দ্বাবিংশতম সংখ্যা, পঞ্চদশ ই-সংস্করণ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

ভাণ পত্রিকা

দ্বাবিংশতম সংখ্যা, পঞ্চদশ ই-সংস্করণ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

পার্থ হালদার

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) [email protected] ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সূচি

সম্পাদকের কথা

আপনারা লক্ষ্য করে থাকবেন কোভিডের সঙ্গে পুঁজির সম্পর্ক ক্রমশ গভীর হয়েছে।আমাদের যা কিছু ভালো মন্দ ,সোহাগ আদর, পবিত্র অপবিত্র, পুঁজি তাদের কাউকে ছাড়ে না। সবকিছুকে তার মত ভালো-মন্দ বানিয়ে না নিতে পারলে পুঁজির মুক্তি নেই। কিন্তু আমরা জানি, পুঁজির মুক্তির সঙ্গে আমাদের মুক্তির ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে। সাহিত্য শিল্প কলা তাবৎ চিন্তা প্রস্থানের মধ্যে বারবার উঠে আসছে পুঁজির দাসত্বের কথা। কথা উঠছে কিভাবে কখন কতটুকু পরিত্রান মিলবে! কখন আমরা বানানো জগতের বাইরে যেতে পারি। আমাদের নিজত্ব নিজস্ব স্বভাবে ফিরতে পারি।  স্বাভাবিক প্রকাশে প্রকাশিত হতে পারি! এই আন্তরিক ইচ্ছেই আজকে আমাদের একমাত্র ভরসা।

লক্ষ্য করছি সিরিয়ালের নায়িকার অভিনয় নয়, সিরিয়ালের বিষয় নয়, তার মেকিং নয়,    যারা এসব বানান, যারা জোগান, যারা ঘটান, যারা গেলেন, – তাদের মন মানসিকতা খোঁজার দায় নেই। নায়িকার ছবি মিলিয়ন ভিউজ পাচ্ছে, তার রোল খাওয়ার ছবিতে, গালে টোল পড়ার ছবিতে। নির্মাতা ও দর্শকদের মান এমন অবনমন হলে নির্মাণ বিগড়োবেই। লেখা পড়া, ছবি,সিনেমা কোন কিছুর আন্তরিক গম্ভীর প্রাসঙ্গিক চিন্তা হাসি-ঠাট্টা বেলেল্লাপনার দৌরাত্মে চাপা পড়ে যাচ্ছে ।চাপা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে ।মগজ ধোলাইয়ের এখন হাজারো কারখানা। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিপীড়িত জনতা জানতে চায় না।ভুলতে চায়।মাততে চায়। বিনোদনের গাঁজা তে বুঁদ হয়ে থাকতে চায়। তার মাঝে যতটুকু ছটফট, হাত-পা ছোড়াছুড়ি, চিৎকার-গোঙানি  বিকল্প পরিসর তৈরি করছে, তা যথেষ্ট নয়।তবু নয় বলে ঘরে বসে থাকা চলে না। নয় নয় করেও কিছু করে যেতে হয়। আমরা যে ফাঁদে পড়েছি। রাম নামের মতো সে কথা জপতে হয়। অপেক্ষা করতে হয় । ওৎ পেতে থাকতে  হয় ভালো সময়ের জন্য। এ কাজে যে যেখানে যেভাবে সামিল, ভাণ এর বিনম্র শ্রদ্ধা রইল তাদের প্রতি।
আপনারা ভালো থাকুন। দেখতে থাকুন, ভাবতে থাকুন। এবং ভাবান।
ভাবনা ছাড়লে প্রভুর ভালো। ওদের আর কত ভালো হবে!? আমরা প্রজার পক্ষে।

শাঁওলি মিত্র :নিঃশব্দ প্রস্থানে হৃদয়ে শব্দ হলো লিখেছেন -শর্মিলা ঘোষ

শর্মিলা ঘোষ

অথ শাঁওলী মিত্র কথা : এক অসমাপ্ত প্রতিবেদন।

শাঁওলী মিত্র (১৯৪৮ – ২০২২) বাংলা নাট্যের এক কালজয়ী নাম। ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকারে, সৃজনশীলতায় এবং মৌলিকতায়, প্রতিবাদে এবং দৃঢ়তায় ব্যাপ্ত তাঁর জীবন। তিনি মঞ্চ ও বেতারের এক অসামান্য অভিনেতা। চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় শাশ্বত। দূরদর্শনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করেছেন। এরই সঙ্গে তিনি একাধারে নাট্য নির্দেশক, নাটককার, নিজস্ব নাট্য দলের প্রতিষ্ঠাতা, গ্রন্থকার, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, সম্পাদক, অসাধারণ একজন বাচিক শিল্পী এবং প্রণম্য একজন শিক্ষক।

 
  শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের একমাত্র কন্যা শাঁওলী মিত্রের জন্ম ১৯৪৮ সালে, সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া ভারতবর্ষে, একেবারেই অন্যরকম এক পারিবারিক পরিবেশে। ১১এ নাসিরুদ্দিন রোডের সেই বাড়িটিতে ছিল বাংলার প্রথম গ্রুপ থিয়েটারের নাট্যযাপন, ছিল সব অর্থেই অসাম্প্রদায়িক এক প্রতিবেশ আর ছিল ভয়ংকর সাংসারিক অনটন। শাঁওলী মিত্রের গ্রন্থ থেকে জানা যায় এমনকি এই শিশুকে দুধ কিনে দেবার মতো সামর্থ্যও সবসময় থাকত না দুই প্রবাদপ্রতিম অভিভাবকের। ১।
 
ছেলেবেলা থেকেই অসুস্থতার মাঝেই অদম্য জেদে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া, বিবিধ সাহিত্য পাঠ, খালেদ চৌধুরির কাছে মঞ্চ অথবা তৃপ্তি মিত্র ও কুমার রায়কে ধরে মেকআপ শিখে নেওয়ার চেষ্টা – তাঁরই লেখার এসব টুকরো টুকরো ছবি তাঁর হয়ে ওঠাকে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে।
 
এরই মধ্যে ১৯৫৭ সালে বহুরূপীতে তৃপ্তি মিত্রের নির্দেশনায় ‘ডাকঘর’ নাটকে অমলের ভূমিকায় অভিনয় 
করলেন শাঁওলী মিত্র। বাংলা মঞ্চ প্রত্যক্ষ করল এক নতুন শিল্পীর আত্মপ্রকাশ। বিভিন্ন সংবাদপত্রের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা থেকে স্পষ্ট এই শিশু শিল্পীর উওরাধিকার।২।
 
পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে হিমাংশু চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় 
‘ত্রিশ শতাব্দী’ নাটকে শাঁওলী মিত্রের ” পূর্ণ চরিত্রাভিনয়ে প্রথম আত্মপ্রকাশ।” ( স্বপন মজুমদার ” বহুরূপী ১৯৪৮_১৯৮৮)। এরপর তৃপ্তি মিত্রের নির্দশনায় ‘কিংবদন্তী’ নাটকে অভিনয়ের পর শাঁওলী প্রথম পিতার নির্দেশনায় কাজ করলেন। নাটক বাদল সরকারের ‘পাগলা ঘোড়া।’
 
নানা দিক থেকেই ‘পাগলা ঘোড়া’ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই নাটক থেকেই বহুরূপী অ্যাকাদেমি অফ্ ফাইন আর্টস মঞ্চে তাদের অভিনয় শুরু করে। যা আজও পর্যন্ত বাংলা নাট্যাভিনয়ের পীঠস্থান। আর শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় এটিই
শাঁওলী মিত্রের প্রথম কাজ করার সুযোগ। তাঁর নিজের কথায় “একরকম শেষও বটে। কারণ অন্য যা করেছি , যেমন ‘দশচক্র’ তে মঞ্জু বা ‘রাজা’য় সুরঙ্গমা- কোনওটাই তো নতুন নাটক নয়, একটা নির্মিত কাঠামো র মধ্যে নিজেকে সাজিয়ে নেওয়া।” ৩।
 
‘পাগলা ঘোড়া’ নাটকে রাত্রির পরিবেশে শ্মশানের পটভূমিতে চারজন ভিন্ন বয়সের পুরুষ, অনাত্মীয় এক তরুণীর মৃতদেহ বহন করে এনেছে।সেই মৃতদেহ পুড়ে যাবার অবসরে তাসখেলা ও মদ্যপানের ফাঁকে এই চারজন নিজেদের গল্প বলেছিল। যাকে এক ধরণের স্বীকারোক্তি বলা চলে। এই চার পুরুষ চরিত্রে কুমার রায়,শান্তি দাস, কালীপ্রসাদ ঘোষ এবং দেবতোষ ঘোষ 
অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। আর নাটকের ভিন্নতর এক স্তরে অপূর্ব অভিনয় করেছিলেন শাঁওলী মিত্র। অশরীরী একটি চরিত্রে তাঁর অভিনয় উৎকর্ষতার চরম বিন্দুকে স্পর্শ করেছিল। ৪।
 
এরপরে প্রধানত তৃপ্তি মিত্রের নির্দেশনায় বহুরূপীতে শাঁওলী মিত্রের অভিনয়। ইন্দ্র উপাধ্যায়ের ‘টেরোড্যাকটিল’, ইয়োনেস্কো অবলম্বনে গন্ডার, রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে, বাদল সরকারের ‘যদি আর একবার’, এবং মনোজ মিত্রের ‘পাখি’ নাটকে শাঁওলী মিত্রের অভিনয় বিশেষ প্রশংসিত হয়। ৫।
এরই মধ্যে ইয়োনেস্কো অবলম্বনে ‘গন্ডার’ শাঁওলী মিত্রের নিজের অনুবাদ। ১৯৭৩ সালে ‘ডাকঘর’ নাটকের পুনর্নির্মাণে সহকারীর কাজ করেছিলেন শাঁওলী মিত্র। এই 
বুঝি প্রথম তাঁর নির্দেশনার কাজে হাতেখড়ি।
 
১৯৭৬ সালে নিধুবাবুর জীবন নিয়ে চিত্তরঞ্জন ঘোষের লেখা ‘গীতরত্ন’ নাটকের মহলা শুরু করেছিলেন কুমার রায়। শাঁওলী মিত্র ছিলেন শ্রীমতীর ভূমিকায়। কিন্তু একটিমাত্র ঘরোয়া অভিনয়ের পর সে নাটক বন্ধ হয়ে যায়। 
এই বছরেই ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকের মহলা শুরু করেছিলেন শম্ভু মিত্র। বেহুলা চরিত্রে ছিলেন শাঁওলী 
মিত্র। তবে কোন অজ্ঞাত কারণে সেই প্রস্তুতি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। 
 
১৯৭৯ সালের জুন মাসে বহুরূপী ছেড়ে বেরিয়ে আসেন শাঁওলী মিত্র। জন্মলগ্ন থেকে লিপ্ত এই সংগঠন থেকে কেন তিনি বেরিয়ে এলেন তার কার্যকারণ বিচার করার জন্য এই প্রবন্ধ নয়। পরে কখনো সেই আলোচনার অবকাশ রইল। 
১৯৮০ সালে কলকাতা নাট্যকেন্দ্রের ‘গ্যালিলেওর জীবন ‘ একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা। আর্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক ফ্রিৎজ্ বেনেউইৎজ্ ছিলেন এর নির্দেশক। শম্ভু মিত্র ছিলেন গ্যালিলেওর ভূমিকায়। শাঁওলী মিত্র গ্যালিলেওর ছোট মেয়ে ভার্জিনিয়ার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। শাঁওলী মিত্র লিখেছেন যে এই চরিত্রটি লোভনীয় না হলেও আন্তর্জাতিক মানের একজন নির্দেশকের একটা নাট্য নির্মাণ কাছ থেকে দেখতে পাওয়া এবং পিতাকে কোনো বড়ো ভূমিকায় তৈরি হতে দেখা। এই দুটি কারণেই এই কাজে তাঁর সম্পৃক্তি। যদিও কিছুটা আকস্মিক ভাবেই কয়েকটি অভিনয়ের পর সে নাটক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। 
 
এরই সঙ্গে চলছে কবিতা পাঠ। ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকটিও পাঠ করছেন পিতা কন্যা। অসম্ভব জনপ্রিয়তা পাচ্ছে সেই পাঠাভিনয়।
এইরকম একটা সময়পর্বেই দ্রৌপদী র ভাবনা এসেছিল শাঁওলী মিত্রের মনে। পিতা মাতা উভয়েই উৎসাহিত হয়েছিলেন। পিতার সঙ্গে কথা বলে যেন জুড়তে পেরেছিলেন সূত্রগুলিকে। খুলে গিয়েছিল ভাবনার জট। শম্ভু মিত্রের কাছেই শুনেছিলেন কথকতার প্রসঙ্গ। জেনেছিলেন বিভিন্ন প্রদেশের লোকনাট্য ধারার কথা। শম্ভু মিত্র তাঁকে দিয়েছিলেন ইরাবতী কর্ য়ের ‘যুগান্ত’ বইটি। যে বই পড়ে মুগ্ধ কন্যা নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন দ্রৌপদী কে। তৈরি হয়েছিল ” নাথবতী অনাথবৎ। ” বাংলা নাট্যমঞ্চের এক আশ্চর্য প্রযোজনা। এই নাটক তৈরি হওয়ার অপূর্ব ইতিহাস শাঁওলী মিত্র বিস্তৃত লিখে গেছেন তাঁর গ্রন্থে। ৬।
এই অভিনয়ের সূত্রেই শাঁওলী মিত্র তৈরি করলেন তাঁর নিজস্ব নাট্যদল। পঞ্চম বৈদিক। যে দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্র। 
 
এই সংগঠন শাঁওলি মিত্রের নির্দেশনায় আরও অনেকগুলি অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ নাট্য নির্মাণ করেছে। তৈরি হয়েছে কথা অমৃত সমান, বিতত বিতংস, চন্ডালী, পুতুলখেলা ইত্যাদি। আরও পরবর্তী তে যোগ্য উত্তরসূরী অর্পিতা ঘোষ নির্দেশনার দায়িত্ব নিয়েছেন। তৈরি হয়েছে অসামান্য কিছু নাট্য প্রযোজনা। ‘পশুখামার’ তার মধ্যে অন্যতম। সমকালীন সমাজ রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে যার গুরুত্ব অপরিসীম। 
   ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ছবিতে বঙ্গবালা চরিত্রে শাঁওলী মিত্রের অভিনয় একটি মাইলফলক। 
 
 শাঁওলী মিত্র আরও অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গেছেন। নাট্য ও সমাজ বিষয়ক বহু উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ লিখেছেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়। ‘শম্ভু মিত্র: বিচিত্র জীবন পরিক্রমা’ এবং’ গণনাট্য নবনাট্য সৎনাট্য ও শম্ভু মিত্র’ তাঁর অসামান্য দুটি গবেষণাধর্মী বই। মা তৃপ্তি মিত্র সম্বন্ধে তাঁর গ্রন্থ “মা-‘মণি'” একটি অসামান্য সংকলন। এছাড়াও দিদৃক্ষা, মুকুরে মুখ না মুখোশ, তর্পণ, শম্ভু মিত্র ও সৎনাট্য
ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য কিছু বই তাঁর রচনা। তাঁর লেখা নাটক সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। ‘অবেলার গল্প’ তাঁর গল্প সংকলন। একই সঙ্গে তিনি একজন ঋজু সম্পাদক। তাঁর সম্পাদনায় শম্ভু মিত্র রচনা সমগ্র তিনটি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থ বাংলা নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে এক চিরস্থায়ী সম্পদ।
 বহু পাঠ অভিনয় করেছেন অ্যাকাডেমি এবং অন্যান্য দর্শক পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে। সেসব পাঠ শোনার স্মৃতি অমলিন থেকে যাবে আজীবন। 
সামাজিক অবস্থানেও তিনি ছিলেন দৃঢ়। আপোষহীন একজন মানুষ। প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠান বিরোধি পদক্ষেপ নিয়েছেন। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। মিটিং মিছিলে যোগ দিয়েছেন। নিজস্ব সত্যের প্রশ্নে দ্বিধা ছিল না কোথাও।
বহু পুরস্কার পেয়েছেন শাঁওলী মিত্র। কিন্তু সেই তালিকা তাঁর জীবন চর্যা ও সৃজনশীলতার আলোচনায় বড় অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হয়।
এই সবকিছুর মধ্যেই বাচিক পাঠ দিয়েছেন শিক্ষার্থীদের। 
অসামান্য উচ্চারণ ও ভাব শিক্ষা, হারমোনিয়ামের সঙ্গে চর্চা, সাহিত্যের আলোচনা এবং আশ্চর্য শৃঙ্খলা অথচ উষ্ণতায় ভরা সেই শিক্ষাক্রমের একজন শিক্ষার্থী হতে পেরে এই লেখক নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করে। বাস্তবিক আমার জীবনের একটা সেরা সময় সেই দিনগুলো। পরবর্তী সময়ে গবেষণার কাজেও তাঁর সাহায্য এক পরম সম্পদ। তাঁকে আমার অন্তরের প্রণাম জানাই। 
 
  এত স্বল্প কথায় তাঁর মতো একজন ব্যক্তিত্ব কে প্রকাশ করা বোধকরি অসম্ভব। সেই যোগ্যতাও এই লেখকের নেই। অনেক কথা বাকি রয়ে গেল। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই লেখা তাই অসম্পূর্ণ। 
 
জীবনের শেষ পর্বে মৃত্যু পরবর্তী বিষয়ে নিজস্ব সিদ্ধান্ত জানিয়ে ইচ্ছাপত্র লিখে রেখে তিনি দেখিয়ে গেলেন সেই দৃঢ়তা যা বোধকরি উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর পরম প্রাপ্তি। কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁদেরও যাঁরা এই ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করলেন। 
এমন একজন সৃজনশীল- মৌলিক- পরিশ্রমী- সংযমী- শৃঙ্খলাপরায়ণ- প্রতিবাদী- দৃঢ় অথচ আন্তরিক মানুষকে আমার প্রণাম। আমার শ্রদ্ধা। 
 
তথ্যসূত্র 
১। শাঁওলী মিত্র- শম্ভু মিত্র: বিচিত্র জীবন পরিক্রমা। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট। প্রথম প্রকাশ ২০১০
২। বহুরূপী ৭০। বহুরূপী বিশেষ প্রযোজনা সংখ্যা ২।
৩। ১। এর ন্যায়।
৪। ২।এর ন্যায়।
৫। ঐ
৬। ১এর ন্যায়।
এছাড়া বিভিন্ন পত্র পত্রিকার সাহায্য নেওয়া হয়েছে। 
 যা নাট্যশোধ সংস্থা এবং লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি 
 সূত্রে শ্রাপ্ত।

অপূর্ব সতী"এর নাটককার কে নিয়ে অপূর্ব গদ্য বুনলেন - কেকা ত্রিবেদী

কেকা ত্রিবেদী

প্রথম বাঙালি মহিলা নাটককার: সুকুমারী দত্ত

উনিশ শতক বাংলায় নবজাগরণের শতক। শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত, উদারচেতা, elite সমাজের হাত ধরে বাংলার সমাজ সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের কথা আমরা ইতিহাসে পাই। কিন্তু এই নবজাগরণে যেসব প্রান্তিক মানুষেরা এগিয়ে এসেছিলেন তারা চিরকাল উপেক্ষিত থেকে গেছেন তথাকথিত সংস্কৃতিমনস্ক elite সমাজের কাছে। আর এই প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের মধ্যে নারীদের অবস্থান অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। তেমনই একজন প্রতিভাময়ী, চিন্তাশীল মানবী ছিলেন সুকুমারী দত্ত। বাংলা রঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রী ( গোলাপমোহিনী/ গোলাপ কামিনী / গোলাপ সুন্দরী / গোলাপ ) থেকে বাংলার প্রথম মহিলা নাটককার সুকুমারী দত্ত হয়ে ওঠাও সেই সময়ে দাঁড়িয়ে একপ্রকার নবজাগরণ। 
 
১৮৭২ সালে নেশনাল থিয়েটার স্থাপিত হওয়ার পর থেকেই বাংলার রঙ্গমঞ্চে নতুন হাওয়া বইতে শুরু করে। এতদিন পর্যন্ত নাটকে মহিলা চরিত্রে পুরুষ অভিনেতারাই অভিনয় করতেন। বেঙ্গল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পর মাইকেল মধুসূদনের প্রস্তাবে চারজন অভিনেত্রী নির্বাচিত হন। সেসময় মহিলারা কেউ অভিনয়ে যোগ দিতে রাজি ছিলেননা। সুতরাং, পরিচালকরা বারাঙ্গনাদের দ্বারস্থ হলেন। এই প্রথম পতিতাপল্লী থেকে বাংলার রঙ্গমঞ্চে পা রাখলেন গোলাপ, এলোকেশী, শ্যামারা। গোলাপ তাঁর মায়ের সঙ্গে বাস করতেন শ্রীরামপুরের মাহেশের কাছে। উপেন্দ্রনাথ দাসের হাত ধরে তিনি এলেন বেঙ্গল থিয়েটারে। বারাঙ্গনাদের এই পুনর্বাসন স্বাভাবিক ভাবেই সেকালের সমাজে যথেষ্ট সমালোচিত হয়। বিদ্রুপ, গালাগালি এমনকি সংবাদপত্রে লেখালেখিও কম হয়নি। 
 
মাইকেল মধুসূদনের সন্তানদের সাহায্যের জন্য ১৮৭৩ সালের ১৬ ই আগস্ট ‘ শর্মিষ্ঠা ‘ নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে সফল হন সুকুমারী দত্ত। এরপর মায়াকানন, কৃষ্ণকুমারী নাটকে অভিনয় সূত্রে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তবে ১৮৭৪ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুরুবিক্রম নাটকে ঐলবিলার ভূমিকায় অভিনয় তাঁর জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা। এই আশাতীত সাফল্য তাঁকে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর আসনে বসায়। ১৮৭৫ সালে উপেন্দ্রনাথ দাসের ‘ শরৎ সরোজিনী ‘ নাটকে শরতের বোন সুকুমারীর ভূমিকায় অভিনয় করে ‘ গোলাপ ‘ যে কৃতিত্ব অর্জন করেন তার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ‘ সুকুমারী ‘ নামে পরিচিত হন। ১৮৭৫ সালে ৩১ এ ডিসেম্বর গ্রেট নেশানাল থিয়েটারে উপেন্দ্রনাথ দাসের ‘ সুরেন্দ্র বিনোদিনী ‘ নাটকে তিনি বিনোদিনীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। এর পাশাপাশি এমারেল্ড থিয়েটারেও সুকুমারী নিয়মিত অভিনেত্রী ছিলেন। শোনা যায়, বিমলা, গিরিজায়ার অভিনয় দেখে বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই বলেছিলেন ” আজ বিমলা, গিরিজায়া কে জীবন্ত দেখিলাম “। সুকুমারী দত্ত ছিলেন একাধারে সুগায়িকা ও সুঅভিনেত্রী। তাঁর অভিনয়ের দাপট এমনই ছিল যে অনেকসময় তাঁর কথা মাথায় রেখে নাটকের সংলাপ রচনা করা হত, গান সংযোজিত হত। ১৮৭৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ অশ্রুমতী ‘ নাটকের বিশেষ অভিনয় হয় বেঙ্গল থিয়েটার ভাড়া নিয়ে। সেদিন সুকুমারী মলিনা ও অক্ষয়কুমার মজুমদার ভীল সর্দার সেজেছিলেন। দর্শকাসনে উপস্থিত ছিলেন ঠাকুর বাড়ির সকলে।
 
১৮৭৫ সালে গ্রেট নেশনাল্ থিয়েটারের অভিনেতা গোষ্ঠ বিহারী দত্তের সঙ্গে সুকুমারী সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্টের (১৮৭২) মাধ্যমে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন। উপেন্দ্র নাথ দাসের উদ্যোগে কলকাতার বিশিষ্ট ধনী সুবর্ণ বণিক পরিবারের সন্তান গোষ্ঠ বিহারীর সঙ্গে সুকুমারী সংসার পাতেন। এই বিয়ে প্রেমজ বিয়ে কিনা তা জানা যায়না, তবে এই বিয়ে যে সেকালের কলকাতা কড়চার রসাল বিষয় ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। সেই সময় ‘ এডুকেশন গেজেটে’ র মতো সংবাদপত্রেও এই বিয়ে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই অসামাজিক বিয়ের অপরাধে আত্মীয় স্বজন পরিত্যক্ত হয়ে গোষ্ঠ বিহারী ও সুকুমারী ভদ্র পল্লিতে বাসা ভাড়া করে অত্যন্ত আর্থিক কষ্ঠে জীবন যাপন করেন। উপেন্দ্রনাথ সম্ভবত এই দম্পতিকে কিছু আর্থিক সহায়তা করতেন। সেই কারণে, বাবার নির্দেশে উপেন্দ্রনাথ বিলেত চলে যাওয়ার পর গোষ্ঠ বিহারী অথৈ জলে পড়েন। আর্থিক কষ্ট সহ্য করতে না পেরে তিনি জাহাজের খালাসী হয়ে বিলেত পারি দেন। কিন্তু কিছুদিন পর সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। গোষ্ঠ বিহারীর দেশে ফেরা না হলেও উপেন্দ্রনাথ কিছুদিন পর দেশে ফিরে আসেন। এদিকে স্বামী পরিত্যক্তা সুকুমারী সেই সময় একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন এবং স্বাভাবিক ভাবেই বেশ কিছুদিন অভিনয় জগৎ থেকে দূরে থাকার জন্য নিদারুণ আর্থিক কষ্টের মধ্যে জীবন ধারণ করেন। ১৮৯০/১৮৯১ সাল নাগাদ আবার তাঁর মঞ্চাভিনয়ের কথা জানা যায়। আর জানা যায় তাঁর রচিত অপূর্বসতী নাটকের কথা। 
 
এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তিনিই বাংলার প্রথম মহিলা নাটককার। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসে তিনি চরম উপেক্ষিত। এমনকি তাঁর মৃত্যু দিনটি পর্যন্ত কেউ লিখে রাখেনি। ১৮৭৫ সালের ২৩ আগস্ট সুকুমারী দত্তের সাহায্য রজনী উপলক্ষে দি ইন্ডিয়ান নেশনাল থিয়েটারে অপূর্বসতী নাটকটি প্রথমবার অভিনীত হয়। গ্রসাচ্ছাদনের জন্য সুকুমারী দত্ত নাটকটি রচনা করেন। নাটকের অনুশীলন ও চর্চা সুকুমারীর চিত্তে নাটক সম্পর্কে একটা বোধ এনে দেয়। সংলাপ রচনাতেও তিনি দক্ষ হয়ে ওঠেন। অপূর্বসতী নাটকটি পড়লে পাঠকের মনে যেমন কতগুলি প্রশ্নের উদয় হয়, তেমনই সেই সময়ের বাংলা সমাজের বিভিন্ন তথ্য পরিস্ফুট হয়। নাটকটির মুখবন্ধে প্রণেতা হিসেবে শ্রী আশুতোষ দাস ও প্রণেত্রী হিসেবে শ্রীমতি সুকুমারী দত্তের নাম পাই। অথচ বইটির প্রতিটি পাতায় সুকুমারীই যে বইটির রচয়িতা তার প্রমাণ রয়েছে। আবার নাটকে ব্যবহৃত ইংরিজি সংলাপের বাক্যগুলি মাইকেল মধুসূদনের ‘ হেক্টর বধের ‘ ভাষা কে স্মরণ করিয়ে দেয়। আশুতোষ দাস কে ছিলেন, তিনি কি সুকুমারীর অভিভাবক ছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর জানা যায়নি। সুতরাং, নিছক কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে নাকি একজন মহিলা নাটককারের নাটক বাণিজ্যিকভাবে অসফল হতে পারে এই আশঙ্কায় যুগ্ম ভাবে মুখবন্ধ লেখা হয় সে রহস্য অজানাই থেকে যায়। আবার সুকুমারী ঠিক কতটা ইংরিজি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন, মাইকেল মধুসূদনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল কিনা এসব প্রশ্ন থেকেই যায়। নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্র নলিনী বারাঙ্গনার কন্যা। মা হরমণি চেয়েছিলেন মেয়েকে এই ঘৃণিত জীবন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। সেজন্য তিনি চন্দ্রকেতুর সঙ্গে নলিনীর প্রেমকে সমর্থন করেন। কিন্তু আর্থিক প্রলোভনে নিজেই আবার মেয়েকে লম্পট তরুবাবুর হাতে তুলে দেন। নাটকে চন্দ্রকেতু ও নলিনীর বিয়ে হলেও সামাজিক চাপে তাদের মিলন হয়নি। পরিণতি হিসেবে একে একে নলিনী, চন্দ্রকেতু ও বন্ধু ব্রজেন্দ্রর বিলাপ এবং আত্মহত্যা – ট্র্যাজেডির চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে।
 
নাটক হিসেবে রচনাটি দুর্বল হলেও এর ঐতিহাসিক ও সামাজিক মূল্য অত্যন্ত বেশি। নিঃসন্দেহে এই নাটকে সুকুমারী তথা তখনকার বারাঙ্গনাদের জীবন প্রতিফলিত হয়েছে। বয়াটের হাত ধরে বা বৈষ্ণবীদের পাল্লায় পড়ে হিন্দু বিধবা, মুসলমান ও পর্তুগিজ নাবালিকারা কীভাবে পতিতাল্লিতে আসত ও শেষ বয়সে নিদারুণ দুঃখ কষ্টের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হত তার প্রামাণ্য দলিল এই নাটক। প্রথম মহিলা নাটককারের রচনা হিসেবে এর স্বতন্ত্র্ মূল্য যেমন অনস্বীকার্য, তেমনই বারাঙ্গনা বিবাহ ঘটনাটিও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। টাইটেল পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন castus mirabilis অর্থাৎ তিনি অপূর্ব সতী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য নাটকটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন ‘ বঙ্গ – বিদ্যা – হিতৈষেণী ‘ মহারানী শ্রীমতি স্বর্ণময়ী দেবীকে। নিজেকে ‘ হীনজন ‘ বলে অভিহিত করলেও উৎসর্গ পত্রে বিদ্যার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ প্রদর্শন করেছেন। পাশাপাশি নিজের নিচ সংসর্গকে অস্বীকার না করেও একজন মহিলার সমাজে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার এই লড়াইকে কুর্নিশ জানাই। নলিনীর স্কুলের শিক্ষা, পবিত্র জীবনযাপনের সদিচ্ছা এবং সতীত্ব নাশের জন্য নিজের মাকে পিশাচি বলে তিরস্কার ইত্যাদি এইসব আত্মগ্লানির ভিতর দিয়ে নাটককার পতিতাদের জীবন যন্ত্রণা ও অসহায়তার মর্মান্তিক চিত্র তুলে ধরেছেন। নাটক লেখার সময় সুকুমারী নিশ্চয় ‘ একেই কি বলে সভ্যতা ‘ প্রহসনের কথা মনে রেখেছিলেন। নাটকে বারাঙ্গনাদের নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে জোটবদ্ধতা দর্শকের মনে সমাজ জিজ্ঞাসারও উদ্রেক করে।
 
 
নাটকটির বিশেষত্ব হল বারাঙ্গনা প্রেম ও সমাজে স্থান নির্ণয়ের ইতিহাস। উনিশ শতকে নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা শহরে বারাঙ্গনাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বারাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের পক্ষে সওয়াল করে এই নাটক। মা মেয়ের দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে প্রকৃতপক্ষে সতীত্ব বনাম দারিদ্রের টানাপোড়েন প্রকট হয়। সেযুগে বারাঙ্গনাদের নিয়ে ১৮৭৫ সালের আগে লেখা কাহিনি, নাটক, নকশার থেকে এই নাটকের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ন আলাদা। সুকুমারীর মতো সমস্যাটির দিকে এত গভীরভাবে কেউ নজর দেয়নি। সুকুমারী নিজের জীবনের বাসনাকে ফুটিয়ে তুলেছেন নলিনীর চরিত্রে। মায়ের বিরুদ্ধে লড়াই কি আসলে সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই নয়? উৎসর্গ পত্র থেকে বোঝা যায় তিনি সমাজের উঁচু তলার শিক্ষিতা মেয়েদের কাছে বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। বিধবা বিবাহ, স্ত্রী শিক্ষা এবং পতিতা দের সমস্যা স্থান পেয়েছে তাঁর নাটকে। নলিনীর জীবন যে সুখের হতে পারেনা তা সুকুমারী নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। ফলে কোন ফ্যান্টাসি নয় নির্মম বাস্তব এই নাটকের পরিণতি। ব্রাহ্ম সমাজের মানুষদেরও ‘ ছেলেধরা ‘ বলে অভিহিত করে কটাক্ষ করা হয়েছে। এমনকি নিন্দাচ্ছলে হলেও ভারতবর্ষের পরাধীনতার প্রসঙ্গও রয়েছে এই নাটকে।বোঝাই যায় সমসাময়িক সমাজ ও দেশের রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ভাবনা চিন্তার অবকাশ ছিল। সুকুমারী বিনোদিনীর মতন আত্মকথা লেখেননি। এই নাটকটিকেই আমরা তাঁর আত্মকথা বলে ধরে নিতে পারি। এদেশের লক্ষ লক্ষ অভাগিনীর ঘৃণিত জীবন ত্যাগ করে উপযুক্ত দীক্ষা ও শিক্ষালাভ করে সম্মানজনক পুনর্বাসনের দাবির অপর নাম অপূর্ব সতী।

গোরা ওয়েবসিরিজ রিভিউ

পার্থ হালদার
একটি ডিফেকটিভ ডিটেকটিভের গল্প
 
প্রাইভেট গোয়েন্দা বলতেই যে চিত্রকল্প বাঙালিদের মনে ভেসে ওঠে, সেখানে ফেলুদা, ব্যোমকেশ বা কিরীটি বাবুদের বাদে কাউকে প্রথম চিন্তাতেই ভেবে ফেলা আজকের সময় পর্যন্ত কঠিন। তদুপরি, হাতেগোনা কয়েকজন গোয়েন্দা বাঙালির জীবনযাত্রায় আরো কিছু টুকরো টুকরো উদাহরণ হিসেবে থেকে গিয়েছে, যাদের একাংশের মানুষরাই জানেন শুধু। কিন্তু হঠাৎ করেই নতুন বছরের শুরুতেই গোরা নামক এক ব্যক্তির আবির্ভাব হয় বাঙালি সিরিজ-প্রেমীদের কাছে। না ইনি দাড়িবুড়োর অন্যতম প্রিয় চরিত্র গোরা নন। ইনি হচ্ছেন হইচই-এর অর্থপুষ্ট, সায়ন্তন ঘোষাল পরিচালিত এবং ৮টি এপিসোড সম্বলিত একটি সিরিজের প্রাইভেট ডিফেকটিভ ডিটেকটিভ।
হ্যাঁ ডিফেকটিভ মানে গোদা বাংলায় যাকে বলে ত্রুটিপূর্ণ একজন। এবার এই গোটা সমাজে কেউ ত্রুটিমুক্ত নয়। কিন্তু বিষয়টি সেইরকম নয়। গোরা বাবুর এই বিশেষ ত্রুটি একজন গোয়েন্দা হিসেবে বেশ নজর কাড়ে। কারণ তিনি মুহূর্তে মুহূর্তে মানুষজনের নাম, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দুমদাম ভুলে যান। কিন্তু গল্পটি কী? কলকাতা শহরে হঠাৎ করেই পরপর তিনজন লেখক নৃশংস ভাবে খুন হন। যথারীতি পেটমোটা কলকাতা পুলিশ তার সুরাহা করতে অক্ষম। তাই শেষত, গোরা বাবুর চরণে বশ্যতা স্বীকার এবং সাহায্য কামনা। নিয়মমাফিক গোরা বাবুর একজন অ্যাসিসট্যান্ট আছেন, থুড়ি ড্রাইভার বা সারথি আছেন যিনি গোরা বাবুকে এই তদন্তে আগাগোড়া সাহায্য করবেন। গল্পকে বাঙালি ধাঁচায় ফেলতে এই সারথিকে আবার গোরা বাবুর বোনের হবু স্বামী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এই মূল তদন্তের পাশাপাশি আর একটি উপকাহিনি এসে উপস্থিত হয়, যেখানে একজন বিবাহিত মহিলা রাতে ঘুমের মধ্যে হাঁটেন এবং এমন কিছু অঘটন করতে থাকেন যার ফলে তার শ্বশুর বাড়ির লোকজনের জীবন মরণের কথা অবধি চলে এসেছে। কিন্তু কেন ব্যাপার এমন বিয়ের পর হঠাৎ করে হচ্ছে? এর পিছনেও কি কোনো অজানা রহস্য কাজ করছে?
 
এই দুই কাহিনির মেলবন্ধনে শেষমেশ কীভাবে দুটো ঘটনার সমাধান হয় তার গল্প বলে এই গোরা সিরিজ। কিন্তু গোটা বিষয়টি খুব খাপছাড়া এবং সাযুজ্যহীন। কারণ, সাধারণত এইরকম সিরিয়াল কিলিং এর গল্পে দু-তিনটে সাবপ্লট থাকে। মূল গল্পের সমান্তরালে সেই গল্পগুলি চলতে থাকে যা মূল গল্পকে দিতে থাকে রসদ এবং দর্শককে ফেলে দেয় আরো দোটানায়। কিন্তু এক্ষেত্রে বোঝাই যাচ্ছে দুটি গল্পকে জোর করে একীভূত করার একটি অক্ষম চেষ্টা করা হয়েছে। পরের একটি সিজনের অপেক্ষা হয়তো বা কেউ কেউ করতে পারেন কিন্তু তার জন্য আগাম বার্তা দেওয়ার জন্য এইরকম জগাখিচুড়ি হয়তো বা দরকার ছিল না। ফলতঃ মূল গল্পেও যথেষ্ট ফাঁক-ফোকড় থেকে গিয়েছে যা, যে কোনো মনোযোগী দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য।
 
অভিনয়ে আমি ঋত্বিক চক্রবর্তী ব্যতীত কাউকে চেষ্টা করতে দেখিনি। হ্যাঁ, ঋত্বিক চক্রবর্তীর অভিনয়েও বেশ খামতি আছে, দেখা গিয়েছে নিস্পৃহ মনোভাব। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঋত্বিক তাঁর নিজস্ব অভিনয়ের মারপ্যাঁচে বিষয়টি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। সুহত্র মুখোপাধ্যায় আরো অনেকবেশি ভালো কাজ করতে পারেন। এছাড়াও বাকিরাও বেশ খামতি পূর্ণ। মন্দের ভালো প্রত্যেকটি এপিসোডের সময় যা ২০-২৫ মিনিটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
 
এবার অনেকেই হয়তো আমার উপর রে রে করে উঠতে পারেন, কারণ এই সিরিজ অনেকেরই ভালো লেগেছে। আসলে আমার মনে হয় এই সিরিজ যাদের ভালো লেগেছে তাদের আসলে ভালো লাগেনি, লেগেছে নতুন, পেয়েছেন তারা নতুনের স্বাদ। নতুন মানেই যে তা ভালো এবং মনোগ্রাহী হবে তার কোনো নিয়ম নেই। উদাহরণস্বরূপ, শবর নতুন ছিল , সঙ্গে মনোগ্রাহী। আজও আপনি দেখতে চাইলে দেখতে পারেন। কিন্তু এই সিরিজ কি আপনি পুনরায় পুরোটি দেখবেন? সৎ উত্তর আশাতীত।

সিনেমা: 8/12 বিনয় বাদল দীনেশ - শুভস্মিতা কাঞ্জী

শুভস্মিতা কাঞ্জী
 
“How does it feel? Huh?” শব্দগুলো এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে যেন। কমলার উপর করা অত্যাচার, নৃশংসতার কথা মনে পড়লেই শিউরে উঠতে হবে দর্শককে। 
 
অলিন্দ যুদ্ধের কথা ইতিহাস বইতে পড়া, কিন্তু কতটা অনুভব করেছি আমরা? কতটাই বা বুঝেছি? তিন সাহসী যুবকের কথা যাঁরা জানত আর ফেরা হবে না, তবুও হাসিমুখে তিনজন মিলে অতগুলো ইংরেজকে মেরে ভয় তৈরি করে দিয়েছিল তাঁদের কতটা চিনি বা মনে রেখেছি? ওই বইয়ের পাতা কিংবা বিবাদী বাগ মিনিবাস বা জায়গাটা ছাড়া? তাঁদেরকে যেন নতুন করে চেনালেন পরিচালক অরুণ রায়। ইতিহাসের পাতা থেকে চরিত্রগুলো উঠে এসে ভীষণ জীবন্ত হয়ে নিজেদের কথা মনে করিয়ে দিয়ে গেল যেন গোটা সিনেমা জুড়ে। 
 
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর বাংলাদেশে সূর্য সেন এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের খোঁজে চিরুনি তল্লাশি চলছে এমন দৃশ্য দিয়ে শুরু ছবি। সেখানেই দেখা কমলাকে, যাঁর চরিত্র দর্শকদের মনে দাগ কাটতে বাধ্য। গুলশানারা খাতুন যে কী মারাত্মক অভিনয় করেছেন তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। তাঁর প্রতিটা এক্সপ্রেশনের সঙ্গে সঙ্গে দর্শকরাও যেন একটু করে ভয়ে, আতঙ্কে, ঘৃণায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল। একদিকে মেয়েটি অত্যাচারিত হচ্ছে, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে অন্যদিকে তাঁর মাতৃত্ববোধ ফুটে উঠছে। লাঞ্ছনার, বর্বরতার শিকার হতে হতেই মৃত্যু পথযাত্রী সহযোদ্ধার জন্য মাতৃস্নেহে আঁচলে জল ভরে নিচ্ছে। 
 
শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নতুন করে কিছুই বলার নেই। কী দারুণ চোখের ভাষা, কী বলিষ্ঠ বচন ভঙ্গি। এক কথায় হেমদার চরিত্রে যথাযথ। তাঁর পান খাওয়ার দৃশ্যে তাঁর এক্সপ্রেশন এবং তারপর ক্যামেরা ঘুরে যাওয়ার দৃশ্যটি বেশ।
 
বিনয় বাদল দীনেশের ভূমিকায় থাকা কিঞ্জল নন্দ , অর্ণ মুখোপাধ্যায় , এবং রেমো, তিনজনকেই বাস্তবের চরিত্রের সঙ্গে দারুন ভাবে মানিয়েছে। চরিত্রগুলো যেমন দাবি করে শান্ত, অথচ চোখে আগুন, তেজ ঠিক তাই। রাইটার্সের অলিন্দে তিনজনের সমবেত দৌড়ানোর জায়গাটায় সত্যি গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল। কমরেডস কী সেটা যেন ওঁদের তিনজনকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। তিনজনের অযথা বাইসেপ, ট্রাইসেপ দেখানো হয়নি। বাঙালি ছেলে, মুগুর ভাজা, ব্যায়াম করা পেটানো শরীর দেখানো হয়েছে। চরিত্র যা যতটা দাবি করে ঠিক যেন মেপে মেপে ততটুকুই দেওয়া হয়েছে।
 
বিনয়ের লওম্যানকে হত্যা করার জায়গাটা আলাদা ভাবে প্রসংশার দাবি রাখে। কিংবা বিনয় যখন রাইটার্সে যাওয়ার আগে যাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছে সেই জায়গাটায় চোখের জল আটকানো যায়নি কোনও মতেই। ছেলে চলে যাচ্ছে আর ফিরবে না জেনেও মা যেমন তার মঙ্গলকামনা করেন, তেমনই সেই মহিলাও এই অল্প পরিচিত বিনয়ের জন্যও তাই করলেন। আসলে সব মেয়েদের মধ্যেই যে মাতৃত্ববোধ লুকিয়ে থাকে। আর ঠিক তারপরেই ছিল সেই যুদ্ধ। ফলে এই ছোট ছোট চেঞ্জগুলো দারুন। 
 
অন্যদিকে বাদল যখন সিম্পসনকে হত্যা করার পরও তাঁর বুকের জ্বালা জুড়াল না, সিম্পসনের করা বাংলার মেয়েদের উপর অত্যাচারের বদলা নিতে সে আবারও সিম্পসনের উপর গুলি চালিয়ে বলে, “how does it feel?” সেখানে সিম্পসনের কেমন লেগেছিল জানা নেই, তবে দর্শকরা নিশ্চয় তৃপ্তিবোধ করবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ঠিক তেমনই সে যখন দীনেশ কে বলছে “লাউ পাতার বড়া খাওয়া বাকি থেকে গেল” বলে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগে সেখানে চোখের জল ধরে রাখা মুশকিল হয়ে ওঠে।
 
 দীনেশের দৃপ্ত কণ্ঠ থেকে যখন এক ইংরেজ পুলিশ অফিসারের উদ্দেশ্যে “shoot me, come on shoot me” কথাগুলো আগুনের মতো বেরিয়ে আসে সেখানে গায়ে কাঁটা দিতে বাধ্য। 
 
খরাজ মুখোপাধ্যায় সহ অন্যান্য অভিনেতারা যথেষ্ট ভাল। খরাজ মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে একটা ছোট কমিক রিলিফ দেওয়া হয়েছে, যেটা বেশ ভাল। তবে গোটা ছবিতে খারাপ বা তুলনামূলক ভাবে বাকিদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি হল সুভাষের চরিত্র। যিনি সুভাষের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাঁর মধ্যে সুভাষচন্দ্রের সেই তেজ ছিল না। বড্ডই নরম, শান্ত, ভাল মানুষটি লাগল। 
 
গোটা সিনেমা জুড়েই বেশ কিছু ওয়াও মোমেন্ট আছে, যেখানে হয় আপনি ঘেন্নায় কুঁকড়ে যাবেন, বা রাগে ফুঁসবেন অথবা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠবেন। তখনকার দিনে কী ভাবে গোপন খবর পৌঁছানো হতো বা গোপন জায়গায় যাওয়া হতো তার একটি সাম্যক ধারণা তৈরি করে দেবে এই ছবি। সবার চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সাজ পোশাক করা হয়েছে। ক্যামেরা এবং আলোর কাজ দারুন। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট তার সঙ্গে সঙ্গে রক্তের আসল রং, গোটা আমেজটাকে দারুন ভাবে তুলে ধরেছে। বেশ কিছু ক্লোজ শট ভাল ছিল। আবহ সঙ্গীত বেশ ভাল। দুটি গানই খুব সুন্দর, এবং যথাযথ ছবির সঙ্গে।
 
পরিচালক ছবিটাকে অযথা টেনে লম্বা করেননি, ভুলভাল অতিরিক্ত কিছু দেখাননি। ছবিতে তথাকথিত টলিউডের সব সুপারস্টার সব সুপারস্টার না থাকলেও, সব জাত অভিনেতা ছিল। অর্ণর অভিনয়ের সঙ্গে সবাই কম বেশি পরিচিত, তবে কিঞ্জল, রেমো, গুলশানারাও যে লম্বা রেসের ঘোড়া তা এই ছবি স্পষ্ট করে দিল। এটি মাস্ট ওয়াচ সিনেমা।

নাট্য -নিয়ন্ত্রণের আগেপিছে বাংলার বুদ্ধিজীবী - ময়ূরী মিত্র

ময়ূরী মিত্র
 
পর্ব -এক
আগে — 
সবে তখন ভোল বদলাচ্ছে বুদ্ধিজীবী ভদ্রলোকের | ভোল ও বোল -দুটোই | ঝরঝরে খলনলচেখানা ঝেড়েঝুড়ে ঝকঝকে উঠছেন সিপাহি বিদ্রোহোত্তর মধ্যবিত্ত | বলে নেয়া দরকার -১৮৫৭ এর মহাবিদ্রোহ বা তার কিছু আগে থেকেই বাঙালির বুদ্ধিচর্চায় যে মৌলিক প্রশ্ন তৈরি হচ্ছিল সেটি ছিল –পাশ্চাত্য ধারা ও পশ্চিমীভাব গ্রহণ করা উচিত কিনা – গ্রহণ করলেও সেটা কতটুকু গ্রহণীয় – কতটুকুই বা ফেলে দেয়া যেতে পারে | বিতর্কে গোড়ার পনের কুড়ি বছর পাশ্চাত্যপ্রেমীদের জিত হলেও ষাটের দশকের শেষভাগ থেকেই বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবনাচিন্তার গতিমুখ ঘুরে যায় দেশীয় ভাষা – শিল্প সাহিত্য – সংস্কৃতির সার্বিক পরিবেশ গঠনের উদ্যোগে | কখনো বা বাঙালির নিজস্ব ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ কিংবা নতুন ব্যাখ্যায় | আরো একটি বড় বিষয় হল –সিপাহি বিদ্রোহের পরের সময়টায় উনিশ শতকের প্রথমার্ধের প্রজন্মগত ব্যবধান ঘুচে দেশের উন্নতি অবনতির প্রসঙ্গে প্রাচীনে – নবীনে একটা আপাত মিলও তৈরি হয়ে যাচ্ছিল | ১৮৬৬ তে রাজনারায়ন বসুর জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা অথবা ১৮৬৭ তে নবগোপাল মিত্রের হিন্দুমেলার সময় থেকেই বাঙালি ভদ্রলোকের আত্মনির্মাণ ও আত্মনির্ভরতার এই সূত্রপাত |
                      বদলে যাচ্ছিল Elitist Culture এর উৎসও | রামমোহনের কাছে পূজ্য ছিল বেদান্ত আর বঙ্কিমের কাছে ? গীতা বা মহাভারত | দেখে নি , বঙ্কিমের অগ্রজ ভূদেব মুখোপাধ্যায় কী বলছেন এই সময় —-
            সন্তান সন্ততিকে স্বধর্মনিষ্ঠ ও স্বজাতির 
             মুখাপেক্ষী করিবার নিমিত্ত প্রাণপণ 
            যত্ন কর |
বঙ্কিম ভূদেব শুধু নন , রাজনারায়ন বসুর মতো ইংরেজিশিক্ষিত ব্রাহ্মনেতাদেরও যে হিন্দুবাদ ও স্বদেশচেতনায় আস্থা জন্মাচ্ছিল এমন ইঙ্গিত পাই বিপিনচন্দ্র পালের স্মৃতিচারণায় | তাই বোধহয় কলকাতা বাসকালে রাজনারায়ন প্রদত্ত ‘ বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক ‘ বক্তৃতাটি সেসময় জাতীয় উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছিল |
              শুধু দর্শন বা চৈতন্যে নয় , পেশা ও জীবিকাতেও বাঙালি ভদ্রলোকদের সাথে শাসকপক্ষের নাটাঝাপটা শুরু হয় এসময় | বিশেষত উচ্চ রাজপদে বাঙালিদের নিয়োগ যে সরকারের না-পসন্দ ছিল তা পরিষ্কার ভারতসচিবকে লিখিত লর্ড লিটনের গোপন চিঠিতে | লিটন লিখছেন —
      ভারতবাসীদের সিবিল সার্ভিসের দাবী পূরণ 
      করা আদবে সম্ভব নয় |কাজেই তাদের এ দাবী 
       অস্বীকার করা বা তাদের প্রবঞ্চনা করা এ      
       দুটির একটি পথ বেছে নিতে হবে | আমরা  
        দ্বিতীয়টি বেছে নিয়েছি |
  বাঙালিদের উচ্চশিক্ষার আওতায় না আনার জন্য ছোটলাট ক্যাম্বল তড়িঘড়ি উচ্চশিক্ষাতে নির্দিষ্ট অংকে ব্যায়বরাদ্দ পর্যন্ত করে ফেললেন | ২৪ ফেব্রুয়ারি ,১৮৭০, অমৃতবাজার পত্রিকা লিখল —
          Why did you not tell this before ? Why 
          did you not tell this before that more      
          we learn ,the less shall be liked by      
           you ? Was that a hoax ? Must we    
           forever remain enchained crushed ,
          trodden , ignorant , superstitious to 
          satisfy your love of power ? And you 
          emancipated millions of slaves and     
          you boast of your civilization and 
          Christianity 
এরপর ১৮৭৫ এ শিশিকুমার ঘোষ ও শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ইন্ডিয়ান লীগের নির্মাণ | বোঝা যাচ্ছিল , ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের জমিদারি মেজাজের দিন শেষ আর মধ্যবিত্তের সম্প্রসারণ শুরু | অল্প কিছুদিন পরেই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতিতে জড়িয়ে যাওয়া এবং মধ্যবিত্তের একটি নিজস্ব রাজনৈতিক মতামত , মূল্যায়ন ও সংগঠনের প্রস্তুতি শুরু হওয়া | তলানিতে এসে ঠেকেছিল ভিনদেশি প্রশাসন সম্পর্কে বাঙালি বুদ্ধিজীবীর অভ্যস্ত বিশ্বাস ও আনুগত্য | পূর্বকৃত সর্ববিধ রাজনৈতিক ভ্রম শোধনে বাঙালি তখন কী ব্যস্ত কী ব্যস্ত ! বাঙালির নাট্যবিষয়ে দেখা গেল ঝুঁকি – রাজনীতির উঁকিঝুঁকি ৷

আলাপচারিতায় নৃত্য শিল্পী - মধুমিতা পাল

মধুমিতা পাল
ভাণ: নাচে আপনাকে টানল কে? কখন সিদ্ধান্ত নিলেন নাচ সর্বক্ষণের সঙ্গী হবে? 
মধুমিতা পাল: আসলে নাচে কিন্তু আমাকে টেনেছেন আমার ঠাকুরদাদা বিখ্যাত শ্রী পানু পাল | মূলত দাদু ভাইয়ের সাথে ছোটবেলায় ঘুরতে ঘুরতে, ওর দলের নাচ দেখেই নাচের প্রেমে পড়েছিলাম | মাত্র সাড়ে চার বছর বয়সে দাদুভাই আমাকে দিয়ে ওর নৃত্যনাট্য ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’- তে পায়রা করিয়েছিলেন, আর পাঁচ বছর বয়সে ‘আয় চাঁদ আয়’ নৃত্যনাট্যের জোনাকি করিয়েছিলেন গোর্কি সদনে ও মেদিনীপুরে | দাদুভাই আমার জীবনের সবটুকু, বলতে পারেন আমার নায়ক।
 আর কখন সিদ্ধান্ত নিলাম? হায়ার সেকেন্ডারির পরেই নিয়েছি। হায়ার সেকেন্ডারির পরে বাবা যখন আমাকে বললেন স্কটিশ চার্চে ভর্তি করবেন ফিলোজফি নিয়ে, তখন আমি সেটা করলাম না। দাদুভাইকে বললাম যে আমি নাচ নিয়ে কিছু করতে চাই। তখন দাদুভাই বাবাকে বললেন সোনাইকে রবীন্দ্রভারতীতে ভর্তি করো। বাবা গিয়ে ফর্ম তুলল, রবীন্দ্রভারতীতে ভর্তি হলাম, বি.এ, এম.এ, তারপর তো নাচ আমার সর্বক্ষণের সাথী হলো।
 
ভাণ: বাড়ির পরিবেশ বিশেষত স্বনামধন্য দাদু কিভাবে অনুপ্রাণিত করেছে আপনাকে?
মধুমিতা পাল: বাড়ির পরিবেশ খুবই অনুকূল ছিল। বাড়ির পরিবেশ এতই অসাধারণ ছিল যে, এই পরিবেশে যে কোন ছেলেমেয়ে খুবই আনন্দে বড় হতে পারে। আমাদের পয়সা ছিল না, আমরা অভাবের সাথে লড়েছি কিন্তু সেই অভাবকে অভাবই মনে হয়নি। আমার মা দাদুভাইয়ের ছাত্রী ছিলেন। দাদুভাই পড়াতেন এবং ভীষণ ভালো টিচার ছিলেন। বেলঘরিয়াতে একডাকে সবাই মাস্টারমশাই বলে চিনত। দাদুভাই একজন গুণী মানুষ। সেই সময়কার এম.এসসি। দাদুভাই টিউশন করে আমাদের সংসার চালাতেন। তারপর বাবা পরে ইনকাম ট্যাক্সে চাকরি পেয়েছে। বাবা ছিল ফুটবলার। তারপরে বাবা দাদুভাইয়ের গ্রুপটাকে ধরেছে। এখন যে ছেলেমেয়েরা সিরিয়াল করে তারা অনেকেই বাবার হাত ধরে এসেছে। দাদুভাইয়ের গ্রুপটাকে, শিল্পাঙ্গনকেই বাবা ধরেছিল। বাবা আমাকে নিয়ে যেত অনিতাদির কাছে (অনিতা মল্লিক) নাচ শেখাতে। নাচের স্কুলের বাইরে কাগজ পড়ত, আর আমি ঘন্টার পর ঘন্টা প্র্যাকটিস করতাম। যখন ছৌ শিখছি তখন মা যেত গ্রামে গ্রামে, বাবা অফিসের চাকরিতে কামাই করে আমার সঙ্গে সঙ্গে যেত সব গ্রামে। মানে সাংঘাতিক ভালো পরিবেশ। কাকু- কাকিমারা, আমার ঠাকুমা, আর ঠাকুরদার কথা কী আর বলব, উনি তো আমার দেবতা। 
 
ভাণ: ঝুমুর এবং ছৌ-এ আকর্ষণ কীভাবে? 
মধুমিতা পাল: আমি প্রথমে রবীন্দ্রভারতীতে ভরতনাট্যম্ নিয়ে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েছি। রবীন্দ্রভারতীতে তখন ছিলেন ডঃ শিশির মজুমদার, উনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নৃত্য নাটক সঙ্গীত ও দৃশ্যকলা অ্যাকাডেমির সেক্রেটারি। উনি তখন ক্যাম্পাস ইন চার্জও ছিলেন। তখন ডঃ শুভঙ্কর চক্রবর্তী আমাদের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। এই সময়ে আমি নন্দিতা কৃপালনি অ্যাওয়ার্ড পাই রবীন্দ্র নৃত্যের উপরে। তারপরে ক্লাস করছি, ক্লাস করি, কিন্তু তারপর নাইনটি সেভেন থেকে শনি-রবিবার করে শিশিরবাবু ছৌ-এর একটা কর্মশালা আয়োজন করেন। শনিবার রবিবার সারাদিন, সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত।তখন আমাদের ১২০০ টাকা বছরে লাগত। আমি তো করবো না, তখন শিশির মজুমদার আমাকে বললেন খালি ভরতনাট্যম্ নিয়ে থাকলে হবে!? তখন আমি ‘চন্ডালিকা’ করছি রবীন্দ্রভারতীতে। স্বাগতালক্ষ্মী তখন আমার টিচার ছিলেন। তারপর আমার বাবাকে বলে কোনরকমে আমাকে ছৌ -এ আনালেন। তখন শনি-রবি করে ছৌ-এর ওয়ার্কশপগুলো করতাম। ওয়ার্কশপগুলো করতে করতে আমি ইন্টারেস্ট পেয়ে গেলাম। 
ভাণ: আজকের ঝুমুর ও ছৌ-এর ফর্মের অবস্থা কেমন?এর পাশাপাশি, মহিলাদের ছৌ নৃত্য, যা আজকে অনেক পরিপ্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে, একজন মহিলা ছৌ শিল্পী হিসেবে এই বিষয়ে কিছু বলুন।
মধুমিতা পাল: তিন ধরনের ছৌ নাচ আছে। সিরাইকেলা- ঝাড়খণ্ড ( তখন বিহারে ছিল),ময়ূরভঞ্জ – উড়িষ্যা, পুরুলিয়া – পশ্চিমবঙ্গ।এই তিনটে ছৌ হত চার মাস করে । দুই বছর টানা ছৌ করেছি। তারপর সার্টিফিকেট পেলাম।তখন রবীন্দ্রভারতীর দিনগুলো শেষ হয়ে গেল, শিশিরবাবুও বললেন এই ওয়ার্কশপটাও আর করা যাবে না। সব গুরুরাও আসতে পারছিলেন না। তখন বাবাকে কনভিন্স করলেন যে তুমি মেয়েকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে চলে যাও। আমি গ্রামে গ্রামে মুভ করতে লাগলাম। ময়ূরভঞ্জ-এর অ্যাকাডেমিতে গিয়ে থাকতাম।পাহাড়ের ওপরে ওখানে আলোকরঞ্জন বিশুই, সঞ্জীব ঘোড়ুই , রামচন্দ্র ঘোড়ুই, সঞ্জয়দা এঁরা সবাই আমাকে নাচ শেখাতেন। যখন আমি পুরুলিয়ায় থাকতাম (১৯৯৯-২০০২সাল)তখন কোনো মেয়েরাই আসতো না পুরুলিয়ার ছৌ-এ। আমি রয়্যাল ছৌ অ্যাকাডেমীতে থাকতাম ছেলেদের সঙ্গে। দিনের পর দিন একসাথে থাকতাম, শো করতে যেতাম। লরির ওপরে মাচা বাঁধা হত। কখনো আমার বাবা থাকত, কখনো থাকত না। এটা একটা বিশাল ইতিহাস। তারপর গম্ভীর সিং মুন্ডাকে বাবা রাজি করালেন আমাদের বাড়ি আসার জন্য। উনি আমাদের বাড়িতে ছিলেন। বাবা ওনার চিকিৎসাও করিয়েছিল। গম্ভীর সিং মুন্ডার বাড়িতে গিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের নিচে থাকতাম। গম্ভীর সিং মুন্ডা কিন্তু আমার অন্যতম একজন গুরু। উনি চাল চকর রংবাজি উড়া ঘুরা ডিগবাজি শিখিয়েছিলেন। আমি প্রত্যেকটা গ্রামে গিয়ে গিয়ে থাকতে লাগলাম। পুরুলিয়াতে একটা অসুবিধা হতে লাগল, সবাই বলতে লাগল ‘মাইয়া ছ্যালা বটে কী লাচ শিকবেক’। আমার গুরু গম্ভীর সিং মুন্ডা বাবার কাছে মদ চেয়েছেন, বাবা মদ খাওয়াচ্ছেন তাকে। বাবা তো মাঠের ছেলে, বিখ্যাত ফুটবলার ছিলেন। বাবার প্রথমে রাঁচিতে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর চাকরি ছিল, তারপর বাবাকে ডেকে ইনকাম ট্যাক্স-এর চাকরি দেওয়া হয়েছিল। এইরকম পরিবারে আমার জন্ম। বাবাও ছাড়নেওয়ালা নয়। মেয়ে যখন বলেছে তখন শেখাতেই হবে। উনি রসগোল্লা খেতে চাইছেন বাবা রসগোল্লা কিনে দিচ্ছে। তাঁর বাড়িতে থাকাকালীন যা যা বলেছেন, ছোট রেডিও কিনবেন বলেছেন বাবা কিনে দিয়েছে। এইরকম করতে করতে একদিন রাজি হলেন যে শেখাবেন। সেই ছবিও রয়েছে উনি খাটিয়ার উপর বসে আছেন আর আমাকে বুঝাচ্ছেন চাল চকর রংবাজি উড়া ঘুরা ডিগবাজি। এই যে ছয়- এ ছৌ হয়, ছ’টা ওয়ার্ডের যে কবিতা- এটা প্রথম শুনেছিলাম গম্ভীর সিং দাদুর কাছে। তার মানে এটা স্পষ্ট যে গম্ভীর সিং দাদু এই ছড়াটা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। উড়া বা ডিগবাজি এটা কিন্তু উনি গরুর চাল দেখে শিখেছিলেন। গরুর বাছুর যখন জন্মায়, বাছুর জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে কয়েক মিনিট বাদে বাছুর উল্টে যায়, উল্টো জাম্প করে । এটা কিন্তু আমরা অনেকেই লক্ষ্য করিনি। সেইখান থেকে উনি এইযে পেছনে ডিগবাজির বিষয়টা ছৌ নাচে এনেছিলেন। ছৌ-এর প্রথম গঠন কিন্তু কাপঝাপ। কাপঝাপ হল সঙ সাজা।কাপ মানে হল অভিনয় করা। আগে মুখোশ ব্যবহার হত না, আমি কিন্তু এটা পুরুলিয়ায় কথা বলছি। নানারকম পেন্টিং করতেন, এর কালি, ওর ভুসোকালি- সেটা ওনারা নিজেরা বানাতেন । গেঁড়ি গুগলি ঘুঙ্গুরের মত পায়ে বেঁধে ওনারা বিভিন্ন রকম মুভমেন্ট করতেন,, রঙ্গ করতেন। বিভিন্ন রকম অভিনয় করতেন গ্রামে গ্রামে। এর নামই কাপঝাপ। সেটা এই ছৌ-এর আগের রূপের কথা বলছি। তার মানে কাপঝাপ একটা প্রাথমিক পর্যায়। এইভাবে আজকের ছৌ-এর রূপ পায়। কিন্ত ছৌ-এর মধ্যে নাটুয়ার অনেক ইনভল্ভমেন্ট রয়েছে। নাটুয়া নাচে ছৌ-এর অনেক মুভমেন্ট ইউজ করা হয়। নাটুয়া নাচ থেকেও ছৌ-এ অনেক কিছু নিয়ে আসা হয়েছিল। স্থানীয় ঝুমুর নাচ, মাঝি সম্প্রদায়ের নাচের প্রভাব ছৌ নাচের মধ্যে রয়েছে। আজকের ছৌ নাচের যে মুভমেন্ট তা অনেকটাই বাইরে থেকে এসেছে। আর ময়ূরভঞ্জের ছৌ নাচ তো খুবই ইন্টারেস্টিং। ওরা বিভিন্ন দিক দিয়ে বিশেষ করে মুভমেন্ট, পড়াশুনো, গঠন, বিষয় এইসব দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে আছে। যেমন ময়ূরভঞ্জের ছৌ নাচের মুভমেন্ট অনেকটা ভরতনাট্যমে্র মত। শোনা যায় ভরতনাট্যমে্র দুজন গুরু চেন্নাই থেকে এসেছিলেন ময়ূরভঞ্জে। ফলে সেটা ডেভলপ হয়। তাই বোঝাই যাচ্ছে যে বাইরে থেকে কিছু মুভমেন্ট না এলে ময়ূরভঞ্জের ছৌ নাচ এতটা ডেভলপ করত না। তারপর সেখানকার পাইকরা যে কসরত করত সেখান থেকেও মুভমেন্ট এসেছে। পাইক ডান্স বলে ওরা। সিরাইকেলার প্রাথমিক মুভমেন্ট টাকে ফারিখান্ডা মুভমেন্ট বলে। সিরাইকেলা আর ময়ূরভঞ্জ অনেকটা এক, কিন্তু ময়ূরভঞ্জের ক্ষেত্রে ডান পা আগে রেখে ত্রিভঙ্গীতে বসে, আর সিরাইকেলাতে বাঁ পা সামনে রেখে ত্রিভঙ্গীতে বসে। মুভমেন্ট আলাদা, আবার অঅনেক্ষেত্রে এক। সিরাইকেলাতে বেশিরভাগই লাস্য মুভমেন্ট হয়, কিন্তু এখানে লাস্য মানে নরম নয়। ম্যাসকুলিন এবং ফেমিনাইন উভয়ই সংমিশ্রিত হয়ে ছৌ নাচ ডেভেলপ করেছে।
 
ভাণ: নগর নৃত্য লোকনৃত্য কিংবা কৌম বা গোষ্ঠী নৃত্যের পার্থক্য ও সমন্বয়কে আপনি কীভাবে দেখেন?
মধুমিতা পাল: নগরের যে নৃত্য হয়, যেমন ধ্রুপদী নৃত্য বা শান্তিনিকেতনের ররবীন্দ্রনৃত্য, নৃত্যনাট্য, ছৌ নাচকে সবাই লোকনৃত্যের পর্যায়ে ফেলছে, কিন্তু এটাতো ঠিক লোকনৃত্য নয়, এটা ট্রাডিশনাল ফর্ম অফ ডান্স। গুরু পরম্পরায় এই নাচ শিখতে হয়। সেটা আমার পড়াশোনার কথা বলতে পারি। সো ইট ইজ অ্যা ট্রাডিশনাল আর্ট ফর্ম। লোকনৃত্য- লোকে যা করে তা কিন্তু নয়। এটা সোলোও হতে পারে, আবার সমন্বয় নৃত্যও হতে পারে। ময়ূরভঞ্জে সিরাইকেলাতে অনেক সোলো আইটেম আছে, কিন্তু পুরুলিয়াতে কোনো সোলো আইটেম নেই।
ভাণ: বাঙালির নৃত্য বলে কি কিছু আছে? না থাকলে কেন তৈরি হলো না?
মধুমিতা পাল: বাঙালির নৃত্য বলে কিছু আছে কিনা আমি জানিনা। মানে গৌড়ীয় নৃত্য নিয়ে অনেক দ্বন্দ্ব আছে অনেক কথা আছে। সেই দ্বন্দ্বমূলক কথার মধ্যে আমি ঢুকতে চাই না, তবে আমার মনে হয় বাঙ্গালির নৃত্য বলতে যেটা আছে- ঝুমুর নাচ বা কীর্তন, কীর্তনের গান করার সময় যে মুভমেন্টগুলো ইউজ করা হয় তা দেখে বোঝা যায় এখানে যে দেবদাসীরা ছিল, যেমন মাহারিদের নৃত্য থেকে ওড়িশি এসেছে, সেইরকমই শ্রীচৈতন্যদেব যে ধারায় কীর্তনের সঙ্গে পা মেলাতেন, হাত এবং দেহ সঞ্চালনা করতেন সেটার তো একটা ধারা আছেই। এখনও আমরা গ্রামে, গ্রামীণ উৎসবে, মন্দিরে লীলাকীর্তন দেখি। আমার মনে হয় ঝুমুর, পুরুলিয়ার ছৌ সম্পূর্ণভাবে বাঙ্গালির নৃত্য। কীর্তনের সঙ্গে যে নৃত্য পদচারণা তা অবশ্যই বাঙ্গালির নৃত্য।
 
ভাণ: আপনার নৃত্য পরিবেশন, শিক্ষা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কিছু বলুন।
মধুমিতা পাল: আমি কখনোই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাইনি এবং তার জন্য প্রচুর সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছি। আজও হই। আমাকে অনেক কম্প্রোমাইজ করতে হয়েছে। অনেক সময় কম্প্রোমাইজ করার মুখে এসে আমি পিছিয়ে গিয়েছি। সেইজন্য হয়তো আমজনতা আজও আমাকে চিনতে পারছে না। কিন্তু সেই কম্প্রোমাইজটা আমি করবো না কারণ, আমি জানি আমি কী কাজ করি এবং আমি কী গুন নিয়ে জন্মেছি। আমার ঠাকুরদা পানু পাল বিখ্যাত নৃত্য শিল্পী, পথনাটকের স্রষ্টা। সেই ঘরানায় আমি জানি, আমি যেটা করছি সেটা সঠিক জেনেবুঝেই করছি। তাই কম্প্রোমাইজ করার প্রয়োজনীয়তাই আমার নেই। না চিনল আমজনতা, আপনাদের মত কিছু মানুষ তো চিনছে। তাতেই আমার হবে। আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে অন্যরকম কাজ করেছি- নটরাজের ঋতুরঙ্গশালা। সবসময় আমার পরীক্ষামূলক কাজ করতে ভালো লাগে।
 
আমি বিশ্বাস করি মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার, রঞ্জাবতী সরকার এঁদের যে নবনৃত্য বা এঁরা যে ছৌ মুভমেন্ট ইউজ করেছিলেন, এঁরা যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অন্যরকমভাবে, তার ভাবসম্প্রসারণের বিষয়ে থিওরিটিক্যালি তো বটেই প্র্যাকটিক্যালিও যে ভেবেছিলেন আমি তার একনিষ্ঠ ভক্ত এবং আমার নাচেও তার প্রভাব পড়ে। আমার ইচ্ছে আছে একটি গ্রাম তৈরি করার। পয়সা নেই, সরকারও সাহায্য করছে না। কলকাতা থেকে একটু দূরে, কল্যাণীতে কিংবা সুন্দরবনে, যেখানে রাতদিন ছৌ নৃত্য চর্চা হবে, ছৌ নৃত্য নিয়ে পড়াশোনা হবে, সংস্কৃত গুরু সংস্কৃত শেখাবে। কিন্তু আমি জানিনা সেটা আদৌ এই জীবনে করে যেতে পারবো কিনা।
ভাণ: সামগ্রিকভাবে নৃত্য নিয়ে কোনোরকম সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন আছে কি? কীরকম হবে তার চেহারা?
মধুমিতা পাল : অবশ্যই সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন আছে। সরকারি উদ্যোগ ছাড়া আমরা সারভাইভ করবো না।
 ভাণ: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *