বিংশতম সংখ্যা ।। ত্রয়োদশ ই-সংস্করণ ।। নভেম্বর, ২০২১

ভাণ পত্রিকা

বিংশতম সংখ্যা ।। ত্রয়োদশ ই-সংস্করণ ।। নভেম্বর, ২০২১

সম্পাদক :

সম্পাদনা সহযোগী :

প্রচ্ছদ :

নক্সা পরিকল্পক :

অন্যান্য কাজে :





ভাণ-এর পক্ষে:

মৌলিকা সাজোয়াল

কর্তৃক

৮৬, সুবোধ গার্ডেন, বাঁশদ্রোণী, কলকাতা : ৭০০০৭০ থেকে প্রকাশিত। যোগাযোগ : ৯৬৪৭৪৭৯২৫৬

( হোয়াটসঅ্যাপ ) ৮৩৩৫০৩১৯৩৪ ( কথা / হোয়াটসঅ্যাপ )

৮৭৭৭৪২৪৯২৮ ( কথা ) [email protected] ( ই – মেল ) ​

Reg. No : S/2L/28241

সূচি

সম্পাদকের কথা

বিষয় বিশেষ

পাঠশালার কথা ভাবতে গিয়ে প্রসঙ্গত অনেক কথা তুললেন  – আবীর কর

মাদ্রাসা শিক্ষা কোথা থেকে কেমন করে এবং.. বুঝিয়ে বললেন – সা’আদুল ইসলাম

রবীন্দ্রনাট্যের অন্দরের শিক্ষা-চিন্তা কে প্রকাশ্যে আনলেন – শর্মিলা ঘোষ

বিশেষ নিবন্ধ

ফটোগ্রাফি আদতে কি? — অল্প কথায় বুঝিয়ে দিলেন – তপেশ‌ মুখার্জি

লোকশিল্পের নন্দন তত্ত্বের সুলুক করলেন – স্বর্নালী দত্ত

থিয়েটার

অতিমারী ও বাংলা থিয়েটার- ভাবলেন – সস্মিত চক্রবর্তী

চলচ্চিত্র

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সিনেমা তাঁর কবিতার মতোই সৎ – লিখেছেন – অজন্তা সিনহা

‘সেক্স এডুকেশন’ ওয়েব সিরিজ নিয়ে কিছু কথা তুললেনঅণ্বয় গুপ্ত

সম্পাদকের কথা

   

গৌরাঙ্গ দণ্ডপাট

ভাবতে ভালো লাসম্পাদকের কথা (১)

যন্ত্রের যন্ত্রনার কথা জানতে যন্ত্রবিদ হতে হয় না। সাধারণ মানুষই তার প্রতিদিনের জীবন যাপনে একথা হাড়ে হাড়ে টের পান। সেপ্টেম্বর মাসে এমনই এক যন্ত্রণাকর উপলব্ধি ঘটল ভাণ এর। ওয়েবজিন প্রকাশিত হওয়ার মাত্র দুদিনের মাথাতেই ঘটল বিপর্যয়। পত্রিকা আর পড়া যায় না। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে সেসব লেখা পুনরুদ্ধার করতে করতেই এসে পড়ল ছাপার হরফে পুজোসংখ্যা।ভাণ  পত্রিকা কমিটি অতঃপর মিটিং করে ঠিক করল ,  সংখ্যাটিকে আবার নভেম্বর মাসে আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে আপলোড করব।নতুবা লেখক এবং পাঠক — কারোর প্রতি আমাদের দায়িত্ব প্রকাশ পাবে না! সেই অনুযায়ী এবারের সংখ্যা আসলে সেপ্টেম্বরে সংখ্যারই পুনর্মুদ্রণ। এই সংখ্যার গুণগতমান কেমন,তা দুদিনের প্রতিক্রিয়াতেই আমরা কিছুটা টের পেয়েছিলাম। সেটাও একটা বড় কারণ সংখ্যাটিকে পুনঃপ্রকাশ করার তাড়না।”পড়াশুনোর কালচার”বিষয়ক তিনটি লেখা সহ নিয়মিত বিভাগ এর লেখাগুলো পড়ুন আমাদের মতামত জানান।ভালো থাকুন। সঙ্গে থাকুন। দীপাবলির শুভেচ্ছা শুভকামনা রইল ভাণ এর পক্ষ‌ থেকে।

বি.দ্র সেপ্টেম্বর এর ‘সম্পাদকের কথা’ টি , সম্পাদকের কথা (২) হিসেবে অবিকৃতভাবে রাখা গেল

পাঠশালার কথা

   

আবীর কর

ষোড়শ শতকে জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ এ নদীয়া খন্ডে শ্রীহট্টের বর্ণনায় আছে-

‘শ্রীহট্ট দেশের মধ্যে জয়পুর গ্ৰাম।

সর্ব্ব সুখময় স্থান ক্ষিতি অনুপাম।।

দীঘি সরোবর কূপ তড়াগ সোপান।

দেউল দেহারা মঠ নানা পুষ্পোদ্যান।।

নাটশাল পাঠশাল চৌখন্ডী বাঙ্গালী।

ধ্বজ কল হংস পারাবত করে কেলি।।

আবার নদীয়ার বর্ণনাতে আছে- ‘নাটশাল পাঠশাল দীঘি সরোবর…।’ প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ‘চৈতন্যমঙ্গল’ এ চৈতন্যের হাতেখড়ি, কর্ণবেধ ও উপনয়নের বর্ণনার পাশাপাশি সুদর্শন পন্ডিত, বিষ্ণু পন্ডিত, গঙ্গাদাস পন্ডিতের প্রসঙ্গ পেড়েছেন কবি জয়ানন্দ। তবে চৈতন্যদেবের শিক্ষার বর্ণনায় যে ছবি মেলে তার সঙ্গে টোলের শিক্ষার মিল যথেষ্ট।

এবার আসা যাক, মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ এর ধনপতি আখ্যানে, সেও ষোড়শ শতকের রচনা। শ্রীমন্তের বিদ্যাশিক্ষার প্রসঙ্গ এসেছে সেখানে বিস্তারিত ভাবে। জনার্দন ওঝার কাছে ধনপতি পুত্রের শিক্ষা লাভের ছবিতে আছে-

‘পড়য়ে সাধুর বালা প্রথমে আঠার ফলা

ক খ আক্ষ আস্ক বানান।

গুরুবাক্যে দিয়া কর্ণ চিনিল অনেক বর্ণ

পড়িল শুনিল সুলক্ষণ।।

দ্বিজ মাধবের ‘মঙ্গলচন্ডীর গীত’ এ শ্রীমন্তের বিদ্যাশিক্ষার বর্ণনায় আছে-

‘চন্ডিকার ব্রত হেতু পড়িল সকল ধাতু

দীপিকায়ে জানিল কারণ

ষত্ব ণত্ব জ্ঞান হয়ে সংস্কতে কথা কহে

পারগ হইল ব্যাকরণ।’

— শ্রীমন্ত ধনীর দুলাল, তার বাবার নাম ধনপতি, সওদাগর জাত, ফলস্বরূপ তার পুত্র শ্রীমন্ত সংস্কৃতজ্ঞ হয়ে আরও গণ্যমান্যদের পরিমন্ডলে স্থানলাভে প্রয়াসী হবে, এ স্বাভাবিক। উল্টোদিকে কালকেতুর পাঁচ বছরের পদার্পণ কালে তারও কান বেঁধানো (কর্ণবেধ) হয়, তবে শিক্ষা নয় শিকারে অভিষেক ঘটানোর জন্য। বর্ণনায় আছে- ‘পঞ্চম বরিষে কৈল কর্ণের বেধন’। তারপর-

‘গণকে আনিয়া ঘরে শুভদিন শুভবারে

ধনু দিল ব্যাধসুত-করে।’

— এরপর চন্ডীর কৃপায় কালকেতুর রত্নলাভ, গুজরাট নগরীর পত্তন। সেই নয়া রাজপাট গুজরাটে পাঠশালার উল্লেখ না থাকলেও মক্তবের কথা আছে। উল্লেখ্য- ‘যত শিশু মুসলমান/তুলিল মক্তবখান।’ সেই সময়কালে মন্দির সংলগ্ন নাটশালা, পাঠশালার মতোই মসজিদের সাথে মক্তবের যোগ ছিল।

এরপর আঠারো শতকের পুঁথি বিপ্রদাস পিপলাই -এর ‘মনসাবিজয়’ -এ পাঠশালার উল্লেখ আছে স্পষ্ট ভাবে। উল্লেখ্য-

‘ছোট জন নহে চান্দ রাজ ভোগে ভোলা।

লক্ষ লক্ষ লোক যার আছে পাঠশালা।।

নানা দেশে পাঠসব, নানা দেশে ঘর।

সোমাই পন্ডিত পাঠ পড়ায় নিরন্তর।।

কেহ কাব্য শাস্ত্র পড়ে, কেহ ব্যাকরণ।

সব হইতে যোগ্য চান্দর পুত্র ছয়জন।।

একদিনে ছয় ভাই পড়ে পাঠশালা।

পড়িতে পড়িতে হইল দুপ্রহর বেলা।।’

— এরপর লখিন্দরের শিক্ষালাভ সম্পর্কে বক্তব্য-

‘লখাইর অনুমতি পায়্যা রাজরানি।

সোমাই পন্ডিত দ্বিজে ডাক দিয়া আনি।।

সনকা বলেন দ্বিজ না করিহ হেলা।

যত্নে পড়াইহ মোর লখিন্দর বালা।।

শুনিয়া হরিষ দ্বিজ রানির বচনে।

লখাইর হাতেখড়ি দিল শুভক্ষণে।।’

– এরপর বিস্তারিত ভাবে লখিন্দরের মেধা ও স্বল্পসময়ে শিক্ষার্জনের বর্ণনা দিয়েছেন কবি। আঠারো শতকের আর এক কবি বিষ্ণুপাল, তার ‘মনসামঙ্গল’ গ্ৰন্থেও পাঠশালার উল্লেখ করেছেন-

‘রাজপুত্র মুনিপুত্র পড়ে পাটশালে।’ উল্লেখ্য ‘মনসামঙ্গল’ এ পাঠশালার পাশাপাশি মক্তবের উল্লেখও আছে। আর বিপ্রদাসের সনকা হলেন সন্তানের পড়াশোনার বিষয়ে উদ্বিগ্না মায়েদের মধ্যে সম্ভবত প্রথম অভিভাবক স্থানীয়।

সপ্তদশ শতাব্দীতে রচিত আলাওলের ‘পদ্মাবতী’তে আছে রাজকন্যা পদ্মাবতীর পড়াশোনার প্রসঙ্গ। সেই বর্ণনায় পাই-

‘পঞ্চম বৎসরে যদি হৈল রাজবালা।

পড়িতে গুরুর স্থানে দিল ছাত্রশালা।।

মহান পন্ডিত হৈল কন্যা গুণবান।

— অর্থাৎ সপ্তদশ শতকে মেয়েদের পড়াশোনার এক দৃষ্টান্তমূলক ছবি মিলছে ।

শুধু তাই নয়, সতেরো-আঠারো শতকে লিপি করা দৌলত উজির বাহরাম খাঁ রচিত ‘লায়লী-মজনু’ কাব্যে পাঠশালার যে ছবি মেলের তা আজকের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার স্কুলকেও হার মানায়। উল্লেখ আছে-

‘সেই উদ্যানে গিয়া কএস সুমতি।

গুরুপদ ভজিয়া পড়এ প্রতিনিধি।।

সুন্দর বালকগণ অতি সুরচিত।

একস্থানে সভানে পড়এ আনন্দিত।।

সেই পাঠশালাতে পড়এ কত বালা।

সুচরিতা সুললিতা নির্ম্মলা উজ্জ্বলা।।

—- এই পাঠশালায় একই সঙ্গে পড়ে আমির পুত্র কয়েস আর বণিক কন্যা লায়লী। শুধু তাই নয়, সতেরো-আঠারো শতকে লিপি করা দৌলত উজির বাহরাম খাঁ রচিত ‘লায়লী-মজনু’ কাব্যে পাঠশালার যে ছবি মেলের তা আজকের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার স্কুলকেও হার মানায়। উল্লেখ আছে-

‘সেই উদ্যানে গিয়া কএস সুমতি।

গুরুপদ ভজিয়া পড়এ প্রতিনিধি।।

সুন্দর বালকগণ অতি সুরচিত।

একস্থানে সভানে পড়এ আনন্দিত।।

সেই পাঠশালাতে পড়এ কত বালা।

সুচরিতা সুললিতা নির্ম্মলা উজ্জ্বলা।।

—- কো-এডুকেশনের প্রথম দৃষ্টান্ত হতে পারে এই আখ্যান সম্বলিত চিত্র। এই পাঠশালায় একই সঙ্গে পড়ে আমির পুত্র কয়েস আর বণিক কন্যা লায়লী। এই পাঠশালে পড়াকালীন তাদের প্রেমে পড়া, দৌলত উজির লিখছেন-

‘শাস্ত্র পাঠ মুখ হন্তে থুইল সত্বর।

প্রেম পাঠ লেখিলেন্ত হৃদয় অন্তর।। …

যেই দিন পাঠশালে মিলন না হএ।

কএস চলিয়া যায় কন্যার আলএ।। ‘

— এরপর আমির-পুত্র কয়েস/কএস যখন লায়লীর প্রেমে মজনু তথা পাগল। তখন লায়লীর মায়ের তদন্তে ধরা পড়ছে, যত নষ্টের গোড়া ঐ পাঠশালা। তাই উদ্বিগ্ন মায়ের কড়া নির্দেশ-

‘আজি হন্তে তেজহ চৌআড়ি পাঠশাল।

কুলের মহিমা নিজ রাখহ সামাল।।’

কিন্তু তারপরও আটকে রাখা যাচ্ছে না মেয়েকে, কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার সেই পাঠশালাতেই দেখা হচ্ছে তাদের-

‘চলি গেল শীঘ্র গতি ভাবক ভাবিনী।

পাঠশালে দোহান মিলন হৈল পুনি।।’

— যদিও শেষপর্যন্ত তাদের প্রেম পরিনয়ে আবদ্ধ হলোনা, সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু আঠারো শতকের একটি আখ্যানে আমরা ছেলেমেয়েদের একই পাঠশালে পড়ার নজির ও তার ফলস্বরূপ প্রেমে পড়ার যে নিদর্শন পেলাম, তা তো একেবারে এই সময়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিকতম ঘটনা বলে মনে হয়।

পাঠশালার শিক্ষায় হিন্দু ও মুসলমানরা একই সঙ্গে পড়াশোনা করতো। মূলত গ্রামের মন্দিরে আটচালায় বা ধনাঢ্য ব্যক্তির বৈঠকখানা, বারান্দা বা রোয়াকে পাঠশালা আয়োজিত হতো। দু-একটি স্থলে ব্যতিক্রম থাকলেও শিক্ষার্থীরা অধিকাংশই ছিল ছাত্র। ছাত্রের বাড়ির ‘সিধা’ থেকেই পন্ডিতমশায়ের সংসার নির্বাহ হতো। নগদ মূল্যের চেয়ে বেশী ছিল কলাটা, মুলোটা এমন কি অবস্থাপন্ন ছাত্রদের বাড়ির চাল,ডাল, পুকুরের মাছ আসতো পণ্ডিতমশায়ের জন্য। উনিশ শতকেও পাঠশালার প্রসার ছিল যথেষ্ট। পরমেশ আচার্য তার ‘বাংলার দেশজ শিক্ষাধারা’ গ্রন্থে, ‘এ্যাডাম রিপোর্ট’ সম্পর্কে জানাচ্ছেন- ‘দেশজ পাঠশালা শিক্ষা সম্পর্কে সরেজমিন তদন্ত করে উইলিয়াম এ্যাডাম ১৮৩৫, ১৮৩৬ ও ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনটি বিস্তারিত প্রতিবেদন পেশ করেন শিক্ষা কমিটির কাছে। তিনি জানাচ্ছেন যে, তখন বাংলা ও বিহারের দেড় লক্ষ গ্রামের বেশিরভাগ গ্রামে একটি করে পাঠশালা ছিল। তাঁর মতে তখন এক লক্ষ দেশজ পাঠশালা ছিল গরিব শ্রেণির শিশুদের মাতৃভাষায় লেখা, পড়া আর অঙ্ক শেখার জন্য।’ এড্যাম রিপোর্ট থেকে জানা যায় পাঠশালা শিক্ষা ছিল স্বতন্ত্র শিক্ষা, এর সঙ্গে টোল বা চতুষ্পাঠী শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। পাঠশালার শিক্ষার বিষয় ছিল বর্ণপরিচয়, বানান শিক্ষা, প্রাথমিক গণিত, ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োজনীয় হিসেবের জন্য শুভঙ্করী-আর্যা।

সতেরো শতক থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পাঠশালার ভূমিকা বাংলা ও বাঙালির জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ আমলে ভারতের প্রথম শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট ১৮৮৪’তে জানাচ্ছে, ১৮৮১-৮২ তে পঞ্চাশ হাজার পাঠশালাকে শিক্ষা বিভাগের আওতায় আনা হয়েছে। যদিও পাঠশালার পরিবর্তে বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই। বিদ্যাসাগর মহাশয় দক্ষিণবঙ্গে যে কুড়িটি আদর্শ বিদ্যালয় বা মডেল স্কুল স্থাপন করছেন তার সময়কাল……. বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের সময়কাল। যদিও তারপরও দীর্ঘ সময়কাল জুড়ে বিদ্যালয়ের মধ্যেও পাঠশালার ধরন-ধারন বজায় ছিল। বিদ্যাসাগর যে বিদ্যালয় স্থাপন করছেন সেখানেও শিক্ষক নিয়োগ ছাড়া বাকিটা ছিল পাঠশালার বৈশিষ্ট্য। বিদ্যালয় থেকে পাঠশালার গন্ধ মুছতে অনেক অনেক দিন সময় লেগেছে। এমনকি স্বাধীনতা উত্তরকালেও কোনো কোনো পাঠদানে পাঠশালার রীতিনীতি বজায় ছিল পাঠশালায়-পড়া মাস্টারমশাইয়ের আনুকূল্যে।

পাঠশালা সম্পর্কে নানান তথ্য উঠে আসে নানা খ্যাতজনের লেখায় স্মৃতি-রেখায়। আগ্ৰহী পাঠক দেখতে পারেন- ‘সেকালের শিক্ষা/উজ্জ্বল উদ্ধার, সঙ্কলন-সম্পাদনা- অপূর্ব সাহা, আলাপ প্রকাশনী।’ উক্ত সঙ্কলন-গ্ৰন্থ থেকে পাঠকের দরবারে রাখা যাক সেকালীন পাঠশালার কিছু অভিনব চিত্র। অক্টোবর ১৮৯৫, ‘দাসী’ পত্রিকায় রাসবিহারী সেন তার ‘সেকালের পাঠশালা’ রচনায় সেই সময়ের পাঠশালার শাস্তি বিষয়ে ‘মনোজ্ঞ’ বর্ণনা দিয়েছেন। একথা তো অনেকেরই জানা যে আজ ছাত্রছাত্রীদের কোনরূপ শাস্তি দেওয়া চলেনা এবং তুলনায় সেকালে শাস্তি ছিল চরম কড়া। শুধুমাত্র লাঠিষ্যোধির সাহায্যেই কত কত পন্ডিত অনায়াসে ছাত্রদের শায়েস্তা করেছেন এবং শিক্ষিতও করেছেন। এখন যেমন স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের হাজিরার বিষয়টি তেমন কড়া নয়। কোথাও কোথাও নূন্যতম উপস্থিতির হার থাকলেও, সেও খুব নরম গোছের। তা সেকালীন পাঠশালায় ছাত্রদের গরহাজিরাকে মোটেই হাল্কাভাবে নেওয়া হতোনা। কে আসছে, কে আসছে না, এবিষয়ে কড়া নজর থাকতো মাস্টরমশায়ের। অনুপস্থিতির কারণও ঐ সময়ে সংশ্লিষ্ট ছাত্রের যথাযথ অবস্থান নজরে রাখার জন্য মাস্টারমশায়ের নিজস্ব টিম ছিল, আর সেই টিম নিজেদের এহেন কাজে চরম আন্তরিকতার সঙ্গে নিজেদের উজাড় করে দিত। পাঠশালায় একজন থাকতো ‘সর্দার-পোড়ো’, সে মাস্টারমশায়ের সহকারী, অবশ্যই তাকে পড়াশোনায় ভালো হতে হতো, কেননা অনেক সময় পাঠশালার পাঠে তাকেই নেতৃত্ব দিতে হতো। পাঠশালার নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায়ের ক্ষেত্রেও ‘সর্দার-পোড়ো’র ভূমিকা ছিল প্রবল। আজকের দিনে ক্লাস-মনিটরের সঙ্গে যা তুলনীয়। অনেক সময় বেয়াড়া বিশৃঙ্খল ছেলেকে শায়েস্তা করার গুরুদায়িত্ব নিতে হতো ‘সর্দার-পোড়ো’ দের। তবে যে কোনো কারণে যে কোনো বালকের শাস্তিদানের বিষয়টি বাকি বালকদের কাছে যে বেশ উপভোগ্য, তা সবকালেই সমান সত্যি। রাসবিহারী সেন মহাশয় তার রচনায় সেকালের শাস্তির একখানি ছবি ছড়ায় বর্ণনা করেছেন-

‘গুরুমশায় গুরুমশায় আর বলব কি

বেত বনের আসামী হাজির করেছি

রাম তুলসী রাম তুলসী রাম তুলসীর পাতা

গুরুমশায় কয়ে দিছেন কান মলার কথা। ‘

— বিষয়টি ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, কোনো বালক পাঠশালায় ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে ছিল বেত বনের আড়ালে, কিন্তু বাকি বালকদের বা মাস্টারমশায়ের হুকুম-পালনে সদাব্রতী গোয়েন্দা-টিমের নজর এড়াতে পারেনি সে বালক। তার ফলে তাকে সবাই মিলে পাকড়াও করে মাস্টারমশায়ের কাছে আনার সময় আসামী-ধরার সাফল্যে গোয়েন্দা-টিমের ঐ আনন্দ-গান।

জলধর সেন মহাশয় তার ‘সেকালের পাঠশালা’ রচনায় অনুরূপ শাস্তির কথা বলেছেন। ধরা যাক নিতাই নামে কোন এক বালক পাঠশালায় অনুপস্থিত। আমবাগানে বা জামবাগানে লুকিয়ে থাকা নিতাই ধরা পড়ে গেছে গোয়েন্দা ছাত্রদের হাতে এরপর নিতাইকে চ্যাংদোলা করে ঐ ছাত্ররা নিয়ে যাচ্ছে গুরুমশায়ের কাছে। যাওয়ার সময় তারা ছড়া কাটছে-

‘নিতাই যাবে শ্বশুর বাড়ি সঙ্গে যাবে কে পাঠশালাতে জোড়া বেত নাচতে লেগেছে

এক তুলসী, দুই তুলসী, তিন তুলসীর পাতা গুরুমশাই বলে দিছেন কান মলবার কথা।’

-গরহাজিরাতে গুরুমশায়ের প্রথম শাস্তি জোড়া বেত আসামী-বালকের পিঠে নিশ্চিহ্ন হবে, এরপর প্রয়োজনে দ্বিতীয় শাস্তি- গুরুমশায়ের হুকুম মতো- ‘ওকে উঠোনের রৌদ্রের মধ্যে ওর হাতের আড়াই হাত জমি মেপে– দুই পা সেই পরিমাণ ফাঁক করে দাঁড় করা– আর ওর দুই হাত সমুখ দিকে উঁচু করিয়ে দিয়ে তার উপর দুইখানি দশ ইঞ্চি ইট বসিয়ে দে।’

— এই শাস্তির কথা আমরা আরও অনেকের লেখায় পাই। শ্রী কালীকৃষ্ণ ঘোষ, তার ‘সেকালের চিত্র'(১৯১৮) গ্ৰন্থের গোড়াতেই সেকালের পাঠশালার সূত্রে এক গুরুমশায়ের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন- ‘ভাই, এই যে ছেলে আমার কাছে দিতে আনিয়াছ, ইহার কেবল হাড় ক’খানি তোমার, চামড়া ও মাংস আমার। এই সর্ত্তে যদি ছেলেকে এখানে দিতে হয় দাও, না হয় তোমার ছেলে তুমি নিয়া যাও।’

আরও অন্যান্য তথ্যের মধ্যে উল্লেখ্য, সেকালের পাঠশালার পাঠ শুরু হতো সকাল থেকেই শেষ হতে সন্ধ্যে নামার আগে, মাঝখানে দু’বার বিরতি। প্রথমটা জলখাবারের ছুটি, যাকে বলা হতো ‘এড়াভাত’ এর ছুটি, যা সম্ভবত পান্তাভাত খাওয়ার ছুটি। তারপর আবার পাঠ। আর দ্বিতীয় বিরতি ছিল, দুপুর বেলার ভাতের ছুটি। সে ছুটি সবাই একসঙ্গে পেতো না, গুরুমশায় জানতেন কার বাড়িতে কখন ভাত হয় সেই অনুযায়ী তিনি পোড়োদের ছাড়তেন। আর সকাল-সকাল পাঠশালায় আসাটা ছিল ভালো ছাত্রের পরিচয়জ্ঞাপক। এই বিষয়টা আমরা বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ বা তারও কিছু পরবর্তী কাল অবধি খেয়াল করি। বিদ্যাসাগরের গোপাল পাঠশালায় সবার আগে যায়, আর রাখাল সবার শেষে যায়, ভালো ও মন্দের দুই নিদর্শন পাঠশালায় এহেন উপস্থিতি সেই সময়ের খুব বিচার্য বিষয়। তাই সেকালীন পাঠশালায় যে সবার আগে পৌঁছাতো তার হাতে গুরু মহাশয় বেত দিয়ে একটি শন্যি/শূন্য দিতেন, এরপর যে পৌঁছাতো তার একটি বেত, তারপরের জনের হাতে দুটি, এইভাবে তিন, চার, পাঁচ করে বেতের সংখ্যা বাড়তো। সবচেয়ে শেষে আসা ‘রাখাল’ এর অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়।

তবে সব ছাত্রই যে অবনত মস্তকে গুরুমশায়ের শাস্তি মেনে নিত তা হয়তো নয়। সেকালও বেশকিছু বেয়াড়া ডানপিটে ছেলে ছিল বইকি। রাসবিহারী সেনের স্মৃতিধর্মী রচনায় সেরকমই এক মদনমোহন নামক দুষ্টু বালকের পরিচয় আছে, যে পাঠ চলাকালীন অঙ্ক করার পরিবর্তে তাদের পাঠশালার মাস্টামশাইদের কার্য-কলাপ নিয়ে একখানি পদ্য লেখে। পদ্যটা ছিল-

‘হেডমাস্টার মুদের কামড়

তার নীচেতে নবনে বানর,

নবনে বানর বেড়ায় গাছে

বেণী বাঘ তার নীচে আছে।

বেণী বাঘের দাঁত খিটিমিটি

ফোর্থ মাস্টার বামা টিকটিকি,

গুপে পন্ডিত নষ্টের গোড়া

বিদ্যা বুদ্ধি কচুপোড়া।’

— মদনমোহনের এরকম ‘উচ্চমানের’ কবিত্বের পরিণতি হলো ভয়ঙ্কর, বেণী মাস্টার মারফত ঐ কবিতা-লেখা শ্লেট জমা পড়লো হেডমাস্টারের জিম্মায়। ডাক পড়লো ‘বিচ্ছু’ মদনমোহনের, তৎক্ষণাৎ তার শাস্তি হলো হাত-পা বেঁধে বিছুটি-গাছের মার, তারপর শাস্তি ঘোষণা হলো আগামী সাতদিন পাঠশালার বারান্দায় রোদে সে হবে ‘লাড়ুগোপাল’। অর্থাৎ হাঁটু মুড়ে বসে একহাতে ইঁট নিয়ে বসে থাকতে হবে। শাস্তি যে খুবই গুরুতর সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে এহেন শাস্তি দানের পরেও মদনমোহনের কবিত্বে ভাটা পড়ে নাই। পরে আরও কোনো এক কারণে তাকে ‘লাড়ুগোপাল’ সাজা ছেড়ে, সাজা স্বরূপ ‘কেষ্টঠাকুর’ সাজতে হয়, অর্থাৎ বেঞ্চের উপর একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা। তা সেই শাস্তিকেও পদ্যাকারে বেঁধে ফেললো স্বভাব-কবি মদনমোহন, লিখে ফেলল-

‘ফোর্থ কেলাসে থার্ড মাস্টার থার্ড জানুয়ারী করে দিলে বেঞ্চির উপর মোহন বংশিধারী ।

বেণী মাস্টার মানুষ-বাঘ সদাই থাকে চটে চক্ষুদুটি মুদিত সদা পাছে নেশা ছোটে।

আর জন্মে বোলতা ছিল বেণী মাস্টার **

এই জন্মে তার হুলের বিষে প্রাণটা ঝালাপালা।’

— নির্মম শাস্তিদানের এই নির্মেদ কবিত্বের নিদর্শন এবার পৌঁছালো মদনমোহনের বাড়ি অবধি, বাড়িতে ছিলেন মদনমোহনের পিসীমা, তিনি কবিতা শুনে চমৎকৃত হলেন, মদনমোহনের এই লেখনী সমৃদ্ধ গুণপনায় তিনি যারপরনাই মুগ্ধ, উল্টে তিনি গ্ৰামের মাস্টার বেণীকেই চোখা চোখা বিশেষণে বিশেষিত করলেন। সেকালের পাষান-হৃদয় মাস্টারমশাইদের দু’চার কথা শোনাতে পারতেন এই পিসিমারই। আর তখন প্রায় ঘরেই অকাল-বৈধব্যের কারণে দু’একখানা পিসিমা বিরাজ করতেন। নতুবা এহেন মাস্টারমশাইদের ‘নৈরাজ্যে’ প্রাণ টেকানো দুষ্কর ছিল। তবে মদনমোহনের মতো হাড়বজ্জাত ছেলেও ছিল, যাদেরকে বাগে আনাটাও ছিল কঠিন কাজ। এতখানি শাস্তির পরেও তার বদমাইশি কমেনি, মাস্টারমশাইদের বানর, টিকটিকি, বাঘ, বোলতার পাশাপাশি এমন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যা রাসবিহারী সেন মহাশয় ছাপার অক্ষরে আনতে পারেননি। যদিও ‘ঝালাপালা’র অন্ত্যমিলে কি ‘সম্বন্ধীয়’ শব্দ হতে পারে সে বিষয়ে আমরা অনুমান করতে পারছি।

সেকালের পাঠশালায় পাঠ সম্পর্কিত তথ্য-মধ্যে উল্লেখ্য- লেখা ও পড়ার বিষয় বলতে প্রথমে বর্ণ পরিচয়, বানান শিক্ষা, যুক্তাক্ষর বানান, নীতিবাক্য শেখা, পত্রলেখা, অঙ্ক- গণনা, শুভঙ্করী-আর্যা। শিক্ষণ-বই বলতে বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ বা মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’র থেকেও বেশি জনপ্রিয় ছিল ‘শিশুবোধক’ নামক এক সংকলন গ্রন্থের। উক্ত সঙ্কলন-গ্ৰন্থটি যেন পাঠশালার ‘সিলেবাস’ ভিত্তি করেই বানানো। আর লেখার ক্ষেত্রে ছিল বিশেষ শ্রেণীবিভাগ। প্রথম পড়ুয়াদের লেখার বন্দোবস্ত ছিল মেঝেতে, তারপর অক্ষরের ছিরিছাঁদ ঠিক হলে তালপাতায়, হাতের লেখার আঁকিবুকি সুন্দর ও মসৃণ হলে সে ছাত্র উন্নীত হতো কলাপাতায়। এরপর হস্তাক্ষর মাস্টারমশায়ের মনমতো হলে তাকে দেওয়া হতো কাগজ ও খাগের কলম। এই যে মেঝে < তালপাতা < কলাপাতা < কাগজ —– এই পুরো লেখনীর যাত্রা পূর্ণ হতে লেগে যেত অনেক বছর। তালপাতা থেকে কলাপাতায় উন্নীত হওয়াটা ছিল উৎসবের মতো। কোনো কোনো বাড়িতে অনুষ্ঠানও হতো। আর কাগজ-কলম প্রাপ্তি তো শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার স্মারক। রাজনারায়ণ বসু মহাশয় তার ‘সেকাল আর একাল’ গ্ৰন্থে সেকালের পাঠশালার সম্পর্কে বলছেন, ‘পাঁচ বৎসর হইতে দশ বৎসর বয়স পর্যন্ত্য তালপাতে, তারপর পনেরো বৎসর বয়স পর্যন্ত্য কলাপাতে, তারপর কুড়ি বৎসর বয়স পর্যন্ত্য কাগজে লেখা হইত। সামান্য অঙ্ক কষিতে, সামান্য পত্র লিখিতে ও গুরুদক্ষিণা ও দাতা কর্ণ নামক পুস্তক পড়িতে সক্ষম করা গুরুমহাশয় দিগের শিক্ষার শেষ সীমা ছিল।’ রাজনারায়ণ বসুর পড়াশোনার শুরু পাঠশালায় হলেও পরবর্তীতে তিনি স্কুলের ছাত্র। যদিও জলধর সেন মহাশয়ের বক্তব্য অনুযায়ী- সেকালের সরস্বতী পুজোর দিন হাতেখড়ির রীতি ছিল (আজও আছে) এরপর একটি শুভ দিন দেখে পাঠশালায় ভর্তি, ছেলেরা প্রথম লেখা শুরু করতো তালপাতায় তারপর তালপাতার হাত ঠিক হলে ছেলেকে কলাপাতায় প্রমোশন’ দেওয়া হতো। তারপর যখন হাতের লেখা গুরুমশাইয়ের মনের মতন হতো তখন ছাত্র কাগজ হাতে করতে পেতো। আর এই কাগুজে ছাত্র হতে সাধারণত ছাত্রের চার-পাঁচ বছর লাগতো। তিনিও বলছেন আমাদের পাঠশালায় তখন একখানি বটতলার বই আদর পেয়েছিল, সেখানির নাম ‘শিশুবোধক’। তার আরও বক্তব্য- ‘এই বইখানা ছেলেদের হাতে দেওয়া হতো না। এখানি পাঠশালার সম্পত্তি। বইখানির আগাগোড়া গুরুমশাই ও সর্দার পোড়োদের কণ্ঠস্থ ছিল। তারা সকল ছাত্রকে লাইন বেঁধে দাঁড় করিয়ে, সুর করে একটু একটু আবৃত্তি করতেন, আর সকল ছাত্র তেমনি করে আবৃত্তি করত।’

স্কুল-শিক্ষায় শিক্ষিত পরবর্তীতে ইংরেজি শিক্ষায় পরিশীলিত রাজনারায়ণ বসুর মতো অনেকেই পাঠশালার শিক্ষাকে একটু অন্য নজরে দেখলেও, রায়বাহাদুর জলধর সেন পাঠশালার পক্ষে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছেন, তিনি বলছেন- ‘এই বাঙালা স্কুলে পড়াশোনার ব্যবস্থা আর পাঠশালার পড়াবার রীতি, এর মধ্যে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ, এরকম যদি কেহ আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে আমি নিঃসংকোচে বলব যে আমাদের ছেলেবেলায় আমরা পাঠশালে যে শিক্ষা পেয়েছিলাম, তা স্কুলের শিক্ষা অপেক্ষা অনেক ভালো।’

সব দিক বিচার করে বলা যায় যে, পাঠশালার পাঠে হয়ত সীমাবদ্ধতা ছিল। কিন্তু একথা মানতেই হবে যে, আড়াই থেকে তিন শতক বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার বিস্তীর্ণ এলাকায় যে লক্ষাধিক পাঠশালা ছিল, সেখানে প্রয়োজনীয় বাংলা এবং নিত্য ব্যবহার্য অংকের যে পদ্ধতি ও প্রকরণ চালু ছিল তা সেই সময়ের জনজীবনের পক্ষে ভীষণই সহায়ক হয়েছিল। পাঠশালা উঠে যাওয়ার পরেও আরো কয়েক দশক স্কুলের গায়ে পাঠশালার আলো-ছায়া থেকে গিয়েছিল। স্কুল ছুটির বেলায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে কোরাসে নামতা পড়ার অভিজ্ঞতা তো আমরাই লাভ করেছি গত শতকের ন’য়ের দশকে, সে অভিজ্ঞতায় এটা মানতে বাধ্য এক থেকে কুড়ির কঠিন নামতা রপ্ত হয়েছিল, ঐ সমবেত সরব পাঠের অনায়স ছন্দে।

আর পাঠশালার মুক্তাঙ্গনে এরকম অনায়স ছন্দে, অনাবিল আনন্দে অনেক অনেক কিছুই রপ্ত হতো যা অর্থ উপার্জনের সহায়ক না হোক, জীবনযাপনে শিক্ষার্জনের অর্থ জানতে সহায়ক হতো।

সহায়ক গ্ৰন্থ :-

১. বাংলার দেশজ শিক্ষাধারা, পরমেশ আচার্য, অনুষ্টুপ প্রকাশনী, ২০০৯।

২. সেকালের শিক্ষা/উজ্জ্বল উদ্ধার, সঙ্কলন-সম্পাদনা- অপূর্ব সাহা, আলাপ প্রকাশন।

৩. সেকালের কথা, রায় শ্রীজলধর সেন বাহাদুর, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স, ১৩৩৭।

৪. সেকাল আর একাল, শ্রীরাজনারায়ণ বসু, বাল্মীকি যন্ত্র, ১৭৯৬ শকাব্দ।

ব্যাক্তি ঋণ :-

দেবাশিস মুখোপাধ্যায় (দে.মু), সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়

মাদ্রাসা শিক্ষার সেকাল একাল

   

সা’আদুল ইসলাম

মাদ্রাসা শব্দটি আরবি, যেখানে ‘দারস’ অর্থাৎ পাঠ দান করা হয়, শিক্ষাগার। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স) প্রথম শিক্ষদাতা। আর শিক্ষালয় হল মক্কার অদূরে পর্বত সমাকীর্ণ দুর্গম গলিপথে অবস্থিত ইবনে রকিমের বাড়ি, ‘দারে আরকাম’।

আরকাম ইবনে আবী আল আরকাম মাখযুমী (রাজি)। কারণ, ইসলামের নবীজীর এক আল্লায় আহ্বানের প্রথম লগ্নে কোরায়েশদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে নবীজী দুচারজন সঙ্গী নিয়ে মিলিত হতেন এই দুর্গম স্থানে অবস্থিত বাড়িটিতে। সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের সানুদেশে সা ঈ করার সময় এই বাড়ি থেকে বাইরে দেখা যেত, গলিটিতে প্রবেশের মুখটি সংকীর্ণ ছিল বলে বাড়িটি নিরাপদ মনে করতেন নবীজী ও তাঁর সঙ্গীরা। সেখানেই সঙ্গীদের শিক্ষা দিতেন মহানবী। ইসলামের শিক্ষার ইতিহাসে ‘দার-এ- আরকাম’ তাই মাদ্রাসাব্যবস্থার প্রথম সোপান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।

মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পরে মসজিদে নববীর পূর্ব পাশে ‘আহলে সুফফা’দের (আবাসিক প্রিয় সহচরগণ) মধ্যে শিক্ষাদান করা হতো। শিক্ষক উবাদা ইবনে সামেত। শিক্ষার্থী ছিলেন আবু হোরায়রা, মুয়াজ ইবনে জাবাল, আবু জার গিফারী (রাযি) প্রমুখ অনেক বয়স্ক সাহাবী।

মাদ্রাসা শিক্ষার গোড়ার কথা, আগে মানসিক প্রস্তুতি ও শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। ক্রমে খলিফাগণ নানা দিকে মাদ্রাসা স্থাপন করেন। হযরত আলি (রাযি) মাদ্রাসা স্থাপন করেছেন কুফায়। পরবর্তীকালে খলিফাগণ দরবারে পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ করে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার উজাড় করে দেন পৃথিবীবাসীর কাছে। স্পেন বিজয়ের পরে কর্ডোভার কথা কে না জানে? এদিকে আব্বাসী দরবারে বসে চরক সুশ্রুত-র মতো ভারতীয় সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ ও ভেষজ বিদ্যার চর্চা, গণিত, দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে ‘পঞ্চতন্ত্র’ অনুবাদ হচ্ছে ‘কলীলাহ ওয়া দিমনাহ’ নামে। অর্থাৎ রসসাহিত্যের চর্চা হচ্ছে। ইসলামের ভাবনায় রয়েছে এই বিশ্বাস — জ্ঞান হচ্ছে পানি। পানির অপর নাম জীবন। তাতে কোন বাঁধ নেই, বাধা নেই। শিক্ষায় বাধা দেয় মানবতার শত্রুরা। আর যারা লাইব্রেরি পোড়ায়? … তারা শত্রু সভ্যতার।

কারণ, ইসলামের প্রথম ঐশী বাণী ই হচ্ছে – ‘ ইকরা বিসমি রব্বিকাল্লাযী খালাক্ব্ ; পড়ো বিশ্বজগতের প্রভুর নামে।’ পড়ো শব্দটি প্রথম শব্দ কোরআনের এবং ইসলামের। খলিফাদের আমলে মাদ্রাসা স্থাপিত হয়েছে আর তৈরি হয়েছে লাইব্রেরি। গবেষণাগার, মহাকাশ গবেষণায় মানমন্দিরও। কিন্তু সেকথা পরে।

কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছে মসজিদ থেকেই কোরআনিয়া মাদ্রাসা কিংবা মক্তবের নামে যে প্রাথমিক শিক্ষার ধারা চলে এসেছে কয়েকশো বছর ধরে তা মসজিদকেন্দ্রিক। ইসলামের ইতিহাসে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার সাহাবীরা রাযিয়াল্লাহু আনহুম মসজিদে বসেই তালিম নিয়েছেন, কখনো কারো বাড়িতে শিক্ষাদাতা কোন ব্যক্তি হাজির হয়েছেন অন্যেরা বসে শিক্ষাগ্রহণ করেছে। নারীদের শিক্ষার জন্য পুরুষরা মসজিদের শিখেছেন বাড়িতে গিয়ে সেই তালিম তারা করতেন মহিলাদের এবং সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে। মোটামুটি এই ছিল খোলাফায়ে রাশেদার আমলের শিক্ষাধারা।

উমাইয়া আমলে মূয়াবিয়া (রাযি)-র সময়ে দামেস্কে মাদ্রাসা তৈরি হয়েছে, কিছু গণিত, ভূগোল, হস্তলিপি বা ক্যালিগ্রাফি, ইসলামের আকিদা বা প্রারম্ভিক দর্শন, ইসলামী আদব কায়দা, কিছু পরিমাণে ব্যাকরণ ও লজিক এই মাদ্রাসাগুলিতে শিক্ষাদানের বিষয় ছিল।

ভিন্ন স্থান থেকে কখনো ইরানীয় কখনো বা অন্য কোন দেশের মানুষ এসে উপস্থিত হওয়ায় আরবি ভাষার ভিতরে যে বিমিশ্রতা তৈরি হয়, তার থেকে বাঁচানোর জন্য আরবি শিক্ষার উপরে, পাঠ ও উচ্চারণশৈলীর শিক্ষাদানের উপরে গুরুত্ব দেওয়া হতো। হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর আমলে সিরিয়াতে দামেশকে। উচ্চতর শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল, ‘বায়তুল হিকমাহ’ (এর নামও বায়তুল হিকমাহ) নামে গ্রন্থাগার। বিভিন্ন ভাষার রচিত মূল্যবান গ্রন্থগুলির সংগ্রহ, গ্রিক পারসিক এবং ভারতীয় ভাষা সংস্কৃত থেকে অনুবাদ হয়েছে উমাইয়া খলিফাদের শেষের দিকে।

বায়তুল হিকমাহ

প্রকৃতপক্ষে, ঐকান্তিক জ্ঞানচর্চার স্রোত বয়ে যায় অষ্টম শতাব্দীতে বাগদাদে বসে আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ উমাইয়া শাসনের অবসান ও আব্বাসিয়া শাসন শুরু। আল-মনসুর ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে রাজধানী স্থাপন করেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণীদের সেখানে আমন্ত্রণ জানান। খলিফা হারুনুর রশিদ ( শাসনকাল ৭৮৬-৮০৯) এবং তাঁর পুত্র আল মামুন (শাসনকাল ৮১৩-৮৩৩) এদের শাসনকালে ‘বাইতুল হিকমাহ’ ( House of Wisdom) শুধু বিজ্ঞানভবন নয়, সারা পৃথিবীর কাছে স্বর্ণযুগের জ্ঞানভাণ্ডারের পরিচয় তুলে ধরে। গ্রিক পারসিক ও ভারতীয় ভাষার জ্ঞান আহরণ করে, অনুবাদ কর্মের মাধ্যমে ও মৌলিক গবেষণার মধ্য দিয়ে বায়তুল হিকমাহ প্রকৃতই এক স্বর্ণযুগ সৃষ্টি করে শিক্ষাক্ষেত্রে। বিজ্ঞান চর্চায় চিকিৎসা বিজ্ঞান, গণিত, অ্যালজেবরা এবং নানা প্রকৌশলী যন্ত্র উদ্ভাবন ইত্যাদি ক্ষেত্রে এক অসামান্য অগ্রগতি শুরু হয়।

মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খোয়ারিজমী (৭৮০-৮৫০) রচিত ‘কিতাব আল জাবর ওয়াল মুকাবলা’ (যার থেকে বীজগণিত কে অ্যালজেবরা বলা হয়) এবং তার ‘অ্যালগরিদম’ সূত্র উদ্ভাবন, আরব জগতে হিন্দু সংখ্যা পদ্ধতির প্রচলন, যা পরে ইউরোপে পৌঁছায়, বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আহমদ ইবনে মুসা ইবনে শাকিব ছবিসহ যন্ত্র- বিষয়ক বই পূর্ণাঙ্গ বর্ণণা সহকারে প্রকাশ করেন। আহমদ ইবনে মুসা ও তার ভাতৃদ্বয় আহমদ ইবনে মুসা ও হাসান ইবনে মুসা (তাদেরকে একত্রে বলা হতো বুনু মুসা) বিখ্যাত প্রকৌশলী ছিলেন। গ্রন্থটির নাম ‘কিতাবুল হিয়াল’।

পদার্থবিজ্ঞানে মুহাম্মদ জাফর ইবনে মুসা মুহাম্মদ মুসা পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের বিশ্বজনীনতার কথা প্রথম বলেন।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে হুনায়ন ইবনে ইসহাক চক্ষুরোগ বিষয়ে আলোকপাত করেন। অন্যান্যরা গুটিবসন্ত ও সংক্রমণ বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেন। এবং সেই যুগে শল্যচিকিৎসা বা অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করেন চিকিৎসক।

আলকেমি বা রসায়ন বিজ্ঞানে আল কিন্দী (৮০১-৮৭৩)-র নাম উল্লেখযোগ্য। এই মহাবিজ্ঞানী প্রতিভা বিজ্ঞানের নানা শাখায় রসায়ন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, আবহবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে পেরিপ্যাটেটিক দর্শনেরও পুরোধাপুরুষ ছিলেন। জ্ঞানের ব্যাখ্যায় আল কিন্দী তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন। ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও কল্পনা। ইন্দ্রিয় মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়, বুদ্ধির সাহায্যে প্রজ্ঞার অধিকারী হওয়া যায় এবং কল্পনা এই দুইয়ের সমন্বয় সাধন করে। ইমানুয়েল কান্টের সমন্বয়বাদী জ্ঞানতত্ত্ব-এর সঙ্গে আল কিন্দীর দর্শনচর্চার যোগসূত্র দেখতে পাওয়া যায়। কান্ট বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের সমালোচনায় এক সমন্বয়ক আবিষ্কার করেন, এর নাম দেন সমীক্ষণবাদী বুদ্ধি। কান্টের ৯০০ বছর আগে আল কিন্দী অনেকটা এরকম তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন। তিনি কম্পাঙ্ক বিশ্লেষণ পদ্ধতির আবিষ্কর্তা এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে সংগীত থেরাপির প্রয়োগকারী ছিলেন। গুপ্ত সঙ্কেতের মর্মোদ্ধারের জন্য গাণিতিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে গৃহীত হয়েছে।

ইবনে সিনা (আনু. ৯৮০-১০৩০) প্রাক-আধুনিক যুগে সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও দার্শনিক। তিনি একাধারে গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানী। তাঁর লেখা ৪৫০ বইয়ের মধ্যে ২৪০ টির সন্ধান মেলে। ১৬৫০ খ্রি. পর্যন্ত তাঁর চিকিৎসা বিজ্ঞান (চিকিৎসাবিষয়ক বিশ্বকোষ) সারা ইউরোপে পাঠ্য ছিল বলে কথিত। ইবনে সিনার অতি বিখ্যাত বই হল ‘আল কানুন ফিত তিব’ ও ‘কিতাবুশ শিফা’। “শিশুদের প্রশিক্ষণ ও লালন পালনের ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা” শীর্ষক আলোচনায় শ্রেণীভিত্তিক শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। আলোচনা ও পারস্পরিক অনুসরণের মধ্যে শিশুদের শিক্ষা কার্যকরী হয়ে ওঠে। দুটি স্তর কল্পনা করেছেন : ৬ বছর বয়স থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা এবং ১৪+ বছরের ঊর্ধ্বে উচ্চতর স্তর। এই স্তরে কোরআন, হাদিস, ইসলামী দর্শন ভাষা, সাহিত্য ইসলামী আচার-ব্যবহার এবং ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক দক্ষতা অর্জন করার ব্যবস্থা দিয়েছেন। যা কর্মক্ষেত্রে তাদের স্বনির্ভর হতে সাহায্য করবে। তাদের তিনি ইচ্ছামত বিষয় নির্বাচন, বৃত্তিনির্ভর শিক্ষা আর এমন সংবেদনশীল বয়সে তাদের প্রতি নমনীয়তা ও তাদের মানসিক বিকাশ বিবেচনায় রাখা দরকার বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন।

ভারতীয় গ্রিক ও পার্শিয়ান রচনা ব্যবহার করে জ্ঞান বৃদ্ধির চেষ্টা চলে বাগদাদে। ত্রয়োদশ শতকে ‘মেটেরিয়া মেডিকা’র আরবি অনুবাদ হয়। কিন্তু এই বিশাল অনুবাদকর্মের মধ্যে প্রথমটি হলো অ্যারিস্টোটলের ‘টপিক’ গ্রন্থের অনুবাদ। তারপর পিথাগোরাস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হিপোক্রেটিস, ইউক্লিড, আর্যভট্ট, এবং ব্রহ্মগুপ্তের লেখার অনুবাদ।

খলিফা আল মামুন (শাসনকাল ৮১৩-৮৩৩) আকাশ বিজ্ঞান গবেষণার জন্য মানমন্দির স্থাপন করেন। শামাসিয়া অঞ্চলে ৮২৮ খ্রিস্টাব্দে স্থাপন করেন ‘মুমতাহান মানমন্দির’। দ্বিতীয় মানমন্দিরটি দামেশকে কাসিউন পর্বতে। “আল জিজ আল মুমতাহান” গ্রন্থে মানমন্দির বিষয়ক পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করে রাখা আছে। জিজ হল টেবল বা সারণী, গোটা বইটিতে সারণীর মাধ্যমে মানমন্দির গবেষণা – পর্যবেক্ষণ ধরে রাখা হয়েছে।

শিক্ষার সোনালী অতীত ধ্বংস হল হলাগু খানের হাতে

নবম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বিশ্বের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র ছিল। বায়তুল হিকমাহ মোঙ্গলদের সময় হলাগু খান বাহিনীর হাতে এই বিশাল শিক্ষাকেন্দ্র ও গ্রন্থাগার ধ্বংস হয় মোঙ্গলদের বাগদাদ অবরোধের সময়। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি, তেরো দিন ধরে বিপুল ধ্বংসক্রিয়া চলে। শেখ সাদী ১৫৫৮ সালে বিখ্যাত নিজামিয়া মাদ্রাসা ধ্বংস প্রত্যক্ষ করেন।

দেখা গেল

১. মসজিদকেন্দ্রিক প্রাথমিক শিক্ষা মূলত কোরআন ও হাদিসের পাঠদান।

২. ব্যক্তি শিক্ষকের বাড়িতে গিয়ে শিক্ষাগ্রহণের ব্যবস্থা।

৩. খলিফাজাদা ও ওমরাহ ও তাঁদের সন্তানদের শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষককে আমন্ত্রণ জানিয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা।

৪. অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতাল বা সরাইখানা স্থাপন করে তার সঙ্গে রোগ নিরাময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা ছাড়িয়ে উচ্চতর শিক্ষাদানের ব্যবস্থা গ্রহণ।

৫. কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য খলিফাদের বা ওমরাহশ্রেণীর অনুদানের ব্যবস্থাপনা।

৬. ক্রমে উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় লাইব্রেরি স্থাপন, গ্রন্থসংগ্রহ ও সেগুলির অনুবাদ কর্ম চালানো এগুলির মাধ্যমে।

দশম শতাব্দীর পর মক্তব শব্দের ব্যবহার হতে থাকে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষালয় বোঝাতে।

জামেয়া আযহার

ফাতেমী বংশীয়দের ব্যবস্থাপনায় আল-আযহার (যা বর্তমানে জামেয়া আযহার) প্রতিষ্ঠিত হয় ৯৭০/৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে, কায়রো, মিশর। এটি মিশরের প্রাচীনতম শিক্ষাকেন্দ্র । আল মুইজ লিদ দীনিল্লাহ দ্বারা স্থাপিত। বিশ্ববিখ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি আজও সগৌরবে বিদ্যমান।

মাদ্রাসা শিক্ষার স্বর্ণযুগ থেকে বর্তমানের বিবর্ণ অবনমন

দারসে নিজামী আসলে নিজামিয়া মাদ্রাসার সিলেবাসের বিষয় ছিল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বর্তমানে ভারতে দারসে নিজামি নামে যে ইসলামী শিক্ষাধারা চলছে, তার সঙ্গে সম্পর্ক অবশ্যই রয়েছে। ভারতে এই নামের কোর্স চালু হয়েছে হিজরী ১১০০ সালের পরে। মোল্লা নিজামউদ্দিন সাহলভী (১০৮৮/৯৯ মুতাবিক ১৬৭৭/৭৮ খ্রিস্টাব্দে জন্ম) ১০০৫ হিজরি মুতাবিক ১৬৯৩-৯৪ খ্রি. অর্থাৎ ১৭শ শতকের শেষে, ইসলামী শিক্ষাকে ঢেলে সাজালেন, ১১টি বিষয় তার অন্তর্ভুক্ত ছিল। লখনৌতে আওরঙ্গজেবের দেওয়া জায়গীরে বসতি স্থাপন করেন, সেই সঙ্গে স্থাপন করেন মাদ্রাসায়ে নিজামিয়া, লখনৌয়ের অভিজাত ‘ফিরিঙ্গি মহল’ এলাকায়। এই সিলেবাস ‘দারসে নিজামিয়া’ নামে ভারতের বিভিন্ন ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসায় চালু হয়। বিশেষ করে, দারুল উলুম দেওবন্দ প্রভাবিত সকল মাদ্রাসায় এই সিলেবাস চলতে থাকে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের একাদশ শতাব্দীর বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসার সঙ্গে সম্পর্ক থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই, বাগদাদে অবস্থিত নিজামিয়া মাদ্রাসার (কিংবা ভারতের লখনৌয়ের ফিরিঙ্গি মহলে’র মাদ্রাসা; এখানে স্মরণ করি, মোল্লা নিজামুদ্দিনের পূর্বপুরুষ হিরাট থেকে এসেছিলেন) বিবরণ এবং বর্তমানে এর সিলেবাসের যে অবনমন সংবর্জন ও অবমূল্যায়িত রূপটি চালু করা হয়েছে, এটা নিয়ে আলোকপাত করা দরকার, ভারতে বা বাংলার মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা বিষয়ে।

বোঝা যাবে, দারসে নিজামী কোর্স নিয়ে কেন এই প্রতিবেদক এখনও মধ্যপ্রাচ্যে পড়ে আছেন। ইসলামী শিক্ষাধারার কাঠামোটি প্রায় অজর অমর অবস্থায় রয়ে গেছে, অনেক ছাল বাকল পত্র পুষ্প ঝরে গেলেও।

তার আগে কয়েকটি বিখ্যাত মাদ্রাসা নিয়ে আলোচনা থাকছে।

নিজামিয়া মাদ্রাসা প্রথম প্রতিষ্ঠিত নিজামিয়া মাদ্রাসাগুলোর অন্যতম। সেলজূক সাম্রাজ্যের উজির ও পারস্যের বিখ্যাত পণ্ডিত ও দার্শনিক আবু আলী হাসান আলী আল তুসী; ১০১৮-১০৯২) নিজামুল মুলক নামে আখ্যায়িত, তাঁর ব্যবস্থাপনায় ১০৬৫ সালে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হয় এই শিক্ষাকেন্দ্র। তাই-ই মাদ্রাসা নিযামিয়া। এর সিলেবাস আসলে ‘দারসে নিযামিয়া’। ১০৯১- এর জুলাই নিজামুল মুলক দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক আল-গাজ্জালীকে এর অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দান করেন। তখন আল গাজ্জালীর বয়স ৩০ বছর। ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দে গাজ্জালী যখন মাদ্রাসা ত্যাগ করেন তখন এখানে ৩০০০ ছাত্র ছিল। বিনামূল্যে শিক্ষাদানকারী এই প্রতিষ্ঠানটিকে মধ্যযুগের সবচেয়ে বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বার্বার বংশীয় আল- মোহাদ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে তুমারত গাজ্জালী র অধীনে শিক্ষা লাভ করেন। ১১১৬ সালে মুহাম্মদ আল-শাহারিস্তানী সেখানে অধ্যাপক ছিলেন, ১১৭০-এর দশকে বাহাউদ্দিনও অধ্যাপনা করতেন। পারস্যের মরমী কবি, শেখ সাদী ১১৯৫-১২২৬ সাল পর্যন্ত এখানে শিক্ষালাভ করেন। তিনি যখন তার ৩০ বছরব্যাপী যাত্রা শুরু করেন, হালাকু খানের নেতৃত্বে মোঙ্গলদের হাতে এর ধ্বংস প্রত্যক্ষ করেন। ১২৫৮ সালে এই ঘটনা সংঘটিত হয়।

Makdiisi, George –madrasah and University in the middle age s, Studia Islamica, No 32 (1970), p. 255-264

Al -Ahram Weekly, Baghdad Supplement

Black, A — a history of Islamic political thought from the prophet to the present, Cambridge edinburg University press 2001

এক বিশেষজ্ঞের উক্তি উদ্ধৃত করি —

Nizamul Mulk was perhaps the best administrator the Islamic world has known after the Caliph Omar bin al khattab ®. He streamlined the Abbasid administration, rationalized the tax collection system and stimulated the economy that had been battered by the loss of trade with the Mediterranean. But the Nizam is best remembered for starting and patronizing a string of universities in the Abbasid domains. The best known of these was the Nizamia College in Baghdad which attracted the renowned scholars of the age.

এর গৌরবধন্য সিলেবাস-এর এক নিষ্করুণ পরিণতি বিষয়ে যা বললেন এই প্রাজ্ঞ বিশ্লেষক —

Nizamia syllabus has survived almost a thousand years and it is sad reflection on the contemporary madaris that the same syllabus more correctly regressed version of it is still followed.

সিলেবাসের অবনমন বা পরিবর্তনের কারণ সন্ধান করতে গিয়ে তিনি বলেন —

The world went through the Crusades; the Mongol Devastations, the Discovery of America, the Rise and Fall of the Ottoman Empire, the Industrial Revolution,, the consolidation and disappearance of the British Empire, several moon landings and yet a shrunken version of the ‘Nizamia Nisab’ is taught in our school.

এতগুলি বিশ্ববিস্ময় ঘটনাধারা পৃথিবী দেখা সত্বেও নিজামিয়া সিলেবাস চলছে সমসাময়িক ও পরবর্তীকালে অন্যান্য মাদ্রাসায়। কিন্তু অবনমন বা পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে নানা কারণে :

১. সর্বত্র ‘দ্বীন’ প্রাধান্য পাচ্ছে (Deen)

২. ফিকা আর ফতোয়া; আইন ও বিধান মরমিয়া ভাবনার উপরে জয়যুক্ত (fiqh & fatwa gained ascendancy over tasawwuf)

৩. রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা প্রাধান্য পেল (একটু রসিয়ে বলা যায়, রাষ্ট্রের পিঠে ছড়ির ঘা বা প্র -তাড়নার জ্বালায় রাষ্ট্র যা চায়, মানে রাষ্ট্রের চাহিদা); নাগরিক ও পুরসেবা দূরে সরে গেল (statecraft prevailed and civics were also dropped)

৪. যেহেতু ইউরোপীয় সংস্কৃতি ভারতের মাটিতে শিকড় চালিয়েছে; দর্শন ও গণিত মাদ্রাসা থেকে সরে গেল; কারণ এটা তো ফিরাঙ্গী থেকে চুইয়ে পড়া।

(As European culture sank roots on Indian soil, the study of philosophy and mathematics was also dropped from the madaris, in part because these subjects were considered trained from their contact with the firangees.)

মানে, একই রোগ; “ফিরাঙ্গী” অর্থাৎ ইউরোপীয় শিক্ষাধারা থেকে আগত বিদ্যা বলে মনে করা হলো। একসময় তো খ্রিস্টানি আর ‘নাসারা বিদ্যা’ বলে ইংরেজি শিক্ষা থেকে দূরে সরে ছিল, এখন অংক ও দর্শন থেকে। ভাগ্যিস, “খ্রিস্টানি” বলেনি?

মুসতানসিরিয়া মাদ্রাসা (১২২৭ খ্রি)

মধ্যযুগের উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভাদীপ্ত কমপ্লেক্স ছিল এটি। আব্বাসীয় খলিফা আল-মুসতানসির ইরাকের বাগদাদে এটা প্রতিষ্ঠা করেন ২২২৭ খ্রিস্টাব্দে।

Mustansiria Madrasa was a mediaeval-era scholarly complex that provided a universal system of higher Education. It was established in 1227 CE and was named after and built by the Abbasid Caliph al-Mustansir in Baghdad, Iraq. (Wikipedia)

মাদ্রাসা আল-ফেরদাউস (১২৩৬)

সিরিয়ার রানী আল-মালিকা দাইফা খাতুন সম্পূর্ণ নিজ অর্থ ব্যয়ে সিরিয়ার আলেপ্পোতে ১২৩৬ সালে এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাদ্রাসার ব্যয়বহনের জন্য অর্থ বরাদ্দ হত। এই কমপ্লেক্সের স্থাপত্যকর্ম বিশেষ প্রণিধানযোগ্য।

(Rana Jalabi Hodijk –“Al-Madrasa al-Firdaus in Aleppo : a chef-d’oeuvre of Ayyubid architecture”, American University in Cairo, Dept of Arab and Islamic Civilization, 1988, p. 39.)

মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রাচ্যে আসা যাক : ভারতে মাদ্রাসা বাংলায় মাদ্রাসা ব্যবস্থা।

দেখা যাবে সিলেবাসে বিপুল পরিবর্তন অবনমন।

ভারতীয় উপমহাদেশে মাদ্রাসা:

মক্তব বা ফোরকানিয়া মাদ্রাসা দিল্লি, লখনৌ, মাদ্রাজ, ঢাকা ইত্যাদি বড় বড় শহরে সুলতানি যুগে স্থাপিত হয়েছিল। এ দেশে মুসলমান আগমনের সঙ্গে সঙ্গে। মাদ্রাসার ইমারত প্রথম স্থাপিত হয় মুলতানে। এর নির্মাতা ছিলেন নাসির উদ্দিন কুবজা এবং এই মাদ্রাসার প্রধান ছিলেন মাওলানা কুতুব উদ্দিন কাশানি। শেখ বাহাউদ্দিন যাকারিয়া মুলতানি ৫৭৮ হিজরীতে এই মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের এই মহাপ্রাজ্ঞ বুজুর্গ ঐতিহ্যবাহী বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসায় অধ্যাপনার গৌরবজনক পদ অলংকৃত করেছিলেন।

সুলতানি আমলে (১২০৪/১২১০-১৫৭৬) মাদ্রাসা গুলির সিলেবাস ছিল এইরকম : আরবি, নাহু (বাগবিধি), সরফ (রূপতত্ত্ব), বালাগাত (অলংকার), মানতিক (যুক্তিবিদ্যা), কালাম (জ্ঞানতত্ত্ব), তাসাউফ (অতীন্দ্রিয়বাদ) সাহিত্য, ফিকাহ (আইন) ও দর্শন।

Maulana Abul Hasan Ali Nadvi in his manuskript ‘Hindustan ki khadeem darsgahen’ (Shibli Academy 1919), states that the syllabus of the madaris in the subcontinent during the 13th and 14th centuries included the following subjects:

Akhlaq & it’s principles, Grammar, Oration, Hadith & its sciences, Arithmetic & Astronomy, Tasawwuf, Kalam.

মুঘল যুগে বিশেষ করে আকবরের সময় বহুজাতিক উদার ধর্মনিরপেক্ষ আবহাওয়ার কারণে সিলেবাসে বৈচিত্র্য ছিল।. The cosmopolitan culture of Mughal India included the Mughals, the Afghans, the Rajputs, the Persians, the Hindus and the Muslims. He even started his Sufi Tareeqa with himself at his head, called Deen e Ilahi which was misunderstood by the Muslims as a new religion. Through his policy of sulhe kul (peace between all groups) he sought to unify all the cultures of India under the Mughal banner….

মোগল, আফগান, রাজপুত, পারসিক, হিন্দু এবং মুসলমানকে সমন্বয়বাদী ‘দীন-ই-ইলাহি’ ও ‘সর্ব স্বস্তি-শান্তি’র বার্তাবাহী ‘সুলহি কুল’-এর মাধ্যমে একই মুঘল ছত্রতলে আনতে চেয়েছিলেন সম্রাট আকবর।

এই বহুজাতিক সমন্বয়বাদী ধর্মনিরপেক্ষ মানসতা মাদ্রাসার সিলেবাসের প্রভাব সঞ্চারিত করল।

The cosmopolitan character of the Mughals was reflected in the madaris of the age Gone was the narrow focus on the study of akhlaq and hadith. The Mughals instituted a broad based curriculum which included not only the religious sciences but also advanced mathematics, engineering, sociology and history . According to Nadvi, the Mogul madrassah curriculum included the following subjects:

Akhlaq and its principles, Literature and grammar, Law, Philosophy, Mathematics, Astronomy, Medicine, Kalam, Tasawwuf and The life of the Naqshbandi Shaikhs.

ধর্মীয় মাদ্রাসা গুলির সঙ্গে সঙ্গে কিছু ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাকেন্দ্র রাজ্যে স্থাপিত হয়েছিল। সেই স্কুলগুলিতে ইঞ্জিনিয়ার শিল্পী-কারিগর, ডাক্তার ও প্রশাসকদের ট্রেনিং দেওয়া হতো। এখন সিলেবাস আরো বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠলো এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষীকরণ করা হতে থাকলো। বিশেষ করে, ইতিহাস ও আত্মশুদ্ধির পাঠক্রম বিন্যাসে। বিশেষীকরণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। (বন্ধনীর মধ্যে দেখুন)

The curriculum of these schools included the following subjects:

1. Akhlaq (good character, humility, respect for elders, etiquette. The text books used included Akhlaq e Nasiri and Akhlaq e Jalali)

2. Arithmetic 3. Astronomy 4. Astrology 5. Mathematics 6. Geometry

7. History (Shahnama e Firdowsi, Zafarnama of Sharfuddin Ali Tarmizi, Futuhat e Timuri, Akbar Nama, Iqbal Nama a Jahangeeri, Tareeq e Feroqe Shahi, Warzam Nama, Mahabharata)

8. Oration, 9. Medicine, 10. Economics 11. Sociology 12. Literature (prose poetry fiction) 13. Tazkiya Nafs ( Maktubat of Syed Shah Ashrafuddin Yahya Ahmed Muneeri, Nuzhatul Arwah, Mathnawi Molvi Manavi, Hadeeqa Hakim Sinai) 14. Planning 15. Goal setting 16. Operations Management 16. Politics 17. Health Maintenance 18. Mathematics 19. Religious Studies.

লক্ষ্য করার মতো ইতিহাস পাঠ্যসূচিতে জায়গা হচ্ছে তৈমুরের বিজয়কাহিনী, আকবরের আকবরনামা, জাহাঙ্গীরের স্মরণিকা এবং মহাভারত। লক্ষ্য করি, তাজকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধির সিলেবাসে বিভিন্ন বুজুর্গদের লেখনী ও মসনবি। লক্ষ্য করি, প্ল্যানিং বা প্রকৌশল বিদ্যা, অপারেশন ম্যানেজমেন্ট, রাজনীতি, স্বাস্থ্যরক্ষা এবং একেবারে শেষে চলে গিয়েছে ধর্মীয় পাঠ।

মাদ্রাসা ও অন্যান্য স্কুলগুলিতে আর্টস বা কলাবিদ্যার প্রশিক্ষণ চলছে, তরুণ সমাজ ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে, ধাতুবিদ্যা কাঠের কাজ, বয়ন শিল্প, এমব্রয়ডারি, চর্মশিল্প, কার্পেট তৈরি, হাতির দাঁতের তক্ষণকার্য ইত্যাদি। মুঘল কারিগরদের শৈলীগত দক্ষতা তাদের বিদ্যাচর্চার ও প্রশিক্ষণের একটা উচ্চমার্গে পৌঁছেছে বোঝা যায়। বোঝা যাচ্ছে, কেমন করে স্থাপত্যকলায় উন্নতি করেছিল মোঘল যুগের স্থপতিরা এবং কারিগর ও শিল্পী কুশলীরা। তাঁরা সেকেন্দ্রা, হুমায়ুন মকবরা, জুমা মসজিদ বা পৃথিবীর সপ্ত বিস্ময়ের অন্যতম তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ধর্মের প্রাধান্য পুনরায় বেড়ে যাচ্ছে। ধর্মশিক্ষার প্রাধান্য এবং ফিকা ও ফতোয়া চর্চা বেড়ে যাচ্ছে। চরিত্রনির্মাণ বিদ্যার জায়গায় এখন ফতোয়ার বিশ্বকোষ ‘ফতোয়ায়ে আলমগীরী’ পাঠ্য হয়ে উঠছে।

বাংলায় মাদ্রাসা:

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী ১২০৪ গৌড়ের প্রথম মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। পরে গিয়াসউদ্দিন ১২১২ এবং দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন দুটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন এ দুটির নাম লাখনুতী মাদ্রাসা ও গৌড় মাদ্রাসা। তবে, মাহীসন্তোষে হযরত মাওলানা তকিউদ্দীন আল আরাবীর মাদ্রাসাকে বাংলার প্রাচীনতম মাদ্রাসা বলা হচ্ছে। ইখতিয়াউদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী বাংলা দখলের পর ত্রয়োদশ শতকের গোড়ায় আল আরাবী প্রতিষ্ঠিত এই মাদ্রাসাটি প্রাচীনতম।

( http//dhamoirhat.naogaon.gov.bd)

মাওলানা আবু তাওয়ামা ১২৭৮ খ্রি. সোনারগাঁওয়ে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯) ও তাঁর পুত্র নুসরত শাহ আরো কিছু মাদ্রাসা স্থাপন করেন বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। (বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ; দ্র. মাদ্রাসা)

১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে সুবেদার শায়েস্তা খান বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকায় একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। নবাব জাফর মোরশেদ আলি মুর্শিদাবাদে স্থাপন করেন মূর্শিদাবাদ মাদ্রাসা। ১১৭৮ হিজরীতে জমিদার মুন্সি সদরউদ্দিন আল মুসাভী বুহার গ্রামে বর্ধমান মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং লখনৌ থেকে আব্দুল আলি বাহারুল উলুমকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেন। এই মাদ্রাসাগুলির ব্যয়নির্বাহের জন্য নবাবী আমলে লাখেরাজ জমি বরাদ্দ করা হতো। মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রদের জন্য সরকার ভাতা এবং বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিল। ( M.S Asimov, Clifford Edmund Bosworth (1999), The Age of Achievement, Vol. 4, Motilal Banarasidass, 33-34: ISBN 81-208-1596-3)

ইংরেজ শাসনকালে এদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা একটি বিপদজনক অথচ নতুন মোড় নেয়। মাদ্রাসা গুলির নামে মুঘল সরকারের দ্বারা বরাদ্দকৃত লাখেরাজ জমি দ্রুতবেগে বাজেয়াপ্ত করা হয়। আঠারো শতকের শেষে ও উনিশ শতকের গোড়ার দিকে অনেক মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। যদিও ১৭৮০ সালে কলকাতা মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন বাংলার গভর্নর লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস।

কলকাতা তখন বাংলার রাজধানী। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করল ইংরেজি বণিকদল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তিন বছর যেতে না যেতেই দেখা দিল পৃথিবীর ভয়াবহতম মন্বন্তর। বাংলা সন হিসাবে ১১৭৬ মোতাবেক ১৭৬৯ সালে শুরু হল ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’। এই মন্বন্তরের পটভূমিতে ফকির সন্ন্যাসীদের মিলিত বিদ্রোহ, মজনু শাহ-এর নেতৃত্বে, সহায়তা দিলেন ভবানী পাঠক ও অন্যান্য সন্ন্যাসীরা। কোম্পানির ত্রিশঙ্কু অবস্থা। দেশীয় নায়েব গোমস্তা তহশিলদার কালেক্টরদের অত্যাচারে সাধারণ প্রজাদের নাভিশ্বাস উঠে গেল। দ্বৈত শাসনের কালে কোম্পানি চোখ বুজে থাকল, প্রমাদ গণল কোম্পানি, তার আশঙ্কা হল বিপদের। মাত্র কবছর আগে ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার শোচনীয় পরাজয় দেশবাসী ভুলতে পারেনা।

ওদিকে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ এদিকে ভয়াবহ মন্বন্তর। অতএব, কোম্পানি তার আপন জ্বালা নিবারণের জন্য হেস্টিংস স্থাপন করলেন কলকাতা মাদ্রাসা ১৭৮০। উদ্দেশ্য — ইসলামী আইন ও আরবি-ফারসি জানা কিছু কেরানিকুল তৈরি করা, যারা সাধারণ মানের কোন পদে বা কোর্টকাছারিতে কোম্পানির সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারবে। তারা ভাবল, এতে দেশের মুসলমান সমাজের কাছে তারা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। এই সেই প্র-তাড়না,, রাষ্ট্রের আপন পিঠে ছড়ির ঘা। কোথায় বাগদাদের ‘বাইত আল হিকমাহ’ আর কোথায় কলকাতা মাদ্রাসা?

ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারতের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সর্বপ্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কলকাতা মাদ্রাসা। ১৭৮০ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত করেন গভর্নর জেনারেল লর্ড হেস্টিংস। দেড় বছর যাবত এর সম্পূর্ণ দায়ভার নিজে বহন করেন, যদিও পরবর্তী সময়ে এর পুরোটাই তাঁকে ফেরত দেওয়া হয়। ১৭৮০ সালের এপ্রিলে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কলকাতা নগরীর শিয়ালদার কাছে বৌবাজার সন্নিহিত একটি বৈঠকখানায় স্থাপিত হলেও ১৮২৭ সালে এর বর্তমান অবস্থান হাজী মোহাম্মদ মহসিন স্কোয়ারে স্থানান্তরিত করা হয়। এর প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন ইসলামী শিক্ষায় বড় পণ্ডিত বাহারুল উলুম মোল্লা মাজদুদ্দিন। দারসে নিজামীর আদলে নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি করেন তিনি। হেস্টিংস এর নির্দেশিত পথে তিনি এই পাঠক্রমে ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দেন। বাংলার অধিকাংশ মাদ্রাসা দারসে নেজামীর আদলে শিক্ষাদান পরিচালনা করে। এই ব্যবস্থা ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এই পাঠক্রম অনুযায়ী একজন ছাত্রকে ১৭/১৮ বছর বয়সেই আরবি ও ফারসি ভাষায় লিখিত নির্বাচিত ৯৯টি গ্রন্থের মধ্যে অন্তত একটি পড়ার ও অনুধাবনের যোগ্যতা অর্জন করতে হতো। অবশ্য ধর্মীয় পাঠক্রমেও অন্তর্ভুক্ত ছিল ইউনানী চিকিৎসা বিদ্যা, কুটির শিল্প, কারিগরি প্রশিক্ষণ। দরসে নিজামীর মোট শিক্ষাকাল ছিল ৯ বছর।

মাদ্রাসার ব্যাপারে প্রথম প্রত্যক্ষ আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ ঘটে ১৭৯০ সালে। যখন অব্যবস্থাপনা ও ছাত্রদের উচ্ছৃঙ্খলতা ও ব্যাপক অভিযোগের পটভূমিতে ২৪ পরগনার কালেক্টর মাদ্রাসার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তদন্তের পর প্রধান শিক্ষককে ১৭৯১ সালে অপসারণ করা হয়। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল। এবার প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার ভার রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটির উপর ন্যস্ত করা হয়। মাদ্রাসার প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়াতে ১৮১৯ সালে একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সামরিক অফিসার ক্যাপ্টেন অ্যারনকে মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রথম সচিব নিয়োগ করা হয়। ১৮৪২ সালে কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছিল। মাদ্রাসাটিকে নিরবচ্ছিন্ন অবনতির প্রবাহ থেকে উদ্ধার করতে ১৮৫০ সালে প্রথমবারের মতো একজন ইউরোপীয় ড. অ্যালয়েস স্প্রেঞ্জারকে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তাঁর পরে বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় অধ্যক্ষ নিয়োগ করা হয়েছিল এদের মধ্যে সর্বশেষ ছিলেন এ এইচ হার্লি, যিনি ১৯১০-১১ সালে অধ্যক্ষের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

কলকাতা মাদ্রাসা শুরু থেকেই প্রখ্যাত আরবী স্কুল ‘ফিরিঙ্গি মহলে’র দারসে নিজামীর মডেল অনুসরণ করে পাঠদানের কোর্স প্রণয়ন করে, আগেই বলেছি। ১৮৫০ সাল পর্যন্ত মাদ্রাসার পাঠক্রমে ফারসি ভাষা আরবির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে মুখ্য স্থান দখল করে। তখনকার দিনে বাংলা ভাষাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছিল। সুলতানী আমলে ও মুঘল যুগে ফারসি ছিল রাজভাষা, তাই ঝোঁক ছিল ফারসির প্রতি। তবে সিলেবাসে ত্রৈরাশির দ্বৈত নিয়ম অর্থাৎ অনুপাত ও সমানুপাত পর্যন্ত গণিত শেখানো হতো এবং ইউক্লিডের একটি পাঠ পড়ানো হতো। মাদ্রাসার সিলেবাসে ইতিহাস, ভূগোল, এমনকি তাফসীর ও হাদিসেরও স্থান ছিল না। ছিল শুধু আইন (ফিকাহ), জ্যোতির্বিদ্যা, যুক্তিবিজ্ঞান, দর্শন, পাটিগণিত, জ্যামিতি, ছন্দজ্ঞান ও ধর্মতত্ত্ব। অ্যারিস্টটলের পুরাতন দার্শনিক চিন্তাধারার আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন পড়ানো হতো। হয়তো তেমন গুরুত্ব সহকারে নয়।

১৮২৬ সালে প্রবর্তিত প্রাথমিক ইংরেজি কোর্সগুলির প্রবর্তন থেকে শুরু করে কিছু সংস্কার প্রচেষ্টা হয়েছিল বটে, তা তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। ১৮২৬ সাল থেকে ১৮৫১ সাল পর্যন্ত পঁচিশ বছরের অধিক সময় মাদ্রাসাটি শুধু দুজন নিম্নপদস্থ ইংরেজি শিক্ষিত পণ্ডিত — নবাব আব্দুল লতিফ ও ওয়াহিদুন্নবী — তৈরি করতে পেরেছে, একথা বলে নিন্দা জানানো হয়েছে। ১৮৬৩ সালে কলকাতা মাদ্রাসায় এফ. এ. পর্যায়ের ক্লাস সংযোজিত হলে তাও দুঃখজনকভাবে ব্যর্থ হয়। এগুলি ১৮৬৯ সালে গিয়ে স্থগিত রাখা হয় এবং অবশেষে ১৮৮৮ সালে এই কোর্স পরিত্যাগ করা হয়েছিল। আরেকটি সংস্কার প্রচেষ্টা ছিল ১৮৫৪ সালে মাদ্রাসার মধ্যে একটি পৃথক ইনস্টিটিউট হিসেবে ইঙ্গ-ফারসি বিভাগ (Anglo-Persian Department) প্রতিষ্ঠা। এটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নবাব আব্দুল লতিফের পরামর্শ ও উদ্যোগ এখানে সক্রিয় ছিল। তবে এখানে অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে ভর্তি সীমাবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্যে ‘শরাফতনামা’ (উচ্চবংশে জন্মের সনদপত্র)-র উপর জোর দেওয়া হতো। (একটু হেসে নিন, যেমন বাঙালির মাতৃভাষা কী — এই প্রশ্নে আশরাফদের মাতৃভাষা উর্দু ও আতরাফদের বাংলা বলেছিলেন নবাব আব্দুল লতিফ, এই সময় এখানেও কি তাঁর অভিজাত হাত ছিল? না, ফাঁপা কৌলীন্য (!) বজায় রাখার চেষ্টা?) যাই হোক, মুসলিমদের মধ্যে এই অ্যাংলো-পার্সিয়ান ডিপার্টমেন্ট তেমন আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি বলে বলা হয়। তবে উদ্দেশ্য ছিল মহৎ ও জাতির জন্য কল্যাণকর। উচ্চ ইংরেজি স্কুলের ( High English School, HES, যেমন তুলনীয়, Middle English School, M.E. School) অনুরূপ মান বজায় রেখে এবং ফারসি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত ইঙ্গ-ফারসি বিভাগের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদেরকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণের উপযোগী করে গড়ে তোলা। ১৮২১ সালে মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রবল বিরোধিতার মুখে মাদ্রাসার আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা (formal examination) ব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৮৫৪ সালের শিক্ষা সংক্রান্ত যে ডেস্প্যাচ’, যা ‘উডের ডেস্প্যাচ’ নামে পরিচিত, তাতে কলকাতা মাদ্রাসাকে প্রস্তাবিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসার ইঙ্গিত থাকলেও কলকাতা মাদ্রাসাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় আনা হয়নি।

কী করে হবে? থামুন একচোট হেসে নিই। দরজাই নেই, তায় আবার ছিটকিনি! কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তার অধীনে এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসাকে নিয়ে যাওয়া হবে! মনে করি, আগ্রাসী এই মানসিকতা। এই মনোভাব কার ছিল, জানা নেই‌, তবুও ওই প্রস্তাবের ১৬৬ (১৮৫৪-২০২১) বছর পর তীব্র নিন্দা করি।

ফলে কলকাতা মাদ্রাসা উপমহাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি বিচ্ছিন্ন ধারা হিসেবে গড়ে ওঠে। অথচ মনে রাখতে হবে, এই কলকাতা মাদ্রাসা ব্রিটিশ ভারতের সর্বপ্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

একসময় সিলেবাসে থাকলো আইন (ফিকাহ), জ্যোতির্বিদ্যা, যুক্তিবিজ্ঞান, দর্শন, পাটিগণিত, জ্যামিতি, ছন্দোবিজ্ঞান, ব্যাকরণ, এবং ধর্মতত্ত্ব। ১৮২৭ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অধ্যাপক পি ব্রেটন মেডিকেল ক্লাস শুরু করে দেন এই মাদ্রাসায়। ১৮৩৬ সালে ‘কলকাতা মেডিকেল কলেজ’ স্থাপিত হওয়া পর্যন্ত মেডিকেলের ক্লাস এখানেই চলত। এই মাদ্রাসার ছাত্ররা সরাসরি কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেত। ১৯২৭ সালে মাদ্রাসার শিক্ষাকাঠামোর নতুন বিন্যাস ঘটানো হয়। আলিম, ফাজিল, কামিল, মুমতাজুল মুহাদ্দেসিন।

মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার দুটি ভাগ : দারসে নিজামী বা কওমি মাদ্রাসা এবং হাই মাদ্রাসা ব্যবস্থা। যে মুষ্টিমেয় শিক্ষিত জন মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধির চেষ্টা করেছিলেন, মুসলমান সমাজকে শিক্ষা ক্ষেত্রে মূল স্রোতে টেনে আনার চেষ্টা করছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন শিক্ষাবিদ শামসুল উলামা আবু নসর মোহাম্মদ ওয়াহিদ। তিনি ১৯১৪ সালে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার ছবি প্রত্যক্ষ করে এসে যে রিপোর্ট পেশ করলেন, তাতে ধর্মশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক শিক্ষার সংযোগ সাধন করার ব্যবস্থা থাকল। এই শিক্ষাধারার নাম হাই মাদ্রাসা ব্যবস্থা। এখানে মাধ্যমিক সিলেবাস এর সঙ্গে ধর্মীয় সিলেবাসের সংযোগ সাধন করা হলো। হাই মাদ্রাসা ব্যবস্থা থেকে যারা মাধ্যমিক স্তর পার হবে তারা সরাসরি কলেজ ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হতে পারবে। এই ব্যবস্থার অপর নাম নিউ স্কিম মাদ্রাসা। অবশ্য পুরনো পদ্ধতির নাম হয়ে গেল ওল্ড স্কিম।

আলিয়া মাদ্রাসা উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকার গঠিত শিক্ষা কমিশন কর্তৃক প্রণীত পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচির অনুযায়ী আলিয়া মাদ্রাসায় পাঁচটি স্তর: ইবতেদায়ী (প্রাথমিক) ৫ বছর, দাখিল (মাধ্যমিক) ৫ বছর, আলিম (উচ্চমাধ্যমিক) ২ বছর, ফাযিল (ডিগ্রি) ২ বছর এবং কামিল (স্নাতকোত্তর) ২ বছর; মোট ১৬ বছরের কোর্স পরিচালিত হয়। কামিল স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তাফসীর হাদীস আরবি সাহিত্য এবং মুজাব্বিদ শাখায় দুই বছর মেয়াদী কোর্স শেষে ডিগ্রি প্রদান করা হয়।

কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর হতে আলিয়া মাদ্রাসা সংস্কারের জন্য সরকার বিভিন্ন সময় কমিটি গঠন করে। আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রায় ১০ বছর পর ১৭৯১ সালের মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদ আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা কারিকুলাম সিলেবাস প্রবর্তন করে। এই সিলেবাস কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা অধিভুক্ত বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সকল মাদ্রাসায় বাস্তবায়ন করা হয়। ১৮৬৯ সালের কমিটি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় কিছু সংশোধনী আনে। ১৮৭১ সালে বিচারপতি নরম্যান কমিটি বেঙ্গল মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধন করে। ১৮৭০ সালে মহসীন ট্রাস্টের অর্থে ঢাকা মাদ্রাসা (বর্তমান সরকারি কবি নজরুল কলেজ), চট্টগ্রাম দারুল উলুম মোহসিনীয়া মাদ্রাসা (বর্তমানে সরকারি মোহসিন কলেজ), রাজশাহী মাদ্রাসা (বর্তমানে রাজশাহী সরকারি মাদ্রাসা) প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৮২ সালের হান্টার কমিটির রিপোর্ট ১৮৮৪ সালে বাস্তবায়িত হয়। ১৯০৭ সালের কলকাতা কনফারেন্সে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় সমমানের তিন বছরের টাইটেল ক্লাস খোলার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯১০ সালে এ. এইচ. হার্লির নেতৃত্বে গঠিত এডুকেশন অ্যাডভাইজরি কমিটি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু সংস্কারের প্রস্তাব করে।

১৯১৪ সালে অধ্যক্ষ শামসুল উলামা আবু নসর ওয়াহিদ এর নেতৃত্বে গঠিত মহামেডান এডুকেশন এ্যাডভাইজারী কমিটি কর্তৃক প্রণীত কারিকুলাম, আগেই বলেছি, ওল্ড স্কিম ও নিউ স্কিম ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয় এবং ১৯১৫ সালে তা বাস্তবে বাস্তবায়িত হয়। মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে জুনিয়র ও সিনিয়র নামে দু’ধরনের নিউ স্কিম মাদ্রাসা চালু হয়। জুনিয়র মাদ্রাসার পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত, সিনিয়র মাদ্রাসার মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হতো। এসব সিনিয়র মাদ্রাসার পাঠক্রমে ইংরেজি ভাষাকে বাধ্যতামূলক করে সরকারি সাহায্যভুক্ত করা হয়। সরকারি চাকরি পেতে মুসলিম শিক্ষার্থীরা নিউ স্কিম মাদ্রাসায় পড়তে বিশেষ আগ্রহী ছিল।

কিন্তু ১৯২১ সালে হাই মাদ্রাসা ও ইন্টারমিডিয়েট কোর্সের পরীক্ষা পরিচালনা করা ও সার্টিফিকেট দেবার জন্য গঠিত হয় Board of Intermediate and Secondary education.

স্বাধীনতা-পূর্ব কালে এইটিই প্রথম শিক্ষা পর্ষদ।

M.E বা Junior (class vi), Junior High (class viii) এবং High Madrasah (class X) স্থাপিত হতে থাকে।

বর্তমানে পশ্চিম বঙ্গে এই ব্যবস্থা চলছে।

শামসুল হুদা কমিটির ১৯২৭ সালে বাংলা অাসামের ওল্ড স্কিম সিনিয়র মাদ্রাসা গুলির আলিম ফাজিল ও ফাখরুল মুহাদ্দিসীন শ্রেণীর কেন্দ্রীয় পরীক্ষা মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক গ্রহণ করার প্রস্তাব করে। এই কমিটি প্রণীত কামিলের সিলেবাসে সিহাহ সিত্তা (বুখারী মুসলিম তিরমিজি ইবনে মাযা আবু দাউদ) প্রভৃতি হাদিস, তাফসিরুল হাদিস, তাফসিরুল কোরআন, তাফসিরুল কাশশাফ, ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করা হয়।

১৯২৭ সালে Mohammedan Education এর Assistant Director of Public Instruction কে চেয়ারম্যান এবং কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে রেজিষ্ট্রার করে Board of Central

Madrasah Examination, Bengal নামে সর্বপ্রথম একটি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড গঠিত হয় তখনও স্কুল শিক্ষা ক্ষেত্রে মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ গঠিত হয়নি।

দেশভাগের পরে আলিয়া মাদ্রাসা ঢাকা স্থানান্তরিত হল কলকাতা মাদ্রাসার ক্ষেত্রে এক স্বাধীন ভারতের শিক্ষা মন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ হাজার 948 সালে কলকাতা মাদ্রাসা কে স্বাধীন ভারতে এবং এই মাদ্রাসার স্থান হয় তখন হুগলি মাদ্রাসা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ভারতের শিক্ষা কাঠামো নির্মাণের জন্য এবং বিশ্বের দরবারে ভারত সংস্কৃতি ও ভারতীয় শিক্ষার গৌরব ঐতিহ্য কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে শেয়ার গঠন করেছেন আর ভারতের স্থাপন করেছেন নানান রকমের শিক্ষা কমিশন রাধাকৃষ্ণন কমিশন মুদালিয়ার কমিশন কোঠারি কমিশন বিদ্যালয় পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন কমিশন গঠিত হয়েছে কখনো মাওলানা আকরাম খাঁ কখনো ডঃ কুদরত এ খোদা ইত্যাদি কে সামনে রেখে।

১৯৭৮ সালে প্রফেসর মুস্তফা বিন কাসিমের নেতৃত্বে Senior Madrasah Education System Committee গঠিত হয়। ১৯৭৯ সালের ৪ জুন হতে বোর্ডটি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। জনশিক্ষা পরিচালক প্রফেসর বাকিবিল্লা খান এর প্রথম চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।

১৯৮৪ সালে মুস্তফা বিন কাসিমের কমিটির সুপারিশের আলোকে সাধারণ শিক্ষার স্তরের সঙ্গে মাদ্রাসা বোর্ড নিয়ন্ত্রিত আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা স্তরে নিম্নরূপ সামঞ্জস্য করা হয়: ইবতেদায়ী (প্রাথমিক) ৫ বছর, দাখিল (মাধ্যমিক) ৫ বছর, আলিম (উচ্চমাধ্যমিক) ২ বছর, ফাযিল (ডিগ্রি) ২ বছর এবং কামিল (স্নাতকোত্তর) ২ বছর; মোট ১৬ বছরের কোর্স পরিচালিত হয়। এই কমিটি কর্তৃক প্রণীত সিলেবাস ১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত দাখিল ও ১৯৮৭ সালে অনুষ্ঠিত আলিম পরীক্ষায় কার্যকর হয়। উক্ত দুই শ্রেণীতে মাদ্রাসার নির্ধারিত সকল পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও সাধারণ শিক্ষার যথাক্রমে এসএসসি এবং এইচএসসি সম্পূর্ণ কোর্স অন্তর্ভুক্ত করে দাখিলকে এসএসসি এবং আলিমকে এইচএসসির সমমান দেওয়া হয়। সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সমন্বিত হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা এখন মাদ্রাসা শিক্ষা শেষে উচ্চতর শিক্ষার জন্য অনুমোদিত যেকোনো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। কিন্তু ফাযিল (ডিগ্রী) এবং কামিল (স্নাতকোত্তর) সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সমন্বিত না হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা শুধু মাদ্রাসা বা স্কুলের চাকরির ক্ষেত্রে সমমান পায়, অন্য ক্ষেত্রে নয়।

২০০৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত মাদ্রাসা বোর্ড আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষার ইবতেদায়ী বা প্রাথমিক হতে কামিল বা স্নাতকোত্তর পর্যন্ত সকল স্তরের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করত। বর্তমানে Islamic University (Amendment) act, 2006 মোতাবেক সাধারণ শিক্ষার সাথে আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা সমন্বিত করার কারণে ফাযিল (ডিগ্রী) ৩ বছর এবং কামিল (স্নাতকোত্তর) ২ বছর মোট পাঁচ বছরের কোর্স চালু হয়েছে। তাই সিদ্ধান্ত হয় যে, ২০০৬ 2006 সালের পর থেকে মাদ্রাসা বোর্ড শুধু দাখিল ও আলিম পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করবে। উক্ত আইন অনুসারে ২০৮৬টি ফাযিল (স্নাতক) এবং ১৯৮টি কামিল (স্নাতকোত্তর) মাদ্রাসা অর্থাৎ ১২৮৪টি মাদ্রাসা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হয়। এতে সাধারণ শিক্ষার সাথে মাদ্রাসা শিক্ষার দীর্ঘদিনের বিরাজমান পার্থক্য দূরীভূত হয়।

বর্তমানে বহু মাদ্রাসা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হয়েছে এবং প্রায় সকল স্কুল ও মাদ্রাসায় কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ছে। এসবই সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থার সুস্থতার লক্ষণ।

তাই, একথা বলা আবশ্যক যে, অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও কলকাতা মাদ্রাসা কার্যত একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল, যা প্রায় এক শতাব্দীকাল, এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরও, প্রশংসনীয় সংখ্যক মুসলিম ছাত্রদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল।

এখান থেকে বেরিয়েছেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ডঃ কুদরত-এ-খোদা, নবাব আব্দুল লতিফ, জনাব ওয়াহিদুন্নবি প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ।

উপনিষদের শ্লোকাংশ উচ্চারণ করি — “পুষন আপাবৃণু” — হে সূর্য, আবরণ উন্মোচন কর, সত্য উদ্ভাসিত হোক। আলোকিত হোক জগত সংসার। বলি — “নূরুন আলা নূর” — জ্যোতিই জ্যোতি।

কালপুরুষ

   

ড. শর্মিলা ঘোষ

সহযোগী অধ্যাপক,

বাংলা বিভাগ,

শ্রী শিক্ষায়তন কলেজ

ছাত্রাবস্থায় বিদ্যালয়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক কখনই পূর্ণতা পায়নি। শিক্ষকদের স্নেহ ও উদারতা, বন্ধুদের সহৃদয় সাহচর্য অথবা বিদ্যালয়ের পরিবেশ কোনটিই অনুকূল হয়ে ওঠেনি তাঁর কাছে। জীবনস্মৃতি ছেলেবেলা গ্রন্থের বিভিন্ন অংশে এর উল্লেখ স্পষ্ট। তাই তো শহরের স্কুলকে দশটা-পাঁচটার আন্দামান বলতেও দ্বিধা করেন না তিনি।

ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল আকাদেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স- ছেলেবেলায় এই চারটি স্কুলে ভর্তি হলেও কোথাও একাত্মতা বোধ করেননি রবীন্দ্রনাথ।প্রতিটি ক্ষেত্রেই পঠন-পাঠন সম্পূর্ণ না করেই বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। তাই অভিভাবকদের বারংবার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ যে একজন ‘স্কুলছুট’ বা ‘ড্রপ আউট’ সেকথা বলা বোধ করি অন্যায় হবে না। আসলে প্রথাগত শিক্ষা তাঁকে বিমুখ করেছে বিদ্যালয়ের প্রতি। আর সে কারণেই “কোন বিদ্যালয়ের বন্ধনে, কোন ধারাবাহিক বিদ্যাচর্চার নিয়মশৃঙ্খলে তাঁহাকে বাধা যায় নাই।”(রবীন্দ্র জীবনী- প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়)।অথচ প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তিনি ভেবেছেন আজীবন। তাঁর জীবনদর্শনে, কর্মজীবনে এবং সাহিত্যিক প্রকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষা চিন্তা একটা বড় জায়গা অধিকার করেছে। আর শিক্ষা বিষয়ক এই ভাবনা ক্রমে ক্রমে এতটাই গভীর হয়ে উঠেছে যে জীবনের মধ্যভাগে তিনি একটি ব্রহ্মচর্যাশ্রম শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। ৮০ বছরের ব্যাপ্ত জীবনের ঠিক চল্লিশতম বর্ষে(১৯০১) শান্তিনিকেতনে ব্রহ্ম বিদ্যালয় স্থাপনে এক আশ্চর্য সমাপতন সন্দেহ নেই।

১৯০১ সালের ২২ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে এক ব্রহ্ম উপাসনা মন্দিরকে কেন্দ্র করে স্থাপিত এই ব্রহ্মচর্যাশ্রম রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনার একটি দিক্ নির্দেশিকা বা মাইল ফলক সন্দেহ নেই। শিক্ষাদানের প্রচলিত পদ্ধতি রবীন্দ্রনাথকে বিমুখ করেছিল। তিনি চেয়েছিলেন উন্মুক্ত আকাশের নিচে, প্রকৃতির সাহচর্যে, সবুজ গাছপালার মাঝে শিশুরা তাদের বিদ্যালয় জীবন শুরু করুক। এই বিদ্যালয়ে তেমনটাই তিনি করেছিলেন। তিনি জানতেন এই কাজে আনন্দময় পরিবেশের সঙ্গেই প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষক। এই সময় চিঠিতে লিখেছেন-“শান্তিনিকেতনে একটা নির্জন অধ্যাপনের ব্যবস্থা করিবার চেষ্টায় আছি। দুই একজন ত্যাগ-স্বীকারী ব্রহ্মচারী অধ্যাপকের সন্ধানে ফিরিতেছি।”(জগদীশচন্দ্র বসুকে লেখাপত্র, চিঠিপত্র ৬)। শুধু তাই নয়, পরবর্তী সময়েও দেশ-বিদেশের থেকে উপযুক্ত শিক্ষকদের তিনি আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছেন শান্তিনিকেতনে। পরবর্তী কালে লিখেছেন,”আশ্রমে যারা শিক্ষক হবে তারা মুখ্যত হবে সাধক।” এবং “আত্মদানের অকাপর্ণ‍্য যথার্থ শিক্ষকের যথার্থ পরিচয়।”(আশ্রমের রূপ ও বিকাশ)।

সমকালীন শিক্ষা ব্যবস্থার বিপ্রতীপে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা একদিকে যেমন শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি বিভিন্ন সাহিত্যের মধ্যে পরোক্ষভাবে এর প্রকাশ ঘটেছে। বলা বাহুল্য নাটকেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। অচলায়তন, মুক্তধারা, রক্তকরবী, হাস্যকৌতুক প্রমুখ রচনায় প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষক-ছাত্র প্রসঙ্গ রয়েছে।

রবীন্দ্র শিক্ষাভাবনায় এক দলিল স্বরূপ অচলায়তন(১৯১২) নাটক। জীবনের প্রাণস্পন্দন যেখানে নেই, সেই শিক্ষা অচল-কঠোর শৃঙ্খলা,আর সংকীর্ণতায় ভরপুর সেই প্রতিষ্ঠান ‘অচলায়তন’ হয়ে ওঠে। পঞ্চক এই কূপমন্ডুকতাকে,এই জড়ত্বকে স্বীকার করে নি। জীবনের সাধারণ স্বাভাবিক ছন্দকে উপভোগ করতে চেয়েছিল সে। আর তাই তাকে নিয়ে সকলের বিড়ম্বনা। এই আয়তনে অন্য সকল ছাত্রের শিক্ষা যখন ‘ধ্বজাগ্রকেয়ূরী’ মন্ত্র পর্যন্ত পৌঁছে গেছে তখন পঞ্চক একেবারে শুরুর পর্বের “ওঁ তট তট তোতয় তোতয়” তেই আটকে আছে। চক্রেশমন্ত্র, মরীচি, মহামরীচি, পর্নশবরী, শৃঙ্গভেরিব্রত, কাকচঞ্চু পরীক্ষা, ছাগলোমশোধন এগুলির কোনটাই জানা নেই তার। আয়তনের জনৈক ছাত্ৰ যখন বলে যে এগুলো তো অন্তত জানা চাই, “নইলে তুমি অচলায়তনের ছাত্র বলে লোকসমাজে পরিচয় দেবে কোন্ লজ্জায়?”- তখন বোঝা যায় প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কোন গভীরে আঘাত করতে চান রবীন্দ্রনাথ। অচলায়তনের অন্যান্য ছাত্রদের নিয়ে কোন সমস্যা নেই। চিরাচরিতকে মেনে নেওয়াই তাদের ধর্ম। অভ্যাস পালনে কোন দ্বিধা নেই তাদের। এভাবেই সাফল্যের চূড়া স্পর্শ করতে সক্ষম হয় তারা। সংশয়াতুর কোন প্রশ্ন পঞ্চকের মতো, তাড়িত করে না তাদের।

রবীন্দ্রনাথ এই অচলায়তনের মূল ভিতটাকে নাড়িয়ে দিতে চান আর সে কারণেই বুঝি শুধু পঞ্চকের মনে নয়, আচার্য অদীনপুণ্যের মনেও জমা হয় সংশয়; জড়ো হয় দ্বিধা। তাই গুরু আসছেন একথা জানার পর আচার্য উপাচার্যকে বলেন- “…প্রথম যখন এখানে সাধনা আরম্ভ করেছিলুম তখন নবীন বয়স,তখন আশা ছিল সাধনার শেষে একটা কিছু পাওয়া যাবে। …তারপরে সেই সাধনার চক্রে ঘুরতে ঘুরতে একেবারেই ভুলে বসেছিলুম যে সিদ্ধি বলে কিছু একটা আছে। …কিন্তু আজ দেখছি-এই অতিদীর্ঘকালের সাধনা কেবল আপনাকেই আপনি প্রদক্ষিণ করছে- কেবল প্রতিদিনের অন্তহীন পুনরাবৃত্তি রাশীকৃত হয়ে জমে উঠেছে।”

আচার্য পঞ্চককে দেখে বুঝতে পারেন মানুষের মন মন্ত্রের চেয়ে সত্য,হাজার বছরের অতি প্রাচীন আচারের চেয়েও সত্য। পঞ্চকের মধ্যে মুক্তিকে দেখতে পান আচার্য আর পঞ্চক তার মুক্তি খুঁজে পায় তথাকথিত ম্লেচ্ছ,অস্পৃশ্য শোণপাংশু আর দর্ভকদের মাঝখানে।

এ নাটকে তাই শেষ পর্যন্ত অচলায়তনের গুরু, শোণপাংশুদের দাদাঠাকুর আর দর্ভকদের গোঁসাই এক হয়ে যান। গুরুই ভেঙে দেন অচলায়তনের সু-উচ্চ প্রাচীর। সুভদ্র আর পঞ্চক অচলায়তনের উত্তর দক্ষিণ পূব পশ্চিমের সব বন্ধ দরজা জানলাগুলো খুলে খুলে বেড়ানোর ভার নিয়েছে। এই খোলা দরজা জানলা দিয়েই আসবে আলো বাতাস। আর ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া অচলায়তনের প্রাচীরের খোলা পথ দিয়ে সেখানে প্রবেশ করবে শোণপাংশু আর দর্ভকরা।

উচ্চ-নিচের তথাকথিত ব্যবধান ব্যতিরেকে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের এই ভাবনা যেমন রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন নাটকে বা সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি জীবনচর্যায় এর প্রকাশ ঘটেছে। শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় স্থাপনের ক্ষেত্রেও এই মিলনের কথা বলেছেন তিনি,- “প্রথমে ছেলেদের এখানে এনেছিলাম যে বিশ্ব-প্রকৃতির উদার ক্ষেত্রে আমি এদের মুক্তি দেব কিন্তু ক্রমশ আমার মনে হল মানুষে মানুষে যে ভীষণ ব্যবধান আছে তা অপসারিত করে সর্বমানবের বিরাট লোকে মুক্তি দিতে হবে।” মানুষে মানুষের ব্যবধান দূর করার কথাই যেন অচলায়তন নাটকের শেষে রূপ পেয়েছে।

‘মুক্তধারা’(১৯২২) নাটকে এক গুরুমশায় ও তাঁর ছাত্রদের কথা আছে। উত্তরকূটের এই গুরু স্বভাবতই রাজভক্ত। প্রশ্নহীন তাঁর আনুগত্য। তিনি চান ভবিষ্যতের এই নাগরিকরা রাজা রণজিৎ তথা উত্তরকূটের গৌরবে গৌরবান্বিত হতে শিখুক। উত্তরকূটের এই ছাত্রদের মনে শিবতরাইয়ের প্রতি চরম ঘৃণা আর উপেক্ষার বীজ সচেতন ভাবে বপন করেন এই ‘গুরু’। অল্প সময়ের জন্য নাটকে তাদের অবস্থান হলেও গুরুত্ব অপরিসীম। প্রচলিত শিক্ষা যে কত অন্তঃসারশূন্য তার প্রমাণ এই অংশটি। প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন-” Totalitarian রাষ্ট্রের হাতে পড়িলে শিক্ষা, দীক্ষা, সংষ্কৃতি সব কেমন করিয়া রাষ্ট্রনীতির অনুকূল হইয়া গড়িয়া ওঠে,গুরুমশায় ও বালকগণ তাহার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। গুরুমশায় চমৎকার একটি type. তাঁহার দোসর আধুনিক ইউরোপের কোন কোন রাষ্ট্রে সংখ্যায় প্রচুর।” আমাদের মনে হয় বর্তমান ভারতবর্ষেও তার সংখ্যা কম নয়।

তবে প্রত্যক্ষভাবে গুরু ও ছাত্রদলের কথা নাটকে এলেও, রবীন্দ্র ভাবনায় ‘শিক্ষক’ শব্দটির অথবা শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের প্রকৃত যে বয়ান তার প্রকাশ ঘটেছে অভিজিৎ এবং ধনঞ্জয় বৈরাগীর চরিত্রে। ধনঞ্জয় বৈরাগী মুক্তধারা নাটকে শিবতরাইয়ের প্রজাদের পুরোধা। প্রজারা নিশ্চিন্তে নির্ভর করে তাঁকে। কিন্তু তিনি এটা চান না। তিনি চান শিবতরাইয়ের প্রজাদের ভেতরের মানুষটাকে জাগিয়ে তুলতে। না মার দিয়ে মারকে অতিক্রম করার মন্ত্র তিনি শেখাতে চান প্রজাদের। তাঁর প্রতি প্রজাদের পরম নির্ভরতা দেখেও তিনি বলেন-“ভালোবেসে তোদের চেপে মারার চেয়ে ভালোবেসে তোদের ছেড়ে থাকাই ভালো।” রাজা রনজিৎকে বৈরাগী বলেন-“ওদের যতই মাতিয়ে তুলেছি ততই পাকিয়ে তোলা হয়নি আর কি।” আমার বারবারই মনে হয়েছে এগুলো আসলে একজন প্রকৃত শিক্ষকের কথা। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ধনঞ্জয় বৈরাগী “মারখানেওয়ালার ভিতরকার মানুষ।” তিনি মারকে ছাড়িয়ে উঠে জয়ী হতে চান না মার দিয়ে মার কে অতিক্রম করতে চান। আর সেই শিক্ষাই যেন ছড়িয়ে দিতে চান তিনি শিবতরাইবাসীর মধ্যে। সমস্ত নাটক জুড়েই গানে-কথায় বৈরাগীর এ হেন শিক্ষক-সুলভ উপস্থিতি।

অপর চরিত্রটি অভিজিৎ। ব্যক্তিগত স্তরে রাজকুমার সঞ্জয়ের কাছে অথবা সমষ্টিগত দিক থেকে শিবতরাই বাসীর কাছে অভিজিতের বক্তব্য অবশ্যই শিক্ষণীয়। সঞ্জয়, অভিজিৎ অনুগামী। কিন্তু অভিজিৎ অনুগমনকে প্রশ্রয় দিতে চান না। সঞ্জয় অভিজিতের সঙ্গী হতে চাইলে অভিজিৎ জানিয়েছিল যে প্রত্যেককেই নিজের পথ নিজেকেই খুঁজে বের করতে হয়। তা না করে “আমার পিছনে যদি চল তা হলে আমিই তোমার পথকে আড়াল করব।” রবীন্দ্র মানসে একজন আদর্শ শিক্ষকের বয়ান বুঝি এরকমই হবার কথা।

রক্তকরবী(১৯২৪) নাটকে আমরা এক অধ্যাপকের সাক্ষাৎ পাই। এই অধ্যাপক নাটকে তার পেশাগত পরিচয়ে পরিচিত। বস্তুতত্ববিদ্যা বা materialism -এর চর্চা করেন। তিনি এই পরিবেশ পছন্দ করেন না। নিজের অবস্থান সম্পর্কে তিনি অতৃপ্ত, অখুশি। অধ্যাপক রাজার মতোই নিজেকেও জালের আড়ালে বন্দী হয়ে বলে মনে করেন। নন্দিনীর প্রতি অধ্যাপক আকর্ষণ বোধ করেন তার কারণ “নন্দিনীকে সে তার বস্তুগত দিক দিয়ে বুঝতে পারে না। এমন কি নন্দিনীর ‘রক্তকরবী’র আভরণকেও বস্তুগত দিক থেকে বোঝার চেষ্টা করে অধ্যাপক।”(সৌমিত্র বসু, রক্তকরবী : অন্য ভাবনায়) এভাবেই চরিত্রটিকে গড়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ। বলা বাহুল্য রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যায় আদর্শ শিক্ষকের প্রতিনিধি এই অধ্যাপক নন।

‘হাস্যকৌতুক’ শীর্ষক কৌতুক নাট্যের ‘ছাত্রের পরীক্ষা’ রচনাটিতে লঘু সুরে শ্রীযুক্ত কালাচাঁদ মাস্টার ও ছাত্র শ্রী মধুসূদনের কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। শিক্ষককে তাড়ানোর জন্যে ছাত্রের প্রচেষ্টা, সব বিষয়ে ভুল উত্তর দেওয়া এবং শেষপর্যন্ত কার্যসিদ্ধির বিষয়।

প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষক-ছাত্ৰ সম্পর্কের বাইরেও রবীন্দ্রনাথের নাটকে বেশ কয়েকটি শিক্ষক প্রতিম চরিত্র রয়েছে। নাটকের অন্যান্য চরিত্র অথবা পাঠকদের কাছে এঁদের ক্রিয়াকলাপ, সংলাপ এবং সিদ্ধান্ত শিক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এমনই একটি চরিত্র ‘ঠাকুরদাদা’। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন নাটকে এঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। ‘শারদোৎসব’ নাটকেই প্রথম ঠাকুরদাদা চরিত্রের প্রকাশ। পরবর্তী সময়ে ‘রাজা’ নাটকে ঠাকুরদা, ‘অচলায়তন’-এ দাদাঠাকুর অথবা ‘ডাকঘর’-এ ঠাকুরদা রবীন্দ্র ভাবনার প্রকাশে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে।

‘রাজা’ নাটকে ঠাকুরদা বলেছিল যে “রাজা আমাদের সবাইকেই রাজা করে দিয়েছে।…আমাদের রাজা নিজে জায়গা জোড়ে না, সবাইকে জায়গা ছেড়ে দেয়।” আর এই কথার অনুষঙ্গেই ছিল ঠাকুরদা-র গান- “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।” বৃহত্তর অর্থে এ কি এক সামাজিক-রাজনৈতিক শিক্ষা নয়? আর ‘ডাকঘর’ নাটকে ঠাকুরদা অমলকে বিশ্বাসের এক মনোভূমিতে পৌঁছে দিয়েছিল। “চুপ করো, অবিশ্বাসী, কথা কয়ো না”- নাটকে ঠাকুরদার এই শেষ সংলাপ এক অসামান্য কথন তৈরি করে। আমার মনে হয় ঠাকুরদার এই সংলাপে ভর করেই বুঝি এরপরে সুধা আসে। অমলকে যে সে ভোলেনি সেই আশ্চর্য কথাটুকু তাকে জানিয়ে দিতে।

এভাবেই রবীন্দ্র নাটকে রাজা, সন্ন্যাসী, বাউল অথবা কবি চরিত্রকে ব্যাখ্যা করা যায়। ‘শারদোৎসব’ নাটকে রাজা বিজয়াদিত্য সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশ ধারণ করে বলেছিলেন- “রাজা হতে গেলে সন্ন্যাসী হওয়া চাই।” বস্তুত এই চরিত্ররা এমন কিছু কথা বলেন, কোন সংকটময় মুহূর্তে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেন যেন এক মহত্তর বৃহত্তর সমাধানের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। তাঁরা সংকীর্ণতাকে ভাঙেন, পথ দেখান, রুদ্ধ দ্বার উন্মুক্ত করেন এবং সর্বোপরি নতুন করে ভাবতে শেখান। বৃহত্তর অর্থে এ কি শিক্ষকেরই কাজ নয় ?

‘বসন্ত’,’ঋণশোধ’ প্রমুখ নাটকে কবি বলেছিলেন রাজার প্রকৃত সংজ্ঞা, বুঝিয়েছিলেন রাজকার্য কথাটির প্রকৃত অর্থ। আর ‘রথের রশি’ নাটকে কবির অমোঘ বক্তব্য মহাকালের রথ তথা মানবসভ্যতার ইতিহাসের অচল রথ সচল করে তুলতে পারে এতদিন ধরে শোষিত, নিপীড়িত শূদ্ররাই, এই সমাজ রাজনৈতিক ভাবনাও কি বৃহত্তর অর্থে সর্বজনীন এক শিক্ষা চিন্তা নয় ?

এই আলোচনায় আমাদের মনে পড়ে রাজা নাটকের সুরঙ্গমার কথা, দাসী সুরঙ্গমা, সুদর্শনাকে বলেছিল যে রাজা সুন্দর নয়। আর সুন্দর নয় বলেই এমন অদ্ভুত, এমন আশ্চর্য। “তুমি দেখব দেখব করে যে অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে রয়েছ সেইজন্যে কেবল দেখবার দিকেই তোমার সমস্ত মন পড়ে রয়েছে। সেইটে যখন ছেড়ে দেবে তখন সব আপনি সহজ হয়ে যাবে।” এই সত্য মনের গভীরে গ্রথিত হয়েছিল বলেই তো বাইরের সৌন্দর্যে রাজাকে খুঁজতে চাওয়া সুদর্শনা একদিন বহু দুঃখ কষ্টের তপস্যা পেরিয়ে রাজাকে বলতে পেরেছিল- “তোমাকে তেমন করে দেখবার তৃষ্ণা আমার একেবারে ঘুচে গেছে। তুমি সুন্দর নও প্রভু, সুন্দর নও, তুমি অনুপম।” বাহ্যিক সৌন্দর্য পেরিয়ে রূপাতীতে পৌঁছানোর এই শিক্ষা বোধকরি সুদর্শনা প্রথম পেয়েছিল সুরঙ্গমার কাছ থেকেই।

‘বিসর্জন’ নাটকে প্রবল প্রতাপান্বিত রাজা গোবিন্দমাণিক‍্য এবং রাজপুরোহিত রঘুপতি উভয়েই দিশা খুঁজে পেয়েছিলেন অপর্ণার কাছে। অপর্ণার ছাগশিশুর হত্যার রক্তচিহ্ন মন্দিরের সোপান গাত্রে দেখে এবং অপর্ণার কাতর প্রশ্নে গোবিন্দমাণিক‍্য তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মন্দিরে বলি বন্ধ করার। কোন প্রতিকূলতাই তাকে টলাতে পারেনি এই সিদ্ধান্ত থেকে। আর নাটকের শেষে, জয়সিংহের আত্মহননের পরে নিঃস্ব, রিক্ত সর্বহারা রঘুপতি শেষ আশ্রয় পেয়েছিলেন অপর্ণার কাছে। মন্দির ছেড়ে বেরিয়ে এসে অপর্ণার মধ্যে তিনি দেখেছিলেন প্রত্যক্ষ প্রতিমাকে। দেখেছিলেন প্রকৃত জননীকে। ভিখারিণী অপর্ণার পথই তাই এই নাটকের শেষ গন্তব্য হয়ে উঠেছে।

এইভাবেই শিক্ষা সম্বন্ধীয় রবীন্দ্রভাবনার নানা অনুষঙ্গ ছড়িয়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন নাটকে। এই সব সূত্রকে একসাথে করলে হয়তো আদর্শ এক শিক্ষকের রূপরেখা অথবা শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক আমাদের কাছে পূর্ণতা পাবে।

ফটোগ্রাফি আদতে কি?

     

তপেশ‌ মুখার্জি

হটাৎ করে ফটোগ্রাফি নিয়ে কিছু লেখার একটি আমন্ত্রণ পেলাম একটি অনলাইন পত্রিকা “ভাণ পত্রিকা”থেকে। সুযোগ হারাতে চাইলাম না,যদিও সেরকম মাপের চিত্রগ্রাহক আমি নই।যাক আর কথা না বাড়িয়ে আসল লেখায় ফিরি।ফটোগ্রাফারদের আর্টিস্ট হিসাবে চিত্রশিল্পীরা সেরকম আমল দেয়না।কিন্তু ফটোগ্রাফি একটা ক্রিয়েশন,শিল্পের মধ্যেই পরে।চিত্রগ্রাহক তার ক্যামেরার ফ্রেমের মধ্যে তার ক্রিয়েশন তৈরি করে।কিছু ক্ষেত্রে দু-তিনটে ফ্রেমের সাহায্যে এক নতুন ফ্রেম করে,এক অসামান্য চিন্তাধারা প্রয়োগ করে।সেটাও কিন্তু একটি বিশাল ক্রিয়েশন।

ফটোগ্রাফিতে অসাধারণ ফ্রেম আর সাধারণ ফ্রেম বের করে আনাটাই হচ্ছে আসল ক্রিয়েশন।সেখানেই বিচার হয় একজন ফটোগ্রাফার ও একজন ভালো শিল্পীর। প্রযুক্তিগত ক্যামেরা এখন এমন হয়ে গেছে যে একটি মানুষ যে ফোটোগ্রাফি জানে না,সেও কিছু ফ্রেম আনতে পারবে কিন্তু সেটাকে কি ফটোগ্রাফি বলে?একদম না।ওটাকে সুভিনিয়ের ক্যাচ বলা উচিত।প্রচুর মানুষ বেড়াতে গিয়ে বা অনুষ্ঠান বাড়িতে মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে অনেক ছবি তুলছে।কিন্তু ওটাতে তার কোনো চিন্তাশক্তি প্রয়োগ নেই শুধুমাত্র যা ভালো লাগছে ক্লিক করছে।

আসল ফটোগ্রাফি হলো একটি ফ্রেমে একজন ফটোগ্রাফার কিছু গল্প দেখিয়েছেন বা কিছু সাধারণ চোখে ধরা পরেনি কিন্তু ফটো ক্লিকে ক্যান্ডিড মুডে এক অসামান্য মুড এসেছে।

একটি সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য পাহাড়,সমুদ্র,নদী বা যে কোনো সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ,একটি সুন্দরী মেয়ের মুখ,এগুলো একটি লেন্সের মধ্যে ধরে একটি ফ্রেম।বিশেষ কোনো ক্রিয়েশন নেই,যদিও আজকাল এডিটিংয়েই সব ফ্রেমকে সাংঘাতিক আকর্ষিত করে সাধারণ মানুষকে,কিন্তু ভাল চিন্তাশীল ফ্রেম হয় না।দেখা যায় প্রথম দেখেই একটা উচ্ছাস বের হয় তারপর আর ছবিটা নিয়ে বেশি ভাবে না।

কিন্তু অতি সাধারণ প্রেক্ষাপটে চিত্রগ্রাহকের চিন্তাশক্তি দিয়ে যে ফ্রেম বের হয়,সেটা যারা দর্শককে ছবিটা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে সেখানেই একটি ফটোগ্রাফার শিল্পের সত্তা উঠে আসে।

ফ্রেম হবে এমন যেটা দেখে,ভালো বলবে না,খারাপ বলবে না,কিন্তু উপেক্ষা করতে পারবে না।তখনই হবে এক ফটোগ্রাফারের আসল কৃতিত্ব,এক শিল্পের সৃষ্টি।

   

লোকশিল্পের নান্দনিকতা

   

স্বর্ণালী দত্ত

‘লোক’ শব্দটা একটা ছোট্ট শব্দ হলেও অর্থ এর অনেক বিস্তৃত। এই ‘লোক’কে কোনো বিশেষণে জোড়া যায়না। বড় লোক, ছোটলোক, ভদ্রলোক, মন্দলোক, মোটালোক, খাটোলোক এইরকম কোনো লোক নিয়ে ‘লোকসমাজ’ নয়। এই ‘লোক’ কোনো একজন নয়, একটা সমষ্টি, একটা গোষ্ঠী বা দল। এদের মধ্যে একটা সমন্বয় আছে, বাঁধন আছে। এই ‘লোক’রা একই রকম আনন্দ করে, একই রকম তাদের প্রকাশ, অভিবাদন। এরা যুগ যুগ ধরে একই ঐতিহ্যবাহী। ফলে এদের আলাদা এক মধুর সংস্কৃতি আছে যা এদেরকে বৃহত্তর সমাজ থেকে আলাদা করেও সেই সমাজের সঙ্গেই আবার একাত্ম করে দিয়েছে।

লোক-সমাজের সংস্কৃতিগত এই আনন্দ-পরিতৃপ্তির উদাহরণ কোনো না কোনো অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। কারণ কোনো অনুষ্ঠান বা কার্য-কারণ ছাড়া কোনো লোকশিল্প নেই। মানে এই দাঁড়ায় যে, ‘লোক’ তার অভ্যেস বশতই শিল্প তৈরি করে, এটা তার দৈনন্দিন কাজের মধ্যেই পড়ে। এটা একদিকে যেমন তার সমাজের অনেকের জন্য, অনেকের সঙ্গে তাকে করতে হয়, তেমনই তিনি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে ঐ সকল সামাজিক প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠানের অংশীদার। সুতরাং কথা এই যে লোকশিল্প সামাজিক প্রয়োজনে কিম্বা ধরা যাক ব্যক্তিগত সৌন্দর্যচেতনার কারণে যাই হোক না কেন, তা সর্বজনীন এবং সমাজের সকলেই তা রস উপলব্ধি করে। লোকশিল্পের মজাটা হল, এখানে হুবহু অনুকরণের জায়গা নেই। শিল্পীর মনের গভীরে যে সহজ সরল ভাব ও গুন লুকনো থাকে তাই প্রকাশ পায় তার শিল্পে। ফলে মন অনুযায়ী লোক শিল্প আলাদা হতে থাকে। সৃষ্টিতে, সৌন্দর্যে, রসে এক একটি শিল্প আলাদা আস্বাদ নিয়ে আসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় কোনো ধর্মীয় বিষয়ে, অনুষ্ঠানের নিয়মে, বিশ্বাসের বাঁধনে, কৃতজ্ঞতায় এই শিল্পের প্রকাশ ঘটে। শুরু হয় খুব সাধারণ চাওয়া-পাওয়া দিয়ে কিন্তু শেষ হয় এক তূরীয় আনন্দে।

লোকশিল্প বিভিন্নভাবে, বলা ভালো বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ পায়। প্রথমেই বলতে হয় ‘আলপনা’র কথা। লোকশিল্পে ‘আলপনা’ খুব গুরুত্ব পায়। মানুষের মনের ইচ্ছা পুজ্য দেবতার সামনে এই আলপনা দিয়ে তুলে ধরা হয়। ঘরের মেঝে, দেয়ালে বা উঠোনে পিটুলীর গোলা দিয়ে তৈরি হয় নানান নকশা। আলপনা দিতে দিতে মেয়ে-বউরা ছড়া কাটে – “ আমি আঁকি পিটুলির গোলা/আমার হোক ধানের গলা।/আমি আঁকি পিটুলির বালা/আমার হোক সোনার বালা ” ( সেঁজুতি ব্রত)। লক্ষ্মী পুজোর আলপনায় লক্ষ্মীর পা, ধানের গোলা, ধানের শীষ, পেঁচা আজও অটুট আছে। পদ্ম, সূর্য, নানা ধরনের লতার মোটিফ আলপনায় সবসময় ব্যবহার হয়। লতার মধ্যে শঙ্খ, কলসি, খুন্তি; বিভিন্ন কলকাজাতীয় নকশা আলপনায় আলাদা মাত্রা এনে দেয়। শহুরে জীবনে অভ্যস্থ আমরা নিজেদের ‘নাগরিক’ আর ওদের ‘প্রান্তিক’ বলে আলাদা করলেও আমাদের মধ্যে এই ‘সো কল্ড’ – ‘প্রান্তিক’ টানটা রয়েই গেছে। আসলে আমরাতো এই মাত্র তিনশ-সারে তিনশো বছর হল নগর তৈরি করেছি, তাও ধীরে ধীরে। আমাদের শিরায় বয়ে চলেছে গোবিন্দপুর-সুতানুটি গ্রাম। তাই জন্যই বাড়ির পুজো হোক বা বারোয়ারী, উৎসব হোক বা বিয়ে, আলপনা আমদের শিকড়ের টানে নাড়া দেয়। অজান্তেই এঁকে ফেলি সেই পদ্ম, ধান, লতা, কলকা আরও কতকি। কিছুদিন আগে একটা প্রেজেন্টেশানে দেখলাম, কলকাতার এক নামি রেস্তোরায় দেয়ালের বিমে আঁকা হয়েছে ‘খুন্তিলতা’ মোটিফ। জেনেও ভালো লাগল, আমাদের সেই আদি ঐতিহ্য লোকশিল্পের সঙ্গে আমাদের নাগরিক মনের বাঁধনকে মজবুত করতেই স্থাপত্যশিল্পীর এই প্রয়াস।

লোকশিল্পের আর একটা উদাহরণ খুব উল্লেখযোগ্য, তা হল ‘উল্কি’। ‘উল্কি’ চিহ্ন শরীরে ফুটিয়ে তোলা সারা বিশ্ব জুড়ে প্রচলিত আদিম রীতি। একসময় এই ‘উল্কি’ ছিল মানুষের অস্তিত্বের পরিচয়। তারা কোন গোষ্ঠীর লোক সেই চিহ্ন ছিল উল্কি। এখন বিবর্তনের মাধ্যমে উল্কি হয়েছে ট্যাটু। এই ট্যাটুর কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নেই। ফলে নিজের নাম, পরিবারের নাম, প্রিয় কোন লেখা, ফুল, পশু, ব্যক্তি থেকে শুরু করে কৃষ্ণের বাঁশি, ময়ুর পালক সবই বলা চলে মডার্ন ‘উল্কি’র নকশা। আমরা তো এই ‘উল্কি’কে খুব আদরে গ্রহণ করেছি স্টাইল হিসাবে ; অতীতকে না জেনেই আধুনিক হওয়ার ঢঙে।

শিল্পীদের তৈরি মাটির ঘোড়া, কাঠের পেঁচা, পট চিত্র, নকশা পাখা, ডোকরার জিনিস সবই আমাদের সফিস্টিকেটেট বৈঠকখানার শোভা বর্ধন করতে অগ্রগণ্য। সারা বছরই এদিক ওদিক মেলা হচ্ছে, পাওয়া যাচ্ছে বাংলা জুড়ে লোকশিল্পীদের তৈরি করা নানান সামগ্রী। তার মধ্যে থেকেই আমরা ঘরে নিয়ে আসছি ‘মাটির ঘোড়া’। ঘরের কোণে সাজিয়ে রাখছি। অতিথিরা দেখছে আর বাহবা দিচ্ছে। আমরা জানতেই পারছিনা এই ঘোড়াকে আসলে ‘ছলন পুতুল’ বলা হয়। দেবতার বাহনের প্রতীক। ‘লোক’রা দেবতার থানে ( যতদূর সম্ভব ধর্মঠাকুরের কাছে) এই মাটির ঘোড়া দিয়ে আর্জি জানিয়ে যায় যাতে দেবতার আসল ঘোড়া তার ঘর-সম্পত্তি পাহারা দেয়। এরপরেই আমরা পছন্দ করি পেঁচাকে । মানে পেঁচার পুতুল (বর্ধমানের নতুন গ্রাম এর তৈরি), এই পুতুলের ডিজাইন দিয়ে সোফাসেট, মোড়া; পেঁচার মোটিফ দেয়া শাড়ী ইত্যাদি ইত্যাদি। এই পেঁচাও তো আঁকা হতো মাঙ্গলিক অর্থে, কিন্তু আমরা একে নিয়ে এসেছি অর্থ-মুক্ত করে শুধু মাত্র সৌন্দর্য বাড়াতে। ডোকরার জিনিসও তাই। শিল্পী তৈরি করেছে তার কোনো এক ঐতিহ্য মাথায় রেখে কিন্তু আমারা গ্রহণ করেছি নিজেদের ভালোলাগা ও ভালবাসা দিয়ে। পটের একটা আলাদা গল্প আছে। পুরাণের গল্প, মঙ্গলকথা, মনসার ভাসান, কৃষ্ণকথা এইসব পটে এঁকে পালাগানে দেখানো হয়। আমরা খুব সহজেই ঘরের দেয়ালের অবস্থানটা একবার ভেবে নিয়ে মানানসই পট চিত্র কিনে এনে লাগিয়ে দি। তেমনই পছন্দ করি পালা গানের লোকচিত্র, অরলি আর্ট বা মধুবনী লকচিত্রে আঁকা শাড়ী, টিশার্ট, পাঞ্জাবী, চাদর, ওড়না, টেবিল ক্লথ। কোনটায় আঁকা বিয়ের গল্প, চাষের কাজের গল্প, দৈনন্দিন কথন, আবার কোনটায় আঁকা মাৎস্যন্যায়ের মতো কঠিন বিষয়।

এই লোকশিল্পগুলির লোকগোষ্ঠীর মধ্যে একটা অর্থ আছে, আগেই বলেছি যে এগুলি প্রধানত কোন অনুষ্ঠানের সূত্রে তৈরি হয়েছে। কিন্তু শহুরে আভিজাত্যে যখন সেটাকে গ্রহণ করছে বা ‘রিসাইকেল’ করছে তখন সেটা তার পুরনো কার্য থেকে মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। নতুন কোন কার্যতে যুক্ত হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। তবে এই বেড়িয়ে আসার ফলে লোকশিল্প তার রূপ বদলাচ্ছে। বলা যায়, কিছুটা যুগের তালে আবার কিছুটা পেটের দায়ে। লোকশিল্পের মধ্য দিয়ে আমাদের জীবনে যে অতীতচারিতা বা আদি মন কাজ করে, যে সরল আনন্দের অনুভূতি পাই্‌, তা ঐ ‘লোক’দের ‘জীবনানন্দ’। আসলে তাদের সঙ্গে আমাদের মূল সংযোগটা তো এক। শিল্প তৈরি, কেনা-বেচায় শিকড়ের প্রতি টানই সাড়া দেয়। তাই লোকশিল্প এখন আর কোনো নির্দিষ্ট জায়গার হয়ে সীমাবদ্ধ নেই। শহরের সংস্কৃতি, নান্দনিক মন একে বৃত্তের বাইরে নিয়ে এসেছে। তৈরি হয়েছে ‘মিক্সড ফোক’-এর কনসেপ্ট। তথাকথিত এলিট সমাজের ঘরগুলি, (বিশেষ করে ঐ বৈঠকখানার কথা বলেছিলাম একেবারে শুরুতেই) এগুলো সুন্দর করে সাজচ্ছে সব রকমের, সব জায়গার লোকশিল্প দিয়ে। কারণ, লোক সংস্কৃতির এমন একটা সুরকরণ আছে, মায়া , দৃশ্যপট আছে, যার মধ্য দিয়ে আমাদের অনেকদিনের স্মৃতি আমাদের বর্তমানকে ধাক্কা দেয়। তার জন্যই আমরা একে আমাদের শহুরে নন্দনতত্ত্বে সহজেই অন্তর্ভুক্ত করতে পারছি।

অতিমারী ও বাংলা থিয়েটার

   

সস্মিত চক্রবর্তী

এক পচে যাওয়ার সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা সবাই। এই সংকটের সময় ভালো কি সত্যিই আছি আমরা!! যদি পাশের মানুষের মুখের দিকে তাকাই তাহলে সবটাই ফ্যাকাশে লাগে। আলোয় আলোকিত মুখগুলো এখন অন্ধকারের অতলে পরে থাকা করুন মুখ গুলোর মতই হয়ে আছে।থিয়েটারও এর বাইরে নয়। এই অতিমারির বাউন্সার প্রায় সবার শরীরেই ধাক্কা খেয়েছে। গোটা পৃথিবীর থিয়েটার এই বাউন্সার সহ্য করতে পারেনি। থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অনেক মানুষ অন্য ভাবে বাঁচার চেষ্টা করছে। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। যাই হোক এই নিয়ে বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয় আমি সেইসব দিকে আমিও খানিক পা বাড়াচ্ছি। এই অতিমারি আমাদের শিখিয়েছে পাশের মানুষকে স্পর্শ করো না দূরে থাকো, কিন্তু থিয়েটার করতে করতে আমি জেনেছি থিয়েটার আসলে একটা স্পর্শের কথা বলে। অভিনেতার সঙ্গে অভিনেতার। অভিনেতার সঙ্গে দর্শকের। আলোর সাথে মঞ্চের। রূপসজ্জার সঙ্গে মিউজিকের। বহুকাল আগে প্লেগ নামে এক অতিমারি মানুষকে এক ইয়র্কারের সম্মুখীন করেছিল। তখনও থিয়েটার তার নিজের ভঙ্গিতে ডিফেন্স করেছে। থিয়েটারের মত একটা আর্ট কে সহজে আউট করা যায় না। কিন্তু কথা হচ্ছে এই অতিমারির আগে কেমন করে ব্যাটিং করছিলাম আমরা। মাসে হাত খরচা থেকে কোনমতে ১০০ টাকা জমিয়ে নাটক দেখতে যেতাম। আসলে কিছু নতুন দেখার লোভে হয়তো দেখতে যেতাম। কিন্তু যখন নতুন কিছু দেখতে পেতাম না কিংবা একটা অন্য মুহূর্ত দেখতে পেতাম না তখন বড্ড হতাশ লাগতো। আমার শিক্ষকরা শিখিয়েছেন যে ভালোর সঙ্গে খারাপটাও তোমায় দেখতে হবে, শিখতে হবে কারণ ওই ভুলটা যাতে আমি না করি। ধীরে ধীরে খারাপের সংখ্যাটা একটু একটু বাড়তে লাগলো। তা বলে কি ভালো থিয়েটার হচ্ছে না , হচ্ছে তো। তবে সংখ্যায় খুব কম। আর আমাদের সমাজে যার সংখ্যা বেশি তাকেই গণ্য বলে মনে করি। আমার একটি লেখা দিয়ে খানিক আমার কথা বোঝানোর চেষ্টা করছি।

কথোপকথন – ১০

– পুর্ণেন্দু পত্রী

– কাল বাড়ি ফিরে কী করলে?

– কাঁদলাম। তুমি?

– লিখলাম।

– কবিতা? কই দেখাও।

– লিখেই কুচিকুচি।

– কেন?

– আমার আনন্দের ভিতরে অনর্গল কথা বলছিল আর্তনাদ

আর্তনাদের ভিতরে গুনগুন গলা ভাঁজছিল অদ্ভুত এক শান্তি

আর শান্তির ভিতরে সমুদ্রের সাঁইসাঁই ঝড়।

যে সব অক্ষর লিখলেই লাল হওয়ার কথা

তারা হয়ে যাচ্ছিল সাদা।

যে সব শব্দ সাদা কাশবন হয়ে দুলবে

তাদের মনে হচ্ছিল শুকনো পাতার ওড়াউড়ি।

বুঝলাম সে ভাষা আমার জানা নেই

যার আয়নায় নিজের মুখ দেখবে ভালোবাসা।

– তাই বলে ছিঁড়ে ফেললে?

– বাতাস থেকে একটা অট্টহাসি লাফিয়ে উঠে বললে পিদিমের সলতে হয়ে আরো কিছুদিন পুড়ে খাক হ। পুড়ে খাক হ।

এই যে কবিতা এটা পড়ে আমি খানিকক্ষণ চুপ ছিলাম। কেন ছিলাম জানিনা কিন্তু ছিলাম। এই সংলাপ কি আমায় চুপ করে রেখেছিল। তাও জানিনা। আমি বলছি যে প্রায় বেশিরভাগ থিয়েটারের পারফর্মেন্স শেষে আমি এরকম চুপ থাকি না। হল থেকে বেরিয়েই হাহা হিহি করে চা খাই। মেট্রো ধরি। ফোন দেখি। ঘুমিয়ে পরি। আবার কোন পারফরম্যান্স দেখে এমনও হয়েছে যে সেই রাতে ঘুমোতে একটু কষ্ট হয়েছে। কিন্তু ওই যে সংখ্যাটা কম। আবার আমি এমনও দেখেছি যে দুইদলের মানুষ আছে একদল যারা ইউরোপিয়ান থিয়েটার বা প্রসেনিয়াম থিয়েটার দেখতে ভালোবাসেন আরেকদল ইন্টিমেট থিয়েটার বা ফোক থিয়েটার দেখতে ভালোবাসেন। আমি মনে করি এই দুই আর্টফর্ম কিন্তু ওই স্পর্শের কথা বলে অভিনেতার সঙ্গে দর্শকের। যাইহোক আমি এই দ্বন্দ্বতে যাচ্ছি না যে কোনটা শ্রেষ্ঠ। আমার কাছে দুটোই থিয়েটার। এই দিনের পর দিন খারাপ থিয়েটার হয়ে যাওয়ার এক বিরাট কারণ হলো রাজনীতি। তোষামোদের রাজনীতি। পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি। যা দিনের পর দিন ধরে থিয়েটার কে আঘাত করে চলেছে। আসলে আমরা সবটাই বুঝি। জানি। কিন্তু কিছু বলি না। চুপ করে থাকি।কথা বললেই হয়তো নম্বর কাটা যাবে। হয়তো এই লেখা লিখতে গিয়ে আমিও খানিক ভয় পাচ্ছি আমার নম্বর কাটার।

        

কিছুদিন আগে একটা ফেসবুক পোস্ট যেটা দেখে আমি খানিক চমকে গিয়েছিলাম। শ্রী আলোক দেবনাথ। যিনি তাঁর তুলির টানে একজন অভিনেতাকে চরিত্রে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। তিনি তার কাছে থাকা কিছু উইগ বিক্রি করবেন। হয়তো এই উইগ পরে কেউ হয়েছেন রাজা।মন্ত্রী।ভিখারি।কতটা খারাপ সময় গেলে এরকম একটা কাজ করতে হয় একজন শিল্পী কে। এইটাতো হওয়ার কথা ছিল না। কোন রুপো কাঠি স্পর্শ করলে আবার ম্যাজিক ঘটবে,সব নতুন হবে সেও আমি জানি না।

একজন ছাত্র হিসেবে আমার শুধু একটা কথাই বলার যে এই অতিমারির পরে মানুষজনকে আরো অনেক থিয়েটারমুখী করে তুলতে হবে। যাতে আর কোনো অতিমারি আমাদের আর আঘাত করতে না পারে। কারণ আমি বিশ্বাস করি ভালো থিয়েটারে মানুষ হল ভরিয়ে দেন। আর সেই থিয়েটার আমরা গোগ্রাসে দেখবো। সবাই হয়তো ভাবছেন যে আমি খামোখা কেন চারটি খারাপ কথা বললাম। আবার এইটাও খাঁটি সত্যি যে থিয়েটার না থাকলে হয়তো আমি আজ এই লেখাটা হয়তো লিখতে পারতাম না।প্রেমিকাকে ভালোবাসি বলেই তো প্রেমিকাকে নিয়ে বলা যায় তাই না।

ক্ষতি হয়েছে সিনেমার

   

অজন্তা সিনহা

তাঁর সিনেমা ছিল কবিতার মতোই সৎ, সুন্দর, স্বচ্ছ ও বলিষ্ঠ। কবি তো ছিলেনই তিনি। অত্যন্ত শক্তিশালী এক কবি ও আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা নির্মাতার মেলবন্ধন ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিচিত্র মানুষের যাপন টেনেছে তাঁকে বারবার। সেলুলয়েডে সেই জীবনযাপনকেই চিত্রিত করেছেন। শেষের কয়েকটি বছর খুব বেশি আলোচনায় ছিলেন না তিনি। তার কারণ শুধুই কি তাঁর অসুস্থতা ? বলতে দ্বিধা করা উচিত নয়, পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত যে ঘরানার ছবি নির্মাণ করতেন, সেটা দেখার দর্শক ও পরিবেশ দুইই ক্রমশ বিরল হয়ে পড়ছিল, বিরল হয়ে পড়েছে।

     

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

এমনকী আমরা, যারা তাঁর তৈরি সিনেমা দেখতে দেখতে সেলুলয়েডে একেবারে ভিন্নমাত্রার গল্প (নাকি কাব্য !) লেখার স্বতন্ত্র ধারাটি বুঝতে শিখলাম, তারাও কি ঠিক বুঝেছিলাম তাঁকে ? তিনি তো আমাদের সময়ের পরিচালক। আমরাও কি বলিনি, ‘তিনি শুধু পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য সিনেমা বানান ? সাধারণ দর্শকের জন্য বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি নয় !’ ওঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা প্রসঙ্গে যাবার আগে, এইটুকু স্বীকারোক্তি না করলে কালের কাছে অপরাধী থেকে যাব। সেই কাল, যা নির্মম ও কঠিন এক সত্যদ্রষ্টা। যার কাছে কিছুই লুকোনো থাকে না। আমরা, এই বাঙালি জাতি যে চিরকাল ভাবের ঘরে চুরি করে এসেছি, আমরা আদতে এক চরম পর্যায়ের আত্মপ্রবঞ্চক, সে কথা এই মহান পরিচালক সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আরও একবার স্মরণে এলো।

আমার সাংবাদিক পেশায় আমি একবারই তাঁর মুখোমুখি হই। তার আগে বিভিন্ন ছবির প্রিমিয়ারে বা সাংবাদিক সম্মেলনে দূর থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তথাকথিত ভাবে খুব জনপ্রিয় মানুষ ছিলেন না, সেটা যেমন ঠিক ! তেমনই তাঁকে খুব দাম্ভিক ও নাক উঁচু বলে কেউ কেউ যে চিহ্নিত করার চেষ্টা করতো, সেটাও সর্বৈব মিথ্যে। তাঁর কাছে পৌঁছবার পর সহজেই অনুভব করি একথা। আদ্যন্ত শিক্ষিত, সভ্য, স্নেহপ্রবণ একজন মানুষ তিনি। এটা ঠিক মেধা ও শিক্ষার একটা ধারালো দিক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মধ্যে ছিল। আর আমি সেটা স্বীকার করে নিয়েই তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াই, যথাসম্ভব হোমওয়ার্কের পর। আজও মনে আছে, সিনিয়র সিনেমা সাংবাদিক নির্মল ধরের কথা। উনি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের বহুকালের বন্ধু। নির্মলদা ওঁর সম্পর্কে নানা তথ্য দিয়ে আমাকে খুব সাহায্য করেন সেদিন। কোনও দিনই বিষয়ের বাইরে প্রশ্ন ক’রে গুণী মানুষজনকে উত্যক্ত করা আবার ধাতে ছিল না। এক্ষেত্রেও সেভাবেই তৈরি হয়ে গেলাম।

মজার কথা হলো, আমার এপয়েন্টমেন্ট যিনি করে দেন, তিনি সিনেমা জগতের কেউ নন, একজন তরুণ কবি। কবিতার সূত্রেই আমার সেই ভাইটি প্রায় নিয়মিত যেত পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের বাড়ি। এক ব্যস্ত বিকেলে তার সঙ্গেই পৌঁছে গেলাম ওঁর দক্ষিণ কলকাতার ফ্ল্যাটে। আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধদেববাবুর আসন্ন মুক্তি প্রতীক্ষিত ছবি ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ !

বহুকাল আগের কথা। যতদূর মনে পড়ছে, প্রথমেই আমরা কথা বলি, ছবির প্রেক্ষাপট বিষয়ে। সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায়ের লেখা ছোট গল্পটিকে চিত্রনাট্যে রূপ দেন পরিচালক। লতি নামের এক কিশোরী, যার মা একজন পতিতা। মেয়েকে নিয়েও ব্যবসা করতে চায় সে। কিন্তু লতি চায় এক অন্য জীবন। মা তাকে এক প্রবীণ ধনীর সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়। লতি বিদ্রোহী হয় ও পালিয়ে যায় বাড়ি থেকে। সিনেমার গল্পের বিস্তারে না গিয়ে গল্প প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কথাই বলবো, “লতির লড়াইয়ের ইচ্ছেটাই আমাকে টেনেছিল। একটা অসম যুদ্ধ সে লড়তে চাইছে। প্রফুল্লবাবু প্রতিটি চরিত্রকে এমন রক্তমাংসের করে লিখেছেন এখানে…!”

     

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

সাহিত্যানির্ভর ছবিই বেশিরভাগ নির্মাণ করেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “সাহিত্য হলো জীবনসম্পদের খনি। এমন অনেক যাপনের সন্ধান এখানে পাই, যা অভিনব, অজানা, বিচিত্র…সর্বোপরি মনস্তাত্বিক দিক থেকে খুব আকর্ষণীয়। ছবি তৈরি করার ফাঁকে স্টাডি করারও দারুণ একটা সুযোগ মেলে।” সেদিন কথায় কথায় তাঁর সাহিত্যপ্রীতি, গভীর ও ব্যাপ্ত পড়াশোনার এক অনন্যসাধারণ পরিচয় পেয়েছিলাম। কতটা সমৃদ্ধ হই, সেকথা বলার প্রয়োজন পড়ে না। মনে পড়ছে, ঘন্টা কেটে গেছে। নির্ধারিত সময়ের কথা ভুলে বলে চলেছেন তিনি। নিজের জ্ঞানের পরিধি জানাবার জন্য নয়। অকৃত্রিম আবেগে। আর সঙ্গে খুব সুন্দর করে চা-পান। কথাটার উল্লেখ এই জন্য করলাম, নিজের মতোই আমাকেও চা-বিলাসী পেয়ে শিশুর মতো খুশি হতে দেখেছিলাম ওঁকে। সেখানেও পরিপাটি এক শিল্পরস যেন ঘিরেছিল তাঁকে।

ছবিতে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, তাপস পাল, প্রদীপ মুখার্জি, সুদীপ্তা চক্রবর্তী, জুন মালিয়ার মতো তারকা অভিনেতা ছিলেন। কিন্তু তাঁদের নিয়ে নয়। আমি কথা বলেছিলাম মুখ্যত দুজনকে নিয়ে, এক, লতির চরিত্রে সমতা দাস। দুই, নটবর পালধির চরিত্রে রামগোপাল বাজাজ। সমতা সেই সময় বাংলা টেলিভিশনের এক অতি উজ্জ্বল মুখ। লতির জন্য তাঁকে নির্বাচন যে একশোভাগ সঠিক ছিল, একথা বলার সময় বুদ্ধবাবুর মধ্যে এক অসাধারণ উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করেছিলাম। একজন নতুন অভিনেতাকে গড়েপিঠে নেওয়ার মধ্যে এক যথার্থ সৃজনশীল পরিচালকের যে তৃপ্তিটা হয়, সেটা লুকোননি তিনি সেদিন। বলেছিলেন, “সমতা হতাশ করেনি আমায়। অত্যন্ত ক্ষমতাশালী এবং বাধ্য। পরিশ্রম ও প্রতিভায় অনেক দূর যাবে ও দেখবেন !” সমতা এমন এক ব্রেক পাওয়ার পর কতদূর গেছে বা যায়নি, সে আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। তবে, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’-এ তিনি আমাদের আশাহত করেননি, সেটা নিশ্চিতরূপে বলা যায়। ছবির জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্তির একজন অংশীদার তিনিও।

     

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

রামগোপাল বাজাজকে নিয়ে আমি ঠিক বিপরীত প্রশ্ন করেছিলাম। আমাদের এখানে কি চরিত্রাভিনেতার অভাব ? ওঁকেই কেন ভাবলেন পরিচালক ! এ প্রশ্নের জবাবে ওঁর বক্তব্য, “আমি এর আগেও ভিনরাজ্যের অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করেছি। তাঁরা প্রত্যেকেই গর্বিত করেছে আমায়। রামগোপাল একজন অত্যন্ত শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ থিয়েটার ব্যক্তিত্ব। হিন্দিছবিতে আমি ওঁর কাজ দেখেছি। নটবর পালধি চরিত্রে ওঁকেই আমার সবচেয়ে উপযুক্ত মনে হয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, এমন একজনকে চাইছিলাম, যে নিজেকে প্রবলভাবে ভাঙতে সক্ষম। আমি একেবারেই টিপিক্যাল ভিলেন চাইনি।” পরবর্তীতে ওঁর কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার প্রাক্তন অধিকর্তা রামগোপাল বাজাজ নটবরকে জীবন্ত করে তোলেন মেধা, প্রতিভা, শিক্ষা ও চেতনার গুণে ।

ছবির সংগীত, পোস্টার ডিজাইন থেকে অন্যান্য দিক, সব নিয়েই কথা হয় সেদিন। প্রত্যেকটি বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ও পারদর্শিতা নতজানু করবে আমার মতো এক তুচ্ছ সাংবাদিককে, সেটাই স্বাভাবিক। এরইসঙ্গে বিশ্ব সিনেমা বিষয়ে তাঁর পড়াশোনা প্রায় গবেষণার স্তরে। সেই সময়, যখন সিনেমার বহির্বিশ্ব মানে শুধুমাত্র কয়েকটি উৎসব। সেদিন ওঁর এই তথ্যভান্ডারের খবর মুষ্টিমেয়র কাছেই থেকে গেছে। আপামর মানুষের দরবারে পৌঁছয়নি, সে আমাদেরই ব্যর্থতা। আমরা যে চিরকাল সস্তা বিনোদনে বিশ্বাসী, সিনেমা বাণিজ্যের চলাফেরার মানচিত্রটা সে কথাই বলে।

সেই সস্তা লোভ ও লাভের তাগিদেই দর্শক ভালো সিনেমা পরিত্যাগ করে অবাস্তব ও মেকি রঙে রঙিন সিনেমা দেখতে হলে ছোটে। এই আজ-কাল-পরশুর গল্পে প্রায়ই আমরা এই জাতীয় শিক্ষিত পরিচালকদের দোষ দিই এই বলে যে, ওঁরাই আসলে জনমোহিনী ছবি বানাতে পারেন না । তাই ওঁদের ছবি দর্শকধন্য নয়। কিন্তু মনে মনে সত্যিটা সবাই জানি। একটি চক্র, যারা শিক্ষা, প্রতিভা, মেধা, সুস্থ ও জীবনধর্মী চিন্তার একেবারে বিপরীতে হেঁটে শুধু নিজেদের মুনাফা দেখে। এদের স্বার্থে একশ্রেণীর প্রযোজক, পরিচালক, ডিস্ট্রিবিউটর থেকে মিডিয়া কাজ করে। এরাই সুচতুর ভাবে আম জনতার মাথাটা সিনেমা সম্পর্কে গুলিয়ে দেয়। আক্ষেপ, এতে ক্ষতিটা সেইসব সৃজনশীল মানুষের হয়নি। তাঁরা সৃষ্টিসুখে তাঁদের কাজ করে গেছেন। নিজেদের বিশ্বাসে অটল থেকেছেন। ক্ষতি হয়েছে সিনেমার। আজ যে বিশ্বের, এমনকী এশিয়ারও ছোট ছোট দেশগুলি ভালো সিনেমা নির্মাণে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে গেছে, তার কারণ এটাই।

‘সেক্স এডুকেশন ‘( ওয়েব সিরিজ) নিয়ে কিছু কথা।

   

অন্বয় গুপ্ত

– ‘ক’বার লাগিয়েছিস? ‘

ভারতবর্ষের কথা বাদ দিচ্ছি। আমাদের বাংলার ছেলেপিলেরা যখন স্কুল, কোচিং সেন্টার কিংবা কলেজে পড়ে, বন্ধুবান্ধবদের চক্রে এই প্রশ্নটা তাদের হারহামেশাই ফেস করতে হয়।

সেই দলের মধ্যে কয়েকটা শ্রেণি থাকে-

এক, যাদের যৌনতা নিয়ে প্রচুর অভিজ্ঞতা। সেটা আছে বলে মনে করে একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছে। ক্যান্সারের প্রতিষেধক আবিষ্কার করে ফেলার মতো যেন তাদের কৃতিত্ব। অনভিজ্ঞদের কাছে কথায় কথায় বারফট্টাই করে তারা।

দুই, নিয়মিত যৌনতা প্র‍্যাকটিস করে করে তাদের আলো, আগুন, উৎসাহ কোথাও গিয়ে যেন নিভে গেছে। চেরাপুঞ্জির মেঘ সাহারায় নিয়ে না এলে চলবে না।

তিন, এক দলের যৌনতা নিয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। বলা ভালো সুযোগ এবং সাহস নেই। তাদের মধ্যে কেউ সেটাকে পরিস্থিতির উপর ছেড়ে দিতে পারে, কেউ প্রচন্ড ‘শিঙি’ ( horny র বাংলা) হয়ে তক্কে তক্কে থাকতে পারে।

আরও একটা বিষয়ে গৌরচন্দ্রিকা করে নিই। এ বিষয়ে আমি নিজেও বেশ কিছুটা কনফিউজড। অসামান্য প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও ইউরোপীয় ছবিতে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত থেকেছেন কৃষ্ণাঙ্গ এবং এশিয়ানরা। তার মধ্যে গোটা বিশ্ব সরব হয়েছে নারীর অধিকার, সমকামিতা বিভিন্ন সেন্সিটিভ ইস্যু নিয়ে। সেইজন্যই মনে হয় ইদানিং যা যা ওয়েব সিরিজ কিংবা সিনেমা দেখছি, তাতেই এই বিষয়গুলোর ছড়াছড়ি। কখনো কখনো অতি আরোপিতও মনে হচ্ছে। যেন আওয়াজ উঠেছে বলেই দেখানো হচ্ছে। যে বিষয়টা অত্যন্ত প্রাকৃতিক আর স্বাভাবিক, সেটাই জোর করে বলে দিতে হচ্ছে। উপরে যে এক নম্বর দলের কথা বললাম,যেন তাদের মতোই।

মারভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সে তাই কৃষ্ণাঙ্গ আর এশীয়দের ছড়াছড়ি। পিটার পার্কারের প্রিয় বন্ধু এশিয়ার, টনি স্টার্কে প্রিয় বন্ধু রোডি কৃষ্ণাঙ্গ, ক্যাপ্টেন আমেরিকা তার ঢাল তুলে দেয় কৃষ্ণাঙ্গ বন্ধু স্যামের হাতেই – বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে এটা একটা বড় বার্তা। ক্যাপ্টেন মারভেলের সহযোদ্ধা মারিয়া র‍্যাম্বো কৃষ্ণাঙ্গী। নিক ফিউরি, ব্ল্যাক প্যান্থার অ্যান্ড কোং এর কথা তো ছেড়েই দিলাম।

ছোটবেলায় যখন প্রচুর পরিমাণে ম্যানড্রেক আর অরণ্যদেব পড়েছি, সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্রগুলোর প্রতি ভালোবাসা খুব স্বাভাবিকভাবেই এসেছিল। লোথার, কার্মা, লামান্ডা লুয়াগা, কর্ণেল ওয়োরুবু – অনেকেই।

এবার ‘ সেক্স এডুকেশন’এ ফিরি। সেখানেও অলিভিয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত, তার পার্টনার ইরানি, এরিক – ওলা-জ্যাকসন গুরুত্বপূর্ণ একেকটা চরিত্র কৃষ্ণাঙ্গ।

এই সিরিজ নিয়ে প্রচুর প্রশংসা শুনেছি। কিন্তু গোটা লকডাউনে আমি এই সিরিজ দেখার সুযোগ পাইনি। দেখেছি অনেক পরে। এই বছরের জানুয়ারি মাসে শেষ পর্যন্ত সিরিজটা দেখি। দেখার আগে ভেবেছিলাম যৌনতায় ভরা আর মোটাদাগের রসিকতা ছাড়া আর হয়তো কিছু নেই। বড়জোর ‘ আমেরিকান পাই’ কিংবা ‘এইটিন ইয়ার্স ওল্ড ভার্জিন’ এর চকচকে একটা সংস্করণই হবে। কিন্তু না, আমার সেই ভুল ভাঙলো। এই ওয়েব সিরিজ যৌনতার শিক্ষা ছাড়াও আরও অনেক অনেক কিছু। একইসঙ্গে হাসায় এবং মনখারাপ করে দেয়।

আমাদের ছোটবেলার আবেগ, বন্ধুত্ব,ঈর্ষা, প্রতিযোগিতা সবকিছুকে স্পর্শ করে যায় এই সিরিজ।

মজার বিষয় হ’ল এই সিরিজে কেন্দ্রীয় চরিত্র বলে কাউকে দাঁড় করানো মুশকিল। প্রত্যেকেই একেকটা উপন্যাস।

তবুও সিরিজের কেন্দ্রে আছে মেভ উইলি নামের সপ্তদশী এক স্কুলগার্ল। এখানে আরও কয়েকটা কথা বলতেই হবে।

স্কারলেট জোহানসন তাঁর কেরিয়ারের গোড়া থেকেই একের পর এক বয়সে অনেকটাই বড় অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করে এসেছেন। এক ইন্টারভিউতেও তিনি বলেছিলেন সমবয়সী ছেলেদের তাঁর ভ্রাতৃতুল্য মনে হয়। তাঁর আসল পছন্দ বয়সে বড় আর অভিজ্ঞ পুরুষদের।

মেরিলিন মনরোও ঠিক সেটাই পছন্দ করতেন।

মেয়েদের ম্যাচিয়োরিটির তুলনা হয় না। বয়ঃসন্ধির বয়সে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ম্যাচিয়োরিটি অনেক বেশি থাকে। আমার গাদা গাদা বান্ধবীকে দেখেছি ঘন ঘন পার্টনার বদলাতে। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা এতটাই বেশি ছিল যে সহজভাবে মিশতে কিংবা কথাবার্তা বলতেই বাধো বাধো ঠেকত। কম ম্যাচিয়োরড ছেলেদের কাচ্চাবাচ্চা মনে করে তাচ্ছিল্য করত তারা।

মেভ উইলির ছোটবেলা এবং বেড়ে ওঠাটাই অত্যন্ত ডিস্টার্বড। তার বাবার ঠিক নেই, মা বোহেমিয়ান। একের পর এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর একেকটা অবৈধ সন্তানের মতো মেভেরও কোনো খোঁজখবর রাখেন না। মেভের ভাই লোফার, ড্রাগখোর। সেও ফেরার। একা একটা মোটেল ভাড়া করে মেভকে থাকতে হয়। ভাড়া দেওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে কখনো দোকানে অস্থায়ী কর্মচারীর কাজ করে , কখনো অনেক অপ্রিয় কাজ করে তাকে উপার্জন করতে হয়। গোটা স্কুল তার জন্য পাগল। যৌনতার ক্ষেত্রে মেভ খোলামেলা। তাকে নিয়ে স্কুলে চালু কথা হ’ল সে পেমেন্টের জন্য সবার বিছানাতে যায়।কিন্তু তারও পছন্দ অপছন্দ আছে – সহজলভ্য নয়। তার উদ্দামতার সঙ্গে সবাই পাল্লা দিতে পারে না। মেভ ‘ নো স্ট্রিং অ্যাটাচড’ এ বিশ্বাসী। যতখুশি যৌনতা করো কিন্তু প্রেম ট্রেম পোষায় না৷ কারণ প্লেটোনিক প্রেম হতেই পারে না।

জীবনের প্রতি সে বীতশ্রদ্ধ। বুঝে গেছে টিকে থাকার একমাত্র উপায় ধান্দাবাজিই।

পুরুষতন্ত্রকে সেকেন্ডে সেকেন্ডে বিদ্ধ করে মেভ।

গোটা সিরিজের সবচেয়ে অসাধারণ আর মানবিক চরিত্রগুলোর মধ্যে মেভ উইলি একজন। সে ঈর্ষাকাতর নয়, বরং মানবিকতা থেকে অপছন্দের মানুষের জন্যও জান লড়িয়ে দেয়। এক ক্লাসমেট অন্য ক্লাসমেটের যোনির ছবি ভাইরাল করে দিয়ে সেটা মেভের বলে প্রচার করলেও বিপদের সময় নিজের জীবন বিপন্ন করে মেভ তাকে সাহায্য করে। পরে আসল সত্যি বেরিয়ে পড়লে সারা স্কুল যখন সেই ক্লাসমেটকে টিটকিরি দিতে থাকে, মেভ সদর্পে উঠে দাঁড়িয়ে বলে ‘ এটা আমারই যোনি।’ তার মা তাকে জন্ম দিয়ে জীবনটা নরক বানিয়ে তুলেছে বলে জন্মদিনকে দে ঘৃণা করে।

কিন্তু মেভের জন্মদিনেই আরেক সহপাঠিনীর গায়ে ভিড় বাসে এক কামুক বীর্য ছুঁড়লে সে বিষয়টাকে চাপা দিতে বলে কিন্তু তাকে সঙ্গে করে থানায় নিয়ে যায় মেভ।বলে সেটাই তার জন্মদিনের উপহার হোক।

ঘটনাচক্রে স্কুলের অন্যতম ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী এই মেভ-ই। তার সাহিত্যের বোধ, জেনারেল নলেজ, লেখার হাত দুর্দান্ত। স্কুলের প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় ফি বছর যে যে প্রবন্ধ পুরস্কার জিতত, পয়সার বিনিময়ে অন্যের হয়ে সেসব আসলে মেভেরই লিখে দেওয়া।

স্কুলের সাহিত্যের শিক্ষিকা একমাত্র তার প্রতিভাকে চিনতেন। সবসময় লেগে থেকে তাকে উৎসাহ দিতেন।

একদিন মেভের মা ফিরে আসেন নতুন এক সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে।মেভের আরেক বোন।

কেন্দ্রীয় চরিত্র বলা যায় ওটিস মিলবার্নকেও। ওটিস নিরীহ। সেই দলে যারা এখনো ভার্জিন।স্কুলে সে কথা সে লুকিয়ে চলে, তবুও অনেকে ধরে ফেলে। তারও ছোটবেলা অত্যন্ত ডিস্টার্বড। তার মা-বাবা দুজনেই নামকরা মনোবিদ এবং সেক্স থেরাপিস্ট। মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার ট্রমা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তার মা ড. মিলবার্ন খুবই খোলামেলা। তিনি যেচে ছেলেকে যৌনতার টিপস দিতে যান, তার বন্ধুদের সঙ্গে বসে নেশা করেন,একের পর এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে শরীর আদানপ্রদান করেন,তারপর সম্পর্ক রাখেন না । ছেলেকে পর্যবেক্ষণ করে তিনি বয়ঃসন্ধি নিয়ে থিসিস লেখেন।

তাঁর অত্যধিক স্মার্টনেসে হীনম্মন্যতায় ভোগে ওটিস। তার মনে হয় তার ব্যক্তিগত পরিসরে মা বড্ড বেশি ঢুকে পড়ছেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে বড্ড একা ওটিসের মা। ছেলেই তাঁর পৃথিবী। কিন্তু ওটিস সবসময় তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। স্কুলে অবাধ যৌনসংসর্গের ফলে যৌনরোগ ছড়িয়ে পড়লে যৌন শিক্ষিকা এবং বিশেষজ্ঞ হিসেবে ওটিসের মা’কেই নিয়োগ করা হয়।

যৌনতায় অনভিজ্ঞ আর ভীতু হ’লেও ওটিসের ম্যাচিয়োরিটি খুবই ভালো।বয়স অনুযায়ী তার কথাবার্তা বিজ্ঞের মতো। সে সবাইকে সুন্দরভাবে মোটিভেট করতে কিংবা গুছিয়ে ভালো পরামর্শ দিতে পারে। ক্লাসের নামকরা ব্যাড বয় অ্যাডাম একবার অনেকগুলো ভায়াগ্রা খেয়ে ফেলায় তার লিঙ্গ প্রচন্ড সংবেদনশীল আর বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। স্রেফ কাউন্সেলিং করে তাকে সেই অবস্থা থেকে উদ্ধার করে ওটিস। ওটিসের এই গুণ চোখে পড়ে যায় মেভের। সে একটা বুদ্ধি ঠাউরে ফেলে। ওটিসের সঙ্গে মিলে একটা ব্যবসা চালু করে। স্কুলের কেউ যৌন সমস্যায় পড়লে টাকার বিনিময়ে তাকে সেক্স অ্যাডভাইস দেবে ওটিস।ক্লায়েন্ট যোগাড় করবে মেভ। আধাআধি বখরা।

একসময় গভীরভাবে মেভের প্রেমে পড়ে যায় ওটিস। কিন্তু তার মনে হতে থাকে তাকে ব্যবহার করছে মেভ। মেভের গর্ভপাত করাতে যাওয়ার সময় পাহারাদার হিসেবে, দুর্বৃত্ত ধরতে সঙ্গী করে কিংবা বেবিসীটার হিসেবেও ওটিসকে কাজে লাগায় মেভ।জল অনেক দিকে গড়িয়ে যায়। ওটিসের মা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন কল মিস্ত্রী জ্যাকবের সঙ্গে। তাঁর মেয়ে ওলার সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়ে ওটিস।

গোটা সিরিজ জুড়ে দুর্দান্ত সব চরিত্রের ছড়াছড়ি।

ওটিসের প্রাণের বন্ধু কৃষ্ণাঙ্গ এরিক। দিলখোলা, প্রাণোচ্ছ্বল, উপকারী একটা ছেলে। সে ঘোষিত সমকামী, তাই নিয়ে সে গর্বিত।

তার সঙ্গে ওটিস ছাড়া স্কুলের অন্যান্যরা বিশেষ মিশতে চায় না। তার বাড়িতে আছে একগাদা বোন আর রাশভারী বাবা। সে নাস্তিক বলে গীর্জাতেও যায় না। তার নানারকম সাজগোজের জন্য নানাভাবে তাকে হেনস্থা হতে হয়।

ক্লাস ক্যাপ্টেন, স্কুলের গর্ব জ্যাকসন। সে-ও কৃষ্ণাঙ্গ।

সে দুর্দান্ত সাঁতারু। স্কুলকে প্রত্যেকবার প্রাইজ এনে দেয়। তার দুই মা- এক সমকামী দম্পতি। তার গর্ভধারিনী মা ছেলেকে প্রশ্রয় দেন কিন্তু অন্য মা ভীষণ কড়া, প্রচন্ড শাসনে রাখেন ছেলেকে। তাঁর প্রত্যাশার চাপে হাঁফিয়ে ওঠে জ্যাকসন। ইচ্ছে করে নিজের হাত ভেঙে ফেলে যাতে সাঁতার এড়ানো যায়। মেভ তার সঙ্গে পাগলের মতো একাধিকবার সেক্স করে কিন্তু জ্যাকসন চায় মেভ তার গার্লফ্রেন্ড হোক।চায় তারা একসঙ্গে সিনেমায় যেতে, ঘুরতে।কিন্তু মেভ বাঁধা পড়তে রাজি নয়।কাজ মিটে যাওয়ার বাইরে আর কোনো সম্পর্কে সে যাবে না। জ্যাকসন ধীরে ধীরে আমাদের ছোটবেলার পাগলামি গুলোকে ছুঁয়ে ফেলে। সে মেভকে ‘ পটানো’র জন্য তার প্রিয় সমস্ত বই পড়া শুরু করে। তার পছন্দগুলো জেনে সেসব চর্চা করতে থাকে। এমনকি ওটিসকে টাকা দিয়ে বলে মেভকে পটিয়ে দিতে।

দশ বছর আগে হ’লেও ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণ ভাবে একটা প্রধান চরিত্র ‘সাদা’ মানুষের সঙ্গে ‘কালো’ মানুষকে জুড়ে দেওয়া হত কিনা প্রশ্ন, এখানে সুস্পষ্টভাবে মেসেজ দেওয়া হয়েছে।

মহাভারতে যেমন যেকোনো চরিত্রকে কেন্দ্রে রেখে সেখান থেকে মহাভারত পড়া যায়, তেমনি এখানেও সবার সমান্তরালে রাখা হয়েছে অ্যাডামের চরিত্রকে।

অ্যাডাম স্কুলের ‘ ব্যাড বয়।’ ঘটনাচক্রে সে স্কুলের হেডমাস্টারের ছেলে। তার জন্য বার বার মুখ পোড়ে তার বাবার। তার গায়েও খুব জোর। সহপাঠীদের নানাভাবে সে উত্যক্ত করে, গুন্ডামী করে, মেয়েদের উপর হিংস্রভাবে জোর খাটায়। কিন্তু বাড়িতে সে কেঁচো। তার বাবা প্রচন্ড কড়া শাসনে তাকে রাখেন। বাড়ি ফিরে তাকে মোবাইল জমা দিয়ে দিতে হয়। একদিকে ‘ হেডুর ছেলে ‘ আর প্রচন্ড রোবোটিক কড়া শাসন, অন্যদিকে কুখ্যাতি আর বিরাট আকারের পুরুষাঙ্গের জন্য আলোচনায় থাকা – এই তিনটে বিষয় অ্যাডামকে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ফেলে দেয়। সে

আরও ঘেঁটে যায়। কেউ তাকে ভালোবাসে না।

গোটা সিরিজ জুড়ে প্রচুর অসাধারণ দৃশ্য আছে। গর্ভপাত করানোর সময়কার দৃশ্য, ক্যুইজে ইগো ঝেড়ে সবাই মিলেমিশে লড়াই করা,প্রত্যেকের সঙ্গে যা যা যৌন হেনস্থার ঘটনা ঘটেছে সেসব শেয়ার করা, মেভের সঙ্গে তার মায়ের সেকেন্ড সিজনের শেষের দৃশ্য, ওলা আর অ্যাডামের দৃশ্য,জ্যাকসনের সঙ্গে তার ব্লন্ড মমের দৃশ্য- আরও অনেককিছুই।

হাসতে হাসতে যেমন পেটে খিল ধরে যাবে, তেমনি মন ভারিও হয়ে উঠবে।

গোটা সিরিজের প্রত্যেকের অভিনয়ই অসাধারণ। মেভের ভূমিকায় এমা ম্যাকি, ওটিসের ভূমিকায় আসা বাটারফিল্ডের কথা তো ছেড়েই দিলাম। এরিকের ভূমিকায় এনকুটি এফিয়ং, হেডমাস্টারের ভূমিকায় অ্যালিস্টার পেত্রী, ড. জিন মিলবার্নের ভূমিকায় গিলান অ্যান্ডারসন, সবাইকে ধরে ধরে ‘ আমার সঙ্গে সেক্স করবে? ‘ বলা দুর্দান্ত ইলাস্ট্রেটর আর নাট্যদলের পরিচালিকা লিলির ভূমিকায় তান্যা রেনল্ডস, মাতাল মজার শিক্ষক জিম হেন্ড্রিক্সের ভূমিকায় জিম হাউয়িস, অ্যাডামের ভূমিকায় কনর সুইনডেলস দুর্দান্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *