২৫ তম সংখ্যা || ১৮ তম ই-সংস্করণ || মে, ২০২২

ভাণ পত্রিকা

২৫ তম সংখ্যা || ১৮ তম ই-সংস্করণ || মে, ২০২২

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :

ভাণ-এর পক্ষে:

পার্থ হালদার

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) [email protected] ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সূচি

 
 
 
 
 
 
 

সম্পাদকের কথা

বাঙালিদের দেখা হলেই, ‘ভালো’ ‘ভালো আছেন’ এবং প্রত্যুত্তরে ‘ভালো’ ‘ভালোই আছি’ ‘ এইতো চলছে’ ‘এক রকম ভাবে কেটে যাচ্ছে’- এসব শুনতে আমরা অভ্যস্ত। এই নিয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। মঙ্গলার্থে ‘ভালো থাকবেন’ আশাবাদী অর্থে ‘দেখা হবে কথা হবে’ এসব নিতান্তই চালু বুলি। সত্যি সত্যি ভালো আছে কিনা, ভালো চলছে কিনা, কিংবা দেখা হবে কিনা,দেখা হলে ভাল লাগবে কিনা,- এই ধরনের কোন গভীর ব্যঞ্জনা এই রিচুয়ালিস্টিক বাচনে থাকে না। থাকার কথাও নয়। কিছু পরিচিত ভাষা চিহ্নের ভেতর দিয়েই আমাদের প্রাথমিক যোগাযোগ। যোগাযোগ গভীরে গেলেই ভাষার সংকট হয় অথবা নিজের সংকটকে আর ভাষাগত করে তোলা যায় না। ফলে মিস কমিউনিকেশন। ফলে একা হয়ে যাওয়া। ফলে দুঃখ কষ্ট অসহায়তা ইত্যাদি। অন্যপক্ষে, যেকোনো প্রকাশের গভীরে যে ভাষা রাজনীতি সেটিকে তলিয়ে দেখলে কিছু সত্যদর্শন হয়। খুব জটিল কিছু আলোচনা করতে চাইছি না। শুধু বলতে চাইছি জগৎজুড়ে ‘আমি ভালো আছি’ এই বিজ্ঞাপনের কথা। এ কাজে সর্বাগ্রগামী বাঙালি মধ্যবিত্ত। শোনা যায় সাধারণ মানুষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস যখন তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছিল তখনই তিনি উচ্চারণ করেছিলেন মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। মনে হয় মানুষ যখন সবচেয়ে কলঙ্কিত হয়ে আছে নিজেরই গভীরে, তখনই প্রদর্শনের দামামা বাজছে চতুর্দিকে। এতই উচ্চকিত সে দামামা যার প্রদর্শন প্রদর্শনকারীকেই বধির করে তুলছে। এই দেখো আমি কেমন সেজেছি।এই দেখো আমার বর আমাকে কত ভালবাসে। এই দেখো আমি আমার ছেলেকে কি দারুন চুমু খাই। এই দেখো আমি এখন পাহাড়ে সমুদ্রে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই, ভেসে বেড়াই। এই দেখো আমি শহরের সেরা চাইনিজ থেকে চাইনিজ সাটাচ্ছি। বুঝে নাও কোন কোন ব্র্যান্ডের পোশাক-আশাক আমার অঙ্গে অঙ্গে ঢেউ তোলে। দেখো রাতদিন আমার পাকস্থলী কেমন সুস্বাদু শুশ্রূষা পায়। এই দেখো আমার কত বন্ধু স্বজন। এই দেখো অমুক আনন্দময় কবির পাশে আমার চিদানন্দ রূপ। এই বোঝো ক্ষমতাবানের পাশে আমি কি মিষ্টি মতন দাঁড়িয়ে। এই শোনো আমার কেমন নামজাদা অতীত।এই দেখো আমার কেমন সোশ্যাল প্রেস্টিজ। তুমি ভাবো, আমার কত প্রতিভা। আমি কেমন কর্মতৎপর। আমি বিদ্যাসাগরের তুল্য দয়ালু।আমি বঙ্কিম তুল্য কথাকার। আমি শহর কাঁপানো গায়ক। আমি পর্দা মাতানো নায়ক। ইত্যাদি, ইত্যাদি। এই এক্জিবিট করার কৃৎকৌশলে এখন বহু মানুষই দক্ষ। অনেকেই এই সূত্রে নিজেকে চেনান না শুধু, নিজেকেও চেনেন।যদিও অনেকেই দায়িত্বপূর্ণ ভাবে প্রচার বিমুখ, সচেতনভাবে আত্ম প্রদর্শনে বিমুখ। তবু সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে প্রতিদিন এই সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। অথবা যা এতকাল চাপা ছিল, ঢাকা ছিল তাই সোশ্যাল নেটওয়ার্কস কে ঢাল করে ফুড়ে বেরোচ্ছে। এবং ক্রমশ মধ্যবিত্তের গন্ডি ছাড়িয়ে এ নিম্নবিত্তের, এমনকি গরিব জনতাকেও গ্রাস করেছে। নিজেকে ভালো দেখানোর লোভ, অগ্রগামী জীবন প্রদর্শনের বাসনা। প্রশ্ন হল, যদি কেউ তার ব্যক্তিগত জীবন, ইচ্ছা,ভ্রমণ কিংবা গৌরব প্রচার করেন তাতে আমাদের কি? এটা তার ব্যক্তিগত পছন্দ..! কেউ কেউ বলবেন অতিরিক্ত আত্মপ্রদর্শনেই একটা স্থূলতা আছে এবং যখন সেটা কেবলা-ব্যক্তি প্রদর্শন হয়। আমি সেদিকে হাঁটছি না। আমার বক্তব্য কিছু ভিন্ন। কিভেয় শহর ঘেঁষা একটার পর একটা নগর পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। তবুও আমরা ভালো আছি। মেয়েটির এমএ পাস করার পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়া সত্বেও একটিবারের জন্যও সরকারি চাকরির ইন্টারভিউতে বসার সুযোগ পায়নি, সেও জানাচ্ছে সে ভালো আছে। যে দরিদ্র রিক্সাওয়ালার বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরায় তিনিও জন্মদিনে কেক কাটছেন। লাইক বাগাচ্ছেন। শুভেচ্ছা কুড়োচ্ছে। যে চাকরি থেকে ছাঁটাই হল কি়ংবা বাড়ার বদলে কমল মাহিনা তার ডিপি জুড়ে হাসির ফোয়ারা। যে স্ত্রী সংসারে নিত্যদিন

অপমানিত তার ফেসবুক প্রোফাইলে রামধনুর ছটা দেখলে,কার সাধ্যি সে কথা বোঝে। যে শ্রমিক আটঘন্টার অনেক বেশি সময় বেগার খাটে, সে শ্রম আইনের কথা নয়, দীঘা গিয়ে ডাব খাওয়ার পোজ আপলোড করে। যে নারী পথে লম্পটদের দ্বারা আক্রান্ত সে টিকটক ভিডিও তে‌ মুক্তি খোঁজে। উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই। মোদ্দা কথাটি হচ্ছে আমরা লুকোচ্ছি। আমরা পালাচ্ছি। আমরা আড়ালে চলে যাচ্ছি। মিটিং মিছিলে সমস্বরে প্রতিবাদ করা তো দূর অস্ত! আপদ বিপদের কথা, দুঃখ কষ্টের কথার প্রকাশকে ব্যক্তিগত পরাজয় বলে ভাবছি। নিজেকে কেবলই ব্যক্তি ভাবতে ভাবতে এখন মনে করছি ব্যক্তিগত পরাজয় কেবলি ‘ব্যক্তিগত গ্লানি’ বয়ে আনবে। আমি অন্যের দুঃখে দুঃখিত না হবার চর্চায় এত দূর অগ্রসর হয়েছি যে কেউ যেন প্রতিনিয়ত আমাকে শাসন করে বলছে দুঃখকে কষ্টকে প্রকাশ করা মানেই নিজেকে হীন প্রতিপন্ন করা। নিজেকে হাস্যস্পদ করা। এ এক অদ্ভুত নব্য ফ্যাসাদ যার মধ্য দিয়ে যারা অত্যাচারী তারা দিব্য পার পেয়ে যাচ্ছে। সমাজ সরকার কিংবা রাষ্ট্র তাদের দায় কর্তব্যের ত্রিসীমানায় না থেকেও তেমন অভিযোগে বিদীর্ণ হচ্ছে না। এই নব্য খুড়োর কল কে আমরা কি নামে ডাকবো? আমি যা নয় তাই দেখানো শুধুমাত্র ব্যক্তির ক্ষতি নয় সামাজিক অগ্রগতির পরিপন্থী এই কথাটা সমাজপতিরা জানেন। আর জানেন বলেই তেলের দাম বেড়ে যায়, আর মোবাইলে আগডুম বাগডুম নানা কিছু বিনা পয়সাতেই সম্ভব হয়। জীবনদায়ী ওষুধের দাম বেড়ে যায়, মদের দাম কমে যায়। জানেন বলেই, ভার্চুয়াল আর আসলের ফারাক কে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। আসল আর ভার্চুয়াল কে গুলিয়ে দিতে পারলেই কেল্লাফতে। সত্যিকারের কষ্ট কে মিথ্যাকারের সুখে প্রকাশ করাতে পারলেই পোয়াবারো। নিপীড়িত অসুস্থ অসুখী মানুষ প্রতিবাদ এর বদলে যদি নিজেকে স্বাধীন সুস্থ ও সুখী প্রতিপন্ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তবে তো অত্যাচারীর সোনায় সোহাগা। লক্ষ্য করবেন আজকের পৃথিবীতে কিছু লোক মিটিং মিছিল করে। কিছু লোক সিনেমা থিয়েটার দেখে। কিছু লোক বিকেল সন্ধেয় পয়সা কামায় ।কিছু লোক ফুল ফোটায় রবি ঠাকুরের গান শোনে। গান গাইতে গাইতে মিছিলের দিকে কি কেউ হাঁটছে? মিছিল করতে করতে কেউ কি ফুলের পরিচর্যা করছে? সিনেমা থিয়েটারের মানুষ সত্যি সত্যি কি গর্জে উঠছে? গর্জে উঠতে উঠতে কেউ কি বানিয়ে ফেলছে একটা থিয়েটার? প্রতিবাদের শিল্প ও যেন কতিপয় প্রতিবাদী শিল্পীর আনুষ্ঠানিক আত্মরতি। সবকিছুকেই যেন একটা আনুষ্ঠানিকতায়, প্রাতিষ্ঠানিকতায় বন্দি করে দেওয়া গেছে। এমনই এক শৃঙ্খলা যেখানে প্রতিবাদও রীতিনিষ্ঠ।এ এমনই এক সোনার পাথর বাটি যার ঝিলিকে অলীক কে জীবন বলে‌ মনে হচ্ছে। ফলে শেষত ‘আমি ভালো আছি’ এই বিজ্ঞাপন কেবল আত্মরতির প্রকাশ থাকছে না আর, বকলমের সেই আমাদের ভালো বাঁচবার রাস্তাটিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। সভ্যতা যত এগোচ্ছে শোষণের ভাষা সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হচ্ছে। প্রতিবাদের ভাষাকে সমকালীন আর বুদ্ধিদীপ্ত ধারালো না করলে মুক্তি সুদূরপরাহত। সে ভাষার খোঁজ যে ভীষণ জরুরি এই বিশ্বাস তৈরি হোক!!

নাট্য নিয়ন্ত্রণের পূর্বে ও পরে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ভাবলেন (শেষ পর্ব) - ময়ূরী মিত্র

ময়ূরী মিত্র
 
অতঃপর রঙ্গমঞ্চ ? বুদ্ধিজীবীর না মঞ্চজীবীর 
 
একটি চিঠি লিখেছিলেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর অবরসচিব জে . ক্রফোর্ডকে ( বিচারবিভাগ ,সেপ্টেম্বর, ফাইল নং : ২৩২ ) ৷ চিঠিটির তারিখ ১৮৭৬ এর ১৩ এপ্রিল ৷ সেখানে নাট্য – নিয়ন্ত্রণ আইন প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন –যে দেশের শাসকগোষ্ঠী শাসিতের ভাষা জানে না এবং যখন জাতীয় সাহিত্যের আত্মপ্রকাশ এমনভাবে সুনিশ্চিত হয়ে উঠেছে তখন এই আইন শেষপর্যন্ত সরকারি প্রতিক্রিয়াশীলতায় পরিণত হবে ৷ তিনি আরো বলেছিলেন , ভারতীয়দের ভাষা – রীতিনীতি -পোশাক – ধ্যানধারণা – মূল্যবোধ ইউরোপীয়দের তুলনায় ভিন্ন ধরণের ৷ সুতরাং তাদের দৃষ্টিতে ভারতীয়দের ব্যাখ্যা করার চেষ্টাটাও ভুল ৷ যতীন্দ্রমোহন চিঠিতে যশোরে অনুষ্ঠিত একটি যাত্রাপালার উল্লেখ করে দেখাতে চেয়েছিলেন শুধুমাত্র তথ্যগত ভ্রান্তিতে কীভাবে বিজাতীয় প্রশাসন দেশের সাহিত্য সংস্কৃতির স্বাধীনতা হরণ করতে চলেছে ৷ যদিও সুরেন্দ্র – বিনোদিনী মামলায় সরকার পক্ষের প্রতিটি অভিযোগ ছিল সামাজিক মূল্যবোধ সংক্রান্ত কিন্তু আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না নাটকটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে পুলিশের রিপোর্টে যা বলা হয়েছিল অর্থাৎ দেশে রাজনৈতিক বিদ্বেষের আঁচ ছড়াবার যে সম্ভাবনা দেখানো হয়েছিল সেটাই সরকারকে উদ্বিগ্ন করেছিল সবচেয়ে বেশি ৷ অন্ততপক্ষে হবহাউসের স্বীকারোক্তিতে তা বেশ পরিষ্কার ৷ 
                  যতীন্দ্রমোহনের ভয়ই সত্য হয়েছিল ৷ নাট্য- নিয়ন্ত্রণের শেষ ধারায় বলা হলো :
      Nothing in this act
      applies to any jatras or 
      performances of a like
      kind at religious  
      festivals. 
বাংলা মঞ্চমালিকদের মধ্যে তৈরি হলো নাট্যবিষয় নির্বাচনে রাজনৈতিক ঝুঁকি নেয়ার তীব্র অনীহা ৷ তাতেও থামল না সরকার ৷ মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের কর্তৃত্বে থাকা সাধারণ রঙ্গালয়টির সর্বপ্রকার বাণিজ্যিক ভবিষ্যতটিকে নষ্ট করা হলো নাট্য -নিয়ন্ত্রণের একটি নজিরবিহীন ধারায় –যেখানে রাজনৈতিক নাটক মঞ্চায়নের সাথে সাথে সে নাটক দেখতে আসা দর্শকদেরও সমান শাস্তিযোগ্য বিবেচনা করা হয়েছিল ৷ অতএব নতুন নাট্যবৈশিষ্ট্য ও বদলে যাওয়া দর্শক –দুইয়ের সমীকরণে বঙ্গমঞ্চে শুরু হলো নয়া বাণিজ্যিক ছক ৷ পুরাণ ,রামায়ণ ,মহাভারত এবং আরো নানা ধর্মীয় কাহিনির অনুষঙ্গ এলো নাটক ও নাট্যে ৷ জীবনঘনিষ্ঠ নয় আর –নাটক এবার মঞ্চনিষ্ঠ ৷ নাট্যকাররা তখন আর বুদ্ধিজীবী নয় –মঞ্চজীবী এবং মঞ্চবাণিজ্যের সমান অংশীদার ৷ সাধারণ রঙ্গালয়ের সর্বাঙ্গে তখন সরকারি অনুগ্রহের ছাপ ৷ একটু মজা করে বলা যায় – ১৮৭৬ এর নাট্য-নিয়ন্ত্রণ নামক প্রশাসনিক অভিঘাতে যেন ফুরসৎ পেলেন বাংলার নাট্যকাররা ৷ বঙ্গমঞ্চে তখন রীতিমতো কসরৎ চলছে ব্রিটিশ ভজনার – প্রায় ১৯০১ অব্দি ৷ উদাহরণ — গিরিশচন্দ্রের হীরকজুবিলী এবং আরো আরো …৷ সবচেয়ে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলেন সুরেন্দ্র -বিনোদিনীর নাট্যকার উপেন্দ্রনাথ দাস ৷মুক্তির আটদিনের মধ্যে চড়ে বসলেন বিলেতগামী জাহাজে ৷ উদ্দেশ্য সফল ব্যারিস্টার হওয়া ৷ ইংল্যান্ডে বসেও নাটক লিখেছেন কিছু কিছু ৷ দশবছর বাদে দেশে ফেরার পর বীণা , নিউ ন্যাশনাল রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাঁর ৷ কিন্তু ফিরে পাইনি আর প্রতিবাদী উপেন্দ্রনাথকে —এক বিপ্লবী নাট্যকারকে ৷ 
           অথচ আশ্চর্য ,সেদিনের বাঙালি বুদ্ধিজীবীর অন্তরমহল কিন্তু ঠাণ্ডা হয়ে যায়নি ৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়নি তাঁদের ৷ এমনকি নাট্য – নিয়ন্ত্রণ ঘিরেও সবাক তাঁরা ৷ রাজনৈতিক নাটকে হস্তক্ষেপ যে আদতে একটি সাম্রাজ্যবাদী অভিঘাতকেই প্রবল সামর্থ্যে প্রস্তুত ও প্রয়োগ করা –এতদিনের অর্জিত অভিজ্ঞতায় একথা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাঁদের কাছে ৷ হাইকোর্টের প্রধান অনুবাদক শ্যমচরণ সরকার , আর্যদর্শন সম্পাদক যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যভূষণ ,মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন , রাজেন্দ্রলাল মিত্র ,দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ,কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় –কে না একমত হয়েছিলেন সুরেন্দ্র -বিনোদিনী নাটকটির সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে ৷ 
        না — বাঙালি বুদ্ধিজীবীর রাজনৈতিক সক্রিয়তায় কোনো ছেদ পড়েনি ৷বরং দেখি নাট্য – নিয়ন্ত্রণের পরবর্তীতে মধ্যবিত্ত বাঙালি অগ্রসর হচ্ছেন ব্রাহ্মসমাজ সংস্থাপনায় ,স্বায়ত্তশাসন নির্মাণে অথবা বৃহত্তর কোনো রাজনীতির পন্থা -প্রকরণ বুঝে নিতে ৷ কিন্তু যে নাটকে বাঙালি , হয়ত প্রথমবার, সংস্কার ও দ্বন্দ্ব বিসর্জন দিয়ে অবাধে বেগবান হয়ে উঠেছিলেন ,নাটক লেখার চিরায়ত প্রথা ও অভ্যেস বদলাচ্ছিলেন ,যে নাটক দেশের আগামী রাজনৈতিক আন্দোলনের উজ্জীবক হয়ে কাজ করা শুরু করেছিল সে নাটক বাঙালি পরের পঁচিশ বছরে আর লেখেননি ৷ অন্তত ঊনিশ শতকের শেষ অব্দি তো নয়ই ৷ নাটকে রাজনীতি তখন দূরস্থিত ৷ যদি বা দেখা মেলে তাও অবরেসবরে ৷
 
উৎস নির্দেশ :
 
১. বিপিনচন্দ্র পাল, নবযুগের বাংলা ,বৈশাখ ১৩৬২, যুগযাত্রী প্রকাশক লিমিটেড ৷
 
২.যোগেশচন্দ্র বাগল , মুক্তির সন্ধানে ভারত, তৃতীয় সংস্করণ ,১৩৬৭, অশোক পুস্তকালয় ৷
 
৩. বসন্তকুমার চট্টপাধ্যায় ,জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি ,স. প্রশান্তকুমার পাল ,প্রথম সংস্করণ, ২০০২, সুবর্ণরেখা ৷
 
৪.কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় , ভারতে যবন , ১২৮১, ৩ নং রমানাথ মজুমদারের স্ট্রিট পটলডাঙ্গা নূতন ভারত যন্ত্রে শ্রীরাম নৃসিংহ বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বারা মুদ্রিত ৷
 
৫. জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা প্রবন্ধ –আবেদন না আত্মচেষ্টা ৷ভারতী,২৮ বর্ষ, ষষ্ঠ সংখ্যা ,আশ্বিন ১৩১১ ৷
 
৬.জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা প্রবন্ধ –ভারতবর্ষীয়দিগের রাজনৈতিক স্বাধীনতা , ভারতী, দ্বিতীয় বর্ষ ,অষ্টম সংখ্যা ,অগ্রহায়ণ ,১২৮৫ ৷ 
 
৭.রাজনারায়ন বসু ,সে কাল আর এ কাল , নির্বাচিত বাংলা রচনা সংগ্রহ ৷
 
৮. Albion Raj Kumar Banerjee, An Indian Pathfinder ,being the memories of Sebabrata Sasipada Banerji (1840-1924 ) ,Kemp Hall Press, Oxford .
 
৯ . জলধর সেন ,কাঙ্গাল হরিনাথ , ‘ ভূমিকা ‘ র তারিখ : ১৫ আশ্বিন ,১৩২০, বেঙ্গল মেডিকেল লাইব্রেরী ৷

যাপিত নাট্য: ফিরে দেখা ইতিহাসের অলিগলির দ্বিতীয় কিস্তি লিখলেন - কুন্তল মুখোপাধ্যায়

কুন্তল মুখোপাধ্যায়

১৯৬১ সালে আমি পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় মা-বাবার কাছে চলে আসি। আসার সময় দাদুকে আমি প্রথম কাঁদতে দেখলাম। ঘোড়ার গাড়ির পেছনের কাঁচের জানালা দিয়ে দেখলাম দাদু ভিখু ঘোষের বাড়ির দালানের সামনে গলির মোড়ে আস্তে আস্তে বসে পড়লো। অনেক পরে যখন অপুর সংসার দেখছি, তখন এই কাজল আর অপুর মিলন দৃশ্যে যে দূরে নদীর ধার বরাবর বাড়ির পাঁচিলের বাইরে কাজলের দাদুর অপসৃয়মাণ ছবি আমাকে বারেবারে আমার দাদুর কথা মনে করিয়ে দিত। কলকাতায় এসে উঠলাম মানিকতলার বলদেও পাড়া রোডে শান্তি জেঠুদের বাড়িতে। দু কামরার ভাড়াটে হয়ে। বোনটি, মা, বাবা আগের থেকেই ওই বাড়িতে ছিল, আমার সঙ্গে এসেছিলেন মা’র বিধবা মেজ পিসি, আমাদের দিদিমণি। কলকাতায় এসে, বাবা আমাকে মিত্র ইনস্টিটউশন (মেন)-এ ক্লাস ফাইভে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। স্কুলে মনিলাল, প্রশান্ত, নিখিল, (অভিনেত্রী তন্দ্রা বর্মনের ভাই) সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়েছিল। ভিতরে স্কুলের বাধানো চাতালে আমি প্রথম পায়বল (ছোট টেনিস বল দিয়ে ফুটবল) খেলি, আর বহরমপুরের প্রচলিত অভ্যেস অনুযায়ী ঘুড়ি কেটে গেলে ভৌ কাট্টা না বলে ‘দূররে’ বলার জন্য বন্ধুদের কাছে আমি ধূররে হয়ে উঠি। স্কুলে দেববাবুর নির্দেশনায় ”জুতা আবিষ্কার”  নাটকে আমি অভিনয় করেছিলাম, সঙ্গে ছিল চলচ্চিত্রের শিশু শিল্পী তরুণ (মানিক সিনেমা খ্যাত)। এই অভিনয় হয়েছিল ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে। বলদেও পাড়া রোডেই আমি প্রথম নাগরিক আধুনিকতার ছোঁয়া পাই। তরুণদের বাড়িতেই প্রথম গ্রামাফোন শুনি। সাত ভাই চম্পা আর ও নদী রে-র গায়ক-গায়িকাদের কণ্ঠের সঙ্গে পরিচিত হই। তরুণদের বাড়ির উঠোনেই মঞ্চ বেঁধে সিরাজদৌল্লা নাটক হয়েছিল। সিরাজ, দীপঙ্কর সাহেব, আর আমি মোহনলাল সেজে ছিলাম। এই সময় শ্যামবাজারে টকি শো হাউসে আমি ”আইভ্যান হো” আর রাধার মর্নিং শো-এ ট্রোজান ওয়ার, বেনহুর সিনেমা দেখেছিলাম। মিনার্ভা থিয়েটার হলে সত্য বন্দ্যাপাধ্যায়ের (বড়) শেষ থেকে শুরু, আর উৎপল দত্তের ‘অঙ্গার’, আর জোছন দস্তিদারের দুই মহল নাটক, বিশ্বরূপায় দেখেছিলাম শম্ভু মিত্রের কাঞ্চন রঙ্গ। এই সময় বিশেষ অভিনেতার নাম দিয়েই নাটকগুলির পরিচিতি ছিল, পরে জেনেছি এই নাট্যগুলি ইঙ্গিত, এলটিজি, রূপান্তরী, বহুরূপী নাট্য সম্প্রদায়ের প্রযোজনা ছিল। নাটকগুলির মধ্যে কাঞ্চনরঙ্গ দেখে খুব মজা পেয়েছিলাম, তবে চমকে গিয়েছিলাম অঙ্গার দেখে। খনিতে জল ঢুকছে, খনি শ্রমিকদের আর্তনাদ আর বিনুর মা (শোভা সেন)র বিনুর জন্য প্রতীক্ষার ছবিটা এখনও মনে গেঁথে আছে। ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির পাশে ধানুমাসি, পাতু মাসির মায়ের চাটাইয়ের উপরে পা ছড়িয়ে হারিয়ে যাওয়া ছেলে হাবুর শোকে উদ্বেল হয়ে চীৎকার করে হাবুরে – কুন্টি গেলি রে বলে আর্তনাদের ছবিটা শব্দহীন হয়ে যেন ফুটে উঠতো শোভা সেনের অভিনয় ভঙ্গিমায়। এক বছর পরেই আমরা শিয়ালদহে অখিল মিস্ত্রী লেনে একটা দোতলা বাড়ির একতলাটা পুরো ভাড়া নিয়ে চলে আসি। এই বাড়ি থেকে স্কুলের দারোয়ান ফিরিঙ্গি আমায় স্কুলে নিয়ে যাওয়া আসা করতো। ফিরিঙ্গি টিফিনের সময় শোনপাপড়ি বিক্রি করতো, আমি প্রায় দিনই লোভাতুর নির্নিমেষ নয়নে শোনপাপড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু ফিরিঙ্গি আমায় পাত্তাই দিতো না। আমি তখন বহরমপুরের দেখা অভিনয়ে করুণা মামা যেমন পৈতে টেনে আঙ্গুল মটকে অভিশাপ দেবার মুখভঙ্গি করতেন, তেমনই করতামমা, বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝে কলেজ স্কোয়ারে বেড়াতে যেতাম। বিদ্যাসাগরের মূর্তির বাম পাশের চাতালে বসতো কথকতার আসর, অনেকদিন ওখানে বসে রামায়ণ- মহাভারত পাঠ শুনতাম, আর মনে পড়তো বহরমপুরের মামা বাড়ির উঠোনে মিন্টু মামার বাবা শংকর বাগচী দাদুর সঙ্গে হাত নেড়ে নেড়ে এসেছে নিমাই নাচিয়া নাচিয়া  বলে কীর্তন গাওয়া আর হরির লুঠের কথা, বা বহরমপুরের ফকিরী গানের কথা। পরে বুঝেছি, এই সবের প্রীত আকর্ষণ, নতুন ভাবে পুরোনো কথা বলার প্রতি মনোযোগ – আমার নাট্য কৌতুহলকে সমৃদ্ধ করেছে। কথায় কথায় শ্রদ্ধেয় মনোজ মিত্রও বলতেন

দেশ ভাগের পর বসিরহাটে দণ্ডীর হাটে – তার দেখা এই সব খণ্ড খণ্ড চালচিত্রই পরবর্তীতে তার নাটকের উপাদান হয়ে উঠেছে। শিয়ালদহে ৬২ নং অখিল মিস্ত্রী লেনে আমাদের পাশের ৬১ নং বাড়িতে থাকতো মা’র সহপাঠী উমা মাসীরা। উমা মাসির ছোট ভাই বাবুল মামা আর বোন ঝুনু মাসি ছিল আমার আর বোনটির আদর্শ। ঝুনু মাসি নাচের স্কুলে সীতার বনবাস নৃত্যনাট্যে হনুমান সেজেছিল, আমিও ঝুনু মাসিকে নকল করে ৬২নং বাড়ির দোতলায় সিড়ি থেকে প্রায়ই লাফ দিয়ে, হনুমানের মত মুখ ভঙ্গী করতাম, সঙ্গে ছুটে গিয়ে ছিল বোনটি, আর ওপরে খোকন ও টুনু। দোতলার শ্রীনিবাসদাদু একদিন আমাদের দেখে হেসে বলেছিলেন, “তোরা যে এখনও কিষ্কিন্ধা কাণ্ডে পড়ে রইলি” তারপর ওই কাজে ইিত। ৬১-৬২ সালে কলকাতার কোচিং সেন্টার তেমন না থাকলেও, গান-নাচ-আঁকা শেখানোর স্কুল ছিল। না, আবৃত্তি শেখানোর স্কুল বোধহয় ছিল না। ১৯৬২ সালে চীন-ভারতের যুদ্ধ হয়েছিল। ছোটো বেলায় শোনা “হিন্দী –চিনি ভাই ভাই” এর ভাবনা অন্তহিত হয়েছিল রেডিও শুনে খুব মনখারাপ হত। এই সময় রঙমহলে ‘সীমান্তের ডাক’ বলে একটা নাটক দেখেছিলাম, তাছাড়া সেই বছরেই বিশ্বরূপায় মন্মথ রায়ের কারাগার, আর রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিত পাষাণ দেখি। বাবার কাছে শুনেছিলাম সেই সময় মুক্তাঙ্গন রঙ্গালয়ে অনেক ভালো নাটক হত, কিন্তু দূরত্বের জন্য ওই বয়সে ওখানে আমার যাওয়া হয়নি। এই সময় বাবার বন্ধু বিশ্বনাথ সেনগুপ্ত, বিরাটি হাই স্কুলের ইংরেজির টিচার আমার বিশু জ্যেঠা আমায় সাহিত্য পড়ানোর ভার নেন। মফঃস্বল থেকে আসা শুধু ইংরেজি বর্ণমালা চেনা এক কিশোরকে ক্রমেই তিনি ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের রসসাগরে অবগাহন করতে শেখালেন। বিশু জ্যেঠাই আমাকে চার্লস ল্যাম্বের টেইলস্ ফ্রম শেকসপীয়র, র্যাডিয়ান্ট রিডার পড়তে শেখালেন, বিভূতিভূষণের আম আটির ভেঁপু, রবীন্দ্রনাথের ছুটি, অতিথি, বলাই পড়ালেন, হাতে ধরালেন অবনী ঠাকুরের বুড়ো অ্যাংল রাজকাহিনী। আমার কল্পনার জগৎ, ভাবনার দিশা আরও বিস্তূত হলো। সেই সময়ই কোনো এক ছুটির দিনে বিশু জ্যেঠা আমাকে রয়াল শেক্সপীয়র গ্রুপের, মিড্ সামার নাইটস্ ড্রীম নাটকটি দেখান, কোন মঞ্জে সেটা এখন মনে নেই, শুধু মুগ্ধতার কথাই মনে আছে। কত রাত যে পাক্ আর বটম্ কে স্বপ্নে দেখেছি, তা গুনে শেষ করা যাবে না। অনেক পরে এই তো সেদিন নোটো ভাই তরুণ প্রধানের নির্দেশনায় রবীন্দ্রভারতী নাট্য বিভাগের রের্পাটারি প্রযোজনা ফাগুন রাত্রের গল্প দেখেও সেই মুগ্ধতা ফিরে পেয়েছিলাম। শিয়ালদহ ছেড়ে আমরা দমদমে সেন্টার সিঁথি হাউজিং এস্টেটে এসে উঠি ১৯৬৪ সালের কোন এপ্রিলের বিকেলে। সেই দিনই সকালে ওই কোর্য়াটার্সে এসে উঠেছিলেন গানের জগতের পণ্ডিত পবিত্র দাসগুপ্তের পরিবার। পবিত্রবাবুর ছেলে স্বপুদা আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড় হলেও, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, স্বপুদার বোন মুনমুন, পরে নামকরা রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী স্বাগতালক্ষ্মী দাসগুপ্ত, চিরদিনই আমার ছোট বোনের মত। ৬৪ সালের ওই গভঃ হাউজিং এস্টেটে, দমদম অঞ্চলে প্রথম গর্ভমেন্ট কোর্য়াটার্স এবং এখন অবিশ্বাস্য মনে হলেও সেই সময়ে প্রায় শতাধিক পরিবার ছিল যেন একটা এক্সেটেন্ডেড ফ্যামিলি। একসঙ্গে দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজো, রবীন্দ্রজয়ন্তী, বার্ষিক দু-টো নাটক অভিনয় বাঁধা ছিল। ছোটদের মধ্যে আমি, বাবলি, মানা (ডঃ প্রশান্ত), সঞ্জয়, সন্দীপ, নান্টু, পলু, কল্যাণ, সুনীল, স্বপুদার নির্দেশনায়, বিনিপয়সার ভোজ, চারমূর্তি, চাঁদা বিভ্রাট অভিনয় করি এবং পিঠ চাপড়ানি পায়। এই সময় ছ’মাস দমদমের কুমার আশুতোষ ইনস্টিটিউট স্কুলে পড়ার পর আমি শিয়ালদহ আর রাজাবাজারের মাঝামাঝি টাকী হাউস গভঃস্পনসর্ড মাল্টিপারপাস স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হই। সেই বছরই স্কুল আর তার শিক্ষককুল দেবতোষবাবু, যতীনবাবু, জয়ন্তবাবু, অশোকবাবু ও হেড স্যার কানাইলাল মুখার্জী আমার সামনে পড়াশোনা আর সংস্কৃতি চর্চার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছিলেন।

"মেয়েদের আত্মসম্মান এবং বাংলা সিরিয়াল" সম্মানের কথা স্মরণ করালেন - পিকু দাশগুপ্ত

পিকু দাশগুপ্ত

।।নারীর আত্মসম্মান এবং বাংলা সিরিয়াল।।

প্রতি বছরের মতো ৮ ই মার্চ আরও একবার ফিরে এলো। ইন্টারন্যাশানাল উইমেন্স ডে তে অনেক সভা- সমিতি আলাপ আলোচনা হল যথারীতি। এই বিশেষ দিনটি আমরা পালন করলাম সমান অধিকারের দাবিতে।নারীর সক্ষমতা, সমমান কার্যকরী করার দাবিতে। কেননা আমরা এই দিনের শপথ হিসেবে নিলাম- ‘Without gender equality today, a sustainable future and an equal future remains beyond our reach’ কলকাতা থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটি সরকারি কলেজে আমি দীর্ঘদিন ধরে অধ্যাপনা করছি। এবং সেই সুবাদে ওই অঞ্চলের ছোট ছোট মেয়েদের ছাত্রী হিসেবে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। সেই মেয়েগুলি যখন এই বিশেষ দিনটিতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করল। কবিতা বলল, গান করল, তখন নিজেরা খানিকটা আশ্বস্ত হলাম এই ভেবে যে ক্লাস রুমের নির্দিষ্ট সিলেবাসের বাইরে গিয়েও ওরা কিছুটা আত্মবিশ্বাসী হতে পেরেছে। মনে হল ওরা পারবে প্রতিকূলতাকে জয় করে এগোতে। ওদের ওপর ভরসা করতে ইচ্ছে হলো। সত্যি কথা এসব দেখলে মনে হয়, আমাদের প্রতিদিনের শ্রম পন্ডশ্রম হয়নি। মনে হল হতাশার অন্ধকারে ওরা আশার আলোর ফুলকি। কিন্তু এত কিছুর পরেও বাড়িতে যখন সন্ধ্যেবেলায় টিভি চলে। নিয়ম করে না হলেও কৌতুক বসত যখন মাঝে মাঝে সিরিয়ালে চোখ রাখি, তখন কিন্তু একেবারে অন্য একটা জিনিস মালুম হয়। আশঙ্কার কালো মেঘ ছেঁকে ধরে। আপাতদৃষ্টিতে বাংলা সিরিয়ালের কেন্দ্রে রয়েছে এক নারী চরিত্র। ফিমেল‌ প্রোটাগনিষ্ট দেখে কি আমরা খুশি হবো? এটা ভাববো যে সমাজ অনেকটা বদলেছে,তাই সিরিয়াল গুলি নারীকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে! কখনো শ্রীময়ী যমুনা ফুলঝুরি কিংবা ফড়িং – এদের নিয়ে কি আমরা উৎফুল্লিত হব? চরিত্রগুলির জীবন সংগ্রাম জীবনের ওঠাপড়া জীবনদর্শন এগুলি কি খুবই আশাব্যঞ্জক? সিরিয়াল গুলির একটু গভীরে গেলেই উত্তর হবে নেতিবাচক। আর মনে হবে আমার চারপাশে থাকা মহিলাদের যে সত্যিকারের লড়াই, জেনুইন স্ট্রাগল,- তাদের যে চারিত্রিক দৃঢ়তা, তাদের যে স্বাবলম্বী হওয়ার জার্নি, আমার কলেজেরই পুঁচকে পুচকে মেয়ে গুলির মতো- সেটা কোথাও সিরিয়ালে প্রতিফলিত হচ্ছে না। সমস্ত সিরিয়ালের গল্পে যে নারী চরিত্র তাদের শুধু যে কোনোভাবে একটা বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি অসম বিয়ের কাহিনী দিয়ে তৈরি হচ্ছে সিরিয়াল। শহুরে শিক্ষিত ও বিত্তবান নায়ক সে কোনভাবে একটি গ্রামে গিয়ে পড়ল। সেখানে অশিক্ষিত গ্রাম্য একটি মেয়েকে বিয়ে করল এবং শুরু হল সেই মেয়েটির নতুন শ্বশুরবাড়িতে আদর্শ গৃহবধূ হয়ে ওঠার কাহিনী। আর এই বিয়ের প্ল্যান গুলি অনেক ক্ষেত্রেই একই রকম প্রেডিক্টেবল। কখনো উড়ে গিয়ে মাথায় সিঁদুর পড়ছে, কোথাও জোর করে মেয়েটিকে সিঁদুর পরানো হলো। অথবা কোন একটি পরিস্থিতির থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য বিয়ে হয়ে গেল। অর্থাৎ কয়েকটি এপিসোড দেখার পর যেকোনো বাংলা সিরিয়ালের গল্পের গতি কোন দিকে যাবে তা সহজেই অনুমান করে নেওয়া যায়। সিরিয়ালের ফিমেল প্রোটাগনিস্ট কেউ শরীরচর্চা করে ,কেউ ঢাক বাজাতে পারে, কেউ মিষ্টি বানাতে পারে, কিন্তু আসলে তাদের নিয়ে গিয়ে ফেলা হলো একটি বিয়ের সিনে,যা মোটামুটি দু সপ্তাহ ধরে দেখানো হবে!! এরপরই শুরু হবে মেয়েটির ভালো বউ হয়ে ওঠার গল্প।একটি মেয়ের যতই প্রতিভা থাকুক না কেন, সে যতই প্রতিবাদী সত্তায় সঞ্জীবিত হোক না কেন; তার পরিত্রাতা শুধু একজন পুরুষ মানুষের হাতেই। এবং সেটা একমাত্র বিয়ে করেই পাওয়া সম্ভব। একটি মেয়ের আত্মসম্মান, তার স্বাবলম্বী হওয়ার ইচ্ছে – এসব কখনোই সিরিয়াল গুলির কেন্দ্রে থাকবে না। আসল কাহিনী বিন্যাস তৈরি হচ্ছে শুধু কিভাবে এই গ্রামের

অথবা তথাকথিত আর্থ সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা মেয়েটি তার নতুন বিত্তশালী শ্বশুরবাড়িতে ভালো বউ হয়ে ওঠার পরীক্ষায় পাশ করেছে !!! আর কি কোন রাস্তায় দেখানো যায় না? এটা কি শুধু আমাদের চিন্তার দৈন্যতা, নাকি সমাজ আজ নারীদের শুধুমাত্র এই বিয়ের ইনস্টিটিউশন এর মধ্য দিয়েই যাচাই করতে চায়? তাহলে আমাদের উইমেন্স স্টাডিজ, জেন্ডার ইকুয়ালিটির পাঠ- প্রত্যন্ত গ্রামের ছোট ছোট মেয়েদের স্বপ্নগুলি সবই বুঝি বৃথা যাবে! এর পাশাপাশি আরও একটি বিভেদ হামেশাই দেখা যায়,- গ্রাম এবং শহরের বিভেদ। গ্রামের মেয়েটি অর্ধশিক্ষিত অথবা মূর্খ অদ্ভুত ভাবে কথা বলে। তার অন্য রকমের পোশাক পরিচ্ছদ, সে খুব সরল সাদাসিদে। আর অন্যদিকে শহুরে মানুষ যারা সবসময়ই ম্যানুপুলেটর , জেলাস ইন্সেন্সিটিভ। এই দুই এর লড়াই চলতেই থাকে। যদিও সব সময় গ্রামের মেয়েটি আসলে অ্যাচিভ করতে চায় শহরেরই ভাষা, শহরেরই আদব-কায়দা তাদের পোশাক আশাক। কিন্তু আমার দেখা গ্রাম ও শহর এর সাথে এ অভিজ্ঞতা মোটেও মেলে না। সূক্ষ্মভাবে তাহলে এই বিভেদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এরপর ওই সদ্য বিয়ে হওয়া মেয়ে যখন শ্বশুর বাড়িতে এলো,তখন সর্বক্ষেত্রেই এখানকার মহিলা সদস্যরা তাকে হেনস্থা করবার চেষ্টা করেই চলল। তাদের যেন আর কোন কাজ নেই। অন্য কোন ইনভেস্টমেন্ট নেই। তারা প্রতিনিয়ত নানা ভাবে শুধু মেয়েটিকে বিপদে ফেলে চলেছে। এখানেও মেয়েদেরকে মেয়েদের শত্রু করে তোলা হলো। বকলমে ঘুরেফিরে নারীকে কেন্দ্র করে যে কাহিনী তাতে নারীদেরই অপমান করা গেল। এরপর যদি নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী তা বা স্বাধিকারের প্রশ্নে এসে দেখি, সেখানেও এই বাংলা সিরিয়াল গুলি অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল। আমরা প্রতিনিয়ত যেখানে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হওয়ার পাঠ দিচ্ছি আমাদের মেয়েদের, তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মেয়েদের বোঝানোর চেষ্টা করছি নিরন্তর‌। সাহস দিচ্ছি উৎসাহ দিচ্ছি। কিন্তু কখনো এসবের প্রতিফলন বাংলা সিরিয়ালে দেখতে পাচ্ছি না। এগুলি শুধুই মূল পুরুষ চরিত্রের সঙ্গে মূল নারী চরিত্রের বিয়ে দেওয়া এবং সেটিই মেয়েটির একমাত্র ভবিষ্যৎ এভাবেই চিত্রিত হচ্ছে। কখনো কোনো বাংলা সিরিয়ালে কোন স্বাবলম্বী মহিলা যথার্থ অর্থে আত্মনির্ভর কর্মতৎপর মহিলা কে দেখিনা। থাকলেও তার পেছনে একটা পুরুষের ভূমিকা থেকেই যায়। তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা আমাদের চিন্তায়, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। তাই ভালো মেয়ে মানে প্যারাসাইট, টিমিড, ভালো বউ- তবেই টিআরপি ওপরে ওঠে বিজ্ঞাপন বেশি মেলে ইত্যাদি। তাহলে কি নারীর সাফল্য সমাজ পছন্দ করে না? কিন্তু সেটা কি ঠিক? এই সিরিয়াল গুলি দিয়েই আবার নারীকে অন্যদিকে সুপার ওমেন হিসেবে প্রজেক্ট করা হচ্ছে। দেখবেন যে কোনো ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই তারা গান গাইতে পারছে, দুর্দান্ত রান্না চটপট করে ফেলতে পারছে, সবরকম পুজো আচার-অনুষ্ঠান একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটাতে পারছে। সবই যে পারে দক্ষতার সাথে কিন্তু সে সমস্ত রকম নিগ্রহ আবার মুখ বুজে সহ্যও করে। কারন সে নিজেও জানে এসবের ঊর্ধ্বে আছে তার ভালো বউ হয়ে ওঠার আইডেন্টিটি।অর্থাৎ একদিকে সে সফল কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে তাকে স্বাবলম্বী দেখানো হবে না। প্রতিনিয়ত ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স দেখানো হবে এবং সেটা উপভোক্তারা ভালোই উপভোগ করবেন। তার মানে নারী সর্ব্বগুণসম্পন্ন সর্বংসহা নিখুঁত এটাই প্রতিদিন দেখানো হবে। আর যদিও বা কোন নারী চরিত্র শ্রীময়ীর মতন একা লড়াই করার সাহস দেখান সেখানেও হাজির করা হবে রোহিত সেন নামক চরিত্র যে কিনা, বিপদতারণের ভূমিকা নিয়ে সমস্ত সমস্যার ক্ষেত্রে শ্রীময়ীর একমাত্র ভরসার স্থল হয়ে উঠবে। অর্থাৎ দিনের শেষে নারী-পুরুষের ওপর সর্বতোভাবে ডিপেন্ডেন্ট। তাকে প্রতি পদে পুরুষ মানুষের ছত্রছায়ায় থেকেই বাঁচতে হবে। সে কাজের ক্ষেত্রেই হোক (রোহিত সেন এর বিরাট অফিসের দায়িত্বে শ্রীময়ী) অথবা সাংসারিক কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেই হোক, সবসময়ই Damsel and Distress Theory। তাই সব সময় নারী অবলা, পুরুষ পরিত্রাতা। পরিত্রাতা হিসেবে পুরুষ বন্ধুকে মেনে নিতে অসুবিধে নেই।কিন্তু সেটি আসছে একমাত্র বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠান মধ্য দিয়ে। কখনো নারীর বাবা, ভাই এমনকি সন্তান সেই সুরাহা দিতে পারছে না। অন্যদিকে নারীর লড়াইয়ে বন্ধু হিসেবে সমমনা আরো নারীদের একত্রিত হওয়ার ঘটনাও সিরিয়ালে চোখে পড়ে না।তাহলে খুব সুচতুরভাবে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানেই নারীর একমাত্র মুক্তি এটি বারবার জনপ্রিয় মাধ্যমে হাজির করার অর্থ একটা পুরুষ প্রধান রাজনীতি।তাই নয় কি? আরেকটা কমন জিনিস সব সময় চোখে পড়ে সেটি হল সিরিয়াল গুলি পুরুষ চরিত্র,নায়ক চরিত্রের এক বান্ধবী আছে যাকে কিনা সে বিয়ে করবে ভেবেছিল কিন্তু ঘটনাচক্রে গ্রামের মেয়েটিকে সে বিয়ে করল। (লক্ষ্য করবেন সবই বিয়ে এবং বিয়ে কেন্দ্রিক)। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় তাহলে সমাজের এই পুরুষ মানুষদের কি সত্যিই কোন চারিত্রিক দৃঢ়তা নেই? কোন কমিটমেন্ট ট্রান্সপারেন্সি কি এদের ক্ষেত্রে অলীক? এটা সমাজের পুরুষদের কম অপমান করা হয় না। আমাদের চারপাশের দেখা সমস্ত পুরুষ চরিত্র গুলি কি এইরকম? বোধ হয় না। এই নানান স্তরের Dichotomy নিয়ে বাংলা সিরিয়াল আজ আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সমাজ কি সত্যিই কখনো মেয়েদের সঠিক ভাবে স্বাবলম্বী দেখতে চেয়েছে? তাদের প্রকৃত অর্থে আত্মনির্ভর দৃঢ়চেতা একজন মানুষ হিসেবে গ্রহণ করতে পেরেছে? আসলে আমরা নারীকে একটা পরনির্ভরশীল হাস্যকর ‘সুপারম্যান’ করে দেখতে চাই। কিছুক্ষণের জন্য আমরা উমা, মিঠাই ফড়িং, তুবড়ি দের দেখতে দেখতে ভাবি তারা কেমন সবাইকে জব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে। আসলে তো নারীদের অপমানের পর আরো প্রশস্ত হচ্ছে। লড়াই বাস্তবে আরো কঠিন হচ্ছে।নারীর ক্ষমতায়ন অনেক সুপারফিসিয়াল থেকে যাচ্ছে। লেখার শেষে আরো একবার আমার ক্লাসরুমে প্রতিদিন বসে থাকা মেয়েগুলির মুখ ভেসে উঠল। ওর আর আমরা পারব তো ইন্টারন্যাশনাল ওয়মেন্স ডে এরঅঙ্গীকারকে কিছুটা হলেও কার্যকরী করে তুলতে? সেই কণ্টকাকীর্ণ কিন্তু আত্মসম্মানের পথে পা বাড়াতে??

‘কোনো প্রতিষ্ঠানই পারে না প্রকৃত সত্যের সঙ্গে যুঝতে’ বুদ্ধিজীবীর ময়নাতদন্ত দেখে মন্তব্য করলেন - সায়ন ভট্টাচার্য

সায়ন ভট্টাচার্য
 
একটা চিন্তাশীল প্রশ্নই হয়ে ওঠে রাষ্ট্র বিরোধীতার নামান্তর
 
কোনও প্রতিষ্ঠানই পারে না সম্পূর্ণ সত্যের সামনা সামনি গিয়ে দাঁড়াতে, বরং সে কতগুলো দৃষ্টিভঙ্গি সাজায় নিজের সুবিধা অনুযায়ী। আর এই সুবিধা থেকে জন্ম নিতে থাকে ক্ষমতার শোষনমূলক রাজনীতি। কিন্তু যিনি দার্শনিক বা বুদ্ধিজীবী তাঁর চিন্তার খন্ডিত মানচিত্রের কোনও লক্ষণরেখা থাকবে না। গোটা বিশ্বটাই তাঁর কাছে যেন একটা মান(ব)চিত্র। ঠিক এই ভাবনা থেকেই ২৩শে এপ্রিল তপন থিয়েটারের পর্দা সরে গেল – মঞ্চে ‘প্রাচ্য’ প্রযোজিত ‘বুদ্ধিজীবীর ময়নাতদন্ত’, নির্দেশনা রাজীব বর্ধন, প্রযোজনা উপদেশক বিপ্লব বন্দোপাধ্যায়। জি.পি.দেশপান্ডের ‘অন্ধযুগের মানুষ’ অনুবাদ ও পরিমার্জনার মধ্যে দিয়ে অশোক মুখোপাধ্যায় তৈরি করলেন ‘বুদ্ধিজীবীর ময়নাতদন্ত’। 
একজন বুদ্ধিজীবী কে? সমাজে তার প্রয়োজন কি সত্যিই আছে না নেই? নাকি বুদ্ধিজীবী এই রাজনৈতিক পদে রূপান্তরিত এক অবস্থা মাত্র! একটা নাটকের গতিপথ বার বার এই প্রশ্নগুলোর দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো। 
 
এই নাটক শেষ পর্যন্ত খুঁজে নিলো মানবতাবাদের কথা। বুঝতে চাইলো মানুষের কথা, চাষীর ভাষা, শ্রমিকের ভাষা। 
শাশ্বত ব্যানার্জি এই নাটকের কেন্দ্রীয় কন্ঠস্বর। যিনি সবার হয়ে কথা বলতে চান কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যান সেই একাকীত্বে। আমি কন্ঠস্বরই বললাম , চরিত্র নয়। পেশায় অধ্যাপক শাশ্বতর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ট্রায়ালের আয়জন করা হয়েছে। কারণ মঞ্চের পর্দা মুক্ত হতেই অদৃশ্য ‘ম্যাডাম’এর ফোন কলে নির্দেশ আসছে একজন প্রগতিশীল শিক্ষকের বিরুদ্ধে। আসলে ছাত্রদরদী, চিন্তা উদ্রেককারী মানুষগুলো সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে খুব। গোটা দেশ জুড়ে শিল্প সাহিত্য বিজ্ঞান সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে প্রগতিশীলদের প্রতি এক তীব্র অবজ্ঞা। কারণ এরা প্রশ্ন করে। 
 
 যে একলা মানুষের খোঁজ এই নাটক করে চলেছে, যাঁকে আমরা একক এবং একমাত্র বলে অভিহিত করতে পারি সে আসলে আপনি আমি বা আমাদের চারপাশ ছাড়া আর কিছুই নয় । সংসার থেকে, সমাজ থেকে, প্রেম থেকে জীবনের প্রায় প্রতিটি পর্যায়ে এমনকি কর্মজীবনে তিনি যে ইউনিভার্সিটির সঙ্গে জড়িত সেখান থেকেও তাঁর নির্বাসন ঘটে, সেখান থেকেও তিনি একা হয়ে যান শেষ পর্যন্ত। বৃহত্তর অর্থে একজন চিন্তাশীল কিভাবে সাব-অল্টার্ন হয়ে যায় নাটকের পরতে পরতে তার উন্মোচন। 
 
একজন মার্কসবাদী আদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষক, যিনি তার আদর্শ ও অঙ্গীকারে ছাত্র জীবন থেকেই দৃঢ়, মুখোমুখি হচ্ছেন একটি তদন্তের। 
তরুণ বয়সে মার্কসবাদী পার্টির চাপিয়ে দেওয়া নীতিরও যেমন বিরোধীতা করেছেন তেমনই পরবর্তীকালে দক্ষিণপন্থী শাসনের নগ্ন ক্ষমতার বিরুদ্ধে সামনে দাঁড়াতে কুন্ঠা বোধ করেন নি।
সেই অপমানকর বিচারশালায় তার বিরুদ্ধে তুলে ধরা হয় বিভিন্ন অভিযোগ।
অদৃশ্য চাবুকে তাকে আঘাত করা হয় প্রতিনিয়ত। ব্যক্তিগত অতীতকে সামনে এনে যেন রচনা করা হয় অপমান, বিশ্বাসঘাতকতা এবং ব্যর্থতার একটি দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক গল্প।
এই নাটকের মাধ্যমে আমরা তারও সন্ধান পেলাম একজন পাওলো ফ্রেইরির স্বপ্নের ‘বৈপ্লবিক শিক্ষক’ শাশ্বত কে ।
 
সমস্ত অবদমনের বিরুদ্ধে সেই একক মানুষের জীবনযাত্রা কেমন, সেই একক মানুষের ভাবনাচিন্তা কেমন সেই খোঁজ এবং একইসঙ্গে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক চেষ্টা বা যিনি দাঁড়ান তাঁকে কিভাবে এই সোসাইটি এই রাষ্ট্র একা করে দেয়, এই নাটক যেন হয়ে ওঠে তার দলিল ।
যে সমাজে ব্যক্তিস্বাধীনতা, গণতন্ত্রের মত অধিকারমূলক শব্দের অর্থ খুঁজতে আমাদের বারংবার অভিধান ঘাঁটতে হয়, সেই সমাজে দাঁড়িয়ে মানুষের বেঁচে থাকার অভিনয় করে যেতে হয়, আর লড়াইয়ে টিকে থাকা মানুষকে প্ররোচিত করে ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যেতে। না হলে সে যেকোনও মুহূর্তে নগ্ন করে দিতে পারে শাসকের চরিত্র। 
মঞ্চের অঙ্গসজ্জায় ব্যকড্রপে বড় বড় মার্ক্সের নোটবইযের় চিত্র থেকে সালভাডোর দালির ‘পারসিসটেন্স অফ মেমারি’ আমাদের গলে যাওয়া পচে যাওয়া মানবতার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদভাষ্য চিহ্নিত করে নাটকের মুহূর্তগুলিতে। অমিত চ্যাটার্জি, বুদ্ধদেব দাস, সুব্রত ভট্টাচার্য, সৃজিতা দত্ত, অর্ঘ্য মুখার্জি, ভাস্বতী মুখার্জি ও ঝুমুর সাহা প্রত্যেকে অতীত ও বর্তমান চরিত্রের অংশ রূপে নিজেদের সংযোগ সেতু রূপে প্রকাশ করেছেন।
 
 অধ্যযাপকের ভূমিকায় লোকনাথ দে অবশ্যই কেন্দ্রীয় চরিত্র এবং তার শরীরের ব্যবহার , মুখের অভিব্যক্তি ও সেই সঙ্গে সংলাপের মধ্যে দিয়ে অতীত ও বর্তমানে যাত্রা যেন এক বহুমুখী সত্তার রেখাচিত্র তৈরি করছিল। অন্যদিকে শাসক দলের প্রতিনিধি অধ্যাপক চ্যাটার্জীর ভূমিকায় বুদ্ধদেব দাসের অভিনয় যথার্থ ভাবে কাউন্টার করেছে একজন প্রগতিশীলের বিরুদ্ধে ক্ষমতার দম্ভকে। দিনের থেকে আমাদের রাজ্য দেশ কিংবা গোটা দেশ যে দিকে যাচ্ছে – সেখানে কন্ঠস্বর কিংবা চিন্তাই হয়ে উঠবে বিপন্ন এক প্রকাশ । এই নাটক যেন আমাদের একটা সাবধান সংকেত দেয় ভবিষ্যৎ ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে । 

KGF -2 দেখে মুগ্ধ হওয়ার প্রাঞ্জল‌ বর্ণনা করলেন - সৈকত নন্দী

সৈকত নন্দী

প্রথমেই বলে রাখা ভালো ‘কন্নড় ‘ বলে কোনো ভাষা নাই , ‘কান্নাড়া ‘ হলো সঠিক উচ্চারণ । সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা KGF ২, এবং কেমন লাগলো ? সেই অনুভূতি নিয়েই এই প্রতিবেদন । সিনেমার গল্প চিরাচরিত সেই ,’যদা যদা হি ধর্মস্য ,গ্লানির্ভবতী ভারত’ এবং এরকম হলে মাসিহার মতন ‘পরিত্রাণায় সাধুনাং ,বিনাশায় চ দুস্কৃতম’ করতে একমেব দ্বিতীয়ম্ নায়কের উত্থান কাহিনী । কোলার গোল্ড ফিল্ডস বা সংক্ষেপে KGF । ভারতবর্ষের একমাত্র সোনার খনির ওপর ক্ষমতার লড়াই নিয়ে কাল্পনিক এক আখ্যান । ক্যাটাগরি ? অ্যাকশন ড্রামা। তবে শুরু করার আগে বলে রাখা ভালো , দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা নিয়ে এই উন্মাদনা অনেকদিন থেকে শুরু হলেও , সর্বভারতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে, তার বীজ বপন করেছিল বাহুবলী ,ধীরে ধীরে ২.০ (তামিল ), পুষ্পা (তেলুগু ), RRR (তেলুগু ),বিস্ট (তামিল ) সাথে KGF ২ (কান্নাড়া )। কোথাও গিয়ে মনে হচ্ছে , ভারতীয় সিনেমা মানেই ‘বলিউড ‘ কথাটিকে টাটা বাইবাই বলার সময় উপনীত । দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার এই জয়জয়কারের পিছনে কারণ মূলত , টান টান প্লট ,সহজ ভাবে গল্প বলার প্রবৃত্তি , জবরদস্ত স্ক্রিনপ্লে , বিশ্বমানের সিনেমাটোগ্রাফির সাথে আলোর কাজ ,নিজেদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার আকুল চেষ্টা এবং সর্বোপরি সর্বভারতীয় স্তরে তার গ্রহণযোগ্যতা ।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ,কী কী বিষয়ে আলোকপাত করবো তার একটা ছোট বিবরণী দিয়ে রাখি । ১. KGF ২ ঘিরে প্রত্যাশা ও বাস্তবিকতা ২. স্ক্রিনপ্লে ৩. সিনেমাটোগ্রাফি ৪. কাস্ট ৫. অভিনয় ৬ . সংলাপ ৭. পরিচালনা ৮. ভারতীয় সিনেমায় প্রভাব ৯. মিউজিক ১০. কস্টিউম

১. KGF ২ ঘিরে প্রত্যাশা ও বাস্তবিকতা ২০১৮ সালে মুক্তিপ্রার্প্ত KGF নিয়ে সেরকম কিছু উন্মাদনা টের পাওয়া যায়নি প্রথম প্রথম । ধীরে ধীরে এক টুকরো ফুলকি দাবানলের রূপ নেয় । ‘ এই দুনিয়ায় মায়ের থেকে বড় যোদ্ধা কেউ হতে পারেনা ‘ গমগমে সংলাপ আসমুদ্রুহিমাচলের মনকে করেছিল সিক্ত । রাজা কৃষ্ণাপ্পা বাইড়্যা ওরফে ‘রকি ‘ ভাইয়ের ইয়ং অ্যাংরি ম্যানের টাফ লুক ,সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক লোকের মোবাইলের স্ট্যাটাসে তুলেছিল ঝড় । অতিরঞ্জিত ও আদ্যোপান্ত কমার্সিয়াল রসে চোবানো হলেও নির্মেদ গল্পের বুননে ,’জাস্ট ফর ওয়ান মোমেন্ট ‘ এর হিসেবে খারাপ লাগেনি । কী ছিল ইউএসপি ? গল্পের মৌলিকতা ও বলার ধরণে নিজস্বতা । সাথে নতুন নায়কের পর্দায় পদার্পন । সব মিলে ৬.৫/১০। সেখানে নির্দেশক “শেষ হইয়াও হইলোনা শেষ” এর মতন প্রশ্ন ঝুলিয়ে দিয়ে সবাইকে পাক্কা ৪ বছর অপেক্ষা করায় । সেখানে প্রত্যাশা অনেকাংশে বেড়েছে ,”যশ ” আর নতুন মুখ না ,রীতিমতন সুপারস্টার । সেখানে তার সেই পুরোনো অবতার দেখতে সকলে মুখিয়ে ছিল । সাথে সর্ব ভারতীয় জনতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আগমন ঘটেছে ,”সুপার ভিলেন ” এর । কারণ ? আগের সুপার ভিলেনকে ,” ওস্তাদের মার শেষ রাতে ” স্টাইলে হত্যা করে নায়ক লেভেল ২ এ পা দিয়েছেন । অগত্যা “অধীরা” র আগমণ । এবং কি করে ভয়ঙ্কর ,নির্দয় ভিলেনকে শেষ করে নায়ক আবার বাজিমাত করে ,সেটাই এই সিনেমার উপজীব্য । প্রত্যাশা হয়ত সেইভাবে পূরণ হয়নি ,লেভেল ২ ,লেভেল ১ কে ছাপিয়ে যেতে পারেনি । কোথাও গিয়ে অতিরিক্ত হাইপ এর জন্য হয়েছে কিনা তা ভাববার বিষয় । তাই KGF ২ কে ৬/১০ দেওয়া যেতে পারে । ২. স্ক্রিনপ্লে ৩. সিনেমাটোগ্রাফি এবার আসা যাক স্ক্রিনপ্লে ও সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে । প্রথমেই বলেছি অতিরঞ্জিত ও আদ্যোপান্ত কমার্সিয়াল রসে চোবানো KGF সিরিজ । সেখানে সেই আঙ্গিকে স্ক্রিনপ্লে ও গল্প মোটের ওপর উপভোগ্য । পরতে পরতে নানান উত্থান পতন হয়েছে । কখনো খলনায়ক -১ তো নায়ক -০ ; নায়ক আবার ১-১ করে ফেলে । খলনায়ক ২-১ করে ফেললেও স্ক্রিনপ্লের সৌজন্যে নায়ক শেষ পর্যন্ত ৩-২ করে । টানটান স্ক্রিনপ্লের সব ঠিক থাকলেও টানটান ভাবটা কমে আসে লেখকের ;নায়ককে জোর করে জিতিয়ে দেওয়ার এক ইচ্ছে দেখে । তবে ওই যে বললাম ,”আদ্যোপান্ত কমার্সিয়াল” ভারতীয় সিনেমাতে এরকম না হলে দর্শক হলমুখী হবেনা । এখানে খলনায়কের হার নিশ্চিন্ত । ঠিক যেন মহালয়ার ভোরে টেলিভিশনে আসা “মহিষাসুরমর্দিনী “তে মহিষাসুর বা “রামকথা” য় রাবণের হার নিশ্চিন্ত জেনেও আমরা গোগ্রাসে তা দেখি । ঠিক একই ধাঁচে KGF এর স্ক্রিনপ্লেকে তুলে ধরে হয়েছে । সিনেমাটোগ্রাফির কথা বললে বলতেই হয় , VFX এর সৌজন্যে তার সাথে হাই-কোয়ালিটি ক্যামেরার ব্যবহারের দৌলতে KGF ২ বিশ্বমানের সিনেমাটোগ্রাফি পরিবেশন করতে সক্ষম হয়েছে । অ্যাকশন সিকোয়েন্স গুলো বিশেষ করে এক নতুনত্বের দাবি রাখে। স্ক্রিন জুড়ে হাহাকার , সোনার খনি ,তার সাথে জুড়ে মানুষের জীবন ,খনির বাইরেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বহির্জগতের দৃশ্য একবাক্যে KGF ২ কে আন্তর্জাতিক মানের করে তুলেছে । ৪. কাস্ট ৫. অভিনয় ৬ . সংলাপ ৭. পরিচালনা কাস্টিংয়ে নতুন বলতে সঞ্জয় দত্ত , রাবিনা ট্যান্ডন, ও প্রকাশ রাজ যথাক্রমে “অধীরা “, ” রিমিকা সেন” ও “বিজয়েন্দ্রা ” এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন । বাকি মুখ্যভূমিকায় “যশ ” ও “রীনা”র ভূমিকায় শ্রীনিধি শেঠি , অনন্ত নাগ ,অচ্যুত কুমার ,মালবিকা অবিনাশ ,ঈশ্বরী রাও , রাও রমেশ ,টি। এস নাগাভারানা ,অর্চনা জয়েস প্রভৃতি বলিষ্ঠ অভিনেতারা নিজেদের অভিনয় গুনে প্রতিটি চরিত্রকে করে তুলেছেন জীবন্ত । বিশেষ করে অনন্ত নাগ,অর্চনা জয়েস যারা রকির জীবনের দাবাখেলার দুইদিকে বসে রকির জীবনের প্রতিটি অধ্যায়কে আকার দিয়েছেন ,বলিষ্ঠ অভিনয় দর্শককে চুম্বকের মতন টেনে রেখেছেন প্রতি মুহূর্তে । রীনার ভূমিকায় শ্রীনিধি শেঠি সেইভাবে সুযোগ পাননি ,যদিও সিনেমার পুরো গল্পই আবর্তিত হয়েছে তাকে ঘিরেই । অধীরার ভূমিকায় সঞ্জয় দত্ত যতটা হাইপ তৈরী করেছিলেন তার বর্বোরচিত লুকস দিয়ে ; সেভাবে এই চরিত্রের সাথে উনি সুবিচার করতে পারেন নি । কোথাও গিয়ে কিছু তো একটা খামতি সবসময় মনে হয়েছে । রামিকা সেনের ভূমিকায় রাবিনা ,অনেক দিন পর আবার বড় পর্দায় । এক বলিষ্ঠ চরিত্র ছিল ,সেখানে গ্ল্যামারস ব্যাপারটা থেকে উনি বেরোতে পারেননি । অল্প কিন্তু গল্পের সূত্রধরের ভূমিকায় প্রকাশ রাজ প্রত্যাশিত ভাবেই নিজের জাত চিনিয়েছেন। এবার আসা যাক সিনেমার মুখ্যভূমিকায় অভিনয় করা রকিভাই বা যশ এর ব্যাপারে । কমার্শিয়াল সিনেমায় নায়কের থেকে যতটুকু দাবি থাকে , ঠিক ততটাই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যশ । এ যেন KGF না রকিভাইয়ের আত্মজীবনী । সেই খাতিরে ওনাকে ৯/১০ দেওয়া যায় অকাতরে । তাবড় তাবড় অভিনেতাদের সামনে কিন্তু কখনোই ওনাকে ফিকে লাগেনি । তবে উনি কত ভালো অভিনেতা তা বোঝা যাবে ওনার পরবর্তী অন্য কোনো সিনেমায় ,রকিভাইয়ের খোলস থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে প্রমান করলেই সেই পরীক্ষায় অনায়াসে উতরে যাবেন । এই সিনেমার প্রাণকেন্দ্র সংলাপ , যা ইতিমধ্যে লোকের মুখে মুখে ঘুরছে । একটি সিনেমা থেকে তার সংলাপ যখন বেশী লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে ,সেই দেখেই আন্দাজ করা যায় দর্শকমননে তার গ্রহণযোগ্যতা ও স্থায়িত্ব । এবিষয়ে সংলাপকে ৯/১০ দেওয়া যেতেই পারে।তবে এক অন্তর্বর্তী মাফিয়াকে মারতে কোনোদিন কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী কি নৌসেনা ,সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করেছেন কিনা তা জানা নাই ,এইখানেই গল্পের গরু কিন্তু বেশ গাছে চড়ে ডানা মেলে উড়েছে আকাশে | শেষমেশ আসি পরিচালনা ও এডিটিং এর কথায় ,হয়তো সব থেকে কঠিন কাজ । আসমুদ্রহিমাচলের এত বড় প্রত্যাশাকে সঠিক ভাবে পরিবেশনা মুখের কথা না । প্রশান্ত নীল বুঝিয়েছেন তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া । সিনেমার গল্প অতিরঞ্জিত হলেও বড়পর্দার সামনে বসে পুরোটা গোগ্রাসে দেখতে কখনোই খারাপ লাগবেনা । কখনো উত্থান তো কোথাও পতন ,কখনও অযাচিত প্লট টুইস্ট দিয়ে পরিচালক দর্শককে সিটে বসে থাকতে বাধ্য করেছেন । তার জন্য তাকে জানাই কুর্নিশ । ৮. ভারতীয় সিনেমায় প্রভাব ৯. মিউজিক ১০. কস্টিউম এই মুহূর্তে একটি কথা সত্যি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ,সত্যিই কি বলিউডের রমরমা শেষ ?দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার দাপটে সব রেকর্ড ভেঙেচুরে চুরমার । বলিউড যেখানে OTT নির্ভর হওয়ার দিকে এগোচ্ছে ,সেখানে কলিউড ,টলিউড (তামিল ),স্যান্ডেলউড ৫০০ কোটি + বাজার করছে বক্সঅফিসে । গল্প স্বতন্ত্র হলে ,ঠিকঠাক পরিচালনা পেলে , মোটের ওপর ভালো অভিনেতার অভিনয় গুন যুক্ত হলে ভাষাভিত্তিক সিনেমা হিট হওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারেনা । KGF সিরিজ তার প্রজ্জ্বল উদাহরণ । মিউজিকে সেরকম কিছু নতুনত্ব দেখতে বা শুনতে পেলাম না । নতুন বোতলে পুরোনো সুরা পরিবেশিত হয়েছে । সর্বশেষে আসা যাক সিনেমার কস্টিউম প্রসঙ্গে। যেখানে সত্তর ও আশির দশককে তুলে ধরা হয়েছে সেইসময়ের প্লটে সাজপোশাক বেশ কেতাদুরস্ত । পাশ্চাত্য পপ কালচারের আগমণ ঘটছে ধীরে ধীরে সেইসময় ,এমন অবস্থায় বাকি আর যাই মাননসই হোক না কেন ,হেয়ারস্টাইল কিন্তু কখনোই সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি । আমি সবসময় এটাই ভেবে এসেছি ,বাংলাতে আমরা কবে এরকম সিনেমা বানাব ? শিল্পের দিক থেকে আমরা আলবাত অনেক সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি থেকে এগিয়ে ,কিন্তু প্রযুক্তি ও “লার্জার দ্যান লাইফ ” এর বিচারে আমরা সেই তিমিরে পড়ে আছি ।আশা করবো আমাদের এই দুরাবস্থার KGF থেকে কোনো না কোনো রকি ভাই উদ্ধার করতে ঠিক আসবেন । শেষে একটা কথাই বলবো ,হলে গিয়ে সিনেমাটি দেখে আসুন, অনুভব করে আসুন আর সাক্ষী থাকুন এই অভূতপূর্ব সফরের । ওভারঅল একটি রেটিং দেওয়ার চেষ্টা করলাম , পরিচালনা : ৯/১০ সংলাপ : ৯/১০ স্ক্রিনপ্লে : ৯/১০ মিউসিক : ৭/১০ অ্যাকশন : ৯/১০

দেবলীনা মজুমদারের ক্যামেরার বাস্তব লড়াই দেখলেন - সুদীপ্ত নাগ

সুদীপ্ত নাগ

কী  নাম ? দেবলীনা মজুমদার ? ভালো সিনেমা বানায় বলছ ? আচ্ছা দেখব তাহলে মুখে বললেও ভেতরে সাহস পাইনা বাংলা ইন্ডাস্ট্রির যা হাল , হাতে গুনে ভালো ছবি বানায় লোকজন আর আমার মত নার্ড মানে সেলফ প্রক্লেমড মেকার কাম ক্রিটিকরা একটু ব্যাশ করে একা একাই মজা নিয়ে নেয় আবার আমরাই তারা যারা সিনেমা ভালো হওয়া দরকার , ডেডিকেশান দরকার , ফ্রি ওয়ার্কশপ করতে হবে এইসব বুলি আওড়াই খুব অদ্ভুত না ? যাই হোক শেষে মুবির অ্যাকাউন্ট খুলে একটা ব্রাজিলের ছবি দেখব ভাবছি কিন্তু আজ যেন মনটা একটু অন্যরকম বাংলা সিনেমা দেখলে কেমন হয় ? দেবলীনা নাম সার্চ করতে চলে এল তিনটে ছবির লিঙ্ক , যার মধ্যে ২টো ডকু এবং একটা ফিকশান সাইডে জনারার জায়গায় লেখা আছে LGBTQ . বাংলায় এখন অবধি এই রকম বিষয় নিয়ে সিনেমা ভাল লাগেনি চিত্রাঙ্গদা বোধহোয় একটু লেগেছিল দেখব ? সাহস করে দেখতে বসলাম নাহ, কোন আশা টাসা নিয়ে নয় একদমই আলমোদোভার, জেভিয়ার ডোলান বা স্কিয়ামাদের  মত বানানো ইমোশানাল ছবি হয়না কেন আমাদের দেশে ? কেন কন্টেন্টের সাথে সাথে দৃশ্যরা কথা বলে ওঠেনা ? 

আবার যদি ইচ্ছা কর … 

কি রে প্রেমপত্র নাকি ? শঙ্কর এবং নিতার সেই বিখ্যাত চিঠি কাড়াকাড়ির দৃশ্য রেফারেন্স হিসাবে ঢুকে পড়তেই চমকে উঠলাম সত্যি তো ! এই  লেসবিয়ান কাপলের জীবন যেন নিতার মতই সীমাবদ্ধ , বিনা অপরাধে স্যাক্রিফাইসের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছানো, বাঁচতে চাওয়ার ইচ্ছাটুকু পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে নিজেদের ছোট্ট ঘরে কিন্তু সামনে যতই অন্ধকার থাক মেয়েটির চিঠির মতই ভালবাসার প্রতিটি মুহূর্ত উজ্জ্বল সেই সৌন্দর্য উঠে এসেছে মুহূর্তর জন্য অপেক্ষারত ক্যামেরা দিয়ে প্রবল ঝাপসা বৃষ্টির ছাঁটে রাস্তায় উদ্দাম , ভেড়ার পালের মাঝে আটকা পরেও চনমনে হাসি,  প্রতিবেশি বিড়ালের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি এড়িয়ে , নিবিড় অন্ধকারে আরেকজনের পাশ ফেরার অপেক্ষা , বারবার দিকশূন্য হয়েও খুনসুটিটা না ভোলা , এইসব দৃশ্য হয়ত দারুণ সেট আপ নিয়ে তৈরি নয় কিন্তু পরিশ্রমে তৈরি এবং আবেগ ও উন্মাদনা তৈরিতে পুরোপুরি সক্ষম ছবিতে একটি ইয়ং  ছেলে মেয়েদের গ্রুপ বাদে সবার অভিনয় বেশ সাবলীল এবং পরিমিত কিছু রাস্তার দৃশ্যতে সামান্য সমস্যা আছে ,রাস্তার লোকজন ক্যামেরায় ডিরেক্ট লুক দিয়েছে বাট মোস্টলি ব্যাকগ্রাউন্ড ব্লার রাখার কারণে এই সমস্যা অনেক জায়গায় এড়ানো গেছে কিন্তু এতে ফিল্মের আকর্ষণ কমেনি একটুও সর্বোপরি এই কাহিনী সবার আগে ভালবাসার কাহিনী সব কিছু নির্বিশেষে মেয়েটি ঠিক যেমন চিঠিতে লিখেছে কেন ভালবাসি জানিনা কিন্তু খুব ভালবাসি, ওকে ছাড়া থাকতে পারবনা যে কাহিনীর শুরুতেই বলে দেওয়া হচ্ছে বাস্তবের একটু আর বাকিটা কল্পনা সেখানে আর ডিরেক্ট গেজ খুব কিছু সমস্যা বোধহয় নয় কারণ সেটা আগেই একটু সেলফ রিফ্লেক্সিভ । 

এবং বেওয়ারিশ – যে গল্পটি নিয়ে কথা হচ্ছিল সেই আসল ঘটনা নিয়ে এই ডকুটি তবে শুধু তাই নয় , এইরকমই বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতি দিয়ে যারা যাচ্ছেন তারা এই ডকুর সাব প্লটে আছেন ডিরেক্টার নিজের পয়েন্ট অব ভিউয়ের দিকে না গিয়ে এদের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন ওই ঘটনাটি সম্পর্কে হিউম্যান নেচারের একটা বড় পার্ট হল রিলেট করা আমরা সবাই করি কিন্তু আলাদা আলাদা ভাবে যেমন ধরা যাক সিনেমা আমরা কেন বলি সিনেমা সাবজেক্টিভ কারণ প্রত্যেক মানুষের একটা সেম জিনিস নিয়ে অনুভব করা বা বিশ্লেষণ করার পদ্ধতি কিম্বা রিলেট করার ক্ষমতা আলাদা এবং মজাটা হল এখানেই বৈচিত্র্য এই ডকুতে এই বৈচিত্র্য জিনিসটাই একটা আলাদা আবেদন আনতে পেরেছে যেমন বিভিন্ন সোশ্যাল ভিক্টিম পড়ছে মেয়েটির চিঠি , তেমনি একজন বুদ্ধিজীবী , একজন বয়স্ক প্রাচীন ভাবধারার নাগরিকসবার  রিঅ্যাকশ্যান আলাদা হলেও আমরা দেখতে পাচ্ছি চিঠি শেষ করার পর সবার মুখেই বিষাদের ছায়া আবার সিনেমা শেষ হাওয়ার পর কিছু টুকরো সিনেমা দেখে রিঅ্যাকশানের দৃশ্য আছে যা বুঝিয়ে দিচ্ছে এখনও এইসব বিষয়ে আমরা কতটা এলিয়েন ভাল কথা এই এলিয়েন প্রসঙ্গে বলি প্রথিবীর বাইরের জীবকেই যেমন আমরা না ভেবে চিন্তেই এলিয়েন ট্যাগ করব , কিম্বা বাংলা ভাষার পরিচালক/পরিচালিকা  হলেই আমি নাক সিঁটকবো এটা কোন ইম্পিরিকাল অবসারভেশান থেকে নয় একদম পাতি একটা ফিক্সড ধারণা থেকে আসে আর এই ধারণা থেকে কিঞ্চিৎ সরার চেষ্টা আমরা প্রায় করিইনা আর যেই কারণে আমরা কূপমণ্ডূকই থেকে যাই যাই হোক , এই ছবিটি সম্ভবত তিনটি ছবির মধ্যে সব চেয়ে শক্তিশালী এবং ব্যালেন্সড ছবি (অবশ্যই , আমার নিজের মত অনুযায়ী ) । 

তিন সত্যি – বিভিন্ন মানুষ কিভাবে সমাজের মধ্যে অন্যরকম ভাবে নিজের মত করে বেঁচে আছে , এই সিনেমার মূল বিষয় এটাও ডকু তিনটি সেগমেন্ট নিয়ে ডকুটি তৈরি প্রথম সেগমেন্টটি নিয়ে বলার আগে আমি একটা অন্য কথা বলি আগে দিন আগে মা বলল আমার মাসতুতো বোনের একটি চাকরীর ইন্টারভিউতে হয়নি কারণ সে একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি তাকে বলতে বলা হয়েছিল দুজন লেসবিয়ান বিয়ে করলে বা একসাথে থাকলে কি কি সমস্যা হতে পারে আমি শুনে বলেছিলাম যে এই প্রশ্নটাই একটা জঘন্য প্রশ্ন আর টেকনিক্যালি বায়োলজিক্যাল বাচ্চা হবেনা এছাড়া সমস্যা আবার কি ! 

এই প্রথম সেগমেন্টটি এমন দুজন কে নিয়ে যার মধ্যে একজনের বায়োলজিক্যাল সন্তান আছে আগের স্বামীর সাথে এমন ভাবেই তাদের বাড়িতে শ্যুটিং করা হয়েছে যে পার্টানারদের ইন্টারনাল কেমেস্ট্রি এবং সাংসারিক তালমিল একটি সুখী স্বাভাবিক সংসারের ছবি আঁকছে কিন্তু এদের নিয়েই সমাজ প্রশ্ন তুলবে প্রশ্ন তুলবে একজন ফচকে লোক যে এই দুই জীবনসঙ্গীর ছেলেটি বাবার নাম কী লিখবে মাধ্যমিকের খাতায় ? দুর্ভাগ্যের বিষয় এই লোকটি তার বউ বাচ্চা নিয়ে সমাজে গ্রিন সিগন্যাল নিয়ে মাথা উঁচু এইসব আবোল তাবোল বকবে আর যারা বোঝে তারা বুঝেও বুঝিনা হয়ে চুপটি করে থাকবে। 

দ্বিতীয় অধ্যায় একটি মেয়েকে (জেন্ডারের দিক থেকে ছেলে বলাটাই বেটার মেয়ে বি)নিয়ে যে কোন ইমরান হাশমির চেয়ে কম নয় শুধু তাই নয় খেলাধুলোতেও সে দারুন।  

মনে রাখা দরকার নারী শরীর থাকা সত্বেও কেউ পুরুষালি হলে তাকে যদি নারীদের অ্যাট্রাক্টিভ লাগে তাহলে কি আবার এটাই প্রমাণ হয়না যে জেন্ডার আর সেক্স কখনই এক জিনিস না এটা সেক্সের দিক থেকে দেখলে যতটা হোমোসেক্সুয়াল, জেন্ডারের দিক থেকে দেখলে একেবারেই হেট্রোসেক্সুয়াল । 

তৃতীয় অধ্যায় একজন অ্যাক্টিভিস্ট মেয়েকে নিয়ে যে লেসবিয়ান এবং সংসারের তথাকথিত লিনিয়ার স্টেপগুলিতে বিশ্বাসী নয় এরকম কাহিনী খুব কিছু অচেনা নয় আমার কাছে আমার কিছু চেনা লোকজন এরকম ব্যাকগ্রাউন্ডের বা কিছুটা এই ধরণের চিন্তা করে তাই হয়ত নতুন করে এই সেগমেন্টটি আমার সেরকম লাগেনি কিছু এই তৃতীয় ছবিটি আমার বাকি দুটো ছবির থেকে কিছুটা কমজোর মনে হয়েছে তার প্রধান কারণ হল যাদেরকে স্টাডি করা হয়েছে তারাই যখন মুখ্য বিষয় তখন আরো সময় নিয়ে ভেতরের উপাদান গুলো নিয়ে হয়ত নাড়াচাড়া করা যেত ইন্টারভিউ অ্যাপ্রোচ যেমন ডকুতে কার্যকর হতে পারে , তেমনি হতে পারে অনুসন্ধান বা র‍্যান্ডাম মোমেন্ট ক্যাপচার করা তবে এই কথা অস্বীকার করবনা যে ডিরেক্টার তার সাবজেক্টদের গোটা ছবিতে যেরকম সাবলীল ভাবে হ্যাণ্ডেল করেছে তা প্রশংসার দাবী রাখে ছবি গুলির বিষয়বস্তুর চেয়েও ইন্টারেস্টিং বিষয় হল আমাদের চারপাশে মানুষ কি ভাবে বা কিরকম মানসিকতা তাদের এই সোসাইটাল কন্ট্রাকশানের জালে বন্দি হয়ে । 

একজন পরিচালকের সবচেয়ে কঠিন কাজ হল নিজের আনকম্ফর্টেবল জোনে গিয়ে ফিল্ম বানানো দেবলীনা একটি বিশেষ জনারায় কাজ করছেন , পরে কি তিনি অন্য নানান বিষয় নিয়ে ছবি করতে আগ্রহী হবেন ? সেটা সময় বলবে । 

‘ওয়েবে ছয় খন্ড "টিকটিকি" দেখে ফেললে মন্দ‌ লাগবে না' জানালেন - স্নেহা চ্যাটার্জী

স্নেহা চ্যাটার্জী
 
মৃত্যু আপনার কতটা কাছের? মানে আপনি তাকে তাড়িয়ে-তাড়িয়ে উপভোগ করেন? না কল্পনাতীত সমস্ত ভাবনা মুহূর্তে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় একটা এক সেকেন্ডের সময়ের তফাতে?ধ্রুব ব্যানার্জী পরিচালিত সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত হইচইয়ের ওয়েব সিরিজ টিকটিকি হয়তো ভাবাবে। শাফের লেখা ‘স্লিউথ’ নাটকের বাংলা অনুবাদ ‘টিকটিকি’।
 
দুজন তুখোড় অভিনেতা কৌশিক গাঙ্গুলি এবং অনির্বাণ ভট্টাচার্য প্রধান দুই চরিত্রে রয়েছেন। একজন মধ্যবয়স্ক অভিজাত জমিদার বংশের সৌমেন্দ্রকৃষ্ণ দেব যিনি সাহেবিয়ানা বা তথাকথিত এলিট ক্লাসের জীবনযাপন করেন এবং স্বরচিত গোয়েন্দা গল্পের পটভূমিতে বসবাসকেই প্রকৃত সুখ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। তিনি ডেকে পাঠান তার স্ত্রীর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের প্রেমিক মিলন বসাককে যে চরিত্রটি অনির্বাণ করেছেন। মিলন বসাক একজন ছাপোষা মধ্যবিত্ত ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জামের দোকানদার। সৌমেন্দ্রকৃষ্ণের একটি বিশাল হলঘর যার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে মিশর অথবা ইতালির প্রাচুর্য্য।
 
সৌমেন্দ্র দেব এই ঘরেই দেশ-বিদেশের গোয়েন্দা গল্পের মোড়ে ঘুরতপ আর রহস্যের জালে তার মতো “মহান মানুষদের মনের খোরাক” বজায় রাখতে পছন্দ করেন। মিলন বসাক একপ্রকার তাল কাটায় সেখানে। স্যাঁতস্যাতে বস্তির এঁদো গলিতে রিস্কাওয়ালার লাশ আর লুঙ্গি পরা ডিটেকটিভ দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছে ; এই দৃশ্য বাস্তবসম্মত হলেও বিত্তশালী সমাজের এলিটিজম রক্ষার ক্ষেত্রে হয়তো সাদা পাতায় ঠাঁই পাওয়ার অযোগ্য।
 
এপিসোড বাড়তে থাকে, অতিকায় বাড়িটির হল ঘরে। কাজের লোকেদের ছুটি দিয়ে একাই থাকতে দেখা যায় সৌমেন্দ্রকৃষ্ণকে।
 
তাঁর স্ত্রী মিমিকে নিয়ে অযুত অনুযোগ নিয়ে মিলন নামের এই ছোকরার সঙ্গে একপ্রকার ফয়সলার আলাপ করতে চান সৌমেন্দ্রকৃষ্ণ। মিমির সাথে মিলনের বিয়েতে তিনি কোনও আপত্তিই জানান না বরং তিনি একটা নেকলেস উপহার দিতে চান (যদিও মিমির কথা ভেবেই)। এরপর ৫০ লক্ষের ওই নেকলেসকে নিয়েই কাহিনির বুনোটে পড়ে প্রথম গিঁট। মিলনকে চুরি করতে হবে সেই নেকলেস ! শুরু হয় খেলা। হতভম্ব মিলনের নেকলেস চুরির মকশো করা থেকে কাহিনির শেষ অবধি চলতে থাকে একপ্রকার খেলা! এ আবার কেমন খেলা?
 
হার – জিত, সামাজিক – অসামাজিকের ব্যাখ্যা এবং সবার ওপরে ..একাকিত্ব আর মনস্তত্ত্বের মেলবন্ধন হয়ে ওঠে টিকটিকি। অন্যদিকে দুই শ্রেণীর দুই প্রতিনিধি যখন মগজের খেলায় জড়িয়ে পড়তে পড়তে মুখোমুখি বসেন এক টেবিলে তার প্রতিবেদন কী অপরিসীম বিস্ময়ের সামনে দর্শককে এনে দেয় তা বুঝতে দেখতে হবে এই সিরিজ।
 
সিরিজের আবহসঙ্গীত থেকে এডিটিং হইচইপ্রেমীদের চেনা গণ্ডির মধ্যেই। টানা ছয়টি এপিসোড আপনাকে টেনে রাখবে দুজন দক্ষ অভিনেতার শিল্পকলার মাধ্যমেই। গল্পে বেশ কয়েকটি জায়গায় মোড় ঘুরেছে,এবং সবকটি ক্ষেত্রেই অত্যন্ত সাবলীল ভাবেই সেই চরিত্রের বাঁককে ফুটিয়ে তুলেছেন দুজন শিল্পী। রহস্য-রোমাঞ্চের প্লটের স্বাভাবিক চেনা বাঙালি আদলকে নস্যাৎ করে দিয়ে,  দ্বৈতাভিনয়ের এই মৌলিক রহস্য দর্শককে এক অন্য স্বাদ তো দেবেই আরো দেবে অন্য পাঠ।
 
আপনি যদি “বাঙালি উইথ বিবেকের” এই ডেঞ্জারাস কম্বিনেশন শ্রেণীর আওতায় পরে থাকেন, তাহলে এই ভেতরের টানাপোড়েন থেকে জমাট সাসপেন্সের ৬টা এপিসোড নির্দ্বিধায় দেখে ফেলতে পারেন।
 
“সো, লেটস প্লে দ্যা গেম বেবি….!!”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *