![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2022/03/march-2022-regd.jpg)
ভাণ পত্রিকা
ত্রয়োবিংশতম সংখ্যা, ষোড়শ ই-সংস্করণ, মার্চ, ২০২২
সম্পাদক :
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2021/08/b040b0_45afbde0f8f748c79cfbff99eef81d25_mv2-150x150.png)
সম্পাদনা সহযোগী :
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2021/08/b040b0_759cdd3dbeee43cf86e3c6b21e760bbe_mv2-150x150.png)
প্রচ্ছদ :
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2022/02/20220209_230741-150x150.png)
নক্সা পরিকল্পক :
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2021/08/b040b0_c9c583acc1444109b6384cdba4c1af01_mv2-150x150.png)
অন্যান্য কাজে :
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2021/08/b040b0_e064a731345341f28c345444c4a6506c_mv2-150x150.png)
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2021/08/b040b0_c0d63ec0a5ed4b42a7d589770dfa181f_mv2-150x150.png)
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2021/08/5b9835_8d5ab6a2e07b4f3f84d49b7a2e229e44_mv2-150x150.webp)
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2021/08/5b9835_3de77bb138004572abbe2f1ebda0e008_mv2-150x150.webp)
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2021/08/5b9835_e347bfe111a5470a9a39b33c2c076357_mv2-150x150.webp)
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2022/01/l-150x150.png)
ভাণ-এর পক্ষে:
পার্থ হালদার
কর্তৃক
৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬
( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )
৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) [email protected] ( ই – মেল )
Reg. No : S/2L/28241
সূচি
সম্পাদকের কথা
পরলোকে সন্ধ্যা, মর্ত্যে থাকল তাঁর গান' বললেন - অভিষ্যন্দা লাহিড়ী দেব
অভিষ্যন্দা লাহিড়ী দেব
এক ইন্দ্রধনুর রঙ, সুচিত্রা সেনের এক স্মরণ অনুষ্ঠানে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিটির গান গাওয়ার সময় তিনি জানতেন না ছবির নায়িকা কে! ‘সবার উপরে’ ছবির সেটে তাঁর সঙ্গে সুচিত্রা সেনের আলাপ হয়েছিল। অথচ আমরা যখন ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিটি যখন দেখি তখন কিন্তু আমরা ছবির নায়িকার সঙ্গে গায়িকাকে আলাদা করতে পারি না। তা সে ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’র রেনু রেনু হয়ে ছড়িয়ে পড়া সুরই হোক বা ‘কে তুমি আমারে ডাকো’ গানটির দ্বিধাগ্রস্ত বেদনা—ছবির কাহিনি, সুচিত্রা সেনের অভিনয় এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান একেবারে ‘বাগার্থরিব সম্প্রিক্তৌ’! এমন গায়িকা আর কে আছেন? জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পদ্মশ্রী প্রত্যাখ্যান করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন গীতশ্রী। বিতর্কে না জড়িয়েও বলাই যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আরও অনেক বড় সম্মানের যোগ্য তো বটেই।
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2022/03/Sandhya-Mukherjee-1-300x223.jpg)
সুরের সরস্বতী লতা মঙ্গেশকর 'কে নিয়ে লিখলেন - সোমনাথ লাহা
সোমনাথ লাহা
মারাঠি শিকড়.. বাঙালি আত্মা.. চিরন্তন স্বাতন্ত্র্যভরা লতা মঙ্গেশকর : মারাঠি ছবি ‘মাঝাবাল’ এর কাজ চলছে। সেই ছবিতে এক পরীর চরিত্রে অভিনয় করছে সদ্য বয়ঃসন্ধিকালে পা দেওয়া একটি মেয়ে। ছবিতে একটি গান ‘হামারা অখন্ড হিন্দুস্তান’ এর শুটিং। মেয়েটির ১০৪ডিগ্রি জ্বর। মায়ের বারণ সত্ত্বেও মেয়েটি গিয়েছিলেন শুটিংয়ে। কারণ পরিবারের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। কাট টু.. পিচধালা রাস্তা দিয়ে চলছে সেই মেয়েটি। পিচে চপ্পল আটকে যায়। টান দিতেই চপ্পল পা থেকে বেরিয়ে সোজা পিচের উপর পড়ে যায়। অনেক কষ্টে পা ছাড়িয়ে ওই অবস্থায় পা ছাড়িয়ে যন্ত্রণার মধ্যে স্টুডিও পৌঁছে রিহার্সাল দিয়ে দুটো ট্রেন বদলে দুই বোনকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। দুই বোন তারপর নারকেল তেল ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে দিলো দিদির পা। কিন্তু ততক্ষণে ফোসকা পড়ে লাল টকটকে হয়ে গিয়েছে পা। ভিন্ডিবাজারে উস্তাদ অমান আলি খাঁয়ের কাছে তামিল নিতে যাওয়া সেই মেয়েটি সঙ্গে নিয়ে যেতেন তাঁর বোনেদের। একদিকে পারিবারিক দায়িত্ববোধ, অন্যদিকে ভাই-বোনেদের বড় করে তোলার অদম্য জেদ রাতারাতি তাঁকে ‘বড়’ করে দেয়। জেদ আর কৃচ্ছ্রসাধন, অধ্যাবসায়েই তো আজ আসমুদ্রহিমাচলে গুঞ্জরিত হয় ‘মেরি আওয়াজ হি পহেচান হ্যায়…’। তিনি এক এবং অদ্বিতীয় লতা মঙ্গেশকর। যথার্থ অর্থেই সুরসম্রাজ্ঞী। সরস্বতী তাঁর কন্ঠে বিরাজমান। ৩৮ টি ভাষায় তাঁর গানের সংখ্যা সাত হাজার।
১৯২৯ এর ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে মারাঠি সংগীত ও নাট্যজগতের ব্যক্তিত্ব দীননাথ মঙ্গেশকর ও সুধামতীর কোল আলো করে জন্ম নিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। দীননাথের পদবি আগে ছিল হার্দিক। পরে জন্মস্থান গোয়ার মঙ্গেশি গ্রামের নামে নিজের পদবি বদলে নেন ‘মঙ্গেশকর’-এ। জন্মের পর লতার নাম রাখা হয় হেমা। পরে নাম বদলে ‘লতা’ রাখা হয়।দীননাথের এক নাটকের চরিত্র লতিকার নামানুসারে। পাঁচ বছর বয়সে দীননাথের এক ছাত্রকে অজন্তেই শোনাচ্ছিলেন পুরিয়া ধানেশ্রী রাগের শুদ্ধ রূপ। শুনে তাক লেগে গিয়েছিল দীননাথের। কালবিলম্ব না করে মেয়েকে সঙ্গীতের তালিম দিতে শুরু করেন। দিনে প্রায় ১৬ঘন্টা রেওয়াজ করে কাটাতেন লতা। ১৯৪২-এ ২৪ এপ্রিল দীননাথের মৃত্যু লতাকে দায়িত্ববান করে দেয়। চলে যাওয়ার আগের রাতে নিজের তানপুরাটি দিয়ে লতাকে বলে মান “এটাই হোক তোমার বন্ধু, অন্ধকার পথের দিশারি।” কাঁদতে কাঁদতে ১৩বছর বয়সী লতা শপথ করেন সঙ্গীতকে তিনি কোনওদিন ছেড়ে যাবেন না। একদিকে সংগীত সাধনা অন্যদিকে পরিবারের দায়িত্ব। কারণ তাঁর পরিবারে আর কেউ রোজগেরে নেই। তাঁর পরে আরও তিন বোন – মীনা, আশা,উষা। আর রয়েছে আদরের ছোটভাই হৃদয়। বিধবা মা ও চার ভাইবোনকে নিয়ে জীবনের চাকা গড়াতে পুণেয় এসে সাহায্য নেন পারিবারিক বন্ধু বিনায়ক দামোদরের। সেই সময় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন বিনায়ক। সম্পর্কে তিনি অভিনেত্রী নন্দার বাবা। তাঁর প্রচেষ্টাতেই ‘নবযুগ ফিল্মস’-এর ব্যানারে নির্মিত মারাঠি ছবিতে অভিনয় ও গান করে কষ্টের সঙ্গে সংসার চালাতেন লতা। পরবর্তী সময়ে মাস্টার বিনায়কের হাত ধরে পুণে থেকে সপরিবারে কোলাপুর আসেন লতা। তাঁর সিনেমা কোম্পানি ‘প্রফুল্ল পিকচার্স’-এ ‘আপ কি সেবা মেঁ’ ও ‘বড়ি মা’ ছবি দুটিতে অভিনয় করেন লতা।তবে অভিনয় মোটেও উপভোগ করতেন না। মেকআপ করে ক্যামেরার সামনে হাঁসা-কাঁদা সবই বিরক্তিকর লাগত তাঁর কাছে। ‘বড়ি মা’ ছবিতে কাজের সময় জনপ্রিয় অভিনেত্রী তথা গায়িকা নূর জাহানের নজরে পড়েন লতা। একটু অবসর পেলেই তাঁকে ডেকে গান শুনতে চাওয়ার পাশাপাশি সকলকে ডেকে লতার গান শোনাতেন। এসময় বিনায়কের অনুরোধেই লতার হিন্দুস্তানি ক্ল্যাসিক্যালের তালিম নেওয়া শুরু করেন উস্তাদ অমান আলি খাঁয়ের কাছে। একটু একটু করে রোজগারের পথ দেখতে শুরু করেছিল মঙ্গেশকর পরিবার, লতার হাত ধরে। শিল্পীসত্ত্বার লালনে এক মৌলবীকে ধরে উর্দু শিখতে শুরু করেন লতা। কারণ মারাঠিদের বলা হিন্দি কৌলিন্য পায় না হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। ১৯৪৮ -এ মারা যান মাস্টার বিনায়ক। আবারও সমস্যায় পড়েন লতা ও পরিবার। এসময়ই তাঁর হাত ধরেন সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দর। একটি সংগীত প্রতিযোগিতায় ১৩বছরের কিশোরী লতাকে পুরষ্কার দিয়েছিলেন তিনি। দেখেছিলেন তাঁর মধ্যে অনন্ত সম্ভবনা। তিনিই লতাকে নিয়ে যান বোম্বাইয়ের ফিল্মিস্তান স্টুডিওতে। তখন সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির একচ্ছত্র বিধাতা শশধর মুখোপাধ্যায়। কিন্তু তিনি পত্রপাঠ ফিরিয়ে দেন লতাকে। কারণ তাঁর গলা সরু, রিনরিনে। শুরু এক অদ্ভুত স্ট্রাগল। ট্রেনে চড়ে বম্বে টকিজ, গোরেগাঁওয়ের ফিল্মিস্তান স্টুডিও, এইচএমভি-তে ঘুরে বেড়াতেন কিশোরী লতা। হাতে যা অর্থ থাকত তা দিয়ে মুখোরোচক ভাজি স্টেশন থেকে কিনে নিয়ে খেতেন। তবে লতার জীবনে ঢাল হয়ে দাঁড়ান গুলাম হায়দর। নিজের সংগীত পরিচালনায় লতাকে গাইতে বলেন তিনি। ১৯৪৮-এ ‘মজবুর’ ছবিতে লতার গাওয়া ‘দিল মেরা তোড়া’ জনপ্রিয় হয়। তার পরের বছরই ‘মহল’ ছবিতে মধুবালার লিপে লতার সেই বিখ্যাত গান ‘আয়েগা আনেওয়ালা’। ব্যস আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি লতাকে। তাঁর কন্ঠের জাদুতে অমরত্ব লাভ করেছে গান। প্রথম গান গেয়ে তিনি মাত্র ২৫টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন, সুরকার অনিল বিশ্বাস, শচীনদেব বর্মণ,নৌশাদ, শঙ্কর-জয়কিষেন, মদন মোহনের হাত ধরে তিনিই আটশো, হাজার, দু’হাজার থেকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত প্রতি প্লেব্যাকে নিতে থাকেন। ১৯৫২ -তে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ‘আনন্দমঠ’ ছবিতে ‘বন্দেমাতরম্’ গাওয়ানোর জন্য লতার কাছে যান। ফিল্মিস্তানের ছবি হলেও লতা কিন্তু হেমন্তকে ফেরাননি। এমনকি লতার সঙ্গে এই গানের সুবাদে হেমন্তর সম্পর্ক নিবিড় হয়। গানটির ২১টি রিটেক হলেও লতা একবারের জন্যও বিরক্ত হননি। এমনকি বাংলা ভাষাটিকেও এতটাই ভালোবেসে ফেলেন যে পরিচালক বাসু ভট্টাচার্যর কাছে বাংলা শিখতে শুরু করেন। ১৯৫৬ -তে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’ গানটির হাত ধরে বাংলা আধুনিক গানের দুনিয়ায় পা রাখেন লতা। তারপর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকার সুরে বাংলা গান গেয়েছেন তিনি। তবে লতা মঙ্গেশকরকে বাঙালির ‘ঘরের মেয়ে’ তিনি বানিয়ে দেন তিনি সলিল চৌধুরী। লতা মঙ্গেশকর ও সলিল চৌধুরীর যুগলবন্দী এককথায় ‘মণিকাঞ্চন যোগ’। ‘সাত ভাই চম্পা’-র হাত ধরে যার সূচনা হয়েছিল। বাংলা পুজোর গানেও সলিল চৌধুরীর সুরে বেসিক গানের এক একটি অক্ষয় অমর সৃষ্টি করে গিয়েছেন লতা। ‘না যেও না’, ‘ও মোর ময়না গো’, ‘এ দিন তো যাবে না’, ‘ও প্রজাপতি প্রজাপতি’,’কিছু তো চাহিনি আমি’, ‘বাঁশি কেন গায়’,’ধরণীর পথে পথে’, ‘সূর্য দেখা’-র মতো কালজয়ী গান। এমনকি বাংলা ছবিতেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সলিল চৌধুরীর সুরে কালজয়ী হিট গান উপহার দিয়েছেন লতা।
‘অদ্বিতীয়া’ ছবির ‘চঞ্চল ময়ূরী’, ‘যাওয়ার বেলায় পিছু থেকে’, ‘বাঘিনী’ ছবির ‘যদিও রজনী পোহাল তবুও’, ‘মণিহার’ ছবির ‘আষাঢ় শ্রাবণ’, ‘নিঝুম সন্ধ্যায়’ -এর মতো গানগুলি অন্য মাত্রা পেয়েছে লতার কন্ঠে। ‘কবিতা’ ছবিতে সলিল চৌধুরীর সুরে লতার কন্ঠে ‘বুঝবে না কেউ বুঝবে না’, ‘মর্জিনা আবদুল্লা’ ছবির ‘হায় হায় প্রাণ যায়’ লতার ভার্সেটাইল কন্ঠের আরেক রূপ। লতার প্রশংসা করে উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান বলেছিলেন, “লতা আল্লার এক আশ্চর্য সৃষ্টি’। ১৯৬২-তে ভারত-চিন যুদ্ধের রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশ জুড়ে। প্রচুর ভারতীয় সৈন্য মারা গিয়েছিলেন ওই যুদ্ধে। তাঁদের কথা মাথায় রেখে কবি প্রদীপের লেখা ও সি রামচন্দ্রের সুর করা ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ..’ গানটি ১৯৬৩ -তে প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের সামনে গেয়েছিলেন লতা। তারপর বাকিটা ইতিহাস। আজও দেশাত্মবোধক গানের তালিকায় সর্বোচ্চ সারিতে বিরাজ করছে সেই গান। লতার গানে যে সমস্ত অভিনেত্রী লিপ দিয়েছেন তাঁরা শুধু যে নিজেদের ধন্য মনে করেছেন তাই নয়, কালজয়ী সেই সমস্ত গানের জাদুকাঠির ছোঁয়ায় স্টারের তকমা পেয়েছেন তাঁরা। তালিকায় রয়েছেন মধুবালা, নার্গিস, মীনাকুমারী, ওয়াহিদা রহমান, সাধনা, নন্দা, আশা পারেখ, নূতন, তনুজা, শর্মিলা ঠাকুর, রেখা, জয়া বচ্চন, জয়াপ্রদা, শ্রীদেবী থেকে হালফিলের মাধুরী দীক্ষিত, জুহি চাওলা, কাজল, টাবু, প্রীতি জিন্টা। প্লেব্যাকের দুনিয়ায় একটানা ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এইভাবে বিরাজমান আর কোনও গায়িকাকে দেখা গিয়েছে কিনা সন্দেহ। যদিও লতার পাশে নিজস্বতা ও ভার্সেটাইলিটি নিয়ে তাঁকে সমান টক্কর দিয়েছেন তাঁর সুযোগ্য বোন আশা ভোঁসলে। তবে দেশাত্মবোধক, ভক্তিমূলক ( আল্লাহ তেরো নাম), গজল, রোম্যান্টিক সবধরণের গানেই লতা সমানভাবে বিরাজ করেছেন। হেলেনের লিপে তাঁর গাওয়া ক্যাবারে গান ‘আ জানে জা’ রীতিমতো মাদকতায় পরিপূর্ণ। লতার সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, মুকেশ, মহম্মদ রফি ও কিশোর কুমারের যুগলবন্দী তথা বুয়েট গানগুলি এক একটি রত্নসম।বেশ কিছু মারাঠি ছবি (‘রাম রাম পাহুনে, ‘সাধী মানসে’, ‘তাম্বডী মাতি’) -তে সংগীত পরিচালনার দায়িত্বও সামলেছেন লতা। লতার সুরে কিশোর কুমারের গাওয়া দুটি বাংলা আধুনিক গান (পুজো) ‘তারে আমি চোখে দেখিনি’ ও ‘আমি নেই’ রীতিমতো সুপারহিট ও কালজয়ী। সমসাময়িক কুমার শানু, উদিত নারায়ণের সঙ্গেও গান করেছেন তিনি। হিন্দিতে পরবর্তী সময়ে শচীনকর্তার পুত্র রাহুল দেব বর্মন, রোশনের পুত্র রাজেশ রোশনের সুরেও গান করেছেন লতা। এছাড়াও বাপি লাহিড়ী, রামলক্ষণ, উত্তম সিং, যতীন-ললিত থেকে এ আর রহমান সকলের সুরেই গান গেয়েছেন তিনি। এমনকি তাঁর ভাই হৃদয়নাথের সুরেও বাংলা-হিন্দি-মারাঠি ভাষায় গান রয়েছে লতা। অপরেশ লাহিড়ীর পুত্র বাপি লাহিড়ীর প্রতিভাকে তিনিই প্রথম চিনে নিয়েছিলেন এক নজরে। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ -র ভক্ত লতা ছোট থেকেই। মুম্বাইয়ের ‘প্রভুকুঞ্জ’-এ তাঁর গানের ঘরে দেবী সরস্বতীর মূর্তির সঙ্গে রয়েছে ঠাকুর-স্বামীজীর ছবিও। স্টাইলেও তিনি ছিলেন স্বাতন্ত্র্য। সাজগোজের বাহুল্য নেই। সাদা শাড়ি, উজ্জ্বল পাড়, হালকা হীরের গয়নাতেও অসম্ভব দ্যুতি ছড়ানো একজন মানুষ। জরির পাড়ের অফ হোয়াইট শাড়ি,দু কাঁধের উপর জড়ানো, গোল টিপ, দুই বিনুনি.. পুরো স্পটলাইট তিনিই শুষে নেন। হিরের প্রতি লতার ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা। একবার একটি ডায়মন্ড এক্সপোর্ট কম্পানির হয়ে পাঁচটি হিরের গয়না ডিজাইন করেছিলেন। গানের বাইরে লতার অন্যতম প্রিয় শখ ছিল ফটোগ্রাফি ও ক্রিকেট দেখা। ক্রিকেটের সূত্রেই তাঁর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে রাজ সিং দুঙ্গাপুরের। সেই সখ্যতা ঘনিষ্ঠতায় গড়ায়। কিন্তু সাধারণ পরিবারের মেয়ে লতাকে রাজ পরিবারের বধূ করতে রাজি হয়নি রাজের পরিবার। ফলে সাতপাকে বাঁধা পড়া হয়নি তাঁদের। দুজনেই অবিবাহিত রয়ে যান। কিন্তু তাঁদের বন্ধুত্ব রয়ে যায় আমরণ। লতা মঙ্গেশকর অন্যতম একজন শিল্পী যিনি যথার্থভাবে সরকারি ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন। ১৯৬৯ -এ তিনি পান পদ্মভূষণ। ১৯৮৯-তে পান দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার। ১৯৯৯-তে পদ্মবিভূষণ এবং ২০০১-এ পান ভারতরত্ন। ২০০৭-এ ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সন্মান নাইট অফ দ্য লিজিয়ঁ দ্য’নর পান তিনি। এছাড়াও ১৯৭২ -এ ‘পরিচয়’, ১৯৭৪ -এ ‘কোরা কাগজ’ ও ১৯৯০ -এ ‘লেকিন’ ছবির জন্য পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার। শেষোক্ত ছবিটি( ‘লেকিন’) -র প্রযোজক ছিলেন লতা স্বয়ং। তাঁর গান আজীবন রয়ে যাবে সংগীতপ্রেমী সহ আমজনতার মনের মণিকোঠায়। ২০২২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি, তখন বন্ধনমুক্ত হননি দেবী সরস্বতী প্রতিমা। সেই পঞ্চমী তিথিতেই নবতিপর সংগীতের জীবন্ত সরস্বতী, সুরসম্রাজ্ঞী আসমুদ্রহিমাচলে স্তব্ধ করে সুরোলোকে। যতদিন গান থাকবে ততদিন লতার নামও থেকে যাবে।
নারায়ণ দেবনাথ, আমাদের শৈশব - বিতান দে
বিতান দে
এমন একটা সময়ে আমাদের বেড়ে ওঠা, মোবাইল বিষয়টা আসেনি তখনও। স্কুল, বাড়ি, মাঠে কাটানো বিকেল আর পছন্দের কিছু বইপত্তর। এই সবটুকু নিয়ে একটুকরো শৈশব যাপন এবং একটু একটু করে বড়ো হওয়া। টিভি যদিও এসে গেছে ভরপুর। ছোটোবেলায় কার্টুন-সিনেমা দেখেছি অনেক কিন্তু তার বাইরের পরিধিটাও নেহাত কম। আমি যে সময়ের কথা বলছি, খুব বেশি পিছিয়ে যেতে হবে না। আমার বয়স মাত্র ২৫। কিছুটা পিছোলেই সেই শৈশবের টাটকা স্মৃতি বেশ মনে পড়ে। ছোটোবেলায় কমিক্সের প্রতি আগ্রহ ছিল দেদার। বাবার কলেজ থেকে ফেরার পথে মুখিয়ে থাকতাম; কখনো শুকতারা-আনন্দমেলা বা এক পিস টিনটিন যদি নিয়ে আসে! পছন্দসই বিষয়টি পেয়েও যেতাম সহজেই। অপেক্ষা করার মূল কারণ কমিক্স। হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুল, বাহাদুর বেড়াল, গোয়েন্দা কৌশিক কিংবা নন্টে-ফন্টে। যদিও নন্টে-ফন্টে কিশোর ভারতীতে বেরোতো বলেই মনে পড়ছে। বাকি লেখার প্রতি সবসময় খুব আগ্রহ থাকত এমনটা নয়, কিন্তু এইকটির জন্য ছিল অপরিসীম আহ্লাদ।
এই শৈশবের পরিসরকে অনেকটা বড়ো করে তুলেছিলেন এই মানুষটি, নারায়ণ দেবনাথ। বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টের সঙ্গে যাঁর যাপনপর্ব অবিচ্ছেদ্য। ছোটোবেলায় কমিকস্-কার্টুনের প্রতি আগ্রহ অনেকেরই থাকে। পরবর্তীতে বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ তা কমে যেতে থাকে একটু একটু করে। নারায়ণবাবুর চরিত্রগুলো কখনো একঘেয়ে হয়ে ওঠেনি। বয়স বেড়েছে কিন্তু আগ্রহ কমেনি। অনেকে হয়তো অপরিণত বা ছেলেমানুষি বলে রসিকতা করতে পারেন, কিন্তু নারায়ণ দেবনাথের এই চরিত্রদের কাছে সব বয়স হার মানে। পুরনো বইয়ের তাক খুঁজতে খুঁজতে কখনো কখনো সেইসব অমূল্য রতন খুঁজে পাই। কেবলই শৈশবের ছবিই কি তুলে ধরে নারায়ণবাবুর তুলি? তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি শুধুই কি মজা এবং রসিকতা সৃষ্টির জন্য? একটু ভালো করে খেয়াল করলে বোঝা যায়, কেবল আনন্দ তৈরির কারণে এইসব চরিত্র এবং কমিকসগুলি সৃষ্টি করেননি তিনি। এর ভিতর সমাজ-রাজনীতি-সময়ের চালচিত্র ঢুকে পড়ে অনায়াসেই। আলাদা আলাদা করে কমিকস্ ধরে এই উদাহরণ দেওয়া সম্ভব নয় কিন্তু যাঁরা তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা অনায়াসেই বিষয়টি ধরতে পারবেন। বাহাদুর বেড়াল কি কেবল একটি বিড়ালকে ব্যবহার করে তার উপর মানুষী স্বরারোপ? আমাদের চারপাশে তাকালেই তো আমরা এমন অসংখ্য বাহাদুর বেড়ালদের দেখতে পাব! কিংবা ধরুন পাতিরাম হাতি বা পিসেমশাই চরিত্রদুটিকে। খুব অপিরিচিত লাগে কি? এমনই আরও বহু চরিত্র আছে, খুঁজলেই পাওয়া যাবে।
এর বাইরেও বেশ কিছু কাহিনিতে নারায়ণ দেবনাথ ছবি এঁকেছেন। সেই কাহিনিগুলি হয়ে উঠেছে সার্থক কমিকস্। ব্ল্যাক ডায়মন্ড সিরিজের বেশ কিছু গল্প ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো কিশোর ভারতী-তে। এই কাহিনিটির রচয়িতা দিলীপকুমার চট্টোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র। দিলীপকুমারের অকালপ্রয়াণ এই কাহিনিটিকে খুব বেশিদূর নিয়ে যেতে পারেনি। এই কাহিনিটিকে কমিকসে রূপদান করেন নারায়ণ দেবনাথ। গোয়েন্দা কৌশিক বা ডানপিটে খাঁদু ও তার কেমিক্যাল দাদু-র মতো চরিত্রগুলির পাশাপাশি এই ইন্দ্রজিৎ রায়কে হয়তো অনেকেই জানেন না। এই ব্ল্যাক ডায়মন্ড সিরিজটিকে যাঁরা মনে রেখেছেন, তাঁরাও অনেকেই জানেন এটি নারায়ণ দেবনাথের তৈরি করা চরিত্র। দিলীপকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কথা অনেকেই জানেন না হয়তো। হালফিলে গ্রাফিক নভেল এবং গ্রাফিক থ্রিলার খুবই জনপ্রিয়। ব্ল্যাক ডায়মন্ড সিরিজ অনেকদিন আগেই গ্রাফিক থ্রিলারের শুরুয়াৎ করে দিয়ে গেছে। রহস্যকাহিনিতে উপযুক্ত শব্দ-বিন্যাস, চরিত্রসৃষ্টি এবং টানটান উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনাবিন্যাসকে সম্পূর্ণ করেছেন নারায়ণ দেবনাথ, কাহিনিগুলিকে কমিকসে রূপায়িত করে। ‘তুফান মেলের যাত্রী’ বা ‘রহস্যময় সেই বাড়িটা’-র মতো গল্প আমার নজর কেড়েছিল এবং এখনও যথেষ্ট আলোচনার দাবি রাখে বলে মনে হয়।
নারায়ণ দেবনাথকে অনেকেই অনুকরণের অভিযোগে দায়ী করেছেন। কেউ কেউ অনেক তথ্য-প্রমাণ এবং ছবির পাতা, বিষয়কে তুলে ধরে দেখানোর চেষ্টা করেছেন তিনি কতটা নকল করেছেন সেইসমস্ত পাশ্চাত্যের কার্টুন থেকে। সেই বিতর্কের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে আমার লেখা নয়। কয়েকটি প্রসঙ্গ এক্ষেত্রে জানাব কেবল। অনুসরণ এবং অনুকরণ এক বিষয় নয়। পৃথিবীতে যুগে যুগে, সময়ে সময়ে যাঁরা কেবল নকলনবিশ হয়ে থেকেছেন, তাঁদের মনে রেখেছেন কতজন? দেশ-দেশান্তরে সুর-তাল-লয়-ছন্দ কাহিনির অনুসরণ কি কম হয়েছে? অনুসরণের এই তালিকায় পৃথিবীর তাবড় ব্যক্তিরা রয়েছেন। দেশে দেশে লোকগাথার বিভিন্ন কাহিনি, ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মুখে। সংরক্ষিত হয়েছে মৌখিক পরম্পরায়। সেখানেও বিভিন্ন দেশের কাহিনির ভিতর রয়েছে কত মিল। সবক্ষেত্রেই কি তবে অনুকরণের অভিযোগ আনা যায়? কোনো কাহিনির গড়ে ওঠার পিছনে সেখানকার জল-হাওয়া-পরিবেশের বিশেষ ভূমিকা থাকে। হুবহু অনুকরণ করে কেউ সাহিত্যজগতে দীর্ঘস্থায়ী জায়গা অর্জন করতে পারেন কি? এই প্রশ্নটা থেকেই যায়। নারায়ণ দেবনাথের সৃষ্টির ভিতর সেই জল-হাওয়া পরিবেশের প্রভাব রয়েছে। অনুকরণ এবং অনুসরণের মধ্যেকার সূক্ষ্ম তফাতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে এক্ষেত্রে।
নারায়ণ দেবনাথ আমাদের শৈশবকে নির্মাণ করেছেন। শৈশব পেরিয়ে কৈশোর এমনকী যৌবনেও তাঁর প্রভাব মিলিয়ে যায়নি। সুযোগ পেলে এখনও চোখ যায় হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুলের পাতায়। তাকে নিয়ে অসংখ্য মানুষের আবেগ-অনুভূতি জড়িয়ে আছে। তিনি চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে এই সংকটকালে। বয়স একটা সময়পর্বে এসে স্থির হয়, কেবল বেঁচে থাকে সৃষ্টিরা। তাঁর চরিত্ররা বেঁচে থাকুক। এই স্মার্ট যুগের শৈশব কতটা শুকতারা-র পাতা ওল্টায় জানা নেই। কৈশোর থেকে যৌবন অতিক্রান্ত হয়ে যায় কখন। বাহাদুর বেড়ালদের আর কী মনে রাখবে কেউ? উত্তরোত্তর প্রজন্মের পর প্রজন্ম আধুনিক হবে। নন্টে-ফন্টেরা কি সেই আধুনিকতার ছোঁয়ায় হয়ে যাবে সেকেলে? নারায়ণ দেবনাথের মতো তারাও কি হারিয়ে যাবে কোনোদিন? মনে রাখার কতটুকুই বা দায় আছে আমাদের, কতটুকু দায়ই বা ছিল?
'ভারতীয় নৃত্যের বিশ্ব পরিচিতি ও বিরজু মহারাজ' এই নিয়ে কথা পাড়লেন - পল্লবী বন্দ্যোপাধ্যায়
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2022/03/IMG-20220204-WA0003-518x1024.jpg)
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2022/03/Pandit_Birju_Maharaj-200x300.jpg)
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2022/03/Birju_Maharaj_c-300x169.jpeg)
![](https://bhaankolkata.com/wp-content/uploads/2022/03/1642383859-2478-300x225.jpg)
নাট্য নিয়ন্ত্রণের আগে পিছে বাংলার বুদ্ধিজীবী নিয়ে, ভাবালেন - ( ২ য় পর্ব)ময়ূরী মিত্র
ময়ূরী মিত্র
নাট্য- নিয়ন্ত্রণের আগে পিছে বাংলার বুদ্ধিজীবী
চদর-বদর: এক বিলুপ্তপ্রায় সাঁওতালি পুতুল নাচের সঙ্গে আলাপ করালেন - পম্পা হেমব্রম
পম্পা হেমব্রম
“চদর-বদর;এক বিলুপ্তপ্রায় সাঁওতালী পুতুলনাচ “
মনে আছে, বেশ ছোটবেলায় আমার গ্রামের রাস্তায় রং-বেরঙের কাঠের পুতুলদের নিয়ে পুতুলনাচের খেলা দেখাতে আসতেন একজন।তবে সবসময় নয়;বছরে হয়তো এক-আধবার দেখা মিলতো তাঁর। তিনচাকার ঠেলাগাড়ির ওপরে একটি চৌকো বাক্সের ওপরে পুতুলগুলো থাকতো।সেই বাক্সটি রঙিন ঝালর দিয়ে আচ্ছাদিত।পুতুলগুলো ছিল অনেকটা মানুষের মতো,কিন্তু মানুষ নয় অথচ তাদের হাত- পা-মাথা নড়ে,পুরুষ পুতুলগুলো আবার বাজনাও বাজায়।এই পুতুলগুলো বেশিরভাগ আদিবাসী তথা সাঁওতালী পোশাক আশাকে সজ্জিত, চেহারাও আদিবাসীদের মতোই।পুরো পুতুল নাচটির নিয়ন্ত্রণকারীও হতেন একজনই।পুতুলদের দেহের বিভিন্ন অংশের সাথে লাগানো সুতোতে টান দিলেই পুতুলগুলো নাচ করতো।শিল্পী নিজে অনেকসময় খালি গলায় গাইতেন অথবা রেকর্ডের গান বাজিয়ে তাতে সঙ্গত করতেন।বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গানের ভাষা হতো সাঁওতালী অথবা প্রচলিত বাংলা গান।
পরবর্তীকালে পুতুলনাচের পসরা নিয়ে আসতে আর কাউকে দেখি নি।মাঝে মাঝে মনে পড়লেও সময়ের সাথে সে শৈশবস্মৃতি ফিকে হতে সময় লাগে নি।পুতুল নিয়ে খেলা করেনি এমন শৈশব পাওয়া দুষ্কর।
পুতুলের প্রতি শিশুদের এ এক আদিম আসক্তি।যদিও আমাদের দেশের সমাজ–মানসিকতা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে মেয়ে–শিশুদেরকেই পুতুলখেলা,রান্নাবাটি ইত্যাদি তথাকথিত মেয়েলী খেলাধূলা নিয়ে অভ্যস্ত করানো হয়।
এই পুতুল নিয়ে অবসেশন্ ধনী থেকে দরিদ্র সমাজের সর্বস্তরের শিশুদের মধ্যেই থাকে।গ্রামবাংলাতে পুতুল শুধুমাত্র শিশুদের খেলাধূলার জন্য নয়,গৃহসজ্জার জন্য,তন্ত্র–মন্ত্রের জন্য এছাড়া পূজা–আচ্চাতেও ব্যবহার করা হয়।বিশেষ করে গরামথানে,আদিবাসীদের থানে মাটির তৈরী হাতি,ঘোড়া দেখা যায়।
বাংলার আনাচে কানাচে নানারকম পুতুলের সম্ভার দেখতে পাওয়া যায়।মাটির পুতুল,কাগজের পুতুল,গালার পুতুল,কাঠের পুতুল,শোলার পুতুল,কাপড়ের পুতুল,ডোকরার পুতুল ইত্যাদি জনপ্রিয়।
পুতুল নিয়ে পুতুলখেলা/পাপেট শো বেশ প্রচলিত গ্রামীণ বাংলায়।পৌরাণিক,সামাজিক,ধর্মীয়,রাজনৈতিক বা প্রচলিত কোনো বিষয় তাদের পালার বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচিত।
এই পুতুলনাচের থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র হলো আদিবাসী পুতুলনাচ।যদিও বতর্মানে পশ্চিমবঙ্গ,বিহার উড়িষ্যার নির্দিষ্ট কিছুস্থানে এই শিল্প টিমটিম করে টিকে আছে এখনও।
সরকারী সাহায্য, জনপ্রিয়তার অভাব,অন্য সংস্কৃতির সর্বগ্রাসী অস্তিত্বে এই শিল্প ও শিল্পী,দুই–ই ধুঁকছে।অথচ এটি প্রাচীন ভারতের এক আদি ঐতিহ্য।একসময় এটি আদিবাসী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল।
আদিবাসীদের নিজস্ব কারিগরিবিদ্যার আশ্চর্য নিদর্শনও বলা যায় একে।বাঁশের তেপায়া স্ট্যান্ডের নিচে চারদিক ঢাকা থাকে রঙিন কাপড়ের আচ্ছাদনে।সেই ঢাকা অংশেই থাকে পুতুলনাচের প্রাণ।চৌকো বা গোল মঞ্চে নারী–পুরুষ নির্বিশেষে সারি সারি পুতুল মুখোমুখি অবস্থায় দাঁড় করানো থাকে।পুরুষেরা খাটো ধুতি পরে ধামসা মাদল হাতে নিয়ে,আর নারীপুতুলদের আদিবাসী নারীদের মতো শাড়ী পরানো থাকে।ঠিক নাচের ভঙ্গিতে নারীরা একে অপরের হাত ধরা অবস্থায় থাকে।
পুতুলগুলো দেখতে মজাদার হলেও যথেষ্ট দক্ষতা না থাকলে এগুলো বানানো সম্ভব নয়।পুতুলগুলি তৈরী হয় কাঠ দিয়ে।কাঠের অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ গুলি একধরণের শক্ত সুতো বা তারের সাহায্যে সংযুক্ত থাকে মূল কাঠের লিভারের সাথে,যা শিল্পী অসীম নৈপুণ্যে কাঠের লিভারটি টানলেই পুতুলগুলো নাচ ও বাদ্য বাজানো শুরু করে দেয়,আর শিল্পীও গান গাইতে গাইতে পুতুল গুলোর সাথে নানা অঙ্গভঙ্গী করেন।যুগের সাথে তাল মিলিয়ে গানের ভাষা সাঁওতালীর সীমানা অতিক্রম করে হিন্দি বা বাংলা গানকেও আত্তীকরণ করে নিয়েছে।কখনওবা গানের বিষয়বস্তু হিসেবে আদিরসাত্মক–কথা আকার ইঙ্গিতে বয়নিত হয়।
শিল্পীর হাতের জাদুতে জীবন্ত পুতুলগুলো আদিবাসী সমাজ,সংস্কৃতি,ধর্মীয় ও জীবন ইত্যাদির ধারক ও বাহক হয়ে ওঠে।শিল্পী তার চোখে দেখা জীবনকে দেখান কাঠের পুতুলে প্রাণদান করে।
শিশু থেকে পূর্ণবয়স্ক নারী–পুরুষ,বৃদ্ধ–বৃদ্ধা,সবধরণের পুতুল থাকতে পারে।পুতুলগুলোর দৈর্ঘ্য পাঁচ থেকে দশ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে।শিল্পী সামাজিক,ধর্মীয়,সমাজসেবামূলক,শিক্ষামূলক নানা পালাগান দেখান।সাঁওতাল তথা আদিবাসীদের নিজস্ব নানা রীতিনীতি,কারামবিন্তি,সৃষ্টিতত্ত্বের কাহিনী পুতুলনাচের মূল উপজীব্য বিষয়।কথিত যে,হুল বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহ–প্রসারণে পুতুলনাচ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।পুতুলনাচের শিল্পীরা আসলে অনেকটা চারন–কবিদের মতো।বাড়ী থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বেরিয়ে স্থান থেকে স্থানান্তরে যান শিল্পের পসরা নিয়ে।শুধুমাত্র নিজের ও পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনই তাদের মূল লক্ষ্য নয়।আদিবাসী সংস্কৃতির প্রসার ও প্রচার তারা তাদের শিল্পের মাধ্যমে করেন। যদিও এই স্বতন্ত্র শিল্পধারা ও এই শিল্পের শিল্পীরা ক্রমশ কোণঠাসা হতে হতে ক্রম–বিলুপ্তির পথে।
সরকারী সাহায্যও অপ্রতুল।যেটুকু সাহায্য মেলে তাতে ফরমায়েশী গান গাইতে হয়।শিল্পীর নিজ–প্রতিভা বিকাশের সেরকম সুযোগ তাতে নেই।সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর নিজস্ব এই পুতুলনাচ টি “চদরবদর” বা “চাদরবাঁধনি” নামে পরিচিত।কয়েকদিন আগে বঙ্গসংস্কৃতি তে উত্তাল ঝড় উঠেছিল “চুদুর–বুদুর” শব্দের জন্য,কারণ শব্দটি নাকি অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট।কিন্তু ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের মতে শব্দটি মোটেই অশ্লীল নয়,এটি অনার্যসম্ভূত শব্দ মাত্র এবং শব্দটির সাথে অশ্লীলতার কোনো সম্পর্ক নেই।
“চদরবদর” এর শিল্পীরা বেশিরভাগ মালদা,মুর্শিদাবাদ,বীরভূম,বাঁকুড়া,দিনাজপুর,,মানভূম,সিংভূম, ইত্যাদি অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছেন প্রায় হারিয়ে যাওয়া শিল্পের পসরা নিয়ে।এইরকম একজন শিল্পী হলেন ডমন মুর্মু।উত্তর দিনাজপুরের ইটাহারের বাসিন্দা ডমন মুর্মু,পেশায় কৃষক হলেও উনি পরবের সময় বা মেলার সময় বেরিয়ে পড়েন তাঁর “কাঠ–বানাম” “চদর–বদর”পুতুল নিয়ে। নিজে গান বাঁধেন,সুর দেন তাতে।সারাবছরের খাটনির মধ্যে এই পুতুলনাচ টি তাকে মুক্তির স্বাদ এনে দেয়। তাঁর মায়াবী কন্ঠস্বরে মুগ্ধ হননি এমন মানুষ কমই আছেন।
গান–
“হাটে হাটে বেড়াইলম
গুটা হাটে বেড়াইলম
মনের মতন মালা পাইলাম না।
এহকডা কালো ছঁডা
বেল মালা দিল রে
মন গেল গুটা বাজারে।
ছোট ছোট পুখুরি
পানা কেন হেলায় রে
পানার ওপর কুমীর সিঁদাইছে।
পিতাড়ি পিতাড়ি শাক আমার বন্ধু খায় না ভাত,
কুথায় পাব জিওল মাগুর মাছ
হায় রে!
কুথায় পাব জিওল মাগুর মাছ।“
পম্পা হেম্ব্রম
অধ্যাপক
ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজ (মহিলা বিভাগ )