একবিংশতম সংখ্যা ।। চতুর্দশ ই-সংস্করণ ।। জানুয়ারি, ২০২২

ভাণ পত্রিকা

একবিংশতম সংখ্যা ।। চতুর্দশ ই-সংস্করণ ।। জানুয়ারি, ২০২২

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

পার্থ হালদার

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) [email protected] ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সূচি

সম্পাদকের কথা

নতুন আর একটা বছর। দুই হাজার বাইশ। বিশ-একুশের ভয়াবহ দহন এখনও দিকি দিকি জ্বলছে। মালুম হচ্ছে, এ আগুন সহজে নেভার নয়। ভাইরাস বহুরূপী, বহুরূপে সম্মুখে প্রকাশ তার। একবিংশের বিজ্ঞান তার সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে গিয়ে খাবি খাচ্ছে। বুঝছে, বিজ্ঞান এগোলেও বিশ্ব মানবের বিজ্ঞান ( চেতনা) এখনও সেই তিমিরে। বুঝছে, বিজ্ঞান উইদাউট কালচার , একটি অসম্ভব প্রকল্পনা। তারপরও যতটুকু শক্তি, ফুরিয়ে যাচ্ছে ভোট রাজনীতিকে ভেট দিতে। কখনও বা জাত পাত ধর্ম-উন্মাদনা আর বাজারী ফূর্তির পদতলে অসহায় আত্মসমর্পণে!! এই কোভিড কাল আসলে আমাদের এই ক্ষত গুলোকে চিনিয়ে দিল। কালকের চিন্তায় উদ্বেগকে শতগুণ বাড়িয়ে দিল।
আমাদের গান-নাচ-নাট্য- চলচ্চিত্রের, কঠিন সময়ের বিচিত্র অভিঘাত গুলোকে চিনতে এবং চেনানোর দায়িত্ব নেওয়ার কথা। কিন্তু মেইনস্ট্রিম পারফরম্যান্সের বিপরীত ঘটনা ঘটছে। আসলে ওরা ঘটে না। বাজার ওদের ঘটায়। তাই সীমিত গন্ডির মধ্যে দাঁড়িয়ে, মূল স্রোতের বাইরের বন্ধুদেরই পথ হাঁটতে হবে। রাস্তা চিনতে হবে। এপার বাংলার ও ওপার বাংলার এমন হাজারো লড়াকু বন্ধুদের সঙ্গে আমরা ” ভাণ” ও রয়েছি ময়দানে। ভাণ পত্রিকা ও চায়, এ সময়ের সৃষ্টি কলার ভেতরের তাপ উত্তাপ, উদ্দেশ্য বিধেয়, পারা না-পারা, মন‌-মেজাজকে খুঁজতে। শিল্পী, শিল্প ,বাজার, রাষ্ট্র এবং সমাজের অন্তর্লীন সমন্ধ কে আবিষ্কার করতে! যে নাটক মঞ্চে উঠছে, যে সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে, যে মুদ্রা নৃত্যে উঠে আসছে, যে সিরিজে মুখ গুজে বসে আছে আজকের প্রজন্ম,– ভাণ’ তার হিসেব নিতে চায়। কী উঠে আসা উচিত ছিল, কেন উঠছে না, খবর পেতে চায় তারও। নেশাগ্রস্ত সময়ে হিসেব নিতে গেলে নিজেদের যে মৌতাত মুক্ত রাখতে হবে, ভাণ একথা জানে। মেনে চলারও চেষ্টা করে আপ্রাণ।
পাঠক, আপনি ভালো থাকবেন। নতুন বছরে নিত্য নতুন মত বিনিময়ে আমরা একে অপরকে সমৃদ্ধ করি। এটাই অভিপ্রায়। নতুন বছরের শুভেচ্ছা শুভকামনা ভালোবাসা জানবেন! 

মন্দার

সৌম্য দাশগুপ্ত
 
মন্দার… 
অনেকদিন পর বাংলায় কোনো কাজ দেখে মনে হল যে বাংলা স্ক্রিন জগৎ বুঝি maturity লাভ করলো। সেই ঋত্বিক ঘটক আর সত্যজিৎ রায় আর মৃণাল সেন ভাঙিয়ে বহুদিন চললো। ইদানিং বাংলা সিনেমার মান যে খুব উঁচু স্বরে বাঁধা পড়েছিল সেটা কোনোভাবেই বলতে পারিনা খুব মাঝারি মানের কিছু কাজ, অতিরঞ্জিত অভিনয়, নিম্নমানের editing, পরিচালনায় অজস্র loopholes. তাই নিয়েই বাঙালি আহা উহু করেছে বটে। তবে কিছুতেই মানতে পারিনি যে “This is the best that Bengali cinema can afford”. মালয়ালি সিনেমা দেখেছি প্রচুর, দেখে মনে হতো যে এইরম সাবলীল আর অনায়াস ব্যাপারটা তো কিছুতেই বাংলায় খুঁজে পাইনা। ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল বেশ কিছু ভালো কাজ হয়েছে Flawless যাকে বলে। কিন্তু সাধারণ ভাবে আমাকে ভালো বাংলা সিনেমা বা ইদানিং কালের ওয়েব সিরিজ হতাশই করতো।
 
 
তারপর দেখলাম মন্দার। পরিচালক হিসেবে অনির্বাণ ভট্টাচাৰ্যের আত্মপ্রকাশ। Clean bowled করে দিলেন পরিচালক একেবারে।
 
অভিনেতা অনির্বাণ ও অসাধারণ। এক স্বনামধন্য পরিচালকের অধুনা এক ওয়েব সিরিজে অনির্বাণের অভিনয়তো প্রধান অভিনেতাকে ম্লান করে দিয়েছে।
 
যাক সে কথা। আজ আসি পরিচালক অনির্বাণ আর তাঁর প্রথম সৃষ্টি মন্দার এ।
 
 
আমাদের সাহিত্যে দুটি কথা বার বার ব্যবহৃত হয়। Fabula আর Syuzhet. Fabula বলতে খুব সাধারণ ভাবে বলা যায় “The raw material of a story”, আর Syuzhet বলতে “The way a story is organised.”
 
‘Macbeth’ একটি খুব জনপ্রিয় Fabula. উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তাঁর জন্যে অবলম্বন করা অসদুপায়, পরবর্তীকালে মানসিক যন্ত্রণা, অবশেষে সেই উচ্চাভিলাষী, দুষ্ট অথচ ভীষণ আকর্ষণীয় ব্যক্তির পতন। শেক্সপীয়ারের ‘Macbeth’ অবলম্বনে বহু সিনেমা হয়েছে। Kurosawar “Throne of Blood” থেকে বিশাল ভরদ্বাজের ” Maqbool”, Billy Morisette এর “Scotland PA” থেকে Ken Hughes এর “Joe Macbeth”, ও আরো অজস্র।
অনির্বাণও এই fabula টা নিলেন, এবং তাঁর গল্পের অবস্থান করলেন গেইলপুর বলে এক বন্দর শহর সংলগ্ন দ্বীপে।
গেইলপুরের মুকুটহীন সম্রাট ডাবলু। তাঁর অনুগত দুই অনুচর মন্দার ও বঙ্কা। চরিত্রের আদ্যাক্ষরে মিল রেখে অনির্বাণ মূল নাটকের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছেন। Duncan হয়েছে ডাবলু, Macbeth হয়েছে মন্দার, Banquo হয়েছে বঙ্কা, তার ছেলে Fleance হয়েছে ফুন্টুস, Macduff হয়েছে মদন, Lady Macduff হয়েছে লায়লা, Malcolm হয়েছে মঞ্চা। নিজের মতন কিছু পরিবর্তন করেছেন পরিচালক যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ Three Witches কে মা, ছেলে ও বেড়ালের রূপ দিয়ে।
 
 
অনির্বাণের চরিত্রটি সংযোজন, তবে তাঁর নাম ইঙ্গিতবাহী। মুকাদ্দার যেন আসলেই হয়ে উঠেছে কাহিনির Fate বা ভাগ্য নিয়ন্ত্রক। গেইলপুরের বাকিদের আঞ্চলিক ভাষার বিপরীতে মুকাদ্দার এর ভাষা ইংরিজি মিশ্রিত পালিশ করা বাংল‌। সে বাইরে থেকে এসেছে গেইলপুরের মানুষজনের ভাগ্যের মোড় ঘোরানোর জন্য।
 
অভিনয়ে কাউকে নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই। শুরুতেই বলেছিলাম, সিরিজ টি flawless। লায়লার ভূমিকায় সোহিনী অনবদ্য, যেমন অনবদ্য মন্দারের চরিত্রে দেবাশীষ বা বঙ্কার চরিত্রে শঙ্কর দেবনাথ। বাকি সবাই একইরকম flawless, কোথাও মনে হয়নি যে এই অভিনেতার এই জায়গায় অভিনয় jarring লাগছে। উল্লেখ করতেই হয় মজনু বুড়ি ও তাঁর ছেলের অনবদ্য অভিনয়। সৌমিক হালদারের দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফির সঙ্গেই উল্লেখ করতে হয় ক্যামেরার কাজের। কিছু drone shots এর ব্যবহারতো এক কথায় দুর্দান্ত। যোগ্য সঙ্গত ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এবং রূপকের ব্যবহার। ক্ষমতার লাল রং বোঝানোর জন্য মন্দারের লাল সানগ্লাস, বিড়াল ও মরা মাছের রূপক বা পাঁঠা কাটার সমান্তরালে যৌন মিলনের রূপক। সব মিলে মিশে একাকার হয়ে অনবদ্য কিছু single frame এবং একসঙ্গে একটি universal frame তৈরী হয়েছে।
 
 
সিরিজ এ যৌনতার ব্যবহারও ক্ষমতার জন্য, স্বার্থসিদ্ধির জন্য। আর সেই যৌনতাই ডেকে আনে বিপদ। তা সে ডাবলু ভাইয়েরই হোক আর মুকাদ্দারের।
 
আরও অনেক কথা বলা যায় মন্দার নিয়ে বলতে বসলে। আসলে বহুদিন বাদে বাংলায় এইরকম একটি কাজ দেখে মুগ্ধতায় এতটাই মজেছি যে ছোটোখাটো খটকার জায়গা নিয়ে আর ভাবাই হয় না। একটি প্রধান অসুবিধার জায়গা মনে হয়েছে পোড় খাওয়া রাজনৈতিক নেতা মদনের ভোটের মুখে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের অভাব। তবে সে অতি তুচ্ছ ব্যাপার, পরিচালনার অনবদ্যতায়, নতুন আঙ্গিকে বাংলা সিনেমা (থুড়ি webseries) এর পরিবেশনায়, মাঝারি থেকে শ্রেষ্ঠত্বের দিকে আবার বাংলা সিনেজগতের পদার্পণে মন্দার একটি যুগান্তকারী কাজ।
 
 
“Power corrupts, and the pursuit of power devastates” ‘Macbeth’ এর এই Fabula-র ওপর অনির্বাণের তৈরী Syuzhet, প্রচন্ডভাবে আঞ্চলিক হয়েও হয়ে উঠেছে universal। গেইলপুর হয়ে উঠেছে সারা পৃথিবীর রূপক, শেক্সপীয়ার এর ‘Macbeth’ বাংলায় এক অনবদ্য রূপে উপস্থাপিত হল প্রথমবারের মতন।বঙ্কা

অস্তিত্ব সংকটে ধুঁকছে বাংলার ছৌ, সরকারি উদাসীনতায় ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাবে না তো!

অঙ্কিতা পাল
 
পুরুলিয়ার রুক্ষ আবহাওয়া ও পাথুরে জমিতে সহজ, সরল আদিবাসী মানুষের ডেরায় সকাল বিকেল রোজ লালিত পালিত হয় বাংলার এক ঐতিহ্যপূর্ণ লোকসংস্কৃতি। কালো মানুষ, সোনালি সংস্কৃতি। এই কম্বিনেশনটা শুনতে যেরকম জাঁকজমক, মঞ্চে তার থেকেও বেশি জমকালো। দু্র্গা মায়ের মহিষাসুর বধ হোক বা নৃসিংহ অবতারের উরুতে ফেলে হিরণ্ণকশিপুরের জ্বলজ্যান্ত বুক চেড়ার দৃ্শ্য, পুরুলিয়ার ছৌ নাচের মাধ্যমে মঞ্চস্থ এই চরিত্রগুলো থেকে চোখ সরাতে পারবে না কেউই। এই কালো মানুষ, সোনালি সংস্কৃতির মিশেলে তৈরি হয় এক অদ্ভূত সুন্দর সংস্কৃতি যা অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে, পুরুলিয়ার বিভিন্ন গ্রামের রুক্ষ-সূক্ষ্ম মাটিতে গল্প বোনে। বাঙালির লোকসংস্কৃতিকে যা সোনালি পর্যায়ে নিয়ে যায় তা হল পুরুলিয়ার ছৌ-নৃত্য।
 
 
শহরের বহু নামি-দামি অনুষ্ঠানে, রাজনৈতিক শোভাযাত্রা বা প্রজাতন্ত্র দিবসের ট্যাবলোতে ছৌ নাচ পরিবেশনে মোটামুটি পশ্চিমবঙ্গবাসী সকলেই মুগ্ধ। কিন্তু এই নাচের ইতিহাস, ধরন, প্রকারভেদ অনেকেরই অজানা। ছৌ নৃত্যশিল্পীদের ওই ভারী মুখোশগুলির অন্তরালে তাদের প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামের কাহিনী জানে না অনেকেই। সেই মুখোশের আড়ালের মলিন জীবনের গল্পের খোঁজ এই লেখায় তুলে ধরা হয়েছে। প্রধানত তিন ধরনের ছৌ হয়। পুরুলিয়া, সরাইকেল্লা ও ময়ূরভঞ্জ ছৌ। বিভিন্ন রঙের মিশেলে উজ্জ্বল পোশাক ও ভারী মুখোশের ব্যবহারে পুরুলিয়া ছৌ অন্যান্য ছৌ নাচের মধ্যে থেকে দর্শক মনে এক অন্য জায়গা করে নিয়েছে। 
পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা এবং পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামে প্রচলিত ছৌ নাচের ধারাটি পুরুলিয়া ছৌ নামে পরিচিত। পুরুলিয়া ছৌ-এর সৌন্দর্য ও মুখোশের ব্যবহার একে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছে। সত্তরের দশকে পুরুলিয়ার ছৌ-নাচ বিশ্বের দরবারে একটি বিশিষ্ট লোকনৃত্য হিসেবে সমাদৃত হয়। তখন থেকেই ছৌ-নাচের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন বিশিষ্ট মহলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এই নৃত্যকলার নামকরণ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেক মতান্তরও রয়েছে। ছো-নাচ, ছ-নাচ ও আরও অন্যান্য ডাকনাম পেরিয়ে এই নৃত্যকলা এখন ছৌ-নাচ নামেই সর্বজনবিদিত। 
১৯৯৫ সালে নয়া দিল্লিতে আয়োজিত প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ট্যাবলোর থিম ছিল ছৌ-নাচ। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান ছাড়াও রাজনৈতিক শোভাযাত্রায় জায়গা করে নিতে দেখা গিয়েছে ছৌ-নাচকে। ছৌ প্রধানত আদিবাসী যুদ্ধ নৃত্য হিসেবে খ্যাত। তাই ছৌ-নাচে অংশগ্রহণকারীরা প্রধানত পুরুষই হয়। তবে সেই প্রচলিত প্রথা ভেঙে এখন মহিলাদেরও ছৌ-নৃত্যে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। ছৌ নাচ মঞ্চস্থ হয় সানাই, ঢামসা, নাকাড়ার সহযোগে। ছৌ নৃত্যশিল্পী তার শৈল্পিক কলা দেখানোর আগে রং গায়ক ঝুমুর গান গেয়ে নাচের পরিবেশ সৃষ্টি করেন। তারপর একে একে ঢোল, ধামসা, চড়চড়ি, টিকড়া, নাগড়া ও সানাই সহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের রোল ওঠে। তারপর শুরু হয় মহড়া।
ছৌ নাচের বিষয়বস্তু মূলত পৌরাণিক গাঁথা নিয়ে তৈরি হয়। রামায়ণ, মহাভারত, মহিষাসুরমহর্দিনী আরও অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনী যেমন- হিরণ্যকশিপু, সাবিত্রী-সত্যবান, শিব-পুরাণ, নৃসিংহ অবতার ও কৃষ্ণ লীলার কাহিনী জীবন্ত হয়ে ওঠে মুখোশধারী চরিত্রগুলোর ঝাঁপ ও শরীরের সঞ্চালনায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুনত্বের ছোঁয়াও লেগেছে এই আদিবাসী নৃত্যে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন চমক এসেছে বিষয়বস্তুতেও। আগে যেখানে পৌরাণিক গাঁথার মাধ্যমে দর্শকদের মনোরঞ্জন প্রদান ছিল ছৌ নাচের মূল উদ্দেশ্য কোভিড-১৯ অতিমারির সময় সেই ছৌ নাচ হয়ে ওঠে সচেতনতামূলক প্রচারের মাধ্যম। করোনাসুর বধের মাধ্যমে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ববিধি, মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার নিয়ে গ্রামবাসীদের সতর্ক করতে দেখা গিয়েছে ছৌ নাচের মধ্যে দিয়ে।  
 
 
কিন্তু যে ছৌ নাচ ভারতকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছে, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানকে আলোকমন্ডিত করে তুলেছে সেই ছৌ-নৃত্যশিল্পীদের হাঁড়ির খবর রাখেন ক’জন? অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগছে পুরুলিয়ার এই ছৌ-নাচ। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী লোকসংস্কৃতি উৎসব চালু করেছেন বাংলার লোকসংস্কৃতিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেখানে সুযোগ পাচ্ছে হাতে গোনা কয়েকটা দলই। শহরের বড় বড় মঞ্চে নিজেদের জায়গা করে নেওয়ার ঘোড়দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছে বহু দল। ছৌ-নৃত্য শিল্পী তো তাঁরাও। সরকারি অনুদানে উনুন ধরে কই! কোভিডের পর তো সেই উনুনে কাঠেরও খামতি হয়েছে। অতিমারির আগে কলকাতার দুর্গাপুজোর বিভিন্ন মন্ডপে একটা না একটা বায়না পেয়েই যেত ছৌ নাচের দল। কিন্তু কোভিডের কারণে পুজোর বাজেট ছাঁটে বাদ পড়েছে ছৌ নাচ। এরকম অবস্থায় সরকারি সাহায্যের দিকে তাকিয়ে দিন গুনছেন ছৌ শিল্পীরা। পুরুলিয়ার এক ছৌ-নৃত্য শিল্পী বলছেন, “আগে প্রতিটা গ্রামে যদি দুটি করে ছৌ-নাচের দল থাকত এখন তাহলে ৩০ টি গ্রামের মধ্যে ১০ টি গ্রামে হয়তো ছৌ-নাচের দল থাকে।” বহু ছৌ নৃত্যশিল্পীর আবার অভাব-অনটনে স্কুল যাওয়াও বন্ধ হয়ে গিয়েছে শৈশবেই। নবম শ্রেণির এক কিশোর বলছে, তার ভূগোল ও ইংরেজি পড়তে খুব লাগে। স্কুলে যাওয়া হয় না অভাবের কারণে। তাঁর পরিবারে সবাই ছৌ-নৃত্যশিল্পী। অভাবের তারণায় দলে নাম লিখিয়েছে সেও। মহড়া করেই উনুন ধরে তাদের বাড়িতে। এইভাবেই সংসারের অভাব অনটনে শৈশবেই মুখের হাসি হারিয়ে যায় বহু শিল্পীর। সংসারের অভাব অনটন তাদের কাছ থেকে প্রতিভাটুকুও কেড়ে নেয়। ভূগোলের বই ছেড়ে ভারী মুখোশে মুখ ঢাকে কিশোর। সেই মুখোশে লেগে থাকে, না পাওয়া ইচ্ছেদের আক্ষেপের কয়েক ফোঁটা বিন্দু। মুখোশের ওপারে যে একটা মলিন মুখ লুকিয়ে আছে তা ভুলিয়ে দেয় শারীরিক অঙ্গ-ভঙ্গি ও চাল। ছৌ-নাচের শৈল্পিক চাল ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঞ্চালনে যেন অন্য এক কিশোর ফুটে ওঠে। ছৌ-নাচের ডিগবাজিতে সেই কিশোর ভুলে থাকে না পাওয়া শৈশবের কথা। এরকমও বহু পরিবার আছে যারা কয়েক পুরুষ ধরে ছৌ-নাচের মহড়া করে আসলেও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরে এই পেশা বা সংস্কৃতিতে আনতে চান না। কারণ জানতে চাইলে উত্তর আসে এই পেশায় থাকলে খাবে কী? শিল্পীদের কথায়, পরবর্তী প্রজন্ম কতদিন এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে পারবে তার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। সরকারের উদাসীনতার কারণে ইতিহাসের পাতায় জায়গা হতে পারে বাংলার সোনালি সংস্কৃতির। 
 
 
পুরুলিয়া ছৌ-এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে ছৌ নাচের মুখোশ। পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি, ঝালদার পাশাপাশি চড়িদার নাম উঠেই আসে মুখোশের জন্য। পুরুলিয়া ছৌ ও মুখোশ কখনোই আলাদাভাবে স্থাপন করা যাবে না। তবুও প্রচারের আড়ালেই থাকে মুখোশ শিল্পীদের গল্প। বিভিন্ন মুখোশে হাসি, রাগ, কান্নার মতো বিভিন্ন অনুভূতি আঁকেন যাঁরা তাদের মুখে হাসি আঁকেন কে? “ছৌ এর মুখোশ আমরা না গড়লে কিন্তু পুরুলিয়া ছৌ নৃত্য তার অস্তিত্ব হারাবে। কারণ পুরুলিয়া ছৌ-এর বিশেষত্বই রং-বেরঙের মুখোশ। কিন্তু ছৌ নৃত্যশিল্পীরা শিল্পী ভাতা পেলেও, সরকার আমাদের জন্য কিছু রাখেননি,” বলছেন চড়িদার এক মুখোশ শিল্পী ধর্মেন্দ্র সূত্রধর। তিনি মুখোশ গড়ায় অসামান্য প্রতিভার জন্য জাতীয় পুরস্কার পেতে চলেছেন। জাতীয় স্তরে তাঁর কাজ স্বীকৃতি পাওয়ায় তাঁর গলায় উচ্ছ্বাসের সুর। এই স্বীকৃতির মোহে নিজের দুই মেয়েকে এই শিল্পে যুক্ত করতে চান। তার ১১ বছরের বড় মেয়েও তালিম নিচ্ছে একটু একটু করে মাটি, কাগজ, কাঠের গুঁড়োর মিশেলে মুখোশ গড়ার। তবে স্বীকৃতি দিয়ে তো হাঁড়ি চড়ে না সংসারের। তাই ধার দেনায় জর্জড়িত হন এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ধারকরা। মুখোশ শিল্প ধ্যান, জ্ঞান, মূল পেশা হওয়া সত্ত্বেও পাশাপাশি ছোটোখাটো কাজ করতে হয় সংসারে উনুন ধরানোর জন্য। রাজ্য সরকার থেকে কোনও ভাতা না পেলেও বাধ্য হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দেখানো পথ অবলম্বন করতে হয়েছে করোনা অতিমারির সময়। বাটালি, ছেনি, রং-তুলির বদলে শিল্পীদের হাতে উঠেছে খুন্তি, ঝাঝড়ি। কারণ মুখোশ শিল্পে সেইসময় লাভের মুখ না দেখায় লুকিয়ে লুকিয়ে চপ ভেজে সংসার চালাতে হয়েছে তাঁদের।
মুখোশ শিল্পী ধর্মেন্দ্র সূত্রধর জানান,”আগে সরকারের বিশ্ববাংলার জন্য আমাদের থেকে মুখোশ কেনা হত। কিন্তু করোনার পর থেকে সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যদিও বা কেনে তা শুধুমাত্র হাতে গোনা কয়েকটা শিল্পীর থেকে কয়েকটা মুখোশ।” চড়িদা গ্রামের প্রায় বেশিরভাগ পরিবার এই ছৌ নাচের মুখোশ তৈরির কাজে লিপ্ত। চড়িদা গ্রামের শুরু থেকেই রাস্তার চারিধারে মুখোশ রোদে শুকোতে দেখা যায়। বিভিন্ন দেব-দেবী, অসুর, জন্তু জানোয়ারের মুখের আদলে মুখোশ থাকে। যতদিন পুরুলিয়া ছৌ আছে, মুখোশের কারিগররাও আছে। ছৌ-নাচের পাশাপাশি অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে চড়িদার মুখোশ শিল্পীরা। তাদের কথায়, মধ্যস্বত্বভোগীদের হস্তক্ষেপে লাভের মুখ দেখতে পান না তারা। বাংলার এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যের ভার যাদের হাতে তাদের হাতেই ভাতের থালা ওঠে না তিনবেলা। তাই যথাযথ সুযোগ সুবিধার অভাবে ধুঁকছে ছৌ-মুখোশ শিল্পী ও চড়িদা গ্রাম।

মেফিস্টোর প্রতিক্রিয়া

সুমন দে
 
শিল্পীরা বরাবরই ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্সের সন্ধান করে এসেছেন। কিন্তু এই ধ্বংসস্তূপগুলি তৈরি হয় কীভাবে? মানবিক অন্তঃসারশূন্যতা ধীরে ধীরে সামাজিক অসঙ্গতির রূপ নেয়। মানব ইতিহাস বারবার ক্ষমতার রাজনীতির কথা বলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ক্ষমতার প্রকারভেদ ঘটেছে। কিছু শিল্পী ক্ষমতার সঙ্গে থেকেছেন, আবার কিছু শিল্পী ক্ষমতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন। এই প্রক্রিয়াটি অবস্থান হিসেবে পাল্টেছে। কিন্তু আমরা যদি বিংশ শতাব্দীর দুই মহাযুদ্ধের ইতিহাস ঘেটে দেখি তাহলে দেখবো মূল্যবোধের অবক্ষয় সারা পৃথিবী জুড়ে একটি সমবেত ধ্বংসস্তূপের সৃষ্টি করেছে। এই অবস্থায় শিল্পীসত্তা নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা পাবে কোথায়?
 
 
    তৎকালীন ইউরোপে ক্ষমতা কীভাবে সর্বগ্রাসী চেহারা ধারণ করেছিল তার চিহ্ন আজও পাওয়া যায়। বিশেষত জার্মানি ও ইতালি জুড়ে একনায়কত্বের ঝোড়ো হাওয়া পথের সমস্ত কিছু তছনছ করে দিতে লাগল। সেই সময়ে শিল্প বনাম ক্ষমতার লড়াইয়ের একাধিক ঐতিহাসিক কোলাজ আমাদের চোখে পড়ে – বার্লিন স্কোয়ারে সমস্ত হিটলার-বিরোধী বই পুড়িয়ে দেওয়া, বেটোফেন যখন শুনলেন জার্মানিতে হিটলার-রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন তাঁর সদ্য লিখিত ‘থার্ড সিম্ফোনি’ ছিঁড়ে ফেলা, কাইজারের মিছিলের দিকে গ্যাটের প্রতিবাদ ছুঁড়ে দেওয়া, হিটলার জামানায় জার্মানির থিয়েটারের ওপর আধিপত্য কায়েম করে একজন করে নাৎসি ইন্সট্রাক্টর বহাল করা – সবই আমরা লক্ষ করি। আর এই কোলাজগুলিকে একত্র করলে মানব-শিল্পের ইতিহাসের একটি মস্ত বড় দলিল পাওয়া যায়, যা রাজপথের ইতিহাসের সঙ্গে না মিশলেও অন্তঃসলিলা প্রবাহের মতো ছায়াসঙ্গী হয়ে চলেছে আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে।
 
 
       সেই ইতিহাস সাহিত্যের পাতায় পাওয়া যায়। যেমন- বিখ্যাত জার্মান সাহিত্যিক থমাস মানের(১৮৭৫-১৯৫৫) পুত্র ক্লাউস মানের(১৯০৬-১৯৪৯) উপন্যাস ‘মেফিস্টো’(১৯৩৬)। ক্লাউস মান জার্মানিতে জন্মালেও তাঁর মতাদর্শ তাঁকে জার্মানিতে বসবাস করতে দেয়নি। জার্মানি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর প্রথমে চেকোস্লোভাকিয়া, তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হয়েছেন তিনি। জীবনের শেষ পর্যায় কেটেছে ফ্রান্সে। একইভাবে তাঁর ‘মেফিস্টো’ উপন্যাসটি নেদারল্যান্ডের আমস্টার্ডামে প্রকাশিত হওয়ার পর স্বভূমি পশ্চিম জার্মানি সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ হয়ে যাযাবরের মতো ঘুরেছিল এক দেশ থেকে অন্য দেশে। কিন্তু আজ এই উপন্যাসের প্রাসঙ্গিকতা এত প্রবল যে তা কোনো রাষ্ট্রের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
 
 
    ‘মেফিস্টো’ প্রকাশের কয়েক বছরের মধ্যেই এই উপন্যাসটি নাট্য-নির্মাতাদের চোখে পড়ে এবং জার্মানি, রাশিয়া, ইতালি, ফ্রান্স ও আমেরিকা জুড়ে এর মঞ্চায়ন চলতে থাকে। বাংলা থিয়েটারেও এর মঞ্চায়ন ঘটে। কিন্তু অন্যান্য দেশের থিয়েটারে যেমন এই উপন্যাসটি গৃহীত হয়েছিল সমসাময়িক চাঞ্চল্যকর ঘটনার কোলাজের সম্মিলিত রূপ হিসেবে, কিন্তু বাংলা থিয়েটারের জনপ্রিয় পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় এটি মঞ্চে আনলেন প্রাসঙ্গিকতার ভিত্তিতে। আসলে ক্ষমতায়ন বা স্বৈরতন্ত্র একটি প্রবহমান তরঙ্গের মতো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলেছে এবং সমাজের ধ্বংসস্তূপ থেকে মেফিস্টো সৃষ্টি করে চলেছে। এই দার্শনিক মতবাদের উপর ভিত্তি করে সুমন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যুক্ত হলেন ‘চেতনা’, ‘মুখোমুখি’ এবং ‘তৃতীয় সূত্র’ নাট্যদলের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা।
 
 
    নাটকে আমরা একটা বিশেষ সময়ের সন্ধিক্ষণ দেখতে পাই। একদিকে জার্মানিতে বামপন্থার অবসান ঘটছে এবং অন্যদিকে উত্থান হচ্ছে একনায়কতন্ত্রের। জার্মানিতে বামপন্থা যখন শিখরে অবস্থান করছিল তখন সমস্ত ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে যে চাপা গুঞ্জন একত্র হতে থাকে, তাইই পরবর্তীকালে গর্জনের চেহারা নেয়। এই গর্জন যে মানবেতিহাসের পক্ষে কতটা বিপদজনক ছিল সে বিষয়ে আমরা অবগত। পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় ভারতীয় রাজনীতির এমনই এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নাটকটি মঞ্চে আনলেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান যে, ২০০৩-এ গুজরাট দাঙ্গায় ফ্যাসিস্ট উত্থানের সম্ভাবনাময় পরিবেশে নাটকটি লেখা। বর্তমান যুগে স্বৈরতন্ত্রের উত্থান পর্বে দাঁড়িয়ে নাটকটির গুরুত্ব কমে যায় না। তাই নাটকে বিশেষ পরিবর্তন করা হয়নি বা জোর করে সমকালীন আবহাওয়া চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ পরিচালক দর্শকদের উপর ঐতিহাসিক মুহূর্ত এবং বর্তমান পরিস্থিতিকে বিচার করার গুরু-দায়িত্ব দিয়েছেন।
    ক্লাউস তাঁর উপন্যাসে শিল্পীসত্তার দ্বন্দ্বটিকে স্থাপন করেছেন অভিনেতা হেনরিক হফকিন চরিত্রটির মাধ্যমে। হামবুর্গের এই অভিনেতাটি চায় বার্লিনে গিয়ে জার্মানির সেরা অভিনেতা হতে। নাটকের শেষে দেখা যায় সে তার প্রত্যাশার থেকে তিনি অনেক বেশি পেয়েছে, কিন্তু তার বদলে যা হারিয়েছে তার মূল্য কম নয়। শেষে নিজেকে বিক্রি করতে হলেও হফকিনের ভিতরের অভিনেতা বেঁচে থাকে। এবং সেই মূল্যবোধের দংশন বারবার এই চরিত্রটিকে সেই হামবুর্গের ছোট থিয়েটার দলে নিয়ে যায়। এই চারিত্রিক দোলাচলতার মধ্যে হফকিনের যেরকম shade তৈরি হয়েছে তা অনবদ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। এছাড়াও প্রধান চরিত্রদের মধ্যে সুজন মুখোপাধ্যায়কে আমরা দুটি চরিত্রে দেখতে পাই। দুটিই একেবারে বিপরীতধর্মী – একজন জার্মানির অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটককারের চরিত্র, যে ভিক্টোরিয়ান যুগের কোন এক কল্পনার অমরাবতীতে বসবাস করে। বর্তমান সময়ের অভিঘাতকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে, তাই স্বৈরতন্ত্র যখন শিল্পের শ্বাসরোধ করতে চায় তখন তার বিলাপ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। আর অন্য চরিত্রটি হল নাৎসী বাহিনীর জাঁদরেল কমান্ডারের, যে মেফিস্টোর প্রেরণাদাতা। নাটকে দুই বিপরীত-ধর্মী চরিত্রের মাহাত্ম্যকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে তুলেছেন অভিনেতা সুজন মুখোপাধ্যায়। এছাড়াও বেশ কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী নজর কেড়েছেন।
    যখন গৌতম হালদার হেনরিক হফকিনের চরিত্রটি করতেন তখন পরিচালক revolving stage-এ হফকিনের একটি monologue উপস্থাপন করতেন। সব মঞ্চে revolving stage-এর ব্যবস্থা না থাকায় সেটি সবসময় সম্ভব না হলেও ‘মেফিস্টো’-এর পুরনো দর্শকেরা মেফিস্টো-রুপী গৌতম হালদারের সেই বিশেষ দৃশ্যটির প্রতি এখনও মায়া ত্যাগ করতে পারেননি। সেট-এর দিকে একটি বিশেষ চমকপ্রদতার সৃষ্টি করেছে cyclorama-এর ওপর আনুষঙ্গিক দৃশ্যাবলির projection, যা নাটকটিকে অন্যমাত্রা দান করে। আলোকসম্পাতকারীদেরও প্রশংসা করতে হয়। বিশেষত হফকিনের চরিত্রে মেফিস্টোর প্রভাব এবং তার মানবিক দিক – এই দুটি shade ফুটিয়ে তুলতে আলো সাহায্য করেছে।
 
 
    নাটকটি বিশ শতকের ত্রিশের দশকের প্রেক্ষাপটে লেখা হলেও এর প্রাসঙ্গিকতা সুদূরপ্রসারী। সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাটকটির অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং মঞ্চের পেছনে থাকা কলাকুশলীরাও তাদের শিল্পের মাধ্যমে দর্শক-মনে সুদুরপ্রসারী জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছেন।

নবরস

শ্রীপর্ণা ভট্টাচার্য্য
 
শাস্ত্রীয় মতে রস হচ্ছে আস্বাদন। ভাবের অভিব্যক্তি ঘটে রস স্ফুরণের মাধ্যমে। রস বিভিন্ন এবং তা শরীরের বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভূত হয়। চোখের দ্বারা দৃশ্য, কানের দ্বারা শ্রবণ ও নাকের দ্বারা গন্ধ অনুভুত হয়, অর্থাৎ শরীরের বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের অনুভুতির আনন্দকে ‘রস’ বলে। 
‘সঙ্গীত দর্পণে’র মতে রস আট প্রকার কিন্তু নাট্যশাস্ত্র মতে আটটি রসের সঙ্গে নাট্যচার্যগণ ‘শান্ত রস’ কে নবম রস বলে  গ্রহণ করেছেন।
“শৃঙ্গার হাস্য করুণ রৌদ্র বীর ভয়ানকঃ
বীভৎসাদ্ভুত শান্তাশ্চ নবনাট্য রসাঃ স্মৃতা”।।
 
অর্থাৎ – শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত , শান্ত রস। এই নটি রসের আবার নটি স্থায়ী ভাব আছে। রস এবং ভাব পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্বন্ধীয়।  ভাব হল কারণ এবং রস হল তার ফল। নাট্যশাস্ত্রে আটটি রসের আটটি স্থায়ী ভাবের কথা বলেছে।
“রতির্হাসশ্চ শোকশ্চ ক্রোধোৎসাহৌ ভয়ং তথা।
জুগুপ্সা বিস্ময়শ্চেতি স্থায়িভাবাঃ প্রকীর্তিতাঃ”।।
 
অর্থাৎ- শৃঙ্গার রসের স্থায়ীভাব রতি, হাস্যের হাস, করুণের শোক , রৌদ্র- র ক্রোধ, বীর রসের উৎসাহ , ভয়ানকের ভয় , বীভৎস-এর জুগুপ্সা অর্থাৎ ঘৃণা, অদ্ভুতের বিস্ময়, এছাড়া শান্ত রসের শম। স্থায়ীভাব ছাড়াও আছে বিভাব, অনুভাব, ব্যাভিচারী ভাব, সঞ্চারী ভাব। স্থায়ীভাবের যা উদ্বোধক বা কারণ তাকেই বলে বিভাব। বিভাব দুই প্রকার- আলম্বন, উদ্দীপক । যাকে অবলম্বন করে ভাবের উদ্ভব হয় তাকে আলম্বন বলে। যেমন – নায়ক নায়িকা অর্থাৎ শিল্পী। আর যা রসকে উদ্দীপিত করে তাকেই বলে উদ্দীপন। অর্থাৎ বেশভূষা, দেশ, কাল , প্রাকৃতিক  দৃশ্যাবলী ইত্যাদি। 
আলম্বন বা উদ্দীপনের দ্বারা বিভাবের যে বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাকেই বলে অনুভাব। অর্থাৎ বিভাবের কাজকে বলা হয় অনুভাব। যেমন- সলজ্জ হাসি, কটাক্ষ ইত্যাদি ।
 
সাত্ত্বিকভাব অনুভাবেরই অন্তর্গত হলেও এর  চরিত্র আলাদা। সাত্ত্বিকভাবে মানুষ ইহজগৎ  ভুলে ডুব দেয় এক গভীরতর উপলব্ধির জগতে । সাত্ত্বিকভাব আট রকম- স্তম্ভ (অবশ ভাব), স্বেদ (ঘর্ম), বেপথু (কম্প), অশ্রু , বৈবর্ণ, রোমাঞ্চ, স্বরভঙ্গ (স্বরসাদ), মূর্ছা (প্রলয়)।
 
আটপ্রকার স্থায়ীভাব ছাড়াও, আর যে সব ভাব রস সৃষ্টিতে সাহায্য করে তাদের সঞ্চারী ভাব বলে।সঞ্চারী ভাব তেত্রিশ প্রকার। সঞ্চারী ভাব, বিভাব, অনুভাব, সাত্ত্বিক ভাব যখন রসিক মনকে সরস করে তুলতে পারে তখনই হয় রসসৃষ্টি । 
 
শৃঙ্গার রসঃ- রতি নামক স্থায়ীভাব থেকে শৃঙ্গার রসের উদ্ভব । শৃঙ্গ শব্দের অর্থ কামোদ্রেক। কামোদ্রেকের কারণস্বরূপ যে স্বরূপ যে রসের প্রকৃত উৎকৃষ্ট ও উজ্জ্বলভাব তাকে শৃঙ্গার বলে ।  ভাবসমূহের মধ্যে রতি এবং রসসমূহের মধ্যে শৃঙ্গারই শ্রেষ্ঠ। এই শৃঙ্গার রসকে কামোদ্দীপক এবং আদি রস বলে। এই রসের দেবতা বিষ্ণু এবং বর্ণ শ্যাম (নীল)। লৌকিক জগতে যা কিছু শুভ্র, নির্মল ও সুদর্শন তা শৃঙ্গারের সঙ্গে তুলনীয়। শাস্ত্র অনুযায়ী প্রেম-প্রধান শৃঙ্গার রসের দুটি স্থান-১) সম্ভোগ এবং ২) বিপ্রলম্ভ। 
 
১) সম্ভোগ (সম +ভোগ)– নায়ক নায়িকা যখন পরস্পরকে কাছে পায় এবং ভোগ করতে পারে।
ঋতু, মালা, সজ্জা, প্রিয় আসঙ্গ , ইচ্ছা, আনন্দ, উদ্যান, পরিদর্শন , দর্শন এবং শ্রবণ , ক্রীড়া , গমন, অনুভূতি ইত্যাদি বিভাব দ্বারা সম্ভোগ শৃঙ্গার হয়। 
 
রসপ্রকরণে সম্ভোগ দুই ভাগে বিভক্ত- ক)সংক্ষিপ্ত সম্ভোগ এবং খ) সম্পন্ন সম্ভোগ ।
 ক) সংক্ষিপ্ত সম্ভোগ- সাত্ত্বিক ভাব এবং লজ্জা দ্বারা এটি প্রকাশিত হয়। 
খ) সম্পন্ন সম্ভোগ- বিচ্ছেদের পর মিলন সংঘটিত হয়। স্ত্রী-পুরুষের পরস্পর নিষ্পন্ন কার্যই সম্পন্ন সম্ভোগ শৃঙ্গার। 
২)বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গার – নায়ক কর্তৃক বিচ্ছেদ ঘটিত নায়িকার দশাকে বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গার বলে। নির্বেদ , গ্লানি , শঙ্কা, অসূয়া, শ্রম, চিন্তা, ঔৎসুক্য, নিদ্রা, ব্যাধি, উন্মাদ ইত্যাদি বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গার নামে অভিহিত। রস প্রকরণ অনুযায়ী এটি পাঁচ প্রকার।–
ক)আয়োগ বিপ্রলম্ভ- বিচ্ছেদহেতু।
খ) বিরহ- পরিত্যাগহেতু
গ) মান- অবজ্ঞা কোপহেতু
ঘ) প্রবাস- অনুপস্থিতিহেতু
ঙ) শাপ- অভিশাপহেতু
বিভাব ও অনুভাব –  রোমাঞ্চ, অশ্রু, স্বরভঙ্গ, বিবর্ণ, প্রলাপ ইত্যাদি।
সঞ্চারী ভাব- গ্লানি, মদ , আবেগ, নিদ্রা, উন্মাদ ইত্যাদি।
হাস্য রসঃ- যখন কোন কিছু দেখে মনে হাসির উদ্রেক হয় তখন তাকে হাস্য রস বলে। অঙ্গ-ভঙ্গী , বিচিত্র বেশভূষা , হাসা ইত্যাদি থেকে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। এর স্থায়ী ভাব হাস। পরের কার্যের অনুকরণ থেকে হাস উৎপন্ন হয়। বর্ণ সাদা, দেবতা প্রমথ । ওষ্ঠদংশন, নাসিকা ও গণ্ডস্থলের কম্পন, নেত্রের বিস্তার ও আকুঞ্চন, ঘর্ম প্রভৃতি অনুভাবের সাহায্যে এর অভিনয় হয়। এর দুটি প্রকাশ আন্তস্থ ও পরস্থ। নিজে হাসলে হয় আন্তস্থ। পরকে হাসালে হয় পরস্থ। এর ছয়টি ভেদ আছে— স্মিতহাস্য, হসিত, বিহসিত, উপহসিত , অপহসিত, অতিহসিত। উত্তম প্রকৃতির লোকের হয় স্মিত এবং হসিত, মধ্যম প্রকৃতির বিহসিত ও উপহসিত, অধম প্রকৃতির অপহসিত ও অতিহসিত। হাস্য রস ত্রিবিধ- অঙ্গগত বেশগত ও বাক্যগত।
বিভাব- পোশাক, অলঙ্কার, ঝগড়া, লোভ।
অনুভাব- ওষ্ঠ এবং অধরের বিক্ষেপ, নাসিকা, গণ্ডদ্বয় ইত্যাদি।
সঞ্চারী ভাব- গর্ব, আবেগ, বিতর্ক, স্মৃতি ইত্যাদি।
করুণ রসঃ-  যখন কোন কিছু দেখে বা শুনে মনে শোকের অনুভুতি হয়, তখনই করুণ রসের সৃষ্টি হয়। এই রসের স্থায়ী ভাব শোক। বর্ণ  কপোত, দেবতা যম। রোদন (রোদন তিন প্রকার- আনন্দ থেকে জাত, বিপন্নভাবদ্ভুত  এবং ঈর্ষাপ্রসূত), মূর্চ্ছা, বিলাপ, দেহের কষ্ট বা দেহের আঘাতের সাহায্যে করুণ রসের অভিনয় করা হয়। 
বিভাব- অভিশাপ, হত্যা, হঠাৎ দুর্ঘটনা ইত্যাদি।
অনুভাব- চোখের জল, কান্না, মুখের রঙের পরিবর্তন, স্মৃতিভ্রষ্ট ইত্যাদি। 
সঞ্চারী ভাব- শঙ্কা, ত্রাস, শ্রম, চিন্তা, বিষাদ, উৎকণ্ঠা, স্বপ্ন, ব্যাধি, মরণ ইত্যাদি। ভয়
রৌদ্র রসঃ- কোন কিছু দেখে বা শুনে, মনে যখন ক্রোধের উদ্রেক হয় তখনই ঐ অনুভূতিকে রৌদ্র রস বলে। অর্থাৎ উন্মত্ততা এই রসে প্রকাশিত হয়। এই রসের স্থায়ী ভাব ক্রোধ। ক্রোধ পাঁচ প্রকার- শত্রুজাত, গুরুজাত, প্রণয়িজাত, ভৃত্যজাত এবং কৃত্রিম। এই রসের বর্ণ লাল, দেবতা রুদ্র। সাধারণত এই রস উদ্ভব হয় রাক্ষস, দানব এবং উদ্ধত মানুষের মধ্যে।
বিভাব- রাক্ষস, দানব, উগ্রতা, যুদ্ধ, ক্রোধ, মিথ্যা ভাষণ, প্রতিশোধ, হিংসা ইত্যাদি।
অনুভাব- অভিসাপ, ছেদন, আঘাত, হাত ওঠানো, অস্ত্র উদ্যত করা, রক্তপাত, ইত্যাদি।
সঞ্চারী ভাব- উগ্রতা, উন্মাদ ইত্যাদি।
বীর রসঃ- গর্ব, অহংকার, শক্তি ইত্যাদি ভাব মনে উদয় হলে বীর রসের উৎপত্তি হয়। পরাক্রমী, তেজস্বী, বীরপ্রকৃতির ব্যক্তিরা এই রসের নায়ক হয়। এই রসের স্থায়ী ভাব উৎসাহ। এর বর্ণ গৌর এবং দেবতা ইন্দ্র। যে অনুভাবের দ্বারা এর অভিনয় প্রযোজ্য সেগুলি হল- শৌর্য, ধৈর্য, ত্যাগ, ইত্যাদি। এই রস তিন প্রকার- দানবীর, দয়াবীর, যুদ্ধবীর। 
বিভাব-দৃঢ়তা, বাধ্যতা, ক্ষমতা, সাহস, শক্তি, যশ ইত্যাদি।
অনুভাব- আত্মত্যাগ, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি।
সঞ্চারী ভাব- গর্ব,  আবেগ, উগ্রতা ইত্যাদি।
ভয়ানক রসঃ-কোন কিছু দর্শনে বা শুনে মনে ভয়ের উদ্রেক হয় তখন ঐ অনুভুতিকে ভয়ানক রস বলে। এর স্থায়ী ভাব ভয়। ভীষণ কিছু দর্শন, ভয়ংকর কোন বিষয় শ্রবণ ও অন্যান্য কারণে ভয় জন্মে। ভূত থেকেও মানুষের ভয় হয়। এর বর্ণ কালো এবং দেবতা কাল। হস্ত পদের কম্প, নেত্র ঘূর্ণন, রোমাঞ্চ, মুখের বিবর্ণতা, স্বরভঙ্গ প্রভৃতি অনুভাবের সাহায্যে এই রসের অভিনয়।
বিভাব- ভূত দেখা, দ্রুতগমন, প্যাচা-শেয়াল থেকে ভয় পেয়ে উৎকণ্ঠা, খালি বাড়ি বা জঙ্গলে প্রবেশ।
অনুভাব-  হাত কাঁপা, চোখ-পা কাঁপা, শিহরণ, গলার আওয়াজ পরিবর্তন, বিবর্ণ রঙ।
সঞ্চারী ভাব- অপ্রীতিকর দৃশ্য দেখা, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ, শব্দ, শঙ্কা, ত্রাস, বিষাদ, আবেগ ইত্যাদি।
বীভৎস রসঃ-নোংরা বস্তু দর্শন অথবা কু-বাক্য শ্রবণ ইত্যাদি থেকে ঘৃণার উদ্ভব হলে বীভৎস রসের সৃষ্টি হয়। এই রসের স্থায়ী ভাব জুগুপ্সা অর্থাৎ ঘৃনা। এই রসের বর্ণ নীল এবং দেবতা মহাকাল। এই রস তিন প্রকার- ক্ষোভজ, শুদ্ধ, উদ্বেগী।
বিভাব- অপ্রীতিকর দৃশ্য দেখা বা শোনা বা আলোচনা করা।  
অনুভাব- বমন, অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিক্ষেপ, থুতু ফেলা ইত্যাদি।
সঞ্চারী ভাব- অপ্রীতিকর দৃশ্য দর্শন, ঘ্রাণ, স্বাদ, চিন্তা, জড়তা, স্পর্শ ইত্যাদি।
অদ্ভুত রসঃ- কোন কিছু দেখে বা শুনে মনে বিস্ময় ও আশ্চর্য ভাবের উদ্রেক হয় তখন ঐ অনুভুতিকে অদ্ভুত রস বলে। যেমন, যাদুকর ব্যক্তিরা এই রসের নায়ক। আশ্চর্য থেকে এর উৎপত্তি। এর স্থায়ী ভাব বিস্ময়। বর্ণ হলুদ, দেবতা ব্রহ্মা। এই রস দুই প্রকার- দিব্য এবং আনন্দ।
বিভাব- স্বর্গীয় দৃশ্য দর্শন, কামনার পরিপূরণ, মায়া, যাদু ইত্যাদি। 
অনুভাব- চোখ বড় করে খোলা, গায়ে কাঁটা দেওয়া, আনন্দাশ্রু, ঘাম, ইচ্ছাপূরণ, কম্প, রোমাঞ্চ ইত্যাদি।
সঞ্চারী ভাব- চিন্তা, জড়তা, আবেগ, সুন্দর মূর্তিদর্শন ইত্যাদি। 
শান্ত রসঃ-জাগতিক চিন্তা-ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে মন যখন অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি দ্বারা পরিপূর্ণ হয়, তখনই শান্ত রসের উদ্ভব হয়। এই রস সাধারণত ভক্তিমূলক। শান্ত, ধীর ও সাত্ত্বিক ভাবপূর্ণ ব্যক্তিরাই এই রসের নায়ক হয়। এর স্থায়ী ভাব শম। বর্ণ কুন্দেন্দুসুন্দর ও দেবতা শ্রীনারায়ণ।
বিভাব- দার্শনিক জ্ঞান -চিন্তা, পার্থিব ভোগ- বস্তু- কামনা থেকে মন মুক্ত, শুদ্ধ আত্মা ইত্যাদি। 
অনুভাব- সংযত, সত্য, ধ্যান, একাগ্রতা, সর্বজীবে দয়া, ইত্যাদি।
সঞ্চারী ভাব- সাহস, নিদ্রা,স্মৃতি, ইত্যাদি।
 
 
মানব মনের চিত্তবৃত্তির নানারকম নির্যাসে এর রসের উদ্গম হয় যা জীবন থেকেই গৃহীত এবং বোধের দ্বারা ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যকলায় শাস্ত্রসম্মত ভাবে প্রযুক্ত।

ওয়েব সিরিজ রিভিউ : দ‍্য উইচার

অভিষ‍্যন্দা লাহিড়ী দেব
 
এক ছিল শিকারী। তবে সে বাঘ ভাল্লুক মারত না। বড় বড় দৈত‍্য মারত। তার সম্বল বলতে ছিল একটা ঘোড়া আর একটা বর্ম, আর কিছু অস্ত্র শস্ত্র। টাকা পয়সা একেবারে ছিল টিল না। ভবঘুরের জীবন। যেখানে যে ধরণের দৈত‍্য বা দৈত‍্যাকার প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যেত সেখানেই পৌঁছে যেত সে। তারপর সেই দৈত‍্য বধ করা। সে সবে তার বিশেষ অসুবিধে নেই। কারণ, ওই কাজটি করার জন‍্যই ছোটবেলায় ম‍্যাজিক করে তৈরি করা হয়েছে সেই শিকারীকে। সে একা নয় তার মতো আরও অনেক এ জাতীয় শিকারী আছে। তাদের বলা হয় উইচার। দক্ষ উইচার শুধুর যাদুর খেলায় হয় না, নিতে হয় হাড়ভাঙা ট্রেনিং। তবে তাতেও সব সময় হয় না। এমন অনেক দৈত‍্য আছে যাদের যাদুশক্তি এই শিকারীর থেকেও বেশি। তাই সেই সব দৈত‍্যকে মারতে হলে এক ধরনের বিশেষ ওষুধ খেতে হয় তাকে। উইচারের প্রেমে পড়ে এক যাদুকরী। সে তার অসুন্দর চেহারা ম‍্যাজিক করে আশ্চর্য সুন্দর করতে গিয়ে সন্তানধারণের ক্ষমতা হারিয়েছে। একটা সন্তানের জন‍্য সে সব কিছু করতেই রাজি। কিন্তু সে বা উইচার কেউই প্রাকৃতিকভাবে বাবা মা হতে পারবে না। ঘটনাচক্রে এই উইচারকে দায়িত্ব নিতে হয় এক বাপ-মা মরা, রাজ‍্যহারা কিশোরী রাজকুমারীর। সেই রাজকুমারীর মধ‍্যে মাঝে মাঝেই অদ্ভুত সব যাদুশক্তি দেখা যায়। সে সব ম‍্যাজিক কীভাবে সে পেল তা কেউ জানে না, কীভাবে সেই যাদু সংযত করে কাজে লাগানো যায়– সে বিষয়ে কিচ্ছু জানে না রাজকন‍্যেও। অনাথ, ঘরছাড়া আর নিজেকে নিজেই ভয় পাওয়া এই মেয়েটির সঙ্গে জড়িয়ে যায় শিকারীর নিয়তি। আর নিছক এক শিকারী থেকে কীভাবে সে হয়ে ওঠে এক নিরলস রক্ষক–সেটাই গল্প। 
 
 
সেই গল্প নিয়েই তৈরি হচ্ছে নেটফ্লিক্স ওয়েব সিরিজ ‘দ‍্য উইচার’। হচ্ছে বললাম কারণ, আপাতত মোটে দু’টি সিজন তৈরি হয়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলে আরও পাঁচটি সিজন লাইনে আছে। গল্পের মধ‍্যে প্রচুর ঘোরালো মারপ‍্যাঁচ আছে, সে সব সামলে সুমলে ক্লাইম‍্যাক্সে পৌঁছতে ঢের সময় লাগবে।
তা মন্দ নয়, সে গল্প ভাল। গল্পের কারণেই এই সিরিজ নিয়ে এত হইচই। ফ‍্যান্টাসি সিরিজ চিরকালই লোকপ্রিয়, তবে ‘গেম অফ থ্রোনস’এর চুড়ান্ত জনপ্রিয়তার পরে এই জ‍্যঁরের সিরিজ তৈরির হিড়িক পরে গিয়েছে। তা সেই ধরনের সিরিজ নেটফ্লিক্সে আরও গন্ডা গন্ডা আছে। কিন্তু ‘দ‍্য উইচার’ ঘিরে সারা বিশ্বে জবর আলোচনা। আসলে এই সিরিজটি আগে থেকেই বেশ জনপ্রিয়। পোল‍্যান্ডের লেখক অ‍্যান্দ্রেজ স‍্যাপকোবস্কি যখন প্রথম এই সিরিজের ছোটগল্পগুলি লেখেন তখন থেকেই লোকের মনে ধরেছে এই কাহিনি। তারপরে তো তিনি আরও পাঁচটা উপন‍্যাস লিখেছেন এই গল্প নিয়ে। তৈরি হয়েছে পোলিশ ভাষায় সিনেমা। সব থেকে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে এই সিরিজের ভিডিও গেমস। তবে জনপ্রিয়তায় পাল্লা দিচ্ছে নেটফ্লিক্সের এই সিরিজটি।
কারণটা আর কিছুই নয়, দুর্দান্ত গল্প, দারুণ অ‍্যানিমেশন তো আছেই সঙ্গে আছেন মূল চরিত্র উইচার গেরাল্ড অফ রিভিয়ার ভূমিকায় হেনরি কেভিল।
 
 
একে তো ভদ্রলোকের জীভে জল আনার মতো চেহারা তার ওপরে মুকুটে সুপারম‍্যানের পালক আছে। আর এই গেরাল্ডের ভূমিকাটায় একেবারে প্রাণ ঢেলে অভিনয় করেছেন তিনি। বিশালদেহী হেনরি অ‍্যাকশন দৃশ‍্যগুলোয় অত‍্যন্ত সাবলীল। এই চরিত্রের জন‍্য চুলের রঙ থেকে গলার আওয়াজ সবই বদলাতে হয়েছে তাঁকে। সত‍্যি বলতে কী শুধু হেনরির গেরাল্ডকে দেখার জন‍্যই এই সিরিজ দেখা যায়। গেরাল্ডের লাভ ইন্টারেস্ট ইয়ানিফারের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত অভিনেত্রী অন‍্যা চালোত্রা।
 
 
 তিনি এককথায় অনবদ‍্য। আর আছেন রাজকন‍্যের চরিত্রে ফ্রেয়া অ‍্যালান। তিনিও বেশ ভাল। গেরাল্ডের বন্ধু জ‍্যাসিকর একজন সঙ্গীত শিল্পী। সেই চরিত্রে অভিনয় করেছেন জোই ব‍্যাটি। এই সিরিজের কমিক রিলিফ তিনি। বেশ ভাল লাগার মতো চরিত্রটি। জোইর অভিনয় অনবদ‍্য। সিজন ওয়ানের গল্পটা বেশি জটিল ছিল বটে তবে দারুণ জমেছিল, তুলনায় সিজন টু একটু ম্রিয়মান। তবে পরের সিজনের জন‍্য অপেক্ষা থাকবেই।
 
অভিষ‍্যন্দা লাহিড়ী দেব
 
 

আরণ্যক রিভিউ

ত্রয়ী
 
টানটান রহস্য, ঝকঝকে দৃশ্যায়ন
তাল কাটল শেষে গিয়ে
 
ওয়েব সিরিজের দুনিয়ায় রহস্য রোমাঞ্চে ভরপুর সিরিজের কদর সবসময় বেশি। সেই পথে হেঁটেই আরণ্যক আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে একটা রহস্যে মোড়া গল্প। রমেশ সিপ্পি এবং আদিত্য রায় কাপুরের প্রযোজনা এবং নেটফ্লিক্সের যোগ্য সহায়তায় আরণ্যকে প্রথম থেকেই ছিল টানটান উত্তেজনা।
 
আরণ্যক শব্দের সঙ্গে অনেক বাঙালির আবেগ জড়িত দীর্ঘদিন ধরে। ওয়েব সিরিজের নামটি অনেকদিন পর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের কথা মনে পরিয়ে দেয়। অরণ্যের মাদকতার সঙ্গে ‘আরণ্যক’ সিরিজ জুড়ে রয়েছে রহস্যের আস্তরণ। আর রয়েছেন রবিনা ট্যান্ডন, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, সঙ্গে জঙ্গলের জটিল রহস্য এবং সিরিয়াল কিলিং।
 
বিনয় ওয়ায়েকুলের পরিচালনায় পুলিশ অফিসার কস্তুরি ডোগরার চরিত্রে অভিনয় করেছেন রবিনা ট্যান্ডন। তার পরিবর্তে অফিসার হয়ে আসেন অঙ্গদ মালিক (পরমব্রত)। পেশাগত দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও একটি সিরিয়াল কিলিং এর কেস এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে দুজনেই । 
 
 
রবিনা টন্ডন এবং পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় এবং আশুতোষ রানা- তিনজনের অনবদ্য অভিনয় আট পর্বের সিরিজের শেষ পর্যন্ত থ্রিলারের মান ধরে রাখে।
 
সিরিয়াল কিলার, রাজনীতি, পাহাড়ি এলাকার লোকবিশ্বাস, পশুমানব (নরতেন্ডুয়া) সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে থ্রিলারধর্মী এই ওয়েব সিরিজে। গোটা ওয়েব সিরিজটি জুড়ে হিমাচল প্রদেশের অসাধারণ দৃশ্যায়ন। পাহাড়ি রাস্তার আঁকে বাঁকে ঘুরে বেরিয়েছে থ্রিলারটির চিত্রনাট্য। সিরোনা নামক শহরে ঘন জঙ্গলে ফরাসি নাগরিক এমির ঝুলন্ত লাশ পাওয়া থেকে গল্পের শুরু। লোকমুখে চাউর হতে থাকে ঠিক এমন ভাবেই বেশ কয়েক বছর আগে ওই শহরে উদ্ধার হয়েছিল ন’জন মহিলার মৃতদেহ। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এর নেপথ্যে রয়েছে নরতেন্ডুয়া (অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক পশু)। দীর্ঘ বিরতির পরে সে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে ফিরে এসেছে? একদিকে লোকবিশ্বাস, অন্যদিকে বাস্তব একে অপরের রেষারেষিতে এগোতে থাকে গল্প। এতকিছুর মধ্যেও ছোট্ট একটি চরিত্রে নজর কাড়েন ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত। 
 
টলিউডের পাশাপাশি বলিউডে বেশ কয়েকটি কাজ করেছেন পরমব্রত। ২০২০ সালে অনুষ্কা শর্মা প্রযোজিত নেটফ্লিক্স অরিজিনাল ফিল্ম ‘বুলবুল’এও দেখা গিয়েছিল তাকে।
 
সুস্মিতা সেনের পরে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ডেবিউ করেছেন রবিনা। আরণ্যকে তার অভিনয় অনেক দিন মনে রাখবেন দর্শকরা। বয়সোচিত চরিত্রে নিজেকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ছুড়েছেন নব্বই দশকের গ্ল্যামারাস অভিনেত্রী। অবাক করেছেন পার্শ্ব চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন তারা। মেঘনা, জ়াকিরের মতো অভিজ্ঞ চরিত্রাভিনেতারা যেমন তাঁদের চরিত্রে সুন্দর, তেমনই অবাক করছে কিশোর শিল্পীরা। রবিনার মেয়ের চরিত্রে তনিশা বা বান্টি রাওয়াতের চরিত্রে বিশ্বেস সারখোলির অভিনয় সপ্রতিভ।
 
আটটি এপিসোডের ওয়েব সিরিজে প্রথম সাতটি আপন ছন্দেই এগোতে থাকে, কিন্তু শেষের এপিসোডে গিয়ে কোথাও গিয়ে যেন তাল কেটে যায়। লোকবিশ্বাস-ধর্ষণ-খুন-রাজনৈতিক ফায়দা সব মিলেমিশে কোথাও যেন উপস্থাপনার একটা অভাব চোখে পড়ে। গল্পের একেবারে শেষে সিরিয়াল কিলারকেই যদি ধরতে পারা গেল, তবে লোকবিশ্বাসকে আবার সামনে আনার কি খুব প্রয়োজন ছিল? 
 
শেষের খামতি বাদ দিলে গোটা সিরিজ জুড়ে অসাধারণ অভিনয়ই আরণ্যককে এগিয়ে রাখবে অন্য ওয়েব সিরিজগুলোর তুলনায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *