শর্মিলা ঘোষ
অথ শাঁওলী মিত্র কথা : এক অসমাপ্ত প্রতিবেদন।
শাঁওলী মিত্র (১৯৪৮ – ২০২২) বাংলা নাট্যের এক কালজয়ী নাম। ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকারে, সৃজনশীলতায় এবং মৌলিকতায়, প্রতিবাদে এবং দৃঢ়তায় ব্যাপ্ত তাঁর জীবন। তিনি মঞ্চ ও বেতারের এক অসামান্য অভিনেতা। চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় শাশ্বত। দূরদর্শনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করেছেন। এরই সঙ্গে তিনি একাধারে নাট্য নির্দেশক, নাটককার, নিজস্ব নাট্য দলের প্রতিষ্ঠাতা, গ্রন্থকার, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, সম্পাদক, অসাধারণ একজন বাচিক শিল্পী এবং প্রণম্য একজন শিক্ষক।
শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের একমাত্র কন্যা শাঁওলী মিত্রের জন্ম ১৯৪৮ সালে, সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া ভারতবর্ষে, একেবারেই অন্যরকম এক পারিবারিক পরিবেশে। ১১এ নাসিরুদ্দিন রোডের সেই বাড়িটিতে ছিল বাংলার প্রথম গ্রুপ থিয়েটারের নাট্যযাপন, ছিল সব অর্থেই অসাম্প্রদায়িক এক প্রতিবেশ আর ছিল ভয়ংকর সাংসারিক অনটন। শাঁওলী মিত্রের গ্রন্থ থেকে জানা যায় এমনকি এই শিশুকে দুধ কিনে দেবার মতো সামর্থ্যও সবসময় থাকত না দুই প্রবাদপ্রতিম অভিভাবকের। ১।
ছেলেবেলা থেকেই অসুস্থতার মাঝেই অদম্য জেদে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া, বিবিধ সাহিত্য পাঠ, খালেদ চৌধুরির কাছে মঞ্চ অথবা তৃপ্তি মিত্র ও কুমার রায়কে ধরে মেকআপ শিখে নেওয়ার চেষ্টা – তাঁরই লেখার এসব টুকরো টুকরো ছবি তাঁর হয়ে ওঠাকে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে।
এরই মধ্যে ১৯৫৭ সালে বহুরূপীতে তৃপ্তি মিত্রের নির্দেশনায় ‘ডাকঘর’ নাটকে অমলের ভূমিকায় অভিনয়
করলেন শাঁওলী মিত্র। বাংলা মঞ্চ প্রত্যক্ষ করল এক নতুন শিল্পীর আত্মপ্রকাশ। বিভিন্ন সংবাদপত্রের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা থেকে স্পষ্ট এই শিশু শিল্পীর উওরাধিকার।২।
পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে হিমাংশু চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায়
‘ত্রিশ শতাব্দী’ নাটকে শাঁওলী মিত্রের ” পূর্ণ চরিত্রাভিনয়ে প্রথম আত্মপ্রকাশ।” ( স্বপন মজুমদার ” বহুরূপী ১৯৪৮_১৯৮৮)। এরপর তৃপ্তি মিত্রের নির্দশনায় ‘কিংবদন্তী’ নাটকে অভিনয়ের পর শাঁওলী প্রথম পিতার নির্দেশনায় কাজ করলেন। নাটক বাদল সরকারের ‘পাগলা ঘোড়া।’
নানা দিক থেকেই ‘পাগলা ঘোড়া’ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই নাটক থেকেই বহুরূপী অ্যাকাদেমি অফ্ ফাইন আর্টস মঞ্চে তাদের অভিনয় শুরু করে। যা আজও পর্যন্ত বাংলা নাট্যাভিনয়ের পীঠস্থান। আর শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় এটিই
শাঁওলী মিত্রের প্রথম কাজ করার সুযোগ। তাঁর নিজের কথায় “একরকম শেষও বটে। কারণ অন্য যা করেছি , যেমন ‘দশচক্র’ তে মঞ্জু বা ‘রাজা’য় সুরঙ্গমা- কোনওটাই তো নতুন নাটক নয়, একটা নির্মিত কাঠামো র মধ্যে নিজেকে সাজিয়ে নেওয়া।” ৩।
‘পাগলা ঘোড়া’ নাটকে রাত্রির পরিবেশে শ্মশানের পটভূমিতে চারজন ভিন্ন বয়সের পুরুষ, অনাত্মীয় এক তরুণীর মৃতদেহ বহন করে এনেছে।সেই মৃতদেহ পুড়ে যাবার অবসরে তাসখেলা ও মদ্যপানের ফাঁকে এই চারজন নিজেদের গল্প বলেছিল। যাকে এক ধরণের স্বীকারোক্তি বলা চলে। এই চার পুরুষ চরিত্রে কুমার রায়,শান্তি দাস, কালীপ্রসাদ ঘোষ এবং দেবতোষ ঘোষ
অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। আর নাটকের ভিন্নতর এক স্তরে অপূর্ব অভিনয় করেছিলেন শাঁওলী মিত্র। অশরীরী একটি চরিত্রে তাঁর অভিনয় উৎকর্ষতার চরম বিন্দুকে স্পর্শ করেছিল। ৪।
এরপরে প্রধানত তৃপ্তি মিত্রের নির্দেশনায় বহুরূপীতে শাঁওলী মিত্রের অভিনয়। ইন্দ্র উপাধ্যায়ের ‘টেরোড্যাকটিল’, ইয়োনেস্কো অবলম্বনে গন্ডার, রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে, বাদল সরকারের ‘যদি আর একবার’, এবং মনোজ মিত্রের ‘পাখি’ নাটকে শাঁওলী মিত্রের অভিনয় বিশেষ প্রশংসিত হয়। ৫।
এরই মধ্যে ইয়োনেস্কো অবলম্বনে ‘গন্ডার’ শাঁওলী মিত্রের নিজের অনুবাদ। ১৯৭৩ সালে ‘ডাকঘর’ নাটকের পুনর্নির্মাণে সহকারীর কাজ করেছিলেন শাঁওলী মিত্র। এই
বুঝি প্রথম তাঁর নির্দেশনার কাজে হাতেখড়ি।
১৯৭৬ সালে নিধুবাবুর জীবন নিয়ে চিত্তরঞ্জন ঘোষের লেখা ‘গীতরত্ন’ নাটকের মহলা শুরু করেছিলেন কুমার রায়। শাঁওলী মিত্র ছিলেন শ্রীমতীর ভূমিকায়। কিন্তু একটিমাত্র ঘরোয়া অভিনয়ের পর সে নাটক বন্ধ হয়ে যায়।
এই বছরেই ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকের মহলা শুরু করেছিলেন শম্ভু মিত্র। বেহুলা চরিত্রে ছিলেন শাঁওলী
মিত্র। তবে কোন অজ্ঞাত কারণে সেই প্রস্তুতি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
১৯৭৯ সালের জুন মাসে বহুরূপী ছেড়ে বেরিয়ে আসেন শাঁওলী মিত্র। জন্মলগ্ন থেকে লিপ্ত এই সংগঠন থেকে কেন তিনি বেরিয়ে এলেন তার কার্যকারণ বিচার করার জন্য এই প্রবন্ধ নয়। পরে কখনো সেই আলোচনার অবকাশ রইল।
১৯৮০ সালে কলকাতা নাট্যকেন্দ্রের ‘গ্যালিলেওর জীবন ‘ একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা। আর্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক ফ্রিৎজ্ বেনেউইৎজ্ ছিলেন এর নির্দেশক। শম্ভু মিত্র ছিলেন গ্যালিলেওর ভূমিকায়। শাঁওলী মিত্র গ্যালিলেওর ছোট মেয়ে ভার্জিনিয়ার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। শাঁওলী মিত্র লিখেছেন যে এই চরিত্রটি লোভনীয় না হলেও আন্তর্জাতিক মানের একজন নির্দেশকের একটা নাট্য নির্মাণ কাছ থেকে দেখতে পাওয়া এবং পিতাকে কোনো বড়ো ভূমিকায় তৈরি হতে দেখা। এই দুটি কারণেই এই কাজে তাঁর সম্পৃক্তি। যদিও কিছুটা আকস্মিক ভাবেই কয়েকটি অভিনয়ের পর সে নাটক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এরই সঙ্গে চলছে কবিতা পাঠ। ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকটিও পাঠ করছেন পিতা কন্যা। অসম্ভব জনপ্রিয়তা পাচ্ছে সেই পাঠাভিনয়।
এইরকম একটা সময়পর্বেই দ্রৌপদী র ভাবনা এসেছিল শাঁওলী মিত্রের মনে। পিতা মাতা উভয়েই উৎসাহিত হয়েছিলেন। পিতার সঙ্গে কথা বলে যেন জুড়তে পেরেছিলেন সূত্রগুলিকে। খুলে গিয়েছিল ভাবনার জট। শম্ভু মিত্রের কাছেই শুনেছিলেন কথকতার প্রসঙ্গ। জেনেছিলেন বিভিন্ন প্রদেশের লোকনাট্য ধারার কথা। শম্ভু মিত্র তাঁকে দিয়েছিলেন ইরাবতী কর্ য়ের ‘যুগান্ত’ বইটি। যে বই পড়ে মুগ্ধ কন্যা নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন দ্রৌপদী কে। তৈরি হয়েছিল ” নাথবতী অনাথবৎ। ” বাংলা নাট্যমঞ্চের এক আশ্চর্য প্রযোজনা। এই নাটক তৈরি হওয়ার অপূর্ব ইতিহাস শাঁওলী মিত্র বিস্তৃত লিখে গেছেন তাঁর গ্রন্থে। ৬।
এই অভিনয়ের সূত্রেই শাঁওলী মিত্র তৈরি করলেন তাঁর নিজস্ব নাট্যদল। পঞ্চম বৈদিক। যে দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্র।
এই সংগঠন শাঁওলি মিত্রের নির্দেশনায় আরও অনেকগুলি অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ নাট্য নির্মাণ করেছে। তৈরি হয়েছে কথা অমৃত সমান, বিতত বিতংস, চন্ডালী, পুতুলখেলা ইত্যাদি। আরও পরবর্তী তে যোগ্য উত্তরসূরী অর্পিতা ঘোষ নির্দেশনার দায়িত্ব নিয়েছেন। তৈরি হয়েছে অসামান্য কিছু নাট্য প্রযোজনা। ‘পশুখামার’ তার মধ্যে অন্যতম। সমকালীন সমাজ রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে যার গুরুত্ব অপরিসীম।
ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ছবিতে বঙ্গবালা চরিত্রে শাঁওলী মিত্রের অভিনয় একটি মাইলফলক।
শাঁওলী মিত্র আরও অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গেছেন। নাট্য ও সমাজ বিষয়ক বহু উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ লিখেছেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়। ‘শম্ভু মিত্র: বিচিত্র জীবন পরিক্রমা’ এবং’ গণনাট্য নবনাট্য সৎনাট্য ও শম্ভু মিত্র’ তাঁর অসামান্য দুটি গবেষণাধর্মী বই। মা তৃপ্তি মিত্র সম্বন্ধে তাঁর গ্রন্থ “মা-‘মণি'” একটি অসামান্য সংকলন। এছাড়াও দিদৃক্ষা, মুকুরে মুখ না মুখোশ, তর্পণ, শম্ভু মিত্র ও সৎনাট্য
ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য কিছু বই তাঁর রচনা। তাঁর লেখা নাটক সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। ‘অবেলার গল্প’ তাঁর গল্প সংকলন। একই সঙ্গে তিনি একজন ঋজু সম্পাদক। তাঁর সম্পাদনায় শম্ভু মিত্র রচনা সমগ্র তিনটি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থ বাংলা নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে এক চিরস্থায়ী সম্পদ।
বহু পাঠ অভিনয় করেছেন অ্যাকাডেমি এবং অন্যান্য দর্শক পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে। সেসব পাঠ শোনার স্মৃতি অমলিন থেকে যাবে আজীবন।
সামাজিক অবস্থানেও তিনি ছিলেন দৃঢ়। আপোষহীন একজন মানুষ। প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠান বিরোধি পদক্ষেপ নিয়েছেন। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। মিটিং মিছিলে যোগ দিয়েছেন। নিজস্ব সত্যের প্রশ্নে দ্বিধা ছিল না কোথাও।
বহু পুরস্কার পেয়েছেন শাঁওলী মিত্র। কিন্তু সেই তালিকা তাঁর জীবন চর্যা ও সৃজনশীলতার আলোচনায় বড় অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হয়।
এই সবকিছুর মধ্যেই বাচিক পাঠ দিয়েছেন শিক্ষার্থীদের।
অসামান্য উচ্চারণ ও ভাব শিক্ষা, হারমোনিয়ামের সঙ্গে চর্চা, সাহিত্যের আলোচনা এবং আশ্চর্য শৃঙ্খলা অথচ উষ্ণতায় ভরা সেই শিক্ষাক্রমের একজন শিক্ষার্থী হতে পেরে এই লেখক নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করে। বাস্তবিক আমার জীবনের একটা সেরা সময় সেই দিনগুলো। পরবর্তী সময়ে গবেষণার কাজেও তাঁর সাহায্য এক পরম সম্পদ। তাঁকে আমার অন্তরের প্রণাম জানাই।
এত স্বল্প কথায় তাঁর মতো একজন ব্যক্তিত্ব কে প্রকাশ করা বোধকরি অসম্ভব। সেই যোগ্যতাও এই লেখকের নেই। অনেক কথা বাকি রয়ে গেল। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই লেখা তাই অসম্পূর্ণ।
জীবনের শেষ পর্বে মৃত্যু পরবর্তী বিষয়ে নিজস্ব সিদ্ধান্ত জানিয়ে ইচ্ছাপত্র লিখে রেখে তিনি দেখিয়ে গেলেন সেই দৃঢ়তা যা বোধকরি উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর পরম প্রাপ্তি। কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁদেরও যাঁরা এই ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করলেন।
এমন একজন সৃজনশীল- মৌলিক- পরিশ্রমী- সংযমী- শৃঙ্খলাপরায়ণ- প্রতিবাদী- দৃঢ় অথচ আন্তরিক মানুষকে আমার প্রণাম। আমার শ্রদ্ধা।
তথ্যসূত্র
১। শাঁওলী মিত্র- শম্ভু মিত্র: বিচিত্র জীবন পরিক্রমা। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট। প্রথম প্রকাশ ২০১০
২। বহুরূপী ৭০। বহুরূপী বিশেষ প্রযোজনা সংখ্যা ২।
৩। ১। এর ন্যায়।
৪। ২।এর ন্যায়।
৫। ঐ
৬। ১এর ন্যায়।
এছাড়া বিভিন্ন পত্র পত্রিকার সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
যা নাট্যশোধ সংস্থা এবং লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি
সূত্রে শ্রাপ্ত।