তার সৃজনশীলতা ও গাম্ভীর্য|

উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে অবশ্য বিংশ শতাব্দী থেকেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি অন্য পথে হেঁটেছে, যেখানে পৌর-সমাজের পরিবর্তে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়েছে রাজনৈতিক পরিচিতি, রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা| তাই ভারতের মতো উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়েছে দোদুল্যমান এবং অন্ধ-বিরোধিতা বা অন্ধ-সমর্থনের দোষে দুষ্ট| কিন্তু এর ফলে ভারতের মতো বিশাল দেশে যেখানে সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিরাজমান, সেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে আকর্ষনীয় কারণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি এক এক অঙ্গ-রাজ্যে এক এক রকম এবং একই রাজ্যের মধ্যে বিভিন্ন জেলাগুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতি লক্ষ করা যায়| একথা ঠিক যে সমাজগতভাবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠবে| তাই পশ্চিমী দুনিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতির আদলে ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠবে না সে কথা বলাই বাহুল্য| কিন্তু দেশজ রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও তো একটি নির্দিষ্ট স্বরূপ এবং বৈশিষ্ট্য থাকবে| এই জায়গাতেই ভারতের অভিজ্ঞতা অনন্য| ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিবর্তনের ইতিহাসে যেমন পশ্চিম দুনিয়ার উদারবাদী ছাপ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় লক্ষ করা যায় (মুক্ত গণ-মাধ্যম, বিচারালয় এবং মুক্ত পর-সামাজিক পরিসর), আবার কখনো কতৃত্ববাদী ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ লক্ষণীয় হয়ে ওঠে (১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থা বা বর্তমান বি.জে.পি দলের নতুন ইতিহাস লেখার প্রচেষ্টা), কখনো আফ্রিকা মহাদেশের মতন দুর্নীতি ও স্বজন-পোষণের দৃষ্টান্ত তৈরী হয়(২০১১ সালের লোকপাল বিল নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভারত আন্দোলন দ্রষ্টব্য) আবার কখনো এই সংস্কৃতি হয়ে ওঠে জনপ্রিয়তাবাদী(বিস্তৃত কাল্পনিক প্রগতির বা উন্নয়নকল্পের স্বপ্ন ফেরীর মাধ্যমে রাজনৈতিক সমর্থন লাভ)| ১৯৫৫ সালে রাজ কাপুর শ্রী ৪২০ চলচিত্রে গান গেয়েছিলেন – “মেরা জুতা হে জাপানি, পাতলুন ইংলিশথানি , শির মে লাল টোপি রুসি, ফির ভি দিল হে হিন্দুস্থানী”| ভারতীয় সংবিধানের মতই রাজনৈতিক সংস্কৃতিও সব দেশের সংস্কৃতির সমাহার বলা যায়|

ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই বিভিন্নতাকে আরো বেশি মাধুর্য প্রদান করেছে দুই বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক সংস্কৃতি – অর্থাৎ ক্রিয়াশীল এবং নিষ্ক্রিয় সংস্কৃতির মধ্যবর্তী জায়গায় তৈরী হওয়া চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি| এই চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো সদা পরিবর্তনশীল, দৈনন্দিন বিষয়ভিত্তিক এবং সরকার পরিচালনের চুলচেরা বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর| এই চলমান সংস্কৃতির বিশেষত্ব হলো যে এই সংস্কৃতির প্রভাবে ক্রিয়াশীল সংস্কৃতিবানরা নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে আবার নিষ্ক্রিয় সংস্কৃতিবানরা ক্রিয়াশীল হয়ে যেতে পারে রাজনৈতিক দৈনন্দিনতার নিরিখে| এই চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরী হয় গণ-মাধ্যমের পরিসরে সান্ধ্যকালীন তথাকথিত বিতর্ক-সম্প্রচারে যেখানে দৈনন্দিন বিষয়ের ভিত্তিতে কোনো রাজনৈতিক দল সঠিক হয় আবার কোনো রাজনৈতিক দল বিপদে পড়ে| কোনোদিন আবার সব রাজনৈতিক দলগুলি এত ভুলেভরা প্রতিপন্ন হয় যে লোকশক্তি বা জনগণের সমষ্টিকেই সমাজ পরিচালনার ভার দিয়ে দেওয়াই যথার্থ বলে মনে হয়| এই চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্রিড়করা তৈরি করে অস্থিরতা, ধোঁয়াশা এবং দিকশূন্যতা| সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্যের লেখনীতে এবং নাট্যকার দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনাতে জনপ্রিয় হওয়া ‘ফ্যাতারু’ এই চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিবানদের জন্য সঠিক শব্দবন্ধ| এরা ঘোট পাকায়, জোট পাকায়, উল্টো-পাল্টা বা এলো-মেলো করে দেয় চিন্তার পরিসরকে এবং দিনের শেষে দিনটাকেই ভেস্তে দিয়ে চারিপাশকে অন্ধকারসম করে তোলে| বিগত এক বা দেড় দশকে এই দৈনন্দিন চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে ভারতীয় সংস্কৃতির মূল আকর্ষ, পরিচয় এবং প্রবাহ|

এই তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা জরুরী তার কারণ পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিহাস প্রাক-স্বাধীনতা কাল থেকেই বৈপ্লবিক এবং গঠনমূলক| ক্রমাগত সাড়ে তিন দশকের বাম শাসনের মধ্যে দিয়ে মতাদর্শ ও সংগঠন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সমার্থক হয়ে উঠেছিলো| কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বৈপ্লবিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিক যা সবসসময় নতুন কিছুর উন্মেষ ঘটাতো সেগুলো বাম শাসনের শক্ত ঘেরাটোপের মধ্যে হারিয়ে গেলো| তার কারণ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সবুজের অভিযান’ কবিতার মধ্যেই বর্ণিত রয়েছে – “খাঁচাখানা দুলছে মৃদু হাওয়ায়. আর তো কিছুই নড়ে না রে ওদের ঘরে, ওদের ঘরের দাওয়ায়….চলতে ওরা চায়না মাটির ছেলে, মাটির পরে চরণ ফেলে ফেলে, আছে অচল অসনখানা মেলে, যে যার আপন উচ্ছ বাঁশের মাথায়”|তাই যে বাম শাসনের হাত ধরে ১৯৭৭ সালে নকশাল আন্দোলনের অস্থির সময় পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে উঠেছিল ক্রিয়াশীল তা কালের নিয়মে হয়ে উঠলো নিষ্ক্রিয় বা নিস্পৃহ সংস্কৃতি| রাজনীতি থেকে মন উঠে গেলো যেন সমাজের| অন্যদিক থেকে বলা যায় এক ধরনের বশংবাদী বা দলদাস রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরী হলো যেখানে নিস্পৃহ থাকাটাই কাম্য ছিল দলের এবং দলীয় সরকারের কাছে| বাস্তু-ঘুঘুদের বাসা ভাঙার স্বপ্ন দেখিয়ে তারা সাড়ে তিন দশকে নতুন বাস্তু-ঘুঘু তৈরি করে গেলো| তাই ২০১১ সালে আবার রাজনৈতিক সংস্কৃতি ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে রাজনীতিকে পরিবর্তনের আধার হিসেবে ভেবে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে প্রায় ‘বিধির বাঁধন” ভাঙার মতোই জন-শক্তির প্রতিফলন নির্বাচনী পরিসরে বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে| বিগত এক দশকে পশ্চিমবঙ্গে দোদুল্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে যেখানে ক্রিয়াশীল এবং নিষ্ক্রিয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য অতি সূক্ষ হয়ে উঠেছে| এক দশকে নতুন কিছুই স্থাপন না হলেও একই দলকে নির্বাচিত করে যাওয়ার মধ্যে স্থিতাবস্থাকামী রাজনৈতিক সংস্কৃতির ছাপ দেখছেন বিশ্লেষকেরা| অর্থাৎ পুরনো দিনে (পড়ুন বাম আমলে) ফিরে যেতে বা নতুন কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে (পড়ুন বি.জে.পি)পরীক্ষা করতে পশ্চিমবঙ্গবাসী ভীতসতন্ত্র| আর এই ভীতি তৈরী করেছে চলমান বা দৈনন্দিন রাজনৈতিক সংস্কৃতি|তাই বলা যায় সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তনকামী ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে স্থিতাবস্থাকামী নিষ্ক্রিয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি|

ভারতীয় সংস্কৃতি তার্কিক বা তর্ক-প্রিয় এ কথা অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের লেখনীর দ্বারা স্বতঃসিদ্ধ| অধ্যাপক সেন তাঁর ‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়’ গ্রন্থে ভগবৎ গীতার তর্কের কথা তুলে ধরেছেন যেখানে শ্রীকৃষ্ণ ছলে-বলে-কৌশলে অধর্মের বিনাশ করার কর্মের মধ্যেই ধর্মকে উপলব্ধি করার কথা বলছেন এবং অর্জুন মূল্যবোধভিত্তিক দায়িত্ব-নিষ্ঠতার কর্মের মধ্যে ধর্মকে উপলব্ধি করতে চাইছেন| এই আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে ভারতবর্ষে রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক বা আলাপ-আলোচনার ইতিহাস ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত যেখানে মূল দ্বন্দটা হচ্ছে কৌশলভিত্তিক জনমোহিনী কর্মকাণ্ড(পড়ুন সরকারী পরিকল্পনা) বনাম মতাদর্শ-ভিত্তিক দায়িত্ব-নিষ্ঠ সমাজ-গঠনমূলক ব্যক্তির সার্বিক উন্নয়নের রূপরেখার কর্মকাণ্ড(পড়ুন দলীয় নির্বাচনী ইস্তেহারের পরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি বা সামাজিক সংগঠনগুলির দাবি-সনদ)| এই দুই ধরনের কর্ম-কাণ্ডের গুণাগুণের তার্কিক আলাপ-আলোচনা তর্ক-বিতর্ককে বাদ-প্রতিবাদ ধরলে সেখান থেকেই নতুন কিছুর রূপরেখা বা সম্বাদ বেরিয়ে আসতে পারে এবং এভাবেই ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিলো| কিন্তু ১৯৯০এর দশকের উদারিকরণের ফলে ভারতীয় সমাজ দার্শনিক সমাজ থেকে ভোগবাদী সমাজে রূপান্তরিত হয় যেখানে মতাদর্শ হয়ে ওঠে অক্ষমতার নিদর্শন| বিলাসিতা, উৎসব-মুখরতা এবং অর্থ-উপার্জন হয়ে ওঠে ক্ষমতার নিদর্শন| ক্ষমতা-অক্ষমতার দ্বন্দ্বের মধ্যে সাধারণের সক্ষমতার প্রশ্নটাই হারিয়ে যায় আর রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে ওঠে বিশ্লেষণধর্মী সংস্কৃতি যেখানে সরকার বা দলের কর্মকাণ্ডের মানে খুঁজে বের করাই যেন তর্ক-বিতর্কের মূল উদেশ্য হয়ে দাঁড়ায়| কার্ল মার্কস-এর বিখ্যাত উক্তি –“দার্শনিকেরা এতদিন সমাজকে বিশ্লেষণ করেছেন, এখন সময় সমাজ পরিবর্তনের”|ভারতীয় তথা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আলোচনায় এই উক্তিটি বর্তমানে নতুন করে প্রাসঙ্গিকতা লাভ করেছে বলা যায়|

পশ্চিমবঙ্গের লোক-সংস্কৃতির ইতিহাসে তর্কের থেকে তরজা অনেক বেশি জনপ্রিয় ছিল| এর কারণ হলো পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে প্রথমে ব্রাহ্মণবাদ, পরে বিদেশী শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজ সংস্কারক, তার পরে বিত্তশালী জমিদার এবং সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক দল সমস্ত রকম জ্ঞান ও তথ্যের প্রতিভূ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে এক একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে| তার ফলে তর্ক যা সমানে সমানে হয় সেটা হয়নি| হয়েছে তরজা অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, সমাজ সংস্কারক, জমিদার বা রাজনৈতিক দল এদের নিজেদের মধ্যে| অর্থাৎ আলাপটা হয়েছে অনুভূমিতে একটি বিশেষ শ্রেণির মধ্যে, উল্লোম্বিতভাবে শ্রেণিদের মধ্যে হয়নি| তাই সামাজিক বা রাজনৈতিক তরজা বাইরে থেকে দেখে বা শুনে উপভোগ করতো সাধারণ মানুষ| গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে পালাগান বা কবি-গানের লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে এই ধরনের তরজার প্রতিফলন ঘটতো| অনেক রাজনৈতিক চাপানউতোর বা সামাজিক শ্রেণি বিভাজনের সমাধান এই ধরনের পালাগানের তরজা থেকেই বেরিয়ে আসতো| বাংলা চলচ্চিত্র এন্টোনি ফিরিঙ্গি-তে এন্টোনি কবিয়ালের বিখ্যাত উক্তি – “ঐহিকে সব ভিন্ন ভিন্ন অন্তিমেতে একাঙ্গি” – বুঝিয়েই দেয় জাত পাতের ভিন্নতা বা রাজনৈতিক ভিন্নতা নশ্বর পৃথিবীর অঙ্গ এবং জীবনের শেষে সবটাই অর্থহীন হয়ে পড়ে| প্রাচীন বঙ্গ লোকসমাজে পালাগানের মধ্যে দিয়ে সামাজিক শিক্ষা প্রদান করা হতো – যেমন রামায়ণ বা মহাভারতের পালাগান| আবার পালাগানের তরজার মধ্যেও থাকতো সামাজিক বার্তা – ধর্মের কথা, সুন্দর জীবনের উপাদানের কথা ইত্যাদি| আসলে তখনকার সময় পালাগানের তরজা করার জন্য পড়াশুনা বা পুঁথি-বিদ্যা/পুঁথি-চর্চা ছিলো বাধ্যতামূলক| এন্টোনি ফিরিঙ্গি চলচ্চিত্রে এন্টোনি কবিয়ালকে যথেষ্ট বেদ, পুরাণ এবং ধর্মের চর্চা করতে দেখা গেছে কবিয়াল হিসেবে প্রসিদ্ধ হওয়ার জন্য| সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে রাজনৈতিক তরজার প্রতিফলন দেখা যেত স্লোগানে ও দেওয়াল লিখনে কিন্তু তাও প্রায় তিন চার দশক আগের কথা যখন থেকে নিম্নবর্গের ইতিহাস ও পরিচিতি চর্চা জনসমক্ষে আসতে শুরু করলো| ২০২১এর পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাজনৈতিক তরজা-প্রিয় কিন্তু রাজনৈতিক তরজার পরিসর এখন বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের সান্ধ্যকালীন তথাকথিত বিতর্কসভাগুলি| পশ্চিমবঙ্গবাসী আপামর ভারতবাসীর মতই এখন এক ভোগবাদী সমাজের হাতছানির সামনে দাড়িয়ে যেখানে ক্ষণিকের সুখ-বিলাসিতা অনেক বড় হয়ে ওঠে মানুষের জীবনে দীর্ঘমেয়াদী আলোচনা, মতাদর্শ বা জীবন-দর্শনের থেকে| রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও এর প্রতিফলন দেখা যায় যেখানে সাধারণ মানুষ বিষয়ের গভীরে না গিয়ে রাজনৈতিক তরজার মধ্যে থেকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিষয় সম্পর্কে নিজেদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস তৈরি করে নেয়|

বর্তমানে পশ্চিম দেশগুলির মতই আমাদের দেশেও এবং অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলির গণমাধ্যম বিভাগ থাকে| সেখান থেকে নির্দিষ্ট তালিকা তৈরি হয় প্রতি সন্ধ্যায় দলের কোন মুখপাত্র কোনো বৈদ্যুতিন চ্যানেলে গিয়ে নিজেদের দলের মত ও পথকে সমর্থনযোগ্য করে তুলবে| আবার প্রতি চ্যানেল এই দলীয় মুখপাত্রদের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ রাখে যারা এই দলীয় বিপরীতধর্মী মতকে ভারসাম্যমূলক করে এবং সঠিক করে পরিবেশন করতে চ্যানেল-এর সঞ্চালককে সাহায্য করবে| ধারণাগতভাবে বিষয়টি ভালো|বৈদ্যুতিন পরিসর একধরনের জনমত তৈরির প্রচেষ্টা বা একধরনের বৈদ্যুতিন পুরোসমাজ তৈরির প্রচেষ্টা যেখানে সরকারি প্রকল্প, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং সামাজিক বিষয় বিশ্লেষণের অনুবিক্ষণের তলায় এসে স্পষ্টভাবে উপস্থাপিত হয় তার সুফল এবং কুফল আলোকিত করে| কিন্তু বর্তমান সমাজের মতই বর্তমান রাজনীতির সময় নেই, আবার গভীরতাও নেই| তাই এখানে তর্ক-বিতর্ক বা আলাপ-আলোচনা হয় না, হয় তরজা – একে অন্যের বক্তব্য জোর গলায় ছাপিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা, এবং বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতটাও যখন কোনো এক পক্ষের দিকে ঝুঁকে যায় তখন প্রত্যেককে প্রত্যেকের প্রতিপক্ষ হয়ে নিজের বক্তব্যের সমর্থনে এত বেশি বলতে শুরু করে যে ‘সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়’ কিন্তু সারবত্তা হয় শূন্য| শেষ অব্দি চ্যানেলের সঞ্চালককে নিজ নিজ কর্পোরেট মালিকপক্ষের রাজনৈতিক ও সামাজিক মতকে সামনে রেখে অনুষ্ঠান শেষ করতে হয়| সাধারণ মানুষ দিনের শেষে দিনের বিশ্লেষণে সব রাজনীতিকে সমান ভাবা ছাড়া আর কোনো পথ পায় না| কিন্তু সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো এক রাজনীতিকে আপন করে নিতেই হবে সরকার ও সমাজ পরিচালনের জন্য| তাই ‘খারাপের’ মধ্যে তুলনামূলক ‘ভালো’-কে জেতাতে হয় ভারাক্রান্ত মন নিয়েও|

২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গবাসীর রাজনৈতিক-তরজাপ্রিয়তা সংস্কৃতির চরমতম নিদর্শন| বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার থেকে নির্বাচনের দিনগুলি, নির্বাচনের দিনগুলির মধ্যবর্তী দিনগুলি থেকে নির্বাচনী ফলাফল বেরোনোর পরবর্তী সময়ে, রাজনৈতিক তরজার উচ্চলয় সমস্ত গণগমাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে| এমনকি নির্বাচনের আটটি পর্যায়ের মধ্যে প্রচার অভিযান নিয়ে, শিতলকুচিতে গুলি চালানো নিয়ে, রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে, করোনা সময়ের বিধি-নিষেধ মান্য-অমান্য নিয়ে, করোনা টিকা নিয়ে, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে শুধু আলোচনা হয়নি, হয়েছে তরজা, এবং মানুষকে ভাবায়নি, মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে একটি নির্দিষ্ট আবেগের দিকে – বাঙালি আবেগ বনাম বহিরাগত আবেগের মধ্যে| এর ফলে আবেগহীন রাজনীতি অর্থাৎ মতাদর্শগত রাজনীতি নির্বাচনে দাগ কাটতে পারেনি| বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস কোনো আসন পায়নি পশ্চিমবঙ্গের এবারের নির্বাচনে, যদিও পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার পেছনে এই দুই দলেরই সব থেকে বেশি ভূমিকা লক্ষ করা গেছিলো| রাজনৈতিক তর্কে এরা রয়েছে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এরা রয়েছে, সামাজিক পরিসরে তো রেড ভলান্টিয়ার্সদের নাম না করলে পশ্চিমবঙ্গের করোনাকালের ইতিহাস রচনাটাই অসমাপ্ত থেকে যাবে কিন্তু রাজনৈতিক তরজাতে এরা জায়গা করে নিতে পারেনি কারণ রাজনৈতিক তরজা জনপ্রিয়দের নিয়ে হয়, জনসমক্ষে যা ঘটে বা যারা ঘটায় তাদের নিয়ে হয়, অলক্ষ্যে যারা থাকে, বা রাজনৈতিক ভাবে যারা প্রান্তিক তাদের নিয়ে হয় না কারণ তাতে বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের টি.আর.পি বাড়েনা| সাধারণ মানুষ পশ্চিমবঙ্গে আড্ডা-প্রিয়| করোনা সময়ে তো আড্ডা প্রায় উঠেই গেছে, সব আড্ডাই ভার্চুয়াল বা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে| তাই রাস্তার আড্ডার র্রাজনৈতিক তর্ক আজ পর্যবসিত হয়েছে বৈদ্যুতিন আড্ডার তরজায়| যে ধারা শুরু হয়েছিল ১৯৯০এর দশকে প্রণয় রায়ের হাত ধরে নির্বাচনী সমীক্ষার মাধ্যমে, আজ তা হয়ে উঠেছে রোজকার রাজনৈতিক সমীক্ষা| প্রতিদিন সমস্ত রাজনীতির ধারাকে যেন পরীক্ষায় বসতে হয়| যেন গণমাধ্যমের রাজনৈতিক তরজায় জয়লাভ বাস্তব রাজনৈতিক পরিসরের জয়লাভকে অনেকটাই সুনিশ্চিত করে দেয়| এর একটা বড় কারণ মহিলাদের রাজনৈতিক ক্রীড়নক হিসেবে গুরুত্ব বৃদ্ধি| আগেকার দিনে রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সব চর্চা হতো পৌর-সমাজে রাজনৈতিক দলগুলির সভা সমাবেশে বা দেয়াল লিখন বা স্লোগানে-প্রচারে| সেখানে পুরুষদের আধিক্য ছিল বেশি এবং তারাই বাড়ির মহিলাদের কাছে সমাজ-রাজনীতি সম্পর্কে ‘সঞ্জয়’ হয়ে উঠত কারণ বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের এতো চ্যানেলের প্রাদুর্ভাব ঘটেনি| কিন্তু আজকে এই সান্ধ্যকালীন তর্কের দর্শক অনেকটাই মহিলারা এবং মহিলারা ভোটদান করেছেন অনেক বেশি সাম্প্রতিক সময়ে| তাই বলা যায় রাজনৈতিক তরজা রাজনীতির সর্বসাধারণীকরণ ঘটিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে এবং রাজনীতিকে করেছে জনপ্রিয়| রাজনৈতিক তরজার জনপ্রিয় হওয়ার আরেকটি কারণ হলো সাধারণ মানুষের মনে অনেক সময় সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা থাকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে তিরস্কার করার| রাজনৈতিক তরজা মানুষের মনের সেই সুপ্ত তাড়িত বাসনাকে পূর্ণ করে|

সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হঠকারিতার সংস্কৃতি, মুহূর্তের আবেগের সংস্কৃতি এবং দৈনন্দিনতার সংস্কৃতি| তার কারণ এই সংস্কৃতির আধার হলো রাজনৈতিক তরজা| রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক নতুন কিছুর রূপরেখাকে সামনে আনে| তাই এক সময়ে বলা হতো ‘আজ বাংলা যা ভাববে ভবিষ্যতে ভাববে তা ভারতবর্ষ’| কিন্তু আজ বিশ্ব-বাংলা ফলক রাজ্যজুড়ে ছেয়ে গেলেও নতুন ধারণার বা নতুন কর্মসূচির আমদানি ঘটছে না যা ভারতবর্ষের কাছে মডেল স্বরূপ হয়ে উঠবে| কারণ সব রাজনীতিটাই যেন খুব চেনা ক্ষমতার রাজনীতি| আলাদা কোনো পরিবর্তনের রাজনীতি বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না| এর অনেকটা দায় রাজনৈতিক তরজার যারা রাজনীতিকে তো মানুষের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে কিন্তু রাজনীতি সম্পর্কে বিরূপ ধারণা তৈরী করছে মানুষের মনে| তাই গণমাধ্যমগুলির উচিৎ রাজনৈতিক তরজা বন্ধ করা| এবং রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক ও আলাপ আলোচন শুরু করা| যেখানে রাজনৈতিক দলগুলির কর্মকাণ্ড এবং সরকারের কর্মসূচি নিয়ে সপ্তাহান্তে একদিন বসুক বিশ্লেষকেরা, করুক নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ এবং প্রতিফলন ঘটাক গঠনমূলক বিরোধিতা এবং গঠনমূলক সমর্থনে নতুন কর্মকান্ডের রূপরেখা দিয়ে| আরেকদিন সপ্তাহান্তে বসুক রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিরা যারা সেই বিশেষ মতামতগুলির থেকে নির্যাস নিয়ে তাদের দলীয় নেতৃত্বের কাছে সমাজের বার্তা পৌঁছে দিক|

সমকালীন পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সবাই যেন ভগবৎ গীতার শ্রীকৃষ্ণ| যেভাবেই হোক যুদ্ধে জয়লাভ দরকার, কারণ যুদ্ধে না জিতলে ধর্ম স্থাপনা বা মানুষের জন্য কাজ করা যাবে না| ভগবতগীতার অর্জুনের বড়োই অভাব যেখানে দ্বায়িত্ব ও সাম্য নিয়ে ভাবনা ধর্মের(ন্যায়ের) প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধে পরাজিত হয়েও কাজ করবে|আজ যারা ‘শূন্য’ তারাই বোধহয় পারেন এই নতুন দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ‘রাম’-কে বনবাসে পাঠিয়ে, ‘সীতা’-কে বিশ্রাম দিয়ে ‘ধরো হাল শক্ত হাতের’ বাণীতে উদ্দীপ্ত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক তরজার জায়গায় রাজনৈতিক তর্ক ফিরিয়ে আনতে এবং দীর্ঘমেয়াদী সমাজ-অর্থনীতি পুনর্নবীকরণের দিকনির্দেশ করতে| এই বিকল্প ভাবনা যত শীঘ্র সামনে আসবে ততোই রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে উঠবে মতাদর্শ ভিত্তিক এবং সমাজিক পরিসরে গড়ে উঠবে| তাই কোনো ভাণ না করে উপসংহারে বলি, আজ যারা রাজনৈতিকভাবে শূন্য তাদেরই দ্বায়িত্ব বেশি, তাদেরই কাজ করতে হবে বেশী কারণ পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে তার হৃত গৌরব ফিরিয়ে দিতে হবে – গণমাধ্যম-কেন্দ্রিক আবেগঘন চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে করে তুলতে হবে মানবিক, ক্রিয়াশীল এবং জনকেন্দ্রিক| তাই ‘চরৈবেতি, চরৈবেতি’|

বি:দ্র: – লেখক তার ২০০১-২০০৪ সালের প্রেসিডেন্সি কলেজে স্নাতক পর্যায়ের ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক বাস্তবিক ধারণা লাভ করেন| সেই সময়ের সমস্ত অগ্রজ এবং সমসাময়িকদের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই লেখা| তাই এই লেখায় কোনো গ্রন্থপঞ্জি নেই| সবটাই অভিজ্ঞতা থেকে লেখা|

*লেখক কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক|

রাজনৈতিক হিংসা বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ কেন ? ভাবতে বসলেন-বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

বাঙালি জীবনে সংস্কৃতির নানা চেহারা। এর ভেতর সংস্কৃতি (!) হিসাবে রাজনৈতিক হিংসা বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে স্থান করে নিয়েছে বলেই মনে হয়। বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনেও তার প্রভাব আজ গাঢ়তর ফলে রাজনৈতিক রুচি ও ভদ্রতাও আজ অস্তাচলগামী। মুখোশ খুলে যাচ্ছে বারবার…মুখের মাস্ক (Musk) ও খুলে যাচ্ছে, চারিদিকে হিংসা ও কুকথার স্রোত। ইতিহাস সূত্রে দেখি বাংলা বহুদিন ধরে হিংসার পরিবেশ কে লালন করে আসছে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তো বটেই, নিজস্ব ব্যক্তিগত মানসিক বলয়ের ভিতরেও। “ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়ে” কবির ভাষায় যারা বসবাস করে তাদের অনেকে নিজের গোচরে বা অগোচরে হিংসার ভয়াল ছায়ায় আবৃত হয়ে আছে। মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে সাধারণ বাঙালি মানুষ ও মেনে নিচ্ছে অসহায় পশুবলি, জবাই, নির্মম ভাবে পশুহত্যা এবং ঐ সব হত্যা কে আবার দর্শন দিয়ে যুক্তি গ্রাহ্য (justify) করার চেষ্টা চলছে। শুয়োর কে জ্যান্ত পোড়াচ্ছে, অসহায় উট কে বেঁধে জবাই করছে, কুকুর ছানাদের সেবিকারা পিটিয়ে মারছে পণের জন্য মারছে বধূকে, চলছে দলিত হত্যা আরও কত কী। অসহায় মানুষের কাতর চিৎকারে কোন রাজনৈতিক দলের কি কোনোরকম মনোবেদনা আছে? এই হিংসা আছে বলেই রাজনৈতিক হিংসা আরও প্রবল। ভাগ্য ভালো যে সবাই অসৎ নন। আর হিংসা থাকবে নাই বা কেন? পশুহত্যা শুধু নয়, নরবলির প্রচলন ছিল এই বাংলায়।

ঠ্যাঙ্গাড়ের হুঙ্কারে শিউরে উঠত অন্ধকার কসাড় বন। কন্যাজন্মের পর নিষ্ঠুর ভাবে কন্যাটিকে মেরে ফেলা, কখনও গাছে জীবন্ত ঝুলিয়ে রেখে আসা, বিষ পিঁপড়ে ও অন্যান্যদের খাদ্য হিসাবে, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন দেওয়া এসব কাজ বাঙালি তো সংসার প্রতিপালন করতে করতে ধর্মাচরণ করতে করতে অনায়াসে করত আর ধূর্ত রাজনৈতিক নেতাদের মতো যুক্তি খুঁজে নিত। ফলে রাজনীতিতে তো রক্তরাগ এসে পড়বেই। হিংসা, হিংসার জন্ম দেবে। সংসার প্রতিপালন, দেবার্চনা, পিতার ভূমিকা, ভ্রাতার ভূমিকা পালন করতে করতে অক্লেশে বাঙালি পুরুষ কন্যাকে, পুত্রবধূকে তুলে দিয়েছে জ্বলন্ত চিতায়… সতীদাহ সম্ভব হয়েছে। তার মধ্যে সাংসারিক অর্থনীতির রাজনীতি ছিল। আজকের গবেষকরা তা বলেছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই কুটিল ধর্মীয় রাজনীতির স্বপক্ষে ‘সতীদাহ হোক’ এই মর্মে স্বাক্ষর কম পড়েনি। কাজেই হিংসা ছিল ছদ্মবেশে ভগবানের নামে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল। রাজনৈতিক লক্ষ্যে বহুবার বাঙালি মারা গেছে বাঙালির হাতে। আবার বলি হিংসা ছিল কিন্তু হিংসা ছিল ছদ্মবেশে যা আজও আছে। যেমন ফেসবুকে খেলা করে ছদ্মবেশে হিংসার আবহাওয়া এটা দেখেছি। এটা রাজনীতির পর্যায় হতে পারে যার ভেতর লুকিয়ে থাকে ক্ষমতাবানকে তুষ্ট করার রাজনীতি। বুড়ো আঙুল তোলা, লাভ সাইন, কেয়ার ইত্যাদি হল এই রাজনীতির অস্ত্র। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে বশে রাখার অস্ত্র। সবাই তা না করলেও অনেকে করেন। আমি দেখি যে ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকে গোপন হিংসা, প্রতিবেশীর কপট রাত্রি!! “আমি আপনারই” এই কথা বোঝানোর অস্ত্র আর রাজনীতিতেও তো তাই হয়। ‘হিংসা’ ছদ্মবেশে থাকে, মিছরীর ছুরি থাকে। রাজনৈতিক হিংসার আবার অন্য অস্ত্র। যেখানে হাতিয়ার হল গুলি, বন্দুক, বোমা, ছুরি, গাঁজা কেসে ধরিয়ে জামিনের পথ বন্ধ করা ইত্যাদি। সে এক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, হিংসার ভুলভুলাইয়া! অস্ত্রের ঝংকার, হিংসার কলরোল! এই রাজনৈতিক হিংসা বাঙালিকে তখন এক সমীকরণে পৌঁছে দিয়েছে যেখানে শহিদ দিবস পালন মানেই আমাদের পথের লোকরাই, সে ১৩ জন হোক আর ৩০ জন হোক, আমাদের দলের লোকেরাই শহিদ একথা বক্তৃতায় বলব আর অন্য দলের তরুণ ময়দানে যাবার পথে পুলিশের লাঠি চার্জে মারা গেলে বা অন্য দলের কেউ নিহত হলেও যে শহিদ নয় এই সংস্কৃতিকে বক্ষে ধারণ করতে হবে। এ সংস্কৃতি শিক্ষিত বাঙালি, অধ্যাপক বাঙালিকেও আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এক গোপন চাপা হিংসা এসে ঢেকে ফেলছে তাদের রাজনৈতিক চেতনা। কিন্তু কবে থেকে রাজনৈতিক হিংসা বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল? অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ই বা কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে একটু দূর দিগন্তে তাকাতে হবে। বাঙালি জাতির জন্ম এক মহা কলরোলের ভেতর। সুজলা সুফলা বঙ্গ দেশে বারবার আক্রমণকারী হয়ে এসেছে নানা জাতি। যুদ্ধ হয়েছে কিন্তু অনেকেই শেষ পর্যন্ত এখানে থেকে গেছে। একেবারে আদিম অধিবাসীরা বাধ্য হয়েছে মহামিশ্রণের পরিচয় নিতে। প্রমাণ হয়েছে বাঙালি এক মিশ্রিত জাতি। বাঙালির মুখের ভেতর তাই নানা জাতির আদল। আসল ছিল ক্ষমতা লাভের বাসনা যা থেকে এত রাজনীতি, এত হিংসা! রুপিয়া, নীল গাড়ি, দলদাসদের আনুগত্য পাবার লোভে উন্মাদ রাজনৈতিক হিংসায় যোগ দিচ্ছেন মহিলারাও। আমরা বলি যে, আমরা হিংসা ভালোবাসি না কিন্তু হিংসা করি এবং রাজনৈতিক হিংসা তো আমাদের আছেই। যা পরাজিতদের ঘর জ্বালানোর কাজে আগেও লাগতো এখনও লাগে। সব বিজয়ীরাই সাধারণত ভয়ের দর্শন বানাতে জানে।

নীহাররঞ্জন রায় লিখেছিলেন বাঙালির সমাজ বিন্যাসের ইতিহাসই বাঙালির ইতিহাস। সমাজবিন্যাসের পথে আসে প্রথমে ব্যক্তিগত, তারপর পারিবারিক তারপর রাজনৈতিক হিংসা। প্রাচীন গ্রন্থে দেখা গেছে বাঙালির কাম, ক্রোধ বরাবর বেশি। কাজেই সেই পথ ধরে হিংসা বেশি হবে এটা স্বাভাবিক।

নীহাররঞ্জন রায়ের মতানুসারে পাল রাজাদের আসন থেকে ধীরে ধীরে বাঙালি জাতি হিসাবে উত্থিত হওয়া শুরু করে তখন যে বাণিজ্যসম্পদ সুজলা সুফলা এক ভূখণ্ডের অধিবাসী যেখানে পুঁজির ঘনীভবন হচ্ছে। সেন যুগের শেষে রাজনৈতিক অস্থিরতার পরবর্তী পর্যায়ে বাঙালি জাতি ইসলামি সভ্যতার সম্মুখীন হয়। বিজেতা বা আক্রমণকারী শক্তি হিসাবে যারা বাংলার বাইরে থেকে আসে তাদের সঙ্গে বাঙালিদের সংঘাত শুরু হয়। সেই সংঘাত নানা ধারায় বইতে থাকে এবং দেখা যায় আজকে নয় বাঙালি বরাবর কেন্দ্র বিরোধিতা বাঙালির অস্তিত্ব হারাবার ভয় থেকে। ফলে যখন যে শাসক বাঙালির ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় জীবনকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। কী খাবে সে, কী করবে, প্রেম করবে কিনা এইসব যারাই ঠিক করে দিতে গেছে বাঙালি জাতিগতভাবে সমগ্র ও নিরস্ত্রভাবে তার প্রতিবাদ করেছে।

প্রয়োজনে হিংসার আশ্রয় নিয়েছে কেন্দ্রিকরণের রাজনীতির বিরুদ্ধে। উত্তর ভারত থেকে অস্ত্র হাতে, রাজনৈতিক হিংসা নিয়ে ধেয়ে আসা বিশুদ্ধ আর্যরা যখন আর্যাকরণের স্রোত নামিয়ে আনল বাংলায়। অর্থাৎ আর্যাকরণ শুরু হল তখন সে সময়ের বাংলাদেশে বসবাসকারী মানুষ তার প্রতিবাদ করেছিল। বহু বিস্তৃত নগর সভ্যতা আসলে যখন নাগরিকেরাই “ সামাজিক ধনের প্রধান বণ্টন কর্তা” হয়ে উঠছে তখন নগরের সঙ্গে গ্রামের সংঘর্ষ বাঁধল। বোঝা গেল কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হিংসা সংস্কৃতির অঙ্গ হতে বাধ্য। সেখানে কোন ছদ্মবেশ অবশ্য ছিল না। পণ্ডিত বর্জিত এই দেশে আর্যাকরণ শুরু হয়। কেন্দ্রবিরোধিতা ও শুরু হয়।

যখন ইসলামি শাসকরা দিল্লী দখল করল এবং ইসলামিকরণের দিকে জোর দিল কোন কোন শাসক তখন এই রাজনৈতিক অভিসন্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে, বাঙালির রাজনৈতিক হিংসার পর্যায় শুরু হল আবার। দাস খিলজি, তুঘলক মোদী বংশ পেরিয়ে মুঘল সম্রাটদের রাজনৈতিক লক্ষ্য কেন্দ্র থেকে প্রাপ্য ক্ষমতা বিস্তার , যা মৌর্য ও গুপ্তযুগের রাজাদেরও ছিল। এর বিরুদ্ধে প্রতিঘাতে বারো ভুঁইয়াদের উলান, স্বাধীন সুলতানির উত্থান, বাংলায় একের পর এক প্রতিরোধের কাহিনি। “ চাঁদ প্রতাপের হুকুমে হাটিতে হয়েছে দিল্লীনাথে” যা পরে লেখা হল। স্বাধীনতা সংগ্রামে যে রাজনৈতিক হিংসা ছিল তাঁর উৎসে ছিল না ব্যক্তিগত মনো বৈজ্ঞানিক বিকার কিন্তু রাজনৈতিক হিংসা এসেছিল স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয় দেশপ্রেমের জন্য। আবার একটু পিছিয়ে গিয়ে বলি পালযুগে কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে কৈবর্ত বিদ্রোহ ছিল কৌম বিদ্রোহ। এটি প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক হিংসার সংস্কৃতি প্রতিস্থিত করেছিল বাংলায়। কৃষক, শ্রমিক, গাড়োয়ান বিদ্রোহ, পালকি বেহারাদের বিদ্রোহে বাঙালির রাজনৈতিক হিংসা ধ্বনিত হয়েছিল কেন্দ্রীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, তবে কংগ্রেস বা গান্ধিপন্থি কংগ্রেস না আসা পর্যন্ত “ হিংসাই সমাজ বিপ্লবের ধাত্রী” এই পথে বাঙালির বিশ্বাস তৈরি হয়ে তা রাজনৈতিক সংস্কৃতির হিংসা হিসেবে থেকে যায়। নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন “ আদিপর্বের বাঙালির যে উত্তরাধিকার তাহার মধ্যপর্বের ও প্রথম উত্তরাধিকার এই চরিত্র ও জীবন দর্শন।” এই জীবন দর্শনে হিংস ও রাজনৈতিক হিংসা অবশ্যই একটি বিষয় ছিল।

কিন্তু হিংসা এল কেন? এর উত্তর নিহিতি আছে জিন তত্ত্ব ও পরিবেশের ভেতর। আজ আমি সেই বিতর্কে যাব না। সাধারণ ভাবে বলি আত্মগর্ব, জয় লাভের বাসনা, শ্লাঘা, স্বজন বিরোধিতা, প্রতিবাদের ভেতর বাঙালির জীবন ও রাজনৈতিক জীবন বারবার ঘুরপাক খেয়েছে। হাতের বিচারে, কুলীনত্বের বিচারে, বাঙাল-ঘটির বিচারে যদি হিংসা আসে তাহলে রাজনীতিতেও আসবে। এই প্রসঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনিশ্চয়তার পরিবেশ, অস্তিত্ব হারাবার ভয়, বিধান সভা বা পার্লামেন্টে সিট কমে যাবার ভয়, রাজনৈতিক প্রতি আক্রমণের ভয়, যে আক্রমণ আজ ভদ্র শিক্ষিত লেখাপড়া জানা মানুষের কাছ থেকেও আমরা পেতে পারি, যে কোন বিরোধী পক্ষ হলে। ১৯০৫ সালের পরে রাজনৈতিক হিংসা, গোষ্ঠীগত ও ধর্মীয় হিংসা উত্তরোত্তর বাড়ে। ছাগলবলি, উট জবাইয়ের দৃশ্য মানুষ উপভোগ করবে বলে ভিডিওতে দেওয়া হয় আজকের পৃথিবীতে। বাঙালিরাও অনেকে পেস্তাচেরা চোখ নিয়ে ঐ নিষ্ঠুরতা দেখে থাকেন। ইদানীং আরও আঁধার… কোভিডে বাঙালির নিষ্ঠুরতার কাহিনি সহৃদয়তার থেকে বেশি শোনা গেছে যা হিংসার নামান্তর। শেষে বলি বাঙালি কি হিংসা ও রাজনৈতিক ছদ্মবেশী হিংসা ছাড়তে পারবে? মনে হয় না। পশু হত্যা, পশু নির্যাতন, বাড়ির কাজের মেয়ে অসহায় বালিকার গায়ে গরম জল ঢেলে দেওয়া, সেবিকা তরুণীদের দ্বারা কোয়াটারর্সের উঠোনে একের পর এক কুকুর ছানাকে বিস্কুটের লোভ দেখিয়ে নিয়ে এসে নির্মম ভাবে পিটিয়ে হত্যা (দ্রঃ বিভিন্ন সংবাদপত্র)। এইসব হিংসা আরও সমৃদ্ধ করছে রাজনৈতিক হিংসায় দেখেছি অপরাধীকে ছাড়তে রাজনৈতিক নেতাকে থানায় ছুটে যেতে। আশ্চর্য এই যে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক হত্যায় এরা আবার কল্যাণময় ছদ্মবেশের দর্শন ব্যাখ্যার আশ্রয় নেন। সাম্প্রতিক সময়ে ‘স্ট্যান স্বামীর’ মৃত্যু যেটা দেখিয়ে দিয়েছে। আসলে বোধহয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে হিংসা শুধু বাঙালি নয় সকলেরই প্রত্যক্ষে পরোক্ষে থাকে। “বাব্বা! আমরা কি সৎ রাজনৈতিক দল” এই কথা বলার পেছনেও প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক হিংসা থাকে। অন্য দিকে ছোট করার উদ্দেশ্য। বাঙালি আধুনিক হয়েছে রাজনৈতিক হিংসার জয়গান গেয়ে। এই রাজনৈতিক হিংসা শুধু অস্ত্রে নয়, ব্যবহারে, মিথ্যাচারে, মনুষ্যত্বের অবমাননার ভেতর দিয়েও এসেছে। অনেক সময় এর কোন dialouge নেই কিন্তু প্রচ্ছন্ন ধারণা আছে। ধারণার ভেতর দিয়ে এটি সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে যায়।

মনোজগতে আসে আর বাংলার মিডিয়া আবার পিছিয়ে না পড়ে একে বি-বি-বিস্তারিত করে। তখন খ-খ-খবরের কাগজ মানে paid কাগজগুলোর মাধ্যম হয়। তখন হাসি মুছে যায়, রবীন্দ্রনাথ মুছে যান। এই প্রদোষকালে মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশ এর কবিতা – “…. কামানের স্থবির গর্জনে কোথাও বিনষ্ট হতেছে সাংহাই” আমি দেখছি রাজনৈতিক হিংসা আরও বেশি করে বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠছে। বিনষ্ট হচ্ছে মূল্যবোধ…ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাচ্ছে…

আমাদের হতে চাওয়া 'আমি' কে ফিরিয়ে দেয় তাঁর ছবি' অনুভব করলেন- অণ্বেষা বন্দ্যোপাধ্যায়

অণ্বেষা বন্দ্যোপাধ্যায়

ফিরে পাওয়া আমিকে

প্রথমেই বলি এই লেখা অত্যন্ত দুঃসাহসিক কাজ, অন্তত আমার কাছে তো তাই-ই। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবির মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং ওঁর ছবির মাধ্যমে যে হারিয়ে যাওয়া আমিকে আমরা ফিরে পেয়েছি, আমরা সেটুকুর সচেতনতা তৈরি করা। তাই লেখা শুরু করলাম প্রশ্ন দিয়ে যাতে ভাবনার উদ্রেক হয়।

আচ্ছা আপনাদের মনে পড়ে আপনারা ছোটবেলায় কীভাবে ভাবতেন? ছোটবেলার ভাবনার সঙ্গে যখন বড় হওয়া জুড়তে থাকল তখন ভাবনা কীভাবে দিক পরিবর্তন করল? লক্ষ করেছি আমরা? একটা সময়ের পর আমরা কেউ কিন্তু ছোটবেলার মত করে আর বড়বেলায় ভাবতে পারলাম্ না। কিন্তু কিছু মানুষ শুধু বড়র মতই দেখতে হলেন। গাছের কাছে দাঁড়িয়ে তাঁরা স্থির করলেন গাছেদের গল্পই বলবেন বা গাছে যারা বসবাস করে তাদের গল্প। তখন তাদের মনের রঙে ছোটবেলার রঙ আর সাদা কালো রইলনা। তাঁরা ঠিক করলেন এই যে মনের অবাধ যাতায়াত যেখানে বাস্তব স্বপ্ন মিশে যেতে পারে, সেখানে কল্পনার কোন গণ্ডি আঁকা থাকবেনা। সেখানে চরিত্ররা হবেন এমন একজন যেমনটা আসলে আমরা সবাই হতে চেয়েছি, কিন্তু পারিনি।

আমাদের চারপাশ সেই ‘আমি’ হয়ে ওঠাকে প্রশ্রয় দেয়নি। আর সত্যি বলতে কী, নিজেদের মধ্যে আসল আমিকে খুঁজে পেতে কার না ভাল লাগে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এই প্রথম সেই বিভিন্ন আমিদের সঙ্গে আলাপ করাতে এলেন তাঁর সিনেমাতে। যাদের দেখে মনে হল ঠিক এই এরকমই একজন মানুষই তো হতে চেয়েছি আমরা সব্বাই। তাঁর সবচেয়ে চর্চিত ছবি ‘চরাচর’-এর কথাই যদি বলি, আচ্ছা আমরা কি কেউ লক্ষ্মীন্দরের মত চাইনি পাখিরা আমাদের বন্ধু হয়ে উঠুক, এই পৃথিবী মানুষের চেয়ে অনেক বেশি হোক পাখির, এমনটা চাইনি আমরা। একটা সময় আমাদের সকলের জীবনে সত্যিই ছিল যখন আমরা সবাই পাখিদের বন্ধু হতে চেয়েছি, পাখির মৃত্যু, পাখির শিকার এমনকি পাখির মাংসও আমাদের কষ্ট দিয়েছে, এখনো হয়ত দেয় কিন্তু বড়বেলায় ফ্ল্যাটের ই.এম.আই আর চাকরির প্রোমোশনের চাপে এসব নিয়ে আর মাথা ঘামা্নোর সময় পাইনা। এখন আমাদের ভেতরের লক্ষ্মীন্দররা ঘুমিয়ে গিয়েছে, বা তাদের ঘুমোতে বাধ্য করা হয়েছে, তাই ক্ষণিকের জন্য জেগে থাকা সিনেমার লক্ষ্মীন্দরের পরিণতি আমাদের মতই হোক এমনটা চাইনি আমরা এবং এমনটা হয়ও নি, লক্ষ্মীন্দর পেরেছিল পাখিদের বন্ধু হতে ,লক্ষ্মীন্দর হয়ে উঠেছিল মনস্তত্বের ভাষায় ‘আইডিয়াল সেলফ’, আর ‘চরাচর’ হয়ে উঠেছিল উচ্চমানের সিনেমা।

আমাদের সকলেরই ছোটবেলা বলতেই মনে পড়ে স্কুল। আর নিজের স্কুল তা যতই অনামী, ভাঙাচোরা, বিদঘুটে নামেরই হোক না কেন তা নিয়ে আমাদের নস্টালজিয়া আজীবন, আর সেই নিয়ে গল্প তৈরী হল ‘জানালা’-এর। খুব কম রোজগার করা বিমল চাইল নিজের স্কুলকে একটা সুন্দর জানালা দিতে, একদম স্বপ্নের মত ডিজাইন করা জানালা। একদিন স্কুলে ভূগোলের ক্লাসে যখন মাস্টারমশাই বিভিন্ন অজানা দেশের অজানা সমুদ্রের কথা বলছিলেন বিমল সেই সময় জানলা দিয়ে সত্যি সত্যিই যদি সমুদ্রের ঢেউ দেখতে পেয়েছিল, ওর পায়ে এসে ঢেউ ছুঁয়ে গিয়েছিল। কারন এ কথা সত্যিই আমরা যখনই কিছু শুনি বা জানি আমাদের মস্তিস্কে সেই তথ্যের ছবি আঁকা হয়ে যায়। আর ছোটবেলার ভাবনায় সেই দেখতে পাওয়া অনেক গভীর আর স্বতঃস্ফূর্ত।

আমরা এখনো যদি মনের গভীরে একটু উঁকি দিই তবে দেখতে পাব এরকম অনেক স্বপ্ন অনেক ভাবনা আমরা এঁকেছি মনে মনে কিন্তু বলার সাহস পাইনি কখনো। আসলে সমাজের একটা নিজস্ব গণ্ডি আছে, যেটার বাইরে গেলেই ‘পাগল’ বলে দেগে দেওয়া হয় আমাদের। তাই অনেক সময় নিজের এমন অনেক ভাবনাকেও বলি ‘এসব কী পাগলের মত ভাবছি’। এবং আমরা কেউই নিজেকে ‘পাগল’ ভাবতে ভালবাসিনা। দেগে দেওয়া পাগলেরাও বাসেনা। কিন্তু এ কথাও খুব সত্যি মনস্তত্বে ভাবনার নির্দিষ্ট কোন স্রোত থাকেনা, কারন ভাবনার পরিধি অনেক বিস্তর…আমরা কিছু নিয়মের আওতায় নিজেদের ভাবনাকে বেঁধে রাখতে বাধ্য হই। তাই যে মূর্তি আমি শুধু কল্পনায় ভেবেছি তারই যখন প্রতিফলন পর্দায় দেখি, তখন আর সেই মুহূর্তের জন্য নিজেকে ‘একা’, ‘পাগল’ এইসব মনে হয়না, বিশ্বাস করতে সুবিধা হয় বাস্তবের সঙ্গে পরাবাস্তবের সম্পর্ককে। আর যখন সিনেমার পর্দায় দেখি প্রোটাগনিস্ট আমারই মনের কথা বলছে, ঠিক

সেই মুহূর্তেই মনে হয় এই মানুষটাই তো আমি। আমরা কিন্তু প্রত্যেকে আসলে চাই পর্দায় বলা গল্পের সঙ্গে নিজেদের জীবনকে মিলিয়ে দেখতে আর নায়কের সঙ্গে যদি নিজেকে মিলিয়ে ফেলি, ব্যস ওইটুকু সময়ের জন্য আমিই নায়ক, আমারই গল্প বলা হচ্ছে পর্দায়। আর ঠিক এভাবেই আমার মধ্যে থেকে যাওয়া, ঘুমিয়ে থাকা আমিরা; যারা প্রকাশ্যে আসতে পারতনা এতদিন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাদের সঙ্গে আবার আলাপ জমিয়ে দিলেন পর্দায়। এভাবেই তিনি পারলেন ম্যাজিক তৈরি করতে, শুধু গল্প নয় সিনেমায় তৈরি হওয়া ছবি দেখতে দর্শক সেলুলয়েডকেই অগ্রাধিকার দিলেন। যাতে করে সেই ছবিতে তৈরি হওয়া আমারই জীবনের গল্পের টুকরোদের আঁকড়ে রাখতে পারি, সারাজীবন।

পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: এক ছবির কবি' লিখলেন-সোমনাথ লাহা

সোমনাথ লাহা

কাব্যিকছন্দময়তা সেলুলয়েডে গাঁথেন বুদ্ধদেব

‘ছোটি মোটি পিঁপড়াবোটি, তেরে মামা লাড্ডুলায়া.. লাল দরজা খোলদে’.. বাস্তব আর অবাস্তবের মধ্যেলুকিয়ে থাকা সেই দরজাটাখুলতে পারলেই তৈরি হয় ম্যাজিক।আর কবিমন যখন সেই ম্যাজিকরিয়েলিজমকে সেলুলয়েডে আঁকেন তখন পর্দায় আমরাদেখি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত র ছবি। যাঁরএক একটি ছবি আদতেযেন এক চিত্রকল্প। আরসেটি গাঁথা হয়েছে কবিতার পংক্তি দিয়ে। তাই তাঁর ছবির দৃশ্যকল্প এতমুগ্ধ করে দেয় দর্শকদের।এমনকি আকর্ষণ করে চুম্বকের মত।একাধারে একজন কবি, অধ্যাপকবুদ্ধদেব যখন সিনেমার প্রতিভালোবাসা থেকে ছবি তৈরিরজন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে উঠলেন, তিনিহয়ে গেলেন ছবির কবি। সমাজেরবাস্তবকে নিজের চোখ দিয়ে দর্শকদেরচেনানোর এই পথে তিনিআনলেন জাদু বাস্তবতাকে। তাঁরছবিকে বহু বিদেশি দর্শকও সমালোচক স্যারিয়েল আক্ষা দিলেও তিনি নিজে তামানতে নারাজ ছিলেন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর কথায়, “বাস্তবকে চারপাশে দেখতে পাচ্ছি। জীবন বাস্তবময়। কিন্তুএকটা সময়ের পরে বাস্তব আরইন্টারেস্ট করে না। বাস্তবআর অবাস্তবের মাঝখানে এমন জিনিস আছেযা বাস্তবটাকে অনেক বেশি হাইলাইটকরতে পারে।” তাই তাঁর ছবিরদৃশ্যকল্প যেন অবাস্তবের মধ্যেথেকে বাস্তব আর বাস্তবতার মধ্যেঅবাস্তবকে নিরন্তরভাবে খুঁজে চলার এক পথপরিক্রমা।

সেই কারণেই তাঁর সমসাময়িক অনান্যপরিচালকদের থেকে তাঁর ছবিরআঙ্গিক অনেকটাই আলাদা। আর সেটা দেখলেইবুঝতে পারা যায় এটিবুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তেরজন্ম দক্ষিণ পুরুলিয়ার আনাড়ার রেল কোয়ার্টার্সে। তাঁরবাবা তারকনাথ দাশগুপ্তছিলেন রেলের ডাক্তার। পুরুলিয়ার মাটিতে তাঁর বেড়ে ওঠাহলেও বাবার বদলির চাকরির সুবাদে তিনি বড় হয়েছেনমধ্যপ্রদেশের মানেন্দ্রাগড়, চিরিমিরি র মতো জায়গায়।এ বিষয়ে বুদ্ধদেব নিজেও বলেছেন, “ভাগ্যিস আমার ছোটবেলা কলকাতায়কাটেনি। বড় শহরের ছোটবেলায়বৈচিত্র্য কম। প্রায় একইজিনিস ঘটতে থাকে। তুলনায়ছোট জায়গায় নানা ধরণের ঘটনাঘটতেই থাকে।” এজন্যই তিনি বলেছিলেন “কলকাতায়আমি ১৫দিনের বেশি থাকতে পারিনা।এই শহরটার সঙ্গে আমার love & hate এর সম্পর্ক। এইশহরটা প্রতি মুহূর্তে একটা tension তৈরি করে। মনেহয় বুঝি এই আমারগোপনীয়তা দখল হয়ে গেল।” সেই কারণেই বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি মানেই ওয়াইডঅ্যাঙ্গেল ফ্রেমে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। মাথার উপর সুবিস্তৃত নীলাকাশ।ম্যাজিক আওয়ারে কাজ করা ছিলতাঁর অত্যন্ত পছন্দের। আকাশের রূপ,রঙ দেখেতিনি তাঁর ছবির দৃশ্যঠিক করতেন। আসলে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তেরছবি মানেই আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাধারণ মানুষেরপ্রতিচ্ছবি। পারতপক্ষে আমরা যাদের এড়িয়েচলি সেই সব মানুষেরমনের ভিতরে ঢুকে অনায়াস দক্ষতায়তাদের মনের কথা বেরকরে নিয়ে আসতে পারেন বুদ্ধদেব।তাই অতলে পৌঁছে গিয়েচরিত্রকে বোঝার আর এক‌ইসঙ্গেবোঝানোর দায়‌ও নিতেজানেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। সেই কারণেই তিনিড্রয়িংরুম ফিল্মমেকার নন। আর সেটাতিনি হতেও চাননি। তবেতিনি তাঁর মতো করেএন্টারটেনমেন্ট করতে চেয়েছেন দর্শকদের।সিনেমা ছিল তাঁর বিশ্বাসেরজায়গা। তাই তো বরাবরতিনি থেকেছেন তাঁর নিজের মতোকরে। বেঁচেছেন তাঁর মতো করে।কখনো তাই তাঁকে টোপহতে হয়নি। আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি তাঁর সৃষ্টিশীলতা।১৯৬৮ তে ‘সময়ের কাছে’ নামক শর্টফিল্ম দিয়েতাঁর কাজের সূচনা।

প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যর ছবি ‘দূরত্ব’ মুক্তিপায় ১৯৭৮ এ। সেইশুরু।আর তার পরিসমাপ্তি ঘটে২০১৮তে ‘উড়োজাহাজ’ এ এসে। আরএর মাঝে জাতীয় ওআন্তর্জাতিক আঙিনায় তাঁর ছবির সূত্রধরে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ঝুলিতে উঠে এসেছে একাধিকপুরষ্কার। জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে তাঁর ছবি। ১৯৮৯তে ‘বাঘ বাহাদুর’,১৯৯৩তে ‘চরাচর’, ১৯৯৭তে ‘লাল দরজা’, ২০০২তে ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ এবং ২০০৮ এ ‘কালপুরুষ’ সেরা চলচ্চিত্র হিসেবেজাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়। সেরা নির্দেশকহিসেবে তিনি জাতীয় পুরস্কারপান ২০০০এ ‘উত্তরা’ এবং ২০০৫ এ ‘স্বপ্নের দিন’ এর জন্য।সেরাচিত্রনাট্য হিসেবে জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয় তাঁর ছবিফেরা (১৯৮৭তে)। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেওবুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি রীতিমতো সমাদৃতহয়েছে প্রথম সারির চলচ্চিত্র উৎসবগুলিতে। ভেনিস, বার্লিন‌, লোকার্নোর মতো চলচ্চিত্র উৎসবেপুরষ্কৃত ও এক‌ইসাথেপ্রশংসিত হয়েছে তাঁর ছবি।১৯৮২ তেভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বুদ্ধদেবের ছবি ‘গৃহযুদ্ধ’ ফিপ্রেসকিঅ্যাওয়ার্ড পায়। ২০০০এ সিলভার লায়ন ফর বেস্ট ডিরেক্টরসন্মানে ভূষিত হয় ‘উত্তরা’।১৯৮৮তে ‘ফেরা’ এবং ১৯৯৪তে ‘চরাচর’ বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গোল্ডেন বেয়ারের জন্য নমিনেশন পেয়েছিল।লোকার্নোতে তাঁর ছবি ‘দূরত্ব’ ক্রিটিক’স অ্যাওয়ার্ড পায়ও পরবর্তীতে এই চলচ্চিত্র উৎসবেবিশেষ জুরি পুরষ্কারে ভূষিতহয় বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি ‘নিম অন্নপূর্ণা’। ২০০৮ এমাদ্রিদ স্পেন( আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল) তাঁকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে। এছাড়া এশিয়াপ্যাসিফিক, কার্লভি ভ্যারি, দামাস্কাস এর মতো বহুলচর্চিতচলচ্চিত্র উৎসবেও পুরষ্কৃত ও সমাদৃত হয়েছেতাঁর ছবি।

সত্তরোর্ধ্ব বুদ্ধদেবদাশগুপ্তের মধ্যে ছিল ভরপুর জীবনীশক্তি।তাই ডায়ালিসিস চলা অবস্থাতেও প্রাণপ্রাচুর্যেভরপুর হয়ে তিনি করেগিয়েছেন তাঁর ছবির কাজ।ক্লান্তির ছাপ হীন, বরংকাজ বা আর ভালোকরে বললে সৃষ্টির সাধনায়নিবিড় ভাবে মিলন থেকেছেনবুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। কারণ তাঁর প্রিয়বিষয় ও জায়গাগুলো পছন্দেরহয়ে উঠেছে কোনো না কোনোঅনুষঙ্গকে ঘিরে। তাই তিনি মনেকরতেন একা থাকাটা খুবদরকার। কারণ স্মৃতি অনেকইমেজ ফিরিয়ে নিয়ে আসে। আর একান্তেস্যাঁতস্যাঁতে দেওয়ালের গায়ে, এমনকি মেঘের মধ্যেও মুখ খুঁজে বেড়াতেভালোবাসতেন তিনি। মনে মনে প্রতিনিয়ত‌ই ছবি করেবেড়ানো, বলা ভালো ছবিরসঙ্গে ওঠাবসা করেছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। আর তাই তিনিভেবেছেন সময়ের আগের কথা। যেগুলোনিজের ছবির মধ্যে দিয়েফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর মতে, “সময়েরআগের কথা ভাবতেই হয়সৃজনশীল মানুষকে। তারপর কি হবে? সেইকারণেই মোৎসার্ট, বাখ, বিথোভেন, রবীন্দ্রনাথেরসৃষ্টিরা অনন্ত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এঁরা চলে গেলেওএঁদের সৃষ্টি রয়ে গিয়েছে।” তাইগত ১০জুন বিশ্ব চরাচরে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বিলীন হয়ে গেলেও রয়েযাবে তাঁর সৃষ্টিরা। কারণতাঁর সৃষ্টির একটি নিজস্ব ভাষারয়েছে। পরিচালক হিসেবে এই স্বতন্ত্রতাই তাঁকেআলাদা জায়গা করে দিয়েছে। মানুষেরজীবনের একাকীত্বকে তাত্ত্বিকজায়গা থেকে বের করেএনে জীবনের গভীরে নিয়ে যায় বুদ্ধদেব দাশগুপ্তেরছবিগুলি।

থ্রিলার প্রেমি দর্শকদের মুগ্ধ করে ' মেয়ার অফ ইস্টটাউন' জানালেন-অজন্তা সিনহা

ডিটেকটিভ মেয়ারের চরিত্রে দুরন্ত কেট এইচবিও-র ক্রাইম ড্রামামেয়ার অফ ইস্টটাউন

সহ অভিনেতা গাই পিয়ার্সের সঙ্গে একটি ঘনিষ্ঠ যৌন দৃশ্যে অভিনয় করতে হবে তাঁকে। এদিকে চেহারায় বেশ বয়সের ছাপ পড়ে গেছে কেট উইন্সলেটের! চর্বি জমেছে শরীরের কোনও কোনও অংশে। পরিচালক ক্রেগ জোবেলের প্রস্তাব ছিল এই দৃশ্যটির যেখানে যেখানে কেটের পেটে চর্বি থাকায় কিছুটা দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছে সেই অংশগুলি বাদ দেওয়া যেতে পারে। এর জবাবে কেটের সটান জবাব একেবারেই না। এটা করার কথা ভাবার সাহসই কোরো না ,সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমস;কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা জানিয়েছেন কেট স্বয়ং।

এইচবিও-তে প্রদর্শিত সাম্প্রতিক সিরিজ ;মেয়ার অফ ইস্টটাউন (Mare of Easttown) নিয়ে কথা বলতে গিয়ে যথার্থই বিরক্তি প্রকাশ করে কেট বলেছেন, আমার চরিত্রটিকে পর্দায় আকর্ষণীয় দেখাবার ক্ষেত্রে বারবার চেষ্টা চালিয়ে গেছে ওরা। প্রতিবারই আমার জবাব ছিল না বলা বাহুল্য, কেটের শর্তেই তাঁকে দিয়ে কাজটা করাতে হয়েছে ক্রেগকে। সেটাই তো হওয়ার ! কারণ অভিনয়ের ক্ষেত্রে যে অপরিহার্য তিনি! সেখানে কোথাও সমঝোতা করেন না এই অস্কারজয়ী অভিনেতা। পরিচালকও জানেন চরিত্রটিতে তাঁর বিকল্প নেই। অন্যদিকে চরিত্রের প্রয়োজনেই আপসহীন কেট। মাঝবয়সী মেরিয়ান শিহানের চেহারা যেমনটা হওয়া উচিত তেমন ভাবেই দর্শকের সামনে নিজেকে হাজির করতে চেয়েছেন তিনি। কোনও বাড়তি রং নয়। নয় চেহারার তথাকথিত ত্রুটি লুকোবার চেষ্টা ! এটাও ঠিক, চরিত্রের প্রয়োজনে কখনও যদি তাঁকে এর উল্টোটা করতে হয় সেটাই করবেন কেট। তাঁর ট্র্যাক রেকর্ড তো একথাই বলে।

বস্তুত, ৭ পর্বের এই আমেরিকান ক্রাইম ড্রামার অনেকটাই দাঁড়িয়ে কেট উইন্সলেটের অভিনয়ের ওপর। কাহিনি ও নির্মাণ ব্র্যাড ইনগেলসবি। গল্প এইরকম, ফিলাডেলফিয়ার কাছে এক শহরতলি। সেখানেই ডিটেকটিভ মেরিয়ান ওরফে মেয়ার এক তরুণীর খুনের তদন্ত করছে। এই খুনেরও এক পূর্ব ইতিহাস আছে। এমনই আর একটি খুন যার সমাধানে সেদিন ব্যর্থ হয়েছিল মেয়ার। যার স্মৃতি আজও তাড়া করে বেড়ায় মেয়ারকে। প্রসঙ্গত, মেয়ার একদা বাস্কেটবল চ্যাম্পিয়ন। সেই হিসেবে এলাকার হিরো ছিল সে। তবে সে তো পঁচিশ বছর আগের কথা। সেই পুরোনো খুনের ঘটনার সূত্রেই এলাকায় জনপ্রিয়তা হারায় আজকের কড়া ও কাজপাগল

ডিটেকটিভ মেয়ার। এদিকে আজকাল মেয়ারের ব্যক্তিগত জীবনও নানা কারণে জর্জরিত। ডিভোর্স, ছেলের আত্মহত্যা এবং ছেলের বউয়ের সঙ্গে নাতির কাস্টডি নিয়ে আইনি লড়াই। ছেলের বউয়ের আবার একটি মাদকাসক্ত অতীত রয়েছে। যাবতীয় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে কীভাবে দাঁড়াবে মেয়ার তাই নিয়েই টানটান গতিতে এগিয়েছে এই সিরিজ। এবছর এপ্রিলে এই ওয়েবসিরিজ প্রিমিয়ার হওয়ার পর থেকেই দর্শকমহলে দারুণ সাড়া ফেলে দিয়েছে। বলা বাহুল্য, সারা বিশ্বের কেটভক্তরা আরও একবার তাঁর কামাল করা অভিনয় দেখে উদ্বেলিত। অভিনয়ে অন্যান্যদের মধ্যে আছেন জুলিয়েন নিকলসন, জিন স্মার্ট, অ্যাঙ্গরি রাইস, ডেভিড ডেনম্যান, নিল হাফ, গাই পিয়ার্স, ক্যালি স্পেনি, জন ডগলাস থমসন, জো টিপেট, ইভান পিটার্স, সসি বেকন, জেমস ম্যাকারডেল। প্রসঙ্গত, ৭টি পর্বই পরিচালনা করেছেন ক্রেগ জোবেল।

ওয়েবসিরিজের ক্ষেত্রে বরাবরই ক্রাইম থ্রিলারের রমরমা। ওটিটি চিত্রকল্পের প্ল্যাটফর্ম জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অপরাধীর দল। আর তাদের হন্যে হয়ে দমনের চেষ্টায় পুলিশ ও ডিটেকটিভ। অপরাধের এইসব বিচিত্র কাহিনির মধ্যে আধুনিক সময়ের পাশাপাশি প্রচুর অতীত ইতিহাসও উঁকি মারে। আছে মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণের বহুমাত্রিক কাহিনি। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তো আছেই। ভারতীয় দর্শক এখন এই সব সিরিজের কল্যাণে দারুন আকর্ষণীয় সব কাহিনি, সঙ্গে সারা বিশ্বের প্রথমসারির অভিনেতাদের কাজ দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কোনও কোনও সিরিজ আবার একাধিক সিজন ধরে দর্শককে একেবারে নেশাবন্দি করে রাখে। এর মধ্যে সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি সিরিজও আছে। সব মিলিয়ে দর্শক ধরে রাখার ক্ষেত্রে ক্রাইম থ্রিলারের আকর্ষণ অনস্বীকার্য। এত সবের মধ্যে মাত্র ৭ পর্বের এই মিনি সিরিজ একেবারে ভিন্ন স্বাদে মন কেড়ে নিয়েছে তামাম বিশ্বের থ্রিলারপ্রেমী দর্শকের। যার মুখ্য কৃতিত্ব অবশ্যই পাবেন কেট উইন্সলেট।

কীর্তনের সুরে মিনে করা কয়েকটি রবীন্দ্র গান:প্রথম পর্বেই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা পাড়লেন-কবিতা চন্দ

কবিতা চন্দ

 
 

কীর্তনের সুরে মিনে করা কয়েকটি রবীন্দ্রগান কবিতা চন্দ

পর্ব ১

বাংলায় বৈষ্ণবীয় লীলাকীর্তন যেমন আছে – তেমনি আছে কালীকীর্তন। আমরা শ্রৌতধর্ম বৈষ্ণব অধ্যুষিত লীলাকীর্তনের‌ই দ্বারস্থ আজ। সকলের শ্রবণে পদাবলীসূত্রে এক বাঁশির সুরকথার উপলব্ধি আছে। বাঁশি বলে ― রা-ধা, রা-ধা। ‛মধুরং মধুরং মধুরং মধুরম’ ― সেই ধ্বনি। গোঠলীলাতে এই না বাঁশির সুর শুনে অলপবয়সী রাধিকার রন্ধন আউলেছিল, মন‌ও ‛বেয়াকুল’ হয়েছিল। অতঃপর শ্রীহরি-শ্রীরাধিকার মহামিলন আর মহাবিরহ।

শুধু পদাবলীর ভাষাশ্বৈর্যে রাধাকৃষ্ণ লীলার সবটা উপলব্ধি সম্ভব নয়। বাংলাদেশ তাকে কীর্তনে বেঁধে আপন-মনের-মাধুরী সঞ্চারিত করেছিল ― সত্যরূপে। যুগে যুগে সেই গানের আঙ্গিক পরিবর্তিত হতে হতে একালে আমাদের কাছে যে রূপে ধরা দিয়েছে ― তা সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ মাত্রেরই শ্রবণামোদিত হয়েছে। বাঙালি এই হৃদয়স্পর্শী সুরে পদাবলী কীর্তনের মাধ্যমে দেবতাকে প্রিয় ভাবতে ভাবতেই প্রিয়র জন্য‌ যেন তা সঞ্চয় করেছে। কীর্তন এখন ফুল বেলপাতা হাতে নিয়ে নয়, যে-কোনো পরিবেশ পরিস্থিতিতেই মানবমনকে উতলা করে দিতে পারে। একালের কীর্তনের সু্রমহিমা এমনি। এই কীর্তনের সুর টান দেয় দুঃখে। মান দেয় ভালোবাসার। ধন দেয় প্রেমানুভবে।

বেদনাদূতী গাহিছে, ‛ওরে প্রাণ,

তোমার লাগি জাগেন ভগবান।

নিশীথে ঘন অন্ধকারে ডাকেন তোরে প্রেমাভিসারে

দুঃখ দিয়ে রাখেন তোর মান।

তোমার লাগি জাগেন ভগবান।…..

পরান দিয়ে প্রেমের দীপ জ্বালো।

সর্বানুভূতির যে কবি বাংলার কীর্তনের প্রতি অমোচ‍্য-আসক্ত ― তিনি রবীন্দ্রনাথ। তাঁর অন্তরের যাবতীয় আলো, যাবতীয় বেদন প্রকাশ করেছে তাঁর গান। সুরে লেগেছে ঐ অনুভবাদির পরশ। সেখানে কখনো সচেতনে কখনো আপনিই যেন এসেছে কীর্তনের সুর। আনন্দে। দুঃখভরেও। মনোবিদ বলেন ― দুঃখ শব্দটি আপেক্ষিক। দুঃখানুভূতির মূলে আছে সুখের স্মৃতি। কীর্তনের সুরে যেমন ভালোবাসা প্রকাশের অবধি মেলে না ― তেমনি রবীন্দ্রগানে এর প্রয়োগে অনেক সময় দুঃখজনিত হারানো সুখকেই বুঝি খুঁজে ফেরা হয়েছে। কিন্তু এসব কথায় রবীন্দ্রকথার সাক্ষ্য খুঁজে নিতে হবে। প্রথমে ঐ ‛মধুরং মধুরং’ ― ভাবরূপের সন্ধানে দেখি রবীন্দ্রনাথ পদাবলীর শব্দমাধুর্য কীভাবে পেয়েছেন।

বৈষ্ণবপদাবলী ধরা দিয়েছে তাঁর কবিতার শব্দ ছত্রে। এত গীতি, এত ছন্দ, এতভাবে উচ্ছ্বাসিত প্রীতি, এত মধুরতার সুধা মর্ত‍্যনরনারীর অনুভব-নিরিখেই যে মূলত আস্বাদ্য ― এ তাঁর উচ্চারণ। এও তো একপ্রকার কীর্তিগাথার জয়ধ্বনি। পদাবলীতে যাঁর বা যাঁদের সেই কীর্তি, তাঁদের মধ্যে আদিতে শুধু ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ ―পরে রাধা এসে দ্বৈতাদ্বৈত খেলা সম্পূর্ণ করেন। শ্রীমদভাগবতে দেখি : সোনার মতো উজ্জ্বল পীতবাস পরনে, মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, কানে কর্ণিকার ফুল আর গলায় বৈজয়ন্তীমালা ধারণ করে শ্রীকৃষ্ণ যখন বাঁশি বাজাতে বাজাতে নিজ-লীলাস্থল বৃন্দাবনে প্রবেশ করেছিলেন, তখন নাকি সেই অপরূপকে ঘিরে গোপীরা প্রথম তাঁর কীর্তি গান করেছিলেন। যা পরবর্তীকালের সৃষ্টিতে রাধাকৃষ্ণের লীলাকীর্তনে রূপ পেয়েছিল। কৃৎধাতু জাত সেই মধুর সংগীত‌ই কীর্তন। 

 

রবীন্দ্রনাথ জানান : কীর্তনে জীবনের রসলীলার সঙ্গে সঙ্গীতের রসলীলা ঘনিষ্ঠভাবে সম্মিলিত। জীবনের লীলা নদীর স্রোতের মত নতুন নতুন বাঁকে বিচিত্র। ডোবা বা পুকুরের মত ঘের দেওয়া পাড় দিয়ে বাঁধা নয় ― কীর্তনে এই বাঁধাধরায় পরিবর্তমান ক্রমিকতাকে কথায় চেয়েছিল।

বললেন : কীর্তন সংগীত আমি অনেককাল থেকেই ভালোবাসি। ওর মধ্যে ভাব প্রকাশের যে নিবিড় ও গভীর নাট্যশক্তি আছে সে আর কোন সংগীতে এমন সহজভাবে আছে বলে আমি জানিনে।

বুঝতে চেয়েছেন এর আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য‌ও। জানিয়েছেন : বাঙালীর কীর্তন গানে সাহিত্যে-সংগীতে মিলে এক অপূর্ব সৃষ্টি হয়েছিল। তাকে প্রিমিটিভ এবং ফোকম্যাজিক বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না। উচ্চ অংগের কীর্তন গানের আঙ্গিক খুব জটিল ও বিচিত্র। তার তাল ব্যাপক ও দুরুহ, তার পরিসর হিন্দুস্থানী ( উত্তর- ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীত ) গানের চেয়ে বড়ো। তার মধ্যে যে বহু শাখায়িত নাট‍্যরস আছে ― তা হিন্দুস্থানী গানে নেই।

এমন গানের কথাসম্পদ খুব অল্প বয়সেই রবীন্দ্রনাথের শ্রবণ হৃদয় আকৃষ্ট করেছিল। একটি বিশেষ গানের কথা এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়বে। গানটির পদকর্তা বিদ্যাপতি। বর্ষাঘনঘোরে মাথুরের বিরহকাতরতায় পূর্ণ সেই মূল গানটি ছিল এমনি:

এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।

এ ভরা বাদর মাহ ভাদর

শূন‍্য মন্দির মোর।।

ঝম্পি ঘন গর- জন্তি সন্ততি

ভুবন ভরি বরিখন্তিয়া।

কান্ত পাহুন কাম দারুণ

সঘনে খর শর হন্তিয়া।।

কুলিশ শত শত পাত-মোদিত

ময়ূর নাচত মাতিয়া।

মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী

ফাটি যাওত ছাতিয়া।।

তিমির দিগভরি ঘোর যামিনী

অথির বিজুরিক পাঁতিয়া।

বিদ্যাপতি কহে কৈছে গোঙায়বি

হরি বিনে দিন রাতিয়া।।

তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ষোল কি সতের। গঙ্গার ধারে একটি দোতলা বাড়ির বারান্দা থেকে তিনি দেখলেন : নতুন বর্ষা নেমেছে। মেঘের ছায়া ভেসে চলেছে স্রোতের উপর ঢেউ খেলিয়ে, মেঘের ছায়া কালো হয়ে ঘনিয়ে রয়েছে ও বনের মাথায়। অনেকবার এইরকম দিনে নিজে গান তৈরি করেছি, [ স্মৃতিচারণটি বহুকাল পরের ] সেদিন তা হল না। বিদ্যাপতির পদটি জেগে উঠল আমার মনে, ‛এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর’। নিজের সুর দিয়ে ঢালাই করে রাগিণীর ছাপ মেরে তাকে নিজের করে নিলুম।

রবীন্দ্রনাথের গানটির শুরুতে বিদ্যাপতির পদাবলীর প্রথম পংক্তিটির স্থান হল না। এ গান হয়ে উঠল রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান, বিরহের গান, মেঘ-মল্লারে আর সামান্য দেশ রাগে এই গানের সুরের চলনে এলো বর্ষাপ্রকৃতি-বর্ণন। কীর্তনের মতো কথাকেই প্রাণদান এই গানের‌ও যেন লক্ষ্য ― তথাপি এ গানে কীর্তনের সুরের আভাসটুকুও রাখলেন না তিনি। তবে এই গান নিয়ে তাঁর নানা উপলব্ধির প্রকাশ চলতেই থাকল। কল্পনা পাখা মেলল।

সমগ্র পদটির মধ্যে আপাত সাধারণ একটি ছবি ― ‛মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী / ফাটি যাওত ছাতিয়া।’ তার ব্যাখ্যায় জানালেন : এই ব্যাঙের ডাক নববর্ষার মত্তভাবের সঙ্গে নহে, ঘনঘটার নিবিড় ভাবের সঙ্গে বড় চমৎকার খাপ খায়। মেঘের মধ্যে আজ কোনো বর্ণ-বৈচিত্র্য নাই, স্তরবিন্যাস নাই, ― শচীর কোন প্রাচীন কিংকরী আকাশের প্রাঙ্গণ মেঘ দিয়া সমান করিয়া লেপিয়া দিয়াছে, সমস্ত‌ই কৃষ্ণধূসরবর্ণ।……….. আসন্ন বৃষ্টির আশঙ্কায় পঙ্কিল পথে লোক বাহির হয় নাই।

এই রূপ জ‍্যোতিহীন, গতিহীন, কর্মহীন, বৈচিত্রহীন, কালিমালিপ্ত একাকার দিনে ব্যাঙের ডাক ঠিক সুরটি লাগাইয়া থাকে। তাহার সুর ঐ বর্ণহীন মেঘের মতো, এই দীপ্তিশূন‍্য আলোকের মতো, ….বর্ষার গণ্ডিকে আরো ঘন করিয়া চারিদিকে টানিয়া দিতেছে।

অন্য আরেকটি প্রবন্ধে ভিন্ন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এই গানটিকে স্মরণ করে জানান : যাহাকে আমরা গীতিকাব্য বলিয়া থাকি অর্থাৎ যাহা একটুখানির মধ্যে একটুখানি ভাবের বিকাশ এই যেমন বিদ্যাপতির ―

ভরা বাদর মাহ ভাদর

শূন্য মন্দির মোর

সেও আমাদের মনের বহুদিনের অব‍্যক্ত ভাবের একটি কোনো সুযোগ আশ্রয় করিয়া ফুটিয়া ওঠা। ভরা বাদলে ভাদ্রমাসে শূন্য ঘরের বেদনা কত লোকের‌ই মনে কথা না কইয়া কতদিন ঘুরিয়া ঘুরিয়া ফিরিতেছে ― যেমনি ঠিক ছন্দে ঠিক কথাটি বাহির হইল, অমনি সকলেরই এই অনেকদিনের কথাটা মূর্তি ধরিয়া আঁট বাঁধিয়া বসিল।

রবীন্দ্রনাথ এক সময় বলেছিলেন এই গানটি তাঁর গানের ‛সিন্ধুক’-এ রাখা আছে। রবীন্দ্রনাথের কীর্তনের সুর খচিত গানে ব্রজবুলি শব্দ প্রয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু এককালের কীর্তন যে-গানের শব্দাবলী, ভাব আশ্রয় করে নিজেকে প্রকাশ করেছে; এক্ষণে আমরা দেখি যে রবীন্দ্রনাথ যেন সেটি আশ্রয় করেই নিজের অন্তরের ভাবের সৌধ গড়ছেন। বিদ্যাপতির গানে বর্ষার এই ছবিতে আপন বিরহীসত্তার অবয়ব দেখে দেখে অবধি পাচ্ছেন না তিনি যেন।

১৩১৭ সাল। ‛শান্তিনিকেতন’ প্রবন্ধমালার ‛শ্রাবণসন্ধ্যা’য় নিজের সুরে প্রায়শই গাওয়া এই গানটি স্মরণ করেন তিনি। এরই একটি অংশ :

‛তিমির দিগভরি ঘোর যামিনী

অথির বিজুরিক পাঁতিয়া

বিদ্যাপতি কহে, কৈসে গোঙায়বি

হরি বিনে দিন রাতিয়া’ ― পংক্তিগুলি

উদ্ধৃত করে রবীন্দ্রনাথ লেখেন :

প্রহরের পর প্রহর ধরে এই বার্তাই সে জানাচ্ছে, ‛ওরে তুই যে চিরবিরহিনী’ (অক্ষুন্ন রাখলেন রাধার ভাবটি ) তুই বেঁচে আছিস কী করে, তোর দিনরাত্রি কেমন করে কাটছে।’ কিছু পরেই এই আড়ালটুকুও রাখেন না। বলেন : আজ কেবলই মনে হচ্ছে এই যে বর্ষা, এ তো এক সন্ধ্যার বর্ষা নয়। এ যেন আমার সমস্ত জীবনের উপরে সঙ্গিহীন বিরহসন্ধ্যার নিবিড় অন্ধকার ― তারই দিগদিগন্তরকে ঘিরে অশ্রান্ত শ্রাবণের বর্ষণে প্রহরের পর প্রহর কেটে যাচ্ছে; আমার সমস্ত আকাশ ঝর ঝর করে বলছে, ‛ কৈসে গোঙায়বি হরি বিনে দিন রাতিয়া ’।

কে এই ‛হরি’ রবীন্দ্রজীবনে? হয়তো-বা ভালোবেসে অবধি না পাওয়া নিজস্ব সত্তারই রূপক তা। হয়ত বা ভালোবাসার ধন। জীবনের শেষ বেলায় এসে আর একবার ‛সিন্দুক’ থেকে এই গানটি তুলে এনে রবীন্দ্রনাথ সমর্পন করলেন ‛শেষের কবিতা’র অমিতকে। অমিত এ পর্যন্ত কখন‌ও বিদেশী কবির কবিতা ধার করে, কখন‌ও নিবারণ চক্রবর্তীর বকলমে লাবণ্যকে কবিতায় কবিতায় আপন মনের ঠিক কথাটি বলতে চেষ্টা করেছে। এক বৃষ্টির দিনে মনে হলো, তাও যেন ঠিক কথাটি বলে ওঠা হয়নি তার। তখন কথার অতিরিক্ত সত্য প্রকাশে সে সুরের কাছে হাত পাতে। লাবণ্যকে জানায় : পরের কথাকে নিজের কথা করে তুলি। সুর দিতে পারতুমি যদি তবে সুর লাগিয়ে বিদ্যাপতির বর্ষার গানটাকে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করতুম ―

বিদ্যাপতি কহে কৈছে গোঙায়বি

হরি বিনে দিন রাতিয়া।

যাকে না হলে চলে না তাকে না পেয়ে কী করে দিনের পর দিন কাটবে, ঠিক এই কথাটার সুর পাই কোথায়। উপরে চেয়ে কখনো বলি কথা দাও, কখনো বলি সুর দাও।

এইসময় দেখি পদাবলীর শব্দমোহ ছাড়িয়ে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ বহুকাল আগে। পদাবলীর অঙ্গে জড়ানো কীর্তনের সুর ছাড়তে পারেননি তিনি যেন কখনই। তাই আপনকথার সম্ভার রবীন্দ্রগান ক্ষণে ক্ষণে সেই সুর-খচিত হয়েছে। তবে তারও তো একটা শুরুর সময় আছে। সেটি কবে ?

সমুদ্র গুহের লেখা 'প্রতিরোধের নাটক' চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতির বিরুদ্ধ সচেতনতা থেকে এর জন্ম পড়লেন

সৌরিক সামন্ত

” সংস্কৃতি হলো মানব সমাজের এমনই এক আঙ্গিনা যেখানে আধিপত্যের যেকোনও রূপের বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ তার অভিব্যক্তির প্রকাশকে খুঁজে পায়। অস্ত্র হাতে বিপ্লব সংঘটিত করার যে চিরাচরিত অভ্যস্ত পথ তার বিপরীতে অন্য এক খাতে এই প্রতিরোধ সদা বহতা নদীর মতো প্রবহমান। “

সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক অনুশাসন যখন দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ সাধারণ মানুষের উপর চেপে বসেছে, কণ্ঠরোধ করেছে, তখনই দেশে দেশে কালে কালে সেই অনুশাসনের বেড়া ভাঙার জন্য সংগঠিত হয়েছে সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ছবি, কবিতা, গান-এর পাশাপাশি সবথেকে যে শিল্প-মাধ্যমটির মধ্যে দিয়ে মানুষ প্রতিরোধের ভাষ্য নির্মাণ করতে পেরেছেন, সেটি থিয়েটার। থিয়েটার হয়তো সরাসরি বিপ্লব ঘটাতে পারেনি একথা সত্য, কিন্তু বিপ্লবের সমস্ত উপকরণকে মজুত করেছে, মজবুত করেছে। আর তাই, মানুষের প্রতিদিনের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, বেঁচে থাকা- এসবের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে থিয়েটার।

প্রচলিত নাটকের ধারাবাহিকতা থেকে মুক্ত করে থিয়েটারকে জনগণের কাছাকাছি আনার প্রয়াস বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে বহু নাট্যবিদ করে গিয়েছেন। তাঁরা বুঝেছিলেন, থিয়েটারকে জনগণের সংগ্রামের শরিক করে তুলতে হবে। ফলে, দেশে দেশে, কালে কালে ভিন্ন সামাজিক অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে তৈরি হয়েছে ভিন্ন থিয়েটারের আঙ্গিক, শৈলী এবং তার উপস্থাপন। রোমা রোঁলা, এরভিন পিসকাটার, অগাস্তো বোয়াল, মায়ারহোল্ড, গ্রোটোস্কি, দারিও ফো, পিটার শ্যুমান, রিচার্ড শেখনার এবং অতি অবশ্যই ব্রেখট-এর প্রতিবাদী থিয়েটারের কথা বহুজনবিদিত। আমাদের মতো নাট্যশিক্ষার্থীদের কাছে প্রতিবাদের থিয়েটার বলতে এই তালিকাকেই সর্বোত্তম মনে করতাম। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত সমুদ্র গুহ’র গ্রন্থ ‘প্রতিরোধের নাটক’, সেই ধারনার বাইরে প্রতিবাদের থিয়েটার নিয়ে এক দিগন্ত খুলে দিয়েছে। আফ্রিকার, বিশেষত দক্ষিণ আফ্রিকা, ইসরায়েল, জাপান, চীন,প্যালেস্টাইন, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক প্রমুখ দেশের থিয়েটারের মধ্যে দিয়ে জনজাগরণ এবং প্রতিরোধের অবিশ্বাস্য বর্ণনা পাই। যা একাধারে বিশ্ব রাজনীতিতে রাজনৈতিক অবস্থান এবং শাসন-শোষনের খণ্ডচিত্র দেখতে পাই, তেমনই একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবে প্রতিরোধের স্পৃহায় স্নাত হই নতুন করে। আরও একটা দিক দিয়ে আলোচ্য গ্রন্থটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ‘প্রতিরোধের নাটক’ যে শুধুমাত্র অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার নাটক, তা বললে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। অনেকক্ষেত্রেই প্রতিরোধের নাটক তৈরি হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাবনা, যাকে ‘বিশ্বাস’ বলে প্রতিষ্ঠিত করা হয়; তার বিপক্ষে। যেন যৌক্তিকতার বিরুদ্ধে যে গড্ডালিকাপ্রবাহ চলছে যাকে ‘প্যপুলার কালচার’ বলা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে অন্যস্বরের সন্ধান করছে ‘প্রতিরোধের নাটক’।

কেমন প্রতিরোধ? আর সেই প্রতিরোধকেই নাটকের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে হ’ল কেন? গ্রন্থটির ভূমিকায় সমুদ্র গুহ’র নিজস্ব অভিমতটি এরকম- ‘এ দুনিয়ার হরেকরকম নাট্যধারার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো ”প্রতিরোধের নাটক”। একেক দেশে, একেক পরিস্থিতিতে গড়ে উঠেছে এর বুনোট, ধরন, নিজস্বতা। সচেতনভাবেই ভারতবর্ষের কথা বলিনি কারণ আমাদের দেশের চলনটা অদ্ভুতরকমের বিস্তর আলাদা। যেটা আরও গভীর গবেষণার দাবি রাখে’। এবং এই গ্রন্থটির পাঠক কে বা কারা হবেন, তার সম্পর্কেও একটি সুনির্দিষ্ট মত পাওয়া যায়,–‘ লেখাটা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে যারা দিন-রাতের পার্থক্য বোঝেন এবং অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস রাখেন তাদের জন্য’। প্রসঙ্গত, লেখকের ভূমিকাংশের এই অভিজ্ঞতার কথা, গোটা গ্রন্থের প্রতিটা পাতায় পাতায় তুলে ধরেছেন ইতিহাসের কালপর্বের সেই অমোঘ সত্যিকে যা অনিবার্যভাবে সত্য।

গ্রন্থটির সূচনাংশেই লেখক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নাৎসি জার্মানির হাতে দখলীকৃত ফ্রান্স এবং ক্লঁদ ভারমোরেলের লেখা প্রতিরোধের নাটক ‘জাঁ এভেক নাউস’-এর প্রসঙ্গ টেনে আনলেও, লেখকের মতে প্রতিরোধের নাটক নামক নাট্য আন্দোলনের বিশেষ ধারার রূপকার তাঁরাই, যাঁরা নাট্যমঞ্চের সংলাপকে রাজনৈতিক বিদ্রোহের যথার্থ শ্লোগানে পরিণত করতে পেরেছেন, সেই দক্ষিণ আফ্রিকা-তেই শুরু হয় প্রকৃত Theatre of Resistance। সেখানের নাটকের বিষয়ে এলো আত্মপ্রত্যয়ের কথা। এলো কালো মানুষদের আত্মমর্যাদার কথা। উঠে এলেন মাতসেমেলা মানেকা এবং মেইসে মাপোন্নার মতো প্রতিবাদী বর্ণাঢ্য নাট্যব্যক্তিত্ব। যাঁরা তামাম আফ্রিকায় একটা বজ্রঘোষনা হাজির করলেন-‘ বিরোধিতার দিন শেষ, এবার যুদ্ধ সরাসরি’। কী রকম যুদ্ধ? লেখকের ভাষায়,– ‘সেসোথোতে একটা নিয়ম ছিল যে, যারা সাদা-দের বাগানে, বাগিচায়, বাড়িতে, ফার্মে যেখানেই কুঁয়ো খুড়বেন তারা কিন্তু একফোঁটাও জলপান করতে পারবেন না, সে আপনি যতই পরাক্রান্ত, তৃষ্ণার্ত হোন না কেন। নাটকে উঠে এলো সেই কুঁয়ো খননকারী কালো মানুষের কথা। দু হাত জড়ো না করে, সমগ্র ব্যবস্থাটাকে উপড়ে ফেলে দুহাতে জলপান করতে চায় সে। শুরু হলো শোষিতদের ঐক্যবদ্ধ করে শোষকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান। এছাড়া অন্য কোনো বিকল্পও নেই।’

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো থিয়েটারের সংস্পর্শে, তার-ই অনিবার্য পরিণতি- আফ্রিকার মুক্তি আন্দোলন। এবং সেই আন্দোলনের জন্ম দিলেন যিনি, তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তি আন্দোলনের পথিকৃত Black Consciousness Movement-এর প্রণেতা স্টিভ বিকো (Steve Biko)। সত্তরের দশকে আবির্ভূত স্টিভ বিকোর সংগ্রাম, নাট্য-আন্দোলন নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন লেখক। সঙ্গে, ব্রাজিলের শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরির মতাদর্শের প্রতি অমোঘটান কীভাবে স্টিভ বিকো-কে জননায়ক করে তুললো, তারও তথ্যানুসন্ধানী বর্ণনা দিয়েছেন সমুদ্র গুহ- ‘তাই সব অর্থে স্টিভ বিকো’র এই আন্দোলন দ্রুত দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো সর্বত্র। নাটকে উঠে এলো এক ভিন্ন মেজাজ, নতুন প্রত্যয়। মুক্তি সংগ্রামের মাঝখানে সংস্কৃতিকে দাঁড় করালো যা ইতিপূর্বের কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন করতে পারেনি’।

এর পরের অংশে লেখক স্টিভ বিকোর রক্তাক্ত ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন। শহীদের মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল স্টিভ বিকোকে। ১৯৭৭ সালে ইষ্ট কোপের একটি প্রিজন সেলে নির্মমভাবে পিটিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় একটা গাড়ির সঙ্গে ঝুলিয়ে শত মাইল পথ ডিঙিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় প্রিটোরিয়ায়, যেখানকার কারাগারে খুন করা হয় স্টিভ বিকোকে। এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না স্বৈরাচারী সরকারের কাছে। স্টিভ বিকোর প্রসঙ্গেই লেখক এমন আরও প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক এবং নাট্যকর্মীদের উদাহরণ দিয়েছেন। নাট্যকার মাথেলি সেজি’কে তাঁর নাটক Shanti’র প্রযোজনার প্রথম রাতেই চলন্ত ট্রেনের সামনে ফেলে হত্যা করা হয়, বাকি কুশীলবদের সবাইকে টেরোরিস্ট আইনে বন্দি করা হয়। পরবর্তী সময়ে এই নাটক কিন্তু থেমে যায়নি। নাটকটি অন্যান্যরা করতে শুরু করলেন। একইভাবে ‘How Long’ নাটকের নাট্যকার গিবসন কেনেটকে বন্দি করা হল। একটার পর একটা নাটককে এবং নাটকের দলকে অবৈধ, বিপজ্জনক তকমা দিয়ে বাতিল করা হল। ততদিনে সাধারণ মানুষ নাটকের মধ্যে খুঁজে পেতে শুরু করেছে তাদের প্রতিবাদের ভাষা। গবেষক ম্যালরণের মতে ১৯৫৫ – ১৯৭৭-এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রায় দেড়শোটি প্রতিরোধের নাটক তৈরি হয়। এই উত্তাল কালপর্বে শাসকের চোখরাঙানি উপেক্ষা করেই নির্মিত হয়েছে লিউইস নাকোসির লেখা ‘The Rhythm of Violence’, জুলিয়াস ম্যাকানের ‘Give Us This Day’, মেইসে মাপোন্নার ‘Sizwe Bansi is Dead’, ‘ The Blood Knot’ ‘Hungry Earth’, মাতসেমেলো মানেকার ‘Egoli’, পিটার মাখারির ‘Long March’, এমিলি মুরের ‘Sofiatown’ -এর মতো কালজয়ী প্রতিরোধের নাটক, প্রতিবাদের নাটক।

প্রতিরোধের নাটকের উতুঙ্গ কালপর্ব আশির দশক। আয়ারল্যান্ডের সিভিল রাইট মুভমেন্ট, গেরিলা যুদ্ধ, হাজার হাজার মানুষের জেলযাপন। জেলের ভেতরেই তৈরি হতে থাকল, একটার পর একটা নাটক। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বস্তাপচা নীতির বিরুদ্ধে অরাজনৈতিক বন্দীদের মগজে সচেতনতা তৈরি করার লক্ষ্যে জেলের মধ্যে তৈরি হওয়া নাটক বাইরে চলে এলো। লেখকের বর্ণনায় সেই ঘটনার সামান্য বিবরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারা কঠিন। লেখকের বর্ণনায়-‘সিগারেটের মধ্য দিয়ে খোল থেকে তামাক বার করে ছোট চিরকুটে লেখা সংলাপ বোঝাই সিগারেট বিনিময় হচ্ছে বন্দীদের যারা দেখা করতে আসতেন, তাদের মধ্যে। তারপর বাইরে তৈরি হচ্ছে গোটা নাটক’। আর এইভাবেই তৈরি হয়েছে ‘Inside Out’, ‘Time Will Tell’, ‘Threshold’, ‘ At the Black Pig’s Dyke’- এর মতো একাধিক নাটক, যে নাটকগুলির সম্মিলিত আবেদনসুলভ সমবেত সংলাপ,— ‘ Peace is not the absence of war. Peace is the absence of contradictions that create war.’

প্রতিরোধের নাটকের আরেকটি মূল্যবান অধ্যায় রচিত হয়েছে ইজরায়েলে, যার ধরনটা পূর্বকথিত দেশগুলির থেকে বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে আলাদা। ইজরায়েল মানে উগ্র আগ্রাসনবাদ, পুঁজিবাদী মডেল, যুদ্ধের অস্ত্র কেনা-বেচা, গুপ্তচরবৃত্তি, ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ, সামগ্রিক অভ্যুত্থান, বেআইনি বন্দীশিবির, উগ্র ধর্মীয় জিগির। ইজরায়েল মানে গোটা আরব দুনিয়ার মুক্তিস্বপ্নকে ট্যাঙ্কের তলায় পিষে নিজেদের দখলদারি কায়েম করার উদগ্র নেশা। এরকম পরিস্থিতিতে এই দেশে যৌবনকে বিসর্জন দিতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। সেখানে সংস্কৃতি চর্চা, বিশেষত থিয়েটার চর্চা প্রায় সোনার পাথরবাটি। অথচ এর পরেও, হাইফার অত্যাধুনিক সামরিক ঘাঁটির অনতিদূরে নাটকের চর্চা হয়েছে। কারা করছে? জানলে অবাক হতে হয়, তার বেশিরভাগ করছেন মহিলারা। যুদ্ধ-সন্ত্রাস-দখলদারি যাদের মূলমন্ত্র, তাদের কাছে নাটক ‘বাইতুল তোরাহ’ মানে অহেতুক সময় নষ্ট। যেখানে পুরুষরা সমস্তকিছুর নির্ধারক, এবং তারা মনে করে নাটক ঐ ‘বাইতুল তোরাহ’, সেখানে মহিলারাই কুশীলব, তারাই সেই নাটকের দর্শক। এবং প্রতিটি নাটকে সন্তর্পণে নানা ঢাল ব্যবহার করে তারা নারী শোষন নির্যাতনের নির্মম সত্যকে প্রকাশ করছেন। এরকমই এক মহিলা যোদ্ধা নাট্যব্যক্তিত্ব আরনা মের খামিস।

প্যালেস্তাইন, লেবানন, সিরিয়ার সঙ্গে ইজরায়েলের অন্তহীন যুদ্ধে তৈরি হল অসংখ্য শরণার্থী শিবির। তৈরি হল প্যালেস্তাইনের মুক্তিযুদ্ধ ‘ইন্তিফাদা’। তৈরি হল জেহাদ। তৈরি হল মধ্য এশিয়ার সব থেকে বড়ো শরণার্থী শিবির ‘জেনিন’। এই ‘জেনিন’ শরণার্থী শিবিরে প্রতিরোধের নাটকের বীজ বুনে দিয়েছিলেন এক ইজরায়েলি মহিলা, তিনি আরনা মের খামিস। স্টোন থিয়েটার নামে আরনা মের খামিসের তৈরি দল জেনিন শরণার্থী শিবিরের বাচ্চাদের নিয়ে কাজ শুরু করে। যে শিশুদের প্রতিদিন কাঁদানে ধোঁয়া, স্মোক বোমার বিষাক্ত গ্যাস, একফোঁটা জল, একদলা খাবার আর একটু পাথরে পিঠ রেখে শোবার জন্য শিরদাঁড়ার গ্রন্থিগুলো তৈরি হতো, তাদের কাছে থিয়েটারের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার মতো কঠিন কাজটি করতে পেরেছিলেন আরনা মের খামিস। এর থেকেই পরবর্তী সময়ে তৈরি হয় ‘ফ্রিডম থিয়েটার’। প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের জন্য ফ্রিডম থিয়েটার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। দ্রুত জনপ্রিয় হওয়া এই থিয়েটারে রাইফেল ছেড়ে সশস্ত্র বেশ কিছু জেহাদি যোগদান করে। যেমন রাবিয়া টার্কম্যান। পরিচালক মহম্মদ মৌহি। এঁরা সশস্ত্র প্রতিরোধের যোদ্ধা থেকে প্রতিরোধের নাটকে সামিল হন। পরবর্তী সময়ে আরনা মের খামিসের ছেলে জুলিয়ানো মের খামিস-এর নেতৃত্বে ফ্রিডম থিয়েটার আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যদিও ২০১১ সালে জুলিয়ানোকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। তবু থামানো যায়নি ইজরায়েলের নাট্যগতি। ‘ Little Lantern’, ‘ Fragments of Palestine’, ‘Suicide Note from Palestine’, ‘ Sho Kamen?- What Else’ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্য দিয়ে প্রতিরোধের এই নাটকগুলি আর শুধু ইজরায়েল বা প্যালেস্তাইনে সীমাবদ্ধ নেই, বরং সীমান্তের গন্ডি ছাড়িয়ে, মধ্যপ্রাচ্যের গন্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর নাট্যোমোদী মানুষের মধ্যে।

গ্রন্থের একেবারে শেষ পর্বে, লেখক ভারতবর্ষকে বাদ দিয়ে অনান্য দেশের প্রতিরোধের নাটকের তথ্য ও সম্পর্ক সূত্রে প্রাপ্ত এই ধরনের নাটকের যে অভিমুখ নির্দিষ্ট হয়েছে, তার মূল্য বৈশিষ্ট্যকে আলাদা করে উল্লেখ করেছেন। প্রতিরোধের নাটক নিয়ে সমুদ্র গুহ’র অভিমত গুলো-

(এক) প্রতিরোধের নাটকের সারবত্তা হল রাজনৈতিক ভাবধারায় প্রাণিত আদ্যোপান্ত একটি রাজনৈতিক নাটক।

(দুই) প্রতিরোধের নাটক কোনও নির্দিষ্ট একটি রাজনীতির প্রতিভূ নয়, বরং চাপিয়ে দেওয়া যেকোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সচেতনতা থেকেই তার নির্মাণ, প্রস্তুতি এবং প্রযোজনা।

(তিন) বিশ্বায়ন এবং সর্বাত্মক পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সমস্ত লোকসংস্কৃতি, দেশজ ঐতিহ্য, পরম্পরার ধারাবাহিকতা, শিকড়ের উৎস সন্ধান নিয়েই নিজস্ব জনজাতির প্রয়োজনের দাবিতে গড়ে ওঠে প্রতিরোধের নাটক।

(চার) প্রতিরোধের নাটক মানুষকে সক্রিয় জনচেতনার উপস্থাপনায় সঞ্জীবিত করে, দর্শকের ভাবনার মর্মবস্তুতে ধাক্কা দেওয়ার ভেতর দিয়েই। দীক্ষা দেওয়া নয়, প্রশ্ন তৈরি করাই প্রতিরোধের নাটকের মূল উদ্দেশ্য।

(পাঁচ) প্রতিরোধের নাটক কৌশলধর্মী। রাষ্ট্রের কাছে এই নাটক পাল্টা বুলেটের মতো। তাই একই নাটক সময়ের বিচারে, স্থান-কাল বুঝে বারবার পাল্টে যেতে পারে, পাল্টে যেতে পারে নাটকের উপস্থাপন এবং অবয়ব। তাই এক অর্থে বলাই যায় প্রতিরোধের নাটক এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার।

(ছয়) বিশ্বায়িত সংস্কৃতির পরিবর্তে স্থানিক দেশজ সংস্কৃতির কথা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই নাটকে। গ্লোবাল ভাবনা আর লোকাল পরিকল্পনা, সব মিলিয়ে ‘গ্লোবাল’ ধারায় পরিবেশিত হয় প্রতিরোধের নাটক।

(সাত) প্রতিরোধের নাটক পপুলার কালচারের ধ্বজাধারীদের কাছে অত্যন্ত বিপজ্জনক।

গ্রন্থটির একেবারে শেষে লেখক সমুদ্র গুহ প্রতিরোধের নাটকের সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে একটি অসামান্য উদাহরণ প্রসঙ্গে নন্দলাল বসুর কথা তুলে ধরেছেন,যেখানে নন্দলাল বসু বলতেন,–” গাছ যখন আঁকবে তখন পাশ্চাত্য ভঙ্গিতে আঁকবে না, গাছ নিচ থেকে ওপরে ওঠে, ওপর থেকে নিচে নামে না।”

—— লেখকের কথা উদ্ধৃত করেই এই লেখাটি শেষ করব,– ‘ এখানেও তাই হবে, প্রতিরোধের নাটকের যা হবে সব নিচের মহল থেকেই হবে। হবেই। ‘

প্রতিরোধের নাটক

সমুদ্র গুহ

প্রকাশনা – আর.বি.এন্টারপ্রাইস

প্রকাশকাল- জানুয়ারি, ২০২১

প্রচ্ছদ- মনীষ দেব

মূল্য – ১২০/

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) [email protected] ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *