চতুর্বিংশতম সংখ্যা, সপ্তদশ ই-সংস্করণ, এপ্রিল, ২০২২

ভাণ পত্রিকা

চতুর্বিংশতম সংখ্যা, সপ্তদশ ই-সংস্করণ, এপ্রিল, ২০২২

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

পার্থ হালদার

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) [email protected] ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সূচি

সম্পাদকের কথা

সত্যজিৎ বলেছিলেন যত কান্ড কাঠমান্ডুতে। কিন্তু কলকাতাবাসী বুঝছে অতদূর আর যেতে হবে না। নানা কান্ড এখন কলকাতাতেই। বীভৎস সব কান্ডের বধ্যভূমি আমাদের এই বঙ্গ দেশ। যেখানে দিনের আলোয় মানুষের ধড়-মুন্ড আলাদা করা যাচ্ছে।  বাইকে বসে থাকা জনপ্রতিনিধির মাথায় টকাস করে গুলি গুঁজে দৌড়ে ছুটে পালানো‌ যাচ্ছে। এরা সব  রাজনীতিকদের প্রিয় পোষ্যের দল। জনগণ যাদের দুষ্কৃতী নামে চেনে। পুলিশ মাঝরাতে হামলা করছে। ছাত্রনেতার রক্তাক্ত শরীর রাজপথে। মাছিরা ফিরে আসছে। বোর্ড গড়তে কাউন্সিলর কম পড়লে বিরোধী গোষ্ঠীর কাউন্সিলর কে খুন করে তকত রাখা যাচ্ছে। একই দলের দুই উন্মত্ত গোষ্ঠীর দৌরাত্মে রামপুরেই  লঙ্কাকাণ্ড বাঁধানো যাচ্ছে। থানার হস্তক্ষেপে নাকি  রঙ বদলও ঘটছে। আমি নেতা কেন হব না!?- এই দাবি তে  রাস্তা অবরুদ্ধ করা যাচ্ছে। আর চাষীর ডাকা হকের দাবির হরতাল  ভাঙতে সর্বশক্তি প্রযুক্ত হচ্ছে।ঘরে আগুন দিয়ে বাইরে তালা দেওয়া যাচ্ছে। আর সেই তালার কী ম্যাজিক , কানে তালা ধরাচ্ছে তথাকথিত বিদ্বজ্জনের।
নিষ্ঠুরতা অমানবিকতার বাহারি উদযাপন এখন নিত্যদিনের ঘটনা ( মোটেও রটনা নয়) ।   অতঃপর” তাঁরা” “কাজ”এ ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। লজ্জার মাথা খেয়ে  কখনও বা ক্ষীণতর স্বরে মিনমিনাচ্ছেন।।  এ যে ভারী ফ্যাসাদ হল। যেন আরেকটু ধামাচাপা থাকলে পরিস্থিতি, এরকম বেকায়দায় পড়তে হতো না। এই যাকে অন্য মার্গের বামপন্থা ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছি তার এহেন রূপ দেখে এখন তেনাদের মুখোশের ফুটো প্রসারিত হচ্ছে।
 
পড়শীর ঝগড়াতে আক্রমনাত্মক পড়শী যেমন করে শোনায়, ” তুই নিজে কি? তুই যে এত কথা কইছিস!??”.. একথা এখন বুদ্ধিজীবীদের দিকে ঘুরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। বলতে ইচ্ছে করে এতো লালসা নিয়ে লম্পট হওয়া যায়, বুদ্ধিজীবী নয়। আজ অনেকটা চেঁচালেও ওদের মিনমিনে লাগবে।  শঙ্খ ঘোষ পরবর্তী জামানায় এটা একটা সত্যিকারের সংকট  বটে। নন্দীগ্রাম সিঙ্গুর এ যারা সঙ্গতভাবে শিরা ফুলিয়ে ছিলেন, তারা কী অসঙ্গতভাবে চুপ মেরে গেলেন,  দেখলে হাসি পায়। বমিও।  ক্ষমতাতন্ত্র নিয়ে চারটি কোটেশন সহ গরম গরম বাচনের নাম যে বুদ্ধিজীবিতা নয়, একথা ক্রমশ হাড়ে মাংসে টের পেতে শুরু করেছেন   তেনারা। গন্ডারের চামড়ার কিছু স্বঘোষিত বিদ্বজ্জনের অবশ্য সে সঙ্কটটুকুও নেই! তারা পূর্বের মতো উলঙ্গ হয়ে সভ্যতার ঠিক বেঠিক এর রাস্তা বাতলাচ্ছেন। আগামিতেও বলবেন।যতক্ষণ দেহে আছে প্রান, ততাবধি হৃদয়ে শয়তান। সত্যের জন্য ব্যক্তিগত   সুখ কে যারা কোনো মূল্যে ছাড়তে রাজি নন, “আমি” পুজোর সাময়িক বিরতিও যাদের নাপসন্দ,   তাদের পক্ষে বড্ড  মুশকিল এ ঝক্কি পোহানো।সে কথা আর কতভাবে প্রমাণ হবে?
এরপরেও  আনন্দ জাত, এবিপি ভজা, জি এ গজা, পেজথ্রি প্রার্থী,…. বহুল প্রচারিত অগ্রগামী বাঁদরামি ছাড়িয়ে , আশার কথা ; অনেক অখ্যাত  কিন্তু হৃদয়বান বুদ্ধিমান প্রজ্ঞাবান মানুষ আছেন এদেশে। তাদের জোট দরকার নেই। ওটা ভোটের জন্য তোলা থাক। একটা যোগাযোগ চাই। পুণ্যতোয়া ক্রোধ গুলো বিকশিত হবে তাতে। পবিত্র ক্রোধের বড় দরকার আজ। যা মক্কা মদিনা গীর্জা কেদারনাথে নেই। তার উৎসস্থল সৎ যাপন। সেই ক্রোধে পুড়ে যাক ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা। আমাদের এইমাত্র কামনা। 

বি-থিয়েটার: একটি স্বপ্নের পুনর্জন্ম, সাক্ষী থাকলো ভাণ

বি- থিয়েটার: একটি স্বপ্নের পুনর্জন্ম।।সাক্ষী থাকল ভাণ….

বিনোদিনী কি কেবল নিজের যশ চেয়েছিলেন? তার মধ্যে কি অগুনতি বিনোদিনীরা ছিলেন না? ছিলেন না কি স্মৃতি ও ভবিষ্যতের বিনোদিনীরা? তাঁর মতো ইতিহাস তৈরি করা মহানটীর নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে একটা নাট্যমঞ্চের নাম হওয়া কি অত্যন্ত অস্বাভাবিক হতো? তবু সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বি থিয়েটার স্থাপিত হয় নি।স্টার থিয়েটার তৈরি হয়েছে তার বদলে। এক যুগ অভিনয়ে ইতিহাস তৈরি করে স্বেচ্ছানির্বাসনে গেছেন বিনোদিনী। একেবারে অন্যধারার ভিন্ন উচ্চারণের কবি হয়েও ” বঙ্গের মহিলা কবি” নামের বইতেও তিনি উচ্চারিত হননি। তারপর গঙ্গা দিয়ে গড়িয়েছে অনেক জল।

কলকাতার বাতাস দূষণে দূষণে ক্রমশ আরো ভারী হয়েছে। এখনো অপূর্ণ আছে একটা ইচ্ছে। উত্তর কলকাতার গলিঘুঁজিতে কান পাতলে শোনা যায় সেই স্বপ্নভঙ্গের হাহাকার। ঊনবিংশ শেষার্ধে একটি স্বপ্নকে হত্যা করেছিল পুরুষতন্ত্র। এখনো তথাকথিত নারীমুক্তির গমগমে বাজারে নারীকে পরীক্ষা দিতে দিতে সন্তর্পণে পা ফেলতে হয়। পলকা কাঁচের মতো এখনো ভাঙছে নারীর ইচ্ছে, নারীর স্বপ্ন। শিল্প সমাজ নাকি সংবেদে টানটান। অথচ আজকের শিল্পজগতেও পুরনো খেলার অনুবর্তন। আপাত স্বীকৃতির আড়ালে তাচ্ছিল্য, গ্রহণ এর নামে সূর্য গ্রহণের আঁধার।! ইতিহাসে তাঁকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। অন্তরালে আটকে রাখার চক্রান্ত করেছিল পুরুষালি ইতিহাস। হয়তো সে জন্যেই এত বেশি বেশি করে আমাদের হৃদয় সতত বিনোদিনীর পানে ধায়। নইলে সুচরিতা অলোকপর্ণারা তাঁকে খুঁজে বেড়াবেন কেন? কেন সেই উদ্যোগে আনন্দে যুতে যাবেন কল্পনা, ঋতুপর্ণা কিংবা সোমা। এই পাঁচ নাট্যশিল্পীর নিজের নিজের দল আছে । অভিনয় করছেন কয়েক দশক জুড়ে । তবু কিসের টানে এরা জোট বাঁধলেন! কীভাবে এতকাল পরেও শিল্পী নারীর জোটের সামান্য ধর্ম হয়ে উঠে এলেন অসামান্য সেই বিনোদিনী! অভিনেত্রী জীবনের বঞ্চনা প্রতারণার আর্কিটাইপ হয়ে কীভাবে বাঙালির সত্তায় জ্যান্ত থাকেন উনিশ শতকের বঙ্গরঙ্গ মঞ্চের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসী… সুচরিতা ঋতুপর্ণা কল্পনা সরাসরি থিয়েটারের মানুষ। অনেককাল ধরে তাদের মঞ্চে ঘরবাড়ি। অলোকপর্ণা নৃত্যশিল্পী, নৃত্য ও নাট্য এর বন্ধুতা নিয়ে তিনি ও তাঁর দল মঞ্চাভিনয়ে ক্রমশ দক্ষ হয়ে উঠছে। তবে সে অভিনয়ে লেগে থাকছে নৃত্যরস। নাট্যনৃত্যের যৌথ রসের ভিয়ানে তার স্বাদ স্বতন্ত্র। অন্যদিকে সোমা দাস মূলত মূকাভিনয় শিল্পী, কিন্তু বড় অর্থে এরা প্রত্যেকেই মাচার মানুষ। একালের অভিনেত্রী। আরো বড় অর্থে এই পঞ্চ নারীর বেদনার গভীরে একটা চেনা সিম্ফনি, এরা নারী এবং এরা মঞ্চের নারী। নিজের প্রতি অভিমান অনুরাগের অনেকাংশ মিশে যায় মঞ্চের প্রতি প্রেম বিরহের যাতায়াতে। তাই এরা অকাতরে দাবি করলেন ওরা একালের বিনোদিনী। আমরা ভাবতে বসলাম। একালের বিনোদিনীদের যন্ত্রণা কি ঠিক উনিশ শতকের ছাঁচে ঢালা।? ওরা বললেন ঠিক তেমনটা নয়। আকাশ একটা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মুক্তি আসন্ন। তবু সে আকাশ এবং আমির মধ্যে একটা কাচের ছাদ।সেই ছাদ ভেঙে গুঁড়িয়ে রক্তাক্ত হতে না পারলে আকাশের নীল অধরা থেকে যাবে। আলোয় আলোয় মুক্তিকে পাওয়া অসম্ভব হবে। সেই স্বপ্ন কে সাকার করতেই ” বি থিয়েটার” ঠিক মধ্যিখানে মঞ্চ আলো করে বসে আছেন খ্যাতনামা অভিনেত্রী ছন্দা চট্টোপাধ্যায়। আলো চলকে পড়েছে মঞ্চের আরো পাঁচটি স্থানে। সেখানে দাঁড়িয়ে একালের পাঁচ বিনোদিনী। কথা ভেসে আসে এক প্রান্ত থেকে। বোঝা যায় শুরুটা করলেন ঋতুপর্ণা।’হাওড়া আমতা’ তার দল।তারপর একে একে সব্বাই বললেন অল্প অল্প। ছন্দা চট্টোপাধ্যায় কে নিয়ে। কেননা এই গুণী শিল্পী কে সম্মাননা দিয়ে শুরু হবে বি- থিয়েটারের অভিযাত্রা। স্বপ্নের কথায় কথামুখ শেষ হলে কথা শুরু করলেন ছন্দা দি। বড় সহজ-সরল অথচ গভীর প্রণোদনায় অনেকটা সময় চলল অতীত উদযাপন। গুরু উৎপল দত্তের কথা, টিনের তলোয়ার এর ময়নার কথা, আরো কত কি… পৌঁছানোর কথা ছিল চিত্রা সেনের। কোনো কারণে এসে উঠতে পারেননি তিনি। তবু ছন্দা দি কে ঘিরে একালের পঞ্চ নটীর প্রতিটি বাক্য, শপথ হয়ে আছড়ে পড়ছিল দর্শকের চৈতন্যে। একে একে অভিনীত হলো চার চারটি প্রযোজনা। কল্পনা থিয়েটার ফর কজ এর “গান্ধারী”। থিয়েটার পুষ্পক এর নাটক ” অভিমান”। মাচার মানুষ এর প্রযোজনা ” না-আমি”। এবং সবশেষে সোমা মাইম থিয়েটারের মূকাভিনয় ” উত্তরা-রা” পৃথক চারটি প্রযোজনায় কল্পনা আচ্ছন্ন করলেন দর্শকদের, অলোকপর্ণা দেখালেন অভিমানের চোখ ও শরীরের ভাষা। সোমার মাইম সহজ করে তুলল দরকারি কিছু বিবেচনা। এরা বিষয় হিসেবে বাছলেন প্রিয় পুরানচরিত। একমাত্র সুচরিতার মনোলগে বিনোদিনী বিবিধ রূপে ধরা দিলেন। তবু সবকটি প্রযোজনার অন্তর্লীন সিম্ফনি জানাল কেন এটা বি-থিয়েটার। মনে হল এ চলা যেন না থামে। পাঁচে পাঁচে পঁচিশ হোক বিনোদের দল। বলার এই, কেবল নারী পুরুষের বাইনারি নয়, তাকে ভেঙে, কখনো ডিঙিয়ে কিংবা পাশ কাটিয়ে আসুন আরও গভীর কোনো সংলাপে ডুব দিই আমরা। আরোও সূক্ষতর কোনো আত্মদর্শন ঘটুক আমাদের। সে দৃষ্টির তরাসে গলে যাক সীসার ছাদ। বিনোদিনীরা পাখি হোক।।

নাট্য নিয়ন্ত্রণ এর আগে পিছে বাংলার বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ভাবালেন (৩ য় পর্ব ) - ময়ূরী মিত্র

ময়ূরী মিত্র
 
ঠিক তখন 
 
জাতীয়তাবাদের এই নির্ণায়ক মুহূর্তে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা ক্রমশ বুঝছিলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদ উজ্জীবনে সমাজ হিতৈষণা ও সামাজিক সাম্য অতি আবশ্যিক শর্ত ৷ আমরা দেখি -১৮৭০ থেকেই বাঙালি ভদ্রলোকদের সঙ্গে বিলাতের সমাজসংস্কারকদের শ্রমিক সমস্যা নিয়ে চিঠিপত্র আদানপ্রদান হতে থাকে ৷ ১৮৭১ এ কেশবচন্দ্র সেনের শিষ্য শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায় বিলাতে মেরি কার্পেন্টারের আমন্ত্রণ পেয়ে তাঁকে একটি চিঠিতে ইংল্যান্ডের শ্রমিকদের জীবনযাত্রা ও সেখানকার শ্রমিক সংগঠন সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেন ,যাতে তিনি দেশে ফিরে ভারতবর্ষের শ্রমিককল্যাণ সাধনে এগোতে পারেন ৷ সন্দেহ নেই , বাঙালি ভদ্রলোক সমাজের মুলস্রোতের বাইরে থাকা অন্তজ মানুষের পিছুটানে ফিরে দাঁড়াচ্ছিলেন ৷ Albion Rajkumar Banerji ‘An Indian Pathfinder ‘ বইয়ে লিখছেন —
Hardly any native and certainly no Europeans could hope to wield the same influence over the poorest classes as that exercised by a man of Mr Sasipada Banarji’s position .A despised outcast feels himself fully honoured when a Brahmin in the teeth of old tradition and time -honoured custom not only enters his poor hut , but actually eats with him and chats with him as a man and brother. 
               গল্পটা শুধু শশিপদ ব্যানার্জির ছিল না ৷ সরাসরি অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের কথা না বললেও সেসময়কার অনেক বুদ্ধিজীবীই কিন্তু মানুষের সাধ্যের মধ্যে যতদূর অর্থনৈতিক সুরাহা আনা যায় তার পক্ষে রায় দিতে শুরু করেছিলেন এবং এইসময় থেকেই আমরা দেখছি -বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত পরিচালিত সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্ৰগুলো কৃষকবিক্ষোভের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছে ৷পাবনা সিরাজগঞ্জের কৃষকবিক্ষোভের সময় ১৯ .৯.১৮৭৩ এ এডুকেশন গেজেটে একটি প্রতিবেদন বের হয় –যার থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল জমিদার কৃষকের বিবাদে কলকাতার ভদ্রলোকেরা এবার কৃষকদের পক্ষে ৷ অর্থাৎ সিপাহি বিদ্রোহের সময়কার বাঙালির মনোভাব আমূল না হলেও অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে বিশেষ করে প্রশাসক ও শাসিতের পারস্পরিক সম্পর্কের মূল্যায়ন করার ব্যাপারে ৷
             এই পাবনা -সিরাজগঞ্জের বিক্ষোভ নিয়ে মীর মশাররাফ হোসেন লিখলেন জমিদার দর্পণ ৷ যদিও নাটকটির কোথাও প্রকাশ্য ইংরেজবিরোধিতা নেই কিন্তু জমিদারি ব্যবস্থাকে সরাসরি আক্রমণ আছে ৷ কোন জমিদারি ব্যবস্থা ? সেই ব্যবস্থা -যা ছিল ব্রিটিশের বানানো ভূমিব্যাবস্থার ফলাফল ৷ দেখা যাক –এই নাটককার এইসময় আর কী কী ধরণের লেখা লিখছেন ! কাঙ্গাল হরিনাথ প্রকাশিত গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন মশাররাফ , যে হরিনাথ তাঁর আত্মজীবনীতে বলছেন —
সাধ্য ততদূর না থাকুক, প্রজার প্রতি নীলকরের অত্যাচার যাহাতে নিবারিত হয়,তাহার উপায় চিন্তনকরণ …আমার নিত্যব্রত ছিল ৷
সারাজীবন ধরে নিলবিদ্রোহ সম্পর্কে প্রচুর নোট সংগ্রহ করেছিলেন মশাররাফ ৷ ইতিহাস লেখার ইচ্ছে ছিল তাঁর ৷ পারেননি ৷ শেষজীবনে এইসব সংগৃহীত নোট জলধর সেনকে দিতে চেয়েছিলেন ৷অন্তত এমনটাই আছে জলধর সেনের লেখায় ৷
           বোঝা যাচ্ছে বাঙালি ভদ্রলোকরা ইংরেজ বিরোধিতায় সবাই সমান সক্ষম না হলেও তৎকালীন আর্থ – রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াকে এড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না কেউই ৷ এড়িয়ে থাকতে পারছিলেনও না ৷ তাই ব্রিটিশ ভারতের অর্থনীতির গোপন প্রতারণাগুলোই প্রথম উন্মোচিত হতে লাগল বাঙালির নাটকে ৷ ১৮৭৫ – দক্ষিণাচরণ চট্টপাধ্যায় লিখলেন চা-কর দর্পণ ৷ শ্রমিক -শোষণ নিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীর এটি প্রথম রাজনৈতিক নাটক ৷ রাজনৈতিক এইকারণে – সরাসরি উপনিবেশ বিরোধিতা না থাকলেও নাটকটি তুমুল রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল ঔপনিবেশিক মহলে ৷ চা -কর সাহেবরা কীভাবে প্রশাসন ,আইন ,বিচারপদ্ধতিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে যাচ্ছিল তার বেশ কিছু আবশ্যিক তথ্য দেওয়া হয়েছিল নাটকটিতে ৷
     পরবর্তীকালে সঞ্জীবনী পত্রিকায় দুটি মামলার কথা প্রকাশিত হয়েছিল -১.ওয়েব সাহেবের হাতে শুকরমণি হত্যার মামলা ২. উমেশ হত্যার মামলা ৷ দুটোর সঙ্গেই চা -কর দর্পণে বর্ণিত তথ্য ও কাহিনির মিল পাওয়া যায় ৷ আশ্চর্য সব মিল ৷ দুটো ক্ষেত্রেই ছিল প্রশাসনিক মদতে পোস্টমর্টেম ও ডাক্তারি সার্টিফিকেটের কারচুপি ৷ কৃষ্ণকুমার মিত্র , দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ,কালীশঙ্কর সুকুল ও হেরম্বচন্দ্র মৈত্র এই মামলা সংক্রান্ত যে মুদ্রিত স্মারকলিপি পার্লামেন্টের সদস্য উইলিয়াম স্কায়োন ব্লাউন্ট মারফত পার্লামেন্টে পেশ করেন ,তার শিরোনামই ছিল -Justice Murdered in India .
                সরকারি লেখ্যাগারে প্রাপ্ত তথ্য ( বিচারবিভাগ , ১৮৭৬,ফাইল নম্বর -৪৬ ) জানাচ্ছে – ৯ আগস্ট ,১৮৭৫ -এর একটি চিঠিতে স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে স্টেট সেক্রেটারিকে জানানো হয় —
A few months ago our attention was directed to a native play ,called ‘Cha -Kar -Darpan ‘ or the ‘Mirror of Planting ‘ which had been published in Calcutta .This work contains a scandalous libel on the tea planters in Assam and if represented on the stage , would be calculated to exite feelings of personal hostility against them…. Although we are informed by the Lt.Governor of Bengal that this performance has not attracted any particular attention,it is obvious that at a time of political excitement , representations of this class might give rise of serious consequences .
বোঝা যাচ্ছে চা -কর দর্পণ তখনও অভিনীত হয়নি ৷ কিন্তু তদানীন্তন ল মেম্বার হবহাউস এইসব গোপন রিপোর্ট থেকে জানতে পেরেছেন -এই নাটকে এমন কিছু আছে যা ব্রিটিশ 
শিল্পপুঁজির একটি মুনাফাজনক বিনিয়োগ ক্ষেত্রকে অচিরেই রুদ্ধ করে দেবে –ঠিক যেমন করেছিল নীলদর্পণ নীলবাণিজ্যের ক্ষেত্রে ৷
              ১৮৭৪ -১৮৭৫ ৷ পজিটিভিস্ট কোঁৎ -এর ভক্ত এবং ইন্ডিয়ান রাডিক্যাল লীগের সভাপতি উপেন্দ্রনাথ দাস লিখলেন শরৎ -সরোজিনী ও সুরেন্দ্র -বিনোদিনী ৷ নাটকদুটিতে আমরা পেলাম এক ঝাঁক শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ভদ্রলোককে -যাঁরা স্পর্ধিত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ ,দর্শন ও প্রজ্ঞা দিয়ে পরখ করে নিচ্ছে চারপাশটাকে ৷ প্রথমবার নাটক হয়ে উঠল মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক প্রতিবাদের বাহন ৷ কারণ এর আগে প্রতিবাদ যা কিছু এসেছে গ্রামীন সমাজের প্রান্তীয় মানুষদের কাছ থেকে ৷ সুরেন্দ্র -বিনোদিনীতে একের পর এক সমালোচিত হল উচ্চশিক্ষায় সরকারি ভেদনীতি ,ব্রিটিশ বিচারব্যবস্থায় জাতিগত পক্ষপাত ,আইনপ্রসঙ্গে ফিরিঙ্গি আসামিদের স্বার্থে স্টিফেন সাহেবের নয়া উদ্ভাবন নীতি ৷ আরো আছে —এ নাটকে দেখা গেল ব্রিটিশ জেলে বাঙালি বন্দীদের বিদ্রোহ ৷বাঙালি বুদ্ধিজীবীর কলমে এবার জোটবদ্ধ সংগ্রামের আহবান ৷ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান যে হিন্দু – মুসলমান উভয় জাতির মিলিত প্রতিরোধ ছাড়া সম্ভব নয় -এই জরুরি রাজনৈতিক শিক্ষাটা উপেন্দ্রনাথের নাটকে স্পষ্ট ধ্বনিত হয় ৷ শেষাবধি বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা নাটকে যোগ করলেন সমকালীন সর্বভারতীয় প্রসঙ্গ ৷ উদাহরণ -হীরকচূর্ণ ,প্রকাশকাল ওই ১৮৭৫ ৷ এরপর যথাক্রমে সুরেন্দ্র-বিনোদিনী মামলা ,জগদানন্দ বৃত্তান্ত ও নাট্য -নিয়ন্ত্রণ ৷ জানা বৃত্তান্তের পুনরাবৃত্তি করছি না ৷
 
[ চলবে ]

যাপিত নাট্য: নাট্যজীবনের স্মৃতিকথায় - কুন্তল মুখোপাধ্যায়

কুন্তল মুখোপাধ্যায়

আজ ২৭শে মার্চ, ২০২২, বিশ্ব নাট্যদিবস। ১৯৬১ সালে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট এই দিনটিকে বিশ্ব নাট্য দিবস হিসাবে চিহ্নিত করেন। প্রথম বছর এই দিনে বাণী দিয়েছিলেন জ্যঁ ককতো, তারপর থেকে প্রতি বছর পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে বিশিষ্ট নাট্যজনরা এই দিনে বাণী দিয়ে চলেছেন, এবছর বাণী দিয়েছেন বিশিষ্ট অভিনেতা পিটার সেলার্স। এই দিনের মূল বার্তা হল থিয়েটার ও শান্তির সংস্কৃতি প্রচার। এই কথাগুলো আসলে ধান ভানতে শিবের গীতের মত। এবারের বিশ্ব নাট্য দিবস ব্যক্তি আমি’র কাছে খুবই আনন্দময় হয়ে উঠেছে, এই কারণে যে এই দিনে কলকাতায়, বহরমপুরে, নিউব্যারাকপুরে, হাওড়ায় ও বর্ধমানে আমার লেখা পাঁচটি নাটকের সংলাপ অভিনয় হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আমার দলের সংলাপ কোলকাতার ‘চোপ আদালত চলছে’ আর বহরমপুরে ঋত্বিক এর ‘শূদ্রায়ণ’ প্রথমটি বিজয় তেন্ডুলকারের ‘শানতাতা কোর্ট চালু আছে’ সম্পাদিত ও সংশোধিত রূপায়ণ, যেখানে বিজয় তেণ্ডুলকর, সুলভা দেশপাণ্ডে, অরবিন্দ দেশপাণ্ডে, তৃপ্তি মিত্র, শম্ভু মিত্র, সত্যদেব দুবেকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সংলাপ আকাদেমী মঞ্চে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে অভিনয় করেছে, আর দ্বিতীয়টি কম্বন রামায়ণ অনুসৃত সৃজন শূদ্রায়ণ, যা সংলাপ ১৯৯৮ সালের ১লা ফ্রেব্রুয়ারি তে শুরু করে ২০০০ সাল অবধি প্রায় দেড়শত রজনী অভিনয় করে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার, জাতীয় সম্মান লাভ করেছে। প্রথমটি পঞ্চাশ বছর আগের প্রযোজনা, দ্বিতীয়টি প্রায় বাইশ চব্বিশ বছরের পরেও এখনও প্রাসঙ্গিক মনে করেছে প্রযোজক দলটি। এটি ঐতিহ্যের পূর্ণনির্মাণ না অতীতের নাট্য ভাবনাকে বর্তমানের প্রেক্ষিতে দেখতে চাওয়া তা নিয়ে কথা হতেই পারে। যাই হোক না আমার ভালোলাগা আনন্দের কথা হল এই যে যখন প্রথম থিয়েটার শুরু করেছিলাম, তখন কি ভেবেছিলাম যাপিত নাট্য জীবন এতটা পথ চলতে পারবে, নাট্যসাগরে ছোট্ট ডিঙি নৌকা নিয়ে নানা বন্দর ঘুরে ঘুরে নাট্য সম্পদে ভরে উঠবে আমার ছোট্ট এই তরী এই সব ভাবতে ভাবতেই ভেসে ওঠে আমার ছেলেবেলা।

কিশোর কাল, যুবা বয়স থেকে আজ প্রৌঢ়ত্বের আঙিনায় দেখা এবং জড়িয়ে পড়া নাট্যজীবনের ছবি।

*

আমার জন্ম ও শৈশবের বেশ কয়েক বছর কেটেছে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে। এখনকার বহরপমপুরের জমজমাটি নগর জীবন দেখলে বোঝাই যাবে না, বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বহরমপুর কেমন ছিল। নাগরিক সভ্যতার বাহ্যিক আড়ম্বর প্রায় ছিল না বললেই চলে, বরং যেটা ছিল সেটা হলো স্বতস্ফূর্ত আন্তরিকতা, আমি বড় হয়েছি মামা বাড়ীতে, দিদু দাদু মামা আর মা বাবার আদরে প্রশ্রয়ে। মামা বাড়ীতে গান আর নাট্য চর্চার একটা চলন ছিল। মা মুর্শিদাবাদ জেলায় সংগীত প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন, দাদু নাটক করতেন, বাবা কবিতা লিখতেন, ছবি আঁকতেন আর মামা ছিলেন একান্তই নাট্যমগ্ন পুরুষ, আর এদেঁর সকলের প্রশ্রয় ও  আশ্রয়ের প্রধান ভরসা আমার দিদু। জ্ঞান হওয়া অবধি আমি গানশুনে আবৃত্তি ও ছড়া বলে, নাটকের মহড়া আর তার মঞ্চায়ণ দেখতে দেখতেই বড় হয়েছি। মার কাছে শুনেছি আড়াই বছর বয়সে মামার কোলে চড়ে ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেরানীর জীবন নাটকে আমার প্রথম মঞ্চ আবতরণ। মামা অনেক সময়ই (যে যে অভিনয় আমি দেখতে যেতে পারতাম না) নাটকের শেষে মেকআপ না তুলে দিদুর পাশে শুয়ে থাকা আমাকে জাগিয়ে মশারী তুলে নিজের রূপ সজ্জা দেখিয়ে তবে মেক আপ মুছে ফলতেন। আর আমি আধো ঘুমে আধো জাগরণে কখনও কর্ণাজুনের কর্ণ, উল্কার অরুনাংশু, দুই পুরুষের সুশোভন, বড়ঠাকুরানীর হাটের প্রতাপ, বিসর্জনের জয় সিংহ এর ছবিও কথা ভাবতে ভাবতে বাস্তবের উর্দ্ধে এক অন্য জগতে পৌঁছে যেতাম। আমার মামার নাম শংখশেখর গাঙ্গুলী, পরে কলকাতার যাত্রা জগতে তিনি শেখর গাঙ্গুলী নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। বহরমপুরে এখন চৌমাথায় মোড়ে চার্চের কিছু দূরে গ্রান্ট হলে নাটক হত, এছাড়া সূর্য সিনেমা হলে, খাগড়া মিশনারী স্কুলের মঞ্চে বা কৃষ্ণনাথ কলেজের মঞ্চে নাটক মঞ্চস্থ হত তবে বেশীরভাগ সময়েই মাঠে মাঁচা বেঁধে নাটক হত এবং তার বেশ কৌলিন্যও ছিল। শিশু বয়স থেকেই দেখেছি মামার বন্ধুরা দেবুমামা, মিন্টু মামা আমার মামা বাড়ির বৈঠকখানা ঘরের বড় তক্তাপোষ, আর আশেপাশের বাড়ির থেকে চৌকি তক্তাপোষ নিয়ে তিন চার ঘন্টার মধ্যেই মঞ্চ বানিয়ে ফেললেন পাড়ার কাছাকাছি কোনো ডেকারটার্সের কাছ থেকে পেছনের পর্দা (পরে জেনেছি সাইস্কোরামা) ও ড্রপিসনও জোগাড় হয়ে গেল। আমার থেকে একটু বড় সিধু মামা, মদন মামা, শীতল মামাদের কাজ ছিল বাচ্চা মামা হুইসিল বাজালেই দড়ি টেনে পর্দা খোলা ও বন্ধ করা। ওই মঞ্চেই দেখেছি মামা হয়ে উঠলো টিপু সুলতান, মিন্টু মামা ফরাসী সেনাধ্যক্ষ লালী, করুণা মামা (যার বৃত্তি ছিল পৌরহিত্য), তিনি হলেন হায়দার আলী, আর মামার থেকে বেশ কিছুটা বড় পশুপতি মামা টিপুর ভাই করিম শাহ। মামার থেকে বয়সে বড়, কিন্তু নাটকে ছোট ভাই বলেই কি পশুমামার করিম শাহ্ একটু মৃয়মান থাকবেন। আমাদের পাড়ার পূজোর মণ্ডপে পাশের লেঠেল মণ্ডপে, সোনাপট্টীতে, বা গঙ্গার ধারের মাঠে মঞ্চ বেঁধেও নাটকের অভিনয় হত। অনেক সময় সেই সব নাটকে কলকাতার মহিলা শিল্পীরা ছোট রাজলক্ষ্মী, লীলাবতি করালী প্রভৃতি অভিনয় করলেও আদতে লক্ষ্মীমামা, ভন্নুমামা, গণেশ মামারাই মেয়ে সেজে নাটকের মহিলা চরিত্র অভিনয় করতেন। সেই সময় বহরমপুরের ডাকসাইটে অভিনেতা ছিলেন কালু সমাদ্দার, মসীনবাবু এঁদের স্বীকৃতি পেলেই মামাদের অভিনয় সার্থক হ’ত। এছাড়া সেই সময়ে বহরমপুরে গণনাট্য সংঘ, ক্রান্তিশিল্পী সংঘের লোকজনেরাও নাটক করতেন। কলকাতা থেকে আসা নামকরা অভিনেতাদের বেশ কিছু নাটক আমি ছোটো বেলায় দেখেছি, তাদের মধ্যে কমল মিত্রের উচ্চতা, মহেন্দ্রগুপ্তের কণ্ঠস্বর আর সবযূবালার ব্যক্তিত্বময়ী চরিত্রায়ণের কথাই আমার মনে আছে। আর মনে আছে এম্ জি এন্টারপ্রাইজের (মলিনা গারুদাস) ঠাকুর রামকূষ্ণ ও রানী রাসমণি নাটক অভিনয় দেখা। শুনেছি এই সময়েই শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র সহ বহুরূপী নাট্য সম্প্রদায় ছেঁড়া তার’ আর ‘চার অধ্যায় নাটক’ অভিনয় করতে এসেছিলেন, শব্দ প্রক্ষেপণ ও আলোর অপ্রতুলতা নিয়ে আয়োজক সংগঠনের সঙ্গে তাঁদের কিছু মতান্তরের কথাও শুনেছি মামার কাছে। তবে যেটা এখনই স্পষ্ট মনে আছে, সেটা হল মামাবাড়ির বৈঠকখানা ঘরে মামা মিন্টু মামার সঙ্গে বাচ্চা মামা, রামা মামা, করুণা মামার বহুরূপীর অভিনয় ধরণ নিয়ে জোর তর্ক বিতর্কের কথা। বাচ্চা মামা রামা মামা বহুরূপীর অভিনয়ের অনুনাসিক সুরের ব্যবহার নিয়ে তীব্র আপত্তি, আর মামা মিন্টু মামার বহুরূপীর দলীয় শৃঙ্খলা পুরাতন অভিনয় রীতির বদল ঘটিয়ে এক বাস্তবোচিত বিষয়ও অভিনয়ের ধরণ প্রবর্তনের প্রশংসা। এই সময় আমি না বুঝলেও জেনে ছিলাম অভিনয় রীতির প্রাচীন নবীন ভাগ আছে; বহরমপুরের কালু সমাদ্দার মসীনবাবু যদি হন প্রাচীন তবে কলকাতা আগত বহুরূপী হল নবীন। মামার হাত ধরে আমিও, না বুঝেই নবীনের দলে…

কাশ্মীর ফাইলস: কথা কিন্তু একটা নয়। বিশ্লেষণে - কৌশিক দাস

কৌশিক দাস
 
কাশ্মীর ! এই নাম শুনলেই আমাদের মনের মধ্যে একটা নেশা ছেয়ে যায়, নৈসর্গিক সৌন্দর্যের নেশা, পাহাড়ের শীতল স্নিগ্ধতায় প্রশান্তির আবেশে হারিয়ে যাওয়ার নেশা। তবে মাঝে মধ্যেই এই স্বর্গের উদ্যান সেজে উঠে মৃত্যু উপত্যকায়, মাঝে মধ্যে ফুলের গন্ধে মিশে থাকে বারুদ আর ছাই ! কিন্তু কেন? প্রশ্ন সহজ তবে উত্তর যেন এক জটিল-কুটিল উপপাদ্য। 
 
সম্প্রতি The Kashmir Files নিয়ে সিনেমাপ্রেমী দুভাগে বিভক্ত ! একদল বলছে, “এটা প্রোপাগান্ডা সিনেমা” ওদিকে আরেকদল বলছে, “এটা এতদিনের দাবিয়ে রাখা চাপা আর্তনাদের ফসিলস ।” একদল বলছে, “খবরদার ! দেখবেন না এটা”, ওদিকে আরেকদল বলছে ” এটা অতি অবশ্যই দেখুন । ” এই সিনেমা সম্পর্কিত প্রায় সমস্ত সমাজ মাধ্যমের পোস্টের কমেন্টেই সুস্থ তর্ক-বিতর্কের পরিবর্তে চলছে নোংরা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কাদা ছোড়াছুড়ি ! 
 
তাই আমি চেষ্টা করবো, সিনেমার টেকনিক্যালিটিস (যতটুকু বুঝি) থেকে শুরু করে, যারা যতটা ভাল বলছে ততটা ভাল হয়েছে কি না এবং যারা যেই যেই কারণে খারাপ বলছে সেগুলো যুক্তিসঙ্গত কিনা, এইসব নিয়ে একটা নিরপেক্ষ মতামত উপস্থাপন করার । 
 
সিনেমার যে কটা সংলাপ জনপ্রিয় হয়েছে তার বাইরের একটা সংলাল ভীষণ সময়োপযোগী –
“This is a war of narratives ! ” 
সত্যিই তো সিনেমা রিলিজ হওয়ার পর থেকে দুটো দল নিজেদের ন্যারেটিভ নিয়েই লড়ে চলছে ! 
 
সিনেমার একদম শুরুর দৃশ্যই মন জয় করে নেয় বিশেষ করে ক্রিকেটপ্রেমীদের , যেখানে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেডিওতে ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের ম্যাচের (ব্যাটিং এ শচীন এবং বোলিংয়ে ইমরান খান) ধারাভাষ্য শোনা যায় এবং সেই ধারাভাষ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শট মারছে, দৌড়ে রান নিচ্ছে খুদে শিবা ও তার বন্ধু ! তারপর থেকেই শুরু হয় রুদ্ধশ্বাস ঘটনাবলী !  
 
কাশ্মীরের এক দুষ্কৃতিকে ফাঁসির সাজা শোনানোর জন্য দিন-দুপুরে সেই বিচারককে খুন করে কাশ্মীরী মিলিট্যান্ট । সেই বিচারক ছিলেন একজন কাশ্মীরি পন্ডিত । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য , কাশ্মীরের হিন্দুদের সাধারণত কাশ্মীরি পন্ডিত হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে । এই ঘটনার পর JLKF এর হিটলিস্টে আসে শিক্ষক পুষ্করনাথ পন্ডিত (অনুপম খের) এর ছেলের । মিলিট্যান্টদের অভিযোগ , উনি নাকি ভারতের গুপ্তচর, তাই সুযোগ পেলেই গর্দান যাবে এমন ফতোয়া । পুলিশেের হাই লেভেলের অফিসারকে (মিঠুন) জানিয়েও কোন লাভ হয়না । সুযোগ বুঝে বিট্টা কারাতের (চিন্ময় মান্ডলেকর !) দল ঢুকে পড়ে পুষ্করনাথের বাড়িতে । শুরু হয় রুদ্ধশ্বাস দৃশ্যাবলী ! বিট্টা সিঁড়ি দিয়ে উঠছে, ক্যামেরা আঙ্গেল বেঁকে আছে (খুব সম্ভবত Dutch Angle), ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছে । বিট্টা এসে আলো-আঁধারিতে দাঁড়ালো । এমন আবহ তৈরী হয় এই দৃশ্যে যা আমাদের মনে সঞ্চার করে অশনি সংকেত । তারপর যা যা ঘটে সেসব সহজপাচ্য নয় । অন্যান্য দিকের পাশাপাশি এই দৃশ্যে আলোর ব্যবহার বেশ প্রশংসার দাবী রাখে । 
সেই দৃশ্যে কী হয় সেটা যারা দেখেছেন জানবেন, ভীষণ হৃদয় বিদারক ! একই দৃশ্য যখন আবার সেকেন্ড হাফে দেখানো হয় সেটা হজম করা তুলনামূলক আরো শক্ত । রক্ত মাখানো চাল হাতের মুঠোয় উঠিয়ে নিতেই আমার শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে, অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নেই স্ক্রিন থেকে !
বিট্টার চরিত্রে অভিনয় করেছেন মারাঠি অভিনেতা চিন্ময় মান্ডলেকরের । এহেন অভিনয়ের জন্য তিনি দর্শক এবং সমালোচক এই দুপক্ষের থেকেই ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন । তবে তেমন কাউকেই দেখলাম না শারদা পন্ডিত এর চরিত্রাভিনেত্রী ভাষা সুম্বলিকে নিয়ে আলোচনা করতে । অভিনয়ে উনি প্রায় সকলেই দারুণ টেক্কা দিয়েছেন ! শারদা যখন চাল খাচ্ছে তখন অনুপম খের এর কান্নার দৃশ্য দুঃস্বপ্নের ভয়াবহতাকে তরান্বিত করে । তবে বেশ কিছু দৃশ্যে অনুপম খের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি । বিশেষ করে সিনেমার প্রথমার্ধে তবে দ্বিতীয়ার্ধের কিছু কিছু দৃশ্য ব্যতীত বেশ নজর করেছেন । সেই দিক থেকে মিঠুন চক্রবর্তী প্রথমার্ধে আমার প্রত্যাশা ছাপিয়ে গিয়ে দ্বিতীয়ার্ধে নিরাশ করেছেন । কৃষ্ণার চরিত্রে দর্শন কুমার আহামরি না হলেও শেষের দিকের ওই সংলাপ মনে গভীর দাগ কাটে । পল্লবী যোশী যথাযথ । 
 
সিনেমার গল্প দু-তিনটে টাইমলাইন মিলিয়ে এগোলেও ঘটিনাবলী অনুধাবন করতে তেমন বেগ পেতে হয় না । গল্পের মূল চরিত্র কৃষ্ণা কাশ্মীরে যায় কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে, যেই উত্তরে লুকিয়ে রয়েছে তার ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকশনে জেতার চাবিকাঠি । কারণ একমাত্র কাশ্মীরের “আজাদি” ই (ভারত সরকার থেকে) পারে কাশ্মীরের বঞ্চিত মানুষদের ন্যায়ের আস্বাদ (ওদের কথায়) । ঠিক এই কারণেই কাশ্মীরের “আজাদি”র জন্য যারা লড়াই করছে তাদের দৃষ্টিকোণ ও বোঝা দরকার । আবার এদিকে কৃষণা নিজের পরিবারই সেই তথাকথিত “আজাদি”র যুদ্ধে মৃত, ক্ষত-বিক্ষত , বিতাড়িত, যাদের আজো ঘরে ফেরা হয়নি ! এদের ঘরে ফেরাও একটা “মুক্তিযুদ্ধ” ! 
 
এবার প্রশ্ন, এই দুই পক্ষের মধ্যে কাদের যুদ্ধ ন্যায়সঙ্গত ? সত্যিটাই বা কি ? আমরা আদৌ কি সত্যিটা জানি ? সরকারী কাগজে-কলমে কখনো সত্যিইকারের পরিসংখ্যান পাওয়া গিয়েছে ? তাহলে ইতিহাসে যা লেখা আছে সেটাকেই কি সত্যি বলে মেনে নেওয়া যায় ? সব ইতিহাসবিদই কি নিরপেক্ষভাবে ইতিহাসে সত্যি তুলে ধরেছেন ? যারা ভুক্তভোগী তাদের ন্যারেটিভই বা কতটা সত্যি ? The Kashmir Files কৃষ্ণার পাশাপাশি আমাদেরও এমন আরো বহু প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় ! কৃষ্ণা কি জানতে পারবে সত্যিকারের উত্তর ? জানতে হলে দেখতে হবে The Kashmir Files .
 
এবার আসি সিনেমার চুলচেরা আলোচনা এবং সমালোচনায় ! 
 
♦ ১. এই সিনেমার প্রতি যা যা সমালোচনা শোনা যায় সেসবের মধ্যে অন্যতম হল – “এটা একটা প্রোপাগান্ডা সিনেমা ” –>
 হ্যাঁ হতে পারে এটা প্রোপাগান্ডা সিনেমা, কিন্তু যদি এই সিনেমা অতীতের এমন এক ঘটনা দেখাতে চায় যা ইচ্ছাকৃতভাবে চাপা দেওয়া হয়েছিল আপামর জনসাধারণের কাছ থেকে তবে আমি নিরপেক্ষ দর্শক হিসেবে সিনেমাটা অবশ্যই দেখব । একইভাবে আমি অনুরাগ কশ্যপ পরিচালিত নোটবন্দি নিয়ে তৈরী সিনেমা Chocked দেখেছি, নন্দিতা দাশ এর গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে সিনেমা Firaaq দেখেছি, কামাল হাসানের Hey Ram দেখেছি । সিনেমাটা না দেখলে বুঝবো কীভাবে যে সেটা আদৌ প্রোপাগান্ডা না উগান্ডা ? 
 
♦ ২. “সিনেমায় সত্যি দেখানো হয়নি !” –>
এবার কথা হল, সিনেমায় সত্যি দেখানো হয়নি ! এটা খুবই সাটল একটা বক্তব্য ! যারা এমন বলছে তারা একটা RTI এর স্ক্রিনশট দেখাচ্ছে যেখানে দেখানো হয়েছে কাশ্মীরী পন্ডিতদের মৃত্যুর সংখ্যা কয়েকশ মাত্র, যেখানে সিনেমায় বলা হয় কয়েক হাজার । এখন কথা হল, সরকারী তথ্যে সত্যিকারের পরিসংখ্যান কি সব সবসময় উঠে আসে? আমার জানা নেই ! আপনারা কী বলেন ?  
 
♦৩. “এই সিনেমায় পলিটিকাল কমপ্লেক্সিসিটি দেখানো হয়নি ! ” –>
এই ব্যাপারে আমি কিছুটা সহমত । কাশ্মীরের এই সমস্যা কিন্তু রাতারাতি তৈরী হয়নি । এই Exodus/Genoside বুঝতে গেলে কাশ্মীরের পলিটিকাল হিস্টোরির ক্রনোলজি ও জটিলতা বুঝতে হবে । ১৯৫১ এর প্রথম নির্বাচন বুঝতে হবে, ১৯৫২ এর আর্টিকেল ৩৭০ বুঝতে হবে, শেখ আব্দুল্লার National Conference এবং National Congress এর জোট বুঝতে হবে, ১৯৫৩ র শেখ আবদুল্লার আরেস্ট ও বক্সি গুলামের গদিতে বসা বুঝতে হবে, কাশ্মীরের অফিশিয়াল ভাষা ‘কাশ্মীরী’ না করে ‘উর্দু’ কেন করা হল বুঝতে হবে, ১৯৫৬ র যুদ্ধ বুঝতে হবে, Kashmir Accord বুঝতে হবে, ১৯৭৭ এর আবদুল্লার NC র সঙ্গে কংগ্রেসের বিচ্ছেদ বুঝতে হবে, ১৯৮০ থেকে কাশ্মীরে মাদ্রাসার রমরমা বুঝতে হবে, সোভিয়েতের সঙ্গে আফগানদের যুদ্ধের প্রভাব বুঝতে হবে, Jaamat-i-islami র উত্থান বুঝতে হবে, ১৯৮৭ দিকের কাশ্মীরের যুবকদের বেকারত্ব বুঝতে হবে, ASFA বুঝতে হবে, ১৯৮৯ পর্যন্ত প্রায় ১০০০০ গ্রাজুয়েট বেকারদের পাকিস্তানে গিয়ে ট্রেনিং নেওয়া বুঝতে হবে, JKLF, Hijbul Mujahideen এর উত্থান বুঝতে হবে !
এগুলো না দেখালে এই সমস্যার উৎপত্তির ক্ল্যারিটি আসবে না । আর এই সিনেমার পরিসরে আমার মনে হয় সেটা করা সম্ভবপর নয় । তবে হ্যাঁ অবশ্যই সেন্ট্রালের সাথে স্টেটের কনফ্লিক্ট আরো একটু বেশি দেখানো যেত । কিছু কিছু সংলাপের মধ্যে দিয়ে
 (মিঠুনের টেলিফোনে কথোপকথন, CM এর সাথে আলাপচারিতা ইত্যাদি) সেই চেষ্টা করা হলেও কিছু দৃশ্যায়ন করা যেতে পারত । সেকেন্ড হাফের কিছু কিছু অপ্রয়োজনীয় দৃশ্য (আমার দুটো চোখে পড়েছে) বাদ দিয়ে এই দিকটা দেখানো যেতেই পারত । 
 
♦ ৪. ” মুসলিমদের ভিক্টিমাইজ করা হচ্ছে, এতে হিংসা বাড়বে৷। ” –>
কেউ যদি সিনেমাটা মন দিয়ে দেখে থাকে তবে লক্ষ্য করবে যে, শুরুর দৃশ্যেই যখন শিবা কে ছেলেগুলো মারছিল তখন ওর মুসলমান বন্ধুই ওকে বাঁচায় ! হাসপাতালে সেই বন্দুকধারী রক্ত নিতে এলে একজন নার্স বাঁধা দেয় এবং তার পরিনতি আমরা দেখি । সেই নার্সের জন্য যে হাউমাউ করে কাঁদে তাদে দেখে বুঝি সেই নার্স মুসলিমই ছিলেন, শেষের দিকের সেই ডায়লগে কৃষনাও বলে, যে উগ্রপন্থীরা অনেক সম্ভ্রান্ত মুসমিলদের ও মেরে ফেলেছিল যারা হিন্দুদের সাপোর্ট করেছিল !  
 
এবার কথা হল, যাদের মনে ইতিমধ্যে মুসলিম বিদ্বেষের বীজ বপন করা আছে (আমি ব্যক্তিগত ভাবে কিছু কাছের মানুষকে চিনি) তাদের যতই বোঝাও যে, একদল মানুষের জন্য সবকটা মানুষ খারাপ হয়না, তারা বুঝবে না । তাই একটা সিনেমা মননশীল মানুষের মধ্যে নতুন করে বিদ্বেষের বীজ জন্ম দিতে পারে না বলেই আমার বিশ্বাস । তাই সমস্যার পেছনে পড়ে না থেকে সমাধানের প্রচেষ্টা করা উচিৎ । তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হোক, ঘরের মানুষদের ঘরে ফেরানো হোক । সিনেমা দেখে অহেতুক পাশের বাড়ির মুসলিম ভাই-বোনদের উত্যক্ত করা বন্ধ হোক । যারা এমন করছে তারাও সমান দোষী ! 
 
♦৫. “অন্যান্য নৃশংস ঘটনা নিয়েও (বিশেষ করে গুজরাট) Files হোক । ” –>
অতীতের বিভিন্ন হিংসা নিয়ে ইতিমধ্যে অনেকেই সিনেমা বানিয়েছেন আবার অনেককিছু নিয়েই সিনেমা হয়নি ! গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে ইতিমধ্যে Parzania এবং Firaaq এর মত ক্রিটিকালি আক্লেইমড সিনেমা হয়েছে । হিন্দুদের গোঁড়ামি নিয়ে যেমন – Water, The Great Indian Kitchen হয়েছে তেমনি মুসলিমদের গোঁড়ামি নিয়ে Biriyani হয়েছে আবার ক্রিশ্চানদের গোঁড়ামি নিয়ে Trance হয়েছে । আপনারা এবার প্লিজ সিনেমাকে হিন্দু-মুসলমান এর বাইরে নিয়ে এসে সমস্যাগুলোতে ফোকাস করার চেষ্টা করুন দেখবেন পৃথিবীটা আসল কাশ্মীরের মত সুন্দর হয়ে উঠছে |
 
♦ ৬. ” খুবই বাজে অভিনয়, খুবই বাজে 
মেকিং । ” –>
সত্যি কথা বলতে অনুপম খের কিছু কিছু জায়গায় হতাশ করেছে, মিঠুন ও তাই, দর্শন ও শেষের দিক ছাড়া সাধারণ হলেও বাকিরা কিন্তু দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন ! এমনকি সেই সব্জিওয়ালা ছেলেটা যে পাকিস্তানের নোট দেয়, কয়েক সেকেন্ডেও কি অসাধারণ ক্রিন প্রেজেন্স ! আর বিট্টা তো অসাধারণ ! তাই অভিনয় নিয়ে যারা এমন বলছে তাদের বক্তব্য একপেশে মনে হচ্ছে । 
মেকিং নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় প্রথমার্ধে দম ফেলার জায়গা নেই । কিছু কিছু কথোপকথন একইসাথে হাস্যকর এবং গম্ভীর, বেশ উপভোগ্য । সেই তুলনায় দ্বিতীয়ার্ধ একটু স্লথ । অন্তত দুটো সিন তো বাদ দেওয়াই যেত । এছাড়া গল্প ভালই এগিয়েছে । বেশ কিছু ইমপ্যাক্টফুল দৃশ্যাবলী আছে । সেসব নিয়ে শেষের দিকে আলোচনা করবো । সিনেমাটোগ্রাফি দুর্দান্ত, কাশ্মীরকে অনেকদিন পর এত সুন্দরভাবে (খুব বেশী না দেখালেও) দেখলাম । অন্ধকার ঘরের আলোকসম্পাত দারুণ, বেশ কিছু ক্যামেরা আঙ্গেল দারুণ লেগেছে, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও বেশ ভাল । 
 
♦ ৭. “কৃষনার ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্টে আরো সময় দিতে হত । ” –>
অনেকে বলছে, ‘ শেষের দিকে বিট্টার সাথে দেখা করে আর পেপার পড়ে কৃষ্ণার হঠাৎ করে এমন বোধোদয় হল যে সে এমন একটা মারকাটারি বক্তৃতা দিয়ে দিল !? অতিরিক্ত উত্তেজিত মনে হয়েছে ওকে শেষের সেই দৃশ্যে । ব্যাপারটা ওর ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্ট এর সাথে ঠিক খাপ খায় নি । ‘ 
 
এখানে নিমোক্ত জিনিস লক্ষ্য করতে হবে – 
 ইউনিভার্সিটির প্রথম দৃশ্য থেকেই বোঝা যায় কৃষনার কাশ্মীরী পন্ডিতদের প্রতি সহমর্মিত রয়েছে । সে জানে যে কতজন কীভাবে মারা গেছে, কিন্তু তারপর ওর ব্রেইন ওয়াশ করা হয় । ছোটবেলা থেকে ওর পরিবারের ট্র‍্যাজেডি থেকে ওকে অন্ধকারে রাখা হয় । প্রথমে সে জানতে পারে যে ওর বাবা-মা দুর্ঘটনায় মারা যায় নি । তারপর আবার জানতে পারে যে ওর বাবা-মা, দাদা কে বিট্টা মেরেছে । তারপর বিট্টার থেকে জানতে পারে ওর ফ্যামিলিকে বিট্টা নয় ইন্ডিয়ান আর্মি মেরেছে ! এটা জেনে সে ভঙ্গুর মাটির পাত্রের মত ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় । তারপর সে আবার জানতে পারে যে ওর পরিবারকে ইন্ডিয়ান আর্মি নয়, বিট্টার দল ইন্ডিয়ান আর্মির ড্রেস পড়ে ছল করে মেরেছে ! এত কম সময়ে এমন ভয়াবহ সত্যের মুখোমুখি হলে যে কেউ উন্মাদ হয়ে যাবে । এসবের প্রতিক্রিয়াই হল শেষের সেই স্পীচ !
 
♦ ৮. তবে আমার নিজের আরো কিছু জিনিস চোখে লেগেছে –
 
একদম শেষের দৃশ্যে বিট্টা যখন এক এক করে সবার মাথায় গুলি করছে তখন ওদের(যারা মরছে) অভিব্যক্তি খুবই সাধারণ, মৃত্যুর বিভীষিকা নেই চোখে মুখে ! একমাত্র শিবা র অভিব্যক্তি দুর্দান্ত লেগেছে ! 
 
সেই চালের বস্তার দৃশ্যে বিট্টা যখন বাড়িতে ঢোকে তখন বাড়ির চাকর ইশারা করে দেখিয়ে দেয় চালের বস্তায় লুকিয়ে আছে । সে যদি আঁড়ি পেতেই শোনে যে লোকটা লুকোনোর প্ল্যান করছে কিন্তু সে কোথায় লুকোবে সেটা কিন্তু বোঝা সম্ভবপর ছিল না ।
♥ এবার বলি কিছু জিনিস যেগুলো ভাল 
লেগেছে –
১. দুর্দান্ত ফার্স্ট হাফ ! 
২. শেষের স্পিচ ! ডায়লগ ডেলিভারির ইন্টেন্সিটি দুর্দান্ত লেগেছে আমার । কাশ্মীরের মনীষীদের ব্যাপারে কিছু জানতাম তবে এতটা জানা ছিল না । কাশ্মীরী পন্ডিতদের ধর্মান্তরিত হওয়ার ব্যাপারে কিছুটা জানা ছিল তবে এত কান্ড জানা ছিল না ! 
৩. কয়েকজনের কিছু কিছু দৃশ্যে সাধারণ অভিনয় ছাড়া বাকি দারুণ অভিনয় । 
৪. কিছু কিছু পাওয়ারফুল দৃশ্য –
a. চালের বস্তার দৃশ্য !! 
b. মিঠুনের সামনে চারজন এয়ারফোর্স অফিসারদের মারার সময় ভারতের পতাকাকে নীচে পড়তে না দিয়ে বিট্টার চোখে চোখ রেখে মিঠুনের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য । 
c. রাতের অন্ধকারে ট্রাকে করে যাওয়ার সেই দৃশ্য
d. ক্যাম্পে সেই বৃদ্ধার বাড়ি না ফেরার গান গাইতে গাইতে মৃত্যুর দৃশ্য । 
e. শারদার পরিনতির দৃশ্য
f. একদম শেষের দৃশ্য ! 
 
তবে IMDB এর মত (যদিও পরে রেটিং নাকি কমিয়ে দেওয়া হয় !) এই সিনেমাকে আমি হয়ত ১০ এ ১০ দেবো না, আমি কাশ্মীরী পন্ডিত হলে হয়ত দিতাম তবে নিরপেক্ষ সিনেমাপ্রেমী হিসেবে আমি ১০ এ ৮ 
দেবো । 
 
অবশেষে বলব, এই সিনেমা দেখার আগে এবং পরে কাশ্মীরের সমস্যা নিয়ে পরিচিত অনেককেই বিস্তারিত পড়াশোনা করতে দেখেছি এবং কাশ্মীরের নিপীড়িত মানুষদের যেন আমার পাড়ার মানুষ মনে হচ্ছে, সে কাশ্মীরী পন্ডিতরাই হোক কিংবা মৃত নিরপরাধ কাশ্মীরী মুসলীম । অন্তত এখানেই হয়ত এই সিনেমার সার্থকতা ! 
 
অবশেষে বলব, আমার মনে হয় যে, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে, আমার মত অনেকেই চাইবেন যে, যেই সমস্ত কাশ্মীরী পন্ডিত আজও বাড়ি ফিরতে চায়, সরকার যেন তাদের সেই ব্যবস্থাটা করে দেয় কারণ পাখিরাও দিন ফুরোলে বাড়িতে ফেরে ! ❤️

প্রাচ্য'এর 'বালজাকের প্রেমিকারা' দেখে মুগ্ধ হলেন - সোমোয়েত্রী চ্যাটার্জী

সোমোয়েত্রী চ্যাটার্জী
 
‘বালজাকের প্রেমিকারা’
 
কে এই বালজাক? ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার, যাঁর নাম ‘অনরে দ্য বালজাক’।
ফরাসি বিপ্লবের পর ফরাসি ভাষায় কথাসাহিত্যের যে জোয়ার আসে, বলা যায় বালজাক তার ধারক ও বাহক। তাঁকে বলা হয় রিয়েলিজমের গুরু। 
তাকে উনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক বলে গণ্য করা হয়।
 
এ হেন বালজাকের জীবন নিয়ে নাটক লিখেছেন নাট্যকার চন্দন সেন। নাট্যকারের মতে এই নাটক নিজের জন্য লেখা, কোন তাগাদা বা অনুরোধ থেকে নয়। মঞ্চায়নের কথা ভাবেননি কখনোই। কিন্তু নাট্য নির্দেশক বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় এটিকেই বেছে নিয়েছেন এবং অসামান্য দক্ষতায় মঞ্চস্থ করেছেন। 
বহুবছর পরে কোলকাতায় এসে দেখলাম এই দুর্দান্ত নাটক, প্রাচ্য প্রযোজিত এবং বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘বালজাকের প্রেমিকারা’। যারা সাহিত্যপ্রেমী, যারা শিল্পপ্রেমী, যারা চেনা গতের বাইরে অন্যরকম নাটক ভালোবাসেন তাদের জন্যই এই নাটক।
নাটকটি দেখার পরে প্রশ্ন আসে- এটি নাটক না আস্ত একটা ক্যানভাস ? যে ক্যানভাসে এক ঘন্টায় চাপানো হল বহু লেয়ারস, দৃশ্যমান হল একটা যুগ, সময়, লেখকের জন্ম,বেড়ে ওঠা, জীবনের দ্বন্দ্ব, অদম্য জেদ,সৎ প্রেমের আকাঙ্ক্ষায় ধাবমান পৌরুষ। ছুটন্ত রেলগাড়ীর জানলায় চোখ রেখে একের পর এক পেরিয়ে গেলাম প্রতিটি দৃশ্যকল্প, প্রায় সিনেমার মতই। 
 
নাটকে স্বল্প পরিসরে দেখতে পাই মাতৃস্নেহ বঞ্চিত বালজাক আজীবন খুঁজে চলেন ভালোবাসা, একটি সৎ প্রেম, যে প্রেমের কাছে নিশ্চিন্তে সমর্পিত হওয়া যায়, হাঁটু মুড়ে বসা যায় শান্তিতে। দুর্দান্ত, দাপুটে লেখক যিনি জীবন নিয়ে কারবার করেন কাগজে ও কলমে, সেই মানুষটিই ভালোবাসার কাঙাল। দ্বিগুন বয়সী মাদাম দ্য বার্নি, সমসাময়িক লেখিকা মারিয়া এবং শেষে ইভলিন দ্য হানস্কা, এই তিন নারীর প্রতি তার প্রেম, এবং শেষে হানস্কার সঙ্গে পরিণয়। টানটান অভিনয় এবং নাটকের দুরন্ত গতি অন্য কিছু ভাববার বা ফাঁক খোঁজার ফুরসত দেয়না। 
মঞ্চের ব্যবহার নজর কাড়ে। একটা পিয়ানো, একটা টেবিল-চেয়ার আর একটা সিঁড়ি- এই এতটুকুই আয়োজন। শেষে সব সরে গিয়ে একটি সোফা। বাহুল্য ও মেদ বর্জিত মঞ্চ। শিল্পী হিরণ মিত্রের কাজ, যার শিল্পভাবনা নিয়ে কিছু বলার অর্থ ধৃষ্টতা। শিল্পী তার অনায়াস দক্ষতায় ফ্রান্সের সেই যুগকে তুলে এনেছেন মঞ্চে। সিঁড়িটি যেন বালজাকের উত্থান, প্রাপ্তি ও পরিণতির রূপক।
কুশীলবদের বডি ফ্লেক্সিবিলিটি দেখার মত, বহু রিহার্সালের ফসল তা বুঝতে অসুবিধে হয়না। বটম ডান্সের সাবলীলতা শুরুতেই নজর কাড়ে। আর আলো আঁধারিতে রূপকের ব্যবহার করে প্রপসের পরিবর্তন, যারা পরিবর্তন করতে মঞ্চে প্রবেশ করলেন তারাও সেই দৃশ্যের অংশ হয়ে উঠলেন। পরিচালককে অনেক ধন্যবাদ এমন একটি ভাবনার জন্য। 
আলোর ব্যবহার মারাত্মক রকমের, বালজাকের মানসিক দ্বন্দ্বের যাত্রাপথ এই আলোর পথ ধরেই এগিয়েছে এবং সমান্তরালে চলেছে দিশারি চক্রবর্তীর আবহ সঙ্গীত।
 
এতক্ষণ ধরে যার কথা বলছি,বালজাক- নাম ভূমিকায় ছিলেন বুদ্ধদেব দাস, যিনি অভিনয় দিয়ে বশ করার ক্ষমতা রাখেন। নাটকের কথক সুমনা মুখোপাধ্যায় ও তিনজন প্রেমিকার ভূমিকায় সোমা দত্ত, সুপর্ণা দাস ও কথাকলি, প্রত্যেকের অভিনয় অসাধারণ। 
নাটকের কাহিনী বাস্তব নির্ভর হওয়ায় 
নাটকে আছে বেশ কিছু সাহসী দেহভঙ্গিমা এবং পরিচালক সূক্ষ্ম,মার্জিত অথচ সুস্পষ্ট ভাবে তা ফুটিয়ে তুলেছেন। 
 
নাটকটি দেখতে দেখতে ভাবছিলাম আজ যখন কিভ শহর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের যন্ত্রণায় বিবশ, তখন এই নাটক সফর করায় ঊনবিংশ শতাব্দীর কিভ শহরে, যেখানে প্রেমিক বালজাক ছুটতে ছুটতে পৌছান তার প্রেমিকা ইভলিন হানস্কার কাছে। হানস্কা প্রতিশ্রুতি দেন ভালোবাসার,পাশে থাকার। 
 
শেষে আর একবার বলি, ‘বালজাকের প্রেমিকারা’ কেন দেখবেন? এ শুধু এক সাহিত্যিকের বায়োপিক নয়, মিল পাবেন বর্তমান সময়কালের। বালজাকের নিখাদ ভালোবাসাকে কেবল শরীরি প্রেমের প্রলোভন দেখিয়ে ব্যবহার করা এবং শেষে দুমড়ে মুচড়ে ছুঁড়ে ফেলার মধ্যে চিরকালীন স্বার্থ ঘেঁষা বিপণনের মিল পাবেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর বালজাক ও আপনার পরিচিত সময়কাল দুটোই এক মনে হবে। কিন্তু তারও পরে আর একটি বক্তব্য থেকে যায়, যা মাথা তুলে দাঁড়াবার,বশংবদ না হওয়ার। বহু ব্যবহারেও মরচে না ধরার। বালজাক যেমন হার মানেন নি,তার সেই শক্তিটুকু দর্শকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে নাটকের শেষে, ঠিক যেমন সুমনের গানে- 
‘উঠে দাঁড়ালেন যেমন দাঁড়ায়
বন্দিনী এক বাঘিনী চিতা
চিড়িয়াখানায় অসহায়তবু
উঠে দাঁড়ানোয় অপরাজিতা।’

ব্রিজারটন সিরিজ: একবার দেখাই যায়, মন্তব্য করলেন - অভিষ্যন্দা লাহিড়ী দেব।

অভিষ‍্যন্দা লাহিড়ী দেব

ভোরবেলা কোনও এক অপেরা গায়িকার বিছানা থেকে উঠে বাড়ি ফিরছিলেন অ‍্যান্টনি ব্রিজারটন। এমনিতে ভদ্রলোক খুব চাপে আছেন। একে তো বাবার অকালমৃত‍্যুর পরে খুব অল্পবয়সে তাঁকে ভাইকাউন্ট হতে হয়েছে। আরও সাত ভাইবোনের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। তার মধ‍্যে মোটে এক বোনের বিয়ে হয়েছে। এবার তাঁকে বিয়ে করতে হবে। কারণ ইংল‍্যান্ডের ‘পিয়ার অফ দ‍্য রায়াল্ম’ হয়েছেন যখন, তখন বংশরক্ষা করাটা তাঁর রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অন‍্যতম। এত দায়িত্বের চাপ সারা রাতের সঙ্গমও হাল্কা করতে পারেনি। তাই অ‍্যান্টনি ঘোড়ায় চেপে হাইড পার্কের ভিতর দিয়ে চলেছেন, সামনে দুলকি চালে চলেছে দুটো হাঁস। হাঁসের চেয়েও মন্থর গতিতে চলেছে অ‍্যান্টনির ঘোড়া। এমন সময় সেই কাকভোরে ঝড়ের গতিতে আর এক কালো ঘোড়ার সওয়ার ঢুকে পড়ে মাঠে। অ‍্যান্টনি অবাক। কারণ ঘোড়ার পিঠে বসে প্রায় উড়ে চলেছে একটি মেয়ে। একটু পরে জানা গেল তার নাম কেট শর্মা। ব‍্যস সেই যে একটা অসম্ভব প্রেম তৈরি হল, সেটাই গল্প।

গল্পটার মধ‍্যে সারবত্তা বিশেষ কিছু ছিল না। মানে যাঁরা ফাঁপা রোমান্টিক গল্প পড়তে ভালবাসেন বা যাঁরা যৌনতার একেবারে আক্ষরিক বর্ণনা পড়ে আনন্দ পান তাঁদের জন‍্য জুলিয়া কুইনের ‘ব্রিজারটন’ সিরিজ একেবারে আদর্শ। কিন্তু তার বাইরে এই সিরিজটার গল্পে আর কিছুই ছিল না। তবু কেন শন্ডা রাইনসের মতো প্রযোজক এই গল্পগুলো নিয়েই নেটফ্লিক্স সিরিজ তৈরি করতে চাইলেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে তাঁর হাতে পড়ে গল্পগুলোর উন্নতি হয়েছে। শুধু একটাই বক্তব‍্য, একটু রিসার্চের দিকে মন দিলে ভাল হত। ‘ব্রিজারটন’ রিজেন্সি ইরার গল্প। মানে যখন ইংল‍্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জ পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর পক্ষে রাজ‍্য চালনার কাজ আর সম্ভব নয় দেখে তাঁর ছেলে চতুর্থ জর্জ প্রিন্স রিজেন্ট হিসেবে কাজ চালাতে শুরু করেন। যদিও ভীষণ মোটা আর বিলাসী প্রিন্স জর্জকে সামনে রেখে রাজ‍্য চালাতেন ডিউক, মার্কুইস, আর্লরাই কিন্তু প্রিন্স রিজেন্টের নাম থেকে এই সময়কালকে রিজেন্সি ইরা বলা হয়। ইংরেজি সাহিত‍্য এই সময়টায় পেয়েছে জেন অস্টেনকে। তাঁর আদর্শেই আজও এই সময়টাকে ঘিরে লেখা হয় অজস্র রোমান্টিক গল্প। ‘ব্রিজারটন’ও তার ব‍্যতিক্রম নয়। এমনিতে রিসার্চ নিয়ে কিছু বলার ছিল না। সিরিজে রিজেন্সি ইরার ছাপাখানা থেকে পোশাক, বলরুমের সবরকম নাচ সবই নিখুঁত। মুশকিল হল কেট শর্মা এবং তার পরিবার ভারতীয়। সমসাময়িক ভারতবর্ষ নিয়ে এই সিরিজের জ্ঞানের বহর কহতব‍্য নয়। শর্মা একটি উত্তরভারতীয় পদবী। অথচ কেট এবং তার ছোটবোন এডউইনার চেহারা দক্ষিণ ভারতীয়, সাজগোজের কায়দাও দক্ষিণী। তারা তাদের বাবাকে আপ্পা বলে দক্ষিণী রীতিতে। এদিকে এডউইনা কেটকে দিদি বলে ডাকে কেট তাকে ডাকে বন বলে। সম্ভবত বোন শব্দের কোনও বিকৃত রূপ, যেটা আবার বাংলা। তারা ধর্মত ক্রিশ্চিয়ান। কিন্তু বিয়ের আগে তাদের গায়ে হলুদ হয়। যাই হোক এসব কথা না বলাই ভাল। তবু এই সিরিজটি দেখা উচিৎ। কারণ এই সিরিজের একটি বিশেষ সাবপ্লট। অ‍্যান্টনির অন‍্যতম ছোটবোন এলোইস আর তাদের প্রতিবেশী এলোইসের সব থেকে কাছের বন্ধু পেনেলোপের গল্পটার জন‍্যই এই সিরিজের সব খামতি উপেক্ষা করা যায়। পেনেলোপে একজন শখের সাংবাদিক। লেডি হুইসেলডাউন ছদ্মনামে সে উচ্চবিত্ত পরিবারের কেচ্ছা লেখে। কিন্তু এই লেখাটাই তার একমাত্র মুক্তি। তাই নিজের ক্ষতির মূল‍্যেও সে লিখে চলে। আশ্চর্য তার কাহিনি। সিরিজের এই দ্বিতীয় খন্ডের প্রধান আকর্ষণ অবশ‍্য সাইমন অ‍্যাশলের কেট শর্মা আর জোনাথন বেইলির অ‍্যান্টনি ব্রিজারটনের কেমিস্ট্রি। এরা একটা ঘরে থাকলেও যেন পরিবেশে আগুন লেগে যায়। সাইমন অ‍্যাশলের মতো কোনও কন‍্যাকেই বোধহয় রবীন্দ্রনাথ ময়নাপাড়ার মাঠে দেখেছিলেন। আহা এই কৃষ্ণকলিটির কালো হরিণ চোখের প্রেমে হাজার বার পড়েও মন ভরবে না। সিজন ওয়ানের ডাফনে আর সাইমনের শরীরি প্রেম দেখে যাঁদের খুব ভাল লেগেছে দ্বিতীয় পর্বে তাঁরা কিঞ্চিৎ হতাশ হবেন। তবে শেষপর্যন্ত দেখলে কেট আল অ‍্যান্টনির শয‍্যাদৃশ‍্য দেখে খুশি হবেন তাঁরাও। মোট কথা ‘ব্রিজারটন’ মন্দ নয়। দেখতেই পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *